কণিষ্ক – ৫

অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

রাতে শয্যায় শুয়েছিল কমলিকা। পাশের শয্যায় আচার্য চরকের স্ত্রী। ঠাণ্ডা বাতাস আসছিল। ঘুমিয়ে পড়ার কথা কমলিকার। কিন্তু তার ঘুম আসছিল না। জীবনের বিপর্যয়ের ইতিবৃত্ত রোমন্থন করছিল সে। ভাবছিল চন্দ্রভাগার তীরে সেই সুন্দর নগরের কথা। সেখানকার মানুষজন—বাবা—মা—এক সুন্দর জীবনের কথা। গৃহে নৃত্য—গীত—অঙ্কনের চর্চা। চোখে যৌবনের স্বপ্ন। একজন পুরুষ চাই জীবনে। কিন্তু সে কেমন পুরুষ হবে? তার প্রিয় পুরুষের আকার—ব্যক্তিত্ব তখনও তার কাছে ঝাপসা। ছায়ার মত ভেসে উঠত এক বীরপুরুষের মূর্তি। তার বাবার পছন্দমত কোনও বণিক-সামন্ত সমাজের গোলগাল পাত্রকে তার পছন্দ হয়নি। নানা অছিলায় বাতিল করে দিচ্ছিল। বীরপুরুষের কথা চিন্তা করতে করতে ভট্টরাইয়ের মূর্তি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সুন্দর যুবা। পাথর কঠিন অবয়ব। কোমরে তলোয়ার। হাতে শাঙ্গধনু। প্রভাতের অরুণ আলোয় চকিতে তাকে দেখেই যেন সে আশ্বস্ত বোধ করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাকে তিরবিদ্ধ হতে হয়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে আততায়ীদের হত্যা করে সে তাকে দ্বিতীয়বার তিরবিদ্ধ হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। এখানেই ভট্টরাই তাকে আজীবন কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছে। কিন্তু বিধাতার কী পরিহাস! তাদের দুজনের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান! মহামিশ্র বললেন, সে নাকি রাজরানি হওয়ার যোগ্য। তাই যদি হয় তবে ভট্টরাইয়ের কুঁড়ে ঘরে তার স্থান কেমন করে হবে? ভট্টরাই আজ নিয়ে দ্বিতীয় দিন তার সঙ্গে দেখা করতে এল। প্রথম দিনের দেখার পরও সে তার কথা ক্রমাগত ভেবেছে। কেন ভেবেছে? কেনই বা দেখা করতে এল? তার অলংকারের লোভে? মনে হয় না। অন্যদিকে সেই বা কেন প্রতিদিন ভট্টরাইয়ের পথ দেখেছে? কমলিকা নিজেকে সাবধান করল। তার জীবনে ভট্টরাইকে মহামিশ্র নিশ্চয় মেনে নেবেন না। বলতে গেলে এই নগরে তিনিই তার অভিভাবক। অন্তত ক্ষমতার জোরে তাঁর অভিভাবক সেজে বসার বিরুদ্ধে কোন বাধা নেই। মহামিশ্র কণিষ্ক সাম্রাজ্যে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। সুতরাং, তার কি উচিত নয় ভট্টরাইকে সাবধান করে দেওয়া? তাকে কামনা করে সে যেন নিজেকে বিপদের মধ্যে জড়িয়ে না ফেলে। কিন্তু নিষেধই বা সে করবে কী ভাবে? ভট্টরাইকে যথেষ্ট সংযমী বলে মনে হয়। সে এমন কিছু প্রকাশ করেনি যে তাকে সাবধান করতে হবে। তাছাড়া সে নিজে কী করে অস্বীকার করবে যে ভট্টরাইয়ের বীরমূর্তি তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছে! তবু তাকেও কঠোর ভাবে নিজের শিথিলতা বর্জন করতে হবে। ভট্টরাইয়ের জীবন তার ছায়াপাতে নষ্ট হয়ে যাক এ সে চায় না। মনকে শাসন করার চেষ্টা করল কমলিকা। ভট্টরাইকে দেখা না করার জন্য সে বলে দেবে। এতে দুজনেরই কল্যাণ হবে। প্রাথমিক স্তরেই যদি বিষয়টি থেমে যায় তাহলে ভবিষ্যতে কেউ কষ্ট পাবে না।

শয্যায় শুয়ে কমলিকার ঘনঘন পাশ পরিবর্তন লক্ষ করছিলেন চরক-গৃহিণী। আজ ভট্টরাই চলে যাবার পর থেকেই কমলিকার ভাবান্তর তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চরক-গৃহিণী আজ বৃদ্ধা সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনিও একদিন না একদিন যৌবনবতী নারী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি একদিন কামনা-বাসনার স্তর পার করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তাই তিনি কমলিকাকে বুঝতে পারছিলেন। তিনি কোমল স্বরে বললেন, “কমলিকা! ঘুম আসছে না? মন স্থির কর মা। জীবনে চলার পথ বড় নিঃসঙ্গ—কঠিন। এখানে নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই চঞ্চল হলে চলে না। যাও। যাও, দাওয়ায় গিয়ে ঘাড়ে, কানে, মুখে জল দিয়ে এস। একটু ঠাণ্ডা হবে। ঘুম এসে যাবে।”

কমলিকা বিতর্কে গেল না। উপদেশ মতো বাইরে গেল। নিদ্ৰা আসুক, সেও তা চাইছিল মনপ্রাণে।

.

বেশ কদিন গড়িয়ে গেল। ভট্টরাই আর এল না। প্রথমটায় ভাল হয়েছে ভাবলেও শেষের দিকে যেন একটু উতলা হয়ে পড়ল কমলিকা। তার অহংবোধে কোথায় যেন এক সূক্ষ্ম আঘাত লাগল। শেষপর্যন্ত সে ভট্টরাইয়ের ওপর মনে মনে রেগে উঠল। সে যে অবকাশ পায়নি একথাটা তো সে কোন রকমে জানিয়ে যেতেও পারত! উদ্বোধন উৎসবে আজ যোগ দেবে কিনা তাও জানা গেল না। এক প্রচ্ছন্ন অভিমান গ্রাস করল তাকে। উৎসবে যাওয়াটাই তার কাছে বিড়ম্বনাময় হয়ে উঠল। তবু তাকে যেতে হবে। আজই উদ্বোধন উৎসব! মহামিশ্র বলে গেছেন সেদিন—মহাবিহারের উদ্বোধনের সময় তিনি সম্রাটের সঙ্গে সুযোগ বুঝে পরিচয় করিয়ে দেবেন।

আচার্য চরক তাড়া দিলেন, “কই মা! হল!”

সাধারণ ভাবেই সাজসজ্জা শেষ করে কমলিকা বেরিয়ে এল আঙিনায়। ঐ সাধারণ সজ্জাতেই—রত্নালংকারে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সে। আচার্যও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “না! মহামিশ্র যথার্থই বলেছেন, তুমি রাজরানি হওয়ার যোগ্য।” চরক-গৃহিণী কমলিকার থুতনি ধরে আদর করে চুমু খেলেন।—”যাও, মা। আশীর্বাদ করি তুমি তোমার অভিলাষে সফল হও।”

আচার্য আর কমলিকা এগিয়ে গিয়ে আশ্রমের অশ্ব-শকটটিতে উঠলেন।

চরক চালককে বললেন, “চল।”

আজ সারা নগর যেন মহাবিহার মুখি। দূর থেকেই সুউচ্চ স্তুপটি চোখে পড়ছিল। বিস্ময়ের সঙ্গে কমলিকা বলল, “ইস! কী বিশাল স্তুপ!”

চরক বললেন, “যুগযুগান্তর ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে সম্রাট কণিষ্কের এই মহাস্তুপ। ধন্য সম্রাট কণিষ্ক।” একটু থেমে চরক বললেন, “মহামিশ্র আজ তোমার সঙ্গে সম্রাটের পরিচয় করিয়ে দেবেন বলে বলেছেন। কিন্তু এই ব্যস্ততার দিনে—এই ভিড়ে তা কতদূর সম্ভব হবে কে জানে! তবে, মহামিশ্র কথার মানুষ। দেখ কী হয়। রাজপ্রাসাদে যদি সম্মানজনক কোন কাজ তিনি তোমাকে দিতে পারেন! রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তার মধ্যেই তোমার থাকাটা ভাল। বাইরে তোমার একাকী নির্ভয়ে বসবাস করাটা কঠিন। তাছাড়া তোমাকে রাজপ্রাসাদেই মানায়। রাজসিক সুখেই তুমি অভ্যস্ত।”

কমলিকা বলতে চাইল “কেন? আপনার আশ্রমে কি আমি মানিয়ে নিতে পারিনি? মেয়েরা সব পারে। আপনার ওখানেই যদি কোনও কর্ম পেতাম!” পরক্ষণেই সে ভাবল, “সে আশ্রয় তো ক্ষণিকের হোত। আচার্যকে তার বিয়ের ব্যবস্থা তো করতেই হোত। চিরটা কাল সে ওখানে থাকবার সুযোগ পেত না। তাছাড়া তার মতো রূপসীর ঐখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করাটাও ঠিক হোত না। আচার্যের যুবা শিষ্যেরা রয়েছে। তারা যে প্রলুব্ধ হবে না এমন কথা কে বলতে পারে?”

মহাবিহারের দ্বারের কাছাকাছি কমলিকাদের শকটটি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু অজস্র শকটের ভিড় দেখে কমলিকা বলল, “এই শকট-অরণ্যে আমাদের শকট কোথায় থাকবে, আচার্য? পরে খুঁজে পাওয়া যাবে তো?”

আচার্য বলল, “চিন্তা কোর না। দেখ, দ্বারে জাঙ্ক রয়েছে। আমাদের মতো অতিথিদের শকট রাখার স্থান নিশ্চয় পৃথক হবে। দেখই না।”

মূল প্রবেশদ্বারে প্রহরীদের সঙ্গে সত্যই জাঙ্ক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বিশিষ্ট কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক অভ্যাগতরা এবং সম্রাট এ পথেই প্রবেশ করবেন। আচার্য আর কমলিকাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন জাঙ্ক। তাঁর মুখে হাসি এক বিরল ঘটনা। হয়ত কমলিকাকে দেখে আর নয়ত সম্রাটের বিশিষ্ট সভাসদ এবং মহামিশ্রের আত্মীয়জ্ঞানে এই সৌভাগ্য।——”স্বাগত আচার্য! স্বাগত মণিকার পুত্রী!”

কমলিকা জাঙ্কের দৃষ্টিতে একটু অস্বস্তি বোধ করল। তাঁর দৃষ্টি কমলিকার কণ্ঠের মণিহারটির দিকে।

শকট থেকে নামামাত্র জাঙ্ক চালককে একটি নির্দিষ্ট স্থান দেখিয়ে দিয়ে বলল, “শকটটি ঐখানে রাখ। ফেরার পথে আচার্য ঐ স্থানে উপস্থিত হয়ে তোমায় খুঁজে নেবে বা তুমি তাঁকে খুঁজে নেবে।” তারপরেই সে বিগলিত হয়ে কমলিকাকে বলল, “মণিকার পুত্রী! চিন্তা করবেন না। এই নগরাধ্যক্ষের ওপর আস্থা রাখুন। আপনার রত্নপেটিকা আমি উদ্ধার করে দোবই। আপনার পিতামাতার হত্যাকারী দুজন দুর্বৃত্ত তো ইতিমধ্যেই ভট্টরাইয়ের হাতে দন্ড লাভ করেছে। তৃতীয়জনকে আমি খুঁজছি দন্ড দেবার জন্য। সামান্য এক দস্যু ঐ বিপুল ধনভোগ করবে—তা হতেই পারে না। আমি কিসের জন্য আছি?”

জাঙ্কের দৃষ্টির মধ্যে কমিলকা এক লোলুপতার আভাস পেল—তা তার সৌন্দর্যের জন্য নাকি রত্নালংকারগুলির জন্য—সে বুঝে উঠতে পারল না। তবে কমলিকা জানে যতক্ষণ সে আচার্য চরকের আশ্রয়ে আছে ততক্ষণ কোন বিপদ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। তাই কৃত্রিম হাসি হেসে সে বলল, “আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। আপনার আশ্বাসে বুক বাঁধছি। তৃতীয়জন যদি ধরা পড়ে আর আমার পেটিকাটি যদি উদ্ধার হয়—তবে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।”

স্থপতি এজিসিলাওসের শকটটিকে আসতে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জাঙ্ক।———”আপনারা এগোন। আমি যবন স্থপতিটিকে একটু দেখি।”

কমলিকা আচার্যের সঙ্গে পাথর-বাঁধানো পথে বিহারের দিকে এগিয়ে গেল। পথের দু-ধারে ছাঁটা ঝোপ। ফুলের গাছ।

মহামিশ্র পথিমধ্যে বোধহয় তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বললেন, “আচার্য! সম্রাটের আসার সময় হয়ে গেছে। আপনারা ভিতরে গিয়ে আসুন গ্রহণ করুন। আর হ্যাঁ। পিছন দিকে বসবেন যাতে সভাভঙ্গ হলে আপনারা দ্রুত বেরিয়ে এসে এই স্থানটিতেই অপেক্ষা করতে পারেন। সভাগৃহে সম্রাটের সঙ্গে কমলিকার পরিচয় করিয়ে দেবার সুযোগ কম। ফেরার পথেই তা হতে পারে। বিশদ কথাবার্তা আমি প্রাসাদে গিয়েই বলব।”

চরক বললেন, “তাই হবে। আমরা তবে এগোই।”

মহামিশ্র দ্রুত প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে গেলেন। সম্রাটের নামে জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। অর্থাৎ সম্রাট এসে গেছেন।

কমলিকা ভট্টরাইয়ের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকিয়ে চরককে অনুসরণ করল।——কিন্তু ভট্টরাই কোথায়? এ জনসমুদ্রে কোথায় তাকে পাবে? সে এসেছে কিনা তাই নিয়ে সংশয়। হয়ত বিশ্রাম পায়নি।

চরক লক্ষ করছিলেন কমলিকাকে। এক সময়ে তিনি বললেন, “মা, তোমাকে একটা কথা বলব—যদি কিছু মনে না কর।”

“না—না। বলুন না।”

“তুমি কি ভট্টরাইকে খুঁজছ?”

সলজ্জ ভাবে কমলিকা বলল, “হ্যাঁ—না।”

“আমি জানি। তোমার কল্যাণের জন্য একটি কথা বলি, মনে রেখ। তুমি আর ভট্টরাই সমবয়েসি বলে আমার বিশ্বাস। সে তোমার বন্ধু হতে পারে—কিন্তু ভবিষ্যতে পতি কখনই নয়। আমি তার প্রতি কোনও রকমের অসূয়াপরায়ণ হয়ে কথা বলছি না। তাকেও আমি স্নেহ করি। সে ভদ্র। আচার-পরায়ণ। সুদর্শন। সব গুণই তার রয়েছে। সে তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সুতরাং, তার বিরুদ্ধে আমার বলার মতো কিছু নেই। কিন্তু তোমাদের মধ্যে অন্তর রয়েছে। তুমি উচ্চকুলজাতা। রূপসী। তোমার মধ্যে বিশাল এক সম্ভাবনা। রাজপ্রাসাদই তোমার উপযুক্ত স্থান। ভট্টরাইয়ের কুঁড়ে ঘর নয়। আমার বিশ্বাস মহামিশ্র নিশ্চয় তোমাকে রাজপ্রাসাদে এক সন্মানীয় স্থান করে দেবেন। সম্রাট বিপত্নীক এবং রমণী রসিকও নন। তবু জীবনে আশ্চর্য কিছু ঘটনা ঘটে। কে বলতে পারে, তোমার আকর্ষণই সম্রাটকে আবার সংসারমুখী করে তুলবে না? তোমার মধ্যে সম্ভাবনা রয়েছে কুষাণ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হওয়ার।” এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

কমলিকা একটু দমে গেল। সে বুঝতে পারল, তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আচার্য ভট্টরাইকে দূরে রাখতে বলছেন। এ বিষয়ে আচার্যকে দোষ দেওয়া যায় না। তিনি তার কল্যাণ কামনাই করছেন।

ভট্টরাই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসবে না—আসবে না চিন্তা করেও শেষপর্যন্ত এক দুর্মদ আকর্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছিল। কমলিকার দেহের বিকরিত ঘ্রাণ—তার সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা শত চেষ্টা করেও সে মন থেকে দূর করতে পারেনি। যদিও সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন। তবু এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়ে যাওয়াতে সে কমলিকাকে জানিয়ে আসার সুযোগ পায়নি। জনারণ্যে খোঁজাখুজির পর সে কমলিকাকে আবিষ্কার করল। কিন্তু আচার্যের পাশে নীরব-নিষ্পন্দ হয়ে তাকে বসে থাকতে দেখে হতাশ হল। সে আশা করেছিল যে কমলিকাও তাকে উদ্‌গ্রীব হয়ে খুঁজবে। তাই সে আশাহত হল। নক্ষত্রদের সারিতে কমলিকাকে অচঞ্চল হয়ে বসে থাকতে দেখে এক অভিমানবোধে আচ্ছন্ন হয়ে সে ধীর পায়ে সভাগৃহের বাইরে চলে গেল। সামনেই উদ্যান। উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে সে সেদিকেই হাঁটল। তারপর একটি আচ্ছাদনের নীচে বসে পড়ল।

ভট্টরাই দেখল সম্রাট সভাগৃহে প্রবেশ করছেন। সৌজন্য প্রদর্শনের জন্য সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তাকে একাকী শূন্য উদ্যানে ওরকম ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকে অবাকও হল। ভট্টরাই মনে মনে বলল, “আমি সম্রাটকে দেখতে আসিনি। বুদ্ধবাণীও শুনতে আসিনি। আমি এসেছিলাম কমলিকাকে দেখতে। না। তাদের মধ্যে কোনও সম্বন্ধ গড়ে ওঠেনি ঠিকই। কিন্তু, কমলিকার কাছে ছুটে আসতে তার ভাল লাগে। ভাল লাগে তার সান্নিধ্য। কমলিকারও নিশ্চয় লাগে। কিন্তু আজ সে ওরকম নিষ্পন্দ কেন?”

সভাগৃহে সম্রাটের নামে প্রচুর জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। ভট্টরাই কোন আকর্ষণ বোধ না করে চুপচাপ বসে পড়ল। যাবার সময় কি একবারও অন্তত চোখে চোখ মিলবে না?

.

সম্রাটকে এই প্রথম দেখল কমলিকা। দীর্ঘদেহী। শালপ্রাংশু চেহারা। কোমরে দীর্ঘ তলোয়ার। মাথায় স্বর্ণখচিত উষ্ণীষ। বলিষ্ঠ বাহু। এই বাহুতেই কত শত্রু নিধন করেছেন তিনি। সেই বাহুর শক্তিতে তিনি ভারত-বহির্ভারতের এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। কঠিন ব্যক্তিত্বময় মুখায়ব। দীপ্ত পদক্ষেপ। এক মুহূর্তেই যেন অভিভূত হয়ে পড়ল সে।—মধ্য বয়সী। হোক। এখনও তিনি বলিষ্ঠ। শত্রুদমনে সক্ষম। এই তো তার স্বপ্নের পুরুষ!

মঞ্চের ওপর সম্রাটকে ঘিরে রয়েছেন প্রখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিতেরা। রয়েছেন অশ্বঘোষ, সংঘরক্ষিত, বসুমিত্র, নাগার্জুন আদি নানান জন। বিশাল সভাগৃহ তাঁদের এবং সম্রাট কণিষ্কের উপস্থিতিতে যেন ঝলমল করছিল। দেওয়াল গাত্রে গান্ধার শিল্পীদের আঁকা—খচিত বুদ্ধজীবন কথা। রঙে—শিল্প সুষমায় তা সমুজ্জ্বল।

বক্তৃতাপর্ব শুরু হল। অশ্বঘোষ উঠে দাঁড়ালেন। উপস্থিত সবাইকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, “বুদ্ধের কাল প্রায় পাঁচশত বছর হল। কিন্তু আজও তিনি জীবন্ত। মানবমুক্তির প্রতীক। তাঁর প্রিয়তম শিষ্য আনন্দ মৃত্যুকালে তাঁর মূর্তিপূজার অনুমতি চেয়েছিলেন। বুদ্ধ আনন্দকে নিরাশ করে বলেছিলেন, না, আনন্দ। তার প্রয়োজন নেই। প্রতিটি মানুষ এক একটি স্বতন্ত্র দ্বীপ। আমি তোমাদের সুত্ত পিটক, বিনয় পিটক আর অভিধর্ম পিটক দিয়েছি। জানিয়েছি অষ্টমার্গের পথ। স্বতন্ত্রভাবে সাধনা করে নির্বাণ লাভ কর। আমার মূর্তিপূজার কোনও প্রয়োজন নেই। এর থেকে বোঝা যায়, বুদ্ধের ধর্মীয় নেতা বা ধর্মগুরু সাজার কোনও আকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি মূর্তির মধ্যে নয়, মানুষের মনের মধ্যে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, প্রতিটি মানুষ সৎ জীবন ধারণ করে পুনর্জন্মের দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে মুক্ত হোক—নির্বাণ লাভ করুক। বুদ্ধের থেকে বড় মনুষ্যপ্রেমী আর কে হতে পারে?”

“বুদ্ধের জীবিত কালে তাঁর ধর্ম স্বল্প পরিসরে আবদ্ধ ছিল। রাজগৃহ, মল্লরাজ্য, বৈশালী, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, প্রভৃতি কয়েকটি রাজ্যে সীমিত জনের মধ্যেই তা আটকা পড়েছিল। সম্রাট অশোক এসে সেই দ্বার খুলে দিলেন। সাগর অতিক্রম করল সেই মানবধর্ম। এরপর এসেছেন সম্রাট কণিষ্ক! তিনি সেই ধর্মকে ছড়িয়ে দিলেন বিশ্বে! হিমালয়ের ক্রোড়ের রাজ্যগুলি থেকে তা ক্রমশ হিন্দুকুশ অতিক্রম করে চিন থেকে শুরু করে আরও বিস্তৃত আঙিনায় ছড়িয়ে গেল। ধর্মহীন মানুষ ধর্ম কী তা জানল। তারা বিবেকবান হয়ে উঠল। এখানে একটি বিষয় রয়েছে। ব্রহ্মবাদ বা একেশ্বরের বোধ ভারতবাসীর কাছে পরিচিত হলেও অভারতীয়দের কাছে তা সম্পূর্ণ নতুন। যে ধর্মচেতনা ভারতীয়দের কাছে স্বাভাবিক—বর্হিভারতীয়দের কাছে তা স্বাভাবিক ছিল না। বুদ্ধের ভাষা ছিল দেশজ ভাষা, দেশীয় মানুষ সহজেই তা গ্রহণ করতে পেরেছে। কিন্তু বিদেশীদের কাছে সে ভাষা দুর্বোধ্য। তবু কুষাণ সাম্রাজ্যের কল্যাণে তা কিছু পরিমাণে বোধগম্য হয়েছে। সম্রাট কণিষ্ক কিন্তু এখানে থেমে থাকেননি। তিনি জানেন শিক্ষার পক্ষে মাতৃভাষাই সবচেয়ে উপযুক্ত। তাই দীর্ঘদিন হল তিনি আমাদেরই দুই বৌদ্ধ পন্ডিত কাশ্যপ মাতঙ্গ আর ধর্মরক্ষককে চিন দেশে পাঠিয়েছেন। তাঁরা চিনভাষা আয়ত্ত করে ত্রিপিটক চিনা ভাষায় অনুবাদ করার কাজে ব্যস্ত!”

একটু হেসে অশ্বঘোষ বললেন, “ভগবান বুদ্ধ বলতেন, প্রথম প্রহরের দীপ শিখার সঙ্গে শেষ প্রহরের দীপশিখার অন্তর রয়েছে। ঠিক সেই রকম ভাবেই ধর্মও বিবর্তিত হয়। জন্মলগ্নে বুদ্ধ যা বলেছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত তা লিখিত না হওয়ার জন্য এই দীর্ঘ পাঁচশত বছরে বৌদ্ধধর্মও কালের নিয়ম অনুসারে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে। নানান কিংবদন্তী, নানান ধ্যানধারণা, নানান নতুন নতুন আচার আচরণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের ধর্ম পরিবর্ধিত হয়েছে। সনাতন ধর্মীরাও এই পরিবর্তনের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। বেদ ছিল মৌখিক। পরে লিপিবদ্ধ হয়। সুতরাং তাদের আদি ভাবনা-চিন্তাও যে উত্তরকালে পরিবর্তিত হয়নি একথা জোরের সঙ্গে বলতে পারেন না। স্মৃতির বিভ্রম ঘটাটা স্বাভাবিক। যাহোক সনাতনধর্মীদেরও একদা নিরাকার ব্রহ্মকে ধ্যান করা—অনুভব করা কঠিন হয়ে উঠেছিল—বিশেষ করে সাধারণ মানুষদের কাছে। তাই তাদের মধ্যে মূর্তিপূজা ক্রমে প্রচলিত হয়েছে। আজ আমরা নানান জীব এবং প্রাকৃতিক প্রতীককে বুদ্ধজ্ঞানে পূজা করি। কারণ বুদ্ধের কোনও মূর্তি নেই। আমরা জানিনা তিনি ঠিক কেমন দেখতে ছিলেন। সাধারণ মানুষ তাঁর পূজা করতে মানসিকভাবে অসুবিধা বোধ করছেন। তাই কালের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে বুদ্ধের একটি মূর্তি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। আজ যদি বুদ্ধের বা বোধিসত্ত্বের একটি মূর্তি আমাদের চোখের সামনে থাকত তাহলে বুদ্ধকে অনুভব করাটা কি সহজসাধ্য হোত না?”

প্রায় সবাই অশ্বঘোষকে সমর্থন জানাল।—”হ্যাঁ। বুদ্ধের একটি মূর্তি থাকলে আমাদের বুদ্ধকে উপলব্ধি করতে সুবিধা হয়।”

অশ্বঘোষ বললেন, “এ বিষয়ে আমরা ভাবনা-চিন্তা করছি। মহাপুরুষদের দেহ লক্ষণ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট বুদ্ধরূপ আমাদের স্থির করতে হবে। নচেৎ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি আমাদের সুবিধার চেয়ে অসুবিধারই সৃষ্টি করবে। এই সমস্যা এবং কয়েকটি ধর্মীয় সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা একটি সংহতি সভার আয়োজন করতে চলেছি সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায়। সুতরাং আপনাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।”

শ্রোতারা বলল, “আমরা অপেক্ষা করব আপনাদের সিদ্ধান্তের জন্য। বোধিসত্ত্বের এবং বুদ্ধের মূর্তি আমাদের প্রয়োজন।”

অশ্বঘোষ তাঁর বক্তব্য শেষ করে বসে পড়লেন। বসুমিত্র উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন।—”এবার কুষাণ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠতম পুরুষ–সম্রাট কণিষ্ক তাঁর বক্তব্য রাখবেন।”

সম্রাট কণিষ্ক উঠে দাঁড়ালেন। চতুর্দিকে এক নীরবতা ঘনাল। গম্ভীর গলায় বললেন, “আমার প্রিয় প্রজাকুল—আপনারা আজ এই পবিত্র উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছেন দেখে একজন বুদ্ধপ্রেমী হিসাবে আমি যথেষ্ট আনন্দিত হয়েছি। যাহোক, যখন আমাকে কুষাণ-শ্রেষ্ঠ বলে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে তখন আমি অন্যান্য কুষাণ নায়কদের উল্লেখ করে কয়েকটি কথাও জানাতে চাই। এই ভারতবর্ষে বহু বিদেশী জাতিই হিন্দুকুশ পর্বতমালা পার হয়ে ঢুকেছিল। যেমন এসেছিল পারসিকরা বা তাদের পরে যবনরা। কালের অমোঘ নিয়মে তাদের হটে যেতে হয়েছে। নতুন শক্তি তাদের স্থান অধিকার করেছে। চিন দেশের অন্তর্গত কান-সু ও নিং-শিয়া প্রদেশের তৃণভূমি অঞ্চলে অন্যান্য নানান উপজাতিদের মধ্যে ইউ-চি নামেও একটি জাতি ছিল। অন্যান্য উপজাতিদের তাড়নায় আমরা পিছু হটতে হটতে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হই অক্ষু নদীর উপত্যকা অঞ্চলে। এরপর প্রায় শতাধিক বৎসর আমরা শান্তিতে বসবাস করবার সুযোগ পাই। ফলে আমাদের বিবর্তন ঘটে। আমরা পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ি। এদের মধ্যে কুষাণরা হয়ে উঠেছিল শক্তিশালী। সম্রাট প্রথম কুজল কদফিস অন্যান্য চারটি শাখাকে একত্রিত করে সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেন। শক, পহ্লবদের দমন করে কুজল কদফিস হিন্দুকুশ পার হয়ে ভারতবর্ষে পা রাখেন। এখানেও শক, পহ্লবদের সব খন্ড খন্ড রাজ্য অধিকার করে তাদের সামন্তে পরিণত করেন। স্থাপিত হয় একদা যবন অধিকৃত বা থেকে পঞ্চসিন্ধুর তীর অবধি এক বিশাল সাম্রাজ্য। অন্যদিকে আমি—কুষাণ গোষ্ঠীর অন্য এক নেতা খোটান, কাশগড় ও ইয়ারকন্দ অভিযানে বেরিয়ে চিনাদের পরাজিত করি এবং সন্ধির শর্তানুসারে সম্রাটের এক পুত্রকে প্রতিভূ হিসাবে বল্বের মহাক্ষত্রপ বা প্রশাসকের অধীনে রাখি। অতঃপর আমি পামির মালভূমি পেরিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকে পড়ি। ক্রমে অধিকার করি কশ্যপপুরা থেকে মথুরা-বারাণসী পর্যন্ত অঞ্চল। দুটি কুষাণ রাজ্য সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে। আমরা মধ্য এশিয়ার মানুষ। আমাদের মধ্যে তখনও সেরকম ভাবে কোনও ধর্মীয় চেতনা গড়ে ওঠেনি—যদিও অক্ষু নদীর উপত্যকায় শত বৎসরে আমাদের মধ্যে বিশাল পরিবর্তন ঘটে যায়। আমরা বর্বর যাযাবর জীবন ত্যাগ করে কৃষিজীবি হয়ে উঠি। আমাদের আগে পারস্য সম্রাটেরা এবং যবন গ্রিকেরা এ দেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করলেও তারা এদেশকে ভালবাসেনি। এদেশের শিল্প-সংস্কৃতিকেও গ্রহণ করেনি। এর একটা কারণ অবশ্যই ছিল। সেটা হচ্ছে, তাদেরও একটি প্রাচীন সমাজ-সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু আমাদের তো কিছুই ছিল না। ফলে, আমরা ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতিকে সহজেই গ্রহণ করতে পেরেছিলাম। আবার যেহেতু আমরা আমাদের পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে যে কোন দেশকে আঁকড়ে ধরছিলাম সেই মানসিক অবস্থায় ভারতবর্ষকেও আঁকড়ে ধরা আমাদের পক্ষে অসুবিধাজনক হয়নি। আমরা ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হলাম। যাহোক, আমাদের গোষ্ঠীপতি প্রথম কুজুল কদফিসকে এদেশের স্থায়ী অধিবাসী হতে দেখে এবং তাঁকে সনাতনধর্মীদের শৈবধর্মে দীক্ষিত হতে দেখে অদ্ভুত লাগলেও, আশ্চর্য হইনি। ধর্মীয় চেতনা তখনও আমার উপলব্ধির বাইরে। এদিকে প্রথম কুজুল কদফিস মারা গেলে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় কুজুল কদফিস সিংহাসনে বসলেন। আমি তখন মথুরায় সমান্তরাল সাম্রাজ্য শাসন করছি। সেখানকার শক-নাগবংশীয়েরা পরাজিত এবং আমাদের অধীনস্থ।

দ্বিতীয় কুজুল কদফিস ঘোরতর শৈব ধর্মালম্বী। তাঁর স্বর্ণমুদ্রায় আমরা দেখি তিনি নিজেকে মহেশ্বর, রাজাতিরাজা এবং সর্বলোকেশ্বর ইত্যাদি বিভিন্ন নামে বিভূষিত করেছেন। মথুরায় বসে আমি শক-পহ্লবদেরও লক্ষ করলাম—তারাও এদেশে ধর্ম-সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে। এশিয়ার শকস্থান, পার্থিয়া তখন আমাদের অধিকারে। তারা চাইলেও তাদের ফিরে যাবার উপায় ছিল না। এদেশেও তারা আমাদের পদানত। ক্রমে আমার মনে হল, অক্ষু বা আমুদরিয়া-শিরদরিয়ার জলের চেয়ে সিন্ধু-গঙ্গা-যমুনার জল অনেক শান্তিদায়ক। আমাদের বর্বর রক্তে পরিবর্তন শুরু হল। আমি মথুরা অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করলাম। বুদ্ধের পদধূলি ধন্য ঐ অঞ্চল। ক্রমে আমি বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। শুনি মহাপন্ডিত অশ্বঘোষের নাম। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় সম্রাটও মারা গেলেন। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তারিধারসূত্রে আমি সমগ্র কুষাণ সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে উঠি। রাজধানী স্থাপন করলাম এই পুরুষপুরে। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর পাটলিপুত্রবাসী পণ্ডিত অশ্বঘোষকে নিয়ে এলাম পুরুষপুরে। দীক্ষা নিলাম বৌদ্ধধর্মে। তারপর সকলের পরামর্শে গড়ে তুললাম এই বিশাল স্তুপ আর বিহার। যুগ যুগ ধরে এই সুউচ্চ স্তুপ বুদ্ধের কথাই প্রচার করবে।”

কণিষ্ক একটু থামলেন। জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ল সভাগৃহ। হাত তুলে ইংগিতে তিনি সবাইকে নীরব হতে বলে আবার বললেন। “এই মহাবিহার আমি বৌদ্ধ মহাসংঘকে দান করলাম। তাঁরা বুদ্ধের নিরন্তর সেবার জন্য এই বিহার ব্যবহার করবেন।”

আবার সম্রাটের নামে জয়ধ্বনি উঠল।

সম্রাটের ভাষণ, ব্যক্তিত্ব কমলিকার মনের ওপর এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলল। ভট্টরাইয়ের মূর্তি সম্রাটের ভারে যেন চাপা পড়ে গেল। সে ভাবল, আচার্য চরক সত্য কথাই বলেছেন। ভট্টরাই তাঁর পতি হতে পারে না। তার স্বপ্নে দেখা বীরপুরুষটি হচ্ছেন সম্রাট কণিষ্ক। হঠাৎ দমে গেল কমলিকা। ভাবল, সম্রাট অনেক দূরের মানুষ। সেখানে সে পৌঁছবে কেমন করে? সে তো এখন অতি সাধারণ। নিজের জীবিকার সন্ধানে তাকে মহামিশ্রের সাহায্য চাইতে হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল কমলিকা।

সভা ভঙ্গ হয়েছিল। শ্রোতারা সবাই সভা ত্যাগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। চরক তাড়া দিলেন, “চল, চল। সম্রাটের যাবার আগেই আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যেতে হবে।”

কমলিকার যেন চমক ভাঙল।—”ও হ্যাঁ, হ্যাঁ।” পা বাড়াল কমলিকা। ভট্টরাই এ মুহূর্তে তার মন থেকে বিদায় নিয়েছে। অচিরেই তারা পথের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে সম্রাটের জন্য অপেক্ষা করা শুরু করে দিল।

চরক বললেন, “ভিড় একটু কমে গেলেই সম্রাট বার হবেন।” সত্যিই কমলিকার উদ্বেগ দূর করে সম্রাটকে অশ্বঘোষ, মহামিশ্র এবং দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। সম্রাট কথা বলছিলেন অশ্বঘোষের সঙ্গে।—”আপনার বুদ্ধচরিত কতদূর লেখা হল?”

অশ্বঘোষ বললেন, “কিছুদূর এগিয়েছি, সম্রাট। আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তা এদিকে সংহতির বিষয়ে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা রয়েছে। আমরা আপনার অবসর মতো প্রাসাদে এর মধ্যেই যাব। আপনার সহযোগিতা ছাড়া তো আমাদের এগোন সম্ভব নয়।”

কণিষ্ক বললেন, “যে কোন দিন অপরাহ্নের দিকে চলে আসবেন। আমি প্রস্তুত থাকব। ভুলবেন না, আমিও একজন বুদ্ধপুজারী।” হঠাৎ সম্রাট সামনের দিকে তাকালেন।—”আচার্য চরক এখানে দাঁড়িয়ে! মঞ্চে দেখলাম না তাঁকে, ভাবছিলাম।”

মহামিশ্র বললেন, “সম্রাট! আচার্য আমাদের আপনজন হলেও তিনি এক ব্রাহ্মণ—সনাতনধর্মী। তাই সভাগৃহে ছিলেন। মঞ্চে ওঠেননি। এখানে নিশ্চয় আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হয়ত তাঁর আরোগ্য শালার জন্য…!”

সম্রাট এগিয়ে এলেন।—”আচার্য!”

“সম্রাটের জয় হোক! মঞ্চে যেতে পারিনি তাই…।”

চরকের কথা শেষ করার আগেই সম্রাট বিস্ময় প্রকাশ করে প্রথা বিরুদ্ধভাবে বললেন, “আচার্য! আপনার যে কন্যা আছে—তাতো জানতাম না!”

চরক বললেন, “এ আমার কন্যা না হলেও কন্যাসমা।” চরককে থামতে হল। মহামিশ্র বাধা দিয়ে বললেন, “কন্যাটি আমার আত্মীয়া। এর ইতিবৃত্ত অনেক দীর্ঘ। এর বিষয়ে আমি প্রাসাদে আপনাকে কিছু নিবেদন করতে চাই।”

কমলিকা আভূমি নত হয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানাল। তার হৃদপিণ্ডের গতি এখন যথেষ্ট দ্রুত।

সম্রাট আবার স্বাভাবিক গতিতে দ্বারপথের দিকে এগিয়ে গেলেন।

উদ্যানে বসে ভট্টরাই সমস্ত ঘটনাটি দেখল। হতাশা তাকে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হল তার। সে উঠল না। কমলিকাকেও জানাল না তার উপস্থিতির কথা। বরং সে নিজেকেই আবার প্রশ্ন করল, “কেন সে ভাববে? ক’দিনের পরিচয়? কেন সে ব্যাকুল হচ্ছে? একি ভালবাসা? কেন এক ঈর্ষায় সে জর্জরিত হচ্ছে? সম্রাটের সঙ্গে কমলিকার আলাপ হয়েছে বলে!” আবার সে নিজেকে ধিক্কার দিল, “কোথায় সে—আর কোথায় কমলিকা! তার স্পর্ধা হয় কীভাবে? এক ঘটনাচক্রে তাদের সেদিন আলাপ হয়েছিল। বিষয়টি তো এর থেকে বেশি নয়। জীবনের প্রতি বাঁকে এমন কত মানুষের সঙ্গেই তো আলাপ হয়! হাসাহাসি হয়। তা বলে!” অনেকটা নির্মেঘ হয়ে উঠল ভট্টরাই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল, উঠে দাঁড়াল সে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন