নতুন দিনের আলো – মনোজকান্তি ঘোষ

অনেক নদ-নদী পাহাড় মরু পেরিয়ে কমল এসে পৌঁছাল একটা রুক্ষদেশে। এমন রুক্ষদেশ আগে কোনদিন দেখেনি সে। বৃক্ষ আছে। ফুল নেই। ফল নেই পাতা নেই। নেই পাখির কোলাহল। মানুষের মুখে হাসি নেই। আছে শুধু দিগন্ত জুড়ে চরম নিস্তব্ধতা। উষ্ণ বাতাস আর রুক্ষতা।

এক বুক কৌতূহল নিয়ে পক্ষিরাজ ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লো কমল। পাথরের মূর্তির মত সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে এক গুচ্ছ শীর্ণকায় মানুষ। নগ্ন পা। রুক্ষ চুল। মলিন মুখ। ওদের উদভ্রান্ত চোখের চাহনিতে দুখের সমুদ্র

কমল সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো কাছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বললো, তোমরা কারা? তোমাদের দেশ এত রুক্ষ কেন ভাই?

ভয়ে তরাসে লোকগুলি পিছিয়ে গেলো কয়েক পা সংশয় বুকে। কমল চোখ তুলে তাকাল লোকগুলির মুখের দিকে। অভয় দিয়ে বললো, আমাকে ভয় পেওনা ভাই। আমি তোমাদের বন্ধু। আমার নাম কমল।

আতঙ্কের কালো ছায়া ফুটে উঠলো ওদের চোখে মুখে। ওরা এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা সুরে বললো, আমরা এ দেশের প্রজা।

এ এদেশের নাম কি?

পাষাণপুরী।

তোমাদের জল ভরা চোখে ভীরুর চাহনি কেন? তোমরা কি দুখী?

হ্যাঁ, আমরা দুখী। আমাদের সুখী মন থেকে সব সুখ কেড়ে নিয়েছেন দেশের রাজা। কেড়ে নিয়েছেন, এ দেশে থেকে ঋতুরাজ বসন্ত আর বর্ষা। তাই এ দেশ এত রুক্ষ।

তোমাদের রাজা থাকেন কোথায়?

আনন্দপুরীতে। সেখানে দুখী প্রজার প্রবেশ নিষেধ।

এ অন্যায় রাজকার্যে বাধা দাওনি কোনদিন?

সাহস পায়নি। বিন্দুমাত্র বাধাদানে রাজসৈন্যের ক্ষুরধার তরবারি ঝলসে ওঠে। মৃত্যুর চুম্বন এঁকে দেয় প্রতিবাদীর শিরে।

বিরক্তিতে কুঁচকে গেলো কমলের যুগল ভুরু। ও জানে ভীরুদের মনে ভয় একটা বেয়াড়া ব্যাধি। পরগাছার মত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে ভীরুর ভীতু মন। তাই সহানুভূতির সুরে বললো, দুঃখদগ্ধ তোমরা। দুখের দাবানল জ্বলছে তোমাদের বুকে। তাকে আর বাড়তে দিওনা বন্ধু। এগিয়ে যাও। বাধা দাও অন্যায় রাজকার্যে।

হঠাৎ ঘোড়ার খুরের টগবগ শব্দে শিউরে উঠলো পাষাণপুরীর প্রজারা। ওরা কম্পিত কণ্ঠে বললো, তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও সাহসী বন্ধু। ওই দেখ ঝড়ের গতিতে ছুটে আসছে রাজসৈন্য। ওদের হাতে উন্মুক্ত কৃপাণ। ওরা আসছে আমাদের মন থেকে আরও কিছু সুখ কেড়ে নিতে। কুঞ্চিত ভুরু কমলের। অবাক সুরে বললো, তোমরা গৃহহারা, ছন্দহারা দুঃখী মানুষ। সুখ তোমাদের মনে ছিটে ফোটাও নেই। কি নেবে রাজসৈন্য?

আর্তনাদ করে প্রজারা বললো, আছে আছে। কিছু মাত্র সুখ এখনও অবশিষ্ট আছে আমাদের সুখের থলিতে। আমরা এখনও আমাদের জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছি। ওই টুকু সুখই এখন আমাদের মনে অবশিষ্ট।

ভীরু প্রকৃতির লোকগুলির জন্য ভীষণ করুণা হলো কমলের। ওদের দুর্বল মনে সাহস বাড়িয়ে তুলতে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বললো, ভীরুর খোলসের মধ্যে নিজেদের আর লুকিয়ে রেখনা বন্ধু। ওতে বাড়ে দুঃখ যন্ত্রণা। বুক ভরা সাহস নিয়ে বেরিয়ে এসো বাইরে। প্রতিবাদ কর প্রতিপক্ষের নিন্দনীয় কাজে। কিছুতেই লুটে নিতে দিওনা তোমাদের মনের শেষ সুখ।

ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো প্রজাদের বুক। ওরা কাতর কণ্ঠে বললো, আমরা দুর্বল। আমরা নিরস্ত্র। আমার হারিয়েছি মনের শক্তি। প্রতিবাদের সাহস।

ওদের হাবভাবে বিরক্ত কমল। তিরস্কারের সুরে বললো, ভীরুতায় বাঁচার মন্ত্র নেই। আছে মৃত্যুর ইঙ্গিত। রুখে দাঁড়াও একসাথে। তোমাদের মিলিত শক্তির জোয়ারে খড়-কুটোর মতো ভেসে যাবে দুষ্টুরাজার সৈন্য। তোমরা কিছুতেই নিতে দিওনা তোমাদের মনে শেষ সুখ। আমি আছি ভয় পেওনা বন্ধু। মনে রেখ মনের শক্তিই সুখের উৎস। শক্তিহীন মানুষ জীবস্মৃত। ওই দেখ এসে গেছে রাজসৈন্য। আমি আপাততঃ এই বৃক্ষের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। প্রয়োজনে বেরিয়ে আসবো।

কমল লুকিয়ে পড়তেই রাঙামাটির ধুলো উড়িয়ে সপ্ত ঘোড়ার রথ এসে থামলো। বীরদর্পে বেরিয়ে এলো গুটিক রাজ সৈন্য। হাতে ওদের ধারালো কৃপাণ। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। মুখে অহংকারের হাসি। চোখে হিংস্র চাহনি।

ধূর্ত যমদূতের মত সম্মুখে দাঁড়িয়ে রাজসৈন্য। অজানা আশঙ্কা। থরথর করে কেঁপে উঠলো প্রজাদের বুক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ বাধা দিতে সাহস পায় না। ওরা ভয়ে নতজানু হয়ে বললো, আমরা রাজ অনুগত প্রজা। রাজার সেবায় সঁপে দিয়েছি নিজেদের। নিঃস্ব আমরা তবু আজ্ঞা করুন রাজ প্রতিনিধি।

আহ্লাদে হাঃ হাঃ শব্দে হেসে উঠলো রাক্ষুসে রাজসৈন্য। খুশিতে খুশির দু’চোখ নাচিয়ে বললো, শোন, পাষাণপুরীর রাজভক্ত প্রজাবৃন্দ। আমরা এসেছি তোমাদের পায়ের তলা থেকে মাটি তুলে নিতে। আদুরে রাজকুমারীর আবদারে মহারাজ অন্দর মহলে একটি ফুলের বাগান করতে আগ্রহী। তোমরা তো জান, রাজকুমারী রাজার নয়নের মণি, প্রাণ থেকেও প্রিয়। তার সুখের জন্য কোন কিছুই করতে দ্বিধা করেন না মহারাজ। ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রজারা বললো, তবে আমরা দাঁড়াবো কোথায়? বিরক্তিতে বিকৃত হয়ে গেলো রাজসৈন্যর মুখ। ধমকের সুরে বললো, নিরেট পাথরের উপর। আর্তনাদ করে প্রজারা বললো, ওখানে যেমন গরম তেমন শীত। নির্ঘাত আমরা মরে যাবো।

প্রজাদের দূরদর্শিতায় নিষ্ঠুর রাজসৈন্য ক্ষুব্ধ। হুংকার দিয়ে বললো, তোরা কি ভুলে গেছিস রাজমন্ত্র। রাজার ইচ্ছে, প্রজার ইচ্ছে। রাজার সুখ, প্রজার সুখ। যে প্রজা রাজকার্যে বাধা দেবে মৃত্যু হবে তার উপযুক্ত শাস্তি।

নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলো না কমল। গাছের আড়াল থেকে উগ্রসুরে বললো, সত্যমন্ত্র শোন দুষ্টুরাজার সৈন্য; প্রজার সুখ রাজার সুখ। প্রজার আনন্দ, রাজার আনন্দ। প্রজার ঐশ্বর্য, রাজার ঐশ্বর্য। যে দেশে প্রজার মনে অফুরন্ত শান্তি, সে দেশে রাজার মনে অশান্তির আগুন স্পর্শ করে না। কিন্তু যে রাজা প্রজার সুখ চায় না। প্রজারাও সে রাজার সুখ চায় না।

হিংস্র হয়ে উঠলো রাক্ষুসে রাজসৈন্য। হাতের ক্ষুরধার কৃপাণ ঝলসে উঠলো শূন্য আকাশে। ওরা ক্রুদ্ধ আক্রোশে ছুটে গেলো নিরস্ত্র প্রজাদের দিকে।

সঙ্কট মুহূর্ত। নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না কমল। বীরদর্পে বেরিয়ে এলো বাইরে। প্রজাদের আড়াল করে দাঁড়াল। তার হাতেও উন্মুক্ত তরবারি! আগুন ঝরা দু’চোখ নাচিয়ে বললো, খবরদার! শান্তিপ্রিয় প্রজা-অঙ্গ স্পর্শ কোর না দুষ্টু রাজার সৈন্য। প্রাণ নিয়ে ফিরে যাও। আমরা যুদ্ধ চাই না। শান্তি চাই। শান্তি চাই দেশে। শান্তি চাই প্রজাদের মনে।

কমলের হাতে অস্ত্র দেখে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো রাজসৈন্য। এতোদিন গায়ে ফুরফুরে হাওয়া খেয়ে ঘুরছে ওরা যুদ্ধ করতে হয়নি কখনও। শুধু ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করেছে ওরা। ট্যা-ফুঁ কেউ কোনদিন করেনি। নীরবে পেতে দিয়েছে গর্দান। কিন্তু আজ প্রতিপক্ষের হাতে অস্ত্র দেখে ওরা যুদ্ধ ভয়ে ভীত হয়ে পড়লো। তবু মান বাঁচাতে ধমকের সুরে বললো, শোন দুষ্টু প্রজা। রাজ আজ্ঞা পালন করা প্রত্যেক প্রজার কর্তব্য। বিরোধিতায় নিশ্চিত মৃত্যু। অস্ত্র ফেলে দাও। নীরবে পালন কর রাজ আজ্ঞা।

উত্তেজিত কমল। বজ্রের মতো গর্জন করে বললো, পায়ের তলা থেকে মাটি ওরা কিছুতেই কেড়ে নিতে দেবে না।

ক্রোধ যত ভীতি ততোধিক মনে। তবু নীরব থাকতে পারলো না রাজসৈন্য। স্বভাবগত ভঙ্গিমায় হুংকার দিয়ে বললো, রাজার বিরুদ্ধাচারণ। তোর এতবড় স্পর্ধা! কে তুই? মৃত্যুকে কি তোর ভয় নেই?

ভয় আর ক্রোধে বিবর্ণ হয়ে গেছে রাজসৈন্যের মুখ। কমল ঘৃণার চোখে তাকাল ওদের দিকে। বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দু’পা এগিয়ে গেলো কাছে। দৃপ্ত কণ্ঠে বললো, আমি মুক্তির প্রতীক। আমার নাম কমল। এদের ভাই। তোদের যম। বলে অযোগ্য রাজসৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো অতর্কিতে। শুরু হলো লড়াই। তরবারির ঝনঝনানি শব্দে কেঁপে উঠলো সারা পাষাণপুরী। ক্ষিপ্র গতি কমলের। ততোধিক ক্ষিপ্ৰ হাতে আঘাত হানছে বার বার। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে চূর্ণ হয়ে গেলো অপদার্থ রাজসৈন্যের বুক ভরা দম্ভ। তারা স্বীকার করে নিলো নিজেদের পরাজয়। স্বীকার করে নিলো কমলের বশ্যতা।

পরাজিত রাজসৈন্যের হাত থেকে অস্ত্র ঘোড়া কেড়ে নিলো কমল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাল প্রজাদের দিকে। গুটি গুটি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল কাছে। চোখে চোখ রেখে বললো, এই নাও। তোমরা কিছুতেই লুটে নিতে দিওনা তোমাদের মনের শেষ সুখ। মনে রেখ বন্ধু মনের সাহস আর বুদ্ধি, মানুষের শক্তির উৎস।

এতক্ষণে পাষাণপুরীর প্রজারা রুদ্ধশ্বাসে দেখছিলো দু’পক্ষের লড়াই। অস্ত্র আর ঘোড়া হাতে পেয়ে শরীরের শক্তি বেড়ে গেলো দ্বিগুণ। শূন্য আকাশে উন্মুক্ত তরবারি বার কয়েক বনবন করে ঘুরিয়ে চিৎকার করে বললো, আমরা পেয়েছি, আমরা পেয়েছি বাঁচার মন্ত্র। আমরা বাঁচতে চাই। আমরা বাঁচতে চাই।

কমল খুশি। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পক্ষিরাজ ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়লো লাফিয়ে। প্রজাদের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললো, রাত্রি শেষ। ওই দেখ আকাশে প্রভাতের সূর্য চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে নতুন দিনের আলো। বিদায় বন্ধু। বিদায়।

সকল অধ্যায়

১. নিখুঁত মানুষ – লালবিহারী দে
২. রানি কঙ্কাবতী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
৩. বানর রাজপুত্র – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
৪. ছোট চোর ও বড় – যোগীন্দ্রনাথ সরকার
৫. ভুতো আর ঘোঁতো – সুখলতা রাও
৬. চুনির জন্ম – ত্রিভঙ্গ রায়
৭. ভোঁদড় বাহাদুর – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৮. সন্দেশের দেশে – মণীন্দ্রলাল বসু
৯. মনোবীণা – নরেন্দ্র দেব
১০. দুধ পাহাড় দধিসায়র – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১১. অস্তপাহাড়ে মানুষের মেয়ে – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
১২. মায়া আয়না – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
১৩. সেলাইবুড়ি ও আশ্চর্য ছুঁচ – শৈল চক্রবর্তী
১৪. বন্দিনী রাজকন্যার গল্প – রাধারানী দেবী
১৫. রামধনুকের রাজপুত্তুর – স্বপনবুড়ো
১৬. রাজশ্রী – ইন্দিরা দেবী
১৭. কাঠকন্যা – মৌমাছি
১৮. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
১৯. নতুন দিনের আলো – মনোজকান্তি ঘোষ
২০. আশ্চর্য আমগাছ – প্রণবকুমার পাল
২১. কী ভালো মেঘ – উত্থানপদ বিজলী
২২. যাদুশ্রেষ্ঠ বীরমাণিক্য – অমিতাভ রায়
২৩. সোনার চাঁপা ফুল – পুণ্ডরীক চক্রবর্তী
২৪. রাজকুমার বৃষস্কন্ধ আর শ্রীময়ী – নবনীতা দেবসেন
২৫. একটা আইসকীরিম একটা কাঠবেড়ালীর গল্প – কার্তিক ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন