কণিষ্ক – ১৯

অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

নীলাকারের চরটি ঘোড়া নিয়ে সোজা কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ল। জাঙ্ক ঘাতকদের সাফল্যের সংবাদের জন্য উৎকণ্ঠিতভাবে দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিলেন। চরটিকে ঘোড়া থেকে নামতেই কর্কশভাবে তিনি প্রশ্ন করলেন, তুই কে?

চরটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই চিৎকার করে বলে উঠল, সম্রাট জাষ্কের জয় হোক! সম্রাট জাঙ্ক দীর্ঘজীবী হোন। কণিষ্ক নিহত হয়েছে!

উপস্থিত সব প্রহরীদের মধ্যে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়তেই গুঞ্জন উঠল। সম্রাট কণিষ্ক নিহত! কে হত্যা করল? কিন্তু জোর গলায় কেউ প্রশ্নটি চর কিংবা জাষ্ককে করতে সাহসী হল না।

জাঙ্ক কিন্তু সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করলেন, তুই কে? কে পাঠিয়েছে?

আজ্ঞে আমি প্রাসাদেরই লোক। মিউ-সিনান আমাকে পাঠিয়েছে।

জাঙ্ক একটু হোঁচট খেলেন। মিউ-সিনানের নাম তো কারোর জানার কথা নয়। তবু তিনি না দমে বললেন, ওরা সব কোথায়?

ওনারা আজ রাতে ফিরবেন না। প্রাসাদ-রমণীদের নিয়ে আজ রাতভোর ওনারা মহোৎসব করবেন। অনেক দিন তারা দেশছাড়া এবং উপবাসী।

জাঙ্ক আর সন্দেহ করার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। তাঁর প্রশ্নবাণ থামতেই চরটি আবার বলে উঠল, সম্রাট জাঙ্ক দীর্ঘজীবী হোন।

প্রহরী দলের মধ্যে প্রতিধ্বনি উঠল, সম্রাট জাঙ্ক দীর্ঘজীবী হোন।

জাষ্ক হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। দাওয়ার ধারে একটি বিশাল ধনু আর তিনটি বড় ধরনের তির রাখা ছিল। তিরগুলোর মাথায় জড়ানো ছিল তৈলনিষিক্ত কার্পাস বস্ত্র। তিনি চেঁচিয়ে ডাকলেন, খরতান। হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? তিরগুলো ছোড়ো। দেরি হয়ে গেছে।

খরতান নামে একটি বলশালী প্রহরী ছুটে এসে ধনুকটি তুলে নিল। একটি জ্বলন্ত মশাল থেকে তিরগুলি জ্বালিয়ে নিয়ে এক এক করে উত্তর পাহাড় লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। তিরগুলি নগরের উত্তর প্রাচীর পার হতে পারবে না ঠিকই—তবে উত্তর পাহাড়ের আত্মগোপনকারী বল্ম সেনাদের চোখে পড়বে। জ্বলন্ত তিরের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা গেল পাহাড়ের মাথায় সার সার মশাল জ্বলে উঠছে এবং সেগুলি যেন নিচে নেমে আসছে দ্রুতগতিতে।

জাঙ্ক গর্জন করে উঠলেন—প্রহরীরা সার দিয়ে দাঁড়াও। আমাদের সেনারা পাহাড় থেকে ছুটে আসছে। তারা নগরের অধিকার নেবে। আমরা অধিকার করব রাজপ্রাসাদ আর সেনানিবাস। এই মুহূর্ত থেকে আমি সম্রাট! আমার আদেশ যে না পালন করবে তার মৃত্যুদণ্ড।

চরটি বলল, জোর দিয়ে বল, সম্রাট জাঙ্ক দীর্ঘজীবী হোন!

জাঙ্ক চরটির প্রতি প্রসন্ন হলেন। বললেন, কাল রাজসভায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরো। তোমার পদোন্নতি ঘটাব।

সম্রাটের প্রতি আমি আজীবন অনুগত থাকব।

হঠাৎ একসঙ্গে অনেকগুলি ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যেতে থাকল। উল্লসিত হয়ে উঠল জাঙ্ক। বাহিনী নগরে প্রবেশ করেছে। বলছি না। তোমরা সার বেঁধে দাঁড়াও। সেনাদের মতো সার বেঁধে তৈরি হও। নতুন সম্রাটের আদেশ!

অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রহরীরা সারবদ্ধ হতে থাকল। সম্রাট নিহত! তাদেরও সেরকম হলে নিহত হবার বাধা কোথায়?

হঠাৎ জাঙ্ক বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। আগত বাহিনী সরাসরি কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার পরিবর্তে দু-ভাগ হয়ে কার্যালয়টিকে ঘিরে ফেলল। কেবলমাত্র মুখে কালো কাপড় চাপা দিয়ে এক অশ্বারোহী ধীরে ধীরে প্রাঙ্গণে এসে ঢুকল।

জাঙ্ক আতঙ্কিত হয়ে দেখল, এই সেনাটি বল্বের সেনা নয়।—তুই কে? ওরাই বা কারা?

অশ্বারোহীটি চিৎকার করে উঠল, সম্রাট কণিষ্ক দীর্ঘজীবী হোন!

সম্রাট কণিষ্ক তো মৃত! জাঙ্ক নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেছেন। প্রহরীরা বিভ্রান্ত হয়ে বলল।

জাঙ্ক স্নাতক বাহিনী পাঠিয়েছিল। দশজনের সেই দলের একমাত্র জীবিত মিউ-সিনান বন্দি। যণ্ডরূপী সম্রাট জীবিত!

এবার প্রহরীবাহিনীর মধ্যে চাঞ্চল্য জাগল।—তুমি কে?

আমি প্রাসাদ প্রতিরক্ষার নতুন অধিকর্তা—মন্ত্রী মহামিশ্রের সহকারী ভট্টরাই। তোমরা এবং তোমাদের প্রভুও আমাকে চিনবে। আমি নগর-তোরণের সেনা ছিলাম। ভট্টরাই তার মুখের কাপড় সরিয়ে দিল।

খরতান এগিয়ে এল তলোয়ার হাতে।

শান্তভাবে ভট্টরাই বলল, আত্মসমর্পণ কর, জাঙ্ক।

জাঙ্ক আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, হত্যা কর, খরতান।

ভট্টরাই বলল, বাইরে আমার বাহিনী অপেক্ষা করছে। তোমার কার্যালয় ঘিরে ফেলেছে।

তার আগে তুই তো মর। খরতান, হত্যা কর।

খরতান এগিয়ে আসতেই ঘোড়া নিয়ে ঘুরল ভট্টরাই। তার চকিত আঘাতে খরতানের মুণ্ডু ছিটকে পড়ল মাটিতে।

সারবদ্ধ প্রহরীদের মধ্যে সভয় গুঞ্জন। এই খরতানকে দিয়ে জাঙ্ক তাদের ওপর অনেক অত্যাচার করেছেন। বেশিরভাগ প্রহরীরাই খুশি। তারা চেঁচিয়ে উঠল, সম্রাট কণিষ্ক দীর্ঘজীবী হোন! জাঙ্ক নিপাত যাক।

জাঙ্ক বুঝতে পারলেন, তাঁর বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ ঘটে গেছে। তিনি পিছু হটে পালাবার পথ খুঁজলেন। কিন্তু ভট্টরাই তাঁর পথরোধ করে তার খোলা তলোয়ার জাঙ্কের বুকে ঠেকাল। পালাবার পথ সব বন্ধ!

আমায় হত্যা কর।

না। সম্রাট কণিষ্ক এভাবে হত্যা করেন না। তিনি বিচার করে সর্বসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড দেন। তোকে বিচার সভায় তোলা হবে। নানান অভিযোগ ছাড়াও তোর বিরুদ্ধে সম্রাটকে হত্যা করার চেষ্টা এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ রয়েছে। এই শত শত প্রহরীরা সাক্ষ্য দেবে।

জাঙ্ক যেন হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, বেশ। চল। আমায় কোথায় নিয়ে যাবি? কুই-সাং গোষ্ঠী এর প্রতিশোধ নেবে তোর ওপর।

ভট্টরাই হাসল।—আপাতত তোর ঘরে চল। ভাবী সম্রাজ্ঞীর রত্নগুলি তো উদ্ধার করি।

না। ঐ রত্ন আমি দেব না।

ভট্টরাই তলোয়ার দিয়ে জাঙ্কের বুকে চাপ দিল।—চল!

শেষপর্যন্ত ভট্টরাই রত্নপূর্ণ থলিটি উদ্ধার করে জাঙ্ককে নিয়ে বাইরে এল। থলিকাটি সে উঁচু করে তুলে ধরে সবাইকে দেখিয়ে বলল, এরই মধ্যে রয়েছে ভাবী সম্রাজ্ঞীর লুঠ হওয়া রত্ন! এই রত্নের জন্য জাঙ্ক হত্যা করেছে তিনজনকে। আমাকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছে। এই রত্ন হস্তগত করার পর থেকেই তার সম্রাট হবার শখ হয়। সম্রাট হওয়া অত সহজ নয়। তার জন্য শক্তি ছাড়াও প্রয়োজন প্রখর বুদ্ধি। ক্রূরতার সঙ্গে চাই ঔদার্য! ক্রূরতা ছাড়া তোর কোন গুণটি আছে, জাঙ্ক? এরপর ভট্টরাই প্রহরীদের আদেশ করল, একে নিয়ে চল কারাগারে।

প্রহরীরা জাষ্ককে বাঁধার ব্যাপারে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল।

জাঙ্ক তখনও গর্জন করে যাচ্ছে।—আমার সেনারা পাহাড় থেকে নামছে। রাজধানীর অধিকার নিয়ে নেবে সামান্য পরে। তখন দেখব, এদের—তোদের কটার মুণ্ডু ঘাড়ে থাকে!

আবার ভট্টরাই তীব্রভাবে হেসে উঠল, উত্তর পাহাড়ে তোর কত সেনা ছিল, জাঙ্ক? দুহাজার, পাঁচহাজার? তাদের ঘিরে ফেলেছে কত সেনা জানিস—তিরিশ হাজার। একটু পরেই দেখতে পাবি, ঐ বস্তু সেনার কতজনের ঘাড়ে মুণ্ডু থাকে। তোর সামনেই সেগুলি কাটা হবে খরতানের মতো। শেষে তোরটাও। একটু থেমে ভট্টরাই বলল, অনেক হয়েছে। এবার চল। আমার ঘুম পাচ্ছে!

পরদিন প্রভাতে পুরুষপুরের জনসাধারণ উত্তাল হয়ে উঠে রাজপ্রাসাদের দিকে ছুটে এল সম্রাটকে দেখবার জন্য। জাঙ্ক এবং তাঁর সহযোগী ইউনাস, ভার্গব, দুবল আর হিউ-পিনানের রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকার এবং সম্রাটকে হত্যা করার প্রচেষ্টার কথা ছড়িয়ে পড়েছে। লোকের মনে সন্দেহ জেগেছে—সত্যিই সম্রাট জীবিত তো?

সম্রাটের নিজেকে ক্লান্ত, ভারাক্রান্ত লাগছিল। তিনি শুয়েছিলেন। চরক উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আবার ঔষধী দিয়ে গেছেন। সম্রাট আজ প্রাসাদ-রমণীদের সেবা নিতে কৌশলে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ওদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই। চার-চারজন সঙ্গী ধর্ষিতা এবং নিহত হয়েছে—জানুকা, বল্লভী, পদ্মা আর সুগতা! ওদের আজ ডেকো না, মহামিশ্র।

মহামিশ্রের পক্ষে প্রকৃত কারণটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি। তিনি লক্ষ করেছেন যে গতরাত থেকেই সম্রাট প্রাসাদ-রমণীদের সম্পর্কে শীতলতা প্রকাশ করেছেন। এর একটিমাত্র কারণ, কমলিকার বুদ্ধিহীন আচরণ! মহামিশ্র জানেন না, কমলিকার ভবিষ্যৎ কী? সম্রাজ্ঞী হওয়া তো দূরের কথা—তার প্রাণদণ্ড না হয়ে যায়!

সম্রাটের নতুন কক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহামিশ্র। সম্রাট বললেন, আমি আমার পূর্বতন কক্ষে আর ফিরে যেতে চাই না, মহামিশ্র। এই কক্ষটিও যথেষ্ট সুন্দর—তবে একটু ছোট। তা হোক। আমি এখানেই থাকব।

ও কক্ষে কেন নয়—জানতে পারি কি সম্রাট?

ওখানকার মৃতদেহগুলি—রক্তের দাগ আমাকে ঘুমোতে দেবে না, মহামিশ্র।

এবারও মহামিশ্র যা বোঝার তা বুঝে নিলেন। রণক্ষেত্রে সম্রাট নিজের হাতে কত শত মানুষকে হত্যা করেছেন—নররক্তে স্নান করেছেন! তাই সম্রাটের ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে সম্রাট ভট্টরাইয়ের অচেতন দেহের ওপর কমলিকার সেই বিলাপ ভুলতে পারছেন না। সম্রাটের হিমশীতল সেই দৃষ্টি এখনো তাঁর চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে!

প্রসঙ্গান্তরে গেলেন সম্রাট।–অন্য সব সংবাদ কী?

সোরোডান বন্দী হিউ-পিনানকে নিয়ে পুরুষপুরের পথে বেরিয়ে পড়েছে। উত্তর পাহাড়ে বল্ব দেশীয় প্রায় হাজার দুয়েক সেনা নিহত হয়েছে। পুরুষপুরের আংশিক সেনা, সৌরাষ্ট্র আর নিম্নসিন্ধুর সামরিক ঘাঁটির সেনাদের মিলিত আক্রমণে পহ্লব বিদ্রোহ নিঃশেষ হয়ে গেছে। পহ্লব ক্ষত্রপকেও বন্দী করে পুরুষপুরে আনা হচ্ছে। নগরে জাঙ্ক ও তাঁর সহযোগী তিন মন্ত্রী ইউনাস, ভার্গব আর দুবলও সৈন্য-কারাগারে রয়েছে।

নগর পরিচালক পদ তো শূন্য রাখা যায় না, মহামিশ্র।

জানি। তবে বর্তমানে নগর কার্যালয়ের ভার দেওয়া হয়েছে উপসেনাপতি সোনাপতকে। ভবিষ্যতে উপযুক্ত ব্যক্তিকে তার জায়গায় বসিয়ে সোনাপতকে বাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হবে। আপনি একটু সুস্থ হয়ে উঠুন।

সম্রাট চেষ্টা করেও তাঁর দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে পারলেন না, আর সুস্থ! কবে যে আচার্যের হাত থেকে মুক্তি পাব!

বাইরের জনতার কোলাহলের শব্দ সম্রাটের কক্ষ পর্যন্ত প্লাবিত করছিল। মহামিশ্র বললেন, সম্রাট! আপনার একবার দর্শন দেওয়া উচিত। আপনি যে জীবিত তা জানানোর বিশেষ প্রয়োজন। নচেৎ শত্রুরা হয়তো মিথ্যা প্রচার করে অনর্থ বাধাবে। জাঙ্ক বা ইউনাসের হীনবল হয়ে গেছে তা ভাববার কোনো কারণ নেই।

সম্রাট বললেন, তুমি সব সময়েই উচিত পরামর্শ দাও, মহামিশ্র। চল, তোমার পরামর্শ আজও আমি অগ্রাহ্য করব না।

মহামিশ্র বুঝলেন, সম্রাট তাকে প্রচ্ছন্নভাবে ব্যঙ্গ করলেন। কারণ, ‘প্রাসাদ-রমণী’ পরিকল্পনা মূলত তাঁরই! সেই পরিকল্পনা এমন ভাবে ব্যর্থ হওয়াতে তিনিই দায়ী! কমলিকা তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে এসেছিল। কমলিকার ওপর ভীষণ রাগ হলো মহামিশ্রের। সে নিজে তো ডুবলই। উপরন্তু সম্রাটের চোখে তাঁকেও হেয় প্রতিপন্ন করল! কিন্তু কী ঘটল? ভট্টরাইয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল—সেকথা তিনি জানতেন। কমলিকা বা ভট্টরাই এক প্রাসাদে থাকলেও একে অন্যের সঙ্গে যে যোগাযোগ করত—তার কোনো প্রমাণ নেই! বরং জানতেন, জানুকা আর বল্লভী মাঝেমধ্যেই ভট্টরাইয়ের সঙ্গে দেখা করছিল। ভট্টরাই বা কমলিকা কেউই কারোর কথা তাঁকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি। তবে হঠাৎ কী হলো? তাঁর মনে হলো, মুনি-ঋষিরা সত্য কথাই বলে গেছেন, মেয়েদের মনের তল পাওয়া মুশকিল!

সম্রাট মহামিশ্রের হাত ধরে বাতায়নে এসে দাঁড়ালেন। জীবিত সম্রাটকে দেখে জনতা জয়ধ্বনিতে ভেঙে পড়ল—সম্রাট কণিষ্ক দীর্ঘজীবী হোন! ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যুদণ্ড চাই।

সম্রাট হাত নেড়ে জনতাকে অভিবাদন জানালেন।

মহামিশ্র বললেন, সম্রাট শারীরিকভাবে এখনো সুস্থ নন। সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু গতরাত্রের অভিঘাতে তিনি আবার একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অবশ্য আচার্য চরক বলেছেন যে আর কয়েকটা দিনের মধ্যেই সম্রাট রাজসভা চালাবার মতো সুস্থ হয়ে উঠবেন। তখন তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার করে উপযুক্ত দণ্ড দেবেন। আপনারা এখন শান্ত মনে গৃহে বা কর্মস্থলে ফিরে যান। শত্রুরা এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আপনারা তাদের ওপর লক্ষ্য রাখবেন। বলুন, জয় সম্রাট কণিষ্কের জয়! সম্রাট কণিষ্ক দীর্ঘজীবী হোন!

জনতা গগনভেদী স্বরে চিৎকার করে উঠল, জয় সম্রাট কণিষ্কের জয়! সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন!

সম্রাট কক্ষে ফিরে গিয়ে শয্যা গ্রহণ করলেন। তাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।

মহামিশ্র ইচ্ছে করেই প্রশ্ন করলেন, সম্রাট কি অসুস্থ বোধ করছেন?

না, ভাবছি—সামনের এই বিচার আমার মনের ওপর প্রবল চাপের সৃষ্টি করবে। আশ্চর্য! ছদ্মবেশী শত্রুদের আমি চিনতে পারিনি।

মহামিশ্র বললেন, দীর্ঘ বিচারের প্রয়োজন হবে না, সম্রাট। কয়েকজন রাজসাক্ষী হবে। তাছাড়া, শত্রুদের বিরুদ্ধে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে। প্রয়োজনে, আপনাকে কঠোর হতে হবে। ভগবান বুদ্ধের পূজা করা আর শাসন পরিচালনা করা দুটি স্বতন্ত্র বিষয়। সম্রাট অশোক রাজ্যে প্রাণীহত্যা বন্ধ করেছিলেন, কিন্তু অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড রোধ করেননি। সিংহাসনে বসে তিনি হয়ে যেতেন কঠোর প্রশাসক!

কণিষ্ক বললেন, সম্রাট অশোক—অশোকই!

অপরাহ্নে অশ্বঘোষ, বসুমিত্র আর সংঘরক্ষিত এসে দেখা করলেন সম্রাটের সঙ্গে। মহাযান বিচারধারা প্রসারের সম্পর্কে সম্রাটের সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা করলেন। আচার্য চরকও এলেন। সম্রাটকে পরীক্ষা করে ঔষধী দিলেন। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, কাকে বুঝিয়ে দেব এসব ঔষধী? কমলিকা কোথায়?

সম্রাটকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে মহামিশ্র বললেন, আচার্য! প্রাসাদ রমণীরা ক্লান্ত ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তারা চোখের সামনে নরহত্যা দেখেছে। দেখেছে তাদের চারজন সাথীর ক্ষতবিক্ষত ধর্ষিত দেহ! তাঁরা মানসিকভাবে সুস্থ না হয়ে ওঠা অবধি সম্রাট তাদের সেবার কাজে নিযুক্ত করতে চান না।

অশ্বঘোষ বললেন, কিন্তু ভাবী সম্রাজ্ঞীর তো আসা উচিত ছিল।

এবারও মহামিশ্র উত্তর দিলেন, তিনি সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত। সম্রাট তাঁকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলেছেন।

অশ্বঘোষ বললেন, ভালোই করেছেন, সম্রাট। তবে বিবাহ নিশ্চয় পিছিয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলজনক ক্রিয়াকর্ম কেমন করে হতে পারে?

মহামিশ্রই বললেন, যথার্থ কথাই বলেছেন। সম্রাট চান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে! কথা শেষ করে মহামিশ্র সম্রাটের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন। দেখলেন, সম্রাটের চোখে কৃতজ্ঞতা! মহামিশ্র বুঝলেন, তাঁর অনুমান নির্ভুল। কমলিকার আচরণ সমস্ত পরিস্থিতি পরিবর্তিত করে দিয়েছে। এ কী ভুল করল কমলিকা! সম্রাটের মনের কোনো তল খুঁজে পাচ্ছেন না মহামিশ্র। সেইজন্যই তাঁর দুশ্চিন্তা!

সংঘরক্ষিত আর বসুমিত্র একসময় বললেন, শুনলাম, ভট্টরাই নামে এক তরুণ সেনানীই নাকি সম্রাটের প্রাণ বাঁচিয়েছেন?

সম্রাট এবার বললেন, এ সত্য! অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতির সেই যুবক। এই প্রাসাদ প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল সে। সেও নিজে কিছুটা আহত। বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছে।

অশ্বঘোষ বললেন, সম্রাট আপনি ভাগ্যবান। মহামিশ্র, গুণবর্ধন, নীলাকার, ভট্টরাইয়ের মতো মানুষকে আপনি পাশে পেয়েছেন। এরা সম্রাটে নিবেদিতপ্রাণ!

মহামিশ্র বললেন, এ আমাদের কর্তব্য!

.

ঘটনার চারদিন পরেই রাজপ্রাসাদে এক পরিবর্তন ঘটল। সম্রাট বললেন, আর প্রাসাদ-রমণীদের প্রয়োজন নেই। তারা গৃহে ফিরে গিয়ে নিজেদের জীবন বেছে নিক। চারজন ধর্ষিতা এবং মৃত প্রাসাদ-রমণীদের জন্য তিনি ভীষণ দুঃখিত। সম্রাট এই মুহূর্তে বিবাহের কথা চিন্তা করছেন না। তাই, ভবিষ্যৎ সম্রাজ্ঞীর পক্ষেও এই প্রাসাদে বাস করা শোভনীয় নয়। তার অন্য আশ্রয় না থাকার জন্য তাকে আচার্য চরকের আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। চরক তাকে কন্যাজ্ঞান করেন। ভট্টরাইয়ের মস্তিষ্কের আঘাত গুরুতর। আচার্য চরক তাকে দেখছেন। তাকে দীর্ঘদিনের ছুটি মঞ্জুর করা হলো। ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার সাঙ্গ হলে তিনি এসব বিষয়ে পুনরায় মনোনিবেশ করবেন।

রাজাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা মহামিশ্রের স্বভাব নয়। তিনি সমস্ত বিষয়টি এবার পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলেন যে সম্রাট কমলিকা আর ভট্টরাইয়ের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখলেন। জাঙ্ক—হিউ-পিনানদের বিচার পর্ব সমাপন হতেই তিনি ওদের দুজনকে নিয়ে পড়বেন। তাঁকেও এই বিষয়ে জড়িত করলে তিনি অবাক হবেন না।

পঞ্চম দিনে সম্রাট ঘোষণা করলেন যে ষষ্ঠদিন থেকেই তিনি রাজসভায় যাবেন এবং বিচারপর্ব শুরু করবেন।

আচার্য চরক মৃদু প্রতিবাদ করলেও, সম্রাট তাঁকে কথা দিয়েছেন যে অধিক মানসিক চাপ তিনি নেবেন না। বিচার খুবই সংক্ষিপ্ত হবে। সাক্ষ্য-সাক্ষী সবই প্রস্তুত। ক্ষুব্ধ চরক বলেছেন, অগত্যা! তবে, সম্রাট স্মরণে রাখবেন, অগণিত প্রজা যেন পিতৃহীন না হয়। আমরা অন্য কোনো পিতার কথা চিন্তাও করতে পারছি না।

কণিষ্ক আশ্বস্ত করলেন আচার্যকে।—চিন্তা করবেন না। আপনি তো সকাল সন্ধ্যায় আমাকে দেখে যাবেন। আমাকে এবার রাজধর্ম পালন করতে হবে। বিলম্বিত বিচার—অবিচারের নামান্তর।

চরক আর বাধা দেননি। সম্রাটের পরিবর্তন তাঁরও চোখে ধরা পড়ছিল। প্রকৃত কারণ তিনি অবশ্য উপলব্ধি করতে পারেননি।

.

সমাজ-উৎসব রাতের ঘটনা এখন প্রায় মাসাধিক কাল পূর্বের ঘটনা। কমলিকা চরকের আশ্রমে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছে। সর্বদাই যেন এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে সে। এখনও সে তার মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে উঠতে পারেনি—কেন সে ঐদিন ভট্টরাইয়ের সঙ্গে অমন আচরণ করল? কী করে সম্রাটের বিশাল অস্তিত্ব চাপা পড়ে গেল ভট্টরাইয়ের ছায়ায়। ভট্টরাই-ই কি তাহলে গোপন পথে তার মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে আত্মগোপন করেছিল? তার স্পর্শ—তার সেই বীরত্বব্যঞ্জক মূর্তিই কি তার অস্তিত্ব প্রকাশ করে দিয়েছিল? তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিলেন সম্রাট? কে সত্য—সম্রট না ভট্টরাই? সম্রাটের প্রতি ভালোবাসা—কি নেহাৎ আবেগই ছিল? তার সঙ্গে কি প্রচ্ছন্নভাবে জড়িয়ে ছিল সম্রাজ্ঞী হবার লোভ? জানুকাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কি আবেগের বৃদ্ধি ঘটেছিল? তার কল্পনার বীরপুরুষ কি সম্রাটের মতো বয়স্ক ছিল, না কি ভট্টরাইয়ের মতো তারুণ্যে ভরা ছিল? কমলিকার আরও মনে হলো, মহামিশ্র—আচার্যের স্তুতি তার মধ্যে ইন্ধনের কাজ করেছিল। তাছাড়া এক নারী হিসাবে সম্রাটের ঐ নিঃসঙ্গ জীবন নিশ্চয় তাকে সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। সত্য-মিথ্যার আবর্তে জর্জরিত হয় কমলিকা। আচার্য বলেন, অমন বিমর্ষ হয়ে থেকো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার দেওয়া অর্থে শ্রীবৃদ্ধি পাওয়া আশ্রমের কাজে নিজেকে একটু নিয়োগ করো। শান্তি পাবে। সম্রাট একটু সুস্থির হয়ে বসলেই তোমার জীবনে এই বিরহ যন্ত্রণা অতীত হয়ে যাবে। সম্রাট বিবাহের দিন স্থির করবেন। তুমিও হবে এই বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। উজ্জ্বল তোমার ভবিষ্যৎ!

মনে মনে হাসে কমলিকা। এই বৃদ্ধ জানেন না যে, তার আর সম্রাটের মধ্যে কী ঘটে গেছে! সম্রাটের শীতল দৃষ্টি সে সেই রাতেই অনুভব করেছে। সম্রাট ভদ্রমানুষ। তাই হয়তো প্রকাশ্যে তাকে অপমান করেননি। তাঁর হৃদয় ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রতিশোধ নেননি। কিন্তু সে আবার সম্রাটকে ‘স্ত্রীজাতির প্রতি ঘৃণা’র জগতে ফিরিয়ে দিয়েছে। মানবিক বিচারে এ এক ধরনের অমার্জনীয় বিশ্বাসভঙ্গ করা। শাস্তি তার প্রাপ্য। প্রতিহিংসার রক্ত সম্রাটের শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুদ্ধের প্রভাবে। কিন্তু কমলিকা বুদ্ধের চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে উঠে এক নিমিষেই সম্রাটের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে তৃণাঞ্চলের সেই বর্বর-নৃশংস ইউ-চি রক্তের প্রভাব। কমলিকা বিশ্বাস করে না যে, সম্রাট তাকে আর ভট্টরাইকে ক্ষমা করবেন। তিনি খুব সহজেই ভুলে যাবেন, তাঁর জীবন রক্ষার পিছনে ভট্টরাই ও তার অবদান কতটুকু! এই বিশ্বাস তার আরও দৃঢ় হয়েছে, কারণ, তার আর ভট্টরাইয়ের নিরাপত্তার জন্যই নাকি চারজন করে সেনাকে প্রহরায় রাখা হয়েছে দিবারাত্রি। সত্য হচ্ছে, সম্রাট তাকে নজরবন্দী করে রেখেছেন। কই—ঐ সেনারা কি কমলিকাকে আশ্রমের বাইরে পা রাখতে দেবে? সে বন্দি—বন্দি ভট্টরাইও।

ভট্টরাই সুস্থ হয়ে এলেও এখনও শয্যাশায়ী। শয্যাশায়ী না থেকে তার করণীয়ই বা কী আছে? সম্রাট তার নিরাপত্তার জন্য প্রহরী বসিয়ে রেখেছেন। আচার্যের মুখে সে শুনেছে—আশ্রমেও নাকি প্রহরা রয়েছে। আসলে সম্রাট তাদের বন্দি করে রেখেছেন। ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের পর তাদের বিচার করবেন। সে সম্রাজ্ঞীকে ভালোবাসে—হ্যাঁ, ভালোবাসে। সেই তার অপরাধ। সে যে জীবনপণ করে তার প্রেমিকার সঙ্গে সম্রাটেরও জীবনরক্ষা করেছে—এই উপকারের কথা ইউ-চি রক্তে চাপা পড়ে যাবে নিশ্চয়। সেদিন কমলিকার দেহের স্পর্শ—তার বক্ষদেশের নরম স্পর্শ যেন তাকে এখনও জড়িয়ে রেখেছে। আসুক মৃত্যু। তবু সে জেনে যাবে, কমলিকা তাকে ভালোবাসে। সম্রাটের বৈভবকে নয়—কমলিকা ভালোবাসে ভট্টরাই নামে এক সাধারণ সেনাকে। কমলিকা তার প্রেমিকের জন্য অস্বীকার করতে পারে সম্রাটের ভয়াল ভ্রূকুটি। তবু সে অস্বীকার করবে না যে, তার দেহের ওপর সর্বসমক্ষে কমলিকার ক্রন্দনে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ত্বরিৎগতিতে কমলিকাকে সরিয়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। জাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযানের কথা তুলে এক প্রকার পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। নিজের আঘাতের কথা মনে ছিল না। সম্রাট বুদ্ধিমান। সর্বসমক্ষে তিনি উপকারীকে অপমান করেন নি। হয়তো তিনি ভীষণ এক প্রতিশোধ নেবার জন্য সময় নিয়েছেন। না—মৃত্যুকে সে ভয় করে না। সে এক যোদ্ধা। সে তার ভালোবাসার ধনের দেহের স্পর্শ পেয়েছে, তার ভালোবাসা কান্না হয়ে তার ওপর ঝরে পড়েছে! আর কী চাই তার? রত্ন? না। তুচ্ছ রত্নগুলো সে ফিরিয়ে দিয়েছে কমলিকাকে। রত্নের চেয়ে মহামূল্য যে ভালোবাসা—সেই ভালোবাসা তাকে দান করেছে কমলিকা।

শয্যায় পাশ ফিরল ভট্টরাই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন