মূল গল্প: Soursop
এক মৃত মানুষের স্মৃতিকোষের ফেলে যাওয়া, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া খাবারের রসাস্বাদন করে হয়তো কিছুক্ষণের জন্য এই নশ্বর অস্তিত্বের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ভুলে থাকা যায়, কিন্তু সেইসঙ্গে নিজের অস্তিত্বকেও ভুলে যেতে হয়। আমি সেটাই করছিলাম, সেকেন্ডগুলোকে বিনোদনের নিক্তিতে মেপে। এরিস টু-তে এখন ‘কিচেন বাটারফ্লাই’ সম্প্রচারের সময়।
 কিন্তু সেই সব-পেয়েছি-র দেশের সম্প্রচার দেখার একমাত্র উপায় নিজস্ব স্ক্রিন আর সঠিকভাবে চিহ্নিত করা ক্লিকারের উপস্থিতি। নাহলে ন্যানোবট মেশানো মেঘের গায়ে সেই সম্প্রচার মিশে তৈরি করে রঙিন শামিয়ানা, ওজোন স্তরের গায়ে ঝুলে থাকা এক চলমান প্রচ্ছদ আমাদের ধূসর, মৃত আকাশের বুকে। 
এখনও তিন মাস বাকি রাত্রি শেষ হতে, এখনো তিন মাস বাকি অন্ধকারের সমাপ্তির। এখনো তিন মাস মস্তিস্ককে সজাগ রাখতে হবে। এই বাধ্যতামূলক সম্প্রচারগুলি সেই কাজেই নিরত, আমাদের পাগল হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে, যতদিন না সূর্যের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে তার মিঠে ওম। মেঘের গায়ে ভেসে থাকা চলচ্চিত্র এই রাত্রির আকাশে যেন ঈশ্বরের আঁকা কোনো অসমাপ্ত ক্যানভাস হয়ে ওঠে। বাতাসে গুজব ছড়ায় যে এরিস ওয়ানে এই ছবিরা নাকি জ্যান্ত, স্পর্শ করা যায় তাদের চলমান ত্রিমাত্রিক আবয়বদের। শুনেছি এরিস টুতে নাকি ব্যক্তিগত সম্প্রচারের সুবিধাও পাওয়া যায়। নিজের রান্নাবান্না, ঘরগেরস্থালীর ভিডিও লাইভ দেখতেও দিতে পারা যায় তাদের, যারা এইসব দেখার জন্য মুখিয়ে আছে।
কিন্তু এরিস ওয়ান আর টু নতুন গ্রহ, সেখানে মানুষের পা বেশিদিন পড়েনি। গ্রহগুলো নাকি সাজানো গোছানো বাগানের মত। শুনে আমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে নামে লোভ মাখা নাল। আমার জন্ম এখানে, এই প্রাণপ্রদীপ নিভতে থাকা গ্রহের মাটিতে। হয়তো আমার কঙ্কাল পোঁতা হবে এই গ্রহেরই পাথরের মাঝে। এই গ্রহ আমার ঘর, আমার আর মানুষের পৃথিবী।
  
হ্যাঁ, তুমি হলোগ্রাফিক চিঠিকে করতেই পারো নিজের সম্প্রচারের মাধ্যম, কিন্তু তাতে রান্নার নির্দেশ বাদে আর কিছুই রাখা সম্ভব হয় না। আর সেই রান্নার নির্দেশাবলী রাখাই থাকে এরিস টু-এর এই ভিডিওগুলোর মধ্যে। তুমি কীভাবে টক্কর দেবে তাদের সঙ্গে? তোমার না আছে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ সম্প্রচার করার যন্ত্রপাতি, না আছে মাধ্যম। তোমার আছে শুধু অস্পষ্ট, ধূসর, মৃতবৎ ছবির অধিকার।
রঙিন বিনোদন কি কাজে লাগবে আমাদের? সে কি ভুলিয়ে দিতে পেরেছে রুক্ষ বাস্তবের কথাচিত্রকে? একদা শস্যশ্যামলা বসুন্ধরায় আজ আর শস্য ফলে না। অতিলোভী লোকান্তরগামি মানুষের দল তাদের মহাশূন্যে ভাসমান ধাতুর চাদরে মোড়া কৃত্রিম দ্বীপদের জন্য সব মাটি তুলে নিয়ে গেছে। অতিপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ক্যাপস্যুলগুলো সপ্তাহে দুই এক বার আকাশ থেকে খসে পড়ে দয়ার অবতার হয়ে। কাজ আর ভালো আচারব্যবহারের নিক্তিতে তাদের কিছু অংশকে ভাগ করা হয়, বাকিটা চলে যায় চোরাবাজারের ঝনঝনানির ভিড়ে হারিয়ে যেতে। এ হল জাতিপুঞ্জের দয়া, মানবসভ্যতার শেষ পার্থিব প্রতিনিধিদের জন্য।
আজকে কিচেন বাটারফ্লাইতে দেখাচ্ছিল কী করে যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) লক্ষ্মণ ফল১ থেকে আচার আর জ্যাম প্রস্তুত করে। এই রান্নাবান্নার প্রোগ্রামের শেষ মানুষ সঞ্চালক বিদায় নিয়েছে প্রায় একশো বছর হয়ে গেল। পর্দায় ফুটে উঠেছে কীভাবে সেই প্রাণহীন, প্রাণবন্ত যন্ত্র সেই খুব চেনা ঝকঝকে রান্নাঘরের একপাশ থেকে আরেকপাশে খেলে বেড়াচ্ছে অবলীলায়, লক্ষ্মণ ফলের কণ্টকিত ত্বক ছাড়িয়ে ফেলছে অনায়াসে, সেই সঙ্গে বীজগুলো জমা করছে একধারে। সেই যন্ত্রের ধাতব কনুই বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে ফলের রস। মজা পেয়ে গেছে যেন এই যন্ত্র, খিলখিল করে হেসে উঠছে অকারণে। এইরকম সম্প্রচারের বাকি সঞ্চালকদের মতো এটারও হাসি কৃত্রিমভাবে বানানো, মাপা, বাইনারি কোডের কাঠামোর উপরে দাঁড়িয়ে, এবং তীক্ষ্ণ। হয়তো কোনো এক আদিম যুগে, যখন মানুষ ‘মানুষ’ হয়ে ওঠেনি, মেয়েরা হয়তো এইভাবেই হাসত। হয়তো সেই হাসি ছিল প্রাণবন্ত, টলটলে, সুর মেশানো। মেয়েদের হাসি কেমন শুনতে, আমি জানি না। সেই স্বর্ণযুগে জন্মানোর সৌভাগ্য হয়নি আমার।
“তৈরি?” অবিওরা২ জিজ্ঞেস করল। 
“হ্যাঁ।” প্রোগ্রামের ওপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই উত্তর দিলাম গালে হাত বুলিয়ে। গালের উপরে তিলটা মাঝে মাঝেই কুটকুট করে ওঠে, যেন মন জানান দিতে চায় কোনো কিছুর অস্তিত্বকে– সময়ের, ইতিহাসের, রক্তের। 
আড়চোখে দেখলাম অবিওরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে তার স্মার্টস্ক্রিন নিয়ে। তার আঙুলগুলোর নির্দেশে একে একে জ্বলে উঠছে সেন্সর প্যাডগুলো। সেই সেন্সর প্যাডের আলো দেয়ালের গায়ে এসে পড়ছে তীব্র নীল-সাদা আলো হয়ে, যেন এক সর্বভুক ঝড় জেগে উঠছে এই ঘরের মধ্যে।
আনুগো, তোমার কথা এখন মনে পড়ছে কেন আমার? তোমায় দেখিনি আজ কত বছর হয়ে গেল। 
আমার ছোটো ভাইটা বড়ো ঝড় ভালোবাসত। কোথাও যেন তার শিশু মন গুলিয়ে ফেলত ভয়ঙ্কর আর সুন্দরের ভিন্ন সংজ্ঞাকে। জমির নীচে আমাদের আশ্রয়স্থল থেকে সে ছিটকে বেরিয়ে আসত ঝড় থামলেই। পায়ে পায়ে পরখ করত বিদ্যুৎপৃষ্ট জমির উপরে জন্মানো নতুন গোলাকার ক্ষতগুলোকে। মাটির সোঁদা গন্ধ অপরিচিত ছিল তার কাছে। মাটিই তো ছিল না পৃথিবীতে আর। যতদিন না জি১৩ আমাদের অর্ধমৃত গ্রহকে মুড়ে দিল কৃত্রিম মাটির মাপা চাদরে, পৃথিবী ছিল এক বন্ধ্যা জগত। এখনও তাই আছে। এই মরুভূমিতে খুদকুঁড়ো খুঁটে খেয়ে আরশোলাদের মতো মাটিতে দাঁত কামড়ে পড়ে আছি আমরা। গুনছি অপেক্ষার প্রহর। মৃত মানুষের দেহ আর মৃত আরশোলার দেহ একই অর্থ বহন করে। এদেরকে যা বা যে মারতে পারে, সে বাকিদেরও অনায়াসে সংহার করতে পারে। বীরত্ব, মনুষ্যত্ব… এসব শব্দের অর্থ ভুলে গেছি আমরা। ভয়ের কিন্তু অনেক রকম প্রতিশব্দ জানি, শিখতে হয়েছে জীবনের তাগিদে।
“দাঁতে দাঁত চিপে বসো।” অবিওরা মন্তব্য করল।
ধাতব সংযোজক লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যথাটা উঠে এল একেবারে দুশমনের মতন, যেন আমার মাথার এফোঁড়ওফোঁড় করে কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে ভোঁতা শলাকা। সেই ব্যথার অনুভূতি তারপর চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমে জমা হল আমার চোয়ালের দু’পাশে, অস্ত্রোপচার করে বসানো বিষের থলির মত। যন্ত্রণার চোটে মনে হল যেন আমার চোয়াল ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে মাথা থেকে, কথা বলার ক্ষমতা প্রায় কেড়ে নিয়েছে এক মুখ.. ভর্তি অবাধ্য নাল।
“এই, এই, দাঁড়াও… ডোজটা বেশি হয়ে গিয়েছে।” আমার পাশে অবিওরার সাপের মত হিলহিলে ধাতব আঙুল কিছুক্ষণ কনসোলটার উপরে খেলে বেরালো। কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করলাম আবার জিভ নাড়াতে পারছি। ব্যথাটা পরাজিত পশুর মতো জমি ছাড়ছে। তার পদচিহ্ন আমার গলায় জমা তেতো স্বাদ।
শুরু থেকেই আমি জানতাম এই প্রক্রিয়া তীব্র যন্ত্রণার। ইন্দ্রিয় নিয়ে খেললে তার মাশুল তো দিতেই হবে, তাই না? কয়েক পাতা বিজ্ঞান পড়া থাকলে হয়তো আরও বিশদ বিবরণী দিতে পারতাম। কিন্তু কষ্টের কেষ্ট কথাটাও তো মিথ্যা না। যন্ত্রণা ছাড়া ফাইলগুলোকে ঘাঁটা অসম্ভব। ফাইলগুলোর মধ্যে জমা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইতিহাস– তার রূপ, রস, স্পর্শ, গন্ধ… না। গন্ধ না। ঘ্রাণেন্দ্রিয়র কাজ ফুরিয়েছে বহু আগে। ২২৯৮ খ্রিস্টাব্দের পরে জন্মানো শিশুরা জানে না গন্ধ কী।
আমাদের কেউ কেউ পালিয়ে গিয়েছিল ভয় পেয়ে, গড়ে তুলেছিল একটা… আহা, এরিস ওয়ানকে ধরে নাহয় দেড়টাই হবে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ওটা ছিল একটা পরীক্ষামূলক প্রকল্প– একটা আস্ত গ্রহ, স্বয়ংসম্পূর্ণ সভ্যতা। কিন্তু আমরা এখনও স্মৃতিফাইলের দুইয়ের অধিক
 ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্যকে গ্রহণ করতে শিখিনি, যেমন শিখিনি শিশুদের কীভাবে আবার গন্ধ চেনাতে হয়।  
তাছাড়া, মানবসভ্যতার উচ্ছিষ্ট যারা, যাদেরকে ফেলে আসা হল পৃথিবীতে, তাদের ভালোমন্দের খবর ইতিহাস কবে রেখেছে? আমি তাই আমার ডাকাবুকো ভাইকে বলতাম বৃষ্টির পর মাটির গন্ধ সোঁদা। বৃষ্টির গন্ধ মরচে ধরা লোহার মত। নিজে ঘ্রাণের সংজ্ঞা জানত না বলে ও তাই বিশ্বাস করত।
স্মৃতি রোমন্থনের মাঝে খেয়াল করলাম আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে। এটা ডাবল ভিশন৪-এর পূর্বলক্ষণ। ফিচারটা আমাদের মত মানুষের কাছে বেশ মহার্ঘ, প্রায় আশি হাজার কুদি দিয়ে কিনতে হয়েছে। হ্যাঁ, আমি ইচ্ছে করলে স্মৃতির ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারতাম, সেটা শুধু অপেক্ষাকৃত কম কষ্টের শুধু না, সস্তাও। কিন্তু অভিজ্ঞতা আমাকে এক চোখ খুলে ঘুমাতে শিখিয়েছে। আমি সজাগ, আমি দেখতে পাচ্ছি অবিওরার ঝাঁপ ফেলা অন্ধকার দোকানে আমার চারপাশকে। আমার ঘেমে ওঠা হাতের মুঠোয় থাকা ..ঠান্ডা বন্দুকটা ..একটা শক্তসমর্থ মানুষকে অজ্ঞান
করতে সক্ষম। 
ফাইল থেকে স্মৃতিটা আমার মস্তিষ্কের চিলেকোঠায় নামলো বাঁধভাঙা নদীর মতো, আগে এতবার দেখা সত্ত্বেও। কিন্তু রান্নার প্রোগ্রামগুলোর মতো বাধ্যতামূলক অত্যাচার এটা নয়। এখানে আমি জানি কখন সঞ্চালক ফলের ছাল ছাড়িয়ে আঙুল থেকে গড়িয়ে নামা রস চেটে খিলখিল করে হেসে উঠবে। বা, রান্নার শেষে একটা ছোট্ট টুকরো মুখে পুরে পরিতৃপ্তির শব্দ করবে। আমি জানি কখন তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তৃপ্তি ধরা দেবে ফাইলের মধ্যে। আমার মধ্যে।
অবিওরাও জানত। তাই, যেই মুহূর্তে সঞ্চালক ঠোঁটে ঠেকালেন তাঁর রসসিক্ত আঙুল, আমার জিভে ছোঁয়া লাগলো এক অর্বাচীন, অসম্ভব স্বাদের, লক্ষ্মণ ফলের নেশা লাগানো টক আর মিঠে স্বাদের। যে মানুষটি আসলে স্বাদ পেয়েছিল লক্ষ্মণ ফলের, সে ছিল এক ভোজনরসিক। তারিয়ে তারিয়ে, জিভের উপরে ফলের টুকরোটাকে খেলিয়ে সে উপভোগ করেছিল প্রত্যেক কামড়ের মজা। অবিওরার কেরামতি কৃতিত্বের দাবি রাখে। নাহলে, যেভাবে আমার জিভের উপরে এক মিথ্যে ফলের রস ছড়িয়ে যাচ্ছিল, যেভাবে প্রত্যেক দাঁতের চাপ বুঝিয়ে দিচ্ছিল পিচ্ছিল ঠান্ডা রস গড়িয়ে পড়ছে আমার জিভের দুইপাশে, যে ফল পৃথিবীর বুকে জন্মায়নি বহু বছর, সেই ফলের জ্যান্ত স্বাদ আমি পেতাম না। ফলটার রস বের করে ছিবড়ে বানিয়ে সেটাকে গিলে ফেলে লোকটা যখন আরেকটা ফলে কামড় বসাল, আমি বুঝতে পারলাম শুধু গন্ধ আর স্বাদই খাবারকে উপভোগ করার জন্য যথেষ্ট না। এই জিভের উপরে ফলের টুকরোটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার অনুভূতি, আজকে অবিওরা না থাকলে জানতে পারতাম? বুঝতে পারতাম আরও কতকিছু আমরা অজান্তেই হারিয়েছি?
না, আমি যে লোকটার অনুভূতি ধার করে নিজের ভোজনবিলাসিতা পরোক্ষভাবে মেটাচ্ছি, সে খেতে জানে। উদর তো না, উদরকন্দর। সেই উদরকে তার মাথা থেকে আলাদা করে রেখেছে একটা বটগাছের গুঁড়ির মতো মোটা গলা। লোকটার পেট প্রায় নিটোল একটা গোলক, মাংস আর চর্বির তৈরি ফুলে ওঠা বেলুনের মত। লোকটা যখন
 লক্ষ্মণ ফলের প্লেটে থাবা বসাল, অনিচ্ছার সঙ্গে তার ভুঁড়িও কেঁপে উঠল। গায়ে যে ফুলহাতা গোলাপি-নীল ডোরাকাটা শার্টটা কেটে বসছে, তার হাতা শেষ হয়েছে দুটি সুদৃশ্য আস্তিনের বোতামে। সেই বোতামের গায়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা ‘জেএমবি’-র অর্থ আমি জানি; অনেকদিন তাদের সঙ্গে থাকার জন্যই। 
আমার স্মৃতি ফাইলের আসল অধিকারী জন মুগাবে বাবাঙ্গিডা৫। নামটা এত বছর পরেও সেই একই অর্থ বহন করে। 
আমি জানতাম খাওয়ার পর জন কী বলবে, এবার না শুনলেও আমি জানি তার মোটা কর্কশ গলা তার চরিত্রের প্রতিবিম্ব মাত্র। যে প্রতিবিম্বর অস্তিত্ব এর পর আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
প্রথমে জন বলবে, “তোর এখানে ঢোকার সাহস হল কী করে? কে তুই?” তারপর, “দূর হয়ে যায় আমার মুখের সামনে থেকে। পেয়াদা, এটাকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে ফেল এখান থেকে।”
জনের শেষ কথায় তার দম্ভ নয়, ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল তার ভয়।
“না, না। ছেড়ে দাও।”
প্রত্যুত্তরে শুধু একটা পিস্তল তিনবার
 বজ্রনির্ঘোষ করেছিল। 
স্মৃতি ফাইল শেষ হওয়ার আগে দেখিয়েছিল লোকটার পেটের উপরের শার্ট ফিনকি দিয়ে বেরোনো রক্তে ভিজে গেছে। তার হাতেও প্রলেপ লেগেছে সেই রক্তের। স্মৃতি ফাইলের এই জায়গায় এসে আমার ভেতরটা একই সঙ্গে বিষাক্ত আর উৎফুল্ল হয়ে ওঠে; মৃত্যুকে এভাবে বারবার দেখেও আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। মৃত্যুর আগে পৃথুল লোকটার দৃষ্টিসীমায় ধরা দেয় অনাহার আর অপুষ্টিতে ভোগা আততায়ীর আবয়ব। তার পরনে সান্ত্রীর পোশাক। এককালে সে হয়তো সুপুরুষ ছিল, কিন্তু দুশ্চিন্তা আর অনাহার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে তার থেকে। তার দুই চোখে ধিকধিক করে জ্বলছে এক সর্বগ্রাসি খিদে। সেই ক্ষুধা কেবল খাদ্যের না, সেই ক্ষুধা সম্মানের, বিচারের। সেই ক্ষুধা সবকিছুর জন্য। মরার আগে লোকটার চোখ আরেকবার গেল তার আততায়ীর দিকে। আততায়ীর বাম গালে বিধাতা বসিয়ে দিয়েছে এক বেমানান তিল।
আমার মুখে এখন লক্ষ্মণ ফলের স্বাদ দখল করেছে এক চেনা লোনা স্বাদ। মরার আগে স্থূলকায় মানুষটা খুব কেঁদেছিল বটে। প্রাণভিক্ষার কান্না।
আমেরিকা বলে একটা দেশ ছিল জানেন? সেখানে আদালতের কাজকর্মের আর্কাইভ করা ফুটেজ যদি দেখেন, একটা জিনিস প্রায় সব সাক্ষীই বলে শপথ নেওয়ার মতো ।করে। “সব এত দ্রুত ঘটে গেল, মানে বলতে পারেন চোখের পলকের মধ্যে, কী হল কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
৪৬ সেকেন্ড৬ সময় আর যাই হোক, চোখের পলক নয়, মৃত্যুর পক্ষেও অনেকটা সময়, প্রাণ নেওয়ার পক্ষেও যথেষ্ট, মৃত্যুকে বোঝার জন্যেও। পিস্তলটা ছিল আমার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের হাতে। ‘ধনতন্ত্রের অবসান হবে শ্রমিকের হাতে’— এই প্রবাদটা তিনি নিজের হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছিলেন। ফলাফল, এক ব্যর্থ বিপ্লব যার অঙ্কুরেই বিনাশ হওয়ার দরকার ছিল। এক ব্যর্থ বিপ্লব যার শেষ ৪৬ সেকেন্ড আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। আমরা তাই মনুষ্যজাতির উচ্ছিষ্ট, এই মৃত পৃথিবীতে থেকে যাওয়ার শাস্তি বয়ে চলেছি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এখানেই আমরা থাকব, থাকতে বাধ্য যতদিন না দুনিয়াটা একেবারে বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, বা আমরা বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছি। এটাই আমাদের ললাটলিখন, আমাদের ভবিষ্যৎ। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া রক্ত আর ধোঁয়ায় লেখা উত্তরাধিকার।
কতটা নির্বোধ হলে একটা লোক খুন করে ভাবে কেউ জানতে পারবে না? যেখানে সমাজের উপরের তলার মানুষগুলো তাদের স্মৃতিগুলোকে নিয়মিত আপলোড করত সুখের মুহূর্তগুলোকে বারবার উপভোগ করার জন্য। কিছু মানুষের শুধু নিজের সময়ই খারাপ হয় শুধু না, বাকিদেরও যাতে ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হয় সেটাও সে নির্ধারণ করে যায়।
তারপর?
আমাদের জেনেটিক মেকআপ এমন কিছু আহামরি ছিল না; না আমাদের মধ্যে কেউ ছিল ডাক্তার, না ইঞ্জিনিয়ার, না ন্যানোটেকে পারদর্শী। বা রাঁধুনি। রাঁধুনিদের চাহিদা খুব এরিস টুতে। ওখানে পার্থিব শাকসবজির চাষ আবার শুরু করা গেছে। এরিস টুতে এখন খুঁজে দেখলে কিছু অজানা গাছও পাওয়া যায়— আবিষ্কারক আর সেনার দল গ্যালাক্সি চষে বেড়িয়ে নিয়ে এসেছে সেগুলো। পার্থিব আর বিজাতীয় শাকসবজি মিশিয়ে রাঁধুনিরা তৈরি করেছে অবিশ্বাস্য স্বাদের সম্ভার, যার প্রত্যেকটা যে কোনো মানুষের জিভ লালায়িত করতে বাধ্য।
কিন্তু আমাদের মধ্যে থেকে অকপারাহ৭  আইয়ের মত মানুষ উঠে আসেনি যে রেশন ব্যবস্থার যুগান্তর এনে মানুষের মন জয় করেছিল, বা সেই সব মানুষের দল যারা এরিস ওয়ানে ঠাঁই পেয়েছে তাদের ভালো স্বভাবের জন্য। আমার জীবদ্দশায় এমন ঘটনা একবারের বেশি না ঘটলেও একবার তো ঘটেছে। মানুষের
 মনে আশার আলো ফুটিয়েছে।
কিন্তু আমরা? আমরা যে উচ্ছিষ্ট! আর উচ্ছিষ্টদের স্থান আস্তাকুঁড়ে। কী করে ভাবতে পারি আমাদের মানুষ বলে এখনও গণ্য করা হয়? কী করে ভাবতে পারি যে আমাদের স্থান হবে এরিস টু বা ওয়ানে? কী করে ভাবি আমাদের অতীত বিস্মৃত হয়েছে? কী করে ভাবতে পারি যে আমাদের বাঁচার অধিকার আছে? আমরা যে রক্তচোষা বুভুক্ষু সর্বগ্রাসী, দাঁত-নখ-বন্দুক আর প্রতিহিংসা-সর্বস্ব মানবরূপী ইঁদুরের দল। যে ইঁদুরেরা রক্তের স্বাদ পেলে আর কিছু চায় না, হাতে পিস্তল উঠে এলে যারা আর কিছু ভাবে না। মানবসভ্যতার এক প্রতিকৃতকে মারতে একবিন্দুও হাত কাঁপে না তাদের। সেই ইঁদুরের স্থান নেই মানুষের বানানো নতুন স্বর্গে। আমরা সেই ইঁদুরের দল, সেই অপরাধীদের বংশধর, সন্ত্রাসবাদে দুষিত পচে যাওয়া রক্ত বইছে আমাদের ধমনি বেয়ে। সব দাগ উঠে যায়, ইতিহাসের পাতায় লাগা রক্তের দাগ ওঠে না।
পৃথিবীর অক্ষীয় গতি কমছে, কমছে আমাদের আয়ুও। এই গ্রহ আমাদের ঘর। আমাদের কবর।
অবিওরা আমায় একটা ছেঁড়া কাপড় ছুঁড়ে দিল চোখের জল মোছার জন্য। ন্যাতাটার প্রত্যেক সুতোয় তেল লেগে, যে তেলের উৎস ঘুণ ধরা মেশিন বা ঘুণ পড়া শরীর। তেলের কালিমা ঢেকে দিল আমার চোখের জলের দাগেদের। অবিওরার হাতে সিরিঞ্জ উঠে আসতে আমি তাকে বারণ করলাম। পেনকিলারের প্রয়োজন নেই আমার।
“বারবার নিজেকে এভাবে কষ্ট দাও কেন? কী পাও এতে তুমি?” সে জিজ্ঞাসা করল।
একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উত্তরটা এল আমার,
 “আমি সত্যিই জানি না।”   
কিচেন বাটারফ্লাই প্রোগ্রামটা এখনও আমার সামনে নীরবে চলছে। কী মাখছে যন্ত্রটা ওই বাটিতে? কেউ হয়তো বিরক্ত হয়ে প্রোগ্রামটার শেষে গিয়ে দেখছে কী রান্না বানিয়েছে যন্ত্রটা! খাবার! জিভে জল আনা খাবার! যে খাবার আমরা খাইনি কোনোদিন। খাবও না কখনও। যন্ত্র সঞ্চালক বাটির মেঘের মত মোলায়েম মাখা খাবারে আঙুল ডোবাল, তারপর জিভে ঠেকাল সেই আঙুল। যে তৃপ্তির শব্দটা বেরিয়ে এল সঞ্চালকের মুখে সেটা পাখি পড়ানো বুলি। তার গায়ের লেপে থাকা ‘বউবউ’ কাপড়টার রঙ রামধনুর মত— মোহময় নীল, উজ্জ্বল হলুদ, তার মাঝে মাঝে খেলে বেড়াচ্ছে সূর্যাস্তের রঙ। সঞ্চালককে দেখতে লাগছে ক্রান্তীয় অঞ্চলের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কীটগুলোর মতো, যাদের বৃষ্টিস্নাত সোনামাখা রঙ এককালে অবাক করত মানুষদের। মানুষ এককালে শান্তি পেত চোখের সামনে নিরবচ্ছিন্ন জলরাশি দেখে, মেঘের চাদরে মোড়া ভেজা সবুজ পাহাড় দেখে, বজ্রপাতের গর্ত বা হাইড্রেশন ক্যাপস্যুল দেখে নয়।
আমরা দেখছি। আমরা দেখতে বাধ্য।
“পরের সপ্তাহে এই সময়েই কি সব ব্যবস্থা করে রাখব, সার্জেন্ট?” অবিওরা গোছাতে গোছাতে জিজ্ঞেস করল। তার হাতের জায়গা দখল করেছে যে টাইটেনিয়াম প্রত্যঙ্গ, তার গায়ের একটা টিউব থেকে টুপ করে খসে পড়ল এক বিন্দু তরল। মেঝের উপরে জন্ম নিল এক বুদবুদ কাটা তেলের দাগ।
আমি আমার তুলোর থেকেও সাদা ধড়াচূড়া পরে নিলাম। এই পোশাক, এই ইউনিফর্ম আমায় মানুষের ভিড়ে চিনিয়ে দেয় আলাদা করে, জঞ্জালের ভিড়ে, সভ্যতার মৃতদেহের মাঝে। আমার ইউনিফর্মের বুকের উপরে দগদগে ক্ষতর মত লাল রঙে লেখা জেএমবি কর্পস্, আর তার নীচে লেখা ‘ণজকু৮ ডিভিশন’। এই পোশাক আমার বুকের উপরে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসল— ইতিহাসের ভার। 
“হাতটা একবার দেখিয়ে নাও পারলে,” আমি অবিওরাকে দেখালাম যেখানে ওর ধাতব হাত থেকে তেল গড়িয়ে নামছে। বলে আর দাঁড়ালাম না; আমার শিফট আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। মুখে আমার কান্নার লোনা স্বাদ, আর লক্ষ্মণ ফলের টকমিঠে স্বাদ মিলেমিশে একাকার। যে স্বাদের আমি কাঙাল। সেই জন্যই তো বারবার ছুটে আসি অবিওরার কাছে, মৃত্যুকে বারবার কাছ থেকে চিনে নিতে।
দোকানের মধ্যে অবিওরা এখন ওর হাত দেখছে আর কত খরচ হবে হিসেব করে গজগজ করছে।         
টীকা
১) লক্ষ্মণ ফল/Soursop– শক্তিবর্ধক এবং সর্বরোগনিবারক গুণে ভরপুর ফল।
২) অবিওরা– মানুষের হিতকামী।
৩)জি১/G1– সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ কর্মীবৃন্দের একটা অংশ যারা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করে মানবজাতির সেবায় নিহিত থেকে।
৪) ডাবল ভিশন/Double Vision– যখন একই সঙ্গে একই জিনিস দুইবার দেখতে হয়। দৃষ্টিবিভ্রম।
৫) বাবাঙ্গিডা– পদবি; ঘরের (মানুষের) কর্তা।
৬) ৪৬– সংখ্যাতত্ব অনুসারে যে সংখ্যা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। যে সংখ্যা একাকি ও স্বার্থপর। যে সংখ্যার অধিকারি তার পরিবারকে সুরক্ষা প্রদান করে।
৭) অকপারাহ– নাইজেরিয়ার ইগবো জনজাতির কাছে এই নামের অর্থ অগ্রজ, বা যে পথ দেখায়।
৮) ণজকু/Njoku– দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় বসবাসকারী ইগবো জনজাতির মানুষদের খাদ্য ইয়ামের (একধরনের রসালো মূল) দেবতা। এই দেবতার পুজোয় নিহিত শিশুদেরও এই নামেই ডাকা হয়, এবং মনে করা হয় প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের মনের অভিলাষ পূর্ণ হয়।
লেখক পরিচিতি
চিকোদিলি এমেলুমাডুর জন্ম নাইজেরিয়ায়। কর্মজীবন লন্ডনে। সমকালীন আফ্রিকান স্পেকুলেটিভ ঘরানায় চিকোদিলি ধূমকেতুর মতো উঠে এসেছেন। অনবদ্য বিষয়বস্তু আর বলিষ্ঠ কলমকে সঙ্গী করে তিনি একের পর এক গল্প উপহার দিচ্ছেন পাঠকদের। ‘Bush Baby, ‘Candy Girl, ‘Soursop’, ‘Tunbi’, ‘Jermyn’… প্রতিটা লেখা যেন একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে চাইছে। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে ইলেক্টিকা, লুনা স্টেশন কোয়াটার্লি, ওমেনানা, ওয়ান থ্রোন,
 সাব-কিউ ম্যাগাজিন সহ অন্যান্য পত্রিকায়, নোমো আর কেইন পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছেন তিনি। তাঁর সাম্প্রতিক কিছু লেখা স্থান পেয়েছে ফক্স স্পিরিট বুক্স্-এর ‘আফ্রিকান মনস্টার’ সঙ্কলনে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘Dazzling’ ২০২৩ সালে ওয়াইল্ডফায়ার বুকস থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে। 
অনুবাদক পরিচিতি
সোহম গুহ সমসাময়িক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের পরিচিত নাম। এই প্রতিশ্রুতিবান তরুণ লেখকের কলম মহাবিশ্ব তৈরির সম্ভাবনা এবং স্বপ্ন নিয়ে একের পর এক অসামান্য গল্প লিখে চলেছে। মাতৃভাষা বাংলা বাদেও ইংরেজিতে গল্প লিখতে তিনি স্বচ্ছন্দ। স্পেকুলেটিভ ফিকশন ঘরানায় লেখা তাঁর গল্পগুলো প্রকাশিত হয়েছে কল্পবিশ্ব, দেশ, কিশোর ভারতী, Mithila Review, The Gollancz Anthology of South Asian Science Fiction and Fantasy Vol II, Meteotopia, এবং Rikha Zine-এ। কল্পবিশ্ব পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত তাঁর গল্প সঙ্কলন ‘আরশিমিডিশ’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন