কণিষ্ক – ৭

অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

সেদিন প্রভাতে কমলিকা চরকের আশ্রমের দাওয়ায় উদাস হয়ে বসেছিল। সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর পনেরোটা দিন পার হয়ে গেছে—কিন্তু মহামিশ্রের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এটাই হতাশ করে তুলছিল কমলিকাকে। মহামিশ্র কি ভুলে গেলেন তাকে? কতকাল আর সে আচার্যের গলগ্রহ হয়ে থাকবে? অবশ্য, গলগ্রহ বলে ভাবাটা ভুল। কারণ সে তার বিপুল ভূসম্পত্তি এই আশ্রমের নামে দান করে দিয়েছে। সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে। তাও কদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। ভূমি সংক্রান্ত বিভাগ থেকে এমনই এক সংবাদ নিয়ে এসেছেন আচার্য। সুতরাং, নিজেকে এই আশ্রম বা আচার্যের গলগ্রহ বলে ভাববার কিছু নেই। কিন্তু মহামিশ্র কেন আসছেন না? সম্রাট কি সম্মত হন নি? নাও হতে পারেন। কারণ সে শুনেছে, বিপত্নীক হলেও সম্রাটের কোনো নারী-প্রীতি নেই।

অদূরের বৃহৎ এক কুটীর থেকে আচার্যের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল। নতুন ছাত্র বা শিষ্যের একটি দল এসেছে। তাদের জ্ঞানদান করছেন আচার্য। আচার্য বলছেন, “কোনো বৈদ্য যদি তাঁর জ্ঞান এবং বোধশক্তির সাহায্যে রোগীর দেহে প্রবেশ না করতে পারেন—তাহলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ হবেন। একজন বৈদ্যকে রোগী সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে তা বিচার-বিবেচনা করতে হবে। পরিবেশকে লক্ষ করতে হবে যা কিনা রোগীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তারপরেই তিনি চিকিৎসা শুরু করবেন। রোগ নিরাময় করার চেয়েও রোগের পুনরাবৃত্তি রোধ করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চরক বলেছেন, আমাদের পরিপাক, পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তিনটি ‘দোষ’-এর সাহায্যে একটি মানবদেহ পরিচালিত হয়। তা হচ্ছে, বায়ু, কফ, আর পিত্ত। বায়ু হচ্ছে দেহ সঞ্চালন, ‘কফ’ হচ্ছে পিচ্ছিলকরণ ও স্থায়িত্ব, কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক- -৫ ৬৬ আর ‘পিত্ত’ হচ্ছে পরিবর্তন। এই ‘দোষ’-এর সৃষ্টি হয় মানুষ যখন খাদ্য গ্রহণ করে, ‘ধাতু’ উৎপন্ন করে। ধাতু হচ্ছে রক্ত, মাংস ও হাড়ের রস। এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে, একই পরিমাণ খাদ্য ভিন্ন ভিন্ন শরীরে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় ‘দোষ’ উৎপন্ন করে। তাই একটি দেহ অন্য একটি দেহের তুলনায় পৃথক। কোনো মানুষ হয় দুর্বল, প্রাণ-চঞ্চলতাহীন, অন্যদিকে আর একটি মানুষ শক্তসমর্থ এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর!”

“মানুষ কখন রোগাক্রান্ত হয়? যখনই শরীরের মধ্যে ত্রিদোষ-এর সমতা বিঘ্নিত হয়—তখনই। এই ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন ঔষুধীর প্রয়োগ।”

চরক একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন, “আমি মগ গোষ্ঠীর এক ব্রাহ্মণ। তবুও শরীরবিদ্যা আমাকে আকর্ষণ করত। যৌবনে আমি শুশ্মশান-মশানে ঘুরে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে দেখবার চেষ্টা করেছি মানুষের ভিতরকার যন্ত্রপাতি। মানুষের দেহে দাঁত সমেত তিনশত ষাটটি হাড় আছে। একটি হৃৎপিণ্ড আছে যা তেরোটি প্রধান নালি দ্বারা রক্ত সঞ্চালন করে। এই নালিগুলির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ক্ষুদ্র-বৃহৎ-সরু-স্থূল সব নালি, যা কিন্তু দেহের প্রত্যন্ত প্রান্তে রক্তের সাহায্যে পুষ্টিকে ও বর্জ্যকে বহন করে নিয়ে যায়। প্রধান নালিগুলি প্রতিরুদ্ধ হলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে।

আমাদের দেশে সুপ্রাচীন কালেও বিজ্ঞ বৈদ্যের অভাব ছিল না। সেইসব যুগে ছিলেন, আত্রেয়, অগ্নিবেশের মতো আয়ুর্বেদাচার্যরা। তাঁরা চিকিৎসক হিসাবে তাঁদের অভিজ্ঞান সব লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আমি তা বর্তমানে সংশোধন ও পরিমার্জন দ্বারা যুগোপযোগী করে তুলেছি। লিখেছি আমার আয়ুর্বেদ-সংহিতা। এছাড়াও ছিলেন, ভেল, জতুকর্ণ, পরাশর, হারিত এবং ক্ষারপানি। তাঁরাও প্রত্যেকে এক একটি সংহিতা রচনা করে যান। আয়ুর্বেদ প্রতিদিনই পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে তোমাদেরই কেউ হয়তো আমার সংহিতাকেও পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করবে। এভাবে এগিয়ে চলবে আয়ুর্বেদ। মানুষ রোগযন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাবে।”

চারদিক শান্ত। ঠান্ডা বাতাস বইছিল। বরিষ্ঠ শিষ্যের দল আরোগ্য নিকেতনে রোগীদের নিয়ে ব্যস্ত। নতুন শিষ্যকুলে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। তারা মুগ্ধ বিস্ময়ে আচার্যের প্রাথমিক ভাষণ শুনছিল।

কমলিকা শুনতে পেল, আচার্য আবার বলা শুরু করেছেন :

“আমাদের আয়ুর্বেদে আটটি শাখা রয়েছে।

১। সূত্রস্থান বা সাধারণ নীতি।

২। নিদান স্থান বা রোগবিদ্যা।

৩। বিমানস্থান বা রোগ নির্ণয়।

৪। শরীর স্থান বা শরীর সম্পর্কীয় এবং শরীর ব্যবচ্ছেদ।

৫। ইন্দ্রিয় স্থান বা রোগের গতি নির্দেশক লক্ষণ ও পূর্বাভাষ।

৬। চিকিৎসা স্থান বা চিকিৎসা বিজ্ঞান।

৭। কল্পস্থান বা ঔষধ সংগ্রহ ও প্রস্তুতকরণ—সংরক্ষণ।

৮। সিদ্ধিস্থান বা চিকিৎসায় সফলতা।

চরক বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে থামতে হল। প্রাঙ্গণে একটি শকট প্রবেশের শব্দে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন মহামিশ্র দেহরক্ষী নিয়ে একটি রথে করে এসেছেন।

ব্যস্ত হয়ে কুটীর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি অভ্যর্থনা জানালেন মহামিশ্রকে। “স্বাগত! ভাবছিলাম, আজ নয় কাল আপনি নিশ্চয় এসে পড়বেন। এদিকে কমলিকা তো উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। তার ভবিষ্যতের কী করলেন?”

মহামিশ্রকে দেখে কমলিকাও এগিয়ে আসছিল। মহামিশ্র বললেন, “চলুন ওদিকের কুটীরে। বলছি সব।”

কমলিকা ফিরে গিয়ে ঘরের ভিতর থেকে আসন এনে দাওয়ার উপর বিছিয়ে দিল। মহামিশ্র আরাম করে বসলেন। তারপর কমলিকা আর চরকের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সম্রাট কমলিকার কাহিনি শুনে ব্যথিত ও লজ্জিত।”

“লজ্জিত কেন?” চরক প্রশ্ন করলেন।

“তাঁর সাম্রাজ্যে—তাঁর রাজধানীর অদূরে এই ভয়ানক কাণ্ড ঘটল—লজ্জা তাঁরই। নগরাধ্যক্ষের ওপর তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, অচিরে যদি ঐ দস্যুকে ধরতে এবং রত্নপেটিকাটি যদি উদ্ধার করা না যায়, তাহলে সেটি নগরাধ্যক্ষের ক্ষেত্রে অযোগ্যতাই প্রমাণ করবে। তার ফলাফল ভোগ করতে হবে তাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা আমি ভট্টরাইয়ের পুরস্কারের জন্য কিছু বলার আগেই সম্রাট বলেছেন, তরুণ সেনাটির পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক।”

কমলিকা চুপ করেছিল। চরক বললেন, “কিন্তু কমলিকার কী ব্যবস্থা হল? সম্রাট কি কিছু আদেশ দিয়েছেন?”

মহামিশ্র হাসিমুখে বললেন, “নিশ্চয়! আমি সে জন্যেই তো আজ সাত  সকালে কমলিকাকে নিয়ে যেতে এসেছি। পড়াশুনা জানা গুণী মেয়ে। উপযুক্ত ব্যবস্থা একটা হবেই। পুরো বিষয়টি সম্রাট আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। জানি না কমলিকর ভাগ্যে কী আছে। যদি সম্রাটকে সে তার নিজের প্রতি এবং নতুন করে সাংসারিক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে পারে—তবে হয়তো আমরা ওকে সম্রাজ্ঞীর ভূমিকায় দেখতে পাব। ও—হ্যাঁ। আমি বলতে ভুলে গেছি। আপনি হয়তো শুনেছেন, সম্রাটকে সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য প্রাসাদে দশ-বারোজন অভিজাত কন্যার সমাগম ইতিমধ্যেই ঘটেছে। তারা সম্রাটের নিত্য সেবাকাজে নিযুক্ত। সর্বোপরি দায়িত্ব আমার। প্রাসাদ-রমণী হিসাবে সেও যুক্ত হবে সেই কাজে—আমার দায়িত্বও খানিকটা কমবে। অবশ্য পরিস্থিতি দেখে কমলিকা যদি প্রাসাদ-রমণী রূপে যুক্ত হতে চায়—তবেই। তবু এখানে অসুবিধা আছে। সম্রাট সম্পূর্ণভাবে নারী-বিরূপ হয়ে উঠেছেন। কোনো প্রাসাদ-রমণীকে ধন্য করার জন্য তিনি এ যাবৎ কারোর দিকে ফিরেও তাকান নি। অথচ তারা সম্রাটের বৈধ স্ত্রী—এমনকি উপপত্নী হবার সুযোগ পেলেও নিজেদের ধন্য জ্ঞান করবে! পৃথক মর্যাদা লাভ করবে। অভিজাতরা তো আশায় বুক বেঁধে তাঁদের কন্যাদের পাঠাচ্ছেন।”

কমলিকা চিন্তা করছিল। মহামিশ্রের প্রস্তাব সে গ্রহণ করবে কি না। সে ভেবে দেখল, ভট্টরাইয়ের ঋণ তো পদোন্নতিতে মিটে যাবে। যাহোক একটা পদোন্নতি তো হচ্ছে। নচেৎ একই পদে তাকে কতকাল পড়ে থাকতে হোত, তা কে জানে! সাম্রাজ্যে বর্তমানে যুদ্ধ-বিগ্রহও নেই। তা থাকলে বিভিন্ন পদ খালি হবার সম্ভবনা থাকত।

কমলিকাকে চিন্তাগ্রস্ত দেখে আচার্য প্রশ্ন করলেন, “কী মা? কী ভাবছ? মহামিশ্রের প্রস্তাব কি গ্রহণীয় নয়?”

কমলিকা বলল, “প্রতিযোগী তো শুনলাম অনেকগুলি। আমি সেখানে আমার স্থান করে নিতে পারব?”

মহামিশ্র বললেন, “তুমি রাজরানি হবার যোগ্য। এতো আগেও বলেছি। শুধু রূপে নয়। তার সঙ্গে গুণেরও প্রয়োজন। তোমার মধ্যে দুটোই আছে। এখন দেখতে হবে তোমার ভাগ্য তোমার সহায়তা করে কি না।”

“আমি প্রস্তুত। জীবন একটা পরীক্ষা। কোনো পরীক্ষার মুখোমুখি হতে আমি ভয় পাই না।”

“তবে চল। তোমার সঙ্গে নেবার মতো কিছু তো নেই। অলংকার যা ছিল তা তো পরেই আছ। পোশাক-আশাক? সে তোমার চিন্তার বিষয় নয়।”

কমলিকা ধীর পায়ে এগিয়ে গড় হয়ে চরককে প্রণাম করল। চরক-গৃহিণীও এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কমলিকা তাঁকে প্রণাম করার আগেই তিনি কমলিকাকে বুকে চেপে ধরলেন। হু-হু করে কেঁদে উঠল কমলিকা।—”আবার মা হারালাম!”

চরক-গৃহিণী নিজের চোখের জল রোধ করে বললেন, “দূর বোকা মেয়ে! আমি তো রইলাম। যখনই মন খারাপ হবে এখানে ঘুরে যাবি। মনে কর, তুই শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিস।”

কমলিকা মৃদু প্রতিবাদ করল, “দূর! সবই কি এত সহজ? দেখছেন না আমার ভাগ্য! এক কুগ্রহে আমার জন্ম!”

চরক বললেন, “নিজেকে এভাবে ছোট করতে নেই। জীবন হচ্ছে সংগ্রাম। প্রতিষ্ঠার জন্য চাই সংগ্রাম। আমাকেই দেখছ না, জীবনে প্রতিকূলতা, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমাকে কম যুদ্ধ করতে হয়েছে? পরিণামে কিছু তো পেয়েছি!”

কমলিকা পা বাড়িয়েও থেমে গেল। হঠাৎ কোথা থেকে ভট্টরাই যেন তার সামনে এসে দাঁড়াল। কমলিকা চরক-গৃহিণীকে বলল, “মা। ভট্টরাই যদি এর মধ্যে আসে, তাহলে বলবেন, তার সম্ভাব্য পদোন্নতিতে কমলিকা খুশি। এই ছোট্ট পুরুষপুরে একদিন না একদিন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবেই। কমলিকা অকৃতজ্ঞ নয়। ভট্টরাইকে সে মনে রাখবে।”

চরক-গৃহিণী বললেন, “বলব মা। তবে এখন ভট্টরাইয়ের কথা থাক। তুমি তোমার জীবনের এক সন্ধিক্ষণে প্রবেশ করতে চলেছ। তুমি বুদ্ধিমতী!”

এক সময় মহামিশ্রের রথ প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল। রথ থেকে সাধারণ পোশাকে এক অপরূপাকে নামতে দেখে প্রহরী-দাসদাসীরা বিস্মিত হল। ইনি কে?

ফিসফিসানি শোনা গেল, “মহামিশ্রের আত্মীয়া।”

কমলিকা রাজপ্রাসাদ দেখে বিস্ফারিত হল। প্রাসাদে প্রবেশ করে সে আরও বিস্মিত হল! এত উপকরণ—একটি মাত্র মানুষের জন্য!

প্রাসাদের একটি বিশাল কক্ষে প্রবেশ করে মহামিশ্র একটি পরিচারিকাকে আদেশ করলেন, “প্রাসাদ-রমণীদের ডেকে আন। পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের হাতে একে সমর্পণ করে যাই। সভাগৃহে যাবার সময় হয়ে গেছে।”

মহামিশ্র প্রকৃতপক্ষে হচ্ছেন এই প্রাসাদ, সম্রাটের শতাধিক দেহরক্ষীর তত্ত্বাবধায়ক আর সম্রাটের ব্যক্তিগত সচিব। পদমর্যাদায় এক ক্ষমতাশালী মন্ত্রী।

অচিরেই জনা বারো সুন্দরী যুবতী ঝলমল করতে করতে কক্ষে প্রবেশ করে কমলিকাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদেরই মধ্যে সত্যা নামে এক যুবতী ৭০ তাদের স্বাভাবিক নেত্রী। সে মহামিশ্রকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, “আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন?”

“হ্যাঁ, সত্যা। তোমাদের দলে যোগ দেবার জন্য আরও একজন এসে গেছে। প্রতিযোগিতা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠল!”

সত্যা বলল, “কঠিন নয়, ভন্তে মহামিশ্র। সবই ভাগ্য! এক সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হওয়া কি সকলের ভাগ্যে লেখা থাকে? আর প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যের লক্ষণ। যাহোক, বলুন। কী আদেশ?”

“একে নিয়ে যাও। তোমার ঘরের পাশে যে ঘরটি খালি আছে সেটিতেই কমলিকা থাকবে। এর পোশাক-আশাক পরিবর্তন করিয়ে তোমাদের মতো করে নাও। আমি উঠছি। পরে সাক্ষাৎ হবে।” মহামিশ্র রাজসভার পথ ধরলেন।

সত্যা বলল, “চল। ওপরে যাই। তোমার ঘর দেখিয়ে দিই। কাজকর্ম বুঝিয়ে দিই।”

প্রাসাদ-রমণীরা প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। কমলিকা অবাক হয়ে দেখল, অলিন্দের দুপাশে সার সার কক্ষ। অন্যান্য প্রাসাদ-রমণীদের সত্যা বলল, “সম্রাটের ঘর গোছানো শুরু করেছে দাসীরা। তোরা দেখ। সম্রাটের মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন কর। আমি কমলিকাকে একটু দেখিয়ে শুনিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।” প্রাসাদ-রমণীরা কাজে চলে গেলে সত্যা একটি কক্ষে প্রবেশ করতে করতে কমলিকাকে বলল, “পাশের কক্ষটি আমার।”

কমলিকা কক্ষে ঢুকে দেখল, নতুন নতুন পোশাক-আশাক আনলায় ঝুলছে। ঘরটি ছবির মতো সুন্দর।

ঘরের ভেতরেই স্নানঘর। সত্যা বলল, “স্নানঘরে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে পোশাক-আশাক পালটে নে। তারপর তোর কথা শুনব’খন। অলিন্দ দিয়ে সোজা চলে গেলে সম্রাটের ঘর। আমরা এখন ঐখানেই থাকব কিছুক্ষণ। দেরি করিসনি।” সত্যা চলে গেল।

কমলিকার ভাল লাগল সত্যাকে। অন্য মেয়েগুলি যেন কিছুটা দাম্ভিক তাদের চোখে-মুখে এক ঈর্ষার ছবি ফুটে উঠেছে।

সম্রাটের মন্ত্রীমন্ডলী মিশ্রিত জনের। সেখানে যেমন ভারতীয়রা রয়েছেন তেমন অ-ভারতীয়রাও রয়েছেন। বন্থের প্রতিনিধিরাও স্থান পেয়েছেন। বর্হি-সাম্রাজ্যের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ। সব সময় হিন্দুকুশ পেরিয়ে দুই অংশের মধ্যে মানুষজনের চলাচল অব্যাহত। এ ছাড়াও অজস্র সার্থবাহের দল হিন্দুকুশের গিরিপথ পেরিয়ে দুই অংশের মধ্যে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। চিনা ৭১ পশমের পথটি এসেছে ইয়ারকন্দ, কাশগড় ও খোটানের মধ্য দিয়ে। বন্থের মধ্যে দিয়ে তার একটি শাখা চলে গেছে পার্থিয়া হয়ে রোমের দিকে। অপর একটি শাখা প্রবেশ করেছে ভারতে। তাই রোমের সঙ্গে গড়ে উঠেছে এক ব্যবসায়িক নিবিড়তা। অফুরন্ত ভারতীয় পণ্যসম্ভার চলে সেই রেশম পথ বেয়ে।

অন্যদিকে নিম্নসিন্ধুর বন্দরগুলি দিয়েও ভারতীয় পণ্য ছড়িয়ে পড়ে মিশর, রোম এবং এশিয়া-ইউরোপের অন্যান্য অংশে। এই রেশম-পথ আর নিম্নসিন্ধুর বন্দরগুলিই কুষাণ সাম্রাজ্যের আর্থিক বুনিয়াদ—বিপুল উন্নতির কারণ। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সম্রাট দ্বিতীয় কুজুল কদফিস তাই নিম্নসিন্ধুর বন্দরগুলিকে নিজ অধিকারে আনেন। পহ্লব আর শক গোষ্ঠীদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। সাম্রাজ্যের আর একটি অংশ হিসাবে গড়ে উঠেছে মথুরা। সেখানকার নাগ ও শক বংশীয়রাও সম্রাটের পতাকা তলে। পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে মথুরা। গান্ধার শিল্পের মতো, মৌর্য, শুঙ্গ ও ভারতের আদি শিল্পকলার সংমিশ্রণে সেখানে মথুরার শিল্প নামে নতুন এক শিল্পকলারও সৃষ্টি হয়েছে। সম্রাটপুত্র বাসিষ্ক তার পৃষ্ঠপোষক।

আজকের সভায় জানা গেল, সিন্ধুর বন্দরগুলিতে এক শ্রমিক অসন্তোষ দেখা গিয়েছে। গূঢ়পুরুষরা নির্ভয়ে ব্যক্ত করল, এই অসন্তোষের জন্য সেখানকার প্রশাসনিক অধিকারীরাই মূলত দায়ী। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের ব্যবহার খুব খারাপ। কাজের মাত্রাও বেশি করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে শ্রমিকরাও ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

মহামিশ্র বললেন, “সম্রাট! এখনই এর প্রতিকার করা প্রয়োজন। বন্দরগুলি আপনার সাম্রাজ্যের উন্নতির কারণ। এই অরাজকতা সেখানে চলতে দেওয়া যায় না। নচেৎ, ভবিষ্যৎ বিদ্রোহের কথাও আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। সম্রাট অশোকের সময় তক্ষশিলায় এইভাবে এক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। বিদ্রোহ হতে যাচ্ছিল উজ্জয়িনীতে।”

সম্রাট বললেন, “মহামিশ্র সঠিক কথাই বলেছেন। সাম্রাজ্যের আর্থিক স্বার্থে আমাদের উচিত হবে এই অসন্তোষ অবিলম্বে দূর করা। এর জন্য আমি চাই মন্ত্রী ইউনাস, ভার্গব আর দুবল আজই সিন্ধুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করুক। সমস্ত বিষয়টি খুঁটিয়ে দেখে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিক। এর ফলে তারা প্রয়োজন মতো যে কোনো আধিকারিক বা শ্রমিককে স্থানান্তরেও পাঠাতে পারে। আমি চাই শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যার সমাধান করা হোক।”

মন্ত্রী ইউনাস বললেন, “সম্রাটের আজ্ঞা শিরোধার্য। আমরা আজই সিন্ধুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করব।”

এরপর কয়েকটি আবেদনের বিচার হল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্রাট আবেদনকারীকে মুক্তি দিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় দণ্ড বহাল রইল। এক সময় সভা সেদিনের মতো ভঙ্গ হল।

সম্রাট মহামিশ্র আর অঙ্গরক্ষকদের নিয়ে প্রাসাদে ফিরে চললেন। প্রাসাদের সিংহদ্বারে অঙ্গরক্ষকেরা থেমে গেল। সম্রাট মহামিশ্রকে নিয়েই প্রাসাদে প্রবেশ করলেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন