অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়
বন্ধনাগারে একটি অপরাধীকে সেবা করে আসার পর নগরাধ্যক্ষ জাঙ্ক নিজের কক্ষে বসে আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিলেন। নিয়মিত বন্ধনাগারের সেবা তাকে প্রফুল্ল করে তোলে। আর তখনই তার চিন্তাশক্তি বেড়ে যায়। আকাশ-পাতাল চিন্তায় তিনি ডুবে যান। আজও চিন্তা করতে করতে তিনি রত্নঘাটে এসে ঠেকলেন। ভাবছিলেন বিপুল রত্ন তো তিনি করায়ত্ত করলেন। এরপর? রত্নগুলি মণিকার সুকান্তের সাহায্যে নানান স্থানে বিক্রি করে বিপুল অর্থও তিনি সংগ্রহ করতে পারেন। তারপর কর্মত্যাগ করে রাজসুখে বাকি জীবনটা কাটাতেও পারেন। কিন্তু সেই রাজসিক সুখ তো কৃত্রিম। তিনি প্রকৃত রাজসুখ ভোগ করতে চান। কণিষ্কের চেয়ে তিনি কম কিসে? একই ইউ-চি রক্ত তাঁরও শরীরে বয়ে চলেছে। অসহ্য এই কুষাণ-কুল। এদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতেই হবে। কুষাণ আধিপত্য তাঁর আর সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু উপায় কী? ভাবলেন, তাঁর নিজের গোষ্ঠীর এবং অনুগত মানুষজন এই পুরুষপুরে কম নেই। তাদের সাহায্য নিয়ে তিনি কি অধিকার করতে পারবেন না এই পুরুষপুরের রাজসিংহাসন? তিনি জানেন, কুষাণ ছাড়া অন্য চারটি গোষ্ঠীর অনেক মানুষ কণিষ্কের এই বুদ্ধ-ভজনা এবং তাঁর নিস্তেজ হয়ে পড়ার বিষয়টিকে সমর্থন করছে না। তাদের অনেকেই সনাতন ধর্মীদের শৈব শাখার অনুরাগী। স্বভাবতই বৌদ্ধদের সঙ্গে তাদের বিবাদ রয়েছে। সম্রাটের ভয়ে তারা কিছু করতে পারে না।
জাঙ্ক তার থলি থেকে একটি হীরক বার করে চোখের সামনে ধরলেন। হীরকটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে তার মন খুশিতে ভরে উঠল। মনে মনে তিনি বললেন, তাঁর হাতে এখন প্রভূত ধন। একে তাঁর ভাগ্য গড়ার কাজে লাগাতে হবে। কণিষ্ক এখন অকর্মা। তাকে পুরুষপুর থেকে দূর করতে হবে। বাসিষ্ককে বলে দেওয়া হবে, পিতাকে সাহায্য করতে সিন্ধুতীরে এলে তারও জীবন বিপন্ন হবে। সে যেন মথুরা নিয়েই আপাতত সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু জাঙ্ক শেষ পর্যন্ত আকাশ-কুসুম কল্পনা ছেড়ে বাস্তবের মুখোমুখি হল।—না! এ তার একার কাজ নয়। কোনো বলিষ্ঠ সাহায্যের প্রয়োজন। কণিষ্কের বিরুদ্ধে উত্থান ঘটাতে গেলে তার মিত্রের প্রয়োজন। কে বা কারা সেই মিত্র হবার উপযুক্ত? অন্যদিকে তিনি যদি কুষাণদের ভারতীয় সাম্রাজ্য অধিকার করেন—তাহলে বন্থের প্রশাসক হিউ-পিনান কি চুপ করে বসে থাকবেন? হোক না তিনি তাঁর গোষ্ঠীর লোক—তাঁর নিকট আত্মীয়। সাম্রাজ্য অধিকারের সময় কোনো সম্পর্কই বিবেচ্য হয় না। বরং তিনি হিউ-পিনানকে তাঁর দলভুক্ত করার চেষ্টা করতে পারেন। দীর্ঘকাল প্রশাসক থাকতে থাকতে তাঁরও নিশ্চয় ঘৃণা ধরে গেছে। হিউ-পিনান আজকালের মধ্যে পুরুষপুরে আসছেন। কৌশলে তাঁকে জয় করতে হবে।
.
সাম্রাজ্যের নানান অংশের প্রশাসক বা উর্ধতন রাজপুরুষদের সম্রাটের সভায় আনাগোনা এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই জাঙ্ক কাউকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য নগর তোরণে ছোটেন না। কিন্তু আজ হিউ-পিনানের আগমনে তাঁকে নগর তোরণে দেখা গেল।
অঙ্গরক্ষকদের নিয়ে হিউ-পিনান সবে তোরণে প্রবেশ করছেন -জাঙ্ক ঠিক সেই সময়ে উপস্থিত হয়ে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিলেন। কিন্তু সবার মুখের ছবি দেখে তাঁর সম্বিত ফিরল। কাজটা ঠিক হয়নি। সম্রাট বর্তমানে—সম্রাটের নগরে এক প্রাদেশিকের নামে জয়ধ্বনি! হিউ-পিনানও ব্যাপারটি বুঝতে পেরে জাঙ্ককে ডাকলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “তুমি কি উন্মাদ হয়ে গেছ জাঙ্ক! আবেগ সংযত কর। আমাকে সম্মান কর, তা স্বতন্ত্র কথা!”
জাঙ্ক হেঁ হেঁ করে বলল, “মাথার ঠিক ছিল না, প্রাদেশিক! অনেক দিন পর দেখা হল তো! হাজার হোক আমাদের শরীরে একই গোষ্ঠীর রক্ত বইছে। আপনাকে দেখে আনন্দ হচ্ছিল!”
হিউ-পিনান সন্দিগ্ধ ভাবে তাকালেন জাঙ্কের দিকে।—”এসব আবার কী বলছ! রক্ত! আমাদের সকলের মধ্যেই তো সেই আদি ইউ-চিদেরই রক্ত বইছে! গোষ্ঠী…এসব ঠিক সংগত কথা নয়।”
জাঙ্ক একটু দমে গেলেন। বুঝতে পারলেন না হিউ-পিনান সম্রাটের পক্ষে? নাকি জনসমক্ষে এই সমস্ত কথা বলছেন? রাজনীতিক তো!
জাঙ্ক বললেন, “ক’দিন থাকছেন পুরুষপুরে?”
হিউ-পিনান বললেন, “ঠিক নেই। দু-তিন দিন হতে পারে। আসলে পার্থিয়া আর কাশগড়কে নিয়ে একটা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে পহ্লবেরা অন্যদিকে চৈনিকরা। তাই সম্রাটের সঙ্গে পরামর্শ করতে এলাম। চিঠিপত্রে তো এসব আলোচনা হয় না।”
জাঙ্ক বললেন, “সে তো নিশ্চয়। সম্মুখ ছাড়া কোনো আলোচনাই সিদ্ধ হয় না। যাক, সম্রাট নিশ্চয় আপনার সম্মানে নৈশভোজ দেবেন। তা ঠিক আছে, আগামীকাল রাত্রে আমার কার্যালয়ে একবার পদধূলি দিলে ধন্য হব। জানেন তো ঐটিই আমার গৃহ। নগরাধ্যক্ষের ব্যক্তিগত জীবন থাকতে নেই।”
হিউ-পিনান হাসলেন, “তা বটে—তা বটে। তা কি তোমারও কিছু আলোচনা আছে?”
“হ্যাঁ, প্রাদেশিক। আমি স্থান পরিবর্তন করতে চাই। এই পদে আর থাকতে চাই না। আপনিই তো আমার সব। তাই প্রথমে আপনার সঙ্গে…”
“চিন্তা কোর না।” হিউ-পিনানের রথ এগিয়ে গেল।
জাঙ্ক হিউ-পিনানের রথের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ভাবলেন, এই হিউ-পিনানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এই নগরাধ্যক্ষের পদটি লাভ করেছিলেন। হিউ-পিনানই তাঁর সপক্ষে সম্রাটকে প্রভাবিত করেছিলেন। এবার পুরুষপুরের অধিপতি হবার জন্য এই হিউ-পিনানেরই সাহায্য নিতে হবে।
অদূরে বিষ্কের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল ভট্টরাই। কর্মজীবনে তাঁর সদ্য উন্নতি ঘটেছে। সহকারী তোরণরক্ষীর পদটি দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়েছিল। বিষ্কের ক্রমাগত আবেদনে শেষ পর্যন্ত সম্রাটের সম্মতি তে মহামিশ্র সাড়া দিলেন। বিষ্ককে তিনি একদিন প্রাসাদে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে পাঠালেন।
মহামিশ্রের আহ্বানে সাধারণ কর্মচারীদের ভয় পাবারই কথা। বিষ্ক তাই ভয়ে ভয়ে একদিন উপস্থিত হলেন প্রাসাদে।—”আজ্ঞে!”
বিষ্ককে বসতে বলে মহামিশ্র সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “তোমার সহকারীর পদটি খালি রয়েছে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“যদি পূরণ না করি…!”
“সে আপনার ইচ্ছা। যত দুরূহ-ই হোক না কেন, আমি উভয় পদের দায়িত্ব পালন করে যাব।”
“বেশ খুশি হলাম। এবার বল, ভট্টরাই ছেলেটি কেমন?”
“অতীব কর্মনিষ্ঠ। সপ্রতিভ। দক্ষ যোদ্ধা।”
“কী করে জানলে, সে অতীব দক্ষ? কোনো যুদ্ধে তো সে যায়নি!”
“আজ্ঞে তা নয়। প্রভাত-কর্তব্যের সময় সে অন্যদের সঙ্গে নিয়মিত অস্ত্রাভ্যাস করে। তোরণদ্বারে ধনুক এবং তলোয়ারে সেই সেরা। তার পিতাও অবসরপ্রাপ্ত এক সেনানী। জানেন নিশ্চয়?”
“হ্যাঁ জানি। এবার বল, তুমি ভট্টরাইকে তোমার সহকারী হিসাবে পেলে খুশি হবে কি না? নাকি তাকে স্থানান্তরে পাঠাব?”
“না। আমাকেই দিন ওকে। আমি খুশি হব।”
“বেশ। এবার তুমি আসতে পার। তোমার কথা আমি বিবেচনা করব।”
দু-একদিন পরেই সম্রাটের আদেশনামায় মহামিশ্র সাক্ষর করে পাঠালেন। ভট্টরাইয়ের পদোন্নতিতে তোরণের সবাই খুশি হয়ে উঠল। প্রায় সকলেই এই প্রাণচঞ্চল তরুণটিকে পছন্দ করে। ভট্টরাই নিজে শুধু অবাক হল। বিষ্ক তাকে আগে কিছুই জানাননি। তবে ভট্টরাই বুঝতে পারল, মহামিশ্র কমলিকাকে রক্ষা করার জন্য প্রতিশ্রুতি মতো পুরস্কার দিয়েছেন। মহামিশ্রের ওপর শ্রদ্ধায় তার মন ভরে উঠল। কিন্তু সে হঠাৎ ভাবল, কমলিকা কি জানে? নিশ্চয় জানে। তাকে কি সে ধন্যবাদ জানাবে? না। অর্থহীন হবে। কমলিকা বহু দূরে সরে গেছে। এ বরং ভালই হল। মাঝে সত্যিই সে কমলিকার চিন্তায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। মহাবিহার উদ্বোধনের দিনই সে সম্বিত ফিরে পায়। প্রাসাদ কর্মচারীদের সূত্রে সে জেনেছে, কমলিকা এখন অন্যতম প্রাসাদ-রমণী। তার সঙ্গে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে গেছে। নিজের কাজ নিয়েই সে সন্তুষ্ট থাকতে চায়।
বিষ্ক ভট্টরাইকে চিন্তাগ্রস্ত দেখে তার কাঁধ ধরে নাড়া দিলেন—”কী ভাবছ?”
“না। কিছু নয়।”
“জাঙ্কের জয়ধ্বনি শুনেছ?”
“হ্যাঁ। ওটা তৈলমর্দন। একই গোষ্ঠীভুক্ত কিনা। শুনেছি হিউ-পিনানেরই জন্য জাঙ্ক নগরাধ্যক্ষের পদটা পেয়েছে।”
বিষ্ক বললেন, “ঠিকই শুনেছ। ঐ দেখ জাঙ্ক এদিকেই আসছে।”
সত্যিই জাঙ্ক তার ঘোড়া নিয়ে বিষ্ক আর ভট্টরাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। “কেমন আছ বিষ্ক! সহকারী পেয়ে পরিশ্রম নিশ্চয় কমেছে!”
বিষ্ক হেসে বললেন, “নিশ্চয়। আপনিও মহামিশ্রের কাছে সহকারীর জন্য আবেদন করুন না। তিনি নিশ্চয় দেবেন। তবে একটা কথা, সেনাবাহিনীর কেউই আপনার সহকারী হতে চাইবে না বলে আমার বিশ্বাস।”
“কেন? কেন? আমি কি খারাপ লোক?”
“সে কথা বলিনি। আপনি এত কর্তব্যপরায়ণ যে তাদের তা সহ্য হবে না। কাজ ফাঁকি দেবার ফন্দী আর কি!”
“তা ঠিক বলেছ বিষ্ক। অলস কাউকে আমি চাই না।”
“হ্যাঁ। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।” বিষ্ক বললেন।
জাঙ্কের আর বলার মতো কোনো কথা হয়তো ছিল না। তাই তিনি বললেন, “আসি, অনেক কাজ পড়ে। যতসব চোর-বদমাশ নিয়ে আমার কাজ!” জাঙ্ক ঘোড়া ছোটালেন।
বিষ্ক অপসৃয়মাণ জাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বললেন, “জাঙ্ক যে ভাবে হিউ-পিনানের নামে জয়ধ্বনি করলেন—তা সম্রাটের কানে গেলে তিনি হয়তো রুষ্ট হবেন।”
“হতেই পারেন। গূঢ়পুরুষের অভাব নেই! তারা নিশ্চয় বিষয়টি সম্রাটের কানে তুলবে।”
বিষ্ক হঠাৎ প্রশ্ন করল, “জাঙ্ককে তোমার কেমন মানুষ বলে মনে হয়?”
“কেন? একথা তো সবাই জানে যে জাঙ্ক এক লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মাধ্যক্ষ। পুরুষপুরে তো তার প্রশংসা কেউই করে না।”
বিষ্ক বললেন, “জাঙ্কের নিশীথ রাত্রের গতিবিধি সন্দেহজনক।”
“কেন?”
“একটা গোপন কথা বলি। কদিন আগের এক রাত্রে জাঙ্ক কুবা নদীর তীরে গিয়েছিল। সম্ভবত কিছু খোঁজাখুঁজি করছিল। কুবা নদী বেয়ে এক জেলের নৌকো তখন উজানে যাচ্ছিল। আকাশে চাঁদ ছিল। ওরা তিনজন ছিল। দূর থেকে সে সবাইকে চিনতে না পারলেও জাঙ্ক যে তাঁর শকটের ওপর বসেছিলেন অন্য এক আরোহীর সঙ্গে—এবিষয়ে সে নিশ্চিত। পুরুষপুর ছাড়াও আশপাশ অঞ্চলের মানুষজন জাঙ্কের ছায়া দেখেও চিনে নিতে পারবে। তৃতীয় ব্যক্তিটি একটি গাছের তলার সম্ভবত কিছু খোঁড়াখুঁড়ি করছিল।”
ভট্টরাইয়ের মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “কমলিকার সেই রত্ন পেটিকার সন্ধান করছিলেন না তো? নিশ্চয় তাই। জাঙ্ক ছাড়া দুজনের একজন নিশ্চয় তাঁর শকট চালক। আর তৃতীয়জন সেই পলাতক দস্যু। এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়টি মহামিশ্রের কানে তুলে দিলে হয় না?”
বিষ্ক বললেন, “না। আরও কিছু অপেক্ষা করা যাক। দেখা যাক, নগরাধ্যক্ষ কী করেন। মণিকার-পুত্রী তো এখন প্রাসাদে অবস্থান করছেন। পেটিকা সম্পর্কে তার খুব একটা যে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। মণিকার-পুত্রীর মন খুব বড়। সারা পুরুষপুর জেনে গেছে যে তিনি তাঁর বিশাল ভূসম্পত্তিও আচার্য চরকের আশ্রমকে দান করেছেন।”
ভট্টরাই স্বগোতক্তি করল, “হ্যাঁ, খুবই ভালমানুষ মণিকার-পুত্রী। আমার সঙ্গে তার সাবলীল ব্যবহারেই তা বুঝেছি। তবে নগরাধ্যক্ষের ওপরে আমাদের লক্ষ রাখা উচিত। কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি দস্যুটিকে আশ্রয় দিয়েছেন। রত্নগুলিও নিশ্চয় তাঁর হস্তগত হয়েছে। গূঢ়পুরুষেরা তো তার ওপর অলক্ষে নজর রাখতে পারে।”
বিষ্ক হতাশ স্বরে বললেন, “যতক্ষণ না আমরা কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারছি ততক্ষণ আমাদের কথা কে বিশ্বাস করবে? বিশেষত জাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ!”
ভট্টরাই বলল, “আমরাই পারতাম—কিন্তু সময় কোথায়?”
বিষ্ক বললেন, “দূর! সারাদিন ধরে একাজ করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব? তার চেয়ে প্রাথমিকভাবে আমরা তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সহায়তা নিতে পারি। আমার সন্ধানে একজন ভিক্ষুক রয়েছে। সে দিনের বেলায় নগরের নানান স্থানে ভিক্ষা করে বেড়ায়। রাতে তার আস্তানায় ফিরে আসে। নগর-কার্যালয়ের বিপরীতে নানান গাছপালায় ঢাকা যে স্থানটুকু রয়েছে—ওখানেই একটি চালা বানিয়ে সে আজ অনেক বছর ধরে বাস করছে। তার চালা থেকে নগর-কার্যালয়ের প্রবেশ দ্বারটি স্পষ্ট দেখা যায়। আশা করি অর্থের বিনিময়ে রাত্রে সে ঐ প্রবেশ পথের ওপর দৃষ্টি রাখতে পারবে। তার চাহিদা মতো সামান্য অর্থের জোগান আমরা দুজনে নিশ্চয় দিতে পারি।”
ভট্টরাই বলল, “তাই করা যাক।”
বিষ্ক বললেন, “ঠিক আছে। পরে বাকিটুকু আলোচনা করা যাবে। সার্থবাহের দল নগরে প্রবেশ করার জন্য সার দিয়েছে। শুল্ক বিভাগের কর্মীরাও এসে গেছে। চল, ওদিকটা দেখি।”
শুল্ক বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে সার্থবাহ দলের একটা বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল। কণিষ্ক আর ভট্টরাই দ্রুত সেদিকে পা বাড়াল। এমন তর্ক-বিতর্ক সব সময়েই লেগে থাকে। কারণ, কিছু অসাধু শুল্ককর্মীদের জবরদস্তি।
.
কণিষ্ক রাতে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে কিছুটা অবাক হলেন। সম্প্রতি প্রাসাদ-রমণীরাই তাঁর শয্যাকক্ষের দায়িত্বে রয়েছে। তারাই দাসীদের সাহায্যে ঘর পরিষ্কার করায়। কিন্তু সাজায় নিজেরা। আজকের সজ্জার সঙ্গে যেন দূর অতীতের এক সুগন্ধ মিশে রয়েছে। তাঁর মনে পড়ে সুখী দাম্পত্য জীবনের সেইসব দিনের কথা। এই শয্যায় তিনি একদিন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে শয়ন করতেন। অনেক সুখময় রাত তিনি কাটিয়েছেন এই শয্যায়। তখন সম্রাজ্ঞী স্বয়ং তাঁর কক্ষসজ্জা করাতেন। তারপর এখন অনেক বছর পার হয়ে গেছে। সেসব স্মৃতিও এখন ধূসর হয়ে এসেছে। এখন তিনি একাকী-ই শয্যায় যান, একাই জেগে ওঠেন। সেবার অবশ্য কোনো কমতি নেই। পরিচারিকারা ছাড়া প্রাসাদ-রমণীরা রয়েছে। তারা সম্রাটকে খুশি করার জন্য সর্বদা উদগ্রীব। আহার থেকে শয়ন—সব সময় তারা উপস্থিত। কিন্তু রাতে সম্রাটের কক্ষে তাদের প্রবেশ নিষেধ। কণিষ্ক জানেন, এই সব কন্যাদের উদ্দেশ্য, মনোগত ইচ্ছা। এরা সকলেই প্রয়াত সম্রাজ্ঞীর স্থান অধিকার করতে চায়। অন্যথায় সম্রাটের উপপত্নী হতেও তাদের আপত্তি নেই। তাতেও তারা নিজেকে ধন্য জ্ঞান করবে। কিছুদিন আগে রাজ্যের সর্বস্তর থেকে তাঁর ওপর সংসার জীবনে প্রবেশ করার জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এমন কি অশ্বঘোষ, বসুমিত্র, সংঘরক্ষিত প্রমুখদেরও এ বিষয়ে অনুমোদন ছিল। তাঁরা বলেছিলেন, “বুদ্ধের গৃহী ভক্তও হওয়া যায়। সম্রাজ্ঞীর স্থান খালি থাকা উচিত নয়।” সম্রাট তাই সেই দাবি শর্তাধীনে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ঠিক আছে। বিবাহযোগ্যা কিছু কন্যাকে নির্বাচন করে এখানে আমার সেবার কাজে ব্যবহার করা হোক। যদি তাদের মধ্যে কেউ আমাকে প্রকৃতই সংসারমুখী করতে পারে—তাকেই আমি গ্রহণ করব।” সম্রাটের উদ্দেশ্য ছিল, এই ভাবেই তিনি শুভানুধ্যায়ীদের চাপ প্রতিহত করতে পারবেন।
কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর সম্রাট ক্রমশ নিজেকে বুদ্ধের পায়ে গভীর থেকে গভীরতর ভাবে নিক্ষেপ করছিলেন। কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি এক বিমল আনন্দের জগতে প্রবেশ করছিলেন। ফলত, প্রাসাদ-রমণীদের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব তাঁর কাছে ছিল না। তারা রাজপ্রাসাদ আলো করে রয়েছে—এই পর্যন্ত। সাম্রাজ্যের অভিজাতেরা তাদের বিবাহযোগ্যা কন্যাদের এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার জন্য উৎসাহিত করে তাদের পাঠিয়েছেন, এই আশায় যদি কেউ সম্রাজ্ঞী হতে পারে! সম্রাজ্ঞী না হোক অন্ততপক্ষে বিশাল কুষাণ সাম্রাজ্যের অধীশ্বরের উপপত্নী তো হতে পারবে! তাই কন্যারা ইচ্ছায় হোক—অনিচ্ছায় হোক, অভিভাবকদের চাপে এখানে এসে জড়ো হয়েছে। কিন্তু কন্যারা সম্রাটের যোগীমূর্তি দেখে প্রতিদিনই নিরাশ হয়। আবার প্রভাতে নতুন উৎসাহে জেগে ওঠে। সম্রাটের ধ্যান ভঙ্গ করে তাঁকে আবার রক্ত-মাংসের মানুষ হিসাবে জাগিয়ে তুলতে হবে! এ বড় কঠিন সাধনা!
কণিষ্ক ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে শয্যার প্রান্তে বসলেন। ঘরের ভেজানো দ্বারের পাশে তাঁর প্রহরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সার সার রক্ষিণী। কিন্তু আজ তাঁর এই কক্ষে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য কেউ নেই। কেউ তাঁকে জড়িয়ে ধরে শয্যায় বসাবে না। এক সময় তাঁর পোশাক পরিবর্তন স্ত্রী-ই নিজের হাতে করে দিত। আজ আর কেউ নেই। শেষের দিকেও কেউ ছিল না। সেই অজ্ঞাত অধ্যায় মহামিশ্র ছাড়া আর কেউ জানেও না। তবে, আজ তিনি সামান্যতম ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রাসাদ-রমণীরা যে হুড়োহুড়ি শুরু করে দেবে তা তিনি জানেন। ঐসব অশোভন প্রতিযোগিতা তাঁর আর ভালো লাগে না। তাই উদাসীনতা আর গাম্ভীর্য দিয়ে তিনি এদের প্রতিহত করে রেখেছেন।
কিন্তু আজ তাঁর কক্ষসজ্জা তাঁকে তাঁর সংসার জীবনের প্রথম অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কোনো এক অপরিচিতার হাতের ছাপ এখানে স্পষ্ট হয়ে আছে। আজ দীর্ঘদিন ধরে যে সমস্ত প্রাসাদ-রমণীরা একাজ করত, এ তাদের কেউ নয়। পুষ্পস্তবকটির মধ্যে রয়েছে পারস্যের সুগন্ধী এক লাল গোলাপ! সেই অপরিচিতা কেমন করে জানল যে সম্রাট ঐ লাল গোলাপ পছন্দ করেন? নাকি সে নিজেও তা পছন্দ করে? একদৃষ্টে লাল গোলাপটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কণিষ্ক হঠাৎ একটু বিচলিত বোধ করলেন।–না! এসব চিন্তায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। বুদ্ধকে স্মরণ করলেন তিনি। “প্রভু! আমায় শান্তি দাও। আমার মনকে দৃঢ় কর। আমি আবার সেই অন্ধকার দিনগুলোয় ফিরে যেতে চাই না। নারীজাতির ওপর আমি বিশ্বাস হারিয়েছি।”
একটু পরেই সম্রাটকে আহার-কক্ষে নিয়ে যাবে রূপসীর দল। দাসীরা আহার সাজিয়ে পরখ করে সম্রাটকে নিবেদন করবে। চুপ করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবে প্রাসাদ-রমণীরা। সামান্য দু-একটা অনুরোধ হয়তো তারা করবে—”সম্রাট! এই ব্যঞ্জনটি পরখ করুন। ওটি আরও একটু গ্রহণ করুন।” সম্রাট তাদের অনুরোধ রক্ষা করে ধন্য করবেন।
শয্যা গ্রহণের সময় হলে সম্রাট আর নারীমুখ দর্শন করেন না। তবে কখনও কখনও সম্রাটের বাসনা হয় যে তিনি ত্রিপিটক বা জাতক কাহিনী শুনবেন শয্যায় শুয়ে শুয়ে। মহামিশ্রকে আদেশ করেন। সম্রাটের শয্যার কাছে একটি পরদা ঝোলানো হয়। পরদার অপর পারে একটি আসনে বসে কোনো প্রাসাদ-রমণী পাঠ করে। সম্রাট শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন। তবে এ কথা ঠিক যে সকলের পাঠ সম্রাটের সমান ভাল লাগে না। কিন্তু তিনি কাউকেও উৎসাহিত করেন না, নিরাশও নন। মহামিশ্র অপেক্ষা করেন। সম্রাট নিদ্রা গেলে প্রাসাদ-রমণীটি আর মহামিশ্র বিদায় নেন। এইভাবে আবর্তিত হচ্ছে সম্রাটের জীবন। তৃণাঞ্চলের উষ্ণ রক্তধারার কোনো চিহ্নই ইদানীং লক্ষ্য করা যায় না তাঁর মধ্যে। সম্রাট সত্যিই যেন ভীষণ শান্ত হয়ে গেছেন। এক অব্যক্ত জগতের পথে হেঁটে চলেছেন। একমাত্র মহামিশ্র জানেন সম্রাটের এই ভাবান্তরের কারণ। আর তাই তিনি কায়মনোবাক্যে চান যে সম্রাট যেন স্বাভাবিক সাংসারিক জীবনে ফিরে আসেন। মহামিশ্রের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন