অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়
সেদিন ভট্টরাই বিষ্ককে বলল, “সম্রাট এখন কণিষ্কপুরে। সুতরাং প্রশাসনিক ভাবে জাষ্কের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়াও অন্য কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। গূঢ়পুরুষেরা জাষ্কের ওপর কতটা লক্ষ রেখেছে—তা আমাদের অজ্ঞাত। সম্রাট বললেও, তাদের মধ্যে একটি দ্বিধার ভাব রয়েছে বলে মনে হয়। হয়তো তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না আর না হয় তারা জাঙ্কের লোক। কিংবা ভয় পাচ্ছে জাষ্কের ক্রূরতার জন্য। প্রতিশোধ হিসাবে জাঙ্ক তাদের পরিবারের কর্মক্ষম কোনো সদস্যকে মিথ্যা অভিযোগে বন্দনাগারে ফেলে রেখে সেবা করবে। সম্রাটের কাছে আবেদন, নিষ্পত্তি সব সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া নগরাধ্যক্ষ হওয়ার সুযোগে গূঢ়পুরুষেরা অধিকাংশই জাঙ্কের পরিচিত। অন্যদিকে জাঙ্কও জানে যে সম্রাটের এখন যে মানসিক স্থিতি—বুদ্ধকে নিয়ে তিনি যেভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁর পক্ষে সহসা হিউ-পিনানের আত্মীয় জাষ্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া একটু অসুবিধা জনক। সম্রাটকে সতর্ক হয়ে এগোতে হবে। সেই তেজস্বী—দুঃসাহসী সম্রাট আর নেই! তাঁর পরিবর্তন ঘটেছে।”
বিষ্ক বলল, “আমার মনে হয় জাষ্কের পেছনে কোনো শক্তি ক্রিয়াশীল। নইলে জাষ্ক যাই হোক না কেন—এক সামান্য নগরাধ্যক্ষ ছাড়া তো কিছুই নয়। এই বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষের বীজ বপন করা—ইউ-চি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিদ্রোহের ভাব জাগানো—এসব একার কাজ নয়। জাঙ্কের কয়েকজন বিশ্বস্ত সহকারী আছে নিশ্চয়—কিন্তু তারাও যথেষ্ট নয়। তবে কে বা কারা…?”
ভট্টরাই বলল, “একজনকে তো আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি—হিউ-পিনান। বন্থের রাজধানী তা-হিয়ায় বসে তিনি যে কী কলকাঠি নাড়ছেন তা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমরা তো এই তোরণ দ্বারেই আবদ্ধ।”
“আর একটা কথা দেখ, গুপ্তচরেরা জাঙ্কের ওপর দিবাভাগে নজর রাখে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু জাঙ্কের ক্রিয়া কলাপ যে রাতের অন্ধকারেই শুরু হয় তা তাদের জানা নেই বলে আমি মনে করি। তাই গূঢ়পুরুষেরা জাঙ্কের সঙ্গে অন্য কারোর যোগাযোগ আবিষ্কার করতে পারেনি। আমাদের পক্ষেও বা ঐ ভিখারিটার দ্বারাও সেই কাজ সম্ভব নয়। অতএব…!” ভট্টরাই থামল।
“অতএব কী?”
ভট্টরাই বলল, “আমাদের সম্পূর্ণ বিষয়টি মহামিশ্রকে জানানো উচিত। ভিখারিটি আমাদের যা যা বলেছে—তা তাঁর বিবেচ্য। আসল কথা, সে হুং-চা কে কখনই রাত্রে ঐ আগন্তুকের সঙ্গে কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে বসে কথা বলতে দেখেনি। অথচ সে যে প্রায়ই কার্যালয়ে আসত এবং খানিকপরে চলে যেত এ সম্বন্ধে সে নিশ্চিত। তাহলে ঐ আগন্তুক কার সঙ্গে দেখা করত?
দ্বিতীয়ত, হিউ-পিনান সেদিন সকলের বিদায় নেবার অনেক পরে কার্যালয় থেকে বেরিয়েছিলেন—কেন?
ও হ্যাঁ। সেই অভিশপ্ত রাতে শকটে চড়ে হুং-চা আর সেই আগন্তুক বেরিয়ে যাবার পরপরই জাঙ্ক ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছিলেন। কোথায় গিয়েছিলেন জাঙ্ক? আজকাল প্রায় রাত্রেই জাঙ্ক একাকী ঘোড়ায় চড়ে বের হন। কেন তাঁর সঙ্গে অন্য কেউ থাকে না—কোথায় যান তিনি?
এসব ছাড়া সুকান্ত মণিকারের দোকানে আগন্তুকটিকে ধরে আনার ঘটনার সাক্ষী ঐ ভিখারিটি। কিন্তু পরদিনই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়—সম্ভবত তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়নি। অভিযুক্ত হলে সে নির্ভয়ে জাষ্কের কার্যালয়ে নির্ভয়ে আসত কেমন করে? সে হুং-চা-এর মিত্রই বা হয় কী করে?”
ভট্টরাই বলল, “সমস্ত বিষয়টি এখন হাতের মধ্যে রয়েছে। চলুন আমরা এখনই মহামিশ্রের কাছে যাই। সম্রাট নেই। রাজসভা বসছে না। তাঁকে নিশ্চয় আমরা প্রাসাদ-কার্যালয়ে পেয়ে যাব।”
ভট্টরাই আর বিষ্ক যখন মহামিশ্রের কার্যালয়ে উপস্থিত হল, তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। একজন পরিচারক তখন দেওয়ালগিরিগুলি প্রস্তুত করছিল আপনমনে। মহামিশ্র বসালেন বিষ্ক আর ভট্টরাইকে। “কী ব্যাপার? হঠাৎ তোমরা?”
বিষ্ক এক এক করে সমস্ত ঘটনা বলল।
সব শোনার পর মহামিশ্র বলে উঠলেন, “তাহলে ঐ ভিখারিটিই একমাত্র সাক্ষী! বাহ চমৎকার! আগামীকালই আমি ওকে এখানে নিয়ে এসে প্রশ্ন করব। সেরকম মনে হলে তার নিরাপত্তা দেব। সম্রাট দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে আসছেন। তিনি এসে সব শুনে যা ব্যবস্থা নেবার নেবেন। তোমাদের ধন্যবাদ। ঘটনাগুলি সত্য প্রমাণিত হলে প্রশাসন তোমাদের কথা ভুলবে না।”
বিষ্ক আর ভট্টরাই বিদায় নিলে মহামিশ্র উঠে দাঁড়িয়ে অশান্তভাবে পদচারণা শুরু করলেন।—কোথায় যেন দুর্যোগের এক কালো মেঘ!
সেদিন প্রভাতেই মহামিশ্র ঠিক করলেন, ভিখারিটি জাঙ্কের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বা সাক্ষী হিসাবে বিবেচিত হতে পারে—যদি তার বক্তব্যগুলি সঠিক হয়। তার উচিত ছিল গতরাত্রেই তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসা। যা হোক, আজ এখনই তাকে নিয়ে আসবেন তিনি। বিলম্বে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। তাই তিনি শয্যা ত্যাগ করেই নীলাকারকে আদেশ পাঠিয়েছিলেন ভিখারিটি তার পর্ণকুটীর ছেড়ে বেরোবার আগেই যেন তাকে নিয়ে আসা হয়।
নীলাকার এবং ভিখারিটির জন্য কার্যালয়ে অপেক্ষা করছিলেন মহামিশ্র। নীলাকারের সামনেই তিনি তাকে প্রশ্ন করতে চান। সদর্থক হলে নীলাকার ব্যবস্থা নেবে।
নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে উৎকণ্ঠিত হলেন মহামিশ্র। তবে কি ভিখারিটিকে পাওয়া যায়নি? সে কি ভিক্ষাবৃত্তিতে বেরিয়ে গেছে? নগরে তাকে খুঁজে বার করার জন্য সময় লাগার কথা।
একসময় নীলাকার ফিরে এলেন। মহামিশ্র প্রশ্ন করলেন, “কোথায় সে?”
মহামিশ্রের অনুমতি নিয়ে একটি আসনে বসে যেন দম নিলেন নীলাকার। তারপর বললেন, “দুসংবাদ! গতরাত্রে কে বা কারা ভিখারিটিকে হত্যা করে তার পর্ণকুটির গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে।”
“জাঙ্কের অভিমত কী তা জেনেছ?”
“হ্যাঁ। তিনি বা কার্যালয়ের কেউ বিষয়টি নীলাকার আসার আগে জানতেই পারেনি।”
“বিশ্বাসযোগ্য?”
“না। যে ভাবে তার কুটিরটি ভাঙা হয়েছে, তার দেহে একাধিক অস্ত্রাঘাত করা হয়েছে—তাতে শব্দ বা চিৎকার হওয়ার কথা। সামনেই কার্যালয়। সেখানকার প্রহরারত প্রহরীরা কিছু শোনেনি বা দেখেনি তা বিশ্বাস করা যায় না।”
মহামিশ্র গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, “আগামী কালই সম্রাট ফিরে আসছেন। তার আগেই জাঙ্ক তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ লোপ করল! যা হোক তুমি অনুসন্ধান চালিয়ে যাও। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে হয়তো সাপ বেরিয়ে পড়বে। আমার মনে হয় না যে এই হত্যাকান্ড শুধুমাত্র রত্ন-পেটিকা আর দস্যু বাকাটকিকে নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে। পরপর তিনটি হত্যাকান্ড ঘটে গেল রাজধানীর বুকে। সম্রাট শুনলে ক্রুদ্ধ হবেন।”
মহামিশ্র বললেন, “আর একটা কথা নীলাকার। তোমার প্রতিনিধি বল্বের রাজধানী তা-হিয়া থেকে কী সংবাদ আনে—তা দেখ। তুমি দিনমানে জাঙ্কের ওপর যেমন নজর রেখেছ—তা রাখ। কিন্তু, রাত্রে জাঙ্কের চলাফেরার ওপরই দৃষ্টি রাখতে হবে। তার কাছে কে আসে যায়—সেই বা কোথায় যাতায়াত করে—এ সম্বন্ধে পুরো মাত্রায় আমাদের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। ভট্টরাই আর বিষ্ক তাই বলছিল। এ কাজ তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ, তারা গূঢ়পুরুষ নয়। তাছাড়া তোরণ দ্বারে তাদের কর্তব্য-কর্ম রয়েছে!”
নীলাকার বললেন, “তাই হবে ভন্তে মহামিশ্র! সম্রাটের কাছে কেমন করে মুখ দেখাব—সে বিষয়েও আমি চিন্তিত।”
মহামিশ্র এক সময়ে তাঁর দৈনন্দিনের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে সম্রাট কালই ফিরে আসছেন যখন! বেলা গড়িয়ে গেল। অপরাহ্নের মুখে ভট্টরাই নগর তোরণের কর্তব্য সেরে মহামিশ্রের সঙ্গে দেখা করতে এল। ভিখারিটির মর্মান্তিক মৃত্যুতে সে স্বভাবতই বিষণ্ণ। তাদের অসাবধানতাই যে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মহামিশ্র ভট্টরাইকে বসতে বলে বললেন, “তুমি যা ভাবছ—তাই ঠিক। আমি গতকালই সাবধান হলে এ মৃত্যু ঘটত না। ভিখারি হলেও কোনো মানুষের অযাচিত মৃত্যু আমি কামনা করি না। আমি দুঃখিত ভট্টরাই। তোমাদের পরিশ্রমের কোনো মূল্য রইল না।”
ভট্টরাই বলল, “না, ভন্তে, মহামিশ্র। এই মৃত্যু অন্তত প্রমাণ করল যে আমরা সঠিক পথেই চলছিলাম।”
“তা অবশ্যই।”
“কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জাঙ্ক একথা জানল কেমন করে? তাহলে এই প্রাসাদেও কি জাঙ্ক তার জাল বিছিয়ে ফেলেছে।”
মহামিশ্রের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।—”তাই তো! একথা তো আমি ভেবে দেখিনি। সে কোন লোক—যে আমাদের আলোচনা শুনেছে?”
ভট্টরাই বলল, “এ তো সোজা। যে পরিচারকটি গতকাল এখানে দেওয়ালগিরিগুলি জ্বালাবার জন্য প্রস্তুত করছিল—তাকে ডাকলেই তো হয়। প্রথম সন্দেহের তালিকায় তারই আসার কথা।”
মহামিশ্র বললেন, “ঠিক। একজন প্রহরীকে দিয়ে তিনি জনাগ নামে এক পরিচারককে ডেকে পাঠালেন।”
একটু পরে প্রহরীটি জানাল, “জনাগ আজ আসেনি। বলে পাঠিয়েছে তার শরীর খারাপ। সে অসুস্থ।”
ভট্টরাই বলল, “পরিচারকেরা সবাই কি এখানে বাস করে না?”
মহামিশ্র বললেন, “না। কয়েকজন বাইরে থেকে আসে। জনাগ তার মধ্যে একজন।”
“দিন বুঝে আজই সে অসুস্থ! বিষয়টি সন্দেহজনক।”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“আপনি তার বাসার বা বাসস্থানের ঠিকানা কি আমায় দিতে পারবেন?”
“তা পারব না কেন? কিন্তু অঞ্চলটি নগরের প্রত্যন্তপ্রান্তে। তুমি এইমাত্র কর্তব্য সেরে ফিরলে—তার চেয়ে আমি একজন প্রহরীকে পাঠাই।”
ভট্টরাই বলল, “ভন্তে মহামিশ্র! আমি বুঝতে পারছি, আপনি চাইছেন না যে আমি এই বিষয়ে জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু আপনি বোধহয় আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি শুধুমাত্র কমলিকার রত্নগুলির জন্য ব্যাকুল নই। আমি ব্যাকুল সম্রাটের নিরাপত্তার জন্য। জাঙ্ককে আমি বিশ্বাস করি না। ওর মতো হিংস্র মানুষ কমই আছে। নগরের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি এবং নানান ধরনের চঞ্চলতা প্রমাণ করছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আপনি অস্বীকার করতে পারবেন?”
মহামিশ্র তবু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন। বললেন, “দেখ ভট্টরাই। যার যা কাজ তাকেই সাজে। আমি বরং নীলাকারকে বলে পাঠাই।”
ভট্টরাই বলল, “আমায় ক্ষমা করবেন। আপনার ইচ্ছা হলে, তা আপনি করতে পারেন। কিন্তু যেহেতু এই ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত—তাই আমাকে একটু সুযোগ দিন। পরে হয়তো দেরি হয়ে যাবে।”
মহামিশ্র শেষপর্যন্ত অনুমতি দিয়ে বললেন, “ভট্টরাই। তোমার পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। নগরের পূর্বপ্রান্তে যে বসতিটি আছে—জনাগ সেখানেই বসবাস করে। ওদের বসতিতে দু’দশ ঘর মানুষ রয়েছে। তাই তাকে খুঁজে বার করা অসুবিধা জনক হবে না। তবে সাবধান! এখন দেখছি দেওয়ালের কান আছে। দেখে যেও। তোমাকে নিষেধ করার পিছনে এটিই আমার কারণ ছিল।”
ভট্টরাই তার ঘোড়া নিয়ে সন্ধান করতে করতে যখন জনাগের কুটিরের সামনে পৌঁছল—তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।
দাওয়ার সামনে ঘোড়া থেকে নেমে সে ডাকল, “জনাগ! জনাগ বাড়ি আছ? আমি তোরণদ্বারের রক্ষী ভট্টরাই। তোমার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে।”
কিছুক্ষণ কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। ঘর অন্ধকার। ভট্টরাই আবার ডাকল, “জনাগ! থাকলে সাড়া দাও। নইলে আমি ভেতরে ঢুকব।”
অতঃপর কুটিরের ভেতর থেকে হাতে একটি প্রদীপ নিয়ে একজন বেরিয়ে এসে দাওয়ায় দাঁড়াল চালের খুঁটি ধরে। “কাকে চাই?”
“জনাগকে। সে আছে?”
“না। দাদা নেই।”
“কোথায় গেছে সে? শুনলাম অসুস্থ!”
“জানি না কোথায় গেছে।”
“বেশ। তুমিই চল। মহামিশ্রের আদেশ, জনাগ না হলে তার ভাইকে যেন ধরে আনা হয়।” মিথ্যা বলল ভট্টরাই।
স্পষ্টতই ভয় পেয়ে গেল জনাগের ভাই।—”কেন? কেন? আমি কী করেছি যে আমায় নিয়ে যেতে হবে!”
আবার মিথ্যে করে ভট্টরাই বলল, “জনাগ কি জাঙ্ককে বলে গেছে?”
জাঙ্কের কথা উঠতেই বিবর্ণ হয়ে গেল জনাগের ভাইয়ের মুখ। সে জাঙ্কের উল্লেখে স্পষ্টতই ভেঙে পড়ল। “আমায় বাঁচান, ভট্টরাই।”
“কেন? তোমায় বাঁচাবার কথা আসছে কেন? তোমার নাম কী?”
“আমি বিনাগ। আমি কায়িক পরিশ্রম করে দিন কাটাই। কদিন আগে আমি নগরাধ্যক্ষের কার্যালয়ে এক নির্মাতার অধীনে কাজ করতে যাই। পরিচয় লিপিবদ্ধ করার সময় জাঙ্ক জানতে পারেন যে আমার দাদা প্রাসাদে কাজ করে। শোনামাত্র তিনি দাদাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বলেন। কারণ কিছু বলেননি আমাকে। দাদা ভয় ভয় তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, রাজপ্রাসাদের কোনো গোপনীয় কথাবার্তা শুনতে পেলেই সে যেন তাঁকে জানায়।
দাদা স্বভাবতই অস্বীকার করে। তখন জাঙ্ক বলেন, বেশ। অন্য লোক দেখব। তুই গরিব মানুষ। কিছু অর্থ পেতিস—এই আর কি!”
বিষয়টি ঐ দিন মিটে গেছে বলে আমরা মনে করলাম। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় কাজ থেকে ফেরার কিছু পরে দেখলাম, জাঙ্ক দুজন প্রহরী নিয়ে হঠাৎ উদয় হয়ে দাদাকে বললেন, ‘চোর বিনাগটাকে আসতে বল। আমার কার্যালয় থেকে পঞ্চাশটি রৌপ্যমুদ্রা চুরি করেছে।’
দাদা প্রতিবাদ করলে তিনি প্রহরীদের আদেশ করলেন, ‘যা। ভেতরে খুঁজে দেখ আর ওটাকে ধরে আন।’
অচিরেই আমাকে আর একটা ছোট্ট মুদ্রাকোষ নিয়ে প্রহরী দুটি বাইরে এসে বলল, ‘এই যে প্রভু! পেয়েছি! রান্নাঘরে চালের হাঁড়িতে রেখে দিয়েছিল।’ আমি বললাম, ‘মিথ্যা কথা। মুদ্রাকোষটি প্রহরীর কাছেই ছিল। আমি চুরি করিনি।’
জাঙ্ক আমাকে পদাঘাত করে প্রহরীদের আদেশ করলেন, ‘বাঁধ এটাকে। বন্দনাগারে এক উপযুক্ত সেবা করতে হবে। কার্যালয় থেকে চুরি! কী সাহস!’ পাড়া-প্রতিবেশী সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করে জাঙ্ক আমায় চোর সাজিয়ে মারতে মারতে কার্যালয়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে চলল অকথ্য অত্যাচার। দেখুন না আমি ভালো করে চলতে ফিরতেও পারছি না!’
ভট্টরাই বলল, “সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তা ছাড়া পেলে কী করে?”
“আমার অবস্থা শুনে দাদা দেখা করতে যায় জাঙ্কের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রথম যেদিন একটা ভালো সংবাদ নিয়ে আসতে পারবি সেদিন তোর ভাইকে ছাড়ব। নইলে জেনে রাখ, তাকে নিত্য সেবা তো করবই, উপরন্তু হুং-চাদের হত্যাকাণ্ডে তাকে জড়িয়ে দেব। মশানে গিয়ে ওকে গলাটা দিতে হবে শেষ পর্যন্ত।’
দাদা ভয় পেয়ে ফিরে গেল। পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় এসে একজন ভিক্ষুক আর আপনার নামে—হ্যাঁ ভট্টরাই তো আপনারই নাম—কিছু বলল। তারপরেই আমি ছাড়া পাই এবং আজই প্রভাতে শুনি ভিক্ষুকটিকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর আমার বা আপনার পালা। আমায় বাঁচান।”
“জনাগ কোথায়?”
“সে পালিয়েছে। একদিকে মহামিশ্রের ভয় অন্যদিকে জাঙ্কের। তিনি নিশ্চিতভাবে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ রাখবেন না। দাদাই বা যে কতদিন নিরাপদে থাকতে পারবে তাও জানি না। আমার দাদার সঙ্গে পথ পাড়ি দেওয়ার অর্থ হোত তাকেই বিপদে ফেলা। তাই দাদাকে বললাম, আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হোক।—আজ রাতেই হয়তো মারবে!”
ভট্টরাই বুঝল, বিনাগ সত্য কথাই বলছে। জাঙ্ক কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। সেক্ষেত্রে তার নিজের কথা ছেড়ে দিলেও বিনাগের প্রাণ যে বিপন্ন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কী করা যায়? বিনাগের জন্য রাতের মতো একটা নিরাপদ আশ্রয় চাই—যেখানে বিনাগকে রাখা যাবে। নগরদ্বার এখন বন্ধ নগর ত্যাগও সে করতে পারবে না। মহামিশ্রের কাছে পৌঁছতে সময় লাগবে। রাতে তাকে বিরক্ত করাটি কি ঠিক হবে? তিনি তো তাকে আসতে নিষেধ করেছিলেন। সে এসেই সম্ভবত বিনাগের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করল। কোথায় নিয়ে যাবে সে বিনাগকে? নিজের বাড়িতে? কিন্তু সেখানেও তো জাঙ্ক মিথ্যা অপরাধে তাকে জড়িয়ে ফেলতে পারে। হঠাৎ বিষ্কের কথা মনে পড়ে গেল ভট্টরাইয়ের। হ্যাঁ—বিষ্ক। সেখানে অন্তত রাতের মধ্যে জাঙ্ক হাত গলাতে পারবে না।
উৎসাহিত হয়ে ভট্টরাই বলল, “ঠিক আছে। চল আমার সঙ্গে। দেখি জাঙ্ক কী করতে পারেন। রাতটুকু পার করতে হবে। প্রভাতেই তোমাকে মহামিশ্রের হাতে দিয়ে আসব। জাঙ্কের জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে যাবে। যাও—তোমার যা নেবার একটি পুঁটুলিতে বেঁধে নিয়ে এস। তারপর আমার ঘোড়ায় চড়ে বস। হাঁটতে তো পারবে না।”
প্রতিবেশীদের অবাক করে ভট্টরাই আর বিনাগ ঘোড়ায় চড়ে বসল। কিন্তু একটু যেতেই ভট্টরাইয়ের মনে হল কয়েক জোড়া চোখ তাদের অনুসরণ করছে। বিনাগও অনুভব করতে পারছিল।—”ওরা আছে। ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ যেন আমি শুনতে পাচ্ছি। সামনের ঐ মাঠটি পার হওয়ার সময়েই ওরা বোধহয় ঝাঁপাবে।”
ভট্টরাই বলল, “তুমি ভয় পাচ্ছ?”
বিনাগ বলল, “ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু এ মুহূর্তে নয়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে! হাতের লাঠিটা শক্ত মুঠোয় ধরে সে বলল, এখন জাঙ্ক এলেও তাকে আমি হত্যা করতে ভয় পাব না। আমি প্রতিশোধ নেব। এই আধো অন্ধকারে ওদের যেমন সুবিধা—আমাদেরও। মাঠের শেষে ঐ গাছগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখবেন। আমার বিশ্বাস ওরা গাছের আড়ালে রয়েছে।”
“ওরা কজন আছে বলে তোমার মনে হয়?”
“পাঁচ-ছ’জন তো হবেই। আসলে ওরা আমার ওপর নজর রেখেছিল। আমি আপনার আসার আগে তাদের আমার কুঁড়েঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। প্রতিবেশীরা জেগে থাকাতে তারা বোধহয় রাতের জন্য অপেক্ষা করছিল। এরমধ্যে আপনার গলা পেয়ে আমি সাহস করে বেরিয়ে আসি।”
“তখন তো এসব কথা বলনি।”
“এমনি। বলে কী লাভ হোত? হয়তো ভয় পেয়ে আপনি আমাকে ফেলে চলে যেতেন। ঘোড়ায় চেপে ওই রাস্তাটুকু পার হবার সুযোগ আমার জুটতো না!”
“ও!” ভট্টরাই চুপ করে থেকে বলল, “তোমার দাদা কোথায় গেছে? জাঙ্কের নাগালের বাইরে যেতে পেরেছে কি?”
বিনাগ বলল, “মনে হয় না। তবে দিন কয়েকের জন্য নিশ্চয় নিশ্চিন্ত থাকবে। সন্ধান পেয়ে সেখানে যেতে জাঙ্কেরও তো সময় লাগবে।”
“কোথায় গেছে?”
“আর লুকিয়ে রাখার অর্থ হয় না।—সে গেছে আমাদের দেশের বাড়িতে। সেই গ্রাম এখান থেকে কুড়ি ক্রোশ দূরে হবে। জাঙ্ক তাকে খুঁজে বার করবেই।”
মাঝ মাঠে আক্রান্ত হল ভট্টরাই। রে-রে করে ছ’জন দুষ্কৃতী ছুটে এল। এরা নগর প্রধানের ঘাতকও হতে পারে। ভট্টরাই শক্ত হাতে তলোয়ার চেপে ধরে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ল। আধো অন্ধকার। ছায়া ছায়া শরীর।
আক্রমণকারীরা প্রতিরোধের আশা করেনি। ভট্টরাই অব্যর্থ লক্ষ্যে সামনের আততায়ীর দিকে তলোয়ার চালাল। কাটা গাছের মতোই লুটিয়ে পড়ল সে। দুষ্কৃতীরা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিমূঢ় হয়ে যাবার পর ভট্টরাই আর বিনাগকে ঘোড়া সমেত ঘিরে ধরল। একজন আততায়ী বিনাগকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতেই বিনাগ তার হাতে থাকা লাঠিটা দিয়ে সজোরে তার মাথায় আঘাত করল। আততায়ীটি আর্তনাদ করে ভূমিশয্যা নিল। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা বিনাগের হাতের লাঠি সে দেখতে পায়নি।
চারজন দুষ্কৃতী এবার একযোগে ভট্টরাইকে আক্রমণ করল। ভট্টরাই দক্ষতার সঙ্গে তাদের আঘাত প্রতিহত করে প্রত্যাঘাত হানতে থাকল।
হঠাৎ আকাশে চাঁদ উঠল। আলোর বন্যায় মাঠটি ভেসে গেল। দু’পক্ষেরই সুবিধা হল। ভট্টরাই ঠিক করল দ্রুত এদের শেষ করতে হবে। এরা অস্ত্রধারী ঘাতক হলেও কেউই তার মতো দক্ষ নয়। তার মতো তরুণও কেউ নয়। তারুণ্যের সুযোগ নিয়ে ভট্টরাই নিপুণভাবে তলোয়ার চালনা করতে লাগল। শেষপর্যন্ত দেখা গেল আরও তিনজন চিরকালের মতো ভূমিশয্যা নিয়েছে—শেষজন পালাচ্ছে। কিন্তু পালাতে পারল না। ঘোড়ার পিঠে বসে থেকে বিনাগ অপূর্ব ক্ষিপ্রতায় হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে দিল। পলাতক দুষ্কৃতীটি মুখ থুবড়ে পড়ল। ভট্টরাই ছুটে গিয়ে তাকে চিৎ করে তলোয়ার ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করল। “কে পাঠিয়েছে? তোরা কারা?”
“প্রহরী। জাঙ্ক পাঠিয়েছেন। আমায় ছেড়ে দাও। নইলে বিপদে পড়বে।”
ভট্টরাই তলোয়ারটি আমূল বসিয়ে দিয়ে তা আবার বার করে মৃতের পোশাকে রক্ত মুছে নিয়ে কোষবদ্ধ করল। জাঙ্ককে সংবাদ দেবার জন্য এর বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই।
বিনাগ বলল, “ভট্টরাই! আপনি সঠিক কাজই করেছেন। কিন্তু আমাদের এখনই পালাতে হবে। অন্য কেউ এসে পড়তে পারে।”
“ঠিক!” ভট্টরাই লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠল। মাঠ পেরিয়ে গাছগুলো পার হতে গিয়ে সে দেখল ছ’টি ঘোড়া একটি গাছে বাঁধা রয়েছে। দুষ্টবুদ্ধি খেলা করল ভট্টরাইয়ের মাথায়। সে ঘোড়াগুলিকে মুক্ত করে তাড়িয়ে দিল।
একসময় ভট্টরাই বিষ্কের কুটিরের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল।—”প্রধান জেগে আছেন?”
বিষ্ক শোবার আয়োজন করছিলেন। একাই রয়েছেন। পরিবার-পরিজনেরা গ্রামের বাড়িতে গেছে।
ভট্টরাইয়ের গলা শুনে একটু অবাক হয়ে তিনি ভেতর থেকে সাড়া দিয়ে বললেন, কে? ভট্টরাই? একটু দাঁড়াও। তারপর একটি প্রদীপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। চাঁদ উঠেছে, প্রদীপের দরকার ছিল না। চাঁদের আলোতেই তিনি রক্তাক্ত ভট্টরাইকে দেখে চমকে উঠলেন।—আহত? সঙ্গে এটি কে?
ঘোড়া থেকে নামতে নামতে ভট্টরাই বলল, আহত নই। ছ-ছটি হত্যা করে এলাম। এটি জনাগের ভাই বিনাগ।
সে আবার কে?
চলুন চলুন। ভেতরে চলুন। একটু স্নান করে নিই। তারপর বলছি সব। দীর্ঘ কাহিনি।
ভেতরের ঘরে সে বিনাগকে বসিয়ে বলল, একটু আহারের ব্যবস্থা দেখুন। না, আমার জন্য নয়। এই বিনাগের জন্য। বাড়িতে মা তো আহার নিয়ে বসে আছেন। দেরি দেখে ভাবছেন নিশ্চয়। যাহোক আপনার কুয়োতলাটা কোন দিকে?
বিষ্ক দেখিয়ে দিতে ভট্টরাই সেদিকে গেল।
স্নান সেরে ভট্টরাই ফিরে এসে দেখল, বিষ্ক একটি পাত্রে কিছু মুড়ি আর গুড় নিয়ে এসেছেন।—এ সময়ে আর কিছুর ব্যবস্থা করতে পারলাম না। ঘরে কেউ নেই তো!
ভট্টরাই বসে পড়ে বলল, এতেই হবে। বিনাগ হাত চালাও। আমি দু এক গাল মুখে দিচ্ছি।
মুড়ি চিবোতে চিবোতে ভট্টরাই ভিখারি হত্যা, মহামিশ্র থেকে এপর্যন্ত সব কিছু খুলে বলল বিষ্ককে। বিষ্ক বললেন, কাল সকালে তো নগরে হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। ছ-ছটি প্রহরী হত্যা। জাঙ্ক নিঃসন্দেহে বিষয়টি জনাগ আর বিনাগের ওপর চাপাবে। তোমার নাম হয়ত সহসা উচ্চারণ করবে না। কিন্তু তা যদি না করে তবে জনাগ-বিনাগের ওপর অভিযোগটা ঠিক মতো দাঁড়াবে না। কারণ ছ-ছটি প্রহরী হত্যা করা ওদের কর্ম বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। সুতরাং, অতি প্রভাতে তুমি মহামিশ্রের শরণ নেবে এবং বিনাগকেও নিয়ে যাবে।
তা যাব। কিন্তু বিনাগ রাতের মতো আপনার কাছে থাকবে তোরণ প্রধান। আমার গৃহে বিনাগের সন্ধানে গেলেও—আপনার এখানে সহসা আসতে পারবে না।
অবশ্য তোমাকে-আমাকে বন্দি করার কথাই উঠছে না—মহামিশ্রের অনুমতি চাই। একটু থেমে বিষ্ক বললেন, আরও একটি কথা। জনাগের স্বীকারোক্তি আমাদের পক্ষে এক মূল্যবান সাক্ষ্য বলে বিবেচিত হবে। সুতরাং, জাষ্ক জনাগকে খুঁজে বার করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে তুমি মহামিশ্রকে বলে একদল সেনা জনাগের গ্রামে পাঠাবে এবং তাকে বন্দি করে আনাবার ব্যবস্থা করবে। মহামিশ্র এক্ষেত্রে যেন দেরি না করেন। নচেৎ কাল সন্ধ্যার মধ্যে জাষ্কের ঘাতক বাহিনী ঠিক পৌঁছে যাবে।
ভট্টরাই উঠে দাঁড়াল। নিজেকে ক্লান্ত লাগছিল। সামান্য মুড়ি-গুড় তার ক্ষিদেকে যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।—আসছি, তোরণ প্রধান। প্রভাতেই উপস্থিত হব। শুভরাত্রি।
ব্যঙ্গ করলেন বিষ্ক।—তুমি আবার এসবও শিখেছ! যা হোক সাবধানে যেও।
ভট্টরাই বলল, আপনার আর্শীবাদে জনা দশবারোর মহড়া আমি নিতে পারব। ওরা কালোধন উপার্জন করতে করতে তলোয়ার চালনা করা ভুলে গেছে!
রাত্রে শান্তিতে শুয়েছিলেন জাঙ্ক। তিনি ভেবেছিলেন পালাক জনাগ। পালিয়ে যাবে সে কোথায়? তাঁর হাত সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে পৌঁছবে। নিস্তার নেই জনাগের। উপস্থিত বিনাগের ওপর নজর রেখেছেন। তার সঙ্গে যদি কেউ দেখা করতে আসে তাহলে বিনাগ আর সেই আগন্তুককেও তাঁর ঘাতকরা হয় হত্যা করবে না হয় বন্দি করে আনবে। ভট্টরাইয়ের ওপরও লক্ষ রাখা হয়েছে। তরুণটি বড় উৎসাহী। ভিখারিটিকে তার পেছনে লাগিয়েছিল। বিষ্কও কম যায় না। কিন্তু একে একে দুজনকেই তিনি দেখে নেবেন। জাঙ্কের উঠোনে পা বাড়ানো যে কী ভয়ংকর! বিষ্কও বুঝবে সমাজ-উৎসবের পরই। এই ছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিষ্কের পরিকল্পনা। কিন্তু সন্ধ্যার পরই তিনি শুনতে পান, জনৈক নগর-প্রহরী ভট্টরাইকে মহামিশ্রের কাছে যেতে এবং বার হয়ে নগরের পূর্ব প্রান্তের দিকে ঘোড়া ছোটাতে দেখেছে। জাঙ্কের বুঝতে ভুল হয় নি যে ভট্টরাই জনাগের সন্ধানে যাচ্ছে। কারণ, তার গৃহ নগরের পশ্চিম অংশে সে যাচ্ছে বিপরীতে! পূবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে জনাগ আর বিনাগ! বিনাগ মুক্ত হয়ে যাবার পর জনাগ আর তার সঙ্গে দেখা করেনি। শুনেছে আত্মগোপন করেছে আর না হয় পালিয়েছে। তাই তিনি চারজন ঘাতক প্রহরীকে পাঠিয়েছেন বিনাগের ওপর দৃষ্টি রাখতে। কে যাচ্ছে—আসছে তা তাঁর জানা প্রয়োজন। ভট্টরাইয়ের কথা শোনামাত্র তিনি আরও দুজন প্রহরীকে পাঠিয়েছিলেন—জনাগ যদি সত্যি না থাকে তাহলে বিনাগ এবং আগন্তুক বেশী ভট্টরাইকে হত্যা করতে! অন্তত দুটি শত্রু তো নিকেশ হবে। ভট্টরাই মরলে যাহোক একটা কিছু গল্প বললেই চলবে। বিনাগকে জড়িয়ে নেবেন। আর জনাগকে ধরতে পারলে তাকে দস্যু বাকাটকি বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। মণিকার পুত্রী তখন ধরা পড়ে যাবে। যে সে মিথ্যা বলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
শুয়ে শুয়ে জাঙ্ক অবশ্য ভাবলেন, পরিকল্পনাগুলির মধ্যে বাঁধন তেমন হল না। না হোক। সামান্য কিছুদিনের তো ব্যাপার। সামনেই সমাজ-উৎসব। পাশার দান সব পালটে যাবে। মধ্যবর্তী সময়টুকু সে পরম বিনয়ী হয়ে কোন রকমে সামলে নেবে। তারপর সমাজ-উৎসবের রাতে স্বমূর্তি ধরবে।
যথাসম্ভব শান্ত মনে থাকতে চাইছিলেন জাঙ্ক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিউ-পিনানের নিস্তব্ধতা তাঁকে চিন্তিত করে তুলল। অনেক কিছু নির্ভর করছে তাঁর উপর। প্রথম অর্থ। আগামী কালই কিছু ধর্মীয় ও গোষ্ঠী নেতাকে কিছু কিছু অর্থ দিতে হবে। তাঁর সহকারীদেরও কিছু অর্থ দেওয়ার কথা। দ্বিতীয়ত, ঘাতক বাহিনী। এখানকার ঘাতকেরা অতটা দক্ষ নয়। হলেও সম্রাট সম্বন্ধে অধিকাংশের মনে একটি দুর্বলতা আছে। কোনও রকম সংশয়ের মধ্যে যেতে চান না জাঙ্ক। তাছাড়া হিউ-পিনানের ঘাতকেরা যদি ব্যর্থও হয় তবে সোজাসুজি তিনি হিউ-পিনানের ওপর দোষারোপ করবেন। মন্ত্রী ইউনাস, ভার্গব আর দুবল তাঁকে সমর্থন করবেন। সমর্থন তাঁদের করতেই হবে। নচেৎ তাঁরা নিজেরাও যে জড়িয়ে পড়বেন একথা ভালভাবেই জানেন। তৃতীয়ত, সেনাবাহিনী প্রয়োজন। অন্তত সীমান্তে সেনা সাজিয়ে আক্রমণ করার ভয় দেখালেও কাজ হবে। তাছাড়া—তাঁর নিজেরও কিছু সেনার প্রয়োজন। রাজপ্রাসাদ এবং সেনানিবাস ঘিরতে হবে। হিউ-পিনান যদি আজ কালের মধ্যে সাড়া না দেন তবে নিজের ব্যবস্থা তাঁকে নিজেই করতে হবে। তিনি একবার যখন এগিয়েছেন তখন পিছোবেন না। হঠাৎ জাঙ্কের মাথায় আর একটা পরিকল্পনা খেলা করে গেল। সেনানিবাসের সেনা হ্রাস করতে হবে। সেক্ষেত্রে কোথাও বা নিম্নসিন্ধু অঞ্চলে যদি কোনও বিদ্রোহের সৃষ্টি করা যায়? বিশাল এক সেনাবাহিনী যদি তা দমন করতে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে যায়…! ওখানকার পহ্লব ক্ষত্রপের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করা অতি জরুরি। কিন্তু কাকে পাঠাবেন? তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। এর আগে সিন্ধু- বন্দরগুলির শ্রমিক অশান্তি দমনে ইউনাস, ভার্গব আর দুবল গিয়েছিলেন। সেই সময়ে তাঁরা সম্রাটের অধীনস্থ শক এবং পহ্লব ক্ষত্রপের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। তাঁরা সম্রাটের ওপর স্বাভাবিক কারণেই রুষ্ট। ঐ অঞ্চলে তাঁর গোষ্ঠীর লোকজনও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। কাল প্রভাতেই তিনি ইউনাসের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। উজ্জীবিত জাঙ্ক বেশ শান্তভাবেই চোখদুটি সবে বুঁজেছেন—ঠিক সেই সময় একজন প্রহরী এসে ডাকল—প্রভু!
মুখ-চোখ বিকৃত করে চেঁচিয়ে উঠলেন জাঙ্ক। কী দরকার পড়ল হঠাৎ? তোরা সামলে নিতে পারিস না একটুও। কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ যে ঢালছি তোদের পেছনে। শান্তিতে একটু শুতেও পারব না!
ভীত সন্ত্রস্ত প্রহরীটি বলল, আজ্ঞে, হিউ-পিনানের কাছ থেকে একজন এসেছেন। আপনাকে এখনই প্রয়োজন।
হিউ-পিনানের লোক! লাফ দিয়ে শয্যা ত্যাগ করলেন জাঙ্ক। মূর্খ কোথাকার! আগে বলবি তো! যা নিয়ে আয় তাকে। আর হ্যাঁ, দেখবি কথাবার্তা বলার সময় এদিকে কেউ যেন না উঁকি মারে। তাহলে তার মুন্ডু যাবে।
প্রহরী সভয়ে চলে গিয়ে বাঁচল।
শেষ পর্যন্ত সম্রাট পুরুষপুরে ফিরলেন—কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের দুদিন পরে। সম্রাট হঠাৎই অসুস্থ বোধ করেন কণিষ্কপুরে। ওখানকার বৈদ্যরা তাঁকে ঔষধী দিয়ে দু-একদিনের জন্য সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাবেই তাঁর বায়ু-কফ-পিত্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তাঁদের ধারণা। সম্রাট বৈদ্যের কথা মেনে নিয়ে প্রাসাদ-রমণী আর পরিচারিকাদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিলেন। সত্যিই সম্রাট দু-একদিনের মধ্যে যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠে আর কণিষ্কপুরে অপেক্ষা করতে চাইলেন না। সম্মেলনে এখন ধর্ম নিয়ে কূট বিতর্ক চলছে। ওখানে তিনি এখন অপ্রয়োজনীয়। তাই তিনি পুরুষপুর যাত্রার আয়োজন করলেন। অশ্বঘোষ প্রমুখেরা বা ওখানকার প্রশাসকেরা তাঁকে আর বাধা দিলেন না।
কিন্তু পুরুষপুরে পৌঁছেই তিনি আবার অসুস্থতা বোধ করতে শুরু করলেন। বাম বুকে—হৃদয়ের কাছে আবার সেই চিনচিনে ব্যথা! কিন্তু সম্রাট তা সম্পূর্ণ গোপন করে গেলেন। ভাবলেন দীর্ঘ যাত্রাপথের জন্যেই এই বেদনার পুনরাবৃত্তি। তাঁর আরও কয়েকদিন বিশ্রাম নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নেবেন কী করে, বুদ্ধের কথা তাঁর স্মরণ হল। শরীর থাকলেই ব্যাধি আশ্রয় করবে। মানুষের জীবনে এ এক স্বাভাবিক অবস্থা। এই ব্যাধিকে দমন করেই মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে।
যাহোক, তিনি সেদিনের জন্য রাজসভা স্থগিত রেখে প্রাসাদ সভাকক্ষে মহামিশ্রকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর অনুপস্থিতির সময়ে যা যা ঘটে গেছে তার পূর্ণ বিবরণ সংগ্রহ করতে বসলেন। সম্রাট হিসাবে প্রতিটি ছোট ছোট বিষয়ও তাঁর জানা উচিত। সমস্ত ঘটনাই সম্রাটের নখদর্পণে থাকার প্রয়োজন।
মহামিশ্র বললেন, গতকাল একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। গতরাত্রে ছ-জন নগর প্রহরী নিহত হয়েছে। প্রভাতে এই সংবাদ পুরুষপুরে ছড়িয়ে পড়ার আগেই ভট্টরাই বিনাগ নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদে দেখা করে। গত পরশু নগর কার্যালয়ের সামনে একটি ভিখারি নিহত হয় এবং জাঙ্ক সব দায় অস্বীকার করে। কিন্তু ভট্টরাই এবং তোরণ প্রধান বিষ্কের কাছে জানা যায় যে তারা জাঙ্কের ওপর নজর রাখার জন্য ঐ ভিখারিটিকে নিয়োগ করেছিল। এবং ভিখারিটি তাদের কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যও দেয়। মহামিশ্র সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক খুলে বলার পর বললেন, ঐ রাত্রেই নিহত হয় ভিখারিটি। অর্থাৎ আমার সঙ্গে ভট্টরাইয়ের কী কথা হয়েছিল তা কেউ জাঙ্ককে জানিয়েছিল। জাঙ্ক তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণকে স্বভাবতই বাঁচিয়ে রাখতে চায়নি। যাহোক আমি অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে জনাগ নামে যে কর্মচারিটি সেদিন দেওয়ালগিরিগুলি প্রস্তুত করছিল সে কর্মে অনুপস্থিত। সে নাকি শারীরিক ভাবে অসুস্থ। ভট্টরাই বলে, বিষয়টি সন্দেহজনক। জনাগের কাছে এখনই যাওয়া দরকার। তাকে ধরে এনে জানতে হবে এই প্রাসাদে জাঙ্কের কোন চর আছে কিনা। আমি ভেবেছিলাম, নীলাকারকে পাঠাব অনুসন্ধানের জন্য। কিন্তু ভট্টরাই অপেক্ষা করতে চায়নি। যদি ভিখারিটির মত জনাগকেও জাঙ্ক সরিয়ে দেয়! কিন্তু আমি ভট্টরাইয়ের জন্য চিন্তিত ছিলাম। ভিখারিটির মৃত্যুর পর ভট্টরাইও যে জাঙ্কের লক্ষ্যের মধ্যে আছে তা আমি অনুমান করেছিলাম। যাহোক, ভট্টরাইকে অনুমতি দিতে আমি বাধ্য হই। আজ প্রভাতে নগর জাগবার আগেই সে জনাগের ভাই বিনাগকে সঙ্গে নিয়ে আমার শরণে আসে এবং সমস্ত ইতিবৃত্ত খুলে বলে। আমি বিনাগকে নীলাকারের হাতে তুলে দিয়েছি তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই। অন্যদিকে জনাগের সন্ধানে একদল সেনা পাঠিয়ে দিয়েছি তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জাঙ্কের ঘাতকরা যথাসম্ভব শিঘ্রই সেখানে উপস্থিত হবে। তার আগে জনাগকে আমাদের হাতে নেওয়া প্রয়োজন।
সম্রাট বললেন, দেখছি, ভট্টরাই বেশ কুশলী এবং করিতকর্মা।
মহামিশ্র বললেন, হ্যাঁ সম্রাট। আশা করি জীবনে সে যথেষ্ট উন্নতি করবে আপনার সহায়তা পেলে। এই মুহূর্তে আমাদের বিশ্বস্ত লোকেরও প্রয়োজন।
সম্রাট বললেন, অন্য সংবাদ?
হ্যাঁ, সম্রাট। গতকালই নীলাকার গুণবর্ধনের সহায়তায় কয়েকজন ধর্মীয় ও গোষ্ঠী নেতাকে বন্দী করেছে। তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা বার করেছিল। অনুসন্ধানে জানা গেছে বিপুল অর্থ পেয়ে তারা এই অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছিল।
অর্থ তারা কার মাধ্যমে পেয়েছিল, তা কী জানা গেছে?
গেছে সম্রাট। তবে কোনও লাভ হয়নি। কারণ সেই মধ্যবর্তী মানুষটিও গতকাল রাত্রে নিহত হয়েছে। ফলে উৎস মুখ জানা যায়নি।
হুঁ! বলে সম্রাট গম্ভীর হয়ে গেলেন।
মহামিশ্র বললেন, প্রতি ঘটনার পেছনে জাঙ্কের উপস্থিতি রয়েছে বলে আমরা বুঝতে পারলেও প্রমাণ অভাবে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।
সম্রাট বললেন, নগরে হত্যাকান্ড বেড়ে চলেছে। অন্তত এই ব্যাপারে আমরা জাস্কের কৈফিয়ৎ দাবী করতে পারি। মহামিশ্র! তুমি এখনই জাঙ্ক, গুণবর্ধন আর নীলাকারকে ডাকাবার ব্যবস্থা কর।
যথা আজ্ঞা সম্রাট। মহামিশ্র সভাকক্ষ ছেড়ে বাইরে গেলেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার জন্য।
কিছু পরে মহামিশ্র যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিয়ে ফিরে এসে দেখলেন সম্রাট খুবই চিন্তিত। মহামিশ্র মৃদু স্বরে বললেন, সম্রাট কি কিছু চিন্তা করছেন?
সম্রাট বললেন, আচ্ছা মহামিশ্র। তোমার কি মনে হচ্ছে না, অশুভ কোন কিছু একটা ঘটতে চলেছে? আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমায় প্রতারণা করে না। তাই জীবনে বহু ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আজও আমি কুষাণ সম্রাট। সেদিনও আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমায় সাবধান করে দিয়েছিল। তাই এখনও আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি।
মৃদু স্বরে মহামিশ্র বললেন, জানি সম্রাট। তবে ওসব এখন ভুলে যান। ওসব অনেক দিনের কথা। বর্তমানে সেই রকম একটা যে পরিবেশ গজিয়ে উঠেছে—তা আমি অস্বীকার করতে পারছি না। এত হত্যা…। পুরুষপুরে এমনটা হয়নি এর আগে!
আমরা কি বলতে পারি, জাঙ্কের আরও কোন গুপ্তচর এই প্রাসাদে ঢুকে পড়েনি? জনাগ কি একা? আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। তোমার একার পক্ষে এই বিশাল প্রাসাদের কর্মচারিদের দায়িত্ব সামলানো সম্ভব নয়। তোমার প্রশাসনিক কাজকর্মও রয়েছে।
মহামিশ্র বললেন, সম্রাট! আপনাকে এতকাল তো কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিইনি। আজ…!
ভুল বুঝেছ মহামিশ্র! আমি অভিযোগ করছি না। তোমার অসুবিধাটুকু অনুভব করার চেষ্টা করছি।
তা সম্রাট আমাকে কী আদেশ করতে চান?
তুমি তোমার একজন উপযুক্ত এবং একশ ভাগ বিশ্বস্ত সহকারী নিয়োগ কর। সে মূলত সমস্ত কর্মচারিদের ওপর নজর রাখবে এবং অন্যান্য কাজে সহায়তা করবে।
মহামিশ্র বললেন, এতো উত্তম প্রস্তাব, সম্রাট। কিন্তু এই মুহূর্তে হাতের কাছে তেমন লোক কই? কার ওপর বিশ্বাস করব?
কেন? ঐ তরুণ ভট্টরাই? তার ওপর কি নির্ভর করা যায় না?
মহামিশ্রের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আমি ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম! অতীব দক্ষ যোদ্ধা এবং যথেষ্ট সপ্রতিভ এবং বুদ্ধিমান।
সম্রাট বললেন, বেশ তুমি এখুনি আরও দুটি লোককে ডেকে পাঠাও। তারা যে যেমন অবস্থায় আছে যেন এখানে এসে উপস্থিত হয়।
কাকে কাকে সম্রাট?
ভট্টরাই আর জাষ্ককে।
ভট্টরাইকে আমি দেখতে চাই আর জাঙ্ককে প্রশ্ন করতে চাই।
গূঢ়পুরুষ প্রধান আর সেনাপতি….?
ওরাও আসুক। কোন অসুবিধে নেই।
মহামিশ্র আবার কক্ষের বাইরে গেলেন। সঙ্গে গুণবর্ধন আর নীলাকারকে নিয়ে ঢুকলেন।
গুণবর্ধন আর নীলাকার আভূমি নত হয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, আশাকরি সম্রাট সুস্থ এবং কুশলে আছেন!
কণিষ্ক কথার উত্তর না দিয়ে দুজনকে আসন গ্রহণ করতে বললেন। এরপর সম্রাট বললেন, আমি মহামিশ্রের কাছ থেকে সব শুনেছি। কিছু বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং ইউ-চি গোষ্ঠীর স্বপ্রচারিত নেতাদের তোমরা বন্দী করেছ—তাতে কিছু কি জানা গেল—নেপথ্যে কে?
না সম্রাট! মধ্যবর্তী মানুষটি যে নিহত হয়েছে- এও নিশ্চয় আপনি শুনেছেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবে আমরা উৎসে এখনও পৌঁছতে পারিনি। তবে আমরা অনুসন্ধান শিথিল করিনি। আশা করছি অচিরেই সে ধরা পড়বে।
জনাগকে উদ্ধার করা গেছে?
গুণবর্ধন বললেন, প্রভাতেই একদল অশ্বারোহী সৈনিককে পাঠানো হয়েছে জনাগের গ্রামে। আশা করছি, কোন ক্ষতি হবার আগেই তাকে নিয়ে সেনারা আগামিকাল প্রভাতের মধ্যে ফিরে আসবে।
জনাগ আর বিনাগকে সাবধানে রাখতে হবে। ওরা আমাদের বহুমূল্য সাক্ষী!
নীলাকার! হিউ-পিনানের সংবাদ কী?
সম্রাট উপ-মহাক্ষত্রপ সোরোড়ানকে জানানো হয়েছে। সেনাবাহিনী সম্রাটের পক্ষে। প্রজারা আপনার পক্ষে। তবে সেখানে চিন সম্রাটকে নিয়ে সময়টা ভাল যাচ্ছে না। ওরা কাশগড়—খোটান আর ইয়ারকন্দের রেশম পথ নিজেদের অধিকারে আনতে চায়। মহাক্ষত্রপ হিউ-পিনান যাতে চিনা প্রতিরোধের অছিলায় অন্য কিছু না করে বসতে পারেন—সেদিকে গূঢ়পুরুষ বিভাগ উপ-মহাক্ষত্রপ সোরোডানের নেতৃত্বে গোপনে লক্ষ্য রেখেছে। সৌভাগ্যের বিষয়, গূঢ়পুরুষ বিভাগটির অধিকর্তা সোরোডান নিজেই।
মহামিশ্রের মনে হল সম্রাট যেন ক্লান্তি অনুভব করছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদ দেখা দিচ্ছে। নিজের অজান্তেই তিনি তাঁর বাম বুকে মাঝে মধ্যে হাত বোলাচ্ছেন। মহামিশ্র আসন ছেড়ে সম্রাটের কাছে উঠে গেলেন। তারপর ফিসফিস স্বরে প্রশ্ন করলেন।—সম্রাট কি অসুস্থ বোধ করছেন?
কণিষ্ক হাসবার চেষ্টা করে বললেন, না। ও কিছু নয়। পরিপাক ক্রিয়ার কিছু গণ্ডোগোল হচ্ছে। মনে হয়, পুরুষপুরের জল আমার ঠিক সহ্য হয়নি।
মহামিশ্র একজন পরিচারককে শীতল জল আনতে বললেন। জলপান করে সম্রাট কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন।
একজন দ্বাররক্ষী এসে জানাল নগরাধ্যক্ষ জাঙ্ক সম্রাটের দর্শনের জন্য উপস্থিত হয়েছেন।
সম্রাট হাত নেড়ে তাকে আসার অনুমতি দিলেন।
সন্তর্পণে জাঙ্ক প্রবেশ করে প্রথমে সম্রাট ও পরে অন্যান্য সকলকে অভিবাদন জানিয়ে বিগলিত ভাবে বললেন, সম্রাট! আমাকে আদেশ করেছেন?
কণিষ্ক স্থির দৃষ্টে জাষ্কের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই নগরের প্রধান কে?
আজ্ঞে, আমি!
নগরে দিনের পর দিন কী ঘটে চলেছে সে সম্বন্ধে কিছু খোঁজ রাখ?
কী সম্রাট? কী ঘটছে?
মহামিশ্র লক্ষ করলেন, সম্রাট তাঁর ক্রোধ পরিপাক করে যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললেন, নগরে একের পর এক হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। একজন অপরাধীও এ পর্যন্ত ধরা পড়েনি। কেন?
জাষ্ক বিনীত স্বরে বললেন, ক্ষমা করবেন, সম্রাট। আমি অনুসন্ধান করছি। কিছু বহিরাগত দুষ্কৃতি এই কান্ডগুলি সংঘটিত করছে। তবে তারা আমার জাল থেকে বেরোতে পারবে না। ধরা পড়বেই।
সম্রাট প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ করে বললেন, খুশি হলাম। কিন্তু ধর্মীয় গোষ্ঠীরা যে অশান্তির চেষ্টা করছে তার কোন সংবাদ রাখ কি?
নিশ্চয় সম্রাট। নীলাকার তো কয়েকজনকে ইতিমধ্যেই বন্দী করেছেন। বাকিরাও নিশ্চয় ধরা পড়বে।
সম্রাট মনের ভাব গোপন করে এবার শেষ কথায় এলেন, সেই দস্যুর কী হল? রত্নগুলি উদ্ধারেরই বা কী হল? অনেক দিন তো হয়ে গেল।
জাঙ্ক এবার বেশ দৃঢ় স্বরে বললেন, সম্রাট! আমার বলতে লজ্জা হচ্ছে —তবু বলছি, সমাজ-উৎসবের দিন পর্যন্ত আমায় সময় দিন। যদি এর মধ্যে আমি সব সমস্যার সমাধান করতে না পারি—তাহলে সমাজ-উৎসবের পরের দিনই আমি পদত্যাগ করব। আপনাকে আর কষ্ট করে আমাকে পদত্যাগ করাতে হবে না।
সম্রাটের সঙ্গে উপস্থিত সবাই জাঙ্কের এই দৃঢ় মনোভাবে বিস্মিত হলেন। শুধু সম্রাট প্রশ্ন করলেন, সমাজ-উৎসব পর্যন্ত কেন?
কারণ আছে, সম্রাট। ঐ দিন জনতার মনের আগল খুলে যাবে। আজ যারা মুখ খুলতে চাইছে না সেদিন মদ্যের প্রভাবে এবং খুশির জোয়ারে ভেসে গিয়ে হুড় হুড় করে সব বলে দেবে। আমার জাল ছড়ানো হয়ে গেছে। প্রতিদিন উৎসব কেন্দ্রে আমার সাদা পোশাকের প্রহরীরা ঘুরে বেড়াবে…সে বিস্তৃত ব্যাপার। সম্রাট যখন এতদিন আমার অপদার্থতা সহ্য করেছেন—তখন এই কটা দিনের সময় আমায় ভিক্ষা দিন। এটিই আমার শেষ সুযোগ…!
সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন অবাক হয়ে। জাঙ্ককে তাঁরা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। জাঙ্ক কি সত্যিই স্বইচ্ছায় অপদার্থতার গ্লানি নিয়ে পদত্যাগ করবে? বাধ্য তো সে হবেই, কারণ নিজেই সে অপরাধী।
সভায় নিস্তব্ধতা ঘনাল।
সম্রাট যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, উত্তম। তাই হোক। তুমি এবার আসতে পার।
জাষ্ক বিদায় নিলে সম্রাট বললেন, তোমরা কি কিছু বুঝতে পারলে?
গুণবর্ধন আর নীলাকার বললেন, না সম্রাট। এটা যদি জাঙ্কের অভিনয় হয়—তবে সে সফল অভিনয় করেছে।
মহামিশ্র! তোমার কী অভিমত!
মহামিশ্র বললেন, সম্রাট! জাঙ্কের আচরণ রহস্যময়! আমি বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। কিন্তু তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য আমাদের সমাজ-উৎসব পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর গতি নেই। তবে আমাদের সব দিক দিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। আপাতত আমি একথাটুকুই বলতে পারি।
সম্রাট বললেন, তোমার অনুমান সত্য, মহামিশ্র। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে এই কথাই বলছে। নীলাকার…? গুণবর্ধন?
নীলাকার আর গুণবর্ধন বললেন, সম্রাট! অস্বীকার করব না যে আমরা একটু বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, জাঙ্ক সময় ক্রয় করতে চাইছে। কেন? হয় সে দেশত্যাগ করে পূর্বাঞ্চলে বা দক্ষিণাঞ্চলে পালাবার মনস্থির করেছে—আর না হয় এর মধ্যে সে কোন অশান্তির পরিকল্পনা করেছে। জাঙ্কের প্রতিশ্রুতি যদি সত্য হয় তবে আমাদের তেমন কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু অসত্য হলে—আমরা অপ্রস্তুত থাকলে সমূহ বিপদ! আমাদের আজ থেকেই সমস্ত রকম প্রস্তুতি গড়ে তুলতে হবে। জাঙ্কের কথায় এক রহস্যময়তা রয়েছে।
সম্রাটের কপালে আবার বিন্দু বিন্দু স্বেদ দেখা দিল। উৎকণ্ঠিত মহামিশ্র বললেন, সম্রাট! আরও একটু জলপান করে আপনি বিশ্রাম নিতে চলুন!
মৃদু কণ্ঠে সম্রাট বললেন, একটু অপেক্ষা কর। জল দাও। জলপান করে সম্রাট একটু সুস্থ বোধ করলেন।—সেই বিষ্ক আর ভট্টরাই কোথায়? তাদের সমস্যাটা মিটিয়ে দিই।
সেই মুহূর্তে দ্বাররক্ষী আবার ঘোষণা করল, সম্রাট! তোরণ-প্রধান ও উপ-প্রধান আপনার দর্শনের অভিলাষী।
গুণবর্ধন আর নীলাকার বিষ্ক আর ভট্টরাইকে দেখে বিস্মিত হলেন।–এরা!
সম্রাট বললেন, আমি আদেশ করেছি। তোমরা চেন নতুন উপ-তোরণ প্রধানকে?
হ্যাঁ সম্রাট। আপনার আদেশে সম্প্রতি এর পদোন্নতি ঘটানো হয়েছে। এর সম্বন্ধে তোমরা কিছু কি জানো?
সব কিছুই জানি সম্রাট। এর উদ্যোগে আমাদের সাক্ষী বিনাগ বেঁচে গেছে। জনাগও নিশ্চয় বেঁচে যাবে।
এর বিরুদ্ধে তোমাদের বলার মতো কিছু আছে?
না, সম্রাট। এ এক সপ্রতিভ যুবক। কর্মঠ। অস্ত্র দক্ষ। বিশ্বস্ত বলেই মনে করি। কোন বিরুদ্ধ মতামত নেই।
সম্রাট বললেন, আমি একে আগামীকাল থেকেই মহামিশ্রের অধীনে প্রাসাদের এক বিশেষ অধিকর্তা হিসাবে নিয়োগ করতে চাই। মহামিশ্র অধিক চাপে বিব্রত। এই সম্ভাব্য আপৎকালীন অবস্থায় মহামিশ্রের একজন যোগ্য সহকারীর প্রয়োজন।
আমরা তা স্বীকার করি।
সম্রাট এবার বিষ্কের দিকে তাকালেন।—বিষ্ক!
আদেশ করুন সম্রাট!
আমি জানি ভট্টরাই চলে গেলে তোমার অসুবিধা হবে—বিশেষ করে এই মুহূর্তে। তোমরা যৌথভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলে। সেজন্য আমি তোমার ওপর প্রীত। তোমার পদোন্নতি ঘটাবার বিষয়টি মহামিশ্র, গুণবর্ধন আর নীলাকার বিবেচনা করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার প্রশ্ন, ভট্টরাইকে তুমি ছাড়তে পারবে কি না?
সম্রাটের স্বার্থে আমি সব কিছুই ছাড়তে প্রস্তুত। কর্মের অতিরিক্ত বোঝা আমি বহন করতে সম্মত আছি সম্রাট।
সম্রাট বললেন, না। একজনের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানোয় প্রশাসকের হয়ত কিছু কিছু সুবিধা হয়—কিন্তু পরিণাম ভাল হয় না। গুণবর্ধন…!
গুণবর্ধন সম্রাটের বক্তব্য মুহূর্তে বুঝে নিলেন। বললেন, কোন অসুবিধা নেই সম্রাট! আমার বিভাগের পদ্মলোচন বলে এক তরুণকে আমি উপ-প্রধানের পদে পূর্বেই মনোনীত করেছিলাম। কিন্তু আপনার নির্দেশে তা রোধ করতে বাধ্য হই। এখন আমি স্বচ্ছন্দে তাকে বিষ্কের অধীনে পাঠাতে পারি—অবশ্য বিষ্ক যদি তাকে গ্রহণ করতে চায়।
পদ্মলোচনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। চমৎকার তরুণ। তবে…!
তবে কী?
ভট্টরাইয়ের পরিবর্ত হলেও সে ভট্টরাই নয়!
সম্রাট বললেন, আমি দুঃখিত বিষ্ক। কিন্তু তোমাকে….!
বিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, আমাকে ক্ষমা করবেন, সম্রাট। আমায় ভুল বুঝবেন না। আসলে আমি ভট্টরাইয়ের সঙ্গে আত্মীকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম…!
সম্রাট বললেন, তোমায় বুঝতে আমার ভুল হয়নি, বিষ্ক। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে সহকারীদের সঙ্গে এই আত্মীক সম্পর্কেরই প্রয়োজন। তবে এই জগতে কেউ কারোর যথার্থ পরিবর্ত হতে পারে না। ব্যক্তিগত দোষগুণ নিয়েই এক একটি ব্যক্তিগত মানুষ। এ জগতে কোন ধর্ম প্রচারক কি বুদ্ধের পরিবর্ত হতে পারেন? তবু মানুষ অন্যান্য ধর্মগুরুদেরও তো শ্রদ্ধা করেন।
বিষ্ক বললেন, জানি সম্রাট! তাই আপনার মুদ্রায় ভারতীয়-অভারতীয় সব ধর্মগুরুদেরই মূর্তি খোদিত হয়। আমি ধন্য সম্রাট! আপনি হয়ত সম্রাট অশোকের সঠিক পরিবর্ত নন। কিন্তু আপনার কীর্তি-কলাপে আপনি আর এক অশোক হয়ে উঠেছেন। সুদূর বা থেকে কোংকন উপকূল, পূর্বে পাটলিপুত্রের নিকটবর্তী অঞ্চল, এদিকে অমরাবতী—আপনার ছত্রছায়ায়। প্রজারা আপনার প্রতি উৎসর্গীকৃত প্রাণ। আমায় মার্জনা করবেন।
সম্রাট কথা বললেন না। হাত নেড়ে বিষ্ককে প্রশস্তি থেকে বিরত করলেন। তারপর কোন রকমে বললেন, কাল প্রভাতেই ভট্টরাই তোমার দায়িত্ব বুঝে নিও।
সম্রাটের অসুস্থতা এবার সকলের চোখে পড়ল! মহামিশ্র বললেন, আর নয়, সম্রাট! সভা ভঙ্গ হোক। আমরা আছি। আপনি বিশ্রাম নেবেন চলুন।
গুণবর্ধন আর নীলাকারও বলে উঠলেন, হ্যাঁ সম্রাট। আপনি বিশ্রাম নিন।
সম্রাট অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মথুরা থেকে এক গুপ্তচরের আগমনে তিনি বসে পড়লেন, কী সংবাদ?
গুপ্তচরটি অভিবাদন জানিয়ে বলল, সম্রাট! সংবাদটি অশুভ হলেও বর্তমানে তত অশুভ নয়।
মহামিশ্র কঠোর গলায় বললেন, ভণিতা রেখে স্পষ্ট করে বল।
গূঢ়পুরুষটি বলল, মথুরায় নাগ-বংশীয়েরা এক উত্থানের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে! যুবরাজ বাসিষ্ক তাদের সফলভাবে দমন করেছেন। কিন্তু তিনি আহত হয়েছিলেন। তবে…!
কণিষ্ক একটি চাপা আর্তনাদ করে বাম বুক চেপে ধরলেন।
গুপ্তচরটি ভীত হয়ে দ্রুত বলল, বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন ১৩৮
সম্রাটের কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মহামিশ্র চিৎকার করে পরিচারকদের ডাক দিলেন। শিঘ্র এস!
সম্রাট অসুস্থ হবার পূর্ব মুহূর্তে বিষ্ক সভাকক্ষ ছেড়ে নগর-তোরণের দিকে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু ভট্টরাই পরিচিত একজনকে দেখে কথা জুড়েছিল। মহামিশ্রের চিৎকারে সেও ভেতরে ছুটে এল। ভন্তে মহামিশ্র…!
মহামিশ্র তখন গূঢ়পুরুষটির সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, তুমি সম্রাটের অসুস্থতার কথা কারোর কাছে প্রকাশ করবে না। এমনকি যুবরাজের কাছেও নয়। যাও। বিশ্রামাগারে যাও।
এবার মহামিশ্র দ্রুত ভট্টরাইয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।—ভট্টরাই! তুমি তোমার অশ্ব নিয়ে দ্রুত আচার্য চরকের কাছে ছুটে যাও। তিনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন তাঁকে নিয়ে এস। বলবে সম্রাট বামবক্ষে বেদনা অনুভব করছেন —হয়ত হৃৎপিন্ডের কোন ব্যাধি! সম্রাট জ্ঞান হারিয়েছেন।
পরিচারকরা সম্রাটকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। গুণবর্ধন আর নীলাকার তখনও কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মহামিশ্র বললেন, আপনারা আপনাদের কর্মস্থলে ফিরে যান। আমি আচার্য চরককে আনতে পাঠিয়েছি। আমি যোগাযোগ রাখব। আর হ্যাঁ, ভন্তে নীলাকার। মথুরার গূঢ়পুরুষটির দিকে লক্ষ রাখবেন সে যেন কোনও ক্রমেই সম্রাটের অসুস্থতার কথা কারোর কাছে প্রকাশ না করে। দ্বিতীয়ত, পরিচারকদের মধ্যে দু একজন যারা প্রাসাদের বাইরে থাকে—তাদের গৃহে ফেরা আজ স্থগিত থাকবে। আমার কার্যালয়ের করণীকদের কাছ থেকে তাদের বাসস্থান জেনে নিয়ে তাদের গৃহে সংবাদ পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। কারণ, একটা কিছু দেখিয়ে দেবেন। সম্রাটের শারীরিক পরিস্থিতি যথার্থ কী তা না জানা পর্যন্ত সম্রাটের অসুস্থ হয়ে পড়ার সংবাদটি গোপন থাকাই ভাল বলে আমি বিবেচনা করি।
গুণবর্ধন আর নীলাকার বললেন, যথার্থ।
গুণবর্ধন চলে গেলে নীলাকার কার্যালয়ের করণিকদের সন্ধানে এগোলেন। মহামিশ্র দোতলায় সম্রাটের কাছে যাবার জন্য সিঁড়িতে পা রাখলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন