অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়
রাত তখন নিস্তব্ধ। পুরুষপুরের জনসাধারণ তখন শয্যায়। অবশ্য যাদের জেগে থাকার কথা তারা জেগে রয়েছেন জীবিকার প্রয়োজনে। তাদের নিয়মিত জাগতেই হয়। কিন্তু কখনও কখনও মানুষ এমনই জাগে—কর্তব্যের জন্য। যেমন আজ এই প্রাসাদে সম্রাটের কক্ষে জেগে রয়েছে কমলিকা। রাত্রি জাগরণ তার জীবিকার মধ্যে পড়ে না। সে জেগে রয়েছে হৃদয়ের টানে। কর্তব্যের জন্য। সম্রাটের শয্যার ধারে একটা আসনে বসে আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিল। ঔষধীর প্রভাবে সম্রাট গভীর ঘুমে মগ্ন। কক্ষের বাইরে চারজন রক্ষিণীর পদচারণা। অলিন্দের এক কোণায় কয়েকজন পরিচারিকা গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। যদি সম্রাটের কোনো প্রয়োজন পড়ে!
কমলিকা ভাবছিল, এ কী বিকার? সে কি বিকারগ্রস্ত হয়েছে? মহামিশ্রের কাছে সে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য একটি নিরাপদ কর্ম প্রার্থনা করেছিল। সম্রাট তখন তার কল্পনাতেও ছিলেন না। কিন্তু মহাবিহার উদ্বোধনের সময় সম্রাট তাকে প্রথম দর্শনেই জয় করে নিলেন! সে সম্রাটের ব্যক্তিত্বে—অবয়বে মুগ্ধ হল। মনের আঙিনায় ভট্টরাই নামে যে বীজ সবে তার জীবপত্র মেলার উপক্রম করছিল—সম্রাটের বিপুল বিশালতার ছায়ায় তা চাপা পড়ে গেল। কিন্তু তখনও সে ঠিক স্বপ্ন দেখা শুরু করেনি। সে যথেষ্ট বাস্তবধর্মী। কোথায় সম্রাট—আর কোথায় সে! শত যোজনের পার্থক্য। পরে মহামিশ্র যখন তাকে প্রাসাদ-রমণীদের দলে স্থান করে দিলেন—সে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। সম্রাটের এত কাছে! সম্রাটের সেবা করতে হবে তাকে? কিন্তু অচিরেই সে অন্যান্যদের মতো হতাশ হল। সম্রাট যেন পাথরে পরিণত হয়েছেন। প্রাসাদ-রমণীরা তাঁর চারপাশে থেকেও যেন নেই! তিনি বিশেষ দৃষ্টিতে কারোর দিকে তাকান না। হাসেন না। কাউকে ধন্যবাদও জানান না। নিজেদের কেমন যেন অবান্তর—অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়। তবু প্রাসাদ-রমণীরা যেন আলোক মুগ্ধ পতঙ্গের মতো। সম্রাটের ঐ দীপ্ত অবয়ব তাদের আকর্ষণ করে। নিজেদের মধ্যে চলে এক নীরব প্রতিযোগিতা। কে সম্রাটকে ধ্যান মুক্ত করতে সফল হবে? কে সম্রাটের ঐ প্রশস্ত বুকে ঝাঁপ দেবে বা তাঁর বাহুবন্ধনে ধরা দেবার সুযোগ লাভ করে রমণী জীবন সার্থক করবে! কে আশ্রয় পাবে তাঁর শয্যায়। কমলিকা জানে, সম্রাট যদি কোনোদিন বুদ্ধ আর সংসারজীবনকে পৃথকভাবে মেনে নিতে পারেন—সেদিনও সম্রাটের স্ত্রীর মর্যাদা বা সম্রাজ্ঞীর মর্যাদা একজনের ভাগ্যেই জুটবে। আশাহত হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে অনেকেই হয়তো গৃহে ফিরে যাবে। আবার অনেকে সম্রাটের উপপত্নীর সম্মানে সম্মানিত হতে দ্বিধা করবে না। সেটাও হবে তাদের পক্ষে গৌরবের বিষয়। কিন্তু সে অসম্মানের জীবন কমলিকা কামনা করে না। সে শুধু সম্রাটকে পাবার সাধনা করে যায়। সম্রাটের কক্ষ সাজায়। কায়মনোবাক্যে নিজেকে নিয়োজিত করে। ক্রমে একটু সফলতার আভাস সে পায়। কিন্তু কণিষ্কপুরে সে দেখেছে, সম্রাট হয়তো তার প্রতি প্রসন্ন—কিন্তু বুদ্ধসাধনার যে গভীরে তিনি প্রবেশ করে গেছেন—সেখান থেকে তাঁকে বার করে আনা অতি কঠিন কাজ!
সম্রাটের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা অস্ফূট এক শব্দে সচকিত হয়ে কমলিকা সম্রাটের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল, সম্রাট যেন অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। ঘুমের ঘোরে অস্পষ্টভাবে কিছু বললেন। নিজের অজ্ঞাতেই নিজের বাম বুকে হাত বোলাচ্ছেন। উৎকণ্ঠিত হয়ে কমলিকা এক পরিচারিকাকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে আচার্যের শিষ্য দেবলকে ডেকে আনতে বলল। তারপর তাঁর আসনটিকে শয্যার আরও কাছে নিয়ে গেল। সম্রাট কষ্ট পাচ্ছেন। সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ত্যাগ করে কমলিকা সম্রাটের বক্ষে হাত বোলানো শুরু করল। সম্রাটের দেহ স্পর্শ করে প্রথমেই সে এক অভূতপূর্ব রোমাঞ্চ অনুভব করল। ক্রমে সহজ হয়ে এল। তার ভালোবাসার মানুষ আজ কত কাছে! প্রবল এক মমতায় কমলিকা সম্রাটের বক্ষ সেবার কাজ করতে থাকল।
দেবল কমলিকার পরিচিত, আশ্রমে পরিচয়। সে এসে বলল, “কী হয়েছে, দেবী?”
“সম্রাটের বুকে বোধহয় যন্ত্রণা হচ্ছে। মৃদু আর্তনাদ করে ঘুমের মধ্যেই নিজের বুকে হাত বোলাচ্ছেন। এখন আমি হাত বোলাতে একটু শান্ত হয়েছেন।”
চিন্তিত মুখে দেবল বলল, “নাড়িটা একটু দেখি।” এক সময় তার মুখ সহজ হয়ে এল। সম্রাটের হাতটি নামিয়ে রেখে দেবল বলল, “না। চিন্তার কিছু নেই। আচার্যের ঔষধীগুলো খাইয়ে দিয়েছিলেন তো?”
“হ্যাঁ।”
“সম্রাট এখন প্রভাত পর্যন্ত ঘুমোবেন। চিন্তার কোনো কারণ নেই। ঔষধীগুলো ধীরে ধীরে কাজ করছে। আপনি প্রয়োজন বোধ করলে সম্রাটের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে পারেন। তাতে উনি স্বস্তিই পাবেন।”
“নতুন কোনো ঔষধী?” কমলিকা প্রশ্ন করল।
“না। এখন নতুন কোনো ঔষধীর প্রয়োজন নেই। আচার্য যা দিয়ে গিয়েছিলেন—তা তো খাওয়ানো হয়ে গেছে। প্রভাতে আবার আচার্য আসবেন। তিনি যা ব্যবস্থা নেবার তা নেবেন।” দেবল চলে গেল।
কমলিকা আবার পরম মমতায় সম্রাটের বুকে-মাথায় হাত বোলাতে থাকল। সে ভাবল, জীবনের পরম ধর্ম আজ তার মুঠির মধ্যে। সেবার মধ্য দিয়ে সম্রাটকে সে জয় করবে। তাকে টেনে নিয়ে আসবে জীবনের আঙিনায়।
প্রভাতে সত্যই সম্রাটের নিদ্রাভঙ্গ হল। কিন্তু সম্রাট চোখ মেলে আশ্চর্য হলেন। তাঁর শয্যার পাশে এক আসনে মণিকার পুত্রী বসে রয়েছে ঘুমন্ত অবস্থায়। মণিকার পুত্রীর একটি হাত তখনও তাঁর বুকের ওপর পড়ে রয়েছে। সম্রাট দ্বিধাগ্রস্ত হলেন—হাতটি সরাবেন কি না। সারারাত নিশ্চয় সে এভাবে তাঁর সেবা করেছে। ঘুমের মধ্যেও তিনি যেন অনুভব করেছিলেন কারোর কোমল হাতের স্পর্শ! সম্রাট মনস্থির করতে না পেরে অসহায়ভাবে কমলিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনে হল, এই মুখ বড় নিষ্পাপ। পবিত্র ফুলের মতো! সম্রাট এ মুহূর্তে নিজের মনের কাছে অকপট হলেন। ইদানীং তাঁর মণিকার পুত্রীর জন্য মনের মধ্যে যেন এক মোহ জন্মাচ্ছিল। সংসার জীবনে আবার ফিরে আসার এক সুবর্ণ হাতছানি যেন তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। মহাপণ্ডিত অশ্বঘোষ, বসুমিত্র, সংঘরক্ষিত কে না তাকে সংসার জীবনে ফিরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন! গৃহী শিষ্য হতে বাধা কোথায়? সম্রাট রয়েছেন, অথচ সম্রাজ্ঞী নেই—এ যেন সাম্রাজ্যের পক্ষে অপূর্ণতা। তাই প্রজাদেরও দীর্ঘদিনের দাবি রয়েছে—সম্রাট দার পরিগ্রহ করুন। সেইজন্য সম্রাট নিজের ওপর চাপ কমাবার জন্য প্রাসাদ-রমণী নাট্যের সূচনার সম্মতি দিয়েছিলেন। এখন তাঁর হিতাকাঙ্ক্ষীরা সবাই শুধু প্রতীক্ষায় রয়েছেন। সম্রাট কবে সম্রাজ্ঞী নির্বাচন করবেন? জাগতিক ভোগ বিলাসের মধ্যে ফিরে আসবেন? সম্রাট এতকাল মনে মনে হাসতেন। ভাবতেন, তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা একদিন হতাশ হয়ে চাপ কমিয়ে নেবে। প্রাসাদ-রমণীরা গৃহে ফিরে যাবে। তিনি তখন আরও প্রগাঢ়ভাবে বুদ্ধের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। কিন্তু মণিকার পুত্রীকে প্রথম দেখা এবং তার প্রাসাদ-রমণী দলে অন্তর্ভুক্তি—অতি ধীর ভাবে সম্রাটের মনে গোপনে এক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। মণিকার পুত্রী কেমন করে তাঁর মনের মধ্যে প্রবেশ করে জানলো—তিনি কেমন কক্ষ-সজ্জা পছন্দ করেন? তবে এতদিন এসব নিয়ে তিনি বিশেষ চিন্তা করেননি। ভালো লাগছে—লাগছে। এই পর্যন্তই। কিন্তু আজ প্রভাতে মণিকার পুত্রীর হাত তাঁর বুকের ওপর পড়ে থাকার ব্যাপারটি যেন তাঁর মনের অনেক কিছুই ওলট-পালট করে দিল। মণিকার পুত্রীর রাত্রি জাগরণ ক্লান্ত মুখটির মধ্যে তিনি যেন এক সেবিকার মূর্তি আবিষ্কার করলেন।—না! মণিকার পুত্রীর কক্ষ-সজ্জায় কোনো খুঁত নেই। সেবাতেও কোনো খুঁত নেই। কাল রাত্রে হতচেতন হয়ে থেকেও তিনি যেন অনুভব করেছেন সস্নেহে এক কোমল হাতের স্পর্শ। সম্রাট যেন কেমন বিহ্বল হয়ে গেলেন। তাঁর প্রয়োজন ছিল স্নান-ঘরে যাওয়ার। শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হলেন তাঁর বুকের ওপর পড়ে থাকা হাতটিকে সন্তর্পণে সরিয়ে দিতে।
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল কমলিকা। উঠে দাঁড়িয়ে সলজ্জভাবে বলল, “ক্ষমা করবেন সম্রাট। একটু চোখ লেগে গিয়েছিল।”
সম্রাট বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবার চেষ্টা না করে বললেন, “ঠিক আছে। ও কিছু নয়। আমি একটু স্নান-ঘরে যাব।”
“না-না সম্রাট। একা উঠবেন না। আমি পরিচারিকাদের ডাকছি। ওরা নিয়ে যাবে আপনাকে।”
সম্রাট উঠে বসে নামবার উপক্রম করলেন, “না থাক। আমি একাই পারব।”
সম্রাট আর কমলিকার গলার স্বর শুনে দুজন পরিচারিকার সতর্ক নিদ্রা ভেঙে গিয়েছিল। তারা এসে দোরগোড়ায় দাঁড়াতেই কমলিকা ইশারায় তাদের ডেকে বলল, “সম্রাটকে ধরে স্নান ঘরে নিয়ে যাও।”
সম্রাট যেন একটু বিরক্ত হলেন। বললেন, “বলছি তো আমি একাই যাব।”
গম্ভীর মুখে কমলিকা বলল, “সম্রাট! ক্ষমা করবেন। আপনার এই আদেশ আমি মানতে পারছি না। বাস্তবে আপনি সম্রাট হলেও বর্তমানে আচার্য চরকের এক রোগী মাত্র। আচার্য আমাকে আপনার সেবিকা হিসেবে নিযুক্ত করে গেছেন। আমার ওপর তাঁর নির্দেশ রয়েছে। আমি তা অমান্য করতে পারি না।”
সম্রাট জ্বলে উঠতে গিয়েও সংযত হয়ে গেলেন।— “বেশ! আচার্য এলে আমি অভিযোগ করব।”
“নিশ্চয় করবেন সম্রাট। একটু পরেই তিনি এসে যাবেন।”
পরিচারিকা দুজন সম্রাটকে ধরে ধরে স্নান-ঘর পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
কমলিকা তাদের সম্রাটের পোশাক নিয়ে আসতে বলে, নির্দেশ দিল, “সম্রাটের পোশাক পালটে দিও।” অতঃপর কমলিকা সরে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সেটি খুলে রেখে কমলিকা বাতায়নে পা দিল। উদ্যানের মাঝে—বাতায়নের অনতিদূরে রক্ষীগৃহ। সেখানে ব্যস্ততা। নৈশ প্রহরীরা চলে যাচ্ছে। প্রভাতের প্রহরীরা এসে গেছে। সারারাত ধরে অতন্দ্রভাবে তারা সম্রাটের কক্ষের দিকে দৃষ্টি রাখে। কঠোর সে প্রহরা। বাইরের অলিন্দে জাগ্রত থাকে দশজন কঠোরদেহী রক্ষিণী। কমলিকা ভাবে, একজন মানুষের শান্তির ঘুমের জন্য কত মানুষকে জাগরণে কাটাতে হয়! অবশ্য এ স্বাভাবিক। তিনি ঐ বিশাল কুষাণ সাম্রাজ্যের অধিপতি। কত চিন্তা তাঁর মাথায় রয়েছে অহর্নিশ। তাঁর নিরুপদ্রব নিদ্রার প্রয়োজন—নয়তো উন্মাদ হয়ে যাবেন। একটা নাম না জানা এক পাখি মিষ্টি সুরের আবেশ তুলে উড়ে গেল। হঠাৎ কমলিকার বুক যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল।— “এ কী তার দুর্মতি! সম্রাটের মুখের ওপর সে তর্ক করেছে! সে কি বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছিল?” একটি ভীতির ভাব চেপে বসল কমলিকার মনে। স্থির করল, প্রথম সুযোগেই সে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। সে নিশ্চয় তার অবস্থান ভুলে গিয়েছিল!
আচার্য চরক হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে সম্রাটকে শয্যায় না দেখে জানলার দিকে তাকালেন। কমলিকাকে বাতায়নে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে মা? সম্রাট কোথায়?”
কমলিকা ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে চরকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।— “সম্রাট স্নান-ঘরে। কিন্তু…!”
চরক কমলিকার বিবর্ণ মুখ দেখে আবার বিস্ময় বোধ করলেন, “কী হয়েছে মা? সম্রাট…!”
“আমি সম্রাটের সঙ্গে তর্ক করেছি। সম্রাট বোধহয় রুষ্ট হয়েছেন।”
“কেন? কী তর্ক?”
সেই মুহূর্তে সম্রাট স্নান-ঘর ছেড়ে পোশাক বদল করে কক্ষে পা রাখলেন। দুজন পরিচারিকা সম্রাটের দুই বাহুমূল ধরে তাঁকে ধীরে ধীরে নিয়ে আসছিল। চরককে দেখে সম্রাট গম্ভীর হয়ে বললেন, “আচার্য! সেবিকার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ রয়েছে। সে সম্রাটকেও অস্বীকার করেছে।”
আচার্য চরক যেন বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি তীর্যকভাবে কমলিকাকে দেখলেন, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সে মুখ নীচু করে রয়েছে। সম্রাটকে দেখলেন, তিনি গিয়ে শয্যায় উপবেশন করেছেন।
চরক বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “সম্রাট যদি বিষয়টি পরিষ্কার করেন…”
“আমি একা শয্যা ত্যাগ করে স্নান-ঘরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেবিকাটি আমার সেই আদেশ গ্রাহ্য না করে পরিচারিকাদের আহ্বান করেছে। সেবিকা সম্রাটের ইচ্ছার মর্যাদা না দিয়ে আপনার নির্দেশ পালন করতেই বেশি উৎসাহী।”
চরক বিষয়টি এবার বুঝতে পেরে হেসে উঠলেন। “বুঝেছি সম্রাট। সেবিকাটি যথার্থ কাজই করেছে। আপনার শয্যাত্যাগ আমি নিষেধ করে গিয়েছিলাম। এই মুহূর্তে আমিই আপনার সম্রাট। আমার আদেশ আপনাকে মানতে হবে। আপনি এখন মোটেও সুস্থ নন। আপনার নাড়ি পরীক্ষা করব।”
সম্রাট শুয়ে পড়ে কমলিকার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “বেশ। আপনি আপনার সেবিকাকে বলুন, যদি সম্ভব হয়, তবে সে যেন আজও রাত্রে আসে। আমি একজন কঠোর সেবিকাকেই চাই।”
কমলিকার মুখে রক্তাভ হয়ে উঠল। তার হৃৎপিণ্ডে যেন প্লাবন।
প্রভাতেই ছুটে এসেছে ভট্টরাই। তার নতুন দায়িত্বশীল কাজের আজ থেকেই সূচনা। মনে আরও এক উল্লাস। এই প্রাসাদেই—তার মাথার ওপর বসবাস করে কমলিকা! হোক না সে প্রাসাদ-রমণী। দূর থেকে দু-একবার দেখেও তো তৃপ্তি পেতে পারবে। কমলিকার সান্নিধ্যেই তো সে থাকবে। প্রাসাদে পা রেখেই সে কার্যালয়ে বসে থাকা মহামিশ্রকে প্রশ্ন করল, “সম্রাট কেমন আছেন?”
মহামিশ্র তাকে বসতে বলে বললেন, “আচার্য এসেছিলেন। এমনই ঠিক আছেন—কিন্তু বিপদমুক্ত নন। বেশ কয়েকটা দিন তাকে শয্যাশায়ী থাকতে হবে। আচার্যের এই বিধান!” তারপর একটু থেমে তিনি বললেন, “এবার তোমার দায়িত্ব বুঝে নাও। তোমার প্রাথমিক দায়িত্ব—এই প্রাসাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর সঙ্গে জড়িত থাকা প্রতিটি কর্মচারী সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানা। আমরা আশা করব জনাগই জাঙ্কের প্রথম ও শেষ লোক এই প্রাসাদে।”
“হ্যাঁ। জনাগ কোথায়? তাকে কি বাঁচানো গেছে?”
“সৌভাগ্যবশত তাকে উদ্ধার করা গেছে। আর কিছু দেরি হলে জাঙ্কের ঘাতক বাহিনী পৌঁছে যেত। রাজকীয় বাহিনীকে দেখে তারা পালায়। জনাগ আর বিনাগকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে সেনানিবাসের বন্দীশালায় রাখা হয়েছে। যা হোক, আমি করণীকদের বলে দিয়েছি, তারা এই প্রাসাদের প্রতিটি অধিবাসীর তালিকা তোমার হাতে তুলে দেবে—এমন কি প্রাসাদ-রমণীদেরও।”
কমলিকার নামটি সেখানে আছে কিনা—তা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেল ভট্টরাই।— “বোকার মতো প্রশ্ন হোত। বরং জিজ্ঞাসা করা যায়, তার বিশেষ প্রাসাদ অধিকর্তা হিসেবে নির্বাচনের কথা কমলিকা জানে কিনা?” এই প্রশ্নটিও অনুচিত বলে মনে হল ভট্টরাইয়ের। প্রাসাদ-রমণীদের সম্পর্কে তার কৌতূহল প্রকাশ না করাই ভালো। তারা এক বিশেষ জগতের বাসিন্দা। ভট্টরাই তাই শেষপর্যন্ত বলল, “ভন্তে মহামিশ্র! প্রাসাদের প্রতিরক্ষার কাজে যেহেতু নিয়োজিত হলাম তাই প্রাসাদটিকে আমার বিশদভাবে জানা প্রয়োজন। কোথায় কার অবস্থিতি—কিসের অবস্থিতি—এটা আমার দেখে নেওয়া উচিত।”
“নিশ্চয়। তবে সবকিছু দেখিয়ে দেবার আগে তুমি জেনে রাখ, প্রাসাদের রন্ধনশালা থেকে শুরু করে প্রতিটি অধিবাসীই বাস করে নীচের তলায়। এখানে অসংখ্য কক্ষ। এখানে পরিচারক-পরিচারিকা—রক্ষিণী থেকে শুরু করে আমি পর্যন্ত এই একতলায় থাকি। তোমার জন্যও একটি ঘর রয়েছে। তুমি ইচ্ছা করলে এখানেই বসবাস করতে পার।”
ভট্টরাই বলল, “থাকার বিষয়টি আমি এখনও চিন্তা করিনি। তবে রাত হয়ে গেলে বা রাতে থেকে যেতে হলে ঘরটি নিশ্চয় ব্যবহার করতে পারব।”
“স্বচ্ছন্দে। ওটি তোমার ঘর। আমার ঘরের পাশেই। কিন্তু দোতলাটি ভীষণভাবে সংরক্ষিত। সম্রাটের অন্দর-মহল বলে এখন আর কিছু না থাকলেও ওপর তলাটি অন্দর-মহল বলেই বিবেচিত হয়। ওপরে বাস করে বারোজন প্রাসাদ-রমণী। দশজন রক্ষিণী আর সম্রাট স্বয়ং। ওপরে বিশেষ কয়েকজন পুরুষ ছাড়া অন্য কারোর যাওয়ার অনুমতি নেই। কোনো যুক্তিসম্মত কারণ ছাড়া অন্য কেউই ঐ সোপানে পা রাখতে পারে না। এমন কি তুমিও পারবে না।”
মনের মধ্যে একটা হতাশার ভাব গোপন করে ভট্টরাই বলল, “এর অন্যথা হবে না।”
মহামিশ্র বললেন, “আরও একটি কথা জেনে রাখ, যদিও সচরাচর কোনো প্রাসাদ-রমণী কোনো প্রয়োজনে কার্যালয়ে আসে না, তবে প্রয়োজনে আসতেও পারে। কিন্তু তুমি তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করবে। কারণ, এঁরা সকলেই সম্মানিত। এঁদের মধ্যে থেকেই হয়তো কেউ ভবিষ্যতের সম্রাজ্ঞী হবেন।”
ভট্টরাই বলল, “আমি বুঝেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি ত্রুটি-মুক্ত থাকার চেষ্টা করব।”
“এবার তাহলে ওঠা যাক।” মহামিশ্র উঠে দাঁড়ালেন।
ভট্টরাই বিশাল প্রাসাদের একতলার প্রতিটি ঘর, রন্ধনশালা, অস্ত্রাগার সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে শেষ পর্যন্ত দোতলায় ওঠবার সোপানের কাছে এসে দাঁড়াল। শ্বেত মর্মরের সেই সোপান। মহামিশ্রের পেছন পেছন সে ওপরে উঠতে থাকল। মনের মধ্যে কেমন যেন এক খুশির ভাব। হয়তো কমলিকার মুখোমুখি হয়ে যাবে। তার এই পদোন্নতিতে বিস্ময় প্রকাশ করবে সে। বলবে, “কই! মহামিশ্র তো আমায় জানান নি!” অথবা বলবে, “শুনেছি। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম!”
দোতলায় পা রেখে বিস্ময়ের সঙ্গে ভট্টরাই দেখল, প্রশস্ত—দীর্ঘ এক অলিন্দপথ। মাঝ বরাবর সুদৃশ্য পাথর মোড়া থামের সারি! অলিন্দের দু’পাশে সার সার কক্ষ। সব কয়টির কপাট বন্ধ।
মহামিশ্র বললেন, “এই ঘরগুলিতে থাকেন প্রাসাদ-রমণীরা। কয়েকটিতে রক্ষিণী এবং পরিচারিকারা। অধিকাংশ কক্ষই খালি।”
ভট্টরাইয়ের হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে উঠল। এরই কোনো এক কক্ষে থাকে কমলিকা! কয়েকজন প্রাসাদ-রমণী তাদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে অন্য কক্ষে গেল। যাবার সময় ভট্টরাইকে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখেও গেল। রোমাঞ্চিত হল ভট্টরাই। ভাবল, এই বুঝি সে কমলিকাকে দেখতে পাবে। কিন্তু না। কমলিকা এল না। তার জানার কথাও নয় যে রাত্রি জাগরণের পর কমলিকা স্নান সেরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আজ রাত্রেও তাকে সেবিকার কার্যে যোগদান করতে হবে। ভট্টরাই মহামিশ্রকেও প্রশ্ন করতে পারল না—কারণ, শর্ত হিসেবে এই বিষয়ে তার কৌতূহল প্রকাশ করাও উচিত নয়!
দীর্ঘ অলিন্দ পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল ভট্টরাই। দেখল, জনা ছয়েক রক্ষিণী একটি কপাট-বন্ধ কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে। তারা ভট্টরাইকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করল।
মহামিশ্র তাদের প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠলেন, “একে চিনে রাখ। নিচে আমার কার্যালয়ে বসবেন আমার সহকারী হয়ে। এই প্রাসাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব এর ওপর।”
রক্ষিণীরা অভিবাদন জানাল।
মহামিশ্র সাবধানে কক্ষের কপাট ঠেললেন। প্রশস্ত এক কক্ষ। সুসজ্জিত। মধ্যবর্তী অংশে সম্রাটের বিশাল পালঙ্ক। সম্রাট শুয়ে আছেন। বোধহয় নিদ্রিত। দুটি প্রাসাদ-রমণী দূরবর্তী দুটি আসনে বসে আছে।
মহামিশ্র কক্ষে প্রবেশ না করে ইংগিতে প্রাসাদ-রমণী দুজনকে কাছে ডাকলেন। তারা এগিয়ে এল।
মহামিশ্র প্রশ্ন করলেন, “সম্রাট কি জেগে আছেন?”
“না। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন।”
“ও!”
“ইনি?”
“আমার সহকারী। এই প্রাসাদের প্রতিরক্ষার বিষয়ে বিশেষ অধিকর্তা। আমার অনুপস্থিতিতে তোমাদের প্রয়োজনের কথা একেও জানাতে পার। এ আমার কার্যালয়েই বসবে।”
ভট্টরাই প্রাসাদ-রমণীদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল।— “বাতায়নের ঐ দ্বারটি কি রাত্রে খোলা থাকে?”
না। বন্ধ থাকে ইদানীং।
ভাল। বাতায়নের নীচেই তো উদ্যান?
হ্যাঁ।
বেশ চলুন। উদ্যানটিও আমি একবার দেখতে চাই।
মহামিশ্র আর ভট্টরাই এগিয়ে গেলেন।
ভট্টরাই উদ্যানটি দেখে নিল। প্রাসাদের প্রবেশ পথ পশ্চিমে। উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্বে উদ্যান প্রাসাদটিকে ঘিরে রেখেছে। সম্রাটের কক্ষের নিচে একটি রক্ষী ঘর। রাত্রে প্রায় পনেরোজন রক্ষী এইখানে সম্রাটের কক্ষের দিকে তাকিয়ে প্রহরা দেয়। পশ্চিম দুয়ারে থাকে জনা কুড়ি সেনা। পশ্চিমের প্রবেশ পথের অদূরেই সম্রাটের দেহরক্ষীদের আবাসস্থল। প্রায় একশত দেহরক্ষী সেখানে থাকে। প্রাসাদ থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে সেনানিবাস।
ভট্টরাই কার্যালয়ে ফিরে এল। মহামিশ্র রাজসভার দিকে এগোলেন। সম্রাটের অসুস্থতার কথা সেখানে ঘোষণা করতে হবে।
একজন পরিচারিকা ভট্টরাইকে জলপান দিয়ে গেল। ক্ষুধার্ত বোধ করায় সে সঙ্গে সঙ্গে তা গলাধঃকরণ করা শুরু করে দিল। আহার করতে করতেই ভট্টরাই প্রাসাদ-রমণীদের তালিকাটিতে চোখ বোলাতে শুরু করল। দুটি নামে তার দৃষ্টি আটকে গেল। এক, মন্ত্রী ইউনাসের কন্যা জানুকা ও দুই, দুবলের কন্যা বল্লভী। দুইজনেই কুই-সাং গোষ্ঠীর অর্থাৎ জাঙ্কের গোষ্ঠী।
পরিচারিকাটি খালি পাত্রগুলি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এল। ভট্টরাই তাকে প্রশ্ন করল, তুমি কি এখানেই থাকো—না ঘর থেকে যাতায়াত করো?
পরিচারিকাটি বলল, না। আমি এখানেই থাকি। ঘর থেকে ঠিক সময়ে যাতায়াত করার অসুবিধা হয়। তবে আমাদের পদ্মা, রোমা, সুতপা এরা যাতায়াত করে। ওদের ঘরবাড়ি কাছে।
বেশ। ওদের তিনজনকে আমার কাছে একটু পাঠিয়ে দাও।
একটু পরেই তিনজন পরিচারিকা এসে উপস্থিত হল। আমাদের ডেকেছেন? হ্যাঁ। আচ্ছা, তোমরা প্রাসাদে বাস করো না কেন?
অসুবিধে আছে। ঘরে ছেলে-মেয়েরা আছে। অবিবাহিত। তাদেরও দেখাশোনা করতে হয়।
সবাই ছোট না বয়স্কও আছে?
পদ্মা বলল, আমার ছেলেটা পূর্ত বিভাগে কাজকর্ম করে।
ও! আচ্ছা, জাঙ্ককে তোমরা চেনো?
চিনি। বড় ভয়ংকর লোক। ওর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখি না।
তাহলে ভয়ংকর বলে জানলে কেমন করে?
আমার ছেলে নগর-কার্যালয়ে একটি বড় ঘর নির্মাণে নিযুক্ত। সমাজ-উৎসবের আগেই ওই ঘর নির্মাণ শেষ করতে হবে। সমাজ-উৎসবের রাতে ওখানে নাকি এক মহোৎসব হবে। ঐদিনই নাকি জাঙ্ক অনেক উঁচুতে উঠে যাবে। দু-হাতে সে তখন ধন বিলোবে। পুরুষপুর তার পায়ে লুটোবে।
ভট্টরাইয়ের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলেও সে তা গোপন করে গিয়ে বলল, জাঙ্ক পাগল হয়ে গেছে নাকি? সম্রাটের আদেশে সে সমাজ-উৎসবের পরের দিনই পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে। কারণ, সম্রাটের কাছে প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে পারবে না। যা হোক, সে যে ভয়ংকর তা তুমি জানলে কেমন করে?
ছেলে বলছিল, যাদের সে ধরে আনে—তাদের ওপর ভীষণ অত্যাচার করে। একটি বন্দী নাকি সেদিন চেঁচিয়ে বলছিল, আপনার সমাজ-উৎসবের রাতের কথা সবাইকে জানিয়ে দেব। আপনি কী করতে চাইছেন তা সবাইকে বলে দেব।
মনের ভাব গোপন করে ভট্টরাই জানতে চাইল, তারপর?
ছেলে বলে, সে রাত্রে বন্দীটি কারাগারের ভেতরেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। প্রহরীরা বলছিল, সে নাকি অত্যাচার সহ্য করতে পারেনি। তাই…।
অন্য এক প্রহরী তর্ক করছিল চাপা স্বরে। জাঙ্ক নাকি দাঁড়িয়ে থেকে তাদের দুজনকে ঝুলিয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে!
ভট্টরাই মৃত্যুর ঘটনাটিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলল, আসলে জাঙ্ক সমাজ-উৎসবের রাতে কীসের মহোৎসব করতে চেয়েছে—জানো কিছু?
পদ্মা বলল, জানি না। কিন্তু সেদিন সব প্রহরীকে কার্যালয়ে উপস্থিত হতে বলেছে। জাঙ্ক বলেছে, সমাজ-উৎসবের রাতে নগরে কোনো প্রহরী থাকবে না। সবাই কার্যালয়ে এসে মহোৎসবে যোগ দেবে। বিশাল খাওয়া-দাওয়ারও নাকি ব্যবস্থা হবে। ঐ রাতেই নাকি বলি দেওয়া হবে একটি বড় ষণ্ডকে! নগরের সব প্রহরীর নিমন্ত্রণ থাকবে।
বলি!
হ্যাঁ, বলি!
মহামিশ্র রাজসভা থেকে ফিরে এলেন। ভট্টরাই পরিচারিকাদের বলল, তোমরা যাও। পরে কথা বলব।
মহামিশ্র চিন্তিতভাবে আসনে দেহ এলিয়ে দিলেন। তারপর ভট্টরাইকে প্রশ্ন করলেন, পরিচারিকাদের সঙ্গে কী কথা বলছিলে?
ভট্টরাই এক এক করে সব খুলে বলল।
মহামিশ্র বললেন, কিছু মনে হচ্ছে না তোমার?
হচ্ছে। জাঙ্ক সমাজ-উৎসবের রাতে কিছু একটা করতে চলেছে। কিন্তু কী সেটা? সেদিন সম্রাটের সামনেও তো সে সমাজ-উৎসবের দিনের কথা বলে গেছে।
মহামিশ্র বললেন, আশ্চর্যের কথা, বিনাগকে প্রশ্ন করা হলে সে বলেছে সমাজ-উৎসব নাকি জাঙ্কের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য দিন হবে—একথা প্রহরীরা বিস্মিতভাবে বলে বেড়াচ্ছে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু তারা জানে না কেন? মহামিশ্র আরও কিছু বলতে গেলেন—কিন্তু এক গূঢ়পুরুষের আগমনে থেমে গেলেন।—বল, সুনাতা, কী সংবাদ?
গূঢ়পুরুষটি ইতস্তত করল!
বল।
আজ্ঞে, গোপনীয়।
বেশ! বেশ। তারপর ভট্টরাইকে দেখিয়ে বললেন, এ আমার সহকারী। প্রাসাদ প্রতিরক্ষক। বল।
আজ্ঞে—আমি নিম্নসিন্ধুর বন্দর এলাকা থেকে ফিরছি। ভন্তে নীলাকারের সঙ্গেও এখনও সাক্ষাৎ হয়নি। ভাবলাম, আপনার কানে অর্থাৎ সম্রাটের কানে সংবাদটি তুলে দিয়ে যাই।
কী সংবাদ?
সিন্ধুর মোহনা অঞ্চলে পহ্লব-ক্ষত্রপ বিদ্রোহের আয়োজন করছে। এখুনি তা দমন করা না গেলে বিপদ! তারা পুরুষপুরে পৌঁছে যাবে সমাজ উৎসবের দিন!
চিন্তিত মহামিশ্র বললেন, ঠিক আছে। তুমি নীলাকার আর গুণবর্ধনের কাছে যাও। তাদের এখানে পাঠিয়ে দেবে। আলোচনা আছে।
গূঢ়পুরুষটি চলে যেতেই মহামিশ্র ভট্টরাইকে বললেন, বুঝতে পারছো, সম্রাট কী ভীষণ কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন? জাঙ্ক সম্ভবত এই বিষয়টি নিয়েই উল্লসিত। পহ্লব-ক্ষত্রপ পুরুষপুর আক্রমণে আসছে। কিন্তু সম্রাটের যে শারীরিক অবস্থা—তাতে তাঁকে এসব কথা বলব কেমন করে? মথুরায় সংবাদ পাঠালেও সেখান থেকে প্রস্তুত হয়ে আসতে বাসিষ্কের বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে। অন্যদিকে সে নিজেও অসুস্থ। তার আঘাত প্রকৃতপক্ষে এখনও নিরাময় হয়নি। সম্রাটকে নিশ্চিন্ত করতে গূঢ়পুরুষটিকে পাঠিয়েছিল বাসিষ্ক।
ভট্টরাই বলল, এ বিষয়ে আমি আর কী বলতে পারি? এ আমার অধিকারভুক্ত এলাকা নয়। সম্রাট পূর্বের তুলনায় কিছুটা সুস্থ বলে শুনেছি। কিন্তু আচার্য চান না, তিনি কোনোভাবে উৎকণ্ঠিত হন। পুনরাবৃত্তি ঘটার এখনও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি চান সম্রাট আরও কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিন। এখন আপনারা অর্থাৎ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতম পুরুষেরাই ঠিক করুন কী করা উচিত আর কী নয়।
মহামিশ্র বললেন, ঠিকই বলেছো। গুণবর্ধন আর নীলাকার আসুক। তাদের সঙ্গে আগে কথাবার্তা সেরে নিই। এরপর মন্ত্রী পরিষদের সভা আহ্বান করতে হবে। মন্ত্রী পরিষদ যা সিদ্ধান্ত নেবে—সম্রাটের অনুপস্থিতিতে আমাদেরও তাই স্বীকার করতে হবে! মহামিশ্র উঠে পড়লেন—ভট্টরাই! আবার আমি সভাগৃহে যাচ্ছি। গুণবর্ধন আর নীলাকার এখনই হয়তো এসে পড়বে।
ভট্টরাই বলল, চিন্তা করবেন না। আমি আছি। অপেক্ষা করতে বলব।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন