রাজশ্রী – ইন্দিরা দেবী

নতুন মা যে তাকে একটু ভালোবাসে না—একথা যখনি মনে হয় তখনি রাজশ্রীর সুন্দর চোখ দুটি জলে ভরে যায়। সে তো খুব ভালবাসে তার মাকে। নতুন মা কী সুন্দর দেখতে, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এত সুন্দরের মধ্যে এত রাগ কেন? বিশেষ করে রাজশ্রীকে তো একেবারেই দেখতে পারে না; যখন তখন মারধর, বকুনি। বলে—শ্রী নাম কে রেখেছে—শ্রী না বিশ্রী? রাজশ্রীর বাবা এসব কিছু জানতেও পারেন না। তিনি তো রাজা। যখন অন্দর মহলে আসেন—রানি ছাড়া কেউ কাছে যেতে পারে না। এই রকমই আদেশ নতুন রানির। রাজশ্রী এখন বাবার কাছে যেতেই পারে না। অথচ নতুন মা আসবার আগে বাবা অন্দর মহলে এসেই দাসীকে বলতেন “আগে রাজশ্রীকে আমার কাছে নিয়ে এসো।” তারপর কতো আদর করতেন। কি চাই জানতে চাইতেন। রাজশ্রীর দাসীকে কতো সাবধান করতেন মেয়ের জন্য। রাজশ্রীর তো মায়ের কথা মনেই পড়ে না। বাবাই তার সব কিছু ছিলেন।

কিন্তু এখন বাবা এলে রাজশ্রী যখন বাবার কাছে যেতে চায়, দাসী বলে, ‘নতুন মা বারণ করেছেন, রাজাবাবু এখন কত ক্লান্ত হয়ে এসেছেন—তুমি যেও না।’ এসব কথায় রাজশ্রীর খুব অবাক লাগে। ভাবে বাবা তো আগে এসেই তাকে ডাকতেন—এখন আর বেশি কি ক্লান্ত হয়েছেন। একদিন দাসীর কাছ থেকে জোর করে চলে গেলো সে নতুন মার ঘরে। বাবা সোনার থালায় পঞ্চাশ রকমের রান্না খাচ্ছেন, আর নতুন মা কাছে বসে কি বলছে। তাকে দেখেই বাবার মুখটা কি খুশি খুশি হয়ে উঠলো। কিন্তু তাঁর কাছে যাবার আগেই রানি চোখ-মুখ কালি করে বললো –“আবার তুমি খাবার সময় বিরক্ত করতে এসেছো? দাসী, তোরা আমার আদেশ অমান্য করছিস কোন্ সাহসে?” নতুন রানিকে সবাই ভয় পায়। রাজার মুখটা করুণ হয়ে উঠলো। আর দাসী তাড়াতাড়ি এসে রাজশ্রীকে কোলে তুলি নিয়ে চলে গেলো।

এরপর থেকে নতুন মা রাজশ্রীর উপর আরও ক্ষেপে গেলো। অকারণে এতো মারে যে রাজশ্রীর দাসী পর্যন্ত মেয়েটার জন্য লুকিয়ে কাঁদে। সহ্য করতে না পেরে দাসীটা রাজাকে সব বলবে ঠিক করে। কিন্তু নতুন রানি এসব কি করে জানতে পেরে যায়। আর পরদিন অতো পুরনো দাসীর চাকরি গেলো। এবার রাজশ্রীর জন্য রানির পছন্দ মতো দাসী বহাল হলো। নতুন দাসীকে ডেকে রানি বললো-–“এ বাড়িতে থেকে রাজশ্রী একেবারে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুই ওকে অন্য একটা জায়গায় রেখে আসবি। আমি আগেই সব কিছু ঠিক করে রেখেছি।” এই বলে রানি চুপি চুপি অনেকগুলো কথা দাসীকে বললো আর রাজশ্রীকে ডেকে দিতে বললো। নতুন মা ডাকছে শুনে রাজশ্রী তো ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দাঁড়ালো। রানি বললো—“তুমি এখানে থেকে একদম খারাপ হয়ে যাচ্ছো। দিনকতক তোমার এক দিদিমার কাছে বেড়িয়ে এসো।” মার মুখে একটু মিষ্টি কথা শুনে আর বেড়াতে যেতে পারবে ভেবে রাজশ্রী তো খুব খুশি। পরদিন সকালে নতুন দাসীর সঙ্গে রাজশ্রী রওনা দিল।

কিন্তু যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পথ ফুরোতে চায় না। খিদে তেষ্টায়, তার উপর প্রচণ্ড পায়ের ব্যথায় রাজশ্রী আর চলতে পারে না। দাসীকে বলে, “মা যে দিদিমার বাড়ি যেতে বললেন, কিন্তু আমরা এ কোথায় যাচ্ছি। কেবল বন আর বন—কোন লোক নেই—বাড়ি ঘর কিছু দেখছি না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। দাসীর মনটা যতই কঠিন হোক এই সুন্দর নিরপরাধ মেয়েটির কথা ভেবে তার মন কেমন করতে লাগলো। কিন্তু রানি তাকে যা বলেছেন সেই মত না করলে কাল সকালেই তার গর্দান যাবে। সে শ্রীকে একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসিয়ে বললো-“তুমি। কিছুক্ষণ বসো, আমি খাবার জল নিয়ে আসি।” শ্রী ভয়ে কেঁদে উঠলো। “এখুনি আসছি”—বলেই দাসী প্রায় দৌড় দিল। তারপর? তারপর সময় বয়ে যায়। দাসী আর ফেরে না।

কেঁদে কেঁদে রাজশ্রী ঘুমিয়ে পড়লো। যখন চোখ মেললো, অবাক হয়ে দেখলো—একটা বেশ সাজানো ঘরের মধ্যে পালঙ্কের উপর সে শুয়ে আছে। কেঁদে-কেঁদে চোখ-মুখ ভীষণ ফুলে গেছে। খিদে তেষ্টায় উঠবার ক্ষমতা নেই প্রায়। তবু ধীরে ধীরে রাজশ্রী উঠলো। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে…এক থুথুরে বুড়ি লাঠি ঠুকে ঠুকে ঘরে ঢুকছে। চোখ প্রায় বন্ধ। মাথার চুল শণের নুড়ি। চেহারা কুৎসিত—দেখলে ভয় হয়। তবুও রাজশ্রী দৌড়ে গিয়ে : বুড়িকে প্রণাম করে বললো—“দিদিমা, মা আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি এখন থেকে তোমার কাছে থাকব।” এসময় খুব বেঁটে কুৎসিত একটা লোক কোথা থেকে এসে উপস্থিত হলো। বুড়ি তার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠলো—”গাছের তলায় ঘুমোচ্ছিল—নিয়ে এসেছি।” বুড়ি বললো,”বেশ করেছিস—কিন্তু সেটা কই? দাসীটা?” “তাকে সরবৎ খাইয়ে তারপর কুকুরের ঘরে রেখে এসেছি। এখন কী করবো?” এসব কথা-টথা শুনে রাজশ্রীর ভয়ে বুক ঢিব ঢিব করছে। বুড়ির কাছ ঘেঁষে বললো—“দিদিমা, আমি তোমার কাছে থাকবো। কোথাও যাব না। তোমার কাজ করবো।” রাজশ্রীর কথায় যে কি জাদু ছিল। বুড়ির বুকটা মুচড়ে উঠল হঠাৎ। বললো, “হ্যারে নাতনি, তাই হবে এখন আয় আমার সঙ্গে।” বুড়ির পেছন একটা ঘরে ঢুকল রাজশ্রী ঘরে কয়েক জায়গায় কয়েক ভাগ খাবার সাজানো। বুড়ি বললো,, “খিদে পেয়েছে তো? যা যে কোন এক ভাগ খেয়ে নে!” রাজশ্রী এক ভাগ খাবারের সামনে বসতেই বুড়ি হা-হা করে বলে উঠল—”ওটা নয়, ওটা নয়—ও-ই ওইটায় বস্ তুই, আমি এটায় বসছি।” রাজশ্রী খেতে খেতে বললো—“খাওয়া হলে আমি তোমার গায়ে পায়ে হাত বুলিয়ে দেবো—বুড়ো বয়সে কত কষ্ট তোমার!” সুন্দর মেয়েটার মিষ্টি মধুর কথায় বুড়ির মনে যেন তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। বলে—“চল্ তোকে আমি খুব যত্ন করে রাখবো। একটা এত সুন্দর দুধের শিশুকে যে কষ্ট দিয়েছে—তাকে আমি সাজা দেবই!”

দিন যায়। মাঝে মাঝে বেঁটে লোকটা নানা জনকে ধরে আনার খবর বয়ে আনে। বুড়ি তাদের কাউকে খাবার দিতে বলে, কাউকে সরবৎ, কাউকে বা অন্য কিছু। বুড়ির অনেক কিছুই রাজশ্রী বুঝতে পারে না। জিজ্ঞেস করলে বুড়ি কেবল বলে—”এসব তুই বুঝবি না নাতনি। তবে যতদিন আমি আছি তোর কোন ভয় বিপদ নেই। একদিন বামনটা কোথাকার এক রাজাকে ধরে নিয়ে আসার খবর দিল। বুড়ি তাকে সরবৎ খাইয়ে কুকুরের ঘরে রেখে দিতে বললো।

আরও কটা বছর চলে গেলো। রাজশ্রী এখন বড়ো হয়েছে। তার রূপ দেখে বুড়ির আর আশ মেটে না। একদিন রাজশ্রীকে বললো-”নাতনি রে! এবার তোর বিয়ে দেবো সুন্দর বর দেখে।” “না-দিদিমা! আমি তোমার কাছে থাকবো—কোথাও যাবো না।” বুড়ি বললো, “কোথাও যেতে হবে না। আমার কাছেই থাকবি। আমার সব কিছু তোর হবে। আয় দেখি আমার সঙ্গে।” বুড়ির পেছনে পেছনে গিয়ে রাজশ্রী দেখলো একটা বড় ঘর—ঘরটা খালি পাথরের চাঁই এ ভর্তি। বুড়ি তার হাতের লাঠিটা সব কটা পাথরের গায়ে ঠেকাতেই অবাক কাণ্ড। হাই তুলে, গা ঝেড়ে সব উঠে দাঁড়ালো—কতো দেশের রাজপুত্র। বুড়ি বললো—“তোমরা সবাই মুক্তি পাবে, দেশে ফিরে যাবে। কেবল আমার নাতনি যাকে পছন্দ করবে—সে থাকবে। তার সঙ্গে বিয়ে দেবো নাতনির।” কিন্তু কেউ আর বিয়ে করতে চায় না। চলে যেতে পারলে বাঁচে। দেখে শুনে শ্রীও হতবাক্ হয়ে গেছে। এ সময় বুড়ি হঠাৎ বামনটাকে কী বলে যেন ডাকলো। সে আসতেই বুড়ি কী বলে টুক্ করে তার গায়ে লাঠিটা ছোঁয়ালো। ও মা! ও মা একি? রাজশ্রী অবাক হয়ে দেখলো তার সামনে অতি রূপবান এক রাজপুত্র দাঁড়িয়ে। বুড়ি বললো—“ও হলো রূপনগরের রাজপুত্র; বড় ভালো ছেলে ছিল বলে ওকে পাথর করিনি। এর সঙ্গেই তোর বিয়ে দেবো। কি রে তোরা রাজী তো দুজন?” দুজনেই লজ্জায় মাথা নিচু করে বুড়িকে প্রণাম করে। এবার বুড়ি মুখে কি একটা আওয়াজ করতে একটা প্রকাণ্ড কুকুর এসে দাঁড়ালো। কুকুরটার গায়ে লাঠিটা ছোঁয়াতেই রাজশ্রী অবাক হয়ে দেখে তার বাবা তার সামনে দাঁড়িয়ে। রাজামশাই রাজশ্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। বুড়িরও চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। রাজাকে বললো—“মা মরা মেয়ে, একটুও খোঁজ নিতে নেই তোমার? প্রচণ্ড হিংসায় মেয়েটাকে মেরে খেয়ে ফেলতে পাঠিয়েছিলো তোমার নতুন রানি আমার কাছে। কারণ, ও আমায় চেনে।” রাজশ্রী আনন্দে বলে উঠলো—“বাবা এ আমার সত্যি দিদিমা। এর জন্য আমার সব হয়েছে।” রূপনগরের রাজারানি এলেন। যে সব রাজপুত্রেরা মুক্তি পেলো তারা দেশে গিয়ে নানা উপহার নিয়ে এসে উৎসবে যোগ দিলো। বুড়ি এক নগর বসিয়ে দিলো—নাম হলো রাজশ্রী। রাজা ফিরে এলেন মেয়ে জামাই নিয়ে। সারা রাজ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। রাজশ্রীর দাসী এলো। বুড়ি হয়ে গেছে। চোখে দেখে না। রাজশ্রীকে জড়িয়ে খালি কাঁদে আর কাঁদে। কিন্তু রানি কোথায়? রাজশ্রীকে মেরে ফেলতে পাঠিয়ে, অত্যাচারে অত্যাচারে রাজাকে দেশছাড়া করিয়ে রানি সুখেই ছিলো। কিন্তু এবার রাজশ্রীর অনুনয়-বিনয় কিছুই শুনলেন না রাজা। কারাগারে বাকি জীবন কাটাতে হলো হিংসুটে রানিকে।

আনন্দের মাঝে কিছু দিন কেটে যায়। কিছুদিন পর রাজা মারা গেলেন। এই রাজ্য আর পাশেই রূপনগর—বিরাট রাজ্যের রানি এখন রাজশ্রী। বহুদিন পর হঠাৎ রাজশ্রীর দিদিমার কথা মনে পড়লো। কতদিন হয়ে গেলো—কোন খবর নেয়নি মনে করে রাজশ্রীর লজ্জা হলো। স্বামীসহ একদিন সে গিয়ে হাজির রাজশ্রী নগরে। “দিদিমা দিদিমা! দিদিমা গো! “রাজশ্রী ডেকে ডেকে সারা। বাড়ি খালি! দিদিমা কই? খুঁজে খুঁজে বাগানের দরজা খুলে বড়ো পুকুরটির কাছে গিয়ে দেখে বুড়ি সেখানে বসে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। রাজশ্রী দু’হাতে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলো। “দিদিমা, আমার উপর বড় রাগ করেছো?” বুড়ি দুর্বল হাতটা মাথার উপর রেখে বললো—“আমার যাবার সময় হয়েছে, আর তোর ওপর কি আমি রাগ করতে পারি? এক দেবতার শাপে ডাইনি হয়েছিলাম। দেবতার কাছে অনেক কাঁদলাম। তখন দেবতা বললেন—যদি কোন দিন কাউকে একান্তভাবে ভালবাসতে পারো, তাহলেই এই ঘৃণিত জীবন থেকে মুক্তি পাবে। যাই হোক্, এই লাঠিটা এবার পুকুরের জলে ফেলে দে তুই। তাহলে আমার মুক্তি। তোকে আমি আশীর্বাদ করছি।” বুড়ির হাতের লাঠিটা জলে ফেলে দিতেই বুড়ির দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলো। রাজশ্রী দেখলো বুড়ি তো নয়, অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে গাছের তলায় ঘুমিয়ে রয়েছে। রাজশ্রীর চোখ থেকে টপ্ টপ্ করে জল পড়তে লাগলো।

সকল অধ্যায়

১. নিখুঁত মানুষ – লালবিহারী দে
২. রানি কঙ্কাবতী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
৩. বানর রাজপুত্র – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
৪. ছোট চোর ও বড় – যোগীন্দ্রনাথ সরকার
৫. ভুতো আর ঘোঁতো – সুখলতা রাও
৬. চুনির জন্ম – ত্রিভঙ্গ রায়
৭. ভোঁদড় বাহাদুর – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৮. সন্দেশের দেশে – মণীন্দ্রলাল বসু
৯. মনোবীণা – নরেন্দ্র দেব
১০. দুধ পাহাড় দধিসায়র – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১১. অস্তপাহাড়ে মানুষের মেয়ে – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
১২. মায়া আয়না – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
১৩. সেলাইবুড়ি ও আশ্চর্য ছুঁচ – শৈল চক্রবর্তী
১৪. বন্দিনী রাজকন্যার গল্প – রাধারানী দেবী
১৫. রামধনুকের রাজপুত্তুর – স্বপনবুড়ো
১৬. রাজশ্রী – ইন্দিরা দেবী
১৭. কাঠকন্যা – মৌমাছি
১৮. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
১৯. নতুন দিনের আলো – মনোজকান্তি ঘোষ
২০. আশ্চর্য আমগাছ – প্রণবকুমার পাল
২১. কী ভালো মেঘ – উত্থানপদ বিজলী
২২. যাদুশ্রেষ্ঠ বীরমাণিক্য – অমিতাভ রায়
২৩. সোনার চাঁপা ফুল – পুণ্ডরীক চক্রবর্তী
২৪. রাজকুমার বৃষস্কন্ধ আর শ্রীময়ী – নবনীতা দেবসেন
২৫. একটা আইসকীরিম একটা কাঠবেড়ালীর গল্প – কার্তিক ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন