অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়
সম্রাট কণিষ্ক ধর্ম নিয়ে বর্তমানে যতই মাতামাতি করুন না কেন, প্রশাসন সম্পর্কে তিনি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসেছিলেন না। যদিও তাঁর মধ্যে আগের সেই উগ্রতা-বিদ্বেষ নেই—পরিবর্তে তাঁর ধৈর্য এবং সহনশীলতা বেড়েছে। কিছুকাল আগে হলে তিনি সন্দেহের বশেই হিউ-পিনান এবং জাঙ্ককে বন্দী করতেন। অত্যাচার চালিয়ে জানতে চাইতেন প্রকৃত কারণ। বর্তমানে তিনি সহজে অশান্তির মুখোমুখি হতে চান না। যদিও তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভীষণ সজাগ। তিনি বুঝতে পারছেন, আবার একটা কিছু ঘটতে চলেছে। মহামিশ্রও এবিষয়ে সহমত। ফলে, গুপ্তচর বিভাগের ওপর চাপ বৃদ্ধি ঘটছে। তারাই সংবাদ বয়ে নিয়ে আসছে। সর্বশেষ সংবাদ, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে এক অসন্তোষ দানা বাঁধছে। সম্রাটের বুদ্ধপ্রীতি তারা ভাল চোখে দেখছে না। সম্রাট মহামিশ্রকে প্রশ্ন করলেন, “এইসব তথাকথিত ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশ্য কী? তারা কি বৌদ্ধ মহাসভার আয়োজন করতে দিতে চায় না নাকি আরও কিছু গূঢ় উদ্দেশ্য সাধন?” খেদের সঙ্গে তিনি বললেন, “অথচ দেখ, আমি কোনো ধর্মকেই অবজ্ঞা করিনি। প্রত্যেককে আমি যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছি। আমার মুদ্রায় তাঁদের দেব-দেবীর মূর্তিও খোদাই করছি। তাছাড়া, এই হঠাৎ উঠে আসা নেতারাই বা কারা? এদের পেছনে কারা রয়েছে? আমার তো মনে হয় জাঙ্কই এসবের পেছনে কোনো না কোনো রকম ভাবে যুক্ত।”
মহামিশ্র বললেন, “জাঙ্ককে বিদায় দিন, সম্রাট।”
সম্রাট বললেন, “বিষয়টি এত সহজ নয়, মহামিশ্র। সে হিউ-পিনানের নিকট আত্মীয়। তাঁরই বিশেষ অনুরোধে আমি তাকে ঐ পদটি দিই। এখন আমাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যখন একটা অশান্তি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে তখন জাঙ্ককে সরালে তা অর্থবহ হয়ে উঠবে। বরং আমাদের এখন ভাবতে হবে যে জাঙ্ক অপদার্থ। সর্বসমক্ষে তার অপদার্থতা প্রমাণ করতে পারলেই তাকে বিদায় দেওয়া সহজ হবে।”
মহামিশ্র বললেন, “আপনি যথার্থ কথাই বলেছেন। আমি এসব কথা ভেবেই আজ জাঙ্ককে আসতে বলেছি। তার কাছ থেকে জানতে চাই, মণিকার পুত্রীর রত্ন-পেটিকা উদ্ধার আর দস্যুটিকে ধরবার কাজ কতদূর এগোল। এছাড়াও নগরে কিছু কিছু লুটের ঘটনা ঘটেছে। সে কোন লুটেরা? নগরাধ্যক্ষ এ বিষয়ে কতটা যত্নবান হয়েছে? নগরে এসব উৎপাত ছিল না। এতে সম্রাটের সম্মানহানি হচ্ছে। বিরোধীরা সম্রাটের সুনাম নষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে। তারা প্রচার করার সুযোগ পাচ্ছে যে সম্রাট প্রশাসনিক কাজে শিথিল হয়ে পড়েছেন অত্যাধিক বুদ্ধচর্চা করার জন্য।”
সম্রাট আর মহামিশ্রের আলোচনা চলার সময়ই একজন পরিচারিকা এসে জানাল, নগরাধ্যক্ষ জাঙ্ক সম্রাটের দর্শনের অভিলাষী।
সম্রাট মহামিশ্রের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পরিচারিকাটিকে বললেন, “ওকে নিয়ে এস।”
দ্বারের বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন জাঙ্ক। অচিরেই তিনি কক্ষে প্রবেশ করে আভূমি নত হয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, “সম্রাট কি আমাকে আসতে আজ্ঞা করেছিলেন?”
বসার আসন ছিল। কিন্তু সম্রাট তা উপেক্ষা করে সরাসরি বললেন, “তোমার কাজে আমি সন্তুষ্ট নই, জাঙ্ক। মনে হচ্ছে, নগরাধ্যক্ষের চাপ তুমি যথাযথ ভাবে সহ্য করতে পারছ না।”
“কেন, কেন সম্রাট! আমি দিবারাত্রি আমার কার্যালয়ে পড়ে থাকি। সেখানেই আমার আহার এবং শয়ন!”
সম্রাট এবার বললেন, “মণিকার পুত্রীর রত্ন-পেটিকা উদ্ধার এবং হত্যাকারী দস্যুটিকে বন্দী করার বিষয়ে তুমি কতদূর এগিয়েছ?”
“আজ্ঞে! আজ্ঞে!” বিব্রত হয়ে পড়ল জাঙ্ক।
“কতদূর এগিয়েছ?”
“আজ্ঞে…আমি সাম্রাজ্যের নগরে নগরে প্রচার করে দিয়েছি। এখনও কোনো সংবাদ পাইনি। চিন্তা করবেন না। আর কয়েক দিনের ব্যাপার।”
“রাজধানীতে দস্যুবৃত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে কেন? এতো ছিল না। এ কোন দস্যু—নিভৃতে নাগরিকদের আক্রমণ করে লুট করছে?”
“আজ্ঞে–সন্ধান করছি। দস্যুটির মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকার জন্য তাকে ঠিক সনাক্ত করতে পারছি না। তবে নগরে প্রহরীরা এ বিষয়ে চোখ কান খোলা রেখেছে। প্রতিটি উপকার্যালয়ে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। আশা করি অতি শীঘ্র এই সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে।”
সম্রাট গম্ভীরভাবে বললেন।–বেশ, তোমায় সাতদিন সময় দিলাম। ব্যর্থ হলে তা তোমার অযোগ্যতা প্রমাণ করবে। যাও।”
সম্রাট আর মহামিশ্রকে অভিবাদন জানাতে জানাতে পালিয়ে বাঁচলেন জাঙ্ক। বেরুবার পর মনে মনে স্থির করলেন, রত্ন-পেটিকাটির ব্যবস্থা তথা দস্যু বাকাটকির বিষয়টির আজ মীমাংসা করতে হবে।
জাঙ্ক বিদায় হতেই সম্রাট বললেন, “মহামিশ্র! জাঙ্কের আচরণ সন্দেহজনক। তুমি এখনই গূঢ়পুরুষ-প্রধান নীলাকার আর সেনাপতি গুণবর্ধনকে ডেকে পাঠাও। তারা যেন এখনই উপস্থিত হয়।”
মহামিশ্র বললেন, “নিশ্চয় সম্রাট!” দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে একজন পরিচারিকাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠিয়ে মহামিশ্র ফিরে এলেন।
গূঢ়পুরুষ নীলাকারের কার্যালয় এবং সেনাপতি গুণবর্ধনের কার্যালয় সেনানিবাসেই—পাশাপাশি। দুটি বিভাগ অপূর্ব সমন্বয়ে কাজ চালায়। তথ্যের আদান প্রদান করে। রাজপ্রাসাদের অনতিদূরেই দুটি কার্যালয়। তাই দুজনের সম্রাটের কাছে ছুটে আসতে বিশেষ সময় লাগল না।
সম্রাট চোখ বুজে আসনে বসে আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিলেন। একটি সময় ছিল যখন তিনি খোলা তলোয়ার হাতে সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে বিভীষিকার মতো ছুটে বেরিয়েছেন। তারপর সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু। সম্রাটের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল। মহামিশ্র ছাড়া সকলেই বিশ্বাস করে যে সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু সম্রাটকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। শিথিল হয়ে গেছেন তিনি। আশ্রয় নিয়েছেন বুদ্ধের চরণে। নারী জাতির প্রতি তাঁর কৌতূহল নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু…!
“সম্রাটের জয় হোক!” গুণবর্ধন ও নীলাকার অভিবাদন জানালেন সম্রাট কণিষ্ককে। “আমাদের আহ্বান করেছেন, সম্রাট?”
সম্রাট চোখ খুললেন। তারপর দুজনকে বসতে বলে একটু চুপ করে রইলেন। এরপর হঠাৎ বললেন, “নীলাকার! তোমার বিভাগ কি সাম্রাজ্যের কোনো খোঁজখবর রাখে আজকাল?”
বিমূঢ় নীলাকার বিব্রত হয়ে বললেন, “এমন কথা কেন বলছেন, সম্রাট? কোনো বিচ্যুতি কি আপনি লক্ষ করেছেন? তাহলে অবিলম্বে আমি তা সংশোধন করে নেব।”
“বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের ভেতরে এক অসন্তোষ যে মাথাচাড়া দিচ্ছে, তার কোনো সংবাদ তোমার কাছে আছে কি?”
“ক্ষমা করবেন সম্রাট। আমার গূঢ়পুরুষেরা ইতিমধ্যেই এই নিয়ে ব্যস্ত। তারা তাদের নেতাদের—তাদের উদ্দেশ্য—তাদের পেছনে উৎসাহদাতা কে রয়েছে সে সম্বন্ধে তথ্য আহরণ করছে। প্রমাণযোগ্য কিছু তথ্য হাতে এলেই আমি তা আপনার গোচরে নিয়ে আসব। তবে একটা কথা আমি বলতে পারি, প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুরু বা ধর্মীয় নেতারা একাজে যুক্ত নন। তাঁরা সম্রাট ভক্ত। বিভিন্ন ধর্মের কিছু উৎসাহী যুবক এসব কাজের উৎসাহদাতা বলে জানা গেছে। কিন্তু বিশদভাবে সবকিছু না জানা পর্যন্ত আপনাকে কিছু জানাতে পারছি না। তারা অতিশয় ধূর্ত! তবু, সম্রাট চিন্তা করবেন না। ভন্তে মহামিশ্রের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। প্রাথমিক প্রতিবেদনটি আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম।”
সম্রাট বললেন, “হ্যাঁ। মহামিশ্র আমায় জানিয়েছে। কিন্তু যা জেনেছি, তা যথেষ্ট নয়। সেইজন্যই তোমাকে ডাকা। এই কাজটি এত শ্লথভাবে করলে চলবে না। দ্রুত শেষ করতে হবে। নচেৎ সাম্রাজ্যে অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে।”
“সম্রাটের নির্দেশ আমি পালন করব। তবে এ প্রসঙ্গ যখন উঠল, তখন সম্রাটের অবগতির জন্য বলে রাখি, বল্খের প্রশাসক হিউ-পিনান আর নগরাধ্যক্ষ জাঙ্ক আমাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। কিন্তু প্রমাণাভাব!”
সম্রাট বললেন, “আমি খুশি যে তোমার সন্দেহ আমারই অনুরূপ। তুমি নিজে পারলে বা তোমার কোনো যোগ্য সহকারীকে আগামীকালই বল্খে পাঠাও। তোমার গূঢ়পুরুষ বিভাগকে নির্দেশ দাও যেন তারা হিউ-পিনানকে সন্দেহের তালিকায় রেখে তার প্রতিটি গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখে। হিউ-পিনানের সহকারী সোরোডানকে সতর্ক কর। আমি জানি, সোরোডানের সঙ্গে হিউ-পিনানের সম্পর্ক মধুর নয়। তাকে ইংগিত দেবে যে ভবিষ্যতে সেই হবে বল্খের প্রশাসক!”
“আপনার আদেশ মতোই কাজ হবে সম্রাট। নিশ্চিন্ত থাকুন।”
সম্রাট এবার গুণবর্ধনের দিকে তাকালেন। “সেনাপতি! সাম্রাজ্য জুড়ে বিশেষ করে পুরুষপুরে ইউ-চি জাতির গোষ্ঠী বিবাদের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। যদিও বিষয়টি এখন অঙ্কুর অবস্থায় রয়ে গেছে—কিন্তু সুযোগ পেলে তা মহীরূহে পরিণত হতে দেরি লাগবে না। সুতরাং…!” সম্রাট একটু থামলেন।
উদ্গ্রীব হয়ে গুণবর্ধন প্রশ্ন করলেন, “‘সুতরাং’ কী সম্রাট?”
সম্রাট বললেন, “তোমার বাহিনীতে—এ অঞ্চলে পৃথক ধর্মগোষ্ঠীর এবং ইউ-চি গোষ্ঠীর কত লোক আছে—সে সম্বন্ধে কোনো হিসাব কি তোমার কাছে আছে?”
“না, সম্রাট। পূর্বে কখনও প্রয়োজন পড়েনি তাই…।”
“এবার প্রয়োজন পড়তে পারে। তুমি কাল বিলম্ব না করে একটি তালিকা প্রস্তুত করবে কোনো এক অজুহাত দেখিয়ে। মূলত উদ্দেশ্য হবে কুই-সাং গোষ্ঠীর এবং বৌদ্ধদের সংখ্যা নিরূপণ করা। কুই-সাং গোষ্ঠী সংখ্যায় অল্প। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাদের কিছু কিছু করে সাম্রাজ্যের পৃথক পৃথক স্থানে পাঠিয়ে ভারতীয় বা অন্য গোষ্ঠীর সেনা দিয়ে সেইসব স্থান পূরণ করে নাও। অন্যদিকে তোমাকে দেখতে হবে সেনাবাহিনীতে বৌদ্ধ জনসংখ্যা যেন অধিক হয়। কারণটা নিশ্চয় বুঝতে পারছ?”
গুণবর্ধন বলল, “বুঝতে পারছি সম্রাট। কিন্তু কিছু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যদি অনুমতি করেন…!”
“সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তো আমিও জানি। কিন্তু আমি চাই এই কাজ তুমি অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং উদ্দেশ্য গোপন রেখে করবে। শুধুমাত্র কুই-সাং গোষ্ঠীর সেনা অপসারণ করলে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। তাই প্রয়োজন হলে কুই-সাং গোষ্ঠীর দলে অন্য গোষ্ঠীর বা কিছু ভারতীয় সেনাকেও স্থানান্তরে পাঠাও। দ্বিতীয়ত, নীলাকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে প্রতিনিয়ত। লক্ষ্য রাখবে বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তি যেন মাথা চাড়া দিতে না পারে। আমি চাই না—বহু জাতি—বহু ধর্মী—বহু গোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে যে কুষাণ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে তা ধ্বংস হয়ে যাক। এই ভারত যেন মহামানবের মিলনভূমি হিসেবেই যুগ যুগ ধরে পরিচিত হতে পারে। সাম্রাজ্যে বেশ কিছু বছর ধরে শান্তির বাতাবরণ রয়েছে। তা ছিন্ন করতে বিভেদকারীদের মুহূর্তমাত্র সময় লাগবে না। আমি আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য পরিভ্রমণে আর বার হইনি। এটা আমার কাছে একটি ত্রুটি বলেই মনে হচ্ছে। তাই আমি স্থির করেছি, আগত বৌদ্ধ-সম্মেলন এবং তারপরেই ‘সমাজ উৎসব’-শেষ হলে আবার আমি সাম্রাজ্য পরিভ্রমণে বার হব। প্রজাদের সঙ্গে আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হওয়া প্রয়োজন। যাইহোক তোমরা তোমাদের বাহিনীকে প্রস্তুত রেখো। দিগন্তে আমি যেন অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি!”
মহামিশ্র, গুণবর্ধন ও নীলাকার একত্রে সম্রাটকে আশ্বস্ত করলেন, “চিন্তা করবেন না সম্রাট। সাম্রাজ্যের কল্যাণের জন্য আমরা আমাদের প্রাণ উৎসর্গ করার শপথ নিয়েছি। আমরা জানি, সমগ্র সাম্রাজ্যের প্রজা এবং সেনাদের কাছে আপনি দ্বিতীয় ‘দেবানংপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা অশোক।’ আপনার বিরুদ্ধে একটি তৃণও উঁচিয়ে ধরার ক্ষমতা কেউ রাখে না। তবু আমরা সতর্ক থাকব। আপনার নির্দেশ মতো কাজ আজ থেকেই শুরু করব।”
সম্রাট আশ্বস্ত হলেন।
সভাভঙ্গ হল। গুণবর্ধন আর নীলাকার বেরিয়ে যেতে মহামিশ্র বললেন, “সম্রাট! আপনাকে ক্লান্ত লাগছে। চলুন, কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন।”
দাসীরা দেওয়ালগিরিগুলি একে একে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। আলোয় ঝলমল করে উঠল প্রাসাদ।
দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মহামিশ্র বললেন, “জগতকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাবার জন্য সম্রাট অশোকের পরই আপনার আগমন। সেই পরম বুদ্ধের পায়ে আপনি নিজেকে সমর্পণ করেছেন। কে আপনার অনিষ্ট করবে?”
দোতলায় মহামিশ্র ছাড়া অন্য পুরুষের আগমন নিষিদ্ধ। অলিন্দের দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষিণী এবং প্রাসাদ-রমণীদের মধ্য দিয়ে মহামিশ্র সম্রাটকে তাঁর কক্ষে নিয়ে গেলেন। সম্রাট শয্যার এক প্রান্তে একটু আরাম করে বসলেন।
মহামিশ্র বললেন, “সম্রাট! বিশ্রামের পর পোষাক পরিবর্তন ও স্নান-ঘরে স্নান সেরে নিন। স্বস্তি পাবেন। আমি দাসী এবং প্রাসাদ-রমণীদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। চিন্তা মুক্ত হন।”
মহামিশ্র চলে গেলেন। সম্রাট ভাবলেন, এক সময় তাঁর স্ত্রীই এইসব বিষয় দেখত। অন্তত কিছুকাল…। তারপর! সম্রাট চান না কোনো দাসী তাঁর দেহের সংস্পর্শে আসুক। নিজে স্নান-ঘরে পোষাক পালটাবেন। কিছু পরে আহার সেরে নিয়ে ঘরের কিনারায় রাখা বুদ্ধ-প্রতীক পদ্মফুলটিকে ধ্যান করবেন। আর একটু রাত হলে—নিদ্রা যদি না আসে কোনো প্রাসাদ-রমণীকে ডেকে পাঠাবেন। পরদার আড়ালে বসে সে ত্রিপিটক বা জাতক কাহিনি পড়ে শোনাবে। এক সময় তিনি নিদ্রার কোলে আত্মসমর্পণ করবেন।
সম্রাটের মাথায় এখন আর একটা চিন্তা। কশ্যপুরার কণিষ্কপুরে চতুর্থ বৌদ্ধ সংহতি। তাম্রপর্ণী, সুবর্ণভূমি, দক্ষিণাপথ, পাটলিপুত্র, ওদিকে বল্খ ইত্যাদি জায়গা থেকেও নিত্য প্রতিনিধিরা আসছেন। কিছু রাজকর্মচারি চলে গেছে কণিষ্কপুরায়। সভামন্ডপ, প্রতিনিধি এবং সম্রাটের বাসস্থানের আয়োজনে তারা ব্যস্ত। সম্রাটকে উদ্বোধন সভায় অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু বিশাল দলবল নিয়ে যাওয়ার অর্থ ওখানকার প্রশাসকদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলা। এমনিতেই তারা দেশ বিদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। তার উপর সম্রাট গিয়ে উপস্থিত হবেন। নতুন গড়ে ওঠা নগরে সম্রাটের বাসোপযোগী বাসস্থানের ব্যবস্থা করা প্রশাসকদের কাছে অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই কণিষ্ক চিন্তা করলেন, স্বল্প সংখ্যক লোক নিয়েই তিনি যাবেন। জনা চারেক প্রাসাদ-রমণী, কিছু দাস-দাসী। অঙ্গরক্ষক আর সেনা তো স্বতন্ত্র প্রশ্ন। তাঁরা সবাই শিবিরে বসবাস করবেন। মহামিশ্র সঙ্গে থাকলে তাঁর সুবিধা হোত। কিন্তু তাঁকে পুরুষপুরে রেখে যেতেই হবে।
চিন্তা থামিয়ে কণিষ্ক এবার কক্ষসজ্জার দিকে দৃষ্টি দিলেন। আজকের সজ্জাও তাকে অভিভূত করল। তিনি মহামিশ্রের কাছে জেনেছিলেন—এই সজ্জা মণিকার পুত্রীর। শুধু এই কক্ষ-সজ্জা নয়। ঐ মণিকার পুত্রী রাত্রে ত্রিপিটক এবং জাতক কাহিনি পাঠ করেও তাঁকে মুগ্ধ করেছে। সুরেলা কন্ঠস্বর। নিখুঁত উচ্চারণ। জড়তাহীন। হঠাৎ কণিষ্ক একটু যেন কেঁপে উঠলেন। মণিকার পুত্রী তাঁকে একটু আকর্ষণ করছে!
এক দাসী এসে বিনীত ভাবে জানাল, “সম্রাট! নৈশ আহার প্রস্তুত। প্রাসাদ- রমণীরা অপেক্ষা করছে।”
সম্রাটের রান্না প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন প্রাসাদ-রমণীর তত্ত্বাবধানে রাঁধা হয়। প্রথা হিসাবে সম্রাটের সামনে তাকে সেই আহার পরখ করতে হয়। খাদ্যে বিষ প্রয়োগ রাজকুলে নতুন কিছু নয়। সম্রাট বিশ্বাস করেন, তাঁকে কেউ ঘৃণীত ভাবে হত্যা করতে চাইবে না। অন্ততপক্ষে এই প্রাসাদ-রমণীরা তো নয়ই। এদের ধ্যানজ্ঞান তিনিই। যদি কোনো রকমে তাঁর অঙ্কশায়িনী হওয়া যায়—তাহলে এদের জীবন ধন্য হয়ে যাবে। কিন্তু মহামিশ্র এ ব্যাপারে ভীষণ প্রাচীনপন্থী। তিনি বলেন, “না সম্রাট, প্রথা—প্রথাই। একে রদ করার কোনো অর্থ হয়না।”
সম্রাট উঠে পড়লেন। ক্ষুধার্ত বোধ করছেন তিনি।
.
জাঙ্ক সম্রাটের কক্ষ থেকে বার হওয়ার পর স্পষ্টই বুঝতে পারলেন যে সম্রাট তাঁর ওপর প্রসন্ন নন। তাকে সাবধান করার জন্যই আজ ডেকে পাঠানো হয়েছিল। হয়তো সন্দেহও করছেন। সুতরাং অভীষ্ট সময় না আসা পর্যন্ত সম্রাটকে রুষ্ট করে তোলা চরম মূর্খামীর কাজ হবে। তাই তিনি ঠিক করলেন যে রত্ন-পেটিকা আর দস্যু বাকাটকির সমস্যাটির আশু সমাধান করতে হবে। মণিকার পুত্রী হয়তো সম্রাটকে নিত্য বিরক্ত করছেন। আর রাজধানীর পথে-ঘাটে দস্যু বাকাটকির দস্যুতা ইতিমধ্যেই পুরুষপুরের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে সম্রাট পর্যন্ত পৌঁছেছে। সুতরাং এসব সমস্যা যদি সপ্তাহখানেকের মধ্যে নিষ্পত্তি করা না যায় তাহলে তা সব তাঁর অপদার্থতা প্রমাণে ব্যবহৃত হবে। অথচ সমাজ উৎসবের দিন পর্যন্ত তাঁকে ধৈর্য ধরে সাবধানে থাকতেই হবে। তারপর…! পরমুহূর্তেই জাঙ্কের মনে চিন্তা এল, বাকাটকির অধ্যায় বন্ধ করে দিলে তাঁর অর্থাগমের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে তাঁর প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। অসাধু ব্যবসায়ী এবং অন্যন্য দুষ্কৃতিদের কাছ থেকে তাঁর যা আয়—তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর উঠতি নেতাদের বিপুল চাহিদা। কাজ শুরু হয়ে গেছে। মাঝপথে অর্থের জন্য তা বন্ধ হয়ে গেলে পুরো অর্থটাই লোকসান হয়ে যাবে। এদিকে হিউ-পিনানের অর্থ এবং তাঁর পাঠানো ঘাতকদলেরও কোনো সংবাদ নেই। জাঙ্ক স্থির করলেন, আর দু-একদিনের মধ্যে হিউ-পিনানের অর্থ না এলে তাঁকে তাঁর গোষ্ঠীভুক্ত মন্ত্রী ইউনাস, ভার্গব আর দুবলের কাছে অর্থ চাইতে হবে। তাঁরাও যখন স্বইচ্ছায় এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছিলেন তখন অর্থব্যয় করতে তাঁরা বাধ্য। হিউ-পিনানের মাধ্যমেই এই তিন মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। তাঁদের দাবি ছোট। তক্ষশিলা আর পুষ্কলাবতীর রাজ্যপদ। অবশ্যই তাঁরা তাঁর অধীনেই থাকবেন। পরে যদি সম্ভব হয়—হিউ-পিনান যদি করুণা করেন—তাহলে তাঁরা ইরারকন্দ-খোটান বা কাশগড়েও যেতে পারেন। রেশম পথে আধিপত্য বিস্তার করবেন। বণিকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা অনেক সহজসাধ্য!
শেষ পর্যন্ত হিউ-পিনানের ওপর বিরক্ত হয়ে জাঙ্ক স্থির করলেন, তিনি নিজেই একটি ঘাতকদল গড়ে তুলবেন। অসুবিধার কী আছে—একটু সাবধানী হতে হবে আর কি! রাজপ্রাসাদের নকশা তিনি ইউনাসের কাছ থেকে জোগাড় করে নেবেন। তাঁর জানা আছে, সম্রাট দোতলায় বাস করেন। উদ্যান দিয়ে রজ্জু সোপানের সাহায্যে ঘাতকরা দোতলায় উঠে যাবে। তার আগে উদ্যানের দিকে সামান্য যে কজন প্রহরী থাকে তাদের নিঃশব্দে হত্যা করলেই চলবে। সমাজ-উৎসবের দিন সবাই এমনিতেই ক্লান্ত থাকবে। বিশেষ অসুবিধা হবার কথা নয়।
জাঙ্কের চিন্তা আবার রত্ন-পেটিকা আর বাকাটকিতে ফিরে এল। সম্রাট মাত্র সাত দিন সময় দিয়েছেন। অন্যদিকে সমাজ-উৎসবের এখনও যথেষ্ট দেরি। সুতরাং কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে বাকাটকীর অধ্যায় তার শেষ করা উচিত। সামান্য কিছু আর্থিক ক্ষতি হবে। হোক গে। একসঙ্গে এত লোভ করা ভাল না। তাই বাকাটকি এবং তাঁর শকটচালকের আর বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। পরিকল্পনা প্রস্তুত করা শুরু করলেন জাঙ্ক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন