কণিষ্ক – ১৪

অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। আচার্যের আশ্রমে দেওয়ালগিরিগুলি এক এক করে জ্বলে উঠছিল। নতুন কিছু কুটীর নির্মিত হচ্ছিল—কমলিকার বদান্যতায়। আচার্য তাঁর আরোগ্য নিকেতনের কাজকর্ম পরিদর্শন করে সবে তাঁর কুটিরের দাওয়ায় বসে জলপান করছিলেন, ঠিক সেই সময় অশ্ব ছুটিয়ে ভট্টরাইকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে তিনি দাওয়া থেকে নেমে পড়লেন।

ভট্টরাই আচার্যের সামনে বল্লা আকর্ষণ করে ঘোড়াটিকে থামাল। তীব্র চিঁ-ইঁ-ইঁ শব্দ করে সামনের দুটি পা কয়েক মুহূর্তের জন্য ওপরে তুলে ঘোড়াটি থামল। ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নামল ভট্টরাই।

ভট্টরাই! তুমি! কি হয়েছে? এতকাল পর! কমলিকার…!

ভট্টরাই আচার্যের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, সম্রাট অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। বাম বুকে হৃদপিন্ডের কাছে বেদনা বোধ করছেন। আপনি এখনই চলুন।

চরকের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। হৃদপিণ্ডে বেদনা! তুমি একটু অপেক্ষা কর ভট্টরাই। আমি প্রয়োজনীয় ঔষধীর থলিকাটি নিয়ে আসি।

ভট্টরাই আবার ফিসফিস করে বলল, খুব গোপনীয়।

আচার্য চরক আরোগ্যশালার দিকে এগিয়ে গেলেন। ভট্টরাইয়ের গলার স্বর শুনে আচার্য গৃহিণী দাওয়ায় বেরিয়ে এলেন। কী সংবাদ, ভট্ট? এতদিন পরে—হঠাৎ? কমলিকা….?

ভট্টরাই সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল, ভাল আছে, মা।

আচার্যকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

প্রাসাদে!

কেন? কার ব্যাধি?

এই মুহূর্তে বলা নিষেধ রয়েছে, মা। ক্ষমা করবেন। কমলিকার সঙ্গে মাঝে একদিন আমার দেখা হয়েছিল। অনেক কথা হল।

আচার্য অতি দ্রুত ফিরে এলেন।—আমি প্রস্তুত ভট্টরাই।

তবে আসুন আমরা যাই।

কিন্তু …!

কিসের কিন্তু–আচার্য?

যাবে কিসে? ঔষধী নিয়ে জঙ্গল থেকে তো ওরা এখনও ফেরেনি। একটু অপেক্ষা কর। এখুনি ওরা ফিরবে।

না আচার্য! ক্ষমা করবেন। অপেক্ষা করার জন্য এক মুহূর্তেরও সময় নেই। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। আপনি আমার অশ্বে উঠে পড়ুন। আর হ্যাঁ। উত্তরীয়ে মুখটি ঢেকে নিন। পথে কারোর কৌতূহল আকর্ষণ করতে চাই না। দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছোটাল ভট্টরাই।

মহামিশ্র আচার্যের জন্য তাঁর কার্যালয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ভট্টরাই আচার্যকে নিয়ে আসামাত্র মহামিশ্র উঠে পড়লেন।—ভট্টরাই তুমি এই মুহূর্ত থেকে দায়িত্বভার নাও। কোন পরিচারক-পরিচারিকা যারা বাইরে থেকে আসে তারা আজ বাড়ি যেতে পারবে না। তাদের গৃহে নীলাকার সংবাদ পাঠিয়ে দেবে। তাদের রাতের আহারের ব্যবস্থা এখানেই হবে। আমি আচার্যকে নিয়ে সম্রাটের কাছে যাচ্ছি। না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।

ভট্টরাই বলল, চিন্তা করবেন না। আমি আছি।

ভট্টরাই তার কাজ শুরু করে দিল। করণীকের কাছ থেকে জেনে নিল ক-জন বাইরে থেকে আসে। তারপর তাদের ডেকে পাঠাল। এক সময় সে কাজ শেষ করে আসনে আরাম করে বসে চোখ বন্ধ করল। আশ্চর্য! ঠিক সেই মুহূর্তে কমলিকা যেন তার বন্ধ চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। সম্রাট ১৪০

তোমাকে বিশেষ অধিকর্তা হিসাবে নিয়োগ করেছেন! আমার প্রাণ রক্ষার দায়িত্বও কি তোমার হাতে?

শুধু তোমার কেন? সম্রাট এবং আরও সকলের।

চোখ খুলে ফেলল ভট্টরাই। মনের মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে যাওয়া এক চঞ্চলতা আবার জেগে উঠল।—কমলিকা তার মাথার ওপরই রয়েছে।হয়ত শুয়ে আছে। নয়ত কারোর সঙ্গে গল্প করছে। না-না। তা সম্ভব নয়। সে এখন উৎকণ্ঠিত ভাবে সম্রাটের কক্ষে রয়েছে। দেখছে আচার্য চরকের চিকিৎসা!

.

সম্রাটের শয্যার কিনারায় একটি আসনে দন্ড খানেকের অধিক সময় ধরে বসে আচার্য চরক সম্রাটের দিকে চিন্তিত ভাবে তাকিয়ে ছিলেন। ঔষধী প্রয়োগ করেছেন জ্ঞান ফেরাবার জন্য।

এক সময় সম্রাটের জ্ঞান ফিরে এল। আচার্যকে সামনে বসে থাকতে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসতে গেলেন সম্রাট।—আমার কী হয়েছে আচার্য? আপনি!

আচার্য সম্রাটকে চেপে ধরে শুইয়ে দিয়ে বললেন, চুপ। কোনও কথা নয়। তারপর তাঁর হাতের নাড়ির স্পন্দন অনুভব করা শুরু করলেন। এক সময়ে তাঁর মুখে সন্তোষের রেখা ফুটে উঠল। চরক এবার কক্ষে উপস্থিত পরিচারিকা, প্রাসাদ-রমণীদের দেখে নিয়ে মহামিশ্রকে কাছে ডাকলেন। মহামিশ্র কাছে আসতেই তিনি বললেন, সম্রাট এখন কম করে তিন সপ্তাহ বিশ্রাম নেবেন এবং ঔষধী সেবন করে যাবেন। শয্যা থেকে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওঠানামা করবেন না। তাও একা নয়। কারোর সাহায্য নিয়ে তিনি স্নান-ঘর ইত্যাদিতে যাবেন।

সম্রাট হঠাৎ বলে উঠলেন, মহামিশ্র—বাসিষ্ক?

মহামিশ্র বললেন, গূঢ়পুরুষটি তো বলল, যুবরাজ সুস্থ আছেন।

সমাজ-উৎসবে তাকে ডেকে পাঠাব। উদ্বোধনের দিনে সে থাকতে পারেনি।

কথাবার্তা একেবারে বলার চেষ্টা করবেন না। ভুলে যাবেন না, আপনি সম্রাট হতে পারেন, কিন্তু এখন আয়ুর্বেদাচার্য চরকের এক রোগী মাত্র। আমার আদেশ আপনাকে মান্য করতেই হবে। চরক বললেন।

সম্রাট আবার কিছু বলার চেষ্টা করতেই আচার্য চরক আবার বলে উঠলেন, “সম্রাট! ভুলবেন না যে প্রাণটা আপনার নিজস্ব নয়। এই প্রাণের ওপর সাম্রাজ্যের শত সহস্র মানুষের প্রাণও নির্ভর করছে। আপনার যোগ্য লোকের অভাব নেই; মহামিশ্র রয়েছেন, মন্ত্রীরা রয়েছেন, গুণবর্ধন, নীলাকার রয়েছেন। মথুরায় পুত্র বাসিষ্ক রয়েছে। সম্প্রতি আর একটি সেবককে তো এনেছেন দেখছি—ভট্টরাই। সবাই মিলে আপনার কিছুদিনের অনুপস্থিতি সামলে নিতে পারবে। ক’দিন পর থেকেই আপনি শয্যায় শুয়ে শুয়েই নির্দেশ দিতে পারবেন। তাঁরা সব যথাযথভাবে পালন করবেন। কী মহামিশ্র? কিছু ভুল বললাম কি?”

মহামিশ্র বললেন, “মোটেও নয়।”

সম্রাট হতাশ হয়ে চোখ বুজলেন। চরক উঠে দাঁড়িয়ে মহামিশ্রকে ডেকে বাতায়নের দিকে নিয়ে গেলেন।— “একটু কথা আছে।”

একটু একান্তে গিয়ে চরক প্রশ্ন করলেন, “কণিষ্কপুরে বৈদ্যরা সম্রাটের রোগ লক্ষণ সম্পর্কে কিছু বলেছিল?”

“হ্যাঁ। সান্নিপাতিক।”

“মূর্খ! শুনুন মহামিশ্র! সম্রাটের হৃৎপিণ্ডের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। হৃৎপিণ্ডে একটু মৃদু আঘাত তিনি পেয়ে গেছেন। ভয়ানক পুনরাবৃত্তি যেকোনো সময় ঘটতে পারে। অবশ্য ঔষধীতে এর প্রতিকার রয়েছে। সম্রাটের নাড়ির গতি পরিমাপ করলাম। এ যাত্রায় তিনি বেঁচে যাবেন—অবশ্য কিছুদিন তাঁকে সাবধানে রাখতে হবে। উত্তেজনা বা চিন্তা করার কোনো ঘটনাই যেন না ঘটে।”

“স্মরণ থাকবে আচার্য। কিন্তু সামনেই সমাজ-উৎসব। এ সময়েই সম্রাট অসুস্থ হয়ে পড়লেন!”

আচার্য বললেন, “সমাজ-উৎসব প্রতি বছরই হবে। তবে উৎসবের আগে সম্রাট আশা করি যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠবেন। বাইরে না হোক, প্রাসাদের ভেতরে কিছু হাঁটা-চলা এবং প্রশাসনিক নির্দেশ দিতে পারবেন—অবশ্য যদি নিয়মিত ঔষধীগুলি সেবন করিয়ে তাঁর নিপুণ সেবা করা যায়। প্রাসাদ-রমণীদের মধ্য থেকে দু-একজন কি সম্পূর্ণভাবে সম্রাটের সেবার দায়িত্ব নিতে পারবে? বিশেষ করে আজ রাত্রে? আমি সম্রাটকে নিদ্রার ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি, তাঁর গভীর ঘুমের প্রয়োজন।”

মহামিশ্র বললেন, “সম্রাট সব প্রাসাদ-রমণীদের পছন্দ করেন। অন্তত কারোর বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিনি। তবে ইদানীং মণিকার পুত্রীকে একটু বেশি পছন্দ করছেন বলে মনে হয়।”

“কমলিকা পছন্দ করারই যোগ্য। তবে তাকেই আজ রাত্রে সম্রাটের পরিচর্যার জন্য রাখুন। কাল সকালে, পরপর কয়েকটি নামের তালিকা তৈরি করে ফেলুন। এই তালিকায় চার-পাঁচজনের বেশি নাম না রাখাই ভালো।”

মহামিশ্র বললেন, “সম্রাটের এই অসুস্থতার সংবাদ তো গোপন রাখা সম্ভব নয়। রাজসভায় কালই প্রশ্ন উঠবে।”

চরক বললেন, “কেন? অসুবিধা কোথায়? বলবেন সান্নিপাতিক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন সম্রাট। কণিষ্কপুরের বৈদ্যদের কথাই মেনে নিন। ঐ কথাই সবাই জানে।”

“সবাই তো দেখা করতে চাইবেন।”

“এই অবরোধে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোনো পুরুষের প্রবেশ তো নিষেধ। তা ছাড়া বলবেন, চরক নির্দেশ দিয়েছেন, সম্রাটের পক্ষে কথা বলা বারণ। শয্যা ত্যাগও নিষিদ্ধ। তবে দূর থেকে দেখেই তাঁরা যেন চলে যান। কাছে যেতে দেবেন না। তারপর একটু সুস্থ হলে দেখা যাবে।”

চরক সম্রাটের শয্যার কাছে ফিরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থেমে বললেন, “আর একটা কথা। মণিকার পুত্রীকে ডেকে দিন। রাতের ঔষধীগুলি আমি তাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। অবশ্য আমি ফিরে গিয়ে আমার দেবল নামে এক যোগ্য শিষ্যকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রাতের ঔষধীর দায়িত্ব সে নিয়ে নেবে। শুধু সম্রাটের ঘরের কাছাকাছি কোথাও তার থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। রাতটি একটু বিপজ্জনক হয়ে উঠতেও পারে। একজন বার্তাবাহককে প্রস্তুত রাখবেন যাতে প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে আমায় নিয়ে আসতে পারে। তবে হ্যাঁ, ভট্টরাইয়ের অশ্ব চড়তে আমি আর প্রস্তুত নই। অশ্ব না ঝড়!”

মহামিশ্র হাসলেন।— “চিন্তা করবেন না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একটি অশ্বশকট আমি সদা প্রস্তুত রাখছি আপনাকে দিয়ে আসা—নিয়ে আসা করার জন্য।”

চরক বললেন, “হ্যাঁ। ভট্টরাই বা আমাকে কেন আনতে গেল?”

“ও! আজই সম্রাট তাঁকে আমার সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। সে এখন প্রাসাদের বিশেষ অধিকর্তা।”

“আনন্দ সংবাদ! আশীর্বাদ করি সে আরও উন্নতি করুক!”

সম্রাটের হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার সংবাদে কমলিকা কেমন যেন মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিল। তার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে সম্রাটের মাথায় বুকে হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু তা সম্ভব নয়। সম্রাট তার ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। তাই সম্রাটের ঘরে অন্যান্য প্রাসাদ-রমণীদের সঙ্গে সে ছুটে গেলেও চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। উপায় নেই। ইতিমধ্যেই তো সে অধিকাংশের কাছে ঈর্ষার বস্তু হয়ে উঠে সময় বিশেষে নানান বক্রোক্তি শুনছে। কমলিকা অবশ্য প্রতিবাদ করে না। শুনে যায় আর মনে মনে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করে—সম্রাটকে সে অধিকার করবেই। এমনই এক বলিষ্ঠ, ক্ষমতাবান, স্থিতধী মানুষকে সে মনের গভীরে লালন করে এসেছে। সম্রাটের কিছু গুণ ভট্টরাইয়ের মধ্যে প্রতিফলিত হলেও পরিমাণগতভাবে তা অতি ক্ষীণ। সম্রাট বিশাল, বিপুল! তাই সম্রাট—সম্রাটই আর ভট্টরাই এক সেনানী মাত্র। বাধা তো আরও—বৈভবের! সুতরাং স্বার্থবাদী হতেই হয়েছে কমলিকা’কে। না। ভট্টরাইকে সে ভুলবে না। সাধ্যমতো উপকার করবে। সে প্রতিষ্ঠিত হোক। তার যোগ্যতা রয়েছে। ভট্টরাইয়ের প্রয়োজন শুধু কিছু যোগাযোগের। বন্ধু হয়েই থাক ভট্টরাই। মাঝে মাঝে নিজের ব্যবহারেই নিজে অবাক হয় কমলিকা। জীবনে দু-চারজন তরুণের সঙ্গে তার আলাপ হয়নি এমন নয়। কিন্তু তারা কেউই তো ভট্টরাইয়ের মতো মনে দাগ ফেলেনি! তার চিন্তার খোরাক হয়নি। আশ্চর্য! কতটুকুই বা তাদের আলাপ! কেন সে ভট্টরাই সম্পর্কে এক অপরাধবোধ অনুভব করে?

সম্রাটের এক মৃদু আর্তনাদে সচকিত হয়ে উঠল কমলিকা। সম্রাটের বুকে কষ্ট হচ্ছে—যদিও আচার্য চরকের ঘুমের ঔষধীতে তিনি গাঢ় আচ্ছন্ন! কমলিকা ভাবল, সম্রাটের যন্ত্রণা তার বুকে বাজছে কেন? সে কি সত্যই সম্রাটকে ভালোবেসে ফেলেছে? কিন্তু সম্রাট যে তাঁর প্রতি আকর্ষণ প্রকাশ করছেন—সেটা সম্ভবত বাহ্যিক। কারণ, কণিষ্কপুরেও সে লক্ষ্য করেছে, সম্রাট যে সাগরে ডুব দিয়েছেন সেখান থেকে তাঁর আবার পাড়ে এসে ওঠা মুশকিল। সম্রাট যদি সত্যিই আশু সংসার জীবনে প্রবেশ করার ইচ্ছা প্রকাশ না করেন তাহলে তার এই ভালোবাসার পরিণামই বা কী হবে? সে কি অনুঢ়া থেকে যাবে? তার দেহের কামনা কি নীরবে-নিভৃতে মাথা কুটে মরবে? সে পুরুষ নয়—নারী। যতদিন দেহে যৌবন পূর্ণমাত্রায় থাকবে ততদিন পুরুষের চোখে তার মূল্য। সে সৌন্দর্যও যদি অপেক্ষা করতে করতে মিলিয়ে যায় শূন্যে তবে তার আর কী থাকবে? সম্পদ গেছে। ভালোবাসাটুকুও যাবে? হ্যাঁ সে সম্রাটকে—ঐ পত্নীহীনা অসহায় পুরুষটিকে ভালোবেসে ফেলেছে। না। ধনসম্পদ নয়, ক্ষমতা—বৈভবও নয়। সে চায় তার কল্পলোকের মানুষটির কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। সম্রাটের কক্ষে পা দিয়েই তার মনে হয়, এ তার নিজের কক্ষ। এ তার নিজের শয্যা! তাই তো মনপ্রাণ দিয়ে সে এই কক্ষ-সজ্জা করে। সম্রাটের আলিঙ্গনকে অনুভব করার চেষ্টা করে। এই মুমূর্ষু সম্রাটকে সে নিজের দায়িত্বে সেবা করতে চায়। কিন্তু তার সুযোগ কোথায়? সে সম্রাট-দখল-প্রতিযোগী দলের এক সদস্যা ভিন্ন তো আর কেউ নয়! নির্লজ্জের মতো সে সেই অধিকার প্রার্থনা করতেও পারে না—যদিও কমলিকা জানে, অন্যান্য প্রাসাদ-রমণীদের বেশির ভাগ সম্রাটের শয্যায় অংশ গ্রহণ করতে যতটা উৎসাহী—তাঁর সেবার জন্য ততটা নয়। দোষও দেওয়া যায় না, এরা সবাই বিত্তশালী ঘরের মেয়ে। সেবা নিতে অভ্যস্ত—করতে নয়। যদিও তারাও ছিল এক উচ্চশ্রেণির পরিবার। কিন্তু এদের তুলনায় কিছু নয়। বাবার পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত রত্নরাশির কোনো বাস্তব মূল্য ছিল না—যতক্ষণ না তা অর্থে পরিণত করা যেত। পেটিকাবদ্ধ হয়ে তারা ছিল মূল্যহীন। বাবা জীবিত থাকলেও বোধহয় একই হোত। বাবা ঐ রত্ন বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করতেন না। তাই ব্যবসার কল্যাণে তারা হয়তো যথেষ্ট ধনী ছিল। কিন্তু বিপুল ধনী নয়। ফলে, তাদের গৃহে প্রয়োজনীয় দাসদাসী থাকলেও ‘সেবা” নামক জিনিসটির দিক থেকে তারা দূরে ছিল না। বাবা অসুস্থ হয়েছেন, মা অসুস্থ হয়েছেন সে নিজেও হয়েছে। পরস্পর পরস্পরকে সেবা করে সুস্থ করে তুলত। রাত্রি জাগরণও হোত কখনও কখনও। মোটকথা—এসব কিছু তার কাছে নতুন নয়।

মহামিশ্রের মৃদু ডাকে চমক ভাঙল কমলিকার, নিঃশব্দে সে এগিয়ে গিয়ে সম্রাটের শয্যার কাছাকাছি দাঁড়াল।— “আজ্ঞা করুন, মহামিশ্র।”

“তুমি কি একটি গুরুদায়িত্ব নিতে প্রস্তুত?”

“কী দায়িত্ব, ভন্তে?”

“আজ রাতে সম্রাটের পরিচর্যার ভার তোমাকে দিতে চাই।”

কেঁপে উঠল কমলিকা। বুদ্ধের করুণাঘন মুখ যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল।— “আমি প্রস্তুত, মহামিশ্র। বলুন, আমায় কী করতে হবে? কিন্তু আমার অন্য সহকর্মিণীরা?”

“সবাই এক এক করে সুযোগ পাবে। অবশ্য তারা যদি কেউ রাজি থাকে। সম্রাট ইদানীং তোমাকে পছন্দ করছেন, তাই প্রথম সুযোগটা তোমাকেই দিতে চাই।”

আচার্য চরক নীরবে লক্ষ্য করছিলেন কমলিকাকে।— “ভয় কী, মা? এসো, আমি করণীয় কর্ম ও ঔষধীগুলি তোমায় বুঝিয়ে দিই। অবশ্য আমি আশ্রমে গিয়ে আমার এক শিষ্য দেবলকে পাঠিয়ে দেব। সে তোমার পাশের ঘরেই থাকবে। সুতরাং, চিন্তার কিছু নেই মা!”

কমলিকা মৃদু হেসে বলল, “আমি চিন্তা করছি না আচার্য। ভাবছি, এ আমার পরম সৌভাগ্য। আপনি বুঝিয়ে দিন।”

.

সেদিন রাত্রে কার্যালয়ের নিভৃত কক্ষে বসে ছিলেন জাঙ্ক আর হিউ-পিনানের প্রতিনিধি। তিনি নিয়ে এসেছিলেন প্রভূত অর্থ। সঙ্গে দশজন ঘাতকের একটি দল। তারা বৌদ্ধ শ্রমণের বেশে বস্থের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রয়েছে। অবস্থান করছে পুরুষপুরের সঙ্ঘারামে। বল্গের মূল প্রতিনিধি দল ইতিমধ্যেই ফিরে গেছে। কিন্তু শ্রমণবেশী ঘাতকের দল বলেছে এত পরিশ্রম করে তারা এদেশে এসেছে। তাই, বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি না দেখে তারা ফিরবে না।

সঙ্ঘারামের আচার্য সংঘরক্ষিত অনুমতি দিয়েছেন।

ঘাতকের দল বলছে নগরাধ্যক্ষ জাঙ্ক তাদের দেশের মানুষ—পরমাত্মীয়। তাঁর সঙ্গে দেখা করে—কয়েকদিন কাটিয়ে তবেই আমরা অন্য জায়গায় যাব। তবে শুনেছি, দেশজুড়ে আসন্ন সমাজ-উৎসবের কথা। সেই উৎসব না দেখে আমরা নড়ছি না।

সংঘরক্ষিত বলেছেন, “নিশ্চয়! সেই উৎসব না দেখলে জীবনই বৃথা। দেশের আপামর জনসাধারণ সেই উৎসব নিয়ে মাতবে। সনাতনপন্থীরা ঘৃণ্য পশুবলি উৎসব পালন করবে। সম্রাট অশোক—সমাজ-উৎসবে এই ঘৃণ্য বলিদান প্রথা রদ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সময় আর রাজনীতির সুযোগ নিয়ে তারা আবার মেতে উঠেছে। আমরা শীঘ্রই সম্রাটকে এই পশুবলি প্রথা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানাব। সম্রাট অ-ভারতীয় হবার জন্য এ ব্যাপারে যথেষ্ট দৃঢ় হতে পারছেন না। ভারতীয় হবার কল্যাণে যা সম্রাট অশোকের পক্ষে সহজসাধ্য ছিল—সম্রাট কণিষ্কের পক্ষে সেটা ততই দুরূহ। আরও অসুবিধা হচ্ছে, পূর্বতন দুই সম্রাট ছিলেন শৈবধর্মী। তাঁদের সময়েই সনাতনপন্থীরা সুযোগ পেয়ে গেছে!”

হিউ-পিনানের প্রতিনিধিই জাঙ্ককে ঘাতকদের কথাগুলি বলল। শুনলে তো—তারা বলেছে তুমি তাদের পরমাত্মীয়। সুতরাং তোমার সঙ্গে সময়-অসময় তাদের দেখা করতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়।”

জাঙ্ক বললেন, “সে তো নিশ্চয়। যাহোক, মন্ত্রী ইউনাস প্রাসাদের একটি নকশা আমার কাছে কাল পাঠিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন। ঘাতকেরা তা এখানে বুঝে নিয়ে কণ্ঠস্থ করে নেবে।”

হিউ-পিনানের প্রতিনিধি বলল, “ধর্মীয়গোষ্ঠীর নেতারা তো ব্যর্থ হল। তাদের গোষ্ঠীর সমর্থকেরাই এই অশান্তি পছন্দ করেনি। যা হোক, আমি মন্ত্রী ইউনাস, ভার্গব আর দুবলের কাছে শুনেছি, তোমার কথা মতো নিম্ন-সিন্ধুর পহ্লব সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়ে গেছে। তারা বন্দরগুলি অধিকার করে সসৈন্যে পুরুষপুরের দিকে এগিয়ে আসবেন। তাঁদেরই একটি দল, পাশ দিয়ে পূব দিকে সরে গিয়ে প্রয়াগের রাস্তা অবরুদ্ধ করবে যাতে বাসিষ্ক মথুরা থেকে পুরুষপুরে আসতে না পারে। ওদিকে চৈনিক অভিযানের নামে হিউ-পিনান নিজে সেনা সজ্জিত করে হিন্দুকুশের কাছে এগিয়ে আসবেন। প্রয়োজনে সেই সেনারা দুভাগ হয়ে গিয়ে—একদল হিন্দুকুশ পার করে কপিশা, তক্ষশিলা-পুষ্কলাবতী হয়ে পুরুষপুরের দিকে এগিয়ে আসবে। অন্যদিকে আর একদল পামির পার করে কশ্যপপুরা হয়ে দক্ষিণে বাসিষ্ক-প্রতিরোধকারী সেনাদের সঙ্গে মিলবে। এসব ঘটনার সূত্রপাত ঘটবে সমাজ-উৎসবের কদিন আগেই। হ্যাঁ, তোমাকে সহায়তা করার জন্য সমাজ-উৎসবের দিন দশেক আগে থাকতেই প্রায় দু-সহস্র সেনা, ছোটখাট দলে বিভক্ত হয়ে কাঠুরিয়া এবং কৃষিজীবির ছদ্মবেশে পুরুষপুরের উত্তর-পাহাড়ের বুকে ঐ গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেবে। সমাজ-উৎসবের দিন এক জ্বলন্ত তির রাতে পাহাড় লক্ষ্য করে ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা পাহাড় থেকে নেমে এসে নগর তোরণ এবং নগর প্রাচীর পার করে নগরে ঢুকে পড়বে নিঃসন্দেহে। তারা এগিয়ে যাবে সৈন্যাবাসের দিকে। সমাজ-উৎসবের রাত্রে প্রতিবছর যা হয়—এবারেও তা হবে নিশ্চয়। সবাই মদ্যের প্রভাবে আচ্ছন্ন থাকবে—নয়ত নারী-ক্রীড়ায় মত্ত থাকবে। কিন্তু একটা কথা!”

“কী কথা!”

“সৈন্যাবাসে এখন সৈন্য সংখ্যা কেমন?”

“হাজার তিরিশেক হবে। বাকি সবই পুরুষপুরের বাইরে বিভিন্ন নগরে রয়েছে।”

“চিন্তিত প্রতিনিধি বলল, “না। হাজার তিরিশ সৈন্য আমাদের দু’হাজার সেনার পক্ষে যথেষ্ট ভারি হয়ে যাবে। আমাদের এক উপায় অবলম্বন করতে হবে।”

“কী উপায়?” জাঙ্ক বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন।

“উপায় খুব সরল ও সোজা। সম্রাট আজই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সান্নিপাতিক! চরক বলেছেন প্রায় তিন সপ্তাহ যেন সম্রাট শয্যা ছেড়ে না ওঠেন। অর্থাৎ রাজকাজ তিনি এসময়ে প্রায় দেখতেই পারবেন না। সম্রাটবিহীন রাজসভা চলবে। দায়িত্ব বর্তাবে মন্ত্রী পরিষদের ওপর।”

“হ্যাঁ। তাতে কী?”

“সিন্ধুর বিদ্রোহটা আমাদের এমন সময় করতে হবে যেন রাজকীয় সেনার সিংহভাগ সেই বিদ্রোহ দমন করতে সমাজ-উৎসবের আগেই বেরিয়ে যায়।”

জাঙ্ক বললেন, “চমৎকার! কিন্তু গুণবর্ধন যদি অন্যস্থানের সেনাদের পাঠায়? কোংকন, সৌরাষ্ট্র থেকেও তো সেনারা যেতে পারে।”

“এখানেই কাজ করতে হবে ইউনাস, ভার্গব আর দুবলকে। মন্ত্রী পরিষদকে সিদ্ধান্ত নেওয়াতে হবে যেন পুরুষপুর থেকেই সেনা যায়। কারণ, ঐ সব স্থানেও শক-পহ্লবেরা বিদ্রোহ করতে পারে। মন্ত্রী পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত হলে অসুস্থ সম্রাটের সাক্ষর আদায় করা কোনো কঠিন কাজ হবে না। মন্ত্রী পরিষদের এই সিদ্ধান্ত সম্রাট ঐ অবস্থায় গ্রহণ না করে পারবেনও না।”

জাঙ্ক উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।— “চমৎকার! চমৎকার! কণিষ্ক এই সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে আমাদের সুবিধাই করে দিল। বাকি রইল রাজপ্রাসাদ অধিকার করা। সে আমি আমার নগর প্রহরীদের বাহিনী নিয়েই পারব। সম্রাট নিহত হয়েছেন শুনলে তারা আর আমার অমতে যেতে সাহস করবে না! সম্রাটকে আমি বলেছিলাম, সমাজ-উৎসবের দিন আমি আমার সব হিসাব মিটিয়ে দেব! পরপার থেকে কণিষ্ক সব হিসেব বুঝে নেবে।” অট্টহাস্য করে উঠলেন জাঙ্ক।

হিউ-পিনানের প্রতিনিধি বলল, “ধীরে। জাঙ্ক ধীরে। আর সামান্য কটা দিন। এই সময়েই আমাদের ভীষণ সতর্কতার প্রয়োজন!”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন