কণিষ্ক – ১১

অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

আসনে বসে জাঙ্ক বাকাটকীর আসার প্রতীক্ষা করছিলেন। কার্যালয়ের পেটা ঘড়িতে মধ্যরাত্রি ঘোষণা করা হয়ে গেছে। ঘুম জড়িয়ে ধরছিল তাঁকে। কিন্তু আজ যদি পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ না হয় তাহলে একটি দিন নষ্ট হবে।

ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠলেন জাঙ্ক। আজ বাকাটকি এত দেরি করছে কেন? করবে তো কিছু অলংকার লুট! তারজন্য মধ্যরাত্রি পার করে দেওয়ার কি অর্থ হয়? এখন পথে কি কোনো সালঙ্কারা কন্যাকে একাকী বা দুর্বল কোনো সঙ্গীর সঙ্গে পাওয়া যাবে? তবে কি সে তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পালিয়েছে? তাই বা সম্ভব কেমন করে হবে? জাঙ্কের মনের কথা জাঙ্ক ছাড়া আর কে জানে? আফসোস হল জাঙ্কের। বাকাটকি এ ক’দিন বেশ ভালই উপার্জন করে আনছিল। আরও কটা দিন চালাতে পারলে ভালই হত। কিন্তু সম্রাট তো মাত্র সাত দিনের সময় দিয়েছেন। এই মহামিশ্রই সম্রাটের কান ভারী করেছে। মনে মনে গর্জালেন জাঙ্ক। তাঁর দিন এলে তিনিও তাঁকে দেখে নেবেন। যে আগুন জাঙ্ক লাগাবে সে আগুন থেকে পুরুষপুরে কেউ বাঁচতে পারবে না। ধর্মীয় বিক্ষোভ বড় ক্ষোভ। গোষ্ঠী বিক্ষোভও প্রাণঘাতি। ক্ষীণ হলেও তাদের প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে এখন থেকেই!

জাঙ্কের হঠাৎ ক্ষুধা পেল। আহারের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। ফলে তৎক্ষণাৎ তিনি আহার নিয়ে বসলেন। আহার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় বাকাটকি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল।

কর্কশ ভাবে জাঙ্ক বললেন, অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারিস না?

বাকাটকি কয়েক দিন জাঙ্কের সঙ্গে মেলামেশা করে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করেছিল। সে বলল, আসব তো আপনার জানা ছিল।

অনেক হয়েছে। দে, আজ কী নিয়ে এসেছিস?

বাকাটকি একটি থলি থেকে দুটি ভারি স্বর্ণহার, কয়েকটি রত্নখচিত অঙ্গুরী আর দুটি কর্ণাভরণ বার করে জাঙ্কের হাতে তুলে দিল।

অঙ্গুরীয়ের হিরেটা চোখের সামনে ধরে জাঙ্ক বলল, এটি নিশ্চয় দক্ষিণাপথের। অন্ধ্রপথের খনি থেকে এসেছে।

নির্লিপ্তভাবে বাকাটকি বলল, হতে পারে। দিন, আমাকে সাত দিনের অর্থ মিটিয়ে দিন। আমি আর পুরুষপুরে থাকব না। আপনার মতো অংশীদারের সঙ্গে আমার কাজ করা পোষাচ্ছে না। সিংহভাগ তো আপনিই নিয়ে নিচ্ছেন।

চাপা স্বরে গর্জন করে উঠলেন জাঙ্ক। বাজে বকিস না। ওরকম মুখে কাপড় বেঁধে দুর্বল মেয়েদের ওপর দস্যুতা করতে সবাই পারে। কিন্তু এই পুরুষপুরে লুটের জিনিস বিক্রি করতে কি পারবি? তোর দস্যুতার চেয়ে জিনিসপত্তর বিক্রি করা আরও কঠিন।

বাকাটকি সতর্ক হয়ে গেল। নরম গলায় বলল, আহা রাগ করছেন কেন? আমি কি সত্যিই তাই বলছি।

জাঙ্ক নরম ভাব দেখাল না। তিনি পঞ্চাশটি কার্যাপণ বাকাটকীর দিকে এগিয়ে বললেন, নে ধর!

হতবাক বাকাটকি বলল, আপনি তো আমার চেয়ে বড় দস্যু! পাঁচ শতের জায়গায় পঞ্চাশ।

জাঙ্ক বললেন, কী করব বল। গত সপ্তাহের জিনিসগুলো এখনও পড়ে আছে। বিক্রি হয়নি। এতো তোকে আমার থেকেই দিলাম!

বিক্ষুব্ধ বাকাটকি বলল, একই কথা তো প্রতিদিনই বলেন। বুঝে গেছি—কার হাতে পড়েছি! আর দস্যুতা নয়। এবার জমি চাষ করে খাব। কই আমার প্রাপ্য রত্নটা অন্তত আমায় দিন।

তোর তো ভারি লোভ! ওটা নিয়ে এখন করবি কী? বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে তো আবার আমার কাছে আসবি, তার চেয়ে বরং ওটা আমার কাছেই থাক। বিক্রি করতে পারলে ভালরকম অর্থ দোব।

বাকাটকি পাশে রাখা জল, ভাণ্ড থেকে ঢক ঢক করে কিছুটা জল পান করে আবার পাশে তাকাল। একটি পাত্রে কয়েক টুকরো মেষ-মাংস রয়েছে দেখে তা গলাধকরণ করল।

সহানুভূতি যেন ভেঙে পড়লেন জাঙ্ক।—আহা রে! যদি একটু আগে আসতিস তাহলে পেট ভরে খেতে পেতিস!

বাকাটকি ব্যঙ্গ করে বলল, জানা আছে কত খাওয়াতেন! নেহাৎ ফাঁদে পড়েছি—তাই খুব খেলাচ্ছেন। আপনি যে কী জিনিস তা আমার জানা হয়ে গেছে। দিন—ঐ পঞ্চাশ কার্যাপণই দিন, নইলে কাল আহার জুটবে না।

জাঙ্ক যেন রসিকতা করলেন। এখনই তো মাংস খেলি! আর এখন থেকেই কালকের আহারের জন্য খাই খাই করছিস? যা হোক, শোন। সম্রাট আমায় আজই ডেকেছিলেন। সেই রত্ন-পেটিকার জন্য বকাবকি করলেন। তাই আজই ঐ সম্বন্ধে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তুই হুং-চাকে নিয়ে শকটে করে নদী তীরে চলে যা। আমার জন্য অপেক্ষা করবি। আমি কয়েকজন সাক্ষী নিয়ে গিয়ে ঐ পেটিকা উদ্ধার করব। লোকের সামনে ওটা খুলে দেখাব যে ওটার ভেতর নুড়িপাথর ছাড়া আর কিছু নেই।

বাকাটকিও কম যায় না। সে বলল, সাক্ষীরা যদি প্রশ্ন করে, পেটিকাটি যে এই জায়গায় রয়েছে তা জানলেন কেমন করে?

জাঙ্ক বললেন, মূর্খ! নগরাধ্যক্ষ কি সর্বসমক্ষে তার সংবাদের উৎস সম্পর্কে প্রচার করবে? আর যদি সেরকম হয় তাহলে বলব, কোনো এক সৎ নাগরিক কাউকে ঐ স্থানে কিছু পুঁতে রাখতে দেখে আমায় সংবাদ দেয়। সেই নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য আমি কোনো কিছু প্রকাশ করতে পারব না।

যুক্তিটি স্বীকার করে নিল বাকাটকি। সে বলল, আপনি পেটিকা উদ্ধার করবেন তো আমার যাবার কী প্রয়োজন? আমায় কি জড়িয়ে ফেলার চক্রান্ত করছেন?

অভয় দিলেন জাঙ্ক। আরে তা নয়। সেই সৎ নাগরিকটি হচ্ছ তুমি। আমার শকট চালকের সঙ্গে তোমায় নদী তীরে পাঠিয়ে দিয়েছি স্থানটিকে পাহারা দেবার জন্য। আমি বিচার বিভাগীয় সাক্ষীদের ডাকতে গেছি। একেবারে পাকা কাজ যাতে পরে কেউ কিছু না বলতে পারে।

এত জটিলতা বোধগম্য হল না বাকাটকির। তবে সঙ্গে হুং-চা যাচ্ছে শুনে সে আশ্বস্ত হল। সে বলল, যাব। কিন্তু একটি শর্ত, ফিরে এসে আমি বাকি পড়ে থাকা অর্থ চাই। বিক্রি না হওয়ার ওজর শুনব না। এমনিতেই তো কয়েক লক্ষ কার্যাপণ আমায় ঠকিয়ে নিয়েছেন।

জাঙ্ক ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন। তবু তিনি প্রাণপণে নিজেকে সংযত রেখে বললেন, ঠিক আছে। তাই হবে। এখন যা তো!

নিজের কুটীরে শুয়ে থাকা ভিখারীটা দেখল, হুং-চা একজনকে নিয়ে শকট চালনা করে বেরিয়ে গেল। ঐ লোকটিই প্রায় মধ্যরাত্রে জাঙ্কের কাছে আসে, কিন্তু কোথায় গেল তারা? আরও আশ্চর্য হল সে যখন দেখল, জাঙ্ক কিছুক্ষণ পরে তাঁর ঘোড়ায় চড়ে কার্যালয় থেকে বেরিয়ে গেলেন। সমস্ত বিষয়টির মধ্যে কোথাও যেন একটি গন্ডগোল রয়েছে।

সকালে ঘুম ভাঙতে ভিখারিটি কৌতূহলী হয়ে কার্যালয়ের দিকে তাকাল। অদ্ভুত ব্যাপার! নগরাধ্যক্ষের ঘোড়াটি বাঁধা রয়েছে অথচ শকটটির কোনো চিহ্ন নেই। রাতে বার হয়ে হুং-চা আর সেই মানুষটি কি আর ফিরে আসেনি? গেল কোথায়? রাতে নগরদ্বার তো বন্ধ থাকে!

ভিক্ষায় বেরোবার জন্য প্রস্তুত হতে হতে ভিখারিটি আরও একটি দৃশ্য দেখতে পেল। বেশ কিছু নাগরিক কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। প্রহরীর দল বেরিয়ে এসেছে।

এক সময় জাঙ্কও চোখ মলতে মলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কার্যালয়ের দাওয়ায় বসে দাঁড়িয়ে থাকা জনতাকে প্রশ্ন করলেন রূঢ়ভাবে—কী ব্যাপার? সাত সকালে এই চিৎকার চেঁচামেচি কেন?

জনতা চিৎকার করে বলল, একটা সাংঘাতিক কান্ড ঘটে গেছে। আপনার শকট চালক ও অপরিচিত এক ব্যক্তি হাতে তলোয়ার নিয়ে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় কুবা নদীর তীরে পড়ে রয়েছে। আপনার শকটটিও সেখানে দাঁড়িয়ে।

বিস্ময় প্রকাশ করে জাঙ্ক স্বগতোক্তি করলেন, আরে তাই তো! শকট কোথায়? কে নিয়ে গেল—প্রহরী? রাত-কর্তব্যে কারা কারা ছিলে, এদিকে এস।

জনাচারেক প্রহরী কাঁচুমাচু মুখে জাঙ্কের সামনে এসে দাঁড়াল, আজ্ঞে?

তোমরা হুং-চাকে শকট নিয়ে বার হতে দেখেছ?

না, প্রভু। তবে আমরা দেখেছি হুং-চা তার এক মিত্রের সঙ্গে শকটের ওপর বসে অনেকক্ষণ গল্প-গুজব করছিল। লোকটিকে আমরা চিনি না। তবে হুং-চা-এর কাছে থেকে শুনেছি, তারা নাকি মিত্র। বল্বে পাশাপাশি তাদের বাড়ি। ইদানিং প্রায়ই সে হুং-চা-এর সঙ্গে গল্প করতে আসত।

সে তো আমিও কদিন লক্ষ করেছি। কিন্তু হুং-চা শকট নিয়ে বেরিয়ে গেল আর তোমরা কেউ দেখনি—কখন সে গেল? তোমরা মিথ্যে কথা বলছ। সত্য বল। নচেৎ কঠিন দণ্ড পাবে। কঠিন গলায় জাঙ্ক বললেন।

একজন প্রহরী ভীতস্বরে বলল, প্রভু যদি অভয় দেন তো একটি সত্য কথা বলি।

নির্ভয়ে বল। সত্য কথা আমি পছন্দ করি।

আজ্ঞে, আমাদের প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল। হুং-চা সে কথা শুনে বলেছিল, তোমরা একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি জেগে রইলাম। আমার মিত্র কাল ফিরে যাবে। তাই ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত পোহিয়ে যাবে। যাও যাও একটু ঘুমিয়ে নাও। আমরা বুঝতে পারিনি যে এটা হুং-চা-র ষড়যন্ত্র! আমাদের ক্ষমা করে দিন, প্রভু।

লোকটার পরিচয় জানো?

না, প্রভু। হুং-চা কোনোদিন আমাদের সঙ্গে আলাপ করায়নি। শুধু বলেছিল, তার মিত্রটি পুরুষপুরের একটি বিশেষ কাজে এসেছে।

কী কাজ, জানো?

না, প্রভু।

অপদার্থ সব। তোমাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করব।

ক্ষমা করুন প্রভু।

জাঙ্ক যেন কিছু চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, অনেক হয়েছে! চল এখন নদীর তীরে। দেখি দুটো কেমন করে মরল!

একসময় জাঙ্ক সদলবলে কুবা নদীর তীরে উপস্থিত হলেন। বহু মানুষ জমে গেছে ইতিমধ্যেই। শকটের ঘোড়াটি একটি গাছের গায়ে বাঁধা। জাঙ্ক তার গায়ে হাত বোলাতেই সেটি চিঁ চিঁ করে উঠল। জাঙ্ক চিৎকার করে জনৈক প্রহরীকে আদেশ করলেন, যা। এটাকে একটু ঘাস-জল খাইয়ে নিয়ে আয়। খিদে পেয়েছে এটার।

একজন প্রহরী এগিয়ে এসে ঘোড়াটিকে নিয়ে গেল। তারপর জমা জনতাকে দেখে জাঙ্ক এবার হুংকার দিয়ে উঠলেন।—সর। সর। পথ ছাড়। দেখি দুটোকে। জনতা সভয়ে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল। অকুস্থলের দিকে এগিয়ে গেলেন জাঙ্ক।

কিছুটা এগোতেই জাঙ্ক দেখতে পেলেন ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় হাতে তলোয়ার নিয়ে হুং-চা আর বাকাটকি পড়ে আছে। জনতাকে শুনিয়ে জাঙ্ক খেদ প্রকাশ করলেন, হতভাগা দুটো এখানে মরতে কেন এল? কী উদ্দেশ্য ছিল এদের? কখনই বা এল—কেনই বা এল? শুনলাম তো দুই বন্ধু গল্প করছিল কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে। কী মতিভ্রম হল? আহা—হুং-চা আমার বহু দিনের সাথী। সুদূর বল্গ থেকে সে আমার সঙ্গে পুরুষপুরে এসেছিল। আর এই লোকটাই বা কে? দেখতে তো দস্যুদের মতো। হুং-চা-র মিত্র ছিল। এও নাকি বল্বের অধিবাসী। হুং-চা-র মিত্র বলে আমি একে কিছু প্রশ্ন করিনি কোনোদিন! কী ভুল করেছি! কথা বলতে বলতে জাঙ্ক পা দিয়ে বাকাটকীর দেহটা উল্টে দিলেন। আরে! আরে! এটা কি…! একটি পেটিকা দেখছি! তোল! তোল! দেখি সোনাদানা কিছু আছে কি না!

একটি প্রহরী ছুটে এসে পেটিকাটি তুলল। বেশ ভারী প্রভু।

খোল! খোল! দেখ কী আছে এতে।

সমস্ত জনতার চোখ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল পেটিকাটির ওপর। কিন্তু খোলামাত্রই এক চাপা হতাশার স্বর বেরিয়ে এল সবায়ের গলা থেকে।—একি! এ যে কেবল নুড়িপাথর! কী ছিল এতে? গেল কোথায়?

জাঙ্ক এবার গম্ভীর স্বরে জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ব্যাপারটা এবার বোঝা গেল। দুজনেই এই পেটিকার অবস্থান জানত। ঠিক করেছিল, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে। সেই উদ্দেশ্যে তারা শকট নিয়ে সবায়ের অগোচরে এখানে এসেছিল এবং পেটিকা খালি দেখে একে অপরের ওপর দোষ চাপায়। ফলে আত্মঘাতি যুদ্ধ এবং মৃত্যু। কী বোঝা গেল?

ভয়ে হোক বা ভক্তিতে হোক জনতা বলে উঠল, তাই হবে। কিন্তু ভেতরে কী ছিল? তা গেলই বা কোথায়?

জাঙ্ক বললেন, সেই চিন্তা তো আমাকেও খাচ্ছে। গেল কোথায়? তারপর প্রহরীটিকে বললেন, পেটিকাটি আন তো—দেখি কার? কোনো কিছু চিহ্ন বা নাম এতে খোদাই করা আছে কিনা।

খালি পেটিকাটি হাতে নিয়ে জাঙ্ক হাতের তালু দিয়ে ওপরকার ধুলো সরালেন। খোদাই করা একটি নাম স্পষ্ট হয়ে উঠল—মণিকার মণিভদ্র! জাঙ্ক যেন চমকে উঠলেন।—আরে! এতো মণিকার পুত্রীর বাবার নাম। মণিকার পুত্রী এখন প্রাসাদ-রমণীদের একজন। এই পেটিকা উদ্ধার করার জন্যই তো সম্রাট গতকাল আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন!

জনতা বলে উঠল, হায় মণিকার পুত্রী! বা-মা গেলেন এই পেটিকার জন্য। সেই পেটিকা যদিও বা পাওয়া গেল—তাও শূন্য!

গর্জন করে উঠলেন জাঙ্ক।—এ আমার পরাজয়। আমি ছাড়ব না। এই পেটিকার পশ্চাতে নিশ্চয় তৃতীয় আরও একজন রয়েছে। তাকে আমি ধরবই। হিমালয়ের কোনো গুহায় লুকিয়ে থাকলেও তাকে আমি টেনে বার করব। সম্রাটের প্রশাসন সহস্রচক্ষু! জাঙ্ককে সে ফাঁকি দিতে পারবে না। এ আমার প্রতিজ্ঞা। তারপরেই জাঙ্ককে যথেষ্ট বিহ্বল দেখাল। সম্রাটকে আমি মুখ দেখাব কী করে? এ আমার ব্যর্থতা! আমি…!

জনতা জাঙ্কের বিলাপে অভিভূত হল। তারা যেন সান্ত্বনা দেবার জন্য বলল, আপনার কী দোষ! এই বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিটি অপরাধীকেই কি সঙ্গে সঙ্গে ধরা সম্ভব? সম্রাট বিবেচক। তিনি নিশ্চয় আপনার অসুবিধাটুকু বুঝবেন।

জাঙ্ক স্বগতোক্তি করে বললেন, তাই যেন বোঝেন। তারপর কন্ঠস্বর চড়িয়ে প্রহরীদের আদেশ করলেন, দেহদুটিকে শকটে তোল। মণিকার পুত্রীকে দেখিয়ে সনাক্ত করতে হবে—এই লোকটি দস্যু বাকাটকি কি না। সার্থবাহ-দলপতি ভল্লাটের বর্ণনা অনুযায়ী আমার মনে হচ্ছে এটি দস্যু বাকাটকি। আমার অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল। দিনের পর দিন আমার কার্যালয়ে এসে হুং-চা-এর সঙ্গে গল্পগুজব করে গেছে! ইস্!

একজন প্রহরী বলে উঠল, আপনি কী করে জানবেন প্রভু? এ তো আসত মধ্যরাতে। আপনি তো তখন শয্যায় থাকতেন। দেখলেও দূর থেকে দু-একবার দেখে থাকবেন—তাতে কি বোঝা যায়!

ঠিক! ঠিক! আমায় তখন কালঘুমে ধরত। সবই আমার কপাল!

জনতার মন সহানুভূতিতে ভরে উঠল।

সমস্ত করণীয় কাজকর্ম সেরে—অকুস্থলে একজন প্রহরীকে রেখে খুশি মনে জাঙ্ক তার কার্যালয়ের দিকে এগিয়ে চললেন। এখন তার কাজ হবে মণিকার পুত্রীকে প্রাসাদ থেকে আনিয়ে বাকাটকির মৃতদেহ সনাক্তকরণ করা। সনাক্তকরণ হয়ে গেলে মণিকার পুত্রী প্রাসাদে ফিরে যাবে—রত্নগুলি চিরকালের জন্য তার কাছেই থেকে যাবে। রইল তৃতীয় ব্যক্তির কথা। তার কাল্পনিক সন্ধান চলবে সমাজ-উৎসবের দিন পর্যন্ত। তারপর কোথায় সম্রাট? কে সম্রাট? নিজের মনে হেসে উঠলেন জাঙ্ক।

জাঙ্কের নির্দেশমতো একজন প্রহরী ছুটল রাজপ্রাসাদে। মহামিশ্রের সঙ্গে দেখা করে সমস্ত ঘটনাটি জানাল এবং বলল, মণিকার পুত্রীকে এখনই একবার কার্যালয়ে যেতে হবে সনাক্তকরণের জন্য। বেশি দেরি হলে মৃতদেহে পচন শুরু হয়ে যাবে। তখন বিষয়টি মণিকার পুত্রীর কাছে অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াবে।

মহামিশ্র বললেন, বেশ তুমি যাও। আমি মণিকার পুত্রীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর জাঙ্কের লোক চলে যেতে মহামিশ্র ভাবলেন, গতকাল সম্রাট চাপ দিলেন আর রাতারাতি সমস্যার সমাধান হয়ে গেল—আশ্চর্য! তিনি বুঝলেন জাঙ্ক ধূর্ত—কিন্তু বুদ্ধিহীন। আজ না হয় কাল এই রহস্যের মীমাংসা নিশ্চয় হবে। গুপ্তচর বিভাগ বসে নেই। তারা প্রয়োজনে মাটি খুঁড়ে একদিন না একদিন প্রকৃত তথ্যটি হাজির করবে। যাহোক, কমলিকাকে সংবাদটি দেবার জন্য দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন মহামিশ্র। কমলিকা প্রস্তুত হলে, তার শকট এবং দেহরক্ষীর ব্যবস্থাও করতে হবে। সে এখন সাধারণ রমণী নয়—প্রাসাদ-রমণী।

কমলিকার প্রতীক্ষায় জাঙ্ক কার্যালয়ের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভট্টরাইকে তিনি সংবাদ পাঠিয়েছেন—যদিও জানেন, ভট্টরাই সনাক্ত করতে পারবে না। কারণ, সে অনেক দূর থেকে বাকাটকিকে দেখেছিল।

কমলিকার শকট কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঢুকতেই জাঙ্ক এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। আসুন মণিকার পুত্রী! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। জাঙ্ক কমলিকাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কক্ষে ঢুকলেন। তারপর বললেন, বসুন। আপনাকে একটা উপহার দোব।

কমলিকা আসনে বসে কৌতুহলী হয়ে জাঙ্কের দিকে তাকাতে জাঙ্ক পেটিকাটি এগিয়ে দিলেন। দেখুন চিনতে পারেন কি না।

না চেনার কিছু ছিল না। তার বাবার নাম পরিষ্কার করে খোদাই করা রয়েছে। কোথায় পেলেন? খালি নিশ্চয়।

মৃতদেহ দুটির কাছে। তৃতীয় কোনো জন রত্নগুলি আগে বা পরে বার করে নিয়ে গেছে—আরও দুটো লড়াই করে মরেছে! তবে চিন্তা করবেন না। রত্নগুলি আমি উদ্ধার করবোই। একটু থেমে জাঙ্ক বললেন, এবার আপনি যদি দস্যু বাকাটকিকে সনাক্ত করতে পারেন তবে আমি তৃতীয়জনের সন্ধানে মন দিতে পারি। আমার সন্দেহ মৃত লোকটিই বাকাটকি।

বেশ চলুন। দেখি। তাকে চিনতে তো আমার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়!

জাঙ্ক উঠে কমলিকাকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। মৃতদেহ দুটি চাদরে ঢাকা দেওয়া ছিল। একটি প্রহরীকে খুলে দিতে বললেন তিনি।

কমলিকা বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠল, এটি কে?

ও আমার শকট চালক। দ্বিতীয়জনটিকে ভাল করে দেখুন।

কমলিকা কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দ্বিতীয় মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে থেকে পেছন ফিরল।-–না।–ও বাকাটকি নয়। আমি নিশ্চিত।

হা-হা করে উঠলেন জাঙ্ক।—না-না আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ভাল করে দেখুন। এ নিশ্চয় বাকাটকি!

কমলিকা ঘুরে দাঁড়াল। তারপর মৃদু হেসে বলল, আপনি কি বলতে চান যে আমার দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে? যে লোকটিকে আমি কিছুদিন ধরে অহর্নিশ দেখেছি, হত্যাকাণ্ডের রাত্রেও দেখেছি—তাকে চিনতে আমার ভুল হবে? আপনিই বা নিশ্চিন্ত হচ্ছেন কী করে? মনে রাখবেন, রত্নগুলি এখনও উদ্ধার হয়নি। কে সেই তৃতীয়জন? তার সঙ্গে মৃত দুজনের কী সম্পর্ক ছিল—অনুসন্ধান করুন। কথা শেষ করে কমলিকা এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় চলে এল।

ঘরের ভেতর নিরুপায় ক্রোধে জাঙ্ক কমলিকার মুণ্ডুপাত করতে থাকল।

কমলিকার চোখে হঠাৎ ধরা পড়ল, প্রাঙ্গণের এক কোণায় ভট্টরাই তাঁর ঘোড়াটিকে বাঁধছে। কমলিকার চোখে খুশির ছায়া জেগে উঠেও মিলিয়ে গেল। ভট্টরাই একবারও তার খোঁজ খবর করল না! একটু অভিমান জাগল কমলিকার মনে। আনমনে দাওয়া থেকে নেমে সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দাঁড়াল সে।

ভট্টরাই আপন খেয়ালে মাথা নিচু করে আসছিল। সিঁড়ির মুখে বাধা পেয়ে হঠাৎ মুখ তুলে তাকাতেই ভট্টরাই থতমত খেয়ে গেল।—তুমি…আপনি…! হঠাৎ?

কমলিকা বলল, হঠাৎ কেন? এতো আমারই বিষয়। দেখছ না পেটিকাটি ফেরত পেয়ে গেছি!

ও! তাই তো দেখছি। তবে শূন্য নিশ্চয়।

কী করে বুঝলে?

মুখে তাহলে খুশির ছাপ থাকত!

তুমি বলা বুঝি নিষেধ! আমি কি এতই দূরের মানুষ হয়ে গেছি? কেন ভট্টরাই…?

না! না! আসলে এখন তোমার প্রাসাদে অবস্থান। আমি এক সাধারণ মানুষ! তোমাকে সম্ভ্রম করতে হবে বই কি। স্বস্থানে অর্থাৎ প্রাসাদে যাবার আগে একবার জানাতে পারোনি? ব্যঙ্গ করল ভট্টরাই! আমি বাধা দিতাম, না কেঁদে ভাসাতাম?

কমলিকা এবার হাসল, ও এই ব্যাপার! তা তুমি কি আশ্রমে আমার খোঁজে গিয়েছিলে?

উদ্বোধনের দিন যখন আবিষ্কার করলাম যে আমি সত্যিই অকিঞ্চিৎকর এক মানুষ—তখন আর তোমার খোঁজে যাইনি। ভেবেছিলাম, তুমিই আমার খোঁজ করবে। তা করনি।

একটু চুপ করে থাকার পর কমলিকা বলল, সত্য কথা। প্রথম দিকে আমি তোমার খোঁজ করেছিলাম। তখনও তুমি সম্ভবত পৌঁছাও নি। আচার্য এটা ঠিক পছন্দ করছিলেন না। অতঃপর!

তা ঠিক!

কমলিকা বলল, আমাকে হঠাৎ আশ্রম ছেড়ে যেতে হয়। ওখানে গেলে জানতে, তোমার কথা আমি বলে এসেছিলাম কিনা!

ভট্টরাই এবার সহজ হয়ে ওঠবার চেষ্টা করল। বলল, থাক ওসব। আমরা এখন যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে। পরস্পরকে তুমি বলার সুযোগটুকু থাকলেই যথেষ্ট! বল, কী দেখলে? চিনতে পারলে?

না।

এটা কেমন হল? তবে কি সেই লোকটা…?

প্রাঙ্গণে নেমে এসে ফিসফিস করে কমলিকা বলল, আমি ইচ্ছে করেই চিনতে চাইনি।

ভট্টরাই বলল, ভালই করেছ। জাঙ্ক নাটক করছে। রত্নগুলো ওর কাছেই আছে। ও চাইছে রত্নের প্রসঙ্গটি চাপা পড়ুক। আর আমাকে ডেকে পাঠানোর তো কোনো অর্থ হয় না। আমি তো চিনতেই পারব না। তবে রত্নের বিষয়টি চাপা পড়ার সম্ভাবনা কম। সার্থবাহ দলের দলপতি ভল্লাটক এখন সম্ভবত পুষ্কলাবতীতে বসে নেই। থাকলেও সনাক্তকরণের জন্য তাকে আনাতে আনাতে মৃতদেহ পচে যাবে। তখন সনাক্তকরণের প্রশ্নটা উঠবে না।

কমলিকা বলল, যা হোক, তোমার কি মনে হয় যে হুং-চা, আর বাকাটকি লড়াই করে মরেছে ঐ রত্নের জন্য?

মোটেও না। বলেছি তো এ হচ্ছে জাঙ্কের সাজানো নাটক। সেই নাটক চুরমার করে দিয়েছ তুমি!

কমলিকা তার শকটের দিকে হাঁটা শুরু করে দিল। সঙ্গে এগোল ভট্টরাই। সে বলল, বাকাটকির কথা সারা সাম্রাজ্যে প্রচারিত হয়েছে—আর সে কিনা কার্যালয়ে হুং-চা-র সঙ্গে গল্পগুজব করতে আসত! এ কথা বিশ্বাস করতে হবে? হুং-চা এর কালের শকট-চালক আর তার সঙ্গে কিনা দস্যুদের যোগাযোগ? জাঙ্ক কি আমাদের বোকা ভাবে? তুমি মহামিশ্রকে সব জানাবে। আমার আর বিষ্কের অনেক কথাও তাকে জানাবার আছে। আমরা জাঙ্কের ওপর কিছুদিন ধরে লক্ষ রাখছি!

কমলিকা শকটে উঠে পড়ল, আসি!

এসো। ভট্টরাইয়ের মনটা হঠাৎই বিষণ্ণ হয়ে গেল। ভাবল, রাজপ্রাসাদের পরিচর্যার মধ্যে থেকে কমলিকা যেন আরও রূপবতী হয়ে উঠেছে। তার ইচ্ছে হল, কমলিকাকে বলে সে কথা। কিন্তু না। সে সংযত হয়ে ভাবল, কমলিকা এখন সম্রাটের কাছে উৎসর্গীকৃত। তার থেকে বহুদূরে। তাকে এসব কথা বলার অর্থ ধৃষ্টতা প্রকাশ করা। তবু তো সে ভাগ্যবান। কার্যালয়ের এই সমস্ত মানুষের সামনে এই অসামান্যা তার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছে। অনেকেই হয়ত তার এই সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত। গর্ব অনুভব করার চেষ্টা করল ভট্টরাই। কিন্তু পারল না। পরিবর্তে তার মন যেন কেমন হু-হু করে উঠল। বিষণ্ণ মুখে সে জাঙ্কের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন