এক দেশে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ছিল একটিমাত্র ছেলে। ছোটবেলায় রানিমা মারা গেছেন। রাজার আদরে আদরে ছেলেটি এক্কেবারে বাঁদর হয়ে উঠেছে। ছেলের নাম বৃষস্কন্ধ। সত্যিই তার বিশাল চেহারা। গায় জোরও খুব। বৃষস্কন্ধের স্বভাবটি কিন্তু মোটেই ভালো নয়। কেবলই মারামারি করতে পছন্দ করে সে। দুমদাম একে খুঁষি মারলে, চটাপট্ ওকে থাপ্পড় কষালে, ক্যাৎ করে এক পদাঘাত করে দিলে কারুর পশ্চাদ্দেশে—এটাতেই তার আনন্দ; ছেলেবেলা থেকে এটাই তার খেলা। এবং সে রাজার ছেলে বলে কেউ তাকে উলটে মারতেও পারে না। মনের সুখে রাজপুত্তুর রাজার কুপুত্তুর হয়ে উঠল। দেশের লোকের মনে খুব উদ্বেগ। এই ছেলে যখন রাজা হবে, তখন দেশ তো উচ্ছন্নে যাবে। দেশসুদ্ধু সবাইকে জ্বালাবে। রাজার মনে একটুও সুখ নেই। এমন সময়ে রাজার শরীরটাও খারাপ হল, রাজা অস্থির হয়ে উঠলেন ছেলের বিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু বৃষস্কন্ধকে মেয়ে দেবে কে? কোনো বাবা মা-ই চায় না তার মেয়েকে ধরে ধরে জামাই পিটুনি দিক!
যতই রাজভোগের লোভ দেখানো হোক না কেন, আশপাশের সব রাজ্য দেশবিদেশ খুঁজে, সওদাগর, কোটাল, মন্ত্রী, উজীর, নাজীর, সভাকবি, কুলপুরোহিত, রাজবৈদ্য, সেনাপতি—মানে রাজসভায় যে যেখানে আছেন, কেউই বৃষস্কন্ধের জন্যে কন্যে যোগাড় করতে পারলেন না। রাজা তো মনের দুঃখে প্রায় মরেই যান বুঝি বা! ছেলের আর বিয়ে হল না। বংশ আর রক্ষা হল না। এমন সময়ে রাজার মালী এসে হাতজোড় করে বললে, “রাজামশাই, আমার ছোট মেয়েটি রাজকুমারকে বিয়ে করতে রাজী। কিন্তু তাকে একশো নিজস্ব দাসদাসী, আর একহাজার নিজস্ব সৈন্যসামন্ত দিতে হবে।”
রাজা শুনে বললেন, “বেশ, তোমার মেয়ে যা বলেছে তাই হবে। বৃষস্কন্ধের বিয়ে না দিলেই নয়। আর ছেলের যা সুনাম, এদিকে ওদিকে সাতখানা দেশ থেকে কেউই তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়নি!”
মালীর মেয়ের নাম শ্রীময়ী। যেমন নাম, তেমনি তার রূপ। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েটি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী। সে দিব্যি হাসিমুখে বৃষস্কন্ধের গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে, মালিনী থেকে যুবরানি হয়ে গেল। এদিকে বৃষস্কন্ধ তাকে সকালে উঠে খানিক পেটায়, তারপর ঘুরতে বেরিয়ে যায়, ফের রাত্রে ফিরে খানিক পেটায়। শ্রীময়ী সহ্য করে, আর মনে মনে ফন্দি আঁটে। কিছুদিন মারধোর খাবার পরে, শ্রীময়ীর শুকপাখিটি একদিন বৃষস্কন্ধকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললে—“গোরুটাও দুধ দেয় বলেই তাকে জাবনা দেওয়া হয়, কুকুরটাও পাহারা দেয় বলেই তাকে হাড় দেওয়া হয়, বেড়ালটাও ইঁদুর ধরে বলে তাকে দুধ দেওয়া হয়, কিন্তু দ্যাখ্ তো সারি, রাজকুমার কিচ্ছুই না করে বসে বসে রাজভোগ খায়। তুই আমি তো তবু দুবেলা রামনামের বুলি পড়ি বলেই ছোলা জল পাই, কিন্তু বৃষস্কন্ধ? সে কেবল সবাইকে পেটায় বলে রাজভোগ খায়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কী লজ্জার কথা!” সারি অমনি বললে—”ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা! মরে যাই! আমি যদি বৃষস্কন্ধ হতুম তাহলে এখুনি রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যেতুম যে কোন কাজকর্মের খোঁজে। বউকে খাওয়ায় না, আবার বউকে ধরে মারে? ছিঃ, লজ্জাও করে না যুবরাজের?”
বৃষস্কন্ধ শুক-সারির কথা শুনে খুব রেগে গেল। ইতিমধ্যে তার বাবার অসুখ সেরে গেছে। তিনিই আবার রাজ্যচালনা করছেন। বৃষস্কন্ধ সত্যিই কিছু করে না। সে রেগেমেগে শুক আর সারির ঘাড় না মটকে ভেঙেই দিলে। তার পরে রাগ কমলে ভেবে দেখল, ওরা তো ঠিক কথাই বলেছে? নাঃ, উপার্জন না করলেই নয়। বৃষস্কন্ধ তখন বাজার থেকে অনেক কিছু ভাল ভাল মালপত্র নিয়ে, পাশের বড় রাজ্যের সওদাগর রাজার কাছে বাণিজ্য করতে গেল। সওদাগর রাজা দারুণ চালাক। সে বৃষস্কন্ধকে দেখেই বুঝেছে তার মাথায় বুদ্ধি নেই। সে বললে, “দ্যাখো, তোমার গায়ে যদি আমার বেড়ালটা লাফিয়ে পড়ে, তবেই তোমার মালপত্র আমি ন্যায্য দামে কিনে নেব। আর যদি তা না পড়ে, তবে সব মালপত্র আমি অমনি কেড়ে নেব। রাজী তো? কী?”
একটু ভেবে বৃষস্কন্ধ বললে, “রাজী!” কিন্তু সওদাগরের বেড়াল তার গায়ে লাফাবে কেন? অত মোটা লম্বা লোক ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলছে ঠিক ষাঁড়েরই মতন, যতই “আয় আয় তু তু” করে ডাকুক না কেন, তাকে দেখেই বেড়ালটা লেজ তুলে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। সওদাগর তখন তার সব মালপত্র কেড়ে নিয়ে বৃষস্কন্ধকে তাড়িয়ে দিলে। বৃষস্কন্ধ যেই ভীষণ রেগে উঠে সওদাগর রাজাকে মারতে গেছে, অমনি তার যত পাইক বরকন্দাজ সব এসে বৃষস্কন্ধকেই মেরে ধরে তার রাজপোশাক খুলে নিয়ে, শুধু একটা কৌপীন পরিয়ে মাথা নেড়া করে নদীর পারে এক চাষীর কাছে ছেড়ে দিয়ে এল। বলল, “সব টাকা রোজগার করে, তবে তোর সওদা ফেরৎ নিবি। ততদিন খাটতে থাক।”
রাজপুত্র বৃষস্কন্ধ এতদিন নিজেই শুধু অন্যকে মেরেছে, অন্যের হাতে মার তো কোনদিন খায়নি, কাজেই আত্মরক্ষার কায়দাও কিছুই জানে না। সে মার খেয়ে খুব ঘাবড়ে গেল। কী আর করবে, চাষীর ক্ষেতেই মজুরের কাজটা মন দিয়ে করতে লাগল। টাকা রোজগার করে হারানো সওদা সব উদ্ধার করে তবে তো নিজের রাজ্যে ফিরবে? টাকা হওয়া দূরের কথা অত সওদা হারিয়ে সে মুখ দেখাবে কেমন করে রাজসভাতে? চাষীর ক্ষেতে কাজ করতে করতে বৃষস্কন্ধের কৌপীনটা ছিঁড়ে গেল, চাষী তখন তাকে নতুন একটা কৌপীন কিনে দিলে। চাষীর কাছে তার হিসেব জমা হচ্ছে, এক বছর হয়েছে মাত্র। আরও ন’বছর কাজ করার পরে সওদার দাম শোধ হবে। বৃষস্কন্ধ প্রচুর খাটতে পারে, তবুও তার রোজগার বাড়ে না। পুরস্কার নেই।
এদিকে শ্রীময়ী তার একশো অনুচরকে সর্বক্ষণ লাগিয়ে রেখেছে রাজপুত্রের খবর সংগ্রহের কাজে। তারা সব খুঁটিনাটি খবর দেয়। রাজপুত্র করে কী দিয়ে ভাত খাচ্ছে, সেটা পর্যন্ত শ্রীময়ী জানে। কৌপীন বদলের খবর শুনেই শ্রীময়ী বললে, “এই ছেঁড়া কৌপীনটা আমার চাই!” অনুচরেরা চটপট ছেঁড়া কৌপীনটা আস্তাকুঁড় থেকে তুলে নিয়ে এল।
শ্রীময়ী এবার বেরুল সওদা নিয়ে, পুরুষের সাজে পাশের রাজ্যের সওদাগর রাজার সভায় গিয়ে হাজির হল। সঙ্গের এক হাজার সৈন্যসামন্ত একটু দূরে বনের মধ্যে লুকিয়ে রইল।
শ্রীময়ীর গায়ে শাল জড়ানো, তার মধ্যে একটা ইলিশ মাছ লুকিয়ে রেখেছে। সওদাগর রাজা তাকে বৃষস্কন্ধের মতোই বললে, “যদি আমার বেড়াল তোমার কাছে যায়, তবেই তোমার সব সওদা আমি কিনে নেব। নইলে তোমার সওদা অমনি অমনিই নিয়ে নেব।”
শ্রীময়ী বললে—“অমন একপেশে শর্তে তো হবে না মশাই? যদি আপনার পোষা বেড়াল আমার দিকে আসে, তবে আমার সব সওদা আপনি কিনে নেবেন আপনার সিংহাসনের বদলে। ওটাই আমার সওদার দাম। আর যদি না আসে, তবে আমাকে সুদ্ধু ক্রীতদাস করে রাখবেন সওদা সমেত।”
সদাগর রাজা তো জানেন, বেড়ালটা কারুর কাছেই যায় না। তিনি তক্ষুনি রাজী। বেড়াল কাছাকাছি আসতেই টুক করে শ্রীময়ী শালটা একটু সরিয়ে বেড়ালটাকে একপলক ইলিশ মাছটা দেখাল। আর যাবে কোথায়? “মিয়াও” বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল হুলোমশাই শ্রীময়ীর কোলের ওপর, ইলিশ মাছের গন্ধে গন্ধে! কিন্তু দুষ্টু সওদাগর তো মাছটা দেখতে পায়নি, সে একেবারে অবাক! শর্তে হেরে সওদাগর রাজা আর কী করে? শ্রীময়ীর সওদার বদলে নিজের সিংহাসন ছেড়েই দিলে। যেমন তাঁর প্যাঁচালো বুদ্ধি, কেবল লোকঠকানোর কায়দা, তেমনি তার শাস্তি হল।
শ্রীময়ী রাজসিংহাসনে বসে সওদাগরকে ডেকে পাঠাল বললে, “দ্যাখো, তোমার সিংহাসন আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তিনটে শর্ত আছে। এক নম্বর, আমাকে তুমি প্রতি বছর খাজনা দেবে, দু’নম্বর, আমাকে এক্ষুনি একহাজার অশ্বারোহী সৈন্য উপহার দিতে হবে। আর তিন নম্বর, আমি চলে যাবার দু’দিন পরে তুমি রাজকুমার বৃষস্কন্ধকে উদ্ধার করবে, তার সমস্ত সওদা তাকে ফেরৎ দেবে এবং এতদিন তাকে কষ্ট দিয়েছ বলে ঠিক দশ গুণ বেশি সওদা তার সঙ্গে দিয়ে রাজকুমারকে তার নিজের রাজ্যে পাঠিয়ে দেবে লোকজন সমেত। দেখো, এর যেন নড়চড় হয় না। তাহ’লে—শ্রীময়ীর ইঙ্গিতে তার একহাজার সৈন্য এক নিমেষেই খাপ থেকে একহাজার ঝকঝকে ইস্পাতের তরোয়াল বের করলে —ঝনাৎ করে ভয়ঙ্কর এক শব্দ হলো, আর রাজসভায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল অত ইস্পাতের ওপর এমন আলো ঝলসে উঠলো একসঙ্গে। সওদাগর ভয় পেয়ে বললেন, “দেব দেব নিশ্চয় দেব। সব শর্ত মানলুম। নড়চড় হবে না।”
শ্রীময়ী তখন নিজের রাজ্যে ফিরে গেল সৈন্যসামন্ত নিয়ে। এক হাজার নতুন অশ্বারোহী সৈন্য ঘোড়ার ক্ষুরে ধুলো উড়িয়ে চলল তাদের সঙ্গে।
এদিকে বৃষস্কন্ধ তো অবাক। সে এসব কিছুই জানে না। হঠাৎ সওদাগরের হল কী? এত উদারতা কেন রে বাবা? তবু যাই হোক মুক্তি পেয়ে সে কেবল খুশিই হল না, এত সওদা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরে তার খুব গর্বও হল। বাড়িতে গিয়ে স্নান করে খেয়েই সে শ্রীময়ীকে বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিলে। বললে —“কী? খুব যে তোমার শুক-সারি বলেছিল বৃদ্ধদ্ধ কিছুই করতে পারে না? এইবার? এত ধনদৌলত কে এনেছে?”
শ্রীময়ী একটু হেসে ও-ঘর থেকে ছেঁড়া সেই কৌপীনটা নিয়ে এল।—“ধন দৌলত সব কে এনেছে? এই কৌপীনটা, এটা চিনতে পারো?” বলে বৃষস্কন্ধের হাতে দিলে। শ্রীময়ীর কাছে নিজের কৌপীন দেখে বৃষস্কন্ধের যেমন লজ্জা, সে তেমনি অবাক। এ কি ম্যাজিক নাকি? তবে তো বউ সবই জানে? এ মা! সে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললে।
তখন শ্রীময়ী তাকে বললে—“দ্যাখো রাজকুমার, অতিকষ্টে তোমাকে উদ্ধার করেছি। ফের যদি কোন মানুষের গায়ে হাত তুলেছ তবে আমার দু’হাজার সৈন্যসামন্ত তোমাকে ফের নির্বাসনে দিয়ে আসবে। তোমাকে আমিই কিনে এনেছি সওদাগরের কাছ থেকে। এখন থেকে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে চল, তবেই রাজপ্রাসাদে থাকতে পারে। তোমার বাবাও আমার সঙ্গে একমত।”
বৃষস্কন্ধ তো লজ্জায় অধোবদন হয়েই ছিল। সে এবার হাত জোড় করে বললে—“শ্রীময়ী, তোমার গুণপনার অবধি নেই। আমাকে মাপ করো। আমি যখন তোমার ক্রীতদাস, তখন আমি কোন মুখে অন্যের গায়ে হাত তুলব? কেবল তুমি কৌপীনের কথাটা যেন উকে বোলো না।”
সেই থেকে রাজকুমার বৃষস্কন্ধ খুব ভাল ছেলে হয়ে গেছে। প্রতিদিন ক্ষেতে গিয়ে চাষবাস করে। দেশে এখন প্রচুর ধান, প্রচুর ধন, প্রজাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য আর ধরে না। সকলেই শ্রীময়ী যুবরানির সুবুদ্ধিকে ধন্য ধন্য করে। রাজামশাইং নিশ্চিত। শ্রীময়ীকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী করে নিলেন। বষস্কন্ধও তাতে খুশি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন