নবীনগড় রাজ্যে হুলুস্থুল কাণ্ড। ছোট রাজকুমার নিখোঁজ। শুধু রাজা বা রানিমা নয় সারা রাজ্যের মানুষের কাছে প্রিয় কদমকুমার। এইতো সেদিন কুমারের জন্মদিনে রাজ্য জুড়ে উৎসব চলল, সে কি ঘটা—ভুরীভোজ, আলোর রোশ নাই, গান বাজনা আর সকল প্রজাকে কত উপহার দিলেন রাজামশাই। ছোট্ট কদমকুমার রানিমার কোলে চুপটি করে বসে। নবীনগড়ের রাজা বিক্রমের এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ের নাম রূপকুমারী। শুধু নামে নয় রূপকুমারীর রূপের কদর সারা পৃথিবীতে। দুই ছেলে মেয়ে রাজার চোখের মনি। হঠাৎই এই সুখের রাজ্যে অস্থিরতা শুরু। রাজকুমারের নিখোঁজের খবরে রানিমা কেঁদেই আকুল। রূপকুমারীর মুখ ভার। আর রাজামশাই বিক্রমের মুখ রাগে লাল। মন্ত্রীদের নিয়ে জরুরী আলোচনায় বসেছেন—ঝরোখা দিয়ে উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে রাজকুমারী রূপকুমারী। মন্ত্রীদের পরামর্শে রাজা সেরা গুপ্তচর মেঘদীপকে ডেকে নির্দেশ দিলেন—সন্ধান আনো কদমকুমারের।
.
মেঘদীপ যে সে চর নয়, অদ্ভুত তার ক্ষমতা। চোখের নিমেষে মেঘের পিছে চড়ে ঘুরে আসতে পারে সাত সমুদ্র তের নদী। রাজার নির্দেশে মাথা নেড়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে গেল মেঘদীপ। সবাই উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগল। সূর্যঘড়ীর ছায়া কাঁটা একঘর এগোতে না এগোতেই ঘেমে নেয়ে হাজির মেঘদীপ। রাজা বললেন-কি খবর?
মেঘদীপ বলে—ব্যাপার সাংঘাতিক রাজামশাই। তেপান্তরের মাঠের পশ্চিমদিকে সুপ্ত নদীর তীরে মাটির তলায় পাতালপুরে বন্দী আছেন রাজকুমার।
গম্ভীর স্বরে রাজা বিক্রম বলেন–বন্দী আছে কদমকুমার? কার এত সাহস তাকে বন্দী করেছে? আর কেনইবা বন্দী করেছে?
চর বলে—পাতালপুরের দানো রাজপুত্র হীনদেব আমাদের রাজকুমারকে তুলে নিয়ে গেছে স্বর্ণগোলাপের বাগান থেকে। তাদের দাবী রাজকুমারী রূপকুমারীর সঙ্গে হীনদেবের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে তবেই ছাড়া পাবে কমকুমার।
রাগে রাজা থর থর করে কাঁপতে থাকেন, গর্জে ওঠেন–সেনাপতি, সৈন্য সাজাও!
চর মেঘদীপ বলে—মহারাজ, দানো রাজপুত্র হীনদেব মাত্র দুই দিনের সময় দিয়েছে। তার মধ্যে রূপকুমারীকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলে অনেক সময় লাগবে তাতে কুমারের ক্ষতির আশঙ্কা।
রাজা মশাই মন্ত্রীদের দিকে তাকালেন। এমন সময় আকাশবাণী শোনা গেল—মাননীয় রাজা মশাই, আমি দানো রাজ বলছি, আপনার পুত্র কদমকুমার আমার কাছে পণবন্দী। রাজকুমারী রূপকুমারীর বিনিময়ে কদমকুমার মুক্তি পাবে। রূপকুমারীকে আমাদের রাজপুত্র হীনদেব বিবাহে আগ্রহী সুতরাং আশাকরি আপনি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হবেন, অন্যথা হলে কদমকুমারের ক্ষতি হবে।
আকাশ বাণী মিলিয়ে যেতে রাজা বিক্রম গর্জে উঠলেন—কখনোই নয়! সারা পৃথিবীর জঘন্যতম রাজ্য হ’ল ওই পাতালপুরের দানো রাজ্য আর রাজকুমার হীনদেবের বদনাম জগৎময়। সুতরাং ওদের হাতে আমার আদরের মেয়েকে কিছুতেই তুলে দেব না। আপনারা উপায় খুঁজে বার করুন, যাতে কদমকুমারকে অক্ষত উদ্ধার করা যায়।
দেওয়ানী আম লোকে লোকারণ্য। সেখানে সাধারণ মানুষের ভীড়। তারা যেমন কিছু ভেবে পায় না তেমনি দেওয়ানী খাসের মন্ত্রী বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও ভেবে কুল কিনারা পায় না কি করা উচিত। এমন সময় দেওয়ানীআমের ভীড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে এলো তরুণ যাদুকর বীরমাণিক্য।
যাদুকর বলল—মহারাজ অভয় দেনতো বলি একটা উপায়।
রাজা বলেন—বলহে যুবক।
—মহারাজ আপনি দানোরাজের কাছে আকাশবাণী প্রেরণ করুন—যে রাজকুমারীকে ওদের হাতে সমর্পণ করবেন কিন্তু সাথে সাথে কদমকুমারকে আমাদের কাছে প্রত্যার্পণ করতে হবে। আর সমর্পণের চার দিবস পর্যন্ত ওরা কেউ রাজকুমারীকে স্পর্শ করতে পারবে না।
ক্রুদ্ধ মহারাজ বলেন—চুপ্ করো যুবক। কোন মতেই রাজকুমারীকে সমর্পণ করব না।
যুবক বীরমাণিক্য বলে—ধৈর্য ধরুন মহারাজ। আমার সব কথা শুনুন।.
রাজা বলেন-বেশ বল।
বীরমাণিক্য বলে—মহারাজ আমি একজন যাদুকর। যাদু শাস্ত্রের কঠিন বিষয় প্রক্ষেপণ বিদ্যা আমার আয়ত্বে। আমি যাদু প্রয়োগ করে রাজকুমারীর অবিকল প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে তা পাঠাব পাতালপুরে। না ছুঁয়ে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। প্রতিবিম্ব প্রেরণের সাথে সাথে আকাশ যানে ঝটিকা বাহিনী প্রেরণ করুন। ওরা প্রতিবিম্ব রাজকুমারী পেয়ে কুমার কদমকে মুক্তি দিলেই ঝটিকা বাহিনী আক্রমণ করবে পাতালপুর।
প্রস্তাব মনে ধরল সবার। রাজা বিক্রমও সায় দিলেন। যাদুকর বীরমাণিক্য রূপকুমারীর প্রতিবিম্ব তৈরী করল। রাজা, রানী এমনকি রূপকুমারী স্বয়ং অবাক সেই প্রতিবিম্ব দেখে। উড়ান রথে চেপে বসল সেই নকল রাজকুমারী রূপকুমারী। চর মেঘদীপ উড়ান রথ নিয়ে গেল পাতালপুরে।
রাজকুমারী রূপকুমারীকে দেখে পাতালপুর রাজপুত্র আনন্দে আত্মহারা। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি দিল কদমকুমারকে। পাতাল রাজ্যে উৎসবের ছুটি ঘোষণা হল। সবাই আনন্দ করতে লাগল, পাতালপুর সৈন্য বাহিনী ছুটির আনন্দে মাদক খেয়ে নাচানাচি শুরু করল, ঠিক সেই সময় আকাশ যান থেকে নবীনগড়ের বীর ঝটিকা সেনারা আক্রমণ করল পাতালপুর। মুহূর্তে পতন ঘটল পাতালপুরের।
এদিকে কৌশলে কদমকুমারকে মুক্ত করার জন্য যাদুকর বীরমাণিক্যের ধন্য ধন্য পড়ে গেল সারা নবীনগড়ে। রাজা ঘোষণা করলেন—এই ঘোর বিপদের হাত থেকে রক্ষাকারী যুবক বীরমাণিক্যের সাথে রাজকুমারী রূপকুমারীর বিবাহ স্থির করলাম আর জয় করা পাতালপুরের শাসক নিযুক্ত করলাম।
লজ্জায় রাঙা রূপকুমারী ঝরোখা ছেড়ে হাসি লুকিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের মহলের দিকে চলে গেল। ছোট্ট কদমকুমার রানীমার কোলে বসে পিট্ পিট্ করে দেখছে সব।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন