বানর রাজপুত্র – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

বানর রাজপুত্র – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

এক রাজার সাত রানী, কিন্তু ছেলেপিলে একটিও নেই। রাজার তাতে বড়ই দুঃখ; তিনি সভায় গিয়ে মাথা গুঁজে বসে থাকেন, কেউ এলে ভাল করে কথা কন না।

একদিন হয়েছে কি—এক মুনি রাজার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মুনি রাজার মুখ ভার দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাজা তোমার মুখ যে ভার দেখছি; তোমার কিসের দুঃখ?’

রাজা বললেন, ‘সে কথা কি বলব, মুনি-ঠাকুর! আমার রাজ্য, ধন, লোকজন সবই আছে, কিন্তু আমার যে ছেলেপিলে নেই, আমি মরলে এ-সব কে দেখবে?’

মুনি বললেন, ‘এই কথা? আচ্ছা, তোমার কোন চিন্তা নেই! কাল ভোরে উঠেই তুমি সোজাসুজি উত্তর দিকে চলে যাবে। অনেক দূর গিয়ে একটা বনের ধারে দেখবে একটা আম গাছ রয়েছে। সেই আম গাছ থেকে সাতটি আম এনে তোমার সাত রানিকে বেটে খাইয়ে দিলেই তোমার সাতটি ছেলে হবে। কিন্তু খবরদার; আম নিয়ে আসবার সময় পিছনের দিকে তাকিয়ো না যেন।’

এই কথা বলে মুনি চলে গেলেন। তারপর দিন গেল, রাত হল, ক্রমে রাত ভোর হল। তখন রাজামশাই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে সোজাসুজি উত্তর দিকে চলতে লাগলেন। যেতে যেতে অনেক দূর গিয়ে তিনি দেখলেন, সত্যি সত্যি বনের ধারে একটা আম গাছ আছে; তাকে পাকা পাকা সাতটি আমও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সেই বনে তিনি কতবার শিকার করতে এসেছেন, কিন্তু আম গাছ কখনো দেখতে পাননি। যা হোক, তিনি তাড়াতাড়ি সেই গাছে উঠে আম সাতটি পেড়ে নিয়ে বাড়িতে ফিরে চললেন।

খানিক দূরে যেতে না যেতেই শুনলেন, কে যেন পিছন থেকে তাঁকে ডাকছে,

ওগো রাজা, ফিরে চাও,
আরো আম নিয়ে যাও।

মুনি যে সাবধান করে দিয়েছিলেন, সে কথা রাজার মনে ছিল না। তিনি পিছন থেকে ডাক শুনেই ফিরে তাকিয়েছেন, আর অমনি আমগুলো তাঁর হাত থেকে ছুটে গিয়ে আবার গাছে ঝুলতে লেগেছে। কাজেই রাজা মশাই-এর আবার গিয়ে গাছে উঠে আমগুলি পেড়ে আনতে হল। এবার আর তিনি কিছুতেই মুনির কথা ভুললেন না। তিনি চলে আসবার সময় পিছন থেকে কত রকম করে ডাকতে লাগল, ‘চোর’ ‘চোর’ বলে কত গালও দিল। রাজা মশাই তাতে কান না দিয়ে বোঁ-বোঁ করে বাড়ির পানে ছুটলেন।

বাড়ি এসে রানিদের হাতে সাতটি আম দিয়ে রাজা মশাই বললেন, ‘তোমরা সাত জনে এই সাতটি আম বেটে খাও।’ ছোট রানি তখন সেখানে ছিলেন না। বড় রানিরা ছ’জনে মিলে তাঁকে কিছু না বলেই সব কটি আম খেয়ে ফেললেন। ছোট রানি এর কিছুই জানতে পারলেন না, কিন্তু তাঁর ঝি সব দেখল। বড় রানিদের খাওয়া হয়ে গেলে সে আমের ছালগুলি চুপি চুপি কুড়িয়ে নিয়ে গেল। সেই ছালগুলি ধুয়ে বেটে ছোট রানির হাতে দিয়ে বলল, ‘মা, এই ওষুধটা খাও, তোমার ভাল হবে।’ ওষুধ খেতে হয়, তাই ছোট রানি আর কোনও কথা না বলেই সেটা খেয়ে ফেললেন।

তারপর বড় রানিদের সকলেরই এক-একটি সুন্দর খোকা হল, রাজা তাতে খুশি হয়ে খুব ধুমধাম আর গান বাজনা করালেন। ছোট রানিরও একটি খোকা হল, কিন্তু সেটি হল বানর। বানর দেখে রাজা চটে গিয়ে ছোট রানিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। দেশের লোকের তাতে বড়ই দুঃখ হল। তারা একটি কুঁড়ে বেঁধে ছোট রানিকে বলল, ‘মা, তুমি এইখানে থাকো।’

সেইখানে ছোট রানি থাকেন। বানরটি সেখানে থেকে দিন দিন বড় হচ্ছে। সে মানুষের মতো কথা কয়। আর অমনি বুদ্ধি যে, কোনও কথা তাকে শিখিয়ে দিতে হয় না। যখন যে কাজের দরকার, অমনি সে তা করে। সারাদিন সে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়, যেখানে যে ফল দেখে তা খায়; খুব ভাল লাগলে মার জন্যে নিয়ে আসে। তাকে কেউ কিছু বলে না। কারুর গাছের ফল খেতে গেলে সে ভারি খুশি হয়ে ভাল ভাল ফল দেখিয়ে দেয়। তার বুদ্ধি দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে যায়।

এমনি করে দিন যাচ্ছে। বড় রানিদের ছেলেদের জন্য মাস্টার এসেছে, তারা পুঁথি নিয়ে তাঁর কাছে বসে পড়ে। তা দেখে বানর গিয়ে তার মাকে বলল, ‘মা আমাকে পুঁথি এনে দাও, আমি পড়ব।’

মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘হায় বাছা, কি করে পড়বে? তুমি যে বানর।’

বানর বলল, ‘সত্যি মা, আমি পড়ব, তুমি বই এনে দিয়েই দেখো। তুমি আমাকে পড়াবে।’

বানরের এমনি বুদ্ধি, যে বই পায় সে দুদিনে পড়ে শেষ করে ফেলে। সে দু’বছরে মস্ত পণ্ডিত হয়ে উঠল। বড় রানিদের ছেলেরা তখনও দু’তিন খানি বই-পুঁথি শেষ করতে পারে নি; রোজ খালি মাষ্টারের বকুনি খায়।

এ-সব কথা শুনে রাজা একদিন বললেন, ‘বটে? বানরের এমনি বুদ্ধি? নিয়ে এসে তো তাকে, আমি দেখব।’

বানরের কিছুতেই ভয় নেই; রাজা ডেকেছেন শুনে সে অমনি তাঁর কাছে উপস্থিত হল। তাকে দেখে আর কথাবার্তা শুনে রাজার এমনি ভাল লাগল যে, তিনি আর কিছুতেই ছোট রানিকে কুঁড়ে ঘরে ফেলে রাখতে পারলেন না। তাই তিনি ছোট রানিকে রাজবাড়ির পাশেই একটি খুব সুন্দর বাড়ি করে দিলেন। সেই বাড়িতে তখন থেকে ছোট রানি তাঁর বানর নিয়ে থাকেন। টাকাকড়ি যত লাগে রাজার লোক এসে দিয়ে যায়। লোকে তাঁর বাড়িটাকে বলে বানরের বাড়ি। এ-সব দেখে বড় রানিদের ছেলেরা বানরকে আরো বেশি হিংসা করতে লাগল।

একটু একটু করে ছেলেরা বড় হয়ে উঠল। সকলে রাজাকে বলল, ‘রাজপুত্রেরা বড় হয়েছেন, এখন এঁদের বিয়ে দিন।

রাজা বললেন, ‘তাদের দেশ বিদেশ ঘুরতে দাও। তারা নানান জায়গা দেখে, নানান রকম শিখে, টুকটুকে ছয়টি রাজকন্যা বিয়ে করে আনুক।’

সকলে বলল, ‘বেশ বেশ! তাই হোক।’

তারপর ছয় রাজপুত্র সেজেগুজে, টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে নানান দেশ দেখতে বেরুল।

তা দেখে বানর তার মাকে গিয়ে বলল, ‘মা, আমিও যাব।’

তার মা বললেন, ‘তুমি কি করতে যাবে যাদু, তোমাকে কোন্ টুকটুকে রাজকন্যা বিয়ে করবে? তুমি যে দেশ দেখতে যাবে, আমি তোমাকে ছেড়ে কি করে থাকব?’

বানর বলল, ‘আমি দেখতে দেখতে ফিরে আসব। তোমার পায়ে পড়ি মা, আমাকে যেতে দাও।’

কাজেই ছোট রানি আর কি করেন? বানরকে যেতে দিতেই হল।

ছয় রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে; রাজবাড়ি থেকে অনেক দূর চলে এসেছে। একটা বনের ভিতর দিয়ে তাদের পথ, সেই পথে চলতে চলতে তাদের নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছে, এমন সময় বনের ভিতর থেকে বানর বেরিয়ে এসে বলল, ‘দাদা, আমিও এসেছি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো।’

তাতে রাজপুত্ররা যারপরনাই রেগে বলল, ‘বটে রে, তোর এতবড় আস্পর্ধা! আমরা রাজকন্যা বিয়ে করে আনতে যাচ্ছি বলে তুইও তাই করতে যাবি! দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি!’ এই বলে তারা বানরকে মারতে মারতে আধমরা করে একটা গাছে বেঁধে রেখে চলে গেল।

সেই বনে ছিল একদল ডাকাত। তারা দেখল যে, ছয় জন রাজপুত্র ভারি সাজ করে টাকাকড়ি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। দেখেই তো তারা মার-মার করে চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলল। রাজপুত্রেরা ভয়েই জড়সড়, তলোয়ার খুলবার কথা আর তাদের মনেই নেই। তাদের টাকাকড়ি, ঘোড়া, পোশাক—সবশুদ্ধ তাদের হাত-পা বেঁধে নিয়ে যেতে ডাকাতদের দু’ মিনিটও লাগল না।

রাজপুত্রদের ধরে নিয়ে খানিক দূরে এসেই ডাকাতেরা দেখল, পথের ধারে একটা বানর বাঁধা রয়েছে। তাকেও তারা সঙ্গে নিয়ে চলল। বানর যেন তাতে বেশ খুশি হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের সঙ্গে যেতে লাগল। তা দেখে ডাকাতেরা ভাবল, বুঝি কারু পোষা বানর, কাজেই তাকে আর তার তেমন করে বাঁধল না।

সেই বনের ভিতরেই ডাকাতদের ঘর। সেদিন তাদের বড্ড পরিশ্রম হয়েছিল, তাই রাজপুত্রদের নিয়ে সন্ধ্যার সময় ঘরে ফিরে এসে বাঁধনসুদ্ধই ছ’টি ভাইকে একটা জায়গায় ফেলে রেখে তারা খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন খুব করে তাদের নাক ডাকতে লেগেছে, তখন বানর চুপিচুপি তার নিজের বাঁধন দাঁত দিয়ে কেটে তাড়াতাড়ি গিয়ে রাজপুত্রদের বাঁধন খুলে দিয়েছে। তখন আর তারা বানরকে ফেলে যাবে কোন্ লাজে? কাজেই তাকেও সঙ্গে করে, জিনিসপত্র নিয়ে, ঘোড়ায় চড়ে অমনি তারা প্রাণপণে ছুট দিল, ডাকাতেরা কিছু টের পেল না।

ডাকাতদের ওখান থেকে পালিয়ে রাজপুত্রেরা প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে লাগল, ভোরের আগে আর তারা কোথাও থামল না। সকালে তারা দেখল যে, তারা ভারি চমৎকার একটা শহরে এসে উপস্থিত হয়েছে। সে খুব বড় এক রাজার দেশ; তার বাড়ি দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, যেন একটা ঝকঝকে সাদা পাহাড়।

ছয় রাজপুত্র সেই বাড়ির কাছে গিয়েই টকটক করে ঘোড়া হাঁকিয়ে তার ভিতরে ঢুকে পড়ল। দারোয়ানেরা তাদের পোশাক আর ঘোড়ার সাজ দেখে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সেলাম করল, আর কিছু বলল না। বানর কিন্তু জানে যে, সে সেখানে গেলেই তাকে ধরে ফেলবে; তাই সে রাজবাড়ির পিছনের দিকে গিয়ে, খিড়কির পুকুরের ধারে শুয়ে রইল।

সেই দেশের রাজার ছিল সাত রানি। তাদের বড় ছ’জন ছিল ভারি হিংসুক আর দেখতে বিশ্রী, আর ছোটটি ছিলেন পরীর মত সুন্দর আর বড় লক্ষ্মী। বড়রা রাজাকে মিছামিছি নানান কথা বলে ছোট রানিকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল; তিনি খিড়কির পুকুরের ধারে একটি কুঁড়ের ভিতরে থাকতেন, রাজা তাঁর কোনও খবরও নিতেন না। বড় ছয় রানির ছটি মেয়ে ছিল, তারা দেখতে ছিল ঠিক তাদের মায়ের মতন, আর তাদের মনও ছিল তেমনি। আর ছোট রানির যে মেয়েটি ছিল, সেও তার মা’র মত—যেমনি সুন্দর, তেমনি লক্ষ্মী। তা হলে কি হয়, বড় রানিরা রাজাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, ছোট রানির মেয়েটা পাগল, কালো, কুঁজো, কানা, খোঁড়া, কালা আর বোবা।

সেই খিড়কির পুকুরের ধারে, সেই ছোট রানির কুঁড়ে ঘরের কাছে বানর গিয়ে শুয়ে রয়েছে। খানিক বাদে বড় রানিদের ছয় মেয়ে ছ’টি ঘটি নিয়ে সেখানে স্নান করতে এল, ছোট রানির মেয়েটিও তার ছোট্ট ঘটিটি নিয়ে এল। তারা স্নান করে চলে আসবার সময় সেই মেয়েটির ঘটি থেকে কেমন করে খানিকটা জল বানরের গাড়ে পড়ে গেল। অমনি বড় রানিদের ছয় মেয়ে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ওমা! ওমা! তোমরা দেখো এসে—ছোট রানির মেয়ে বাঁদরটাকে বিয়ে করেছে!’

বড় রানিরাও তা শুনে ছুটে এসে বলতে লাগল, “তাই তো, তাই তো। ছোট রানির মেয়ে বানরটাকে বিয়ে করেছে!’

সেই খবর তখনি তারা রাজার কাছে পাঠিয়ে দিল। দেশের সকল লোক রাজার সভায় বসে শুনল যে, ছোট রানির মেয়ের একটা বানরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।

ছোট রানির মনে যে কি কষ্ট হল, তা আর কি বলব? তিনি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে, মেয়েটিকে বুকে নিয়ে মাটিতে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। তা দেখে বানর তাঁদের ঘরের দরজায় থেকে হাত জোড় করে বলল, ‘মা, আপনি কাঁদবেন না। ভগবান যা করেন ভালই করেন; এ থেকেও আপনাদের ভাল হতে পারে।’ বানরকে মানুষের মত কথা কইতে দেখে রানি উঠে বসলেন। তাঁর মনের দুঃখ যেন কোথায় চলে গেল। সেই থেকে বানর তাঁর ঘরের কাছে গাছের ওপরে থাকে আর প্রাণপণে তাঁর সেবা করে। রানি যখন শুনলেন যে, সে রাজপুত্র, তখন সে যে বানর, সে কথা তিনি ভুলে গেলেন; তাঁর মনে হল যে, এমন ভাল আর বুদ্ধিমান লোক আর মানুষের ভিতরে নাই।

এদিকে হয়েছে কি, সেই ছয় রাজপুত্রও রাজার বাড়িতে ঢুকে একেবারে তাঁর সভায় এসে হাজির হয়েছে; রাজা দেখেই বুঝতে পেরেছেন, এরা রাজপুত্র। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাপু, তোমরা কে? কি করতে এসেছ?’ তারপর যখন তাদের বাপের নাম শুনলেন, আর শুনলেন যে তারা বিয়ে করবার জন্য রাজকন্যা খুঁজতে বেরিয়েছে, তখন তো আর তাঁর খুশির সীমাই রইল না। তিনি বললেন, ‘বাঃ! তোমরা যে আমার বন্ধুর ছেলে! বেশ হল; আমার ছয় মেয়েকে তোমরা ছ’জনে বিয়ে করবে।’

ঠিক এমনি সময় বাড়ির ভিতর থেকে খবর এল যে ছোট রানীর মেয়ের একটা বাঁদরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে! রাজপুত্ররাও তখনি বুঝে নিল যে, এ আর কেউ নয়, তাদেরই বাঁদর। তাদের মনে হিংসাটা যে হল! বাঁদর এসে তাদের আগেই রাজার মেয়ে বিয়ে করে ফেলল, লোকে আবার কানাকানি করে বলে যে, সে মেয়ে নাকি রাজার আর ছয় মেয়ের চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর আর ভাল—এ সব কথা তারা যত ভাবে ততই খালি হিংসায় জ্বলে মরে।

যা হোক, রাজার ছয় মেয়ের সঙ্গে তো তাদের ছয় জনের বিয়ে হয়ে গেল, তারপর ঝকঝকে ময়ূরপঙ্খী সাজিয়ে ঢাক ঢোল বাজিয়ে তারা বউ নিয়ে দেশে চলল। বানরও একটি ছোট নৌকায় করে তার স্ত্রীকে নিয়ে তাদের পিছু পিছু চলেছে। তাকে দেখেই ছয় রাজপুত্র রেগে ভূত হয়ে গেছে আর ভেবেছে যে, একে বউ নিয়ে দেশে পৌঁছতে দেওয়া হবে না। মুখে কিন্তু ‘ভাই, ভাই’ বলে ভারি আদর দেখাতে লাগল, যেন তাকে কতই ভালবাসে। শেষে যখন বাড়ির কাছে এসেছে, তখন রাত্রে ঘুমের ভিতরে বেচারার হাত-পা বেঁধে তাকে জলে ফেলে দিল। ভাগ্যিস ছোট বউ টের পেয়ে তাড়িতাড়ি একটা বালিশ ফেলে দিয়েছিল, আর তাই ধরে অনেক কষ্টে সে কোনোমতে ডাঙায় উঠল, নইলে সে যাত্রা আর উপায়ই ছিল না।

তারপর সকাল বেলায় নৌকা এসে ঘাটে লাগল, রাজা খবর পেয়ে ছেলে-বউদের আদর করে ঘরে নিতে এলেন। ছয় ছেলে এসে তাঁকে প্রণাম করল, রাজা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বানর কই?’ তারা বলল, ‘সে জলে ডুবে মারা গিয়েছে।’

বানর তো মরে নি, সে নদীর ধারে ধারে তাদের আগেই ঘাটে এসে গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ওরা ‘সে জলে ডুবে মারা গেছে’ বলতেই বানর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রাজাকে প্রণাম করে বলল, ‘আমি মরি নি বাবা, ওরা আমার হাত-পা বেঁধে আমাকে জলে ফেলে দিয়েছিল, আমি অনেক কষ্টে বেঁচে এসেছি।’

তখন তো রাজপুত্রদের মুখ চুন। রাজা ভয়ানক রেগে তাদের বললেন, ‘বটে! তোদের এই কাজ? দূর হ তোরা আমার দেশ থেকে; আর তোদের মুখ দেখব না।

এই বলে দুষ্ট ছেলেগুলিকে তাড়িয়ে দিয়ে রাজা যারপরনাই আদরের সহিত বানর আর ছোট বউকে ঘরে নিয়ে এলেন। বানরের মা ছেলেকে ফিরে পেয়ে আর সুন্দর লক্ষ্মী বউ ঘরে এনে যে কত সুখী হলেন তা বুঝতেই পারো।

.

তারপর খুব সুখেই তাঁদের দিন কাটতে লাগল। এর মধ্যে হয়েছে কি, বউমা দেখলেন যে, বানর শুধু দিনের বেলায়ই বানর সেজে বেড়ায়; রাত্রে সে বানরের ছাল খুলে ফেলে দেবতার মত সুন্দর মানুষ হয়। এ কথা তিনি ছোট রানীকে বললেন, ছোট রানী আবার রাজাকে জানালেন। রাজা তো শুনে ভারি আশ্চর্য হয়ে এসে বললেন, ‘বউমা তুমি এক কাজ করো। আজ রাত্রে যখন সে বানরের ছাল খুলে ঘুমোবে, তখন তুমি ছালটাকে পুড়িয়ে ফেলবে।’

সেদিন বানরের শোবার ঘরের পাশের ঘরে মস্ত আগুন জ্বেলে রাখা হল, বানর তা জানতে পেল না। তারপর রাত্রে যেই ছাল খুলে রেখে সে ঘুমিয়েছে অমনি রাজকন্যা চুপিচুপি সেটাকে নিয়ে সেই আগুনে ফেলে দিয়েছে। সকালে বানর উঠে দেখে তার ছাল নেই। তখন সে তো ধরা পড়ে গিয়ে খুবই ব্যস্ত হল, কিন্তু ব্যস্ত হয়ে কি হবে, আর বানর হবার জো নেই। দেখতে দেখতে সেই খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়ল, আর ছেলেবুড়ো সকলে ছুটে এসে সব দেখে শুনে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল।

সকল অধ্যায়

১. নিখুঁত মানুষ – লালবিহারী দে
২. রানি কঙ্কাবতী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
৩. বানর রাজপুত্র – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
৪. ছোট চোর ও বড় – যোগীন্দ্রনাথ সরকার
৫. ভুতো আর ঘোঁতো – সুখলতা রাও
৬. চুনির জন্ম – ত্রিভঙ্গ রায়
৭. ভোঁদড় বাহাদুর – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৮. সন্দেশের দেশে – মণীন্দ্রলাল বসু
৯. মনোবীণা – নরেন্দ্র দেব
১০. দুধ পাহাড় দধিসায়র – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১১. অস্তপাহাড়ে মানুষের মেয়ে – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
১২. মায়া আয়না – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
১৩. সেলাইবুড়ি ও আশ্চর্য ছুঁচ – শৈল চক্রবর্তী
১৪. বন্দিনী রাজকন্যার গল্প – রাধারানী দেবী
১৫. রামধনুকের রাজপুত্তুর – স্বপনবুড়ো
১৬. রাজশ্রী – ইন্দিরা দেবী
১৭. কাঠকন্যা – মৌমাছি
১৮. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
১৯. নতুন দিনের আলো – মনোজকান্তি ঘোষ
২০. আশ্চর্য আমগাছ – প্রণবকুমার পাল
২১. কী ভালো মেঘ – উত্থানপদ বিজলী
২২. যাদুশ্রেষ্ঠ বীরমাণিক্য – অমিতাভ রায়
২৩. সোনার চাঁপা ফুল – পুণ্ডরীক চক্রবর্তী
২৪. রাজকুমার বৃষস্কন্ধ আর শ্রীময়ী – নবনীতা দেবসেন
২৫. একটা আইসকীরিম একটা কাঠবেড়ালীর গল্প – কার্তিক ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন