সৌভিক চক্রবর্তী
আমাদের গ্রামটা ছবির মতো সুন্দর৷ গ্রামের নাম লেবো৷ মাসাইতে লেবো শব্দের মানে হল, জঙ্গলে যার জন্ম৷ একদম ঠিক কথা, পাহাড়ের ওপর জঙ্গলে ঘেরা আমাদের গ্রাম৷ পাহাড়টা কিন্তু খুব উঁচু না৷ এর চেয়ে ঢের উঁচু পাহাড় আমি দেখেছি৷ তবু এই পাহাড়টার নাম কইনেত, মানে সবার চেয়ে লম্বা! কেন কে জানে! কইনেতের সব চেয়ে উঁচু পাথরটার ওপর দাঁড়ালে চোখে পড়ে একটা বিশাল সাদা পাহাড়ের চুড়ো৷ পাহাড় বলা ভুল, ওটা পর্বত৷ সারা বছর সেখানে বরফ জমে থাকে৷ দাদু বলেছে, ওর নাম কিলিমাঞ্জারো৷ পেছনে ফিরলেও আর একটা পাহাড়৷ ওই পাহাড়ের নাম ওল দইনো লেঙ্গাই, মানে ঈশ্বরের পাহাড়৷ ওটা আগুনপাহাড়৷ তাই মাঝে মাঝেই পাগলা হয়ে যায় ওল দইনো লেঙ্গাই৷ তখন তার পেটের ভেতর থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসে কমলা রঙের লাভা৷ সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়৷ যদিও সেই আগুনের নদী আমাদের গ্রাম পর্যন্ত আসে না, তবু ঈশ্বরের পাহাড় খেপে উঠলে আমরা সবাই হাঁটু মুড়ে প্রার্থনা করতে বসি৷
আমরা মাসাই৷ মাসাইরা খুব ভাল যুদ্ধ করতে পারে৷ তবে আমাদের গ্রামের লোকেরা এখন আর যুদ্ধ করে না৷ আমরা পাহাড়ের ঢালে চাষ করি, জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ, পাতা, মধু আর লাক্ষা নিয়ে আসি৷ সে সব নিয়ে সপ্তাহে একদিন করে আমরা মালাম্বো যাই৷ মালাম্বোয় হাট বসে৷ আমাদের গ্রামটা বড়ই একটেরে তাই সব চেয়ে কাছের শহর মালাম্বো যেতে পায়ে হেঁটে পাক্কা দু’দিন সময় লাগে৷ দাদু বলেছে, মালাম্বোর পূর্বে সেরেঙ্গাটির জঙ্গল আর পশ্চিমে বিশাল নাত্রোন হ্রদ৷ আমি আর দাদু নাত্রোনের কাছ অবধি গেছি কিন্তু সেরেঙ্গাটি যাইনি কখনও৷ বড় হলে যাব৷ আমার নাম সিরোঙ্কা৷ সিরোঙ্কা মানে পবিত্র৷ আমার মা-বাবা নেই৷ আমি দাদুর সঙ্গে থাকি৷ দাদু লেবো গ্রামের মোড়ল৷ দাদুর নাম লেমাইয়া, মানে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য৷
স্বপ্নের মতো দিন কাটছিল৷ সারাটা দিন আমি পাহাড়ে, জঙ্গলে টইটই করে বেড়াতাম৷ সন্ধে হলেই মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে দাদুকে গোল করে ঘিরে বসে পড়ত গ্রামের সবাই৷ দাদু তখন গল্প বলত৷ যুদ্ধের গল্প, ভূতের গল্প, রাজপুত্র-রাজকন্যার গল্প, আরও কত কী৷ দাদুর কোলের মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম৷ বড় আরাম৷ কিন্তু হঠাৎ একদিন সব ওলটপালট হয়ে গেল৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা ঘরছাড়া হয়ে গেলাম৷
*****
আসল কফি বিন থেকে তৈরি কফি একটু চটচটে হয়৷ খাওয়ার সময় জিভে জড়িয়ে জড়িয়ে যায়৷ সিন্থেটিক কফিতে এই মজাটা থাকে না৷ কফিটা খেতে ভালই লাগছে তবু ভুরু কুঁচকে কফিমগে চুমুক দিচ্ছিলেন মিস্টার ওয়েনার৷ সকালের এই সময়টা তাঁর একা থাকতে ভাল লাগে৷ সকালবেলা হল চিন্তার জন্য প্রশস্ত সময়৷ সকালবেলা কিছু ভাবলে পরে সেটা কাজে লাগাতে সুবিধে হয় কিন্তু এখানে আসার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও একা থাকতে পারছেন না তিনি৷ সারাক্ষণ নানা রকমের ঝামেলা লেগেই রয়েছে৷
পাহাড়ের ওপরে একটা হোটেল বানানোর ইচ্ছে তাঁর বহু দিনের৷ বছর দশেক আগে একবার সেরেঙ্গাটি বেড়াতে এসেছিলেন৷ তখনই এক বন্ধু তাঁকে আইডিয়াটা দিয়েছিল৷ এক সন্ধের আড্ডায় সে কথায় কথায় বলেছিল, ‘ইদানীং তানজানিয়ার এই অঞ্চলটায় প্রচুর পর্যটক আসে কিন্তু থাকার মতো তেমন ভাল হোটেল নেই৷ সবই মধ্যবিত্তদের জন্যে৷ বড়লোকেদের জন্যেও একটা হোটেল থাকা দরকার৷’
সোজা হয়ে বসেছিলেন মিস্টার ওয়েনার৷ বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘তোমার কি মনে হয় সত্যি এমন একটা হোটেল দরকার?’
‘অবশ্যই দরকার৷’
‘বেশ তা হলে হোটেলটা আমিই বানাব৷’
‘তুমি কি সিরিয়াস?’
‘আমাকে কোনও দিন তুমি ফালতু কথা বলতে শুনেছ?’
‘না৷’
পাহাড়ের ওপর জঙ্গলে ঘেরা ‘পৃথিবীর নির্জনতম সাততারা হোটেল’ বানানোর জন্য জলের মতো পয়সা খরচ করছেন মার্কিন শিল্পপতি ফ্রেডরিক ওয়েনার৷ কিন্তু মাত্র কয়েকটা অসভ্য জংলির জন্য কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন৷ তানজানিয়া গভর্নমেন্ট হোটেল বানানোর জন্য কইনেত নামের এই পাহাড়টাই বেছে দিয়েছিল৷ তারা বলেনি যে পাহাড়ের ওপর জঙ্গলের মধ্যে লুকনো একটা গ্রাম আছে৷ শুধু তারাই নয়, তিনি যাদের রেইকি করতে পাঠিয়েছিলেন ফিরে এসে তারাও কিছু বলেনি৷ সবাই আসলে ফাঁকিবাজ৷ সব কটাকে গুলি করে মারতে পারলে শান্তি হত৷ আর জংলিগুলোও তেমন জেদি আর বোকা৷ টাকার লোভ দেখানো হয়েছে, পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে দেওয়া হয়েছে, ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা সত্ত্বেও পাহাড়ের নীচে দল বেঁধে বসে আছে৷ কিছুতেই নড়ছে না৷ ‘আরে বাবা তোদের তো আর এমনি এমনি চলে যেতে বলা হচ্ছে না, রীতিমতো টাকা দেওয়া হচ্ছে৷ তা হলে তোরা যাবি না কেন? কী মধু রয়েছে এই নির্জন জঙ্গলে? শহরে গেলে কত রকমের কাজ পাওয়া যায়৷ সে সব করবে না, জংলি হয়ে থাকবে৷ যত অপদার্থের দল৷’ মিস্টার ওয়েনার বিরক্ত হন৷ এ বার এই ছবি মিডিয়ার কাছে পৌঁছে গেলে তখন আর এক অশান্তি হবে৷ তিনি হাঁক দিলেন, ‘রিকার্ডো৷’
রিকার্ডো তাঁর ম্যানেজার৷ সে কাছেপিঠেই ছিল৷ ছুটে এসে দাঁড়াল, ‘ইয়েস স্যার৷’
‘ওদের সঙ্গে আর কথা বলেছ?’
‘হ্যাঁ স্যার বলেছি৷ ওরা কোনও কথা শুনতে চাইছে না৷ বলছে, প্রাণ থাকতে কইনেত পাহাড় ছেড়ে কোথাও যাবে না৷’
‘বেশ৷ তা হলে এ বার আমাকে প্রাণ নিয়েই টানাটানি করতে হবে৷ অনেক সুযোগ দিয়েছি, বাবা বাছা করেছি৷ কিন্তু আর না৷ ওদের বলে দাও, সাত দিনের মধ্যে এলাকা ফাঁকা না করলে আমি মেশিনগান নামাতে বাধ্য হব৷ কয়েকটা ডার্টি জংলি মরলে আমার কিস্যু এসে যাবে না৷ বডিগুলো নাত্রোনের জলে ফেলে দেব৷ কাকপক্ষীও জানতে পারবে না৷ বুঝেছ?’
‘ইয়েস স্যার৷’
*****
যে গাছগুলো কাটা হবে সেগুলোর গায়ে আগের দিন সাদা রঙের দাগ দেওয়া হয়৷ প্রতি বর্গমিটার হিসেব করে পাহাড়ের ওপর জঙ্গল পরিষ্কার করতে হচ্ছে৷ বিরাট বিরাট গাছকাটা করাত আর বুলডোজার সারাদিন সারারাত কাজ করে চলেছে৷ গাছ বলি ছাড়া সভ্যতা গড়া সম্ভব না৷ শ্রমিকেরা এন্তার ছোট হরিণ আর বুনো শুয়োর শিকার করছে৷ পাখিগুলোর অবস্থা তো আরও খারাপ৷ এত পাখি এখানের গাছে যে একটা গুলি করলেই দশটা পাখি মরে৷ একটা গুলিতে আর বাকিগুলো ভয়ে৷ আগুন জ্বালিয়ে সেই সব মাংসের কাবাব করা হচ্ছে৷ টিনের খাবারে এখনও হাত দিতে হয়নি৷ দিতে হবে বলে মনেও হয় না৷
রিকার্ডোর বাড়ি পর্তুগালের ফঞ্চল শহরে৷ বড় সুন্দর শহর৷ তাদের বাড়িটাও সুন্দর৷ চারদিকে প্রচুর গাছগাছালি৷ রিকার্ডোর বাবার বাগানের শখ৷ নিজে হাতে ফুল ফোটান তিনি৷ ছোটবেলায় ছুটির দিনে বাবার পাশে বসে গাছের পরিচর্যা করত রিকার্ডো৷ আর এখন সে গাছ কাটার তদারক করে৷ বড় বড় গাছগুলো যখন সশব্দে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তার বুকটা মুচড়ে ওঠে৷ কিন্তু কিছু করার নেই৷ এটা তার চাকরি৷ জীবনে উন্নতি করতে গেলে আবেগ ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই ভাল৷ নয়তো অনেক সমস্যা হয়৷
একা একাই জঙ্গলের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছিল রিকার্ডো৷ হঠাৎই একটা চিৎকার শুনে থমকে গেল৷ সে দেখল, একটা বাচ্চার হাত ধরে একটা বুড়োলোক দাগ দেওয়া গাছগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর মুখচোখ বিকৃত করে চিৎকার করছে, ‘সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখো নুলোর দল৷ হাত নেই, পা নেই নুলো কোথাকার৷ চোখ নেই কানা অন্ধ৷ কথাও তো কইতে পারিস না৷ তোরা বোবা৷ তোদের দেখি আর গা পিত্তি জ্বলে যায়৷ কোন কাজে লাগিস অপদার্থগুলো? কোন কাজে? মর মর৷ বাজ পড়ে মর৷ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যা নিষ্কম্মার দল৷’
রিকার্ডো কিছু কিছু মাসাই ভাষা বোঝে৷ সে অবাক হয়ে গেল, বুড়োটা কি পাগল? গাছেদের যে কেউ গালাগালি দিতে পারে এটা তার ধারণায় ছিল না৷ সে একজন মাসাই গার্ডকে ডেকে পাঠাল৷ গার্ড এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল৷ রিকার্ডো বলল, ‘বুড়োটাকে চেন?’
‘হ্যাঁ স্যার৷ এই গ্রামটার মোড়ল৷ ওর নাম লেমাইয়া৷’
‘এখানে ঢুকতে দিয়েছ কেন?’
‘ও কিছু করে না স্যার৷ শুধু কাঁদে৷ বুড়োমানুষ তাই আটকাইনি৷’
‘কাঁদছে কোথায়? ও তো গাছেদের গালাগাল দিচ্ছে!’
‘হ্যাঁ স্যার৷ এর পর কাঁদবে৷’
‘গাছেদের গালাগাল দিচ্ছে কেন? গাছেরা ওর কী ক্ষতি করেছে?’
‘গাছগুলো তো কাটা পড়বে স্যার ও তাই আগে থেকেই গাছগুলোকে এত গালাগাল দিচ্ছে যাতে ওরা লজ্জা পায়৷ লজ্জায় যেন ওদের মরে যেতে ইচ্ছে করে৷ তা হলে যখন ওদের কাটা হবে তখন ততটাও কষ্ট পাবে না ওরা৷’
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিকার্ডো৷ সে শুনতে পাচ্ছে, বুড়ো কাঁদছে৷ ভীষণ কাঁদছে৷
*****
দাদুকে কাঁদতে দেখলে আমারও কান্না পায়৷ যেদিন থেকে ওরা আমাদের গ্রামটা দখল করেছে সেদিন থেকে দাদু সারাক্ষণ কাঁদছে৷ আমাদের গ্রামটাকে বিদেশিরা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে৷ দেখে বোঝার উপায় নেই যে কয়েকদিন আগে এখানে একটা আস্ত গ্রাম ছিল৷
আমরা সবাই কইনেতের নীচের উপত্যকায় দল বেঁধে বসে আছি৷ বিদেশিদের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি নেই আমাদের৷ ওদের কাছে অনেক বন্দুক আছে৷ আমাদের তো সেসব নেই৷ তবু দাদু বলেছে, দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে আমরা আমাদের নিজেদের জায়গা ছেড়ে নড়ব না৷ এই জঙ্গল আমাদের৷ এই পাহাড় আমাদের৷ বিদেশিদের মধ্যে একটা লালমুখো মোটা সাহেব আছে৷ সবাই তার কথা শোনে৷ সেই সাহেবটাই যত নষ্টের গোড়া৷ আমি তির ধনুক নিয়ে তৈরি হয়ে আছি৷ বাগে পেলেই ওর চোখে তির ছুড়ব৷
বিদেশিরা আমাদের পাহাড়ের ওপর উঠতে নিষেধ করেছিল৷ কিন্তু দাদু শোনেনি, রোজ পাহাড়ে উঠে আসে৷ প্রথমে গাছগুলোকে বকে তার পর হাউমাউ করে কাঁদে৷ আমি আর কী করি, দাদুর সঙ্গে সঙ্গে থাকি৷
দাদু আজও কাঁদছিল৷ আমি একটা পাথরের ওপর বসেছিলাম৷ হঠাৎ আমার পায়ে কুট করে কী যেন কামড়াল৷ উফ! এ তো পিঁপড়ে৷ সার বেঁধে চলেছে৷ এত পিঁপড়ে আমি জীবনে দেখিনি৷ কোথায় চলেছে ওরা? আমি দাদুকে ডাকলাম, ‘দাদু দ্যাখো দ্যাখো৷ কত পিঁপড়ে!’
পিঁপড়ের সারিটাকে দেখে দাদু হঠাৎ সোজা হয়ে বসল৷ কিছুক্ষণ মন দিয়ে ভুরু কুঁচকে পিঁপড়ের সারিটার দিকে তাকিয়ে রইল তার পর চোখ মুছে বলল, ‘আয় তো দাদু৷’
‘কোথায় যাব?’
‘আয় না দেখি, পিঁপড়েগুলো কোথা থেকে আসছে৷’
আমি আর দাদু পিঁপড়ের সারিটার পাশ দিয়ে হাঁটছি৷ অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি৷ গাছপালা আর পাথর টপকে টপকে আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি কিন্তু এখনও পিঁপড়ের সারির উৎসটা চোখে পড়েনি৷ জঙ্গল এখানে বেশ গভীর৷ এটা পাহাড়ের পেছন দিক৷ এ দিকে আমি আগে কখনও আসিনি৷
হঠাৎ আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল দাদু৷ সামনেই পাথরের খাঁজে একটা ছোট্ট গাছ৷ পাম গাছের মতো দেখতে৷ একটা না, পর পর অনেকগুলো আছে৷ ছোট ছোট সাদা ফুল ধরেছে তাতে৷ দাদু দাঁড়িয়ে পড়েছে৷ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে গাছগুলোর দিকে৷ দাদুর চোখ চকচক করছে খুশিতে৷ কী যে হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না৷ দাদু গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেল৷ একগোছা ফুল তুলে নিল হাতে তার পর আচমকা হেসে উঠল৷ অনেক দিন পর দাদুকে হাসতে দেখলাম৷
‘ও দাদু কী হল? হাসছ কেন?’
দাদু আমার হাত ধরে টানল, ‘পরে বলব৷ তুই এখন পা চালিয়ে চল দিকি৷ আমাদের যেতে হবে৷’
‘পিঁপড়ে খুঁজবে না আর?’
‘না আর দরকার নেই৷ তুই চল৷’
‘কেন? চলো না খুঁজি৷’
‘বকাস না আমায়৷ বড় জ্বালাস তুই৷’
‘কোথায় যাব দাদু?’
দাদু উত্তর দিচ্ছে না৷ আপন মনে হাসছে৷
*****
কড়া রোদ উঠেছে কিন্তু গাছের শামিয়ানা থাকায় সেই রোদ চামড়ায় বিঁধছে না৷ একটা বড় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়েছিলেন মিস্টার ওয়েনার৷ তাঁর মুখের ওপর হ্যাট চাপা দেওয়া৷ শুয়ে শুয়ে তিনি হোটেলটার কথা ভাবছিলেন, বড় সুন্দর হবে হোটেলটা৷ পাহাড়ের ওপর আদিম জঙ্গলের মধ্যে এক টুকরো সভ্যতা৷ সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখে পড়বে কিলিমাঞ্জারোর চূড়া৷ দেখা যাবে লেক নাত্রোনের সুনীল জলরাশি৷ আর ওল দইনো লেঙ্গাই খেপে উঠলে তো কথাই নেই৷ নিরাপদ দূরত্বে বসে দেখা যাবে আগ্নেয়গিরির শোভা৷ সেই সময় হোটেলের ভাড়া পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া যাবে৷ ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়৷
জংলিদের গ্রামটা আছে বলে প্রথমে তিনি রাগ করেছিলেন, কিন্তু পরে ভেবে দেখেছেন, এটা থাকায় একটা বড় সুবিধা হয়েছে৷ বেশ কিছুটা জায়গা ওরা আগে থেকেই বসবাসের উপযুক্ত করে রেখেছে৷ অনেকটা খাটনি বেঁচে যাবে৷
হঠাৎই ছুটতে ছুটতে এল রিকার্ডো৷ সে এখনও হাঁফাচ্ছে৷
মিস্টার ওয়েনার উঠে বসলেন, ‘কী ব্যাপার রিকার্ডো? এনিথিং রং?’
‘স্যার ওরা চলে যাচ্ছে৷’
লাফিয়ে উঠলেন ওয়েনার, ‘চলে যাচ্ছে? হোয়াট আ গুড নিউজ৷ কই দেখি৷’
দল বেঁধে পাহাড়ের নীচ থেকে চলে যাচ্ছে লেবো গ্রামের বাসিন্দারা৷ তারা ডেরাডন্ডা তুলে নিয়েছে৷ ওয়েনার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘প্রাণের ভয় একেই বলে৷ তোমায় বলেছিলাম না রিকার্ডো৷ দেখলে তো, মেশিনগানের কথা শুনেই সুড়সুড় করে পালাচ্ছে অসভ্য জংলিগুলো৷ আমার সঙ্গে লাগতে এসেছিল৷ হাঃ হাঃ৷ গুড জব রিকার্ডো৷ ভেরি গুড জব৷ তুমি আর দেরি কোরো না৷ আজই প্লেন ধরো, নিউইয়র্ক চলে যাও৷ অনেক কাজ পড়ে আছে৷’
জিপে করে এয়ারপোর্টের পথে যেতে যেতে রিকার্ডো ভাবছিল, কী এমন ঘটল যাতে হঠাৎ করে চলে গেল গ্রামবাসীরা! সে তো ওদের মেশিনগানের ভয় দেখায়নি৷
দাদু সবাইকে তাড়া দিচ্ছে৷ আজকের মধ্যেই আমাদের কইনেত পাহাড় থেকে অনেকটা দূরে চলে যেতে হবে৷ এত দিনের ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছি৷ আমার মন খারাপ৷ দাদু কিন্তু দারুণ খুশি৷ সে মাথায় গুঁজেছে পাহাড় থেকে তুলে আনা ফুলগুলো৷ আনন্দে সে ছোটদের মতো লাফাচ্ছে৷ আমাদের দলের বাকিরাও খুশি৷ এত দিন যারা মনমরা হয়ে ছিল তারাই এখন গান গাইছে৷ শুধু আমরা ছোটরাই বোকার মতো হাঁটছি৷ আমাদের কেউ কিছু বলছে না৷ আমার রাগ ধরে গেল৷ আমি দাদুর লাঠিটা টেনে ধরলাম৷ বললাম, ‘দাদু, তুমি কি বলবে আমরা কোথায় যাচ্ছি? যদি না বলো আমি আর তোমার সঙ্গে যাব না৷’
আমার রাগ দেখে দাদু হো হো করে হেসে উঠল৷ বলল, ‘রাগ করিস কেন দাদু? বলব তো৷ সবুর কর না৷’
‘না এখনই বলো৷’
‘বেশ বেশ৷ আপাতত আমরা মালাম্বো যাচ্ছি৷ তার পর অন্য কোথাও৷’
‘আমরা চলে যাচ্ছি কেন দাদু? তোমার মন খারাপ হচ্ছে না?’
‘হচ্ছে তো৷ কিন্তু কিছু করার নেই৷ যাঁর ঘরে বাস তিনিই যদি বলেন উঠে যাও তখন তো আর তর্ক চলে না৷ আমরা তো আর ঘরের মালিক নই বাপ৷’
‘আমরা মালিক নই তো মালিক কে? ওই বদমাইশ সাহেবটা বুঝি?’
‘না রে বাপ, ওই পোড়ারমুখোটা মালিক হতে যাবে কোন দুঃখে? ও তো একটা ভুঁইফোঁড় দালাল৷ পয়সার জোরে আমাদের ঘর দখল করেছে৷ কিন্তু এ বার ঘরের আসল মালিক বলে দিয়েছেন, যেতে হবে৷ তাই যাচ্ছি৷’
দাদুর কথাগুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল৷ আমি বললাম, ‘কী বলছ দাদু? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷’
দাদু আমায় নিয়ে পথের ধারে বসল৷ বলল, ‘দাঁড়া তোকে বুঝিয়ে বলি তবে৷ তোর মনে আছে পাহাড়ের ওপর নতুন একটা গাছ দেখেছিলাম আমরা?’
‘হ্যাঁ মনে আছে৷ এই তো সেদিনের কথা৷’
‘ওটা হল হিরেগাছ৷’
‘হিরেগাছ?’
‘হ্যাঁ৷ আমাদের কইনেত পাহাড়ের তলায় হিরে আছে৷ অনেক হিরে৷’
আমার চোখ গোলগোল হয়ে গেল, ‘তার মানে? ওরা হোটেল বানানোর নামে হিরের খনি বানাচ্ছে?’
‘না রে দাদু, ওরা জানেই না এই পাহাড়ের নীচে হিরের খনি আছে৷ অবশ্য জেনেও কোনও লাভ নেই৷ ঘরের মালিক নারাজ হয়েছেন৷ ও হিরে কারও ভোগে লাগবে না৷ হিরে কোথায় পাওয়া যায় জানিস?’
‘না৷’
‘অনেক কাল আগে আমি হিরের খনিতে কাজ করতাম৷ সেখানেই এক সাহেব আমাকে শিখিয়েছিল, আগ্নেয়গিরির যে জ্বালামুখ তার থেকে অনেক শাখা প্রশাখা বেরোয়৷ সেগুলোকে বলে কিম্বার্লাইট পাইপ৷ হিরে জন্মায় শুধু কিম্বার্লাইট পাইপেই৷ আর কোত্থাও না৷ আর ওই যে পামের মতো গাছগুলো, ওরা চিনিয়ে দেয় মাটির তলায় কোথায় আছে সেই অমূল্য পাইপ৷ তাই ওদের নাম হিরেগাছ৷ বুঝলি?’
‘হুঁ৷ কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের চলে যাওয়ার কী সম্পর্ক?’
‘নীচে হিরে থাকার মানে হল, আমাদের কইনেত আসলে আগুনপাহাড়৷ সে এতদিন ঘুমিয়ে ছিল তাই আমরা টের পাইনি৷ ওই পিঁপড়ের দল বুঝিয়ে দিয়েছে যে পাহাড় জাগছে৷ তাই ওরা দল বেঁধে পালাচ্ছে৷ জীবজন্তুরা প্রকৃতির খেয়াল বুঝতে পারে৷ মানুষ পারে না৷ কেন পারে না বল তো?’
‘জানি না৷’
‘প্রকৃতি হল আমাদের ঘরের মালিক৷ সে দয়া করে থাকতে দেয় বলে আমরা থাকি৷ সে লোভ জিনিসটা একেবারে পছন্দ করে না, কিন্তু মানুষ বড় লোভী জাত৷ তাই প্রকৃতি তার মন্ত্রগুপ্তি লোভী মানুষকে দেয়নি, জীবজন্তুকে দিয়েছে৷ ওই সাহেবটা বেশি লোভ করে প্রকৃতিকে চটিয়ে দিয়েছে৷ তার সাজা হবে৷ কঠিন সাজা৷’
দাদুর কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ মাটি কেঁপে উঠল৷ তার পরই ভয়ানক শব্দে কানে তালা ধরে গেল৷ অসংখ্য পাখি ভয় পেয়ে এক সঙ্গে ডেকে উঠল৷ চমকে উঠে আমরা দেখলাম, আকাশটা ধোঁয়ায় ধোঁয়া হয়ে গেছে৷ কইনেতের চুড়োটা আর নেই৷ তার বদলে সেখান থেকে নেমে আসছে আগুনের নদী৷ কী তার রং! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না সেদিকে৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন