কণিষ্ক – ২০

অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

আজ মাসাধিক কালের পর সম্রাট রাজসভায় পা রেখেছেন। পাশে পাশে হেঁটে এসেছেন মহামিশ্র। তাঁর মনে হয়েছে—সম্রাটের ভেতরে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগের মতো সহজ আর নরম নন সম্রাট। গাম্ভীর্য তাকে ঘিরে রেখেছে। তাঁকেও ভাবনাচিন্তা করে সংযত হয়ে কথা বলতে হচ্ছে।

সম্রাট আজ ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার করবেন। সম্রাট যে প্রলম্বিত বিচারের মধ্যে যাবেন না এ বিষয়ে মহামিশ্র নিশ্চিত। প্রতিশোধ নেবার হিংস্ররূপের ছায়া তিনি দেখতে পেয়েছেন সম্রাটের মধ্যে। প্রতিক্ষণেই তার মনে হচ্ছে এ বৌদ্ধ কণিষ্ক নয়—অশ্বঘোষের ললিত উপদেশ তাঁকে স্পর্শ করেনি। এক ভয়ঙ্কর রক্তলোলুপ শ্বাপদ জেগে ওঠার অপেক্ষায়।

রাজসভা আজ পরিপূর্ণ। বাইরেও অজস্র জনতা। সবার জয়ধ্বনির মধ্যে সম্রাট সিংহাসনে বসে হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বললেন। সভা শান্ত হলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহামিশ্রকে তিনি সভার কাজ শুরু করার কথা বললেন—শুরু হোক সভার কাজ।

ছোটখাট কয়েকটি মীমাংসার কাজ বাকি ছিল। সম্রাট তাঁর অভিমত জানিয়ে সে সবের মীমাংসা করে দিয়ে বললেন, ষড়যন্ত্রকারীদের উপস্থিত করা হোক।

সভায় এক সূচিভেদ্য নীরবতা ঘনিয়ে এল। প্রহরীরা এক-এক করে বন্দি হিউ-পিনান, জাষ্ক, ইউনাস, ভার্গব, দুবল, ক্ষত্রপ সাকটনীকে উপস্থিত করাল।

মহামিশ্র বললেন, সমাজ-উৎসবের রাত্রির কথা আপনারা সবাই জানেন। সম্রাটকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করার এক ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছিল। সেই ষড়যন্ত্রের মূল নায়কেরা এখানে উপস্থিত রয়েছেন। এদের সকলকেই বন্দি করা হয়েছে। কারাগারে এখন রয়েছে এদের অজস্র আজ্ঞাবাহী কর্মচারী। কেউ লোভে আবার কেউ ভীত হয়ে এদের আজ্ঞাপালনে বাধ্য হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই রাজসাক্ষীও হয়েছে। ফলে, যেটুকু অস্বচ্ছতা ছিল, এখন তা সব দূর হয়ে দিনের মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি এবার এক এক করে অভিযোগগুলো জানাচ্ছি।

হিউ-পিনান আর জাঙ্ক: রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক। সম্রাটকে ঘাতকের সাহায্যে হত্যা করার পরিকল্পনা। হিউ-পিনান কাশগড়-খোটান-ইয়ারকন্দের বদলে হিন্দুকুশ অতিক্রম করে পুরুষপুরে আসতে চেয়েছিল। পুরুষপুর অধিকার করার জন্য সুকৌশলে সে প্রায় দু-হাজার সেনা পাঠিয়েছিল। ভেবেছিল নগর অরক্ষিত! জাঙ্কের বিরুদ্ধে হত্যা, রত্ন-লুণ্ঠন প্রভৃতি একাধিক অভিযোগও রয়েছে। সে নিজেকে পুরুষপুরের সম্রাট বলে প্রচার করছিল।

ইউনাস, ভার্গব ও দুবল: এরা হিউ-পিনান আর জাঙ্কের সহযোগী। তারা তাদের বুদ্ধি, প্রভাব এবং অর্থ দিয়ে এই ষড়যন্ত্রকে সমর্থন করেছিল। এরা এত নীচ যে নিজেদের কন্যাদেরও এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার করে তুলেছিল। পরিণামে তাদের কন্যারা ধর্ষিতা ও নিহত হয় ঘাতকদের হাতে। সম্রাট তাদের মৃত্যুর জন্য অতীব লজ্জিত ও দুঃখিত।

তিন মন্ত্রীর আরও একটি অপরাধ তারা মন্ত্রী পরিষদকে বাধ্য করে পুরুষপুর শূন্য করে সমস্ত সেনা ক্ষত্রপ সাকটনীর বিরুদ্ধে পাঠাতে। সেনাপতি গুণবর্ধন আর গুপ্তচর প্রধানের কৌশলে সেই রাত্রে পুরুষপুর এক গণহত্যার হাত থেকে মুক্তি পায়।

ক্ষত্রপ সাকটনী: সে ইউনাস, ভার্গব আর দুবলের প্ররোচনায় বিদ্রোহ করে। এই ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছিল যখন ঐ তিন মন্ত্রী নিম্নসিন্ধুর বন্দরগুলিতে শ্রমিক বিদ্রোহ দমন করতে যায়।

সংক্ষিপ্তভাবে মূল ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অভিযোগগুলি হচ্ছে এই রকমই। ষড়যন্ত্রীরা এখন তাদের অপরাধ স্বীকার করতে পারে অথবা নাও পারে কিংবা একে অন্যকে দোষারোপ করতে পারে। কিন্তু তাতে তাদের পাপস্খলন হয় না। তরবারীর আগা চেপে ধরে কাড়াকাড়ি করতে গেলে—হাত কেটে রক্তারক্তি হবে এ কথা সবার জানা। আর এরা কেউ শিশুও নয়।

বন্দিরা সবাই নীরব রইল। হঠাৎ হিউ-পিনান বলল, কণিষ্ক জেনে রেখো সারা সাম্রাজ্যে আমার লোক ছড়িয়ে আছে। তারা তোমায় শান্তিতে থাকতে দেবে না।

মহামিশ্র বললেন, সম্রাট বলছেন, এ কথা তিনি জানেন। তাই তার আর জাঙ্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সম্রাটকে একটু অপেক্ষা করতে হলো।

সম্রাট এবার মহামিশ্রকে বললেন, এবার দণ্ডগুলি পাঠ করো।

মহামিশ্র বললেন, সভাসদগণ আর বন্দিরা—সকলে মন দিয়ে শুনুন। হিউ-পিনান, জাঙ্ক, ইউনাস, ভার্গব আর দুবলকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। এই আদেশ কাল প্রভাতেই কার্যকরী করা হবে।

ক্ষত্রপ সাকটনীকে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য লঘু শাস্তি দেওয়া হলো। তাকে পদচ্যুত করে পার্থিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হল। শর্ত, সে কখনই আর ভারতে পা রাখার দুঃসাহস করবে না। পার্থিয়ার ক্ষত্রপকেও সেইরকম আদেশ দেওয়া হবে।

জীবিত ঘাতকটিকে দশ বছরের সশ্রম কারাবাস দেওয়া হলো। সে খনি অঞ্চলে কাজ করবে।

বল্বের সেনাদের মহাক্ষত্রপ সোরোডানের হাতে তুলে দেওয়া হবে বিচারের জন্য। সোরোডান যা ভালো বুঝবে তাই করবে।

নগর প্রহরীদের ক্ষমা প্রদর্শন করে স্বপদে বহাল রাখা হল। বিনাগ আর জুনাগকে মুক্ত করে দেওয়া হল।

হিউ-পিনান গর্জন করে উঠলেন, এ বিচার নয়। অবিচার। সম্রাট বিচার এবং দণ্ডদান আগেই করে রেখেছেন!

সম্রাট বিরক্তি প্রকাশ করলেন। মহামিশ্র সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বন্দিদের নিয়ে যাও।

.

সম্রাট কমলিকা আর ভট্টরাইয়ের কথা ভুলে গিয়েছিলেন কিনা তা একমাত্র সম্রাটই বলতে পারেন। তিনিই বলতে পারেন—ওদের দুজনকে নিয়ে তার পরিকল্পনা কী? মহামিশ্রের সাহস হয়নি সম্রাটকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতে। কিন্তু কমলিকা আর ভট্টরাইয়ের প্রসঙ্গ আচম্বিতেই সামনে এসে গেল।

সেদিন প্রভাতে রাজপ্রাসাদের সামনে এক বিশাল শোভাযাত্রা এসে থামল। শোভাযাত্রাকারীদের দাবি সুবিচারক সম্রাটের কলঙ্ক ঘটছে। সম্রাট ভট্টরাই আর বিশ্বাসহন্তা ভাবী সম্রাজ্ঞীর অপরাধের বিচার করছেন না। ভাবী সম্রাজ্ঞী যে আচরণ করেছেন সম্রাট এবং অন্যান্যদের সামনে, তাতে সম্রাট এবং সাম্রাজ্যের মর্যাদা হানি ঘটেছে। ঐ রমণী বিশ্বাসহন্তা। তার এবং তার প্রেমিকের বিরুদ্ধে সম্রাটের এখনই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত—ঐ নারীকে বিবাহ করা তো দূরের কথা!

শোভাযাত্রাকারীরা মহামিশ্রের হাতে তাদের দাবিপত্র পেশ করে ফিরে গেছে। সম্রাট সব শুনেও নিঃশ্চুপ।

কিন্তু ক্রমে ক্রমে সারা পুরুষপুরেই শোভাযাত্রা বেরোতে লাগল ভট্টরাই আর কমলিকার বিরুদ্ধে। সম্রাট এবং সাম্রাজ্যের সম্মানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কমলিকা আর ভট্টরাইয়ের বিচার চাই।

সন্দেহ নেই যে পুরুষপুরের আপামর জনসাধারণ এই দাবির স্বপক্ষে মতদান করেছেন।

সম্রাট সেদিন মহামিশ্রকে প্রশ্ন করলেন, ঐ ঘটনার কথা কেমন করে জনসমক্ষে চলে গেল?

মহামিশ্র বললেন, বলা সম্ভব নয়, সম্রাট। সেখানে আমি, আপনি ছাড়াও প্রচুর লোক উপস্থিত ছিল।

সম্রাট চিন্তিতভাবে বললেন, তা বটে। আমারও বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা ঠিক নয়। এর একটি নিষ্পত্তির প্রয়োজন।

মহামিশ্র নীরব রইলেন। কিন্তু পরদিন সকালেই তিনি শুনতে পেলেন যে গতরাত্রেই কমলিকা আর ভট্টরাইকে প্রাসাদ কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। সংবাদটি শুনে তিনি বিচলিত হলেও অবাক হলেন না। বরং সম্রাট যে দু’টি তরুণ জীবনের দ্রুত মীমাংসা করতে উদ্যোগী হয়েছেন—এতেই তিনি খুশি। কমলিকা যে অপরাধ করেছে—সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের যৌথ প্রচেষ্টাতেই তো তাঁর জীবন রক্ষা পেয়েছে।—এও তো সত্য। সম্রাট তো নিজেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু সম্রাটের তুলনায় তিনি এক সাধারণ মানুষ। বিশাল কুষাণ সাম্রাজ্যের সম্রাটকে তিনি কেমন করে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন? মহামিশ্র একবার স্থির করলেন, তিনি কারাগারে ওদের সঙ্গে দেখা করবেন। পরক্ষণেই ভাবলেন, না। তা উচিত হবে না। হয়তো সম্রাট তাঁর পরীক্ষা নেবার জন্য ওদের প্রাসাদ কারাগারে নিয়ে এসেছেন! তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা তো কমলিকা ইতিমধ্যেই প্রশ্নের মুখে তুলে দিয়েছে!

যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবেই মহামিশ্র সম্রাটের ঘরে প্রবেশ করলেন।

সম্রাট আজ একটু স্বাভাবিক। বললেন, সোরোডানের বার্তা তো দেখেছ? সে চৈনিক সম্রাটের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে সেনা সাজাচ্ছে। রেশম-পথের অধিকার আবার কুষাণ অধিকারে আনতে হবে। নচেৎ এই সাম্রাজ্যের ধনলক্ষী রুষ্ট হবেন। রোম ও অন্যান্য যবনদেশি দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য ব্যাহত হবে। মহামিশ্র বললেন, আমি ভাবছি, সম্রাট—এ কাজ আমাদের আগেই করা উচিত ছিল। হিউ-পিনানের জন্য তা সম্ভব হয়নি অবশ্য।

কিন্তু আরও একটি সংবাদের কথা কী জানো?

কী কথা সম্রাট? মহামিশ্র একটু বিব্রত হয়ে গেলেন।

সোরোডান আমাকে উপস্থিত থাকতে বলেছে।

আপনি যাবেন! অসম্ভব, সম্রাট। আপনার যাওয়া উচিত হবে না।

কেন?

আপনি এখনও যথেষ্ট সুস্থ নন।

সম্রাট হাসলেন, শরীরের অজুহাত আর কতদিন দেব মহামিশ্র? জীবন-মৃত্যু তো আছেই। কিন্তু না গেলে আমার সাম্রাজ্য যদি না থাকে?

থাকবে সম্রাট। আপনার যোগ্য পুত্র রয়েছে। ভবিষ্যতে এই সাম্রাজ্য তো তাকেই দেখতে হবে!

তা হয় না, মহামিশ্র। সোরোডানকে তো তুমি জানোই। সে যখন বলেছে আমাকে প্রয়োজন, তখন ভাবনাচিন্তা করেই বলেছে। তুমি বা বাসিষ্ক হলে—তোমাদেরই উপস্থিত হতে বলত।

মহামিশ্র একটু নীরব থাকার পর বললেন, কালই তো যুবরাজ আসছেন।

হ্যাঁ। আমিই তাকে কিছুদিন আগে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। অনেকদিন তাকে দেখিনি! তুমিই তো সে বার্তা পাঠিয়েছিলে!

মনে পড়েছে, সম্রাট! লজ্জিতভাবে মহামিশ্র বললেন।——ভালোই হয়েছে। বাসিষ্ককে সব বুঝিয়ে দিয়ে যান। আপনি না ফেরা পর্যন্ত সে যেন এই পুরুষপুরেই অধিষ্ঠান করে। পুরুষপুর শূন্য রাখা উচিত হবে না।

সম্রাট বললেন, আমিও তাই ভাবছি। সাম্রাজ্যের সব তথ্য বাসিস্কের হাতে তুলে দিয়ে যেতে হবে। তুমি রইলে, নীলাকার রইল—আমার চিন্তা কী?

গুণবর্ধনের জায়গায় কে দায়িত্ব পালন করবে?

কেন সোনাপত।

সে তো এখন নগরের দায়িত্বে—জাঙ্কের পদে!

আমি চিন্তা করে রেখেছি। দেখ তোমার পছন্দ হয় কিনা। সোনাপত সেনাপতি। বিষ্ক উপসেনাপতি। তার একটা পদোন্নতি হওয়ার প্রয়োজন। তার সাম্প্রতিক অবদান কম নয়।

মহামিশ্র বলতে গেলেন, এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি যার অবদান—সেই ভট্টরাইকে রাতের অন্ধকারে আপনি কারাগারে নিয়ে এসেছেন! তার কী অপরাধ? কমলিকার আচরণের জন্য সে কেন দায়ী হবে? কিন্তু ভট্টরাইয়ের কথা মহামিশ্র উচ্চারণ করতে পারলেন না। তিনি পরিবর্তে বললেন, আপনার সিদ্ধান্ত যথাযথ। তবে নগরাধ্যক্ষের পদের জন্য আমাদের আজ থেকেই এক উপযুক্ত ব্যক্তির সন্ধান করতে হবে। সেনাবাহিনীতে অনেক যোগ্য লোক অবশ্যই রয়েছে।

সম্রাট বললেন, ঠিক আছে। খোঁজ করো। এখনও তিন-চারদিন সময় আছে হাতে। তার মধ্যে নিশ্চয় কাউকে পেয়ে যাবে।

তাই হবে, সম্রাট। আজ কি রাজসভায় যাবেন?

নিশ্চয় যাব। যুদ্ধ যাত্রার দিন পর্যন্ত যাব সম্ভব হলে। বাসিস্কের ওপর কোন পুরনো সমস্যা ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়। কী বলো?

মহামিশ্র বুঝলেন না, পুরনো সমস্যা বলতে সম্রাট কী বলতে চাইছেন। তবু তিনি সম্রাটকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, নিশ্চয় সম্রাট। পুরানোর জের কেন টানবেন যুবরাজ?

সম্রাট হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, পুরোনো জের বলতে আমি কী বোঝাতে চাইছি, বুঝেছ?

মহামিশ্র বিব্রতভাবে বললেন, না, সম্রাট! রাজস্ব সমস্যাটি কী?

না। আমি যাত্রা করার আগেই কমলিকা আর ভট্টরাইয়ের বিচার সমাধা করে দণ্ডদান করে যাব।

মহামিশ্র বললেন, সেটাই উচিত হবে, সম্রাট। যুবরাজ তো এই বিষয়ে কিছুই জানেন না।

সম্রাট বললেন, আমি প্রস্তুত হচ্ছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো।

মহামিশ্র কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলেন। তাঁর মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বিচার এবং দণ্ড। তিনি একবার ভাবলেন, ওদের হয়ে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করবেন কি না? পরমুহূর্তেই ভাবলেন, তা সম্ভব নয়। কমলিকা অপরাধ করেছে। বিশ্বাসহন্তার কাজ করেছে ঠিকই। তার তো দণ্ড পাওয়াই উচিত। সম্রাট এবং সাম্রাজ্যের মুখ জনসমক্ষে কালিমালিপ্ত করেছে। সম্রাট যদি সুস্থ থাকতেন—হয়তো তখনই তার মুণ্ডচ্ছেদ করলেও অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু ভট্টরাইয়ের দণ্ড হলে তিনি প্রতিবাদ জানাবেন—তাতে সম্রাট তাকে যে দণ্ড দেবার দেবেন। অন্তত বিবেকের কাছে তিনি মুক্ত থাকবেন।

.

বাসিষ্ক পুরুষপুরে এসে গেছে। সে সব ঘটনা শুনেছে। ভট্টরাইয়ের কথাও তার কানে গেছে। তাই কারাগারে কমলিকা আর ভট্টরাইকে দেখে সে অবাক হয়েছে। কৌতুহলের বশে মহামিশ্রের সামনেই সে কণিষ্ককে প্রশ্ন করেছে, বাবা! কমলিকাকে না হয় সম্রাট এবং সাম্রাজ্যের মুখ কালিমালিপ্ত করার অভিযোগে কারাগারে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভট্টরাই?

কণিষ্ক বাসিষ্ককে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, পুত্র এটা আমার বিষয়। পরশু যুদ্ধযাত্রা করার আগে—সম্ভবত আগামী কালই ওদের বিচার করে দণ্ড দান করে যাব। তোমাকে বিব্রত হতে হবে না।

আজই সেই বিচার সভা। আজও রাজসভা পূর্ণ। সভার বাইরেও অগণিত জনতা সম্রাটের বিচার দেখতে উপস্থিত হয়েছেন। কণিষ্ক রাজসভায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ সভাগৃহ উঠে দাঁড়িয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানাল। কিন্তু সভার বাইরের জনতার মধ্য থেকে ধ্বনি উঠল: সাম্রাজ্যের মুখ—সম্রাটের মুখ কালিমালিপ্তকারীদের মৃত্যুদণ্ড চাই। মৃত্যুদণ্ড চাই।

সম্রাট বিরক্ত হলেন। মহামিশ্রকে বললেন, মহামিশ্র! তুমি সভার দায়িত্বে থাকা মুখ্য সেনানীকে আদেশ করো—সে যেন বাইরে গিয়ে জনতাকে কোলাহল বন্ধ করতে বলে। সে যেন বলে, বিচার করবেন সম্রাট। দণ্ড ঘোষণা করবেনও সম্রাট। তিনি এই বিশৃঙ্খলা পছন্দ করছেন না। প্রয়োজনে সেনারা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

মহামিশ্রের কথামতো—এক ঝাঁক সেনা মুখ্য সেনানীর নেতৃত্বে বাইরে ছুটে গেল। দেখা গেল অচিরেই সব কোলাহল শান্ত হয়ে গেছে।

সম্রাট আদেশ করলেন, বন্দিদের উপস্থিত করা হোক।

রক্ষীরা বন্দিদের উপস্থিত করল। সভায় গুঞ্জন শুরু হলো। মহামিশ্র আশা করেছিলেন, ভট্টরাই না হোক—কমলিকা অন্তত নত শিরে আসবে। সম্রাট হয়তো করুণা পরবশ হবেন। কিন্তু উন্নত শিরে কমলিকাকে প্রবেশ করতে দেখে তিনি প্রমাদ গুণলেন। ভাবলেন, সম্রাট এমনিতেই রুষ্ট হয়ে আছেন। এখন কমলিকার শারীরিক ভাষা তাঁর ক্রোধে ঘৃতাহুতির সঞ্চার করবে।

বন্দিরা একটু দূরত্ব রেখে পাশাপাশি দাঁড়াল। মহামিশ্র লক্ষ্য করলেন, বন্দিরা সুস্থ সবল রয়েছে। অর্থাৎ বন্দীশালায় কোনো অত্যাচার চালানো হয়নি। তাই যেন তিনি একটু স্বস্তি পেলেন।

সম্রাট হাত তুলে সবাইকে গুঞ্জন থামাতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে সভায় এক অদ্ভুত নীরবতা ঘনিয়ে এল। সম্রাট নিজেই সেই নীরবতা ভাঙলেন। তিনি গম্ভীর স্বরে বন্দিদের প্রশ্ন করলেন, বলো তোমরা দোষী না নির্দোষী?

কমলিকাই উত্তর দিল, নির্দোষী।

মহামিশ্র আবারও শংকিত হয়ে পড়লেন। হালকা দণ্ডের সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দিল কমলিকা। তিনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বললেন, বন্দিনী—ক্ষমা প্রার্থনা করো। সম্রাট হয়তো বিবেচনা করবেন।

দীপ্ত ভঙ্গিতে কমলিকা বলে উঠল, ভন্তে মহামিশ্র। আমি জানি, আপনি আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। আমাদের কঠোর দণ্ডের কথা ভেবে আপনি চিন্তিত হচ্ছেন। কিন্তু জানতে চাই—আমাদের অপরাধ কী? আমরা সম্রাটকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, হত্যা করতে নয়। সম্রাটকে রক্ষা করার জন্য—ষড়যন্ত্রের নায়ককে বন্দী করার জন্য ভট্টরাই তার জীবন পণ করেছিল। আহত হয়েও সে ছুটে গিয়েছিল নগর কার্যালয়ে এবং সফল হয়। এমনকি আমার হৃত রত্নগুলিও উদ্ধার করে। আমি বরং ভট্টরাইকে একলা ফেলে রেখে অঙ্গরক্ষকদের ডাকতে যেতে চাইনি। ভট্টরাই জোর করে আমায় পাঠায়। সেই কর্তব্যনিষ্ঠ বীরপুরুষটিকে যদি আমি রক্তাপ্লুত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখি—তার জন্য সমবেদনা জানানো—দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলা কি আমার পক্ষে অন্যায়? আমি কি মানবতা—কৃতজ্ঞতা বোধহীন একটি প্রাণী? যে মানুষটি দু-দুবার আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনল, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও কি অপরাধ? সম্রাটের সঙ্গে আমার মৃত্যু ছিল অবধারিত। ঘাতকেরা জানুকার ঘরে মহোৎসব মত্ত না হলে আমার এবং অন্যান্য প্রাসাদ-রমণীরা কেউ নারকীয় অত্যাচার এবং মৃত্যু থেকে অব্যাহতি পেত না। সম্রাটের সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধও কি নেই?

মহামিশ্র গর্জন করে উঠলেন।—কমলিকা! তুমি কাকে কী বলছ তা কি তোমার খেয়াল আছে? তুমি তোমার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছ।

দীপ্তভাবে কমলিকা বলল, যে সম্রাট উপকারীর উপকার ভুলে রাতের অন্ধকারে তাদের বন্দী করেন—কারাগারে পাঠান, সেই সম্রাটের প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকার কথা নয়। আর মৃত্যু? সম্রাট মৃত্যু ছাড়া আর কী দিতে পারেন? আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।

মহামিশ্র সম্রাটের হয়েই বললেন, তোমার সঙ্গে সম্রাটের বাগদান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই রাতেই অজস্র মানুষ আর সম্রাটের চোখের সামনে তোমার আচরণ অতীব নিন্দনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। তুমি সম্রাটের সঙ্গে বিশ্বাসহন্তার কাজ করে সম্রাটকে কালিমালিপ্ত করেছ।

কমলিকাও যেন সমান তেজে গর্জন করে উঠল। সে বলল, আমি এই অভিযোগ অস্বীকার করছি। ঐ পরিস্থিতিতে এক মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের যা করণীয় ছিল—তাই করেছি মাত্র। আর বাগদান? বাগদানই কি সমাজবন্ধন—বিবাহ? বাগদানের পরই কি স্ত্রী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাসের অধিকারী হতে পারে? ক্ষমা করবেন, আমি বলতে চাইছি, ঐ রাত্রে সম্রাট যদি নিহত হতেন, আর আমি জীবিত থাকতাম—তাহলে কি আমি সম্রাজ্ঞী বলে বিবেচিত হতাম? আমাকে কি এক পতিহারার জীবন যাপন করতে হতো? এ সমাজে কি বাগদানের পর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিবাহ সম্পাদিত হয়? সম্রাট কি বিবাহের দিন স্থির করেছিলেন? দিন-রাত্রির ব্যবধানে মানুষের জীবনে কত কী ঘটে যেতে পারে—সত্য—মিথ্যা হয়ে যেতে পারে—মিথ্যা—সত্য! বাগদানই যদি বিবাহের একমাত্র শর্ত হতো—তাহলে ধর্মসম্মত ভাবে বিবাহের কী প্রয়োজন?

মহামিশ্রের ক্ষমতা ছিল না কমলিকার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। তিনি অসহায়ভাবে সম্রাটের দিকে তাকালেন। সম্রাট নীরব। ভাবলেশহীন। অগত্যা মহামিশ্র আবার বলে উঠলেন, তুমি জানতে, সম্রাট অসুস্থ। ঐ সময়ে তোমার আচরণ সম্রাটের হৃদয়ে কী প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল—তা কি তুমি অনুমান করতে পার?

কমলিকা এবার বিনয়ের সঙ্গে বলল, পারি। সম্রাট যেন আমায় ক্ষমা করেন। সেই সময় আমি আমার মনের অধিকারে ছিলাম। আমার বাস্তবজ্ঞান তখন ছিল না। আমি উপস্থিত কাউকে তখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম না।

মহামিশ্র যেন এবার কমলিকাকে আক্রমণ করার সুযোগ পেলেন, তুমি সম্রাটকে প্রলোভিত করেছিলে। তাই সম্রাট বারোজন প্রাসাদ-রমণীদের মধ্য থেকে তোমাকেই বেছে নেন। তুমি অর্থ-ক্ষমতা-প্রতিপত্তির আকাঙ্ক্ষায় এ কাজ করেছ।

না। প্রতিবাদ করে উঠল কমলিকা। সম্রাট সাক্ষী। তিনি কি আমার মধ্যে কোনদিন কোন অসংবৃত আচরণ লক্ষ্য করেছেন? সম্রাট আমাকে রাজ্য, বন্দর শুল্কের অংশ—অনেক কিছুই দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি সব অস্বীকার করে শুধুমাত্র মানুষ কণিষ্ককে চেয়েছিলাম।

আর তুমি সেই সম্রাটের ভালবাসাকে পদদলিত করলে!

ক্ষমা করবেন। আমি আমার নিজের মনকে জানতাম না। চিনতাম না। কে জানে নিজের মনকে—মনের গভীরে যে সত্য চাপা থাকে তার হদিশ ক’জন পায়? আমার কল্পনায় এক বীরমূর্তি ভেসে বেড়াত। ভট্টরাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ সামান্য হলেও তার ঐ সুদর্শন-মার্জিত মূর্তি আমার মনের গভীরে বাসা বেঁধে ফেলেছিল। আমি তা টেরও পাইনি। তাকে বন্ধু বলেই নেবার চেষ্টা করছিলাম। প্রেমিক হিসাবে তাকে নিতে পারিনি, কারণ, আমাদের মধ্যে ছিল সামাজিক বৈসাম্য! ভট্টরাইও নিশ্চয় আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু সামান্য দু’দিনের আলাপেই সে আমাকে তা বুঝতে দেয়নি তার পরিশীলিত ব্যবহারে। অন্যদিকে আচার্য চরক এবং মহামিশ্র আমাকে রাজরানি হবার যোগ্য বলে মনে করতে শুরু করেছিলেন। আমি স্বাধীন জীবন শুরু করার জন্য মহামিশ্রের কাছে এক নিরাপত্তাযুক্ত কর্ম প্রার্থনা করেছিলাম। মহামিশ্র মূল্যবোধের মানুষ। তিনি কথা দিয়েছিলেন। সেই কথা তিনি রাখতে মহাবিহারের উদ্বোধনের দিন সম্রাটের সঙ্গে কৌশলে পরিচয় করিয়ে দেন। ঐ প্রথম কোন সম্রাট আমার দেখে মৃদু হাসলেন। সভাগৃহেই আমি সম্রাটের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে যাই। তাঁর মৃদু হাসিতে মোহিত হয়ে গেলাম। এরপরের ইতিহাস তো আপনারা জানেন। আমি কায়মনোবাক্যে সম্রাটের সেবা করতে শুরু করলাম। আমার চাওয়ার কিছু ছিল না। ছিল শুধুমাত্র ঐ বীরপুরুষটিকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তাঁর সঙ্গে আমি আমার কল্পলোকের বীরপুরুষটির অদ্ভুত মিল খুঁজে পেলাম। ভট্টরাই সম্রাটের বিশালত্বে চাপা পড়ে গেল। ভেবেছিলাম, সে বুঝি মারা গেছে। কিন্তু যায় নি। তা বুঝতে পারলাম ঐ ভয়ঙ্কর রাত্রে। আমাকে আর সম্রাটকে বাঁচাতে ছুটে এল—ভট্টরাই। প্রথমটায় তাকে ভুল বুঝলাম। কিন্তু পরক্ষণেই তার প্রকৃত উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পারলাম। ক্ষণিকের জন্য হলেও তার দেহের সঙ্গে আমার দেহের স্পর্শ ঘটল। আশ্চর্য! আমার দৈহিক কম্পনের মধ্য দিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম আমার মনকে। ভট্টরাই মরেনি। আমার মনের গভীরে ঘুমোচ্ছিল। আমার দৈহিক রোমাঞ্চ সেই বোধকে মুহূর্তের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল। সে আমাকে বারবার ঠেলে পাঠাতে চাইছিল। কিন্তু আমি অনড় ছিলাম। মৃত্যুর মুখে তাকে একলা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু সে আমাকে জোর করে ঠেলে পাঠায়। আমি ছুটে যাই অঙ্গরক্ষকদের কাছে। তাদের কেউ সেনাপতিকে সংবাদ দেয়। পরম এক উৎকণ্ঠা নিয়ে সকলের সঙ্গে আমিও সম্রাটের কক্ষে প্রবেশ করি—কিন্তু রক্তাপ্লুত অচেতন ভট্টরাইকে দেখে আমার সমস্ত চৈতন্যের বিলুপ্তি ঘটে। আমি ভেঙে পড়ি। ঈশ্বর সাক্ষী! বুদ্ধ সাক্ষী! আমি সম্রাটের সঙ্গে কোন প্রতারণা করিনি। যেটুকু তাঁর সেবা করেছি—তা হৃদয় দিয়েই করেছি। আমার কাছে তখন সম্রাটই সত্য ছিলেন। ভট্টরাইরূপী প্রবল শক্তিধর সত্য তখনও আত্মপ্রকাশ করেনি। সত্যকে আমি জানতে পারিনি। এ আমার অপরাধ নয়! একটু থেমে কমলিকা আবার বলল, সম্রাট আমাদের দণ্ড দিলে একত্রে মৃত্যুদণ্ড দিন। যাতে আমরা অন্তত জানতে পারি, জীবনের পাড়ে না হলেও মৃত্যুর পাড়ে আমরা একত্রে দাঁড়াতে পেরেছি।

কমলিকার আবেগপূর্ণ ভাষণে সদস্যরা—বাইরের জনতাও যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নীরব রইল। সকলেরই মনে উৎকণ্ঠা। সম্রাট এবার কী দণ্ড ঘোষণা করেন, তা শোনার জন্য।

সম্রাট হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন, সবাইকে বিস্মিত করে। তারপর মুখ্য সেনানীটিকে বললেন, “অপর দু-জন বন্দীকে নিয়ে এস।”

“অপর দু’জন বন্দী! সম্রাট এই দুই বন্দীর বিচার শেষ না করেই আবার অন্য দু’জন কোন বন্দীদের নিয়ে আসছেন?” সভায় গুঞ্জন উঠল।

অচিরেই ভয়ালদর্শন, রজ্জুবদ্ধ দুই বন্দীকে উপস্থিত করা হল। অনেকেই তাদের চিনতে পারল—জাঙ্কের সহযোগী, নগরের কুখ্যাত ব্যক্তি। এদের সঙ্গে এই দুই বন্দীর কী সম্পর্ক? মহামিশ্রও বিস্মিত হলেন।

সম্রাট এবার দু’জন বন্দীকে প্রশ্ন করলেন—”তোমরা এই দুই বন্দীকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলে?”

বন্দীরা নীরব রইল।

গর্জন করে উঠলেন সম্রাট, “উত্তর দাও, হ্যাঁ কি না?”

“হ্যাঁ, সম্রাট।”

“কেন?”

“জাঙ্কের মৃত্যুতে আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম।”

“অপরাধ স্বীকার করছ? অনুতপ্ত?”

“হ্যাঁ, সম্রাট!”

“ঠিক আছে। তোমাদের তিন মাসের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড দিলাম। এদের নিয়ে যাও।”

খুশি হয়ে বন্দীরা সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে রক্ষীদের সঙ্গে চলে গেল।

সম্রাট এবার হঠাৎই যেন সহজ হয়ে উঠলেন। তার গাম্ভীর্য ঝরে পড়ল। তিনি কমলিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সম্রাট অকৃতজ্ঞ নয়, মণিকার পুত্রী। নগরের শোভাযাত্রার কোলাহল বন্ধ করতে, অপর দিকে ঘাতকদের হাতে তোমাদের মৃত্যুকে ঠেকাতে আমাকে তোমাদের কারাগারে নিয়ে আসতে হয়। এর থেকে নিরাপদ স্থান আর কোথায়?”

মহামিশ্র উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “সম্রাট!”

সম্রাট বাধা দিয়ে বললেন, “না, মহামিশ্র। বিচার সম্পূর্ণ। তবে এখনও দণ্ড দান বাকি রয়েছে। তার আগে আমি বলি, মণিকার পুত্রী যা বলেছে তা সর্বৈব সত্য। অস্বীকার করব না। প্রথমে আমি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু আমি নিজের মনকে বোঝার জন্য সময় চাইছিলাম। তাই আমি দু’জনকে নিজের নিজের জায়গায় পাঠিয়ে নিজে চিন্তা করতে আর ওরাও চিন্তা করুক—এই আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে জাঙ্ক আর ইউনাসের লোকেরা এই দু’জনকে তাদের ব্যর্থতার কারণ বলে চিহ্নিত করে প্রচার অভিযান শুরু করে। প্রচার অভিযানে আমি প্রভাবিত হইনি। কিন্তু প্রভাবিত হলাম যখন নীলাকার জানাল, ওদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তাই ভাবলাম, বিচার তো আমায় করতেই হবে তবে কেন তাদের নিরাপত্তার জন্য কারাগারে এনে রাখব না? মহামিশ্রও আমায় ভুল বুঝেছে। অবশ্য তার কোনো দোষ নেই। সে এই পরিকল্পনার কথা জানত না, আমি জানাইনি।”

সম্রাট একটু থামলেন। এরপর বললেন, “আমি দিনের পর দিন নিজের মনের মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে এসেছি, এদের দণ্ডদান করতেই হবে।”

সভায় আবার নীরবতা ঘনাল।

সম্রাট বললেন, “আমি পুত্র বাসিষ্ককে নির্দেশ দিচ্ছি সে যেন আগামী পরশুদিনের মধ্যে কমলিকা আর ভট্টরাইয়ের বিবাহ সম্পাদন করে। না—বাগদান নয়। বিবাহ! মহামিশ্র! তুমি না সোনাপতের পরিবর্ত খুঁজছিলে? পেয়েছ?”

“হ্যাঁ, সম্রাট!”

“কে?”

“ভট্টরাই।”

“উত্তম! আমি ভট্টরাইকে নগরাধ্যক্ষের পদে বসাব। সোনাপত সেনাপতির পদে বসবে।”

মহামিশ্র বললেন, “সম্রাট! আমরা আর এক জনের কথা ভুলে যাচ্ছি।”

“কে সে?”

“তোরণাধ্যক্ষ বিষ্ক!” সম্রাট বললেন, “কেন? আমি বলিনি? উপসেনাপতির পদে কাল থেকেই যোগ দেবে বিষ্ক। সহ-তোরণাধ্যক্ষ হিসাবে যে রয়েছে—তাকে অধ্যক্ষের পদে নিয়োগ করো। সেনাবাহিনী থেকে অন্য একজনকে পাঠাও তার জায়গায়। হয়েছে?”

“চমৎকার হয়েছে, সম্রাট!”

বিষ্ক—কমলিকা আর ভট্টরাইয়ের বিচার দেখতে চায়নি। তাই আসেনি। এলে অবশ্য সম্রাটের ওপর তার জমে থাকা বিদ্বেষ এখনই সরে যেত।

সম্রাট কণিষ্ক এবার উঠে দাঁড়িয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় চাইলেন—”আপনাদের অনেকের সঙ্গে কাল প্রভাতে হয়ত দেখা হবে না। কারণ, কালই আমি যাত্রা করব।”

সবাই বলে উঠল, “সম্রাট, আপনি বিজয়ী হয়ে ফিরবেন।”

কমলিকা আর ভট্টরাই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক প্রবল লজ্জা তাদের গ্রাস করে রেখেছিল। সম্রাট তাদের অবাক করে দিয়েছেন।

ভট্টরাই বলল, “কমলিকা! সকালে আর আমরা সুযোগ পাব না। চল, এখনই ক্ষমা চেয়ে নিই।”

কমলিকা আর ভট্টরাই সম্রাটের সামনে এসে নতজানু হয়ে বসল, “সম্রাট, আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম।”

সম্রাট বললেন, “ওঠো। কর্তব্যনিষ্ঠ থেকো। মণিকার পুত্রীকে সুখী কোরো। তারুণ্যের জয় হোক। আমি পড়ন্ত বেলার সূর্য!” সম্রাটের মুখে মৃদু হাসি।—”আসি।”

কমলিকা এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবার লজ্জা সরিয়ে সে বলল—”সম্রাট!”

“বলো, মণিকার পুত্রী।”

“আপনার না গেলেই কি নয়?”

“কেন?”

“আর কেউ না জানুক, আমি আর আচার্য তো জানি আপনার কী অবস্থা! পাহাড় পার করার ধকল, যুদ্ধের চাপ—আপনার সহ্য হবে না!”

সম্রাটের হাসিটা যেন অপরাহ্নের বেলায় বিদায়ী সূর্যের মতো বিষণ্ণ বলে মনে হল। তিনি বললেন, “তা আর হয় না, মণিকার পুত্রী। যেতে আমাকে হবেই। এই নিয়ে আর প্রশ্ন কোরো না। কুষাণ সাম্রাজ্যকে সেবা কোরো। সুখী থেকো।”

“সম্রাট, কথা দিন পায়ে হেঁটে পাহাড়, পর্বত পার হবেন না। অশ্ব অচল হলে ডুলি ব্যবহার করবেন!”

প্রত্যুত্তরে সম্রাট মৃদু হেসে আর দাঁড়ালেন না। মহামিশ্রের সঙ্গে অঙ্গরক্ষক পরিবৃত হয়ে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলেন।

কমলিকা সম্রাটের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মনে হল, সম্রাট যেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। তার বুক যেন এক অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তার মন হু হু করে উঠল।—সে কি ভুল করেছে? অন্যায় করেছে? এক মানসিক দ্বন্দ্বে যেন ডুবে গেল কমলিকা। সম্রাটকেও কি সে ভালোবেসেছিল? একই সঙ্গে দু’জনকে ভালোবাসা কি সম্ভব? নিজেকে প্রশ্ন করল সে। কেন নয়? এক পুরুষ যদি একাধিক স্ত্রীকে ভালোবাসতে পারে—তাহলে এক নারী পারবে না কেন?

ভট্টরাই লক্ষ্য করছিল কমলিকাকে। এক সময়ে সে বলল, “সম্রাটের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে, কমলিকা? তোমার মনকে আমি চিনেছি। আসলে তুমি সকলের জন্য কষ্ট পাও। প্রাসাদে একটিও প্রাসাদ-রমণী নেই। সম্রাট পরিচারক-পরিচারিকাদের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বরের জীবনে এমনটা কি হওয়া উচিত ছিল? তাঁর এক সামান্য অঙ্গুলী হেলনে সুন্দরী রমণীতে ভরে যেতে পারত ঐ প্রাসাদ। কিন্তু বুদ্ধভক্ত সম্রাট জীবনের গভীরে প্রবেশ করেছেন। জাগতিক ভোগ-বিলাসের কামনা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছেন এতদিনে। তাই তো এত সহজে তিনি আমাদের ক্ষমা করলেন। আমাদের ভালোবাসাকে মর্যাদা দিলেন। হাজার হাজার বছর পরেও সম্রাট কণিষ্কের মতো আর কেউ ফিরে আসবে না! আমি নিশ্চিত!”

কমলিকা অস্ফুটস্বরে বলল, “তুমি সত্য কথাই বলেছ, ভট্টরাই।”

.

সম্রাট কণিষ্ক পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের পুরোভাগে সেনাপতি গুণবর্ধনকে সঙ্গে নিয়ে পামির লক্ষ করে এগিয়ে চলেছেন পার্বত্য পথে। চতুর্দিকে পাহাড়-পর্বত, তাদের বরফে আচ্ছাদিত শৃঙ্গ। গভীর জঙ্গল। কোথাও আবার পাহাড় ভেদ করে জঙ্গলকে চিরে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। পাখ-পাখালিদের ডাকে আচ্ছন্ন বনভূমি। ওপরে সুনীল আকাশ। এই পার্বত্য ভূমির মধ্যেই ইতিমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে মঠ-চৈত্য-গুম্ফা। প্রভু বুদ্ধের সাধনায় মহাযানপন্থীদের কণ্ঠের সেই ত্রিশরণ মন্ত্রের আবৃত্তি ভেসে আসছে বাতাসে—বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধম্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। সম্রাট একান্ত মনে তা শুনতে শুনতে এগিয়ে চলেছিলেন।

পুরুষপুর থেকে যাত্রা করার সময় সম্রাট কণিষ্ককে যাঁরা দেখেছিলেন তাঁরা অবাক হয়েছিলেন—সম্রাট তারুণ্যে টগবগ করছিলেন। এ যেন বৌদ্ধদীক্ষা-পূর্বের কণিষ্ক! সেই ঘোড়ার পিঠে তলোয়ার হাতে! এই শরীরী ভাষা নিয়েই তিনি সেদিন পা রেখেছিলেন পুরুষপুরে। সে অনেক বছর হয়ে গেল। তিনি অনেক ধীর-স্থির হয়ে এসেছিলেন। উচ্চৈঃস্বরে কথা কম বলতেন। এক গাম্ভীর্যের আবরণে নিজেকে ঢেকে ফেলেছিলেন। সেদিন সকালে তাঁর সেই স্বাভাবিক গাম্ভীর্য বজায় রেখেই তিনি উচ্চকণ্ঠে সৈন্যদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সম্রাট যেন এতকাল ঘুমিয়ে ছিলেন। আবার জেগে উঠেছেন। দর্শকেরা তাই কণিষ্ককে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন। আশ্চর্য হয়েছিল কমলিকা আর ভট্টরাই। সম্রাট অপরাহ্নের সূর্য ঠিকই। কিন্তু তার মধ্য দিয়ে মধ্যাহ্নের তেজ যেন প্রতিফলিত হচ্ছিল। এই সম্রাটকে তারা কখনও দেখেনি!

পামির যত এগিয়ে আসছিল সম্রাট যেন ততই স্মৃতির মধ্যে ডুব দিচ্ছিলেন। ভাবেন, এই তো সেই পামির! এই সুউচ্চ পামির অতিক্রম করেই তিনি সেদিন ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। কশ্যপপুরা ইত্যাদি অধিকার করতে করতে এগিয়ে ছিলেন পূর্ব দিকে, শ্রাবস্তী, বারাণসী, মথুরা জয় করে প্রায় এগিয়ে গিয়েছিলেন পাটলিপুত্রের কাছাকাছি। মথুরায় অবস্থান কালে ধর্মহীন সম্রাট ক্রমে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিলেন বৌদ্ধধর্মের দিকে। শুনেছিলেন, পাটলিপুত্রে বাস করেন অশ্বঘোষ নামে এক মহাপণ্ডিত। এর মধ্যে মারা গেলেন কুষাণ সম্রাট দ্বিতীয় কুজুল কদফিস। উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারীও হলেন তিনি। শাসনভার মহাক্ষত্রপ খারপল্লানের এবং ক্ষত্রপ বনস্পরের হাতে দিয়ে তিনি ফিরে চললেন পুরুষপুরে। অনেক অনুনয়-বিনয়—পাটলিপুত্র আক্রমণ করার ভীতি প্রদর্শন করে তিনি শেষপর্যন্ত সহযাত্রী করলেন পণ্ডিত অশ্বঘোষকে। বাসিষ্ক তখন শিশু। পুরুষপুরকেই তিনি রাজধানী হিসাবে স্থির করে বসবাস করা শুরু করলেন। বল্লের শাসনভার রইল হিউ-পিনানের হাতে। অশ্বঘোষের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে যুগপৎ নিজেকে বুদ্ধের সেবায় নিয়োজিত করলেন। এরই মধ্যে জীবনে ঘটে গেল কত ঘটনা! ষড়যন্ত্র—পত্নীর মৃত্যু—মহাবিহার—মহাস্তুপ নির্মাণ—চতুর্থ বৌদ্ধ সংহতি—প্রাসাদ-রমণী উপাখ্যান—তারপর চৈনিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা!

সম্রাট সুউচ্চ পামির মালভূমির দিকে তাকালেন। ওপরে অবস্থান করছে সোরোডান তার বল্বের বাহিনী নিয়ে। সম্রাট পামির অতিক্রম করে তার সঙ্গে মিলিত হবেন। সম্রাট ভাবলেন, এই সেই পামির! কত বছর পর তিনি আবার পা রাখছেন পামিরের বুকে। সেদিন যখন তিনি পামির অতিক্রম করে ভারতে ঢুকেছিলেন, তখন তাঁর চোখে ছিল জয়ের নেশা। আজ আবার তিনি পামির পার হবেন। কিন্তু আজ তার চোখে প্রতিরক্ষার চিন্তা। সাম্রাজ্য অটুট রাখার চিন্তা। রক্তের মূল্যে একদিন যে সাম্রাজ্য তিনি অধিকার করেছিলেন—বিনা যুদ্ধে তিনি তা হারাতে প্রস্তুত নন। উত্তরাধিকারী হিসাবে বাসিষ্কের হাতে তুলে দিয়ে যেতে হবে সবকিছু। পরের দায়িত্ব বাসিষ্কের।

পামিরের পাদদেশে সম্রাটের সঙ্গে সমগ্র বাহিনী দাঁড়িয়ে পড়েছিল। গুণবর্ধন সম্রাটকে ডাকলেন, “কিছু চিন্তা করেছেন কি, সম্রাট?”

কণিষ্ক বললেন, “হ্যাঁ, গুণবর্ধন। একদিন আমি এই পথেই ঢুকে ছিলাম তোমাদের দেশে।”

গুণবর্ধন বললেন, “সম্রাট! এদেশ তো এখন আপনারও!”

“হ্যাঁ গুণবর্ধন! এদেশকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি—তাই বন্থের তা-হিয়ায় আর ফিরে যাইনি। পারস্য সম্রাট বা যবনদের মতো আমি নিজের দেশে থেকে এদেশ শাসন করার চেষ্টা করিনি। এটিই আমার দেশ!”

গুণবর্ধন বললেন, “সম্রট! হাজার হাজার বছর পরেও ভারতবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাকে সম্রাট অশোকের পরেই স্মরণ করবে। অন্তত বুদ্ধের ধর্ম যতদিন জীবিত থাকবে—ততদিন আপনিও থাকবেন!”

সম্রাট হঠাৎ নীরব হয়ে গেলেন। তাঁর মনে হল, কমলিকা কি তাঁকে মনে রাখবে?

গুণবর্ধন আবার সম্রাটের চিন্তাকে বাধা দিলেন।—”সম্রাট! আজই কি পামির অতিক্রম করবেন? সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে এখনও দেরি আছে।”

“তাই করো। যতটা পারি উঠি। প্রভাতে না হয় বাকি পথটুকু পার হওয়া যাবে।”

গুণবর্ধন বললেন, “সম্রাট! কিছু দূর যাবার পর আমাদের পায়ে হাঁটতে হবে। ঘোড়াগুলিকেও হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি…!”

সম্রাট রহস্যময় ভাবে বললেন, “এখন তো এগোনো যাক!” তিনি চিন্তা করলেন, পামির অতিক্রম যদি করতেও পারেন—তারপরেই আসবে রণক্ষেত্র! অস্ত্রের ঝনঝনা—আর্তনাদ—রক্তস্রোত! এরপর…? সম্রাটের মনে পড়ে গেল মণিকার পুত্রীর শেষ আবেদন। পায়ে হেঁটে পাহাড়-পর্বত পার হতে সে নিষেধ করেছে। বলেছে, অশ্ব অচল হলে ডুলি ব্যবহার করতে।

সম্রাট মনে মনে বললেন, “তোমার ঐকান্তিকতায় আমি সন্দেহ প্রকাশ করছি না। জানি, তুমি আমার জন্য উৎকণ্ঠিত। কিন্তু আর কী লাভ কমলিকা? আমার বর্ণহীন হয়ে আসা জীবনে তুমি হঠাৎই রঙের প্রলেপ বুলিয়েছিলে। আমি নতুন করে তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। ভোগ করতে চেয়েছিলাম এই জীবন—এই পৃথিবী। কিন্তু লোভীর মতো চাইতে গিয়ে ভুল করলাম। ভুলে গেলাম অশ্বঘোষেরা অনুমোদন করলেও বুদ্ধ করবেন না। জীবনে নারী-ভোগ আমি কম করিনি। তাই বুদ্ধ হয়ত চাইলেন, আমার ভোগের আকাঙ্ক্ষার পরিনিবৃত্তি ঘটুক। কারণ, আমি এখন বিদায়ী সূর্য। ভট্টরাই উদিত—ভোরের সূর্য! আমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে শিগগিরই। অন্ধকারেও ফুল ফোটে—কিন্তু তা বর্ণহীন। তোমার নবীন যৌবনকে বর্ণহীন করার অধিকার আমার নেই। তুমি বর্ণময় হয়ে ওঠো। তুমি ঠিকই বলেছিলে, হৃদয়ের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা সত্যকে কি সবাই জানতে পারে? পারে—যখন সেই সত্য অনুকূল বাতাসে নিজে থেকেই জেগে ওঠে! বুদ্ধ তোমার সহায়। তাই হয়ত অন্ধকারে ঝাঁপ দেবার আগে তোমার হৃদয়ে সেই সত্য জেগে উঠেছিল। কিন্তু ভট্টরাইয়ের অচেতন দেহের ওপর উপুড় হয়ে তোমার সেই বিলাপ আমার শরীরে ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ইউ-চিরা তাদের সেই বর্বর জীবনে কখনও তাদের নারীকে অপরের কণ্ঠলগ্না হতে দেখা পছন্দ করে না। আমিও অভ্যাস বশে তরবারির জন্য পাশে হাত বাড়িয়ে ছিলাম। বুদ্ধ বোধহয় সেদিন আমাকে এক পাপ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। আমার মনের গভীরে কে যেন বলে উঠল, কণিষ্ক! ক্রোধ পরিহার করো। সত্যকে মেনে নাও। বাস্তবকে মেনে নাও। ধীর-স্থির ভাবে কয়েকদিন ধরে বিষয়টির পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নাও। হঠাৎই আমার মনের চোখ খুলে গেল। মনের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা এক সত্যকে আমি জানতে পারলাম তোমার মতোই। দেহজ কামনা নয়। ভালোবাসা। তোমাকে আমি ভালোবাসি, কমলিকা। পরক্ষণেই আমার মনে হল, তোমার মতো এক রমণীকে এই পৃথিবীর কে না ভালোবাসবে? তাই ভট্টরাইও তোমাকে ভালোবেসে কিছু অন্যায় করেনি। তোমার জীবনে তার উদয় ঘটেছে আমার আগে। আমি পরে। তাই ভট্টরাইয়ের দাবিই অগ্রগণ্য। এটাই সঠিক বিচার। তুমি সুগন্ধে ভরা এক লাল-গোলাপ। পারস্যের লাল গোলাপ আমি ভালোবাসি বলেই সেই গোলাপকে দলে-মুচড়ে দেবার অধিকার কি আমার আছে? হ্যাঁ—বর্বর ইউ-চি কণিষ্কের হয়ত ছিল। বুদ্ধভক্ত কণিষ্কের তা নেই। কমলিকা, আমি এখন ক্রোধমুক্ত, যৌন-হিংসা মুক্ত কণিষ্ক। কিন্তু মুক্ত হতে পারিনি অভিমান থেকে। সেই বুকভরা অভিমান নিয়েই আমি তোমার অনুরোধ উপেক্ষা করেই পায়ে হেঁটে পামিরে উঠব। ডুলি ব্যবহার করব না। আমার নির্বাণ যদি পামিরের উত্তুঙ্গ ভূমিতেই ঘটে—সেই নির্বাণকে আমি সাদরে বরণ করব। যদি ব্যর্থ হই তবে রয়েছে রণক্ষেত্র। বুদ্ধ সেখানে নিশ্চয় আমাকে কোলে স্থান দেবেন। আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন। একথা কেউ না বুঝলেও—তুমি ছাড়া অন্তত আর দু’জন জানে। এক, মহামিশ্র। দুই, আচার্য চরক। তাদের চোখে আমি জল দেখেছি। তারা আমায় আসতে দিতে চাননি।”

সম্রাট এগিয়ে চললেন পাথর ভিঙিয়ে সবুজ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে। মনে মনে তিনি আবার বললেন, “কমলিকা! আর আমাদের দেখা হবে না!”

.

সেদিন এক ভূকম্পন সারা সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিল। তার অভিঘাত পুরুষপুরেও পৌঁছল। সারা সাম্রাজ্যে বিলাপের রোল উঠল: সম্রাট কণিষ্ক আর নেই! পামির অতিক্রম করার সময় তাঁর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎই!

গৃহের দাওয়ায় বিষণ্ণ হয়ে বসে ছিল কমলিকা। ভট্টরাই কার্যালয় থেকে উত্তেজিত ভাবে ছুটে এসে বলল, “শুনেছ? সম্রাট আর নেই!”

কান্নাভরা গলায় কমলিকা বলল, “জানি। সম্রাট আত্মহত্যা করেছেন!”

***

অধ্যায় ২০ / ২০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন