ভুতো আর ঘোঁতো – সুখলতা রাও

ভুতো আর ঘোঁতো দুই ভাই। তাদের মা-বাবা ছিল —না, কাকার কাছে মানুষ হয়েছিল তারা, গ্রামের গুরুমশায় যা জানতেন, সব যখন তারা শিখে নিলো, তখন ভুতো বললো ঘোঁতোকে, ‘আমরা বড়ো হয়েছি, এবার নিজেরা রোজগার করে খাওয়া উচিত। চল্, কাকাকে বলে কাজ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি।’

এমনি পরামর্শ করে দুই ভাই বেরোল পথে, দুটো থলিতে ভরে কিছু খাবার, দু’ বোতল জল, খান দুই কাড় নিল সঙ্গে। সারাদিন হেঁটে হেঁটে, সন্ধ্যাবেলা ভুতো আর ঘোঁতো পথের ধারের একটা সরাইখানায় গিয়ে উঠলো, সেখানে রাত কাটিয়ো পরদিন আবার রওনা হলো তারা। এমনি ভাবেই দুই ভাই চলেছে।

তিন দিনের দিন, সকালবেলা একটা বনের ধারে এলো, সেখানে রাস্তাটা দুই ভাগ হয়ে গেছে। রাস্তার এক দিক চলে গেছে উত্তর মুখো, অন্য দিক গেছে দক্ষিণ মুখো। ভুতো বলল, ‘এই উত্তর মুখো রাস্তাটায় গেলে হবে। ঘোঁতো বলল, ‘না দাদা, দক্ষিণমুখো রাস্তা ভালো।’

‘তুই দক্ষিণ দিকে যেতে চাস যা, আমি উত্তর দিকে যাই, কী বলিস?’

‘তাই যাও’। বললে ঘোঁতো।

তখন সেখানে বসে খাবার খেয়ে নিল তারা। জল বের করে দ্যাখে বোতল প্রায় শেষ। যা ছিল সেইটুকু খেলো। ঘোঁতো বলল, ‘দাদা, ঝমঝম শব্দ শুনতে পাচ্ছ?’

‘হুঁ পাচ্ছি। ওই যে পাহাড় দেখা যাচ্ছে ওখানে ঝরনা আছে বোধ হয়। চল্ ওখান থেকে বোতলে জল ভরে নিই, পথে দরকার হবে।’

বনের মধ্যে গিয়ে দু’জনে দেখলো, পাহাড়ের গায়ে একটা পাথরের দু’পাশে দুটো ফাটল। সেই দুটো ফাটলের ভেতর থেকে, দুদিকে দুটো ঝরনা বেরিয়ে ঝমঝম শব্দে নিচে পড়ছে, ভুতো ডানদিকের ঝরনা থেকে জল ভরে নিলো। ঘোঁতো নিলো বাঁ দিকের ঝরনার জল। তারপর দু’জনে বিদায় নিলো দু’জনের কাছ থেকে। ঠিক করলো, আবার এক বছর পরে, সেই তেমাথা রাস্তায় এসে তারা মিলবে।

উত্তর পথে ভুতো চলেছে, খানিকটা গিয়ে তেষ্টা পেয়েছে তার, বিকেল হয় দেখে, সে রাস্তার পাশে একটা গাছের তলায় বসলো। থলি থেকে খাবার বের করে খেলো, আর ঢকঢক করে খেলো খানিকটা ঝরনার জল। বসবার সময় বেশি নেই। তাই সে উঠে দাঁড়ালো যাবে বলে। কিন্তু দাঁড়াতেই তার শরীর কেমন করতে লাগলো। মনে হলো যেন চারদিকের মাটি ঘাস নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে ভাবছে—এ কী রকম? হঠাৎ তার মাথাটা ঠক করে ঠুকে গেল গাছের ডালে। হায় সর্বনাশ! দেখতে দেখতে বেড়ে বেড়ে সে যে মস্ত লম্বা হয়ে গেছে! ঝরনার জলে কি জাদু ছিল? এদিকে, রাত হবার আগে তাকে কোনও গ্রামে পৌঁছতেই হবে। সে কাপড়খানা যেমন পারে গুছিয়ে পরে নিলো, গায়ে জড়ালো আর একখানা কাপড়। জামা অনেক আগেই ফালা ফালা হয়ে ফেটে গেছে।

গ্রাম বেশি দূরে ছিল না। লোকেরা কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ রাস্তা দিয়ে দৈত্যের মতন প্রকাণ্ড একজন কাকে আসতে দেখে, তারা ‘মা রে, বাবা রে’ বলে ছুট দিলো। যে যার ঘরে গিয়ে এঁটে দিলো দরজা। ভুতো আর কী করে? এক মাঠের মাঝে রাত কাটালো।

সকালবেলা হাট বসেছে যখন, ভুতো সেখানে গেল খাবার কিনতে। লোকদের ডেকে বললো, ‘আমি মানুষ। আমি তোমাদের কিছু বলবো না। বড্ড খিদে পেয়েছে, আমাকে খাবার দাও।’

কিন্তু কে কার কথা শোনে? সবাই দোকান পাট ফেলে চম্পট। ভুতো দোকান থেকে খাবার নিয়ে পেট ভরে খেলো। মস্ত বড় একটা ছালায় পোঁটলা বেঁধে চাল, ডাল, মুড়ি, মুড়কি নিলো, জলের জন্য নিলো মস্ত বড়ো একটা ঘড়া, আর নিলো কাপড়ের জন্য খুব বড় বহরের বিছানার চাদর। তার নিজের থলি তো অনেক ছোট হয়ে গেছে, সেটাকে গুঁজে নিলো ট্যাকে। সব জিনিসের দাম রেখে দিলো দোকানে দোকানে। তারপর রওনা হলো আবার।

যেখানে যায়, সেখানেই একই ব্যাপার ঘটে। খাওয়া-দাওয়ার মুশকিল নেই, কিন্তু কাজ কোথাও পায় না। কেউ তার কাছেই ঘেঁষে না। মনের দুঃখে সে কিছুদিন একটা বনের ভেতরে রইলো। শেষকালে ঠিক করলো, সেখানে সবাই তার মত বড়ো, সেই দেশ খুঁজে বের করবে; দৈত্যদের দেশে যাবে।

উত্তরের পাহাড় পার হয়ে চললো ভূতো, অনেকদিন পরে, অনেক কষ্টে পৌঁছলো দৈত্যদের দেশে। দৈত্যরা তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। তাদের ভাষা ভুতো জানে না। কিন্তু তারা হাত নেড়ে, নানা রকম ইশারা করে, তাদের যা বলবার বুঝিলে দিলো তাকে। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলো, ‘এখানে কেন এসেছ?’

ভুতো বললো, ‘আমি কাজ করতে চাই। কিছু কাজ দিতে পারো?’

একজন দৈত্য বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ পারি। আমাদের বাড়িতে একটি খোকা আছে, তার মা নেই। তাকে দেখাশুনো করতে হবে পারবে?’

‘পারবো।’

দৈত্যদের ঘরে ঢুকতে ভুতোর কোন অসুবিধা হলো না। মস্ত উঁচু মাটির ঘর, পাতার ছাউনি। সেই ঘরে, মাটিতে ঘাসের মাদুর পেতে শোয়ানো আছে দৈত্যদের খোকা, যেন একটা হাতির বাচ্চা। এই গোদা গোদা হাত-পা, ফোলা ফোলা গাল, কুতকুতে চোখ। খোকাকে কোলে নেওয়া একটু মুশকিল বটে। তবু ভুতোর ভালো লাগলো। মজার মিষ্টি খোকা!

দৈত্যরা পাহাড়ের কোলে থাকে। জন্তু শিকার করে খায়। গাছের ফল আর ঝরনার জল খায়। জন্তুর চামড়া-শুকনো কাপড় পরে। কাঠ চেঁছে, পাথর কুঁদে, বড়ো বড়ো বাসন বানায়। মাটির হাঁড়ি গড়তে জানে না। বাঁশের চোঙায় ঘটি হাঁড়ির কাজ সারে। সে বাঁশও যেন বাঁশদের দৈত্য,—প্রকাণ্ড মোটা আর লম্বা।

ভুতো অল্পদিনেই সেখানকার ভাষা শিখে নিলো। পাথরের মস্ত কুণ্ড-ভরা ঝরনার জল থাকে। সেই জল নিজের ঘড়ায় ভরে এনে, খোকাকে ভুতো স্নান করায়। কাঠের গামলায় দুধ এনে, কাঠের হাতা দিয়ে তাকে খাওয়ায়। থাবড়ে থাবড়ে ঘুম পাড়ায়। আর গুনগুন করে গান গায়। গানের সুরে খোকার চোখ বুজে আসে!

এ তো যে-সে খোকা নয়। এ যখন ওঁয়া ওঁয়া করে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে, তখন ঘর-দুয়ার যেন কাঁপতে থাকে।

কিন্তু খোকা কাঁদে খুব কম, অন্য অন্য বাড়ির মেয়েরা বলে, মানুষরা যেমন ছেলে পালতে জানে, আমরা তেমন জানি না।

রাত্রে খোকা ঘুমুলে ভুতো গিয়ে বসে ঘরের দাওয়ায়। আকাশের দিকে নজর রাখে। চাঁদ দেখে সে দিন-মাস ঠিক করে। মাটির দাওয়ায় খড়ি-পাথর দিয়ে দাগ কেটে তারিখ লিখে রাখে। খোকার বাড়ির দৈত্যরা জিজ্ঞাসা করে, ‘ও কী করছো?’

ভূতো জবাব দেয়, ‘হিসাব লিখছি।’

‘সে কিরকম?”

দৈত্যরা কিছু কিছু গুনতে জানে, কিন্তু অঙ্ক কষতে জানে না। লিখতে পড়তে তো জানেই না, তাই ভুতো বলল ‘তোমরা দু’ একজন আমার কাছে লেখাপড়ো একটু শেখো, তবেই বুঝতে পারবে কী রকম।

তখন ভুতোর নতুন কাজ আরম্ভ হলো। দু’একজন তখনি তার ছাত্র হয়ে পড়লো, মাস দুই পরে অন্য দৈত্যরা দেখলো, এই ছাত্ররা মুখে কথা না বলেও, মাটিতে নানা রকম আঁচড় কেটে কথা বলতে পারে। এই দেখে তারা দলে দলে এলো লেখাপড়া শিখতে ভুতোর কাছে। সন্ধ্যাবেলা খোকা ঘুমুলে, ভুতো এদের নিয়ে পাঠশালা বসাতো।

এখন, দৈত্যদের যে সর্দার, তার একটি ছেলে ছিল বোবা, কিন্তু কানে শোনে। সর্দার ভুতোকে ধরে বসলো, তার বোবা ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে হবে। এরপর থেকে সন্ধ্যায় পাঠশালায় সর্দারের ছেলেও আসতো, শিখতো।

আর একটা কাজও শেখালো তাদের ভুতো। মাটি দিয়ে হাঁড়ি ঘটি গড়তে, আর সেগুলো আগুনে পোড়াতে। খুব সুবিধা হলো দৈত্যদের।

ক্রমে খোকা বড়ো হয়, হামা দিতে শেখে; তার দাঁত ওঠে। একদিন হিসাব করে ভুতো দেখলো, এগার মাস কেটে গেছে, এবার দেশে ফিরবার পালা। খোকা তাকে এক মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে চায় না, তাই ভুতো ঠিক করলো, দুপুরবেলা খোকা ঘুমুলে, বেরিয়ে যাবে।

পরদিন দৈত্যদের কাছে বিদায় নেবার সময়, সর্দার নিজে এসে তার হাতে একটা ছোট বাঁশের কৌটো দিলো, কৌটো ভরা ছিল লালপাথর, পদ্মরাগ মণি; আর ছিল মৃগনাভি। তারপর পাহাড়ের পথে পা বাড়ালো ভুতো!

এদিকে ঘোতোর কী হলো? ঘোঁতো খানিক দূর গিয়েই,

জল তেষ্টা পেতে বোতল থেকে জল খেলো। অমনি দ্যাখে, সে কাপড়-চোপড়ের মধ্যে ডুবে গেছে। প্রথমটা কষ্টে কাপড়ের ভাঁজের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে, বুঝলো সে আর আগের ঘোঁতো নেই,—হয়ে গেছে দেড় বিঘত খানিক লম্বা পুতুলের মতো একজন মানুষ। কী যে করবে ভেবে কূল-কিনারা পেলো না। ধুতি থেকে এক ফালি ছিঁড়ে নিয়ে পরলো, এক ফালি গায়ে জড়ালো। তার তুলনায় থলিটা হয়ে গেছে প্রকাণ্ড বড়, সে সেটাকে টানতে টানতে নিয়ে একটা গাছের শিকড়ের নিচে লুকিয়ে রাখলো। তারপর গুটি-গুটি চললো দক্ষিণের রাস্তা ধরে। চলছে তো চলেইছে। ন ওই টুকটুকু পা ফেলে ফেলে কতদূর আর যাবে?

প্রথম গ্রামটায় পৌঁছালো যখন ঘোঁতো, তখন অনেক রাত। একটা ঘরের নর্দমা দিয়ে সে ভিতরে ঢুকলো। সেখানে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ঘুমিয়ে ছিল। মেঝের এক কোণে ঐ পিঁড়ির উপর ছিল তাদের পুতুল ঘর। সেখানে কাঠের পুতুল মাটির পুতুল এরাও বিছানায় শুয়ে ছিল। তাদেরই বিছানার এক পাশে শুয়ে ঘোতো ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালে উঠে, বাড়ির বড়ো খুকি আগে গেল পুতুলদের জাগাতে! গিয়ে তো মহা চ্যাঁচামেচি লাগিয়েছে,—“ও মা! দেখবে এসো, দেখবে এসো, একটা জ্যান্ত পুতুল!

সবাই ছুটে এলো, আশ্চর্য হয়ে ‘বলিস কীরে?’—বলতে বলতে।

‘এই দ্যাখো না, কেমন। নড়ছে—চড়ছে। কে রেখে গেল কী জানি? বোধহয় কাল যে বিদেশী বাবুটি এসেছিলেন তিনি রেখে গেছেন।’

ঘোঁতোর ঘুম তখনও ভালো করে ভাঙেনি। বড়ো খুকি তাকে হাতে নিয়ে পেট টিপে দেখলো, হাত পা নেড়ে দেখলো,—কলে চলছে কিনা। ততক্ষণে ঘোঁতো একেবারে জেগে গেছে। সে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘উঃ লাগে যে। অমন করো না। আমি তোমাদের মতো মানুষ। ছোট্ট হয়ে গেছি। বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো। তার মুখে সব ঘটনা শুনে বাড়ির লোকেরা বললো, ‘আহা বেচারা?—থাকো তুমি, আমাদের কাছে থাকো।’

‘আমাকে কাজ দাও, আমি কাজ চাই।’

‘তুমি এতটুকু মানুষ, কী কাজ করতে পারবে?’

‘লেখাপড়া জানি। হিসাব রাখতে পারবো।’

তখন ঠিক হ’লে ঘোঁতো ঘরের মধ্যে ঝাড়-পৌঁছ করবে যতটা পারে, হিসাবপত্র রাখবে, ফাই-ফরমাশ খাটবে। বাইরে তাকে যেতে দেওয়া হবে না। কাক বা চিল নিয়ে যায় যদি?

সেই লোকদের একটা খাবারের দোকান ছিল। তারা দুপুর বেলা ঘোঁতোকে দোকানে বসিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে, খেতে আসতো। ঘোঁতো দোকান পাহারা দিত।

গ্রামে একদল ডানপিটে ছেলে থাকতো, তারা দুপুর বেলা পড়াশুনা না করে দস্যিপনা করে বেড়াতো! এক দুপুরে যখন ঘোঁতো দোকানে বসেছিল, সেই ডানপিটের দল দোকানের জানালা ভেঙে দোকানে ঢুকে গেল, তারা খাবার-দাবার মুঠো মুঠো নিয়ে মুখে পুরছে দেখে ঘোঁতো চেঁচিয়ে উঠলো, ‘এইয়ো খবরদার।’

‘কে কথা বলে রে?’ ব’লে তারা চারিদিকে চেয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। ‘ভূত রে, ভূত!’ বলে সবাই হুড়মুড়িয়ে জানালা গলিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে চম্পট দিলো।

বেশ আছে ঘোঁতো, কেবল একলা মোটে বাইরে বেরোতে পারে না, এই মুশকিল। ঘরের ভিতর বন্ধ থাকতে হয়। বাড়িওয়ালার পোষা বেড়ালটাকে যেন বাঘের মতো মনে হতো তার। তাই দেখে বাড়িওয়ালা বিদায় করলেন বেড়ালকে। তবু মাঝে মাঝে অন্য বেড়াল দু’একটা ঢুকতে আসতো রান্নাঘরে। ঘোঁতো তখন হাঁড়ির পিছনে লুকিয়ে পড়তো। তার বুক দুরু দুরু কাঁপতে থাকতো। বাইরে কুকুর ডাকলে মনে হতো যেন বাঘ ডাকছে।

দিন কারও বসে থাকে না। ঘোঁতোরও ক্রমে এগারো মাস কেটে গেল এই বাড়িতে। তারপর সে রওনা হ’ল তে-মাথায় যেতে, সেখানে তার দাদা উত্তর দিকে চলে গিয়েছিল। বাড়ির লোকেরা পরামর্শ দিলো, ‘কাপড় দিয়ে গা মাথা ঢেকে, ঝোপ-ঝাপের আড়ালে আড়ালে যেও।’

গুটি গুটি চলেছে ঘোঁতো পা মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে, কখন একটা চিলের নজর পড়লো তার ওপর! চিলটা নেমে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল তাকে। ভাগ্যে গায়ের কাপড় ধরেছিল, তাই ঘোঁতোর গায়ে নখ লাগেনি। চিল চলেছে উড়ে উড়ে। ঘোঁতো চলেছে ঝুলে ঝুলে, আর ভাবছে,—‘যেমনি বসবে চিল, অমনি আমাকে ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে! এই বেলা খসে যাই।’ কিন্তু মাটিতে পড়লে গুঁড়ো হয়ে যাবে, এ ভয়ও আছে। একটা মস্ত গাছের কাছে এসে চিলটা বসতে গেল। ঘোঁতোও আর কিছু না ভেবে, ঝুপ করে গলিয়ে পড়ল কাপড়ের ভিতর থেকে আর, থুপ্ করে পড়ল কী একটা নরম জিনিসের উপরে।

.

সেই নরম জিনিসটা ছিল ভুতোর গা। গাছের তলায় ভুতো অপেক্ষা করছিল ঘোঁতোর জন্য। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল! গায়ে একটা কী পড়তে মুঠো করে নিয়ে জিনিসটাকে চোখের সামনে এনে ধরলো। মনে হলো, আরশোলার মতো ছোট একটা কী যেন। তাই তো, মানুষ যে! ভূতো জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুই কে রে?’

তার বিরাট চেহারা দেখে আর গলার স্বর শুনে ঘোঁতোর পিলে চমকে গেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিলো। ‘আমি ঘোঁতো।’

‘তুই ঘোঁতো।’ বলে ভুতো চোখ কুচকে ভালো করে দেখলো। তারপর হাসবে কি কাঁদবে বুঝতে পারলো না। বললো, ‘এমন দশা কী ক’রে হ’ল তোর?’

‘ঝরনার জল খেয়ে।’

তখন সব কথাই পরিষ্কার হয়ে গেল। ভুতো বললো, ‘ঝরনার জল খেয়ে আমি হয়েছি দৈত্যের মত বড়ো, আর তুই হয়েছিস, এ্যাত্তোটুকু ছোট।’

ঘোঁতো বললো, ‘দাদা, তোমার জলটা আমি খেলে কি বড়ো হয়ে যাবো? আমার জলটা তুমি খেলে কি ছোট হয়ে যাবে?’

‘কই তোর জল কই?’ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল ভুতো। ‘পথের ধারে একটা গাছের শিকড়ের নিচে রেখেছি। আমাকে নিয়ে চলো, তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।’

তখন ভুতো ঘোঁতোকো হাতে নিলো, ঘোঁতো পথ দেখিয়ে চললো, গাছের নিচে পৌঁছে ঘোঁতো থলি বের করলো।’

ভুতো একবার বললো, ‘যদি জল খেয়ে তোর মতো আরশোলা হয়ে যাই তবে আরো খারাপ, না হয় বড়োই রইলাম।’

ঘোঁতো বললো, ‘আগে তোমার জলটা আমি দেখি। তোমার মত বড়ো হয়ে যাই তো দুঃখ নেই। কিন্তু এই রকম ছোট থেকে, বেঁচে লাভ কি?’

বলে সে ভুতোর জল নিয়ে খেল। খেতেই বড় হয়ে মানুষের মতো শরীর হলো তার। ভুতো তখন ঘোঁতোর জলটা ঢক্ ঢক্ করে খেয়ে নিলো, আর ছোট হতে হতে, হয়ে গেল আগের মতো মানুষ। তখন দু’ জনের ফূর্তি দ্যাখে কে!

সকল অধ্যায়

১. নিখুঁত মানুষ – লালবিহারী দে
২. রানি কঙ্কাবতী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
৩. বানর রাজপুত্র – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
৪. ছোট চোর ও বড় – যোগীন্দ্রনাথ সরকার
৫. ভুতো আর ঘোঁতো – সুখলতা রাও
৬. চুনির জন্ম – ত্রিভঙ্গ রায়
৭. ভোঁদড় বাহাদুর – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৮. সন্দেশের দেশে – মণীন্দ্রলাল বসু
৯. মনোবীণা – নরেন্দ্র দেব
১০. দুধ পাহাড় দধিসায়র – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১১. অস্তপাহাড়ে মানুষের মেয়ে – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
১২. মায়া আয়না – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
১৩. সেলাইবুড়ি ও আশ্চর্য ছুঁচ – শৈল চক্রবর্তী
১৪. বন্দিনী রাজকন্যার গল্প – রাধারানী দেবী
১৫. রামধনুকের রাজপুত্তুর – স্বপনবুড়ো
১৬. রাজশ্রী – ইন্দিরা দেবী
১৭. কাঠকন্যা – মৌমাছি
১৮. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
১৯. নতুন দিনের আলো – মনোজকান্তি ঘোষ
২০. আশ্চর্য আমগাছ – প্রণবকুমার পাল
২১. কী ভালো মেঘ – উত্থানপদ বিজলী
২২. যাদুশ্রেষ্ঠ বীরমাণিক্য – অমিতাভ রায়
২৩. সোনার চাঁপা ফুল – পুণ্ডরীক চক্রবর্তী
২৪. রাজকুমার বৃষস্কন্ধ আর শ্রীময়ী – নবনীতা দেবসেন
২৫. একটা আইসকীরিম একটা কাঠবেড়ালীর গল্প – কার্তিক ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন