কণিষ্ক – ১৬

অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

আরও বেশ কয়েকটা দিন পার হয়ে গেল। সম্রাট এখন অনেকটা সুস্থ। কিন্তু আচার্য চরক তাঁকে আরও কিছুদিনের জন্য শয্যাশায়ী করে রেখেছেন। তাঁর বক্তব্য—এ হৃৎপিণ্ডের অসুখ। সামান্য অনিয়মে সম্রাট আবার ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। অগত্যা…।

পরপর কয়েকদিন অনভ্যস্ত রাত্রিজাগরণে কমলিকা একটু ক্লান্ত। সম্রাট তাঁর ক্লান্তি লক্ষ করে মুখে বললেন, তুমি কয়েকদিন বিশ্রাম নাও। কিন্তু কমলিকা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারল এটি এ সম্রাটের মুখের কথা—মনের নয়। কারণ, কমলিকার পরিবর্তে যে সব প্রাসাদ-রমণীরা রাত্রিকালীন সেবায় আসে—তাদের বিরুদ্ধে সম্রাট সরাসরি কিছু অভিযোগ না করলেও, মহামিশ্রকে প্রশ্ন করেন, মণিকার পুত্রী সুস্থ তো?

মহামিশ্রের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সম্রাট কমলিকাকেই কামনা করছেন। কমলিকার প্রতি তাঁর এই আকর্ষণে খুশি হন মহামিশ্র। ভাবেন, কমলিকা শেষ পর্যন্ত সম্রাজ্ঞী হলে, তাঁরই লাভ। তাই তিনি বলেন, সে সুস্থই আছে। আজ রাত্রে সেই আসবে আপনার পরিচর্যায়।

অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে কমলিকার দেহমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে কয়েকদিন। যে সম্রাট ফিরেও তাকাতেন না—সেই সম্রাট আজ কত কাছের মানুষ! ঔষধী খেয়ে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ার আগে কত কথাই বলেন—কত যুদ্ধের, কত পাহাড়-পর্বত-হিমচূড়ার কথা। সম্রাট স্বীকার করেন, বুদ্ধের পায়ে নিজেকে নিবেদন করার আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন এক দুর্ধর্ষ প্রকৃতির মানুষ। সর্বদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে থাকতে ভালোবাসতেন। এখন তিনি শান্ত—নির্বিকার। তবু কখনও কখনও তৃণভূমির সেই আদিম আহ্বান শুনতে পান। তিনি বলেন, আমি কোনো দিনই সম্রাট অশোক হতে পারব না। আমার রক্তে সেই ভারতীয় শীতলতা, ধৈর্য নেই। তবু আমি চেষ্টা করব সেই মহান সম্রাটকে অনুসরণ করতে—তাঁর আরাধ্য কাজ শেষ করতে!

সম্রাট বলেন, কমলিকা! তোমার আঙুলের ছোঁয়ায় আমার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা কণিষ্ক জেগে উঠেছে। তোমার সেবা না পেলেও হয়তো আমি সুস্থ হয়ে উঠতাম। কিন্তু তা হতো শারীরিক—মানসিক ভাবে নয়। আমি বুদ্ধের পায়ে নিবেদিত ছিলাম—এখনও নিবেদিতই আছি। তবু আমার মনের মধ্যে যেন এক অভাব বোধ করতাম। জানতাম না তার স্বরূপ। এরপর তোমাকে মহাবিহারে প্রথম দেখলাম। আমার মধ্যে অতি ধীর এক পরিবর্তন আসতে থাকল। আমি অসুস্থ না হয়ে পড়লে বোধ হয় কিছুই বুঝতাম না। নিজের কাছেও এত অকপট হতে পারতাম না।

কমলিকা বলত, সম্রাট! আপনার অনুগ্রহে আমি ধন্য! আপনি আর কথা বলবেন না। আমি জাতক কাহিনি পাঠ করছি—আপনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ুন। নচেৎ আচার্য রাগ করবেন।

সম্রাট বলেন, আমাকে বলতে দাও কমলিকা। এতদিন পর্দার আড়ালে বসে তোমাদের জাতক-কাহিনি পাঠ শুনতাম। আমি তোমাদের দেখতামও না। কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর আমাকে প্রভাবিত করত। যেদিন তুমি পাঠ করতে আসতে সেইদিন তোমাকে সামনে বসিয়ে পাঠ শোনার ইচ্ছে হতো। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারিনি। আমার অসুখ আমায় সুযোগ করে দিল। অনেক প্রাসাদ-রমণীই আছে। কিন্তু তুমি ছাড়া আমি, কোথাও প্রাণের ছোঁয়াচ পাই না।

সম্রাট এবার ঘুমের চেষ্টা করুন। আমি তো আছি। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কমলিকা কত সহজ হয়ে উঠেছে সম্রাটের কাছে!

কমলিকা শুনেছে ভট্টরাইয়ের কথা। তাদের মধ্যে অনেকেরই সুদর্শন ঐ যুবক সম্পর্কে কৌতূহল জেগেছে। সম্রাটের স্বপ্ন তাদের কাছে মলিন হয়ে উঠছে। সম্রাটের স্থান অধিকার করছে ভট্টরাই। বিশেষ করে ইউনাস কন্যা জানুকা যেন একটু বেশি মাত্রায় উৎসাহিত হয়েছে ভট্টরাইকে নিয়ে। সে ইতিমধ্যে ভট্টরাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাও শুরু করে দিয়েছে। সে বলে, সমাজ-উৎসবের পরপরই সে অধিকার করবে ভট্টরাইকে। কোনো শক্তিই তার কাছ থেকে ভট্টরাইকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। কমলিকা আশ্বস্ত হয়, ভট্টরাই যে তার বিশেষ পরিচিত একথা প্রকাশ হয়নি। ভট্টরাইয়ের যে স্বভাব, তাতে সে নিজেও এসব কথা বলবে না কখনও। তার সঙ্গে সে দেখা করার চেষ্টাও করেনি। এ বরং ভালো হল, জানুকার দৃষ্টি পড়েছে ভট্টরাইয়ের ওপর। জানুকার বাবা এক প্রভাবশালী মন্ত্রী। হয়তো জানুকা সমাজ-উৎসবের পরপরই ভট্টরাইকে বিবাহের প্রস্তাব দেবে। ভট্টরাইয়ের অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। বরং ভালোই হবে—সে আরও উন্নতির পথে হাঁটবে। কমলিকা কল্পনার চোখে দেখতে পায় ভট্টরাই জানুকাকে আদর করছে। জানুকা ভট্টরাইয়ের বুকে মাথা রেখেছে। কিন্তু তখনই অদ্ভুত এক জ্বালা কমলিকার মনকে গ্রাস করতে চায়।—না—

না—না। সতর্ক হয় কমলিকা। সম্রাটের দিকে তাকায় সে। সম্রাট ঘুমিয়ে পড়েছেন। কমলিকার ইচ্ছে হয় সম্রাটের বুকে মাথা রাখে। পরক্ষণেই সে নিজেকে শাসন করে।—না—না। অসুস্থ সম্রাটকে উত্তেজিত করাটা অন্যায় হবে। তার চেয়ে বরং সে সম্রাটের বুকে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিক। কমলিকা সম্রাটের মধ্যে ডুবে যাবার চেষ্টা করল। সোনা ছেড়ে রূপো কেন সে নিতে যাবে? জানুকা পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছে—সুতরাং তার তো একটা অবলম্বন চাই। হোক না ভট্টরাই সেই অবলম্বন। ক্ষতি কী?

.

বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। প্রাসাদ আবাসিকদের নাম-ধাম কণ্ঠস্থ হয়ে গেছে ভট্টরাইয়ের। দেহরক্ষীদের সঙ্গে পরিচয়ও সমাপ্ত। রাজউদ্যানে গেলে কখনও সখনও বাতায়নে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদ-রমণীদের সঙ্গে তার চোখাচোখিও হয়ে যায়। কিন্তু কোথায় কমলিকা? কোনটি তার ঘর? মহামিশ্র কি জানাননি কমলিকাকে? হতাশ হয় ভট্টরাই।

অন্যদিকে কয়েকজন প্রাসাদ-রমণী নানান প্রয়োজনে ভট্টরাইয়ের কার্যালয়ে আসে। তার সঙ্গে আলাপের চেষ্টা করে। সতর্ক থাকে ভট্টরাই। তাকে নিয়ে প্রাসাদ-রমণীদের মধ্যে আলোচনা হয়—এ সে বুঝতে পারে। সবচেয়ে আগ্রাসী বলে মনে হয় জানুকাকে। এই রমণীটি যেন একটু বেশি সাহসী।

সম্রাটের অসুস্থতার সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিদিনই শয়ে শয়ে মানুষ আসে সম্রাটের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। ফলে মহামিশ্রের পরামর্শে একজন করণীককে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে বসানো হয়েছে। ——প্রজাদের সম্রাটের শারীরিক অবস্থা জানাবার জন্য।

সে দিন বেলার দিকে ভট্টরাইয়ের হাতে তেমন কোনো কাজ ছিল না। তাই কার্যালয় ছেড়ে প্রাঙ্গণে চলে এসে একটি কোণায় চারজন গুপ্তচরের সঙ্গে নানান কথাবার্তা বলছিল। শয়ে শয়ে জনতা করণীকটিকে একই প্রশ্ন করে বিরক্ত করছিল। শেষ পর্যন্ত করণীকটি বুদ্ধি করে একটি লেখা তোরণদ্বারে ঝুলিয়ে দিল, সম্রাট ভালো আছেন।

ভট্টরাইয়ের চঞ্চল চোখ চারদিকে কথাবার্তার মাঝেও ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ দুজন ভিনদেশী শ্রমণ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। শ্রমণবেশী হলেও তাদের দৈহিক ভাবভঙ্গির ভেতর কোথায় যেন অসংগতি ছিল। তাদের দেহে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শ্রমণরা কেউ আসে না। অপরাহ্নে অশ্বঘোষ, বসুমিত্র আর সংঘরক্ষিত এসে সম্রাটকে একবার দেখে যান। সামান্য দু-একটি কথাও বলেন। পরে—চৈত্যে সমবেত বুদ্ধজনের কাছে তাঁরাই সম্রাটের শারীরিক অবস্থার কথা প্রচার করেন। ভট্টরাই চারজন গুপ্তচরকে শ্রমণ দুটির দিকে লক্ষ করতে বলে বলল, এদের সন্দেহজনক হাবভাব। তোমরা দুজনে দুটি দল করে এগিয়ে গিয়ে কোথাও অপেক্ষা করো। পরে এই দু’জনকে অনুসরণ করে রাত্রে আমাকে এদের গতিবিধির সম্পর্কে জানাবে। এদের এখানে আসার পিছনে কোনো একটি উদ্দেশ্য রয়েছে বলে আমার অনুমান। সামনেই সমাজ-উৎসব। আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। জাঙ্ক যে কী খেলা খেলতে চলেছে—তা কে জানে! সে তো সম্রাটকে কথা দিয়েছে—সমাজ-উৎসবের দিন সে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। নিজের প্রহরীদের কাছেও সে নানান অসংলগ্ন কথা বলেছে। ঐ দিন নগরের প্রহরীদের প্রহরা ছেড়ে তার মহোৎসবে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছে। সেখানে নাকি মাংসের জন্য একটি ষণ্ডকে বলিদান করা হবে!

একজন গূঢ়পুরুষ বলল, জাঙ্ক উন্মাদ হয়ে গেছে।

ভট্টরাই বলল, বেশ। তোমরা এসো।

.

সেদিন রাতে সম্রাটের সেবা করতে যাবার আগে কমলিকা সাজল। অনেকদিন পরে তার এই দেহসজ্জা। কণ্ঠে দোলাল সেই হীরক খচিত হার। অঙ্গে নানান গহনা। দর্পণে তার সেই রূপ প্রতিফলিত হতে সারা ঘর যেন আনন্দে হেসে উঠল। তার হাতে একগুচ্ছ সুগন্ধী রক্তগোলাপের গুচ্ছ। রক্ষিণী আর পরিচারিকাদের অবাক করে সে সম্রাটের কক্ষে প্রবেশ করল। সম্রাটও অবাক বিস্ময়ে তাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করার পর সামনে এসে বসতে বললেন। তাঁর অসুস্থ হৃদয়েও যেন প্লাবন জাগল।

সলজ্জ পায়ে কমলিকা এগিয়ে গিয়ে সম্রাটের হাতে গোলাপের গুচ্ছটি দিয়ে বলল, আপনার জীবনও এমন সুগন্ধীত হয়ে উঠুক।

সম্রাট সাগ্রহে গোলাপের গুচ্ছটি হাতে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেন।—চমৎকার! তবে আজ হঠাৎ তোমার এই সজ্জা—গোলাপ গুচ্ছ উপহার?

সপ্রতিভ ভাবে কমলিকা বলল, রক্তগোলাপ হৃদয়ের প্রতীক। আজ তাই আপনাকে উপহার দিলাম।

সম্রাট যেন একটু উদাস হয়ে গেলেন। তারপর এক সময় বিষণ্ণ স্বরে বললেন, তুমি কি জানো, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর কেন আমি সংসার বিমুখ?

সম্রাট নিশ্চয় সম্রাজ্ঞীকে গভীর ভাবে ভালোবাসতেন।

সম্রাট কমলিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।—এই কথাটাই তো সকলে বিশ্বাস করে। কিন্তু না। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আসল সত্যটা কেবল জানে মহামিশ্র। তারই অনুরোধে প্রাসাদ-রমণীদের আগমন। আমাকে যৌবনের ধর্ম পালন করানোর আপ্রাণ প্রয়াস!

হতবাক কণ্ঠে কমলিকা বলল, তাহলে সবই কি নাটক? আসল সত্যটা কী, সম্রাট?

সম্রাট বললেন, আমি নারীজাতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। তাই বুদ্ধের পায়ে নিজেকে এই সমর্পণ।

বিবর্ণ কমলিকা বলল, সেই ঘৃণা কি এখনও আপনি বহন করে চলেছেন?

না। ঠিক তা নয়। প্রাসাদ-রমণীরা সেই ঘৃণার অনেকাংশ দূর করে দিচ্ছিল। আমি সহজ হয়ে উঠছিলাম একটু একটু করে। তারপর তোমাকে একদিন দেখলাম। আমি শিহরিত হলাম। আমার মনের বাঁধন খুলে গেল। আজ তোমার গোলাপ-গুচ্ছের উপহার বাঁধনের শেষ অবশিষ্টটুকুও উড়িয়ে দিল! আমি তোমাকে চাই। নতুন করে জীবনকে ভোগ করতে চাই। গৃহী শিষ্য হতে বুদ্ধ কোনো বাধা দেননি। তুমি আমার হবে, কমলিকা?

সলজ্জভাবে কমলিকা বলল, আমায় লজ্জা দেবেন না, সম্রাট। ঐ গোলাপ-গুচ্ছই তো আমার হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করছে। কিন্তু আমি সত্য জানতে চাই। কেন আপনি নারী বিমুখ হয়েছিলেন? সম্রাজ্ঞীকে কি আপনি তাহলে ভালোবাসতেন না? সবাইকে ছলনা করে এসেছিলেন? তারা এতদিন মিথ্যার স্বর্গেই বাস করছিল?

সম্রাট বললেন, কমলিকা! আমি সব বলব। তারপর তুমিই বিচার করবে আমি তাকে ভালোবাসতাম কি না। তার আগে তোমার এই গোলাপ-গুচ্ছের বিনিময়ে আমিও তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। আমি তোমাকে নিম্নসিন্ধুর বন্দরগুলির আয়ের এক চতুর্থাংশ দিতে পারি—দিতে পারি তক্ষশিলার বার্ষিক রাজস্ব—বা আমার সাম্রাজ্যের কোনো ভূখণ্ড। বলো, তুমি কোনটা নিয়ে আমাকে ধন্য করবে? সম্রাজ্ঞীর ব্যক্তিগত ব্যয়ের জন্য কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়।

কমলিকা বলল, সম্রাট! ক্ষমা করবেন। অর্থে আমার লোভ নেই। ক্ষমতাও আমি চাই না। প্রথম দর্শনেই আমি আমার দেহমন-প্রাণ আপনাকে সঁপে দিয়েছি। আপনি আমার কল্পনার বীরপুরুষ। আমি শুধু আপনাকেই চাই। আর কিছু চাই না। আপনি সম্রাট না হলেও আপনাকে আমি কামনা করতাম!

সম্রাট কণিষ্ক কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে দেখলেন কমলিকাকে। তারপর ধীর স্বরে বললেন, তোমায় যতই দেখছি—ততই মুগ্ধ হচ্ছি। আমি তোমায় পেতে চাই কমলিকা। বলো, তুমি প্রস্তুত কি না?

কমলিকা বলল, তা কী করে সম্ভব, সম্রাট? আমি আপনার উপপত্নী হতে প্রস্তুত নই। আমি আপনাকে চাই—সম্পূর্ণভাবে, নিজের করে।

সম্রাট কণিষ্ক বললেন, তুমি কি উন্মাদ হয়ে গেছ, কমলিকা?

কেন? আমি গর্হিত কিছু কি দাবি করলাম?

না। তোমাকে আমি উপপত্নী করব এ চিন্তা তোমার মাথায় কেমন করে এল? তুমি আমার বৈধ স্ত্রী—তথা এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবে। তোমাকে পাশে পেলে আমি ধন্য হব। তোমার মতো নির্লোভ এক প্রেমিকার সঙ্গে আমার যদি আগে সাক্ষাৎ হতো—তবে আমি স্ত্রী জাতির প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে বসতাম না! তোমাদের প্রাসাদ-রমণীদের মধ্যে আমি অনেককেই প্রশ্ন করেছিলাম—তারা কী চায়? উত্তরে সকলেই আমার রাজ্যদান, বন্দর শুল্ক দান, ইত্যাদি প্রস্তাব সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম, একমাত্র তুমি। তুমি শুধু আমাকে চেয়েছ। সম্রাট কণিষ্ককে পর্যন্ত নয়। সত্যি! তোমার সঙ্গে আমার আগে কেন দেখা হলো না!

বুদ্ধের ইচ্ছা, সম্রাট! কিন্তু, এবার আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রাখুন। বলুন, কেন আপনি সম্রাজ্ঞীকে ভালোবাসতেন না? কেন আপনি স্ত্রী-জাতির প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন?

সম্রাট শয্যায় উঠে বসেছিলেন, গম্ভীরভাবে বললেন, অতি সংক্ষিপ্তভাবে আমি বলছি, স্ত্রীকে আমি ভালোই বাসতাম। কিন্তু, আমার সম্রাট হওয়ার পর থেকে ক্রমে তার মধ্যে এক পরিবর্তন এল। সে অর্থলোভী, ক্ষমতা লোভী–এমন কি সাম্রাজ্যলোভী হয়ে উঠল। সে চাইল আমাকে হত্যা করে সাম্রাজ্য অধিকার করতে। মহামিশ্রের মতো সেবক আমি আর পাব না। তার সতর্ক দৃষ্টিতে সেই ষড়যন্ত্রের জাল উন্মোচিত হল। সম্রাজ্ঞী অপরাধ স্বীকার করলেন। না। আমি প্রতিশোধ নিইনি। জনসাধারণের সামনে দাঁড় করিয়ে সম্রাজ্ঞীর অবমাননা আমি করতে চাইনি। কিন্তু তার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে গেল। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেল সে। আমার কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনি। অথচ, মহামিশ্র ছাড়া একথা আর কেউ জানে না। এমনকি আচার্য চরকও। তাঁর হাতেই সম্রাজ্ঞী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

কিন্তু অন্য ষড়যন্ত্রীরা?

তাদের আমি বিচার করিনি—পাছে সমস্ত বিষয়টি জনসমক্ষে এসে যায়।

তবে তাদের কি ক্ষমা করেছিলেন?

না। গুপ্তঘাতকেরা একে একে তাদের হত্যা করেছিল। তাই সাম্রাজ্যের সবাই জানে, সম্রাট কণিষ্ক পত্নীপ্রাণ। পত্নীর মৃত্যুর শোক ভুলতে তিনি বুদ্ধের চরণে আশ্রয় নিয়েছেন। সংসার বিরাগী হয়েছেন।

কমলিকা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, সম্রাট! আমি বুঝতে পারছি, মানসিকভাবে আপনি কী ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন! আমি বুঝতে পারছি, জগৎ শুদ্ধু সকলে জানে, আপনি পত্নীপ্রেমী ছিলেন। সেই রুদ্ধ যন্ত্রণাই আজ আপনার হৃৎপিণ্ডের ব্যাধি ডেকে এনেছে। সম্রাট! এবার আপনি ঘুমের ঔষধটি খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করুন। আমি তো আছি আপনার পাশে। আমি আপনার সব দুঃখ মুছে দেব।

সম্রাট ক্লিষ্টভাবে হাসলেন। দাও। ঔষধ দাও!

.

এই সংবাদ রাজপ্রাসাদ পার করে সারা সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল—সম্রাট আবার সংসার জীবনে প্রবেশ করছেন। অশ্বঘোষ, বসুমিত্র, সংঘরক্ষিত বলেছেন, এ খুব আনন্দের কথা। সম্রাট বলেছেন জনসাধারণের পিতা রয়েছে। মাতারও প্রয়োজন।

সম্রাটের আসন্ন বিবাহের কথায় সারা দেশে—নগরে এখন আনন্দোচ্ছ্বাস। কিন্তু প্রাসাদ-রমণীকুলে তিক্ততার সৃষ্টি হল। ক্ষিপ্ত জানুকা কমলিকাকে বলল, তুই একটা ডাইনী! সম্রাটকে বশ করেছিস যাদুমন্ত্রে। আর এই প্রাসাদে থাকা অর্থহীন। আজই আমি বাড়ি ফিরে যাব। তবে সমাজ-উৎসবের সকালে নিশ্চয় ফিরে আসব। তোদের বাগদানের পর্বটা দেখব না! তোর সম্রাটের উপপত্নী হবারও যোগ্যতা নেই। আর তুই হবি কী না সম্রাজ্ঞী! আমি বেঁচে থাকতে?

বল্লভী ব্যঙ্গ করে বলল, আমায় ভুলিস না কমলিকা। উপপত্নীর স্বীকৃতিটা অন্তত দিস। কতদিন একসঙ্গে রইলাম! তোর শরীর খারাপের সময় আমি না হয় তোর জায়গাটা নেব, সম্রাট অনেকদিন উপোসী হয়ে আছেন! সুতরাং উপবাস আর তার সহ্য হবে না!

অশ্লীল কথাবার্তা শুনে কমলিকার মুখচোখ রক্তাভ হয়ে উঠছিল। তবু সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। বলল, আগে বিয়েটা তো হোক। সম্রাটের মতিগতি! তারপর না হয় তোর কথা ভাবা যাবে। সত্যিই তো! এতদিন একসঙ্গে রইলাম। মায়া পড়ে গেছে!

জানুকা উঠে দাঁড়াল।—আমি মহামিশ্রের কাছে চললাম। আজই আমি বাড়ি যাব। বাবাকে সব বলব।

বল্লভী বলল, আমিও যাব। দাঁড়া। আমিও বাবাকে বলব। কোথাকার কে এসে জুড়ে বসল…!

জানুকা আর বল্লভী দড়বড় করে বেরিয়ে গেল। সত্যা চুপ করে বসেছিল। কমলিকা তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যে কিছু বলছিস না আমাকে!

সত্যা বলল, ওরা পাগল হয়েছে বলে আমিও পাগল হব? তুই আমার কত উপকার করলি, তা কি জানিস?

উপকার করলাম! কীসের উপকার?

কেন? আমার মুক্তির। জানিস তো আমার এক পাগল প্রেমিক রয়েছে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে নে। তাহলে আমিও মুক্ত হয়ে যাব।

কমলিকা বলল, সম্রাট এখন অসুস্থ। আচার্য চরকও ছাড়পত্র দেননি। তবে বাগদান পর্বটা সমাজ-উৎসবের মধ্যে মিটে গেলেই ভালো। রাজা-রাজড়ার বিয়ে! সময় লাগবেই।

সত্যা কমলিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কমলি! তোর তো একজন পুরুষ জুটে গেল। তাড়াতাড়ি কর। নইলে, গিয়ে দেখব আমার পুরুষটা বিরহ যন্ত্রণায় শুরু হয়ে গেছে!

কমলিকা হেসে ফেলল—পারিসও বটে তুই!

ভট্টরাই নিজের কার্যালয়ে চুপচাপ বসেছিল। বাগদানের কথাটা তার কানেও এসেছিল। মনকে সে এতক্ষণ বোঝাচ্ছিল, এটাই ঠিক হয়েছে। সম্রাজ্ঞীর পদই কমলিকার উপযুক্ত পদ। হঠাৎ জানুকা আর বল্লভীর আগমনে ভট্টরাইয়ের চিন্তা ব্যাহত হল। সে সতর্ক হয়ে উঠল।——আজ্ঞে! বলুন কী করতে হবে?

ভট্টরাইয়ের সন্ত্রস্ত ভাব দেখে জানুকা আর বল্লভী হেসে উঠল।—কী হলো? অমন করছেন কেন? ভয়? তা আমাদের নয়। এ প্রাসাদে এক ডাইনী রয়েছে। ভয় তো তাকেই পাবার কথা। শুনেছেন তো, সম্রাটকে সে বশ করেছে!

আজ্ঞে শুনেছি। তবে, আমি সামান্য লোক। আমার ওসবে কান দিয়ে কী লাভ?

জানুকা বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমি ওকে দেখে নেব সমাজ-উৎসবের রাতে। সম্রাজ্ঞী সে হতে পারবে না।

ভট্টরাই এবার ইচ্ছে করেই বলল, তবে আপনি যদি সম্রাজ্ঞী হন তাহলে…।

গলার স্বর নামিয়ে ফিসফিস করে জানুকা বলল, আপনাকে নিয়েই হব। আপনাকে এসব ছোটখাট পদে মানায় না। জানুকা সমাজ-উৎসবের রাতে আপনার ভাগ্য খুলে দেবে! আপনার মতো রূপবান পুরুষ এই প্রাসাদে নেই। পালাবেন না তো? খিলখিল করে হেসে উঠল জানুকা।

ভট্টরাই বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি আপনাদের ঠাট্টার যোগ্য নই। সামান্য এক সেনা।

জানুকা বল্লভীকে ইশারা করে বলল, লজ্জা পাচ্ছে! তারপর হঠাৎ আবার গলার স্বর নামিয়ে বলল, সত্যিই বলছি। আপনাকে দেখার পর থেকে আমি সম্রাটকে ভুলে গেছি। তবে ঐ ডাইনীকে ছাড়ব না! সমাজ-উৎসব পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

ভট্টরাই অনুভব করছিল যে জানুকার মনে কমলিকার বিরুদ্ধে তীব্র এক প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করছে। সে ভাবল, এটা স্বাভাবিক। মন্ত্রী ইউনাসের কন্যা নিশ্চয় আশা করেছিল যে সেই সম্রাজ্ঞী হবে। স্বর্গচ্যুত হওয়ার মধ্যে বেদনা নিশ্চয় আছে। সেই জ্বালায় সে। আর মেয়েরা যে তাকে পছন্দ করে একথা সে প্রাসাদে এসেই বুঝে গেছে। তাই জানুকার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে প্রশ্ন করল, আজ্ঞে বললেন না তো আপনাদের কী চাই? আমি এখনই…।

না। কিছু চাই না। আমরা পিতৃগৃহে যেতে চাই ক’দিনের জন্য। সমাজ-উৎসবের দিনই ফিরব। আমাদের যাওয়ার আয়োজন করে দিন।

নিশ্চয়। আপনারা আপনাদের কক্ষে অপেক্ষা করুন। আমি মহামিশ্রকে জানিয়ে আপনাদের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

জানুকা আর বল্লভী ওপরে চলে গেলে ভট্টরাই মহামিশ্রের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানাল। মহামিশ্র বললেন, বেশ তো, তাদের রাজকীয় শকটে করে পাঠিয়ে দাও। সঙ্গে চারজন সেনা এবং দু-জনের দুজন পরিচারিকা যাবে। এটি রাজকীয় সম্মান রক্ষার বিষয়।

ভট্টরাই বলল, এসব আমি জানি। তাই আমি চাই পরিচারিকা দু’জন গূঢ়পুরুষ বিভাগের কেউ হোক। তারা ছায়ার মতো প্রাসাদ-রমণীদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে। প্রতিটি কথা শোনার চেষ্টা করবে।

কেন? মহামিশ্র প্রশ্ন করলেন।

কারণ, তারা ইউনাস আর দুবলের কন্যা, এরা জাঙ্কের আত্মীয়া। এদের সঙ্গে জাঙ্কের যোগাযোগ রয়েছে। অনেকের মুখে সমাজ-উৎসবের কথা শুনে আমার মনে এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয় ঐ দিনে একটা কিছু ঘটতে চলেছে। নিম্নসিন্ধু অঞ্চলে পহ্লব বিদ্রোহীরা ঐ দিনই পুরুষপুর অভিযান করবে। হিউ-পিনান ঐ দিনই চৈনিকদের বিরুদ্ধে সেনা পরিচালিত করবেন বলেও কথা।

মহামিশ্রকে চিন্তিত দেখাল।—সমাজ-উৎসবের তো আর বেশি দেরি নেই। সম্রাট এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ নন। মন্ত্রী পরিষদের সভা শেষ হয়ে গেছে। সেখানকার সিদ্ধান্ত তো শুনেছো। বিদ্রোহীরা পুরুষপুর আক্রমণ করার আগেই বিদ্রোহীদের আক্রমণ করতে হবে। ফলে প্রায় চল্লিশ হাজার সেনা আজকালের মধ্যেই যাত্রা করবে নিম্নসিন্ধু অঞ্চলে।

ভট্টরাই প্রশ্ন করল, কিন্তু পুরুষপুরের প্রতিরক্ষার জন্য কত সেনা থেকে যাবে?

অতি কম। পাঁচ থেকে সাত হাজার মাত্র!

সম্রাট সম্মতি দিয়েছেন?

উপায় কী? তিনি নিজে অসুস্থ। মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত! তিনি সম্মতি না দিয়ে কী করবেন? সবটাই তিনি ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। অবশ্য আমরা গুণবর্ধন আর নীলাকারের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি। তাঁদের ঐকান্তিকতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে। তারা পুরুষপুরের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা একটা কিছু নিশ্চয় করবেন। তুমি এদিকটায় লক্ষ রাখো। গুণবর্ধন আর নীলাকারকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি। রাজপ্রাসাদের সভাগৃহেই আমরা কিছু পরামর্শে বসব। ওরা এখনই এসে যাবে।

মহামিশ্র চলে গেলেন। ভট্টরাই এর মনে দুটি শব্দ শুধু বাজতে থাকল, সমাজ-উৎসব! সমাজ-উৎসবের দিন কী হতে চলেছে? হঠাৎ ভট্টরাইয়ের মনে পড়ে গেল গতকাল রাত্রে শ্রমণ-অনুসরণকারী গূঢ়পুরুষদের কথা। ঐ দুজন নাকি সমস্ত দিন পুরুষপুর পায়ে হেঁটে পরিভ্রমণ করে। উত্তরের নগর প্রাচীর বিশেষ ভাবে লক্ষ করে। বারবার দেখে উত্তরের পাহাড়কে। এরপর সন্ধ্যাবেলায় প্রবেশ করে জাঙ্কের কার্যালয়ে। অনেক রাতে তারা কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসে। দেখা যায় সেখানে তারা দুজন নয়—দশজন। অর্থাৎ আরও আটজন বল্ব দেশীয় শ্রমণ আগে থাকতেই সেখানে উপস্থিত ছিল। এখন প্রশ্ন হল, অত রাত পর্যন্ত তাদের সেখানে কী কাজ ছিল? কার্যালয় থেকে বেরিয়ে তারা সঙ্ঘারামে ফিরে যায়। সঙ্ঘারামের অধ্যক্ষের সঙ্গে তাদের তর্কাতর্কি শুরু হয় এত রাতে ফেরার জন্য। অতঃপর অধ্যক্ষ তাদের ঢুকতে দিতে বাধ্য হন। অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তাদের হয়নি। কারণ প্রবেশদ্বার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাছাড়া, সঙ্ঘারাম রাজশক্তির অধিকারের বাইরে। সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব নয়। দিনের বেলায় নীলাকার যদি কোনো অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করতে পারেন তো ভালো হয়। ভট্টরাইয়ের মনে হল, প্রতিবেদনটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এখনই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনা প্রয়োজন। অসুবিধার কোনো কারণ নেই। সেনাপতি, গুপ্তচর প্রধান এবং মহামিশ্র ইতিমধ্যেই সভাগৃহে মন্ত্রণার আয়োজন করতে চলেছেন।

ভট্টরাই উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে জানুকা আর বল্লভী এসে আবার উপস্থিত হল।

বিনয়ের সঙ্গে ভট্টরাই বলল, আপনাদের শকট, রক্ষক এবং পরিচারিকারা বাইরে অপেক্ষা করছে। আপনারা আসতে পারেন।

ধন্যবাদ। বলে জানুকা আর বল্লভী এগিয়ে গিয়েও থামল। জানুকা আবার পিছিয়ে ভট্টরাইয়ের কাছে এসে বিলোল কটাক্ষে হাসল। তারপর আবার ফিসফিস করে বলল, একটি সত্য কথা বলে যাই। আমাদের দুজনকে গৃহে ডেকে পাঠানো হয়েছে কোন এক বিশেষ প্রয়োজনে। নচেৎ তোমাকে ছেড়ে আমি যেতাম না।

‘তোমাকে’! প্রমাদ গুনল ভট্টরাই। তারপর বলল, ভয় কী, দেবী? আমি তো আছি। কর্মত্যাগ করে আর কোথায় যাব? আহার জুটবে কেমন করে?

তোমাকে আর আহার জোটাতে হবে না। তোমার আহার এবার আমিই জুটিয়ে যাব। আমার ছত্রছায়ায় আমার প্রেমিক হয়ে তুমি থাকবে।

ভট্টরাই বলল, অত সৌভাগ্য কি আমার হবে? আপনার মতো ধনী, ক্ষমতাবান—রূপসী যে আমাকে গ্রহণ করবে এ আমি ভাবতেও পারছি না, দেবী! আমি সামান্য এক সেনা মাত্র!

তুমি জানো না ভট্টরাই! তোমার ভেতর কী সম্পদ রয়েছে। প্রথম দর্শনেই তা আমি আবিষ্কার করেছি!

ভট্টরাই বলল, আমার ভাগ্য ভালো। অন্য কারোর চোখে আগে পড়িনি। নইলে সবাই মিলে আমায় টানাটানি করলে…!

ঠাট্টা নয় ভট্ট! ঐ বল্লভীরই কি কম লোভ? নেহাত আমি তোমার দাবিদার বলে ও চুপ করে রয়েছে। আর ভাগ্যিস –ডাইনিটার চোখে তুমি পড়নি!

ভট্টরাই বলল, একটা কথা বলব?

কী? বল। স্বচ্ছন্দে বল।

আপনি যখন সম্রাটের মোহ ত্যাগ করেছেন- তখন আর এখানে সমাজ- উৎসবে দিন ফিরে আসার কী প্রয়োজন? আমাকে আপনার গৃহে ডেকে নিলেই তো আমি এখানকার কর্ম পরিত্যাগ করে চলে যেতাম।

চিন্তিত হয়ে জানুকা বলল, সেটাই ভালো হোত। কিন্তু উপায় নেই। কোনো একটা মজা দেখার জন্য আমায় অন্তত ঐ দিনটার জন্য ফিরতে হবেই। হ্যাঁ। তুমি ঐদিন রাতে প্রস্তুত থেকো। সুবিধা মতো সময়ে আমি তোমাকে ওপরে ডেকে নেব। বাধাবদ্ধহীন ভাবে রাতটা আমরা এক কক্ষে ব্যয় করে সমাজ- উৎসব পালন করব। এরপর জানুকা একটু থেমে বল্লভীর দিকে তাকিয়ে এক টুকরো রহস্যময় হাসি ছুঁড়ে দিয়ে আবার ফিসফিস করে বলল, বল্লভী বা অন্য আরও কয়েকজন প্রাসাদ-রমণীও ঐ আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে। মেয়েদের জন্য মেয়েরই যথেষ্ট নয় বলে আজ মনে হচ্ছে, একজন তোমার মতো পুরুষ চাই! সুন্দর! শক্ত! সমর্থ!

বল্লভী একটু দূর থেকেই বলল, আয় জানুকা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

আসি। আবার এক রহস্যপূর্ণ হাসি উপহার দিয়ে এগোল জানুকা।

ভট্টরাইয়ের গা শিরশির করে উঠল। মনে মনে সে ভেবে অবাক হল, এই উত্তাপ নিয়ে জানুকা বা বল্লভীরা পুরুষসঙ্গ বিবর্জিত হয়ে কেমন করে ছিল এতদিন? পরক্ষণেই সে ভাবল, কেমন করে ছিল—তার ইংগিত তো দিয়ে গেল জানুকা! সব ঠিক আছে। কিন্তু জানুকা ঐ রাতে বাধাবন্ধহীন হবার কথা চিন্তা করছে কী ভাবে? তাদের আগলই খুলে যাবে কী করে? কী মজা দেখবার জন্য সে ঐ দিনই ফিরে আসবে? আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে ভট্টরাই মন্ত্রণা সভাগৃহের দিকে এগোল। তাকে প্রতিটি আশংকার কথা ব্যক্ত করতে হবে মহামিশ্রের কাছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন