এক গ্রামে দুই পাকা চোর বাস করিত। তাহাদের কাজের মধ্যে ছিল, কেবল চুরি ও বাটপাড়ি! গ্রামে কোথাও কোনদিন চুরি হইলে, সকলেই বুঝিত, এ সেই হতভাগাদের কাজ। এমন কি, অন্য চোরে চুরি করিলেও লোকের সন্দেহ আগে তাহাদের উপরই পড়িত। তাহারা ভিন্ন আর যে কেহ চুরি করিতে পারে, এ বিশ্বাস বড় কাহারও ছিল না।
ইহাতে ত্যক্ত বিরক্ত হইয়া একদিন দুইজনে পরামর্শ করিল যে, আর তাহারা চুরি করিবে না; অন্য কোথাও গিয়া চাকরি-বাকরির চেষ্টা দেখিবে। তাহাদের গ্রাম হইতে তিন ক্রোশ দূরে এক ঘর ধনী লোক বাস করিতেন। তাহারা সেই ধনীর গৃহে গিয়া দুইজনে দুইটি কাজের জোগাড় করিল। একজনকে সমস্তদিন একটা গরু চরাইতে হইবে; আর একজন প্রত্যহ একটা চাপাগাছের গোড়ায় জল দিবে।
বড় চোর ভারি সেয়ানা। সে ভাবিল, ‘মাঠে মাঠে কে গরু তাড়াইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়! ও কাজটা ছোট চোরের পক্ষেই মানাইবে ভাল। আমি গাছের গোড়ায় দুই চারি কলসী জল ঢালিয়া সমস্ত দিন বেশ মজা করিয়া বেড়াইব!’ এই ভাবিয়া সে গাছে জল দিবার ভার লইল। আর ছোট চোরের ভাগ্যে জুটিল গরু চরান।
পরদিন ভোরের বেলা ছোট চোর গরু লইয়া বাহির হইল, আর বড় চোর গাছে জল ঢালিতে শুরু করিল। সে ভাবিয়াছিল, দুই চারি কলসী ঢালিলেই গাছের গোড়ায় জল দাঁড়াইবে; কিন্তু কি সর্বনাশ, যত ঢালে সব জল শুকাইয়া যায়। একরত্তি মাটি ভিজিতে না ভিজিতে তাহার আর চিহ্নমাত্রও দেখিতে পাওয়া যায় না। সমস্ত সকাল, সারা দুপুর, এমন কি সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত কলসী জল ঢালিল, কিন্তু কিছুতেই সেই পোড়া গাছের গোড়ায় একবিন্দুও দাঁড়াইল না। শেষে ক্লান্ত হইয়া বেচারা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।
ওদিকে ছোট চোরের দুর্দশার অবধি ছিল না। যে গরুটা চরাইবার ভার লইয়াছিল গ্রামের মধ্যে সেইটাই ছিল সকলের ওঁচা। তেমন দুরন্ত গরু আশে-পাশে আর একটাও দেখা যাইত না। ছোট চোর গরুটা লইয়া যেই মাঠে গিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে, অমনি সে শিং বাগাইয়া, লেজ উঠাইয়া, চারি পা তুলিয়া লাফ মারিল এবং চক্ষুর পলকে এ মাঠ-সে মাঠ, একজনের ধানের ক্ষেত হইতে অপরের ক্ষেতে, কাহারও তরি-তরকারির বাগানে, কাহারও শস্যের খামারে—এই ভাবে ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিল। ছোট চোর সমস্ত দিন গরুটার পিছন পিছন ছুটিয়া একেই ভয়ানক ক্লান্ত, তাহার উপর যাহাদের ফসল নষ্ট হইয়াছিল, তাহাদের গালাগালিতে দুঃখে-কষ্টে একেবারে নাকালের একশেষ হইল। শেষে কোন গতিকে গরুটা ধরিয়া টানিতে টানিতে মনিবের বাড়িতে হাজির করিল। বড় চোর বাহিরেই ছিল। জিজ্ঞাসা করিল, কি ভায়া। এত দেরি যে?
ছোট চোর, কি আর বলি ভাই। বড় সুখেই আজ দিন কেটেছে; গরুটা যে এত শান্ত, তা আমি আগে মনে করি নি। ভেবেছিলাম, না জানি কত নাকালই হ’তে হবে, কিন্তু আসলে দেখি, কিছুই না। আমিও তাকে ছেড়ে দিলাম, আর সেও ধীরে ধীরে চরে বেড়াতে লাগল। কাজ নেই কৰ্ম নেই, শুধু বসে বসে কি করি, কাজেই গামছাখানি বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম, যেমন শোয়া অমনি ঘুম। সেই এক ঘুমে একেবারে দিন শেষ। তারপর তাড়াতাড়ি উঠে দড়িগাছি ধরে এই আসছি—আচ্ছা তোমার খবর কি?
বড় চোর।—সেকথা আর জিজ্ঞেস কর কেন? বড় কপালজোরে এমন সুখের চাকুরি জুটেছে; এখন টিক্লে হয়। তুমি ত সেই চলে গেলে, তারপর আমি গাছের গোড়ায় যেই তিন চার কলসী জল ঢেলেছি অমনি জল থৈ থৈ করতে লাগল। আর এক কলসী যে দেব, তার জায়গা রইল না। কাজেই আমিও খানিক ঘুরে ফিরে খানিক ঘুমিয়ে এখন এই শেষ বেলায় চুপচাপ ব’সে
কথাবার্তা শেষ হইলে, বড় চোর ভাবিল, গাছে জল দেওয়া অপেক্ষা গরু চরান ঢের সহজ কাজ। ছোট চোর ভাবিল গরু চরান আর নয়, বাবা। দুই জনেই মনে মনে আপন কাজ বদল করিতে ইচ্ছা করিল। শেষ বড় চোর মুখ ফুটিয়া বলিল, ‘দেখ ভাই, কাল যদি আমরা পরস্পর কাজ বদল করে নিই, তাতে তোমার কোন আপত্তি আছে কি?’
ছোট চোর।-একটুও না। বেশ ত একদিন না হয় তুমি গরুটা চরালে। তবে তোমায় একটা পরামর্শ দিই। আজ সমস্ত দিন চয়! মাটির উপর শুয়ে আমার গায়ে ব্যথা হয়েছে। তুমি একখানা খাটিয়া সঙ্গে নিও। গাছের ছায়ায় বেশ আরামে ঘুমাতে পারবে। পরদিন সকালবেলা বড় চোর গরুটা লইয়া বাহির হইল। আরামে নিদ্রা দিতে পারিবে বলিয়া খাটিয়াখানা সঙ্গে লইতে ভুলে নাই। আর ছোট চোর কলসী লইয়া গাছে জল ঢালিতে শুরু করিল। ভাবিয়াছিল দুই চারি কলসী ঢালিবামাত্র গাছের গোড়ায় জল থৈ থৈ করিবে। কিন্তু সর্বনাশ। দুই শত কলসী জল দিবার পরেও দেখে কি না, একটুও মাটি ভিজে নাই! জল দিতে দিতে বেচারার হাত টন্ট এবং বুক কক করিতে লাগিল। শেষে সূর্যাস্তের পর ছোট চোর একেবারে নাকাল হইয়া বসিয়া পড়িল।
এদিকে বড় চোরেরও দুর্দশার সীমা রহিল না। গরুটা ত সে-ই, সুতরাং তাহার শয়তানীর পরিচয় আর নতুন করিয়া কি দিব? ছাড়িয়া দিবামাত্র সে শিং বাগাইয়া ছুটিল, বড় চোরের মহা বিপদ উপস্থিত। আরামের জন্য সে খাটিয়া লইয়াছিল, এখন সে খাটিয়াই বা রাখে কোথায়, আর তাহা ঘাড়ে করিয়াই বো ছোটে কিরূপে? কিন্তু আর উপায় নাই। বেচারাকে সেই খাটিয়া লইয়াই সমস্ত দিন লোকের আনাচে কানাচে, শস্যের ক্ষেতে, ঘন পাকুড়ের বাগানে, মাঠে ও জঙ্গলে গরুর পিছন পিছন ছুটাছুটি করিতে হইল; নালা ডিঙাইতে পা মচ্কাইয়া গেল। ইহার উপর আবার লোকের গালাগালিই বা কত! মাঝে মাঝে গরুটা যদিও বা একটু থামে, কিন্তু ছেলেদের চিৎকার ও হাত তালিতে তখনি আবার ক্ষেপিয়া উঠে এবং ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে থাকে, সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটাছুটি করিবার পর, বড় চোর কোন রকমে গরুটা ধরিয়া ফেলিল। তারপর তাহাকে টানিতে টানিতে যখন মনিবের বাড়িতে পঁহুছিল তখন সন্ধ্যা অতীত হইয়া গিয়াছে।
দুই চোর আবার একত্র হইল, কিন্তু কাহারও মুখে কথাটি নাই। দুইজনেই আড়চোখে তাকায় আর মুখ মুচকাইয়া হাসে। রাত্রে আহারাদির পর শয়ন করিয়া তাহারা আপন আপন দুঃখের কাহিনী আরম্ভ করিল।
ছোট চোর।—কি ভায়া, দিনটা গেল কেমন?
বড় চোর।—এই তোমার যেমন গেছে, বরং তার চেয়ে আরো এক কাঠি সরেস!
ছোট চোর।—তাই বল ভাই, আমার কিন্তু এ চাকুরি ভাল লাগে না, আমাদের আগের ব্যবসাই ছিল ভাল।
বড় চোর।—তা মিছে নয়। অনেক গরু দেখেছি বাবা, কিন্তু এটার জুড়ি মেলা ভার। উঃ, সারাটা দিন আজ কি কষ্টই না গেছে।
ছোট চোর।—আরে গরু ত কোন কোনটা দুরন্ত হয়েই থাকে। এর চেয়েও দুষ্টু গরু দেখেছি, কিন্তু বল দেখি, এমন অদ্ভুত চাঁপাগাছ আর কোথায় আছে? আচ্ছা, এত যে জল দিলাম, গেল কোথায়? নিচে পুকুর আছে নাকি?
বড় চোর।—আমার ইচ্ছে হয়, একবার খুঁড়ে দেখি। কি আছে না আছে, তা হলেই জানতে পারব।
ছোট চোর।—তা বেশ ত, সকলে ঘুমিয়ে পড়লে আজই চল সন্দেহটা দূর করি।
গভীর রাত্রিতে—যখন জনপ্রাণীর সাড়া-শব্দ নাই—দুই চোর কোদাল, খোন্তা প্রভৃতি লইয়া চাঁপাগাছের গোড়া খুঁড়িতে আরম্ভ করি। খানিক খুঁড়িবার পর ছোট চোরের খোন্তা একটা ধাতুপাত্রে লাগিয়া টং করিয়া উঠিল। শব্দ শুনিয়া দুই জনেই অবাক। ছোট চোর চক্ষুর পলকে হাত ঢুকাইয়া দেখিল পাত্রটি মোহরে ভরা। কিন্তু সে কথা গোপন করিয়া বড় চোরকে বলিল, ‘ও কিছুই না, একখানা পাথরে খোন্তা লেগে ও-রকম শব্দ হয়েছে।’ বড় চোর সবই বুঝিল, কিন্তু এমন ভাব দেখাইল যেন সে কিছুই বুঝে নাই। কিছু পরে দুই জনে হাত পা ধুইয়া ঘুমাইতে গেল।
আন্দাজ একঘণ্টা পরে বড় চোর আস্তে আস্তে উঠিয়া বসিল। ছোট চোর তখন গাঢ় ঘুমে অচেতন। বড় চোর পা টিপিয়া টিপিয়া গাছের কাছে গিয়া, মোহরের ঘড়াটি উঠাইল। কিছু দূরে আরও একটি ঘড়া ছিল, সেটিও মোহরে ভরা। বড় চোর সেই দুইটি ঘড়া লইয়া তাড়াতাড়ি পুকুরের পাড়ে পুতিয়া রাখিল এবং হাত পা ধুইয়া ধীরে ধীরে আবার ছোট চোরের পাশে আসিয়া শুইয়া পড়িল।
ছোট চোর এতক্ষণ ঘুমাইতেছিল; হঠাৎ মোহরের স্বপ্ন তাহাকে একেবারে অস্থির করিয়া তুলিল। বড় চোর শুইবার অল্প পরেই সে উঠিয়া তাড়াতাড়ি চাঁপাগাছের কাছে গেল। সেখানে মোহরের ঘড়া না দেখিয়া ত চক্ষুস্থির। কিন্তু তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, ও সমস্তই বড় চোর মহাশয়ের চালাকি! যাহা হউক, তাহাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। সে আস্তে আস্তে বিছানার পাশে আসিয়া বড় চোরের হাত পা পরীক্ষা করিতে লাগিল। দেখিল, স্থানে স্থানে কাদার চিহ্ন রহিয়াছে। ছোট চোর তখন বেশ বুঝিতে পারিল, যে, বড় চোর মোহরের ঘড়া পুকুরের পাড়ে লুকাইয়া রাখিয়াছে। কিন্তু পুকুরে ত চারিটা পাড়; কোন পাড়ে রাখিল জানা যায় কি রূপে? ভাবিতে ভাবিতে ছোট চোর পুকুরের চারি পাড় একবার ঘুরিয়া আসিল। তিন দিক হইতে কতকগুলো ব্যাঙ লাফাইয়া পড়িল দেখিয়া, ছোট চোর বুঝিল যে, বড় চোর সেই তিন দিকে যায় নাই! তার পর অপর দিকে গিয়া একটু খোঁজ করিতেই ছোট চোর মোহরের কলসী দেখিতে পাইল। সে জানিত কেবল একটি কলসীই পাওয়া যাইবে, কিন্তু যখন মোহরে ভরা আরও একটি কলসী পাইল, তখন তাহার আর আনন্দের সীমা নাই! ছোট চোর তাড়াতাড়ি গোয়াল হইতে সেই দুরন্ত গরুটা আনিয়া তাহার পিঠে দুই কলসী মোহর চাপাইয়া রাতারাতি বাহির হইয়া পড়িল।
ভোরের বেলা বড় চোর ছোট চোরকে না দেখিয়া ভয়ে ভয়ে পুকুরের পাড়ে গেল। হায়! হায়! মোহরের কলসীও নাই আর সেই দুরন্ত গরুটাও নাই। সে বেশ বুঝিতে পারিল যে, ছোট চোর গরুর পিঠে মোহরের কলসী চাপাইয়া দেশে রওনা হইয়াছে। এখন যেরূপে হউক, তাহাকে ধরাই চাই।—এই ভাবিয়া বড় চোর তখনই বাহির হইল। বাজারের ভিতর দিয়া যাইবার সময়ে, তাহার নিকট যে টাকা-কড়ি ছিল, তাই দিয়া একজোড়া সুন্দর জুতা কিনিল। সে যে কত সুন্দর, তাহা আর কি বলিব! তাহার উপর সোনার ফিতা, রূপার ফুল। তার পর বন জঙ্গলের পথ ধরিয়া সে খুব তাড়াতাড়ি ছুটিতে লাগিল। একটু বেলা হইলে, বড় চোর সদর রাস্তার একস্থানে পঁহুছিয়া দেখিল, ছোট চোর অনেক পিছনে পড়িয়াছে। গরু চালাইয়া সদর রাস্তার আঁকে-বাঁকে ঘুরিতে ফিরিতে ছোট চোরের দেরি হইয়া পড়িয়াছিল। বড় চোর দূর হইতে তাহাকে আসিতে দেখিয়া, রাস্তার ঠিক মাঝখানে এক পাটি জুতা ফেলিয়া আরো কিছু দূর অগ্রসর হইল; সেখানে, দ্বিতীয় পার্টি ফেলিয়া পাশের একটা ঝুপী জঙ্গলের মধ্যে লুকাইয়া রহিল। এদিকে ছোট চোর চলিতে চলিতে পথের মাঝে এক পাটি জুতা দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। এমন সুন্দর জুতা সে আর কখনও দেখে নাই। ভাবিল, ‘ভাগ্যগুণে আমার অবস্থা এখন রাজা-রাজড়ার তুল্য। এইজুতা ঠিক আমারই যোগ্য। কিন্তু ইহার জোড়া কোথায়।’ অপর পাটি না পাইলে এক পাটি জুতা লইয়া কি করিব? সে অনেক খোঁজ করিয়াও যখন অপর পাটি পাইল না, তখন প্রথম পাটি একপাশে ফেলিয়া দিয়া, পুনরায় অগ্রসর হইতে লাগিল। পরে অপর পাটি দেখিতে পাইয়া ভাবিল, ‘আমি কি নির্বোধ? যদি প্রথম পাটি হাতে করিয়া লইয়া আসিতাম, তাহা হইলে কি মজাই না হইত? যাহা হউক এখনও বোধ করি পাওয়া যাইতে পারে’—এই ভাবিয়া, সে গরুটা রাস্তার এপাশে বাঁধিয়া রাখিয়া প্রথম পাটির সন্ধানে ফিরিল। বড় চোর কি এমন সুযোগ ছাড়িতে পারে। ছোট চোর পিছন ফিরিবা মাত্র, সে গরুটাকে বনে-জঙ্গলের পথে চাপাইয়া লইয়া চলিল। বড় চোর এমন রাস্তায় গেল যে, কাহারো সাধ্য নাই, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করে।
বড় চোর সরিয়া পড়িবার পর, ছোট চোর ফিরিয়া আসিয়া দেখে, গরুটা সেখানে নাই। সে বেশ বুঝিতে পারিল যে, ইহা বড় চোরেরই কাজ। তখন খুব তাড়াতাড়ি ছুটিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে ছোট চোর একেবারে বড় চোরের বাড়িতে উপস্থিত হইল এবং চুপি চুপি সদর দরজার আড়ালে লুকাইয়া রহিল।
তারপর বড় চোর যেই বাড়িতে পা দিয়াছে, অমনি সে হাসিতে হাসিতে বাহিরে আসিয়া বলিল, ‘কি ভায়া। খবর ভাল ত? এখন এস মোহরগুলো ভাগ করে ফেলি।’ বড় চোর কোনও আপত্তি করিল না।
তখন দুই জনে অন্দরমহলে ঢুকিয়া সমুদয় দরজা, জানালা বন্ধ করিয়া দিল এবং দুই কলসী মোহর একত্রে জড় করিয়া দুই হাতে দুইটি করিয়া তুলিয়া সমান ভাগ করিতে লাগিল। ভাগ শেষ হইলে দেখা গেল, একটি মোহর বেশী রহিয়াছে। এখন সেইটি কাহার হইবে? অনেক বাক্-বিতণ্ডার পর এই স্থির হইল যে, পরদিন সেইটি ভাঙ্গাইয়া টাকা করিয়া উভয়ে সমান ভাগে লইবে। ভাল, তাহা যেন হইল, কিন্তু মোহরটি রাত্রে থাকে কাহার কাছে? তাহা লইয়াও খানিক তর্ক-বিতর্ক চলিল; শেষে সেইটি কেবল এক রাত্রের জন্য বড় চোরের কাছে রাখাই স্থির হইল। ইহার পর ছোট চোর তাহার অংশ লইয়া বাড়িতে ফিরিয়া গেল।
রাত্রে বড় চোর বাড়ির মেয়েদের ডাকিয়া বলিল, ‘দেখ কাল সকালেই ছোট চোর মোহরের ভাগ নিতে আসবে, কিন্তু আমি কিছুতেই তা দেব না। তোমরা এক কাজ করো—ভোর হতে না হতে আমাকে উঠানে শুইয়ে, আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একখানা কাপড় ঢাকা দিও এবং ঠিক মাথার কাছে একটা তুলসী গাছ রেখো। তারপর পথে ছোট চোরকে আসতে দেখলে খুব চেঁচিয়ে কেঁদো। তা হলে সে নিশ্চয়ই ভাববে রাত্তিরে হঠাৎ আমি মরে গেছি। মরা লোকের কাছে সে কখনো মোহরের ভাগ চাইবে না।’
মেয়েরা বড় চোরের পরামর্শ মত, পরদিন তাহাকে উঠানে শোয়াইয়া, কাপড় ঢাকা দিয়া রাখিল এবং তাহার মাথার কাছে একটা তুলসী গাছ রাখিয়া দিল। তারপর ছোট চোরকে আসিতে দেখিয়া, সকলে মিলিয়া বুক চাপড়াইয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল—‘ওগো; কি সর্বনাশ হলো গো। একে তুমি কোথায় নিয়ে গেছিলে। হায়! হায়! আমাদের কপাল পুড়েছে গো!’
শয়তানীতে ছোট চোর আরও পাকা। প্রকৃত ব্যাপার বুঝিতে বাকী রহিল না, কিন্তু মনের ভাব গোপন করিয়া সে কাঁদ কাঁদ সুরে বলিল, ‘আহা, এতকাল পরে আমি সঙ্গীহারা হলাম। যা হোক, আর কেঁদে কি হবে? তোমরা আপন আপন কাজে যাও; আমি এর সৎকার করে আসি।’ এই বলিয়া সে কতকগুলো খড়ের বিচালি সংগ্রহ করিয়া খুব মোটা একগাছা রশি পাকাইল। তারপর বড় চোরের দুই পা এক সঙ্গে বাঁধিয়া টানিতে টানিতে শ্মশানঘাটে লইয়া চলিল। ছোট চোর ভাবিয়া ছিল, রাস্তার পাথরে গা ছড়িয়া গেলে বড় চোর নিশ্চয় কথা বলিবে, কিন্তু সেটা তাহারই বুঝিবার ভুল। বড় চোরের গা দিয়া দর দর ধারে রক্ত ঝরিতে লাগিল, তবুও, পাছে মোহরের ভাগ দিতে হয়, এই ভয়ে সে একটিও কথা বলিল না—ঠিক মড়ার মত পড়িয়া রহিল। তাহাকে টানিতে টানিতে ছোট চোর সন্ধ্যার কিছু পূর্বে শ্মশানঘাটে পঁহুছিল; এইবার তাহাকে দাহ করিতে হইবে। কিন্তু কাঠও নাই আর তাড়াতাড়িতে দিয়াশলাই আনিতেও তাহার মনে ছিল না। এখন যদি সে দিয়াশলাই আনিতে যায়, তাহা হইলে সবই মাটি হইবার সম্ভাবনা। বড় চোর হয়ত সেই সুযোগে পিটান দিবে। এখন উপায় কি? ভাবিতে ভাবিতে ছোট চোরের মাথায় এক ফন্দি জাগিল। সে একটা গাছে চড়িয়া খড়ের রশি ডালে বাঁধিয়া টানিতে টানিতে বড় চোরকে উঁচুতে তুলিল। সেই অবস্থায় তাহাকে ঝুলাইয়া রাখিয়া নিজে একটা ঝোপের মধ্যে লুকাইয়া রহিল। এভাবে বেশীক্ষণ থাকা বড়ই কষ্টকর। ছোট চোর ভাবিয়াছিল, এইবার বড় চোরকে নিশ্চয় কথা বলিতে হইবে। কিন্তু ভাগ দিবার ভয়ে কিছুতেই সে কথা বলিল না—ঠিক মড়ার মত ঝুলিতে লাগিল।
এই সময়ে এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিল। একদল ডাকাত সেই শ্মশানের নিকট দিয়া যাইতে যাইতে দেখিতে পাইল, গাছের ডালে মড়া ঝুলিতেছে। কোন কাজে যাইবার পূর্বে মড়া দেখিতে পাওয়া নাকি একটা শুভ লক্ষণ। ডাকাতেরা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল, ‘আজ আমাদের শুভযাত্রা; সামনে যখন মড়া দেখেছি, তখন লুঠ-পাট্ যে আমাদের মনের মত হবে, তাতে আর সন্দেহ নেই।’ দলপতি বলিল, ‘তা যদি হয়, তবে ফেরবার পথে ওকে পুড়িয়ে যাব।’
ডাকাতেরা সেই রাত্রে এক ধনীর গৃহে প্রবেশ করিয়া তাঁহার সর্বস্ব লুঠ করিল। তাহারা এমন কৌশলে গৃহের লোকজনের হাত, পা ও মুখ বাঁধিয়া ফেলিয়াছিল যে কেহই এই ডাকাতির কথা জানিতে পারিল না। ডাকাতেরা যতটা আশা করিয়াছিল, তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী টাকা-কড়ি, সোনা-দানা পাইল। তাহাদের তখন কি আনন্দ!
হাসিতে হাসিতে শ্মশানঘাটে আসিয়া তাহারা প্রথমেই একটা গর্ত খুঁড়িল। তারপর বন-বাদাড় হইতে কাঠ আনিয়া চিতা সাজাইল। চিতা প্রস্তুত হইলে, রশি কাটিয়া দেহটি নামাইয়া তাহার উপর শোয়াইল। তার পর যেই আগুন দিবার উপক্রম করিতেছে, অমনি সেই মড়া বিকট স্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ছোট চোর ভয়ঙ্কর—’হারে—রে—রে’—শব্দে শ্মশানভূমি কাঁপাইয়া মাটিতে লাফাইয়া পড়িল।
ডাকাতেরা ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে—’বাপ্ রে মা রে’—ডাক ছাড়িয়া যে যেদিকে পারিল, দৌড় দিল। টাকা কড়ি পড়িয়া রহিল। তাহাদের আর এমন সাহস হইল না যে, একবার ফিরিয়া চায়। তাহারা ভাবিল, মড়াটাকে নিশ্চয়ই ‘দানোয়’ পাইয়াছে। আর গেছো ভূতটা যে তাহাদের ঘাড় ভাঙিবার সন্ধানে ফিরিতেছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এই কথা যতই ভাবে, ততই তাহারা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে থাকে।
তখন দুই চোর হাসিতে হাসিতে সেই সমুদয় ধন-দৌলত ভাগাভাগি করিয়া বাড়ি ফিরিল :
আমার কথাটি ফুরুল, ইত্যাদি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন