কী ভালো মেঘ – উত্থানপদ বিজলী

সন্ধের একটু পরেই সিঁড়ি ভেঙে টুকুন ছাদে উঠে এল। চাঁদের আলোয় ছাদ ভেসে যাচ্ছে। কি মজা, কি মজা! কী ধবধবে দেখাচ্ছে ওপরটা।

টুকুন মুখ তুলল আকাশে। মাঝ আকাশে অষ্টমীর আধখানা চাঁদ। চাঁদ হাসছে। সেই চাঁদের চারপাশে মেঘের রাশি। টুকরো টুকরো অনেক মেঘ। ছেঁড়া সাদা তুলোর মতো তারা গায়ে গয়ে পাশাপাশি। তাদের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেশ কিছু তারার আলো টিমটিম করছে। এমনটি তো সে এতোগুলো টুকরো টুকরো মেঘ কখনও দ্যাখে নি!

আকাশের বুকে মেঘের এ-ছবি দেখে অপার আনন্দে টুকুন স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেক্ষণ চেয়ে রইল টুকুন সেদিকে। অনেক ভাল লাগা কিলবিল করে বয়ে গেল তার মনে।

আকাশ ডাক দিয়ে বলল, টুকুন কি দেখছ? টুকুন উত্তর দেয়, ওই সাদা তুলোর মতো ভালো ভালো মেঘগুলো।

—এই মেঘগুলো কারা, জানো? জানো না। জানবেই বা কী করে? তবে শোন। সে অনেক কথা। সে অনেক গল্প।…

আকাশ গল্প বলতে আরম্ভ করল।

.

সে অনেক দিনের কথা। তখন মানুষজন ঘর বাঁধা শেখেনি। পশুপালন করত। মাঠে মাঠে সবুজ ঘাস। তারা এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে তাদের পোষা ভেড়াগুলোকে চরিয়ে নিয়ে বেড়াত। ভেড়াগুলো মহা আনন্দে সারাদিন ধরে সবুজ ঘাস খেয়ে পেট ভরাতো।

আর মেষ-পালক! ক্ষিদে পেলে খেত বনের ফল। তেষ্টা পেলে পান করত ঝরনার জল। তাছাড়া ভেড়ার মিষ্টি দুধ তো আছেই।

একদিন এক মেষ পালক দেখল, তার ভেড়ার পালের ভেতর বাঘ ঢুকেছে। ভেড়াগুলো প্রাণ বাঁচাতে এদিক ওদিক ছুটছে।

মেষ-পালক তার হাতের বাড়িটি নিয়ে এগিয়ে গেল।

—কি চাও তুমি? কি চাও?

বাঘ বলল, হুস্। কি আর চাইব। একটা ভেড়া মেরে করব গুম।

—কেন?

—কেন কি? আমার ক্ষিদে পেলে আমি তো খাবই। এই মাঠে যারা যখন ভেড়ার পাল নিয়ে আসে, তাদের ভেড়া আমি এমনি করে শিকার করি।

মেষ-পালক ব্যাপারটা ভাল ভাবে ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, তার মানে তুমি একটা ভেড়া খেতে চাও তো?

বাঘ হেসে এক পা এগিয়ে এলো। বলল, একটা নয়। প্রতিদিন একটা করে।

—অবাক কথা বললে দেখছি। আমি তো এই মাঠে অনেক দিন ভেড়া চরাবো। এখানে ঘাস প্রচুর। তাছাড়া নদীও কাছাকাছি। আমাদের ভেড়াগুলো দিব্যি খাবেদাবে আর তেষ্টাও মেটাবে। তার মানে তুমি বলতে চাইছ, প্রতিদিন তুমি একটা করে খাবে?

বাঘ ভোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, হ্যাঁ। হ্যাঁ। প্রতিদিনই একটা ক’রে।

মেষ-পালক মহা ফাঁপরে পড়ল। বাঘ বেটা বলে কি! প্রতিদিন একটা একটা করে ভেড়া খেয়ে কমিয়ে দেবে? তাহলে!

চেয়ে দেখল, ভেড়াগুলো ভয় পেয়ে দল বেঁধে এক জায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। বাঘের ভয়ে সবার বুক দুরুদুরু। কেউ ঘাস কাটছে না মুখে।

মেষ-পালক এ বিপদে দিশেহারা। একেবারেই থ।

বাঘে এবার দু’কদম এগিয়ে এলো।

—হুম্। শোন। আমি আমার শিকার করার কথা বলেছি। আমার শিকার করে খেতে গেলে প্রতিদিন একটা করে চাই। তবে যদি আমাকে শিকার করে খেতে না হয়, অর্থাৎ যদি তুমি নিজে আমার খাওয়ার জন্য ভেড়া তুলে দ্যাও, তাহলে অন্য কথা। তা হলে অন্য ব্যবস্থা।

মেষ-পালক আশান্বিত হয়ে জানতে চাইল, কী তোমার আবার অন্য ব্যবস্থা!

বাঘ বলল, তাহলে প্রতিদিন একটা করে লাগবে না আর। শুধু আজ দিনটা একটা ভেড়া দিলে চলবে।

—আর অন্য দিন কি করবে?

—তোমার ভেড়া খাব না। ওই যে দেখছ পাহাড়ের ওদিকটা ঘন বন। ওই বনে চলে যাব শিকার করতে। আর এই মাঠটা তোমাকে দিয়ে দেব। তুমি যতদিন ইচ্ছা ভেড়া চরাতে পার।

মেষ-পালক এবার পড়ল অন্য ফাঁপরে। সব ভেড়াই তো তার কাছে সমান আদরের। সবগুলি ভেড়াকে সে তো সমান ভালবাসে। কাকে সে নিজের হাতে তুলে দেবে বাঘের কাছে? কা’কে যেতে দেবে বাঘের পেটে!

ভেড়াদের পালে বিরাট গুঞ্জন। তারা শুনেছে বাঘের কথা। তারা বুঝেছে তাদের মনিবের কষ্ট। তারা নিজেদের ভেতর আলোচনা করছে তাই। কি করা যায়!

একটা বৃদ্ধ ভেড়া বলল, আমি যাই না বাঘের পেটে? আমার বিনিময়ে এই ঘাসের রাজ্যিটা পেতে পারি। বাঘ একজনকে খেয়ে—দূরের ওই বনে চলে যাবে বলেছে। ছেড়ে দিয়ে যাবে এই মাঠ। তোমরা ইচ্ছা মতো অনেকদিন তাহলে ঘাস খেতে পার এখানে।

একটা যুবক ভেড়া বলল, তাই হয় নাকি? তুমি বাঁচলে দলের অনেক লাভ। অনেক অভিজ্ঞতা তোমার। বিপদে আপদে অনেক পরামর্শ দিতে পারবে দলকে। তার চেয়ে আমি যাই বাঘের পেটে।

একটা ফুটফুটে ভেড়ার ছানা লাফিয়ে এলো ওদের সামনে। সে বলল, সে কি কথা? তোমরা যাবে কেন। আমরা এতো ছানা-বাচ্চা আছি কি করতে? আমি যেতে চাই বাঘের পেটে।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ভেড়ার পালের সকলেই রাজি। সকলেই বলতে চায়, আমি যাব। আমি যাব। আমি যাব। আমি গেলে, তোমরা নিঃশ্চিন্তে এই মাঠটা ভোগ করতে পারবে ইচ্ছা মতো।

শেষপর্যন্ত মেষ-পালকের সামনে ঘটল ঘটনাটা। তারা সকলেই একে একে বাঘের কাছে এসে বলল, বাঘ মশাই, আমাকে খান। আমাকে খেয়ে শর্তমতো এ-মাঠ ছেড়ে দিয়ে যান।

বাঘ তো অবাক। বাঘ হতভম্ভ। বলল, আমি একজন চাই। তো দেখছি তোমরা সকলেই রাজি। তোমরা প্রত্যেকে সকলকে ভালবাস দেখছি।

ভেড়ার পালের সকলেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ।…

.

অকাশ বলল, টুকুন। তারপর কি হলো, জানো?

—না।

—বাঘ তাদের কাউকেই না খেয়ে ফিরে গেল বনে। পাহাড়ের ধারে সেই বনে। আর সেই ভেড়াগুলো….

—হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই ভালো ভেড়াগুলোর কি হলো?

আকাশ বলল, চেয়ে দ্যাখ আমার দিকে। এই যে তুলো তুলো মেঘ দেখছ—এরা হচ্ছে সেই ভেড়াগুলো। ওদের সকলকে আমার এই খোলা মাঠে ডেকে নিয়েছি। এখানে ওরা ইচ্ছামতো চরে চরে ঘাস খায়। এখানে কোন বাঘ নেই। কোনও বিপদ নেই। সারারাত তারাগুলো ভালবেসে বাতি জ্বেলে রাখে। আর চাঁদ মাঝে মাঝে জ্বেলে রাখে মায়াবী লণ্ঠন।

সকল অধ্যায়

১. নিখুঁত মানুষ – লালবিহারী দে
২. রানি কঙ্কাবতী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
৩. বানর রাজপুত্র – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
৪. ছোট চোর ও বড় – যোগীন্দ্রনাথ সরকার
৫. ভুতো আর ঘোঁতো – সুখলতা রাও
৬. চুনির জন্ম – ত্রিভঙ্গ রায়
৭. ভোঁদড় বাহাদুর – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৮. সন্দেশের দেশে – মণীন্দ্রলাল বসু
৯. মনোবীণা – নরেন্দ্র দেব
১০. দুধ পাহাড় দধিসায়র – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১১. অস্তপাহাড়ে মানুষের মেয়ে – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
১২. মায়া আয়না – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
১৩. সেলাইবুড়ি ও আশ্চর্য ছুঁচ – শৈল চক্রবর্তী
১৪. বন্দিনী রাজকন্যার গল্প – রাধারানী দেবী
১৫. রামধনুকের রাজপুত্তুর – স্বপনবুড়ো
১৬. রাজশ্রী – ইন্দিরা দেবী
১৭. কাঠকন্যা – মৌমাছি
১৮. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
১৯. নতুন দিনের আলো – মনোজকান্তি ঘোষ
২০. আশ্চর্য আমগাছ – প্রণবকুমার পাল
২১. কী ভালো মেঘ – উত্থানপদ বিজলী
২২. যাদুশ্রেষ্ঠ বীরমাণিক্য – অমিতাভ রায়
২৩. সোনার চাঁপা ফুল – পুণ্ডরীক চক্রবর্তী
২৪. রাজকুমার বৃষস্কন্ধ আর শ্রীময়ী – নবনীতা দেবসেন
২৫. একটা আইসকীরিম একটা কাঠবেড়ালীর গল্প – কার্তিক ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন