একটা আইসকীরিম একটা কাঠবেড়ালীর গল্প – কার্তিক ঘোষ

একটা আইসকীরিম একটা কাঠবেড়ালীর গল্প – কার্তিক ঘোষ

রোদ্দুর বলে রোদ্দুর!

একেবারে ঝাঁ-ঝাঁ করা কাঠ-ফাটা রোদ্দুর!

তবুও রাস্তায় বেরিয়েছে বুড়োটা।

—সেই বুড়োটা…

জানলা দিয়ে একটু উঁকি দিয়েই মিঠুন বললে টুকাইকে।

—কোন বুড়োটা?

—সেই যে…মাথায় লাল পাগড়ি বাঁধা, গায়ে একটা নীল রঙের জামা…হলদে রঙের কাপড়… সেই বুড়োটা আসছে—

—আইসকীরিম চাই…আ….ই…স…কীরিম…

জানলা দিয়ে হাত বাড়ালো মিঠুন।

আর টুকাই? সে ছুটলো বাইরে।

দুজনকে দুটো আইসকীরিম বিক্রি করে আবার কাঠের বাক্সটা কাঁধে তুলে নিলে বুড়োটা।

তারপর আবার চললো… আবার…

—আইসকীরিম চাই………ই…স কীরিম….

বুড়ো যাচ্ছে কোন দিকে?

বুড়ো যাচ্ছে হাটতলা।

হাটতলাতে কি আছে?

আইসকীরিমগুলো কেউ কিচ্ছুটি জানে না। শুধু ফিসফাস করছে বাক্সটার মধ্যে!

এখন…

সব কিছু জানে শুধু এই বুড়োটা। কিন্তু তা’ জানে তো আর কি হবে!

হাটতলা এখন খাঁ-খাঁ।

ময়রা দোকানের ময়রাটা ঘুমোচ্ছে।

আর ওর সেই ছেলেটা।

—আইস কীরিম চাই…আ….ই…স কীরিম…

ছেলেটা কোথায় গেছে কে জানে! দোকানে থাকলে

ছুটে আসতো পাঁই পাঁই…

বুড়োটা আর দাঁড়ালো না হাটতলায়!

বাক্সর মধ্যে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো লাল আইস কীরিমটা।

হলদেরা দিব্যি ঘুমোচ্ছে একপাশে। আর সব্‌জেরা? ওরা দিব্যি ফুফাস ক’রে গল্প করছে দুধ সাদাদের সঙ্গে।

কিন্তু, লালটি?

ও যে এখন একলাটি!

ওর দলে আর যারা লাল টুকটুকেটি হয়ে ছিল তারা সবাই বিক্রি হয়ে গেছে একটি-দুটি করে।

—আইসকীরিম চাই-আইস…কীরিম….

বুড়োটা এখন কোথায় যাচ্ছে? কোন দিকে?

লালটি কিচ্ছু বুঝতে পারলে না…

বুড়ো যাচ্ছে হাটতলা ছাড়িয়ে কলতলা।

কলতলায় থেমে জল খেয়ে নিলে একটু। তারপর আবার চললো…

সামনে পড়লো মাঠটা।

মাঠের ধরে তালগাছ। একটা-দুটো…তিনটে সারি সারি…একেবারে আটটা।…

বুড়ো যাচ্ছে কোন্ দিকে?

সব্‌জেরা বললে লালটিকে?

—বুড়ো যাচ্ছে পুবদিকে।

—পুব দিকে কী আছে?

—সামনে পড়বে আমতলা…আমতলা ছেড়ে জাম তলা…জামতলা পেরিয়েই সেই নদীটা…নদীর ধারেই তো মিঠুনের মামাবাড়ি…

হঠাৎ বুড়ো বাঁকলো উত্তরে….

সব্‌জেরা গেল চুপ করে। আর হলদেরা? ওরা উঠে পড়লো ঘুম থেকে।

তারপর…

সবাই একসঙ্গে বললে, কী হলো? কী হলো?

লালটি কিছু বললে না।…

সামনে পড়লো বটতলা…

বটের তলায় রোদ নেই। মিষ্টি মিষ্টি ছায়া। হাওয়া বলছে, সরসর্…সরসর্।

ডালে ডালে পাতার ঘর। সেই ঘরে পাখিরা ঘুমোচ্ছে।

ঘুম দেখলেই বুড়োটার ঘুম ধরে। আর তাই বুঝি আইসকীরিমের বাক্সটা নামিয়ে বসে পড়ে বটগাছের তলায়।

বটের ডালে যেই একটা-দুটো পাখি হঠাৎ জেগে উঠলো অমনি বুড়োটা ঘুমিয়ে পড়লো বাক্সটাতে হেলান দিয়ে। …

আগে বললে লালটি।

বুড়ো ঘুমোলো শুনে হাই তুললে হলদেরা।

আর দুধ সাদারা হেসে উঠলো ফিক ফিক করে।

কিন্তু লালটি…ও একলাটি শুধু হাসলো না, কাশলো না…কিচ্ছু না। মুখটা যেন হাঁড়ি করে, গলাটা একট ভারী করে ও শুধু বললো-বুড়ো এখন ঘুমোচ্ছে… এই ফাঁকে চলো আমরা পালাই…

লালটির কথা শুনে সবাই হাঁ হয়ে গেল! কেউ বললে—কোথায়?

—কেন আমাদের দেশে…

—কী বলছো তুমি লালটি?

—কেন, বুঝতে পারছো না?

একটু থেমে লালটি আবার বললে, আমাদের দেশের কথা বলছি…নীল আকাশের তলায় মেঘছোঁয়া সেই দুধ-সাদা পাহাড়ের চুড়োয় আমাদের যে দেশ…কী সুন্দর! তাই না?

সবজেবা, হলদেরা আর দুধ সাদা আইসকীরিমরা সবাই আরো অবাক হয়ে গেল লালটির কথা শুনে!

—যাবে তো চলো…দেরি হলেই উঠে পড়বে বুড়োটা তখন হবে মুশকিল! কেউ কেউ নড়ে-চড়ে উঠলো, কেউ কেউ বললে, কিন্তু…

—কিন্তু আবার কী?

লালটি রেগে উঠলো এবার। বললে, বুড়ো উঠলেই ব্যস্…বিক্রি করে দেবে সবাইকে…আর ঐ হ্যাংলা ছেলেমেয়েগুলো চুষে চুষে—কিন্তু… দেশে যাবার রাস্তা?

—রাস্তা কি আর ঘরে থাকে? রাস্তা তো বাইরে… চলতে চলতে চিনতে হয়… চিনতে চিনতে চলতে হয়…যাও তো চলো…

বলতে বলতে বাক্সর ঢাকনিটা ফুস্ করে খুলে টুস্ ক’রে বাইরে বেরিয়ে পড়লো লাল আইসকীরিমটা।

আর সবাই?

ওরা কেউ পারলো না বেরিয়ে পড়তে। কেউ শুধু উঁকি দিলে, কেউ আবার বুড়োর নাক ডাকার শব্দ শুনেই ভয়ে জড়োসড়ো হ’য়ে রইল অনেকক্ষণ! কিন্তু লালটি? সে এগিয়ে চললো টুকটুক।

কী মজা! কী মজা!

হাততালি দিয়ে ছুটে এলো একটা কাঠবেড়ালী।

লালটি অমনি দাঁড়িয়ে পড়লো কাঠবেড়ালীকে দেখে।

কাঠবেড়ালীর তো খুশী আর ধরে না। আইসকীরিম টাকে হাঁটি হাঁটি পা চলতে দেখে কাঠবেড়ালী বললে, কোথায় যাচ্ছ তুমি আইসকীরিম…এই দুপুর বেলা?

–আমাদের দেশে।

—সে আবার কোথায়?

—কেন, পাহাড়ের চুড়োয় সেই বরফের রাজ্যে…

—ও, তাই বুঝি?

মুচকি একটু হাসলো কাঠবেড়ালী। তারপর বললে, তাহলে মালাই বরফ তোমার কে হয়?

—কেন, আমার পিসেমশাই!

আইসকীরিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেক দূর চলে এলো কাঠবেড়ালী! তারপর হঠাৎ এক সময় বললে,—সত্যি… তোমাকে বড্ড ভালো লাগছে আমার…তুমি চলো না আমার সঙ্গে আজকে আমার মামার বাড়ি। কেমন গল্প করা যাবে দুজনে…

—তোমার মামার বাড়ি আবার কোথায়? কদ্দূর হবে এখান থেকে!

—ঐ তো দেখা যাচ্ছে আমার মামার বাড়ি!

একটা পুকুর পাড়ের দিকে একসারি খেজুর গাছ দেখিয়ে কাঠবেড়ালী বললে, ঐ যে খেজুর গাছগুলো দেখছো, একটা…দুটো… তিনটে…চারটে…ঐ তো আমার মামার বাড়ি…

—তাই নাকি! তাই নাকি!

খুশি ডগমগ ক’রে উঠলো লাল আইসকীরিমটা!

তারপর…

বটের ছায়া ছাড়িয়ে, শিরীষ গাছের ছায়া মাড়িয়ে মাঠের মধ্যে এসে পড়লো দুজনে। আনন্দে নাচতে নাচতে চললো কাঠবেড়ালী…চললো এগিয়ে এগিয়ে…

কিন্তু, মাঠ পেরিয়ে থমকে দাঁড়ালো হঠাৎ!

ওমা, ওর বন্ধু লাল আইসকীরিমটা গেল কোথায়? পিছন ফিরেই ছুট দিলে একবার। ছুটতে ছুটতে মাঠ, মাঠ পেরিয়ে শিরীষতলা…শিরীষতলা ছাড়িয়ে বটতলায়…। কিন্তু…লালটি গেল কোথায়?

হাঁপাতে হাঁপাতে উপুড় হয়ে পড়লো গিয়ে মামার বাড়ি! ওর বড়মামা আবার বড় খেজুর গাছটায় থাকে! যেমনি নাম ডাক, তেমনি চালাক চটপটে।

আদুরে ভাগনেটির আইসকীরিম বন্ধুটা হারিয়ে গেছে শুনেই খবর দিয়ে দিলে চড়াই পাখিদের পাড়ায়। ওদের পাড়াতেই থাকে চৌকিদার চড়াই চন্দর ঘোড়ুই।

চৌকিদার ছুটলো সঙ্গে সঙ্গে!

মাঠ বেরিয়ে শিরীষ গাছে…শিরীষ গাছ থেকে বটগাছ। বটগাছের পাখিরা বললে, আইসকীরিমটা কেমন!

—লাল মতন!

—কখন হারালো… কখন…

—দুপুর বেলা…তখন… তখন…

—মেঘ ছিল…না রোদ ছিল…

—মাঠের মধ্যে রোদ ছিল… গাছের তলায় ছায়া…

—তাহলে খুঁজতে পারো মাঠটা…

চৌকিদার চড়ুই চন্দর তাই করলে। খুঁজতে গেল মাঠটায়।

তারপর…

তারপর কী হলো?

সন্ধ্যে বেলায় চড়াই পাড়ার মোড়ল মশাই একটা চিঠি পাঠালে মামার কাছে। ছোট্ট…একটু খানি চিঠি… ডুমুর পাতায় দেখা…

এই মাত্তর শেষ হয়েছে
চৌকিদারের সফর…
আইসকীরিমনে যায়নি পাওয়া
এই হচ্ছে খবর
দেখা গেছে মাঠের মধ্যে
একটু ভিজে মাটি …
তার ওপরেই পাওয়া গেছে
আইসকীরিমের কাঠি।

***

অধ্যায় ২৫ / ২৫

সকল অধ্যায়

১. নিখুঁত মানুষ – লালবিহারী দে
২. রানি কঙ্কাবতী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
৩. বানর রাজপুত্র – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
৪. ছোট চোর ও বড় – যোগীন্দ্রনাথ সরকার
৫. ভুতো আর ঘোঁতো – সুখলতা রাও
৬. চুনির জন্ম – ত্রিভঙ্গ রায়
৭. ভোঁদড় বাহাদুর – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৮. সন্দেশের দেশে – মণীন্দ্রলাল বসু
৯. মনোবীণা – নরেন্দ্র দেব
১০. দুধ পাহাড় দধিসায়র – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১১. অস্তপাহাড়ে মানুষের মেয়ে – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
১২. মায়া আয়না – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
১৩. সেলাইবুড়ি ও আশ্চর্য ছুঁচ – শৈল চক্রবর্তী
১৪. বন্দিনী রাজকন্যার গল্প – রাধারানী দেবী
১৫. রামধনুকের রাজপুত্তুর – স্বপনবুড়ো
১৬. রাজশ্রী – ইন্দিরা দেবী
১৭. কাঠকন্যা – মৌমাছি
১৮. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
১৯. নতুন দিনের আলো – মনোজকান্তি ঘোষ
২০. আশ্চর্য আমগাছ – প্রণবকুমার পাল
২১. কী ভালো মেঘ – উত্থানপদ বিজলী
২২. যাদুশ্রেষ্ঠ বীরমাণিক্য – অমিতাভ রায়
২৩. সোনার চাঁপা ফুল – পুণ্ডরীক চক্রবর্তী
২৪. রাজকুমার বৃষস্কন্ধ আর শ্রীময়ী – নবনীতা দেবসেন
২৫. একটা আইসকীরিম একটা কাঠবেড়ালীর গল্প – কার্তিক ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন