তৃষ্ণাভূমি – নিক উড। অনুবাদ : রাজর্ষি গুপ্ত

তৃষ্ণাভূমি। লেখক— নিক উড।  অনুবাদ— রাজর্ষি গুপ্ত

মূল গল্প: Thirstlands

একটা কথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এখানেও বর্ষা দূর অস্ত্। বাঁদিকে খাড়া উঠে যাওয়া উঁচু পাহাড়ের পাথুরে গায়ে চোখ চালালাম। কোথায় সেই খাদের মাথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া পাঁচ বছর আগে দেখা বিপুল, অনন্ত জলরাশি? এখন তার জায়গায় খাদের মাথা থেকে আমার পায়ের শ’খানেক মিটার নীচে প্রায় মজতে-বসা শ্যাওলাসবুজ নদীটার খাত পর্যন্ত জলের একটা সরু ঝিরঝিরে পাতলা পর্দা কেবল দুর্বল ভাবে দুলছে। সেই হুহু-বেগে ছুটে আসা জল অনন্ত শূন্য থেকে আছড়ে পড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া জলকণার বৃষ্টি, সেই জলপ্রপাতের উপর আকাশ জুড়ে ছেয়ে থাকা হাতির মতো কালো মেঘ—ও সব এখন সুদূর অতীত। ও-ই দূরে নীচে বাটোকো গিরিখাতের মধ্যে গাছপালার আড়ালে কোনোরকমে নিজের দেহকে টেনে নিয়ে চলেছে নদীটা। বুড়ি রানি ভিক তো কবেই মরে ফৌত হয়েছেন, আর এখানে এই জাম্বিয়ায় তাঁর নামতুতো বোন তাঁরই মতো নামকরা এই জলপ্রপাতও ধুঁকছে। আগেকার সেই ‘মোসি-ওয়া-তুনিয়া’—মানে ‘গর্জনশীল ধোঁয়া’ আর নেই।

অনিচ্ছার গলায় ‘রেকর্ড’ বলে ডান চোখটা টিপতেই আমার নার্ভে বসানো নিউরাল ক্যামেরা চালু হয়ে গেল।

দু প্রিজ-এর এই দৃশ্য একটুও ভালো লাগবে না।

কালো পোশাক পরে কাঁধে একে ঝুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডটি তার হাতের ছোট্ট চৌকো ডিজিটাল স্লেটের উপর টোকা মারতেই আমার কানের পর্দায় পেমেন্ট রিকুয়েস্টের ‘বিপ’ শব্দ ভেসে এল। যত টাকা চাইল, চাইনিজ কারেন্সি ইউয়ানে সেটা বিড়বিড় করে বলে মাথার ভিতরের অফিস অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠিয়ে দিলাম।

নাহ্, দু প্রিজ একেবারে বজ্রাহত হয়ে যাবে! পুরো ক্ষেপে লাট হয়ে যাবে রে!

একটি কালো ছোকরা আদ্যিকালের ফোন-ক্যামেরা বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে গার্ড তার দিকে এগিয়ে গেল। আমি ছাড়া এই ভিউয়িং প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আর মোটে পাঁচজন। কোনো ধাক্কাধাক্কি নেই আগেকার মতো। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলাম। তেষ্টায় সব সময়ই আমার গলা শুকিয়ে থাকে আজকাল।

<অ্যাঁ! আজকাল এই হাল হয়েছে? ধ্যাত্তোর বাঁ*! এই জন্য এত পয়সা খরচা করলাম? সময় নষ্ট খালি!>

মনের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসা পরগাছার মতো বসের কোলাব্যাং-সুলভ গলাখানা আমার কানের পর্দায় ইলেক্ট্রনিক স্বরে ঘ্যানঘ্যান করে উঠল। এই মেরেছে! বস আবার কখন এসে জুটল? ব্যাটা আমারই চোখ দিয়ে সব দেখছে।

চোখ বুজলাম। বন্ধ চোখের পাতার তলার আঁধারে ডানদিকে মিটমিট করে জ্বলছে সিরিল দ্য রিগ-এর নিউরাল সাইবারনেটিক্সের জ্বালানো একটা সবুজ বিন্দু। অফিস তার মানে অনলাইন আছে। আর ওই হতচ্ছাড়া বসও তাই।

কিন্তু বাঁ চোখের নীচে তো কিছু জ্বলছে না—শুধুই অন্ধকারের কালচে-লালচে আভা। কোথায় তুমি লিজেট, কোথায়? কী করছ? কেমন আছো? তোমাকে ছেড়ে আসতে আমার ভালো লাগে না, তুমি তো জানো। কিন্তু কী করব বলো? এতগুলো বিল তো মেটাতে হবে, তাই না? বিশেষ করে ওই জলের বিল…

<কই হে? কী হল তোমার আকাশ ভেঙে বৃষ্টির ফোরকাস্ট আর ভিক জলপ্রপাতের বন্যার? তার জন্যই তো এত কাঠখড় পুড়িয়ে প্লেনের ভাড়া দিয়ে তোমাকে পাঠানো হল ওখানে, নাকি?>

“উবে গেছে বোধ হয় গরমে।” 

প্রবল বিরক্তি-মাখা শব্দগুলো বেরোতে বেরোতে আমার গলা আরো শুকিয়ে দিচ্ছিল। চোখ বন্ধই ছিল। ঝর্না থেকে দুএকটা জলের ফোঁটা এসে পড়ল আমার মুখের উপর, আমার বেরিয়ে থাকা জিভের উপর। উফ্, কী শিহরণ! জলের ফোঁটাটা রোদে পুড়ে ঝামা হয়ে যাওয়ার আগেই জিভটা সড়াৎ করে ভিতরে টেনে নিলাম। প্রাণপণে হিপ-ফ্লাস্কে থাকা জলের খানিকটা টেনে নিলাম—উষ্ণ কিন্তু মিষ্টি তরল জিভের উপর খেলা করল—তারপর আবার যে কে সেই জলতেষ্টার খসখসে যন্ত্রণা। শেষবারের মতো ঢোক গিলে চোখ মেললাম। আঙুল আর হাত প্ল্যাটফর্মের কাঠের রেলিংয়ের উপর রাখা, কিন্তু তাতে আর কোনো জলের ফোঁটার স্পর্শ পাচ্ছি না। চকচকে ঘন নীল আকাশে কালচে রং ধরছে, ফোলা বেলুনের মতো লাল টকটকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।

নাঃ! এখানে কোনো ‘গর্জনশীল ধোঁয়া’, কোনো উত্তুঙ্গ জলপ্রপাত নেই! আছে শুধু এক রক্তাল্পতায় ভোগা তিরতিরে জলধারা, আমি আর আমারই মতো জলপ্রপাতের খাদের দিকে হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকা একদল মানুষ। কিন্তু যে বন্যার অপেক্ষায় আমরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি তা কোনোদিনই আসবে না।

এপাশে ওপাশে জিএম জৈবজ্বালানীর দিগন্তপ্রসারী ক্ষেত জোঁকের মতো নদীর রক্ত শুষে সবুজ হয়ে ফুলেফেঁপে ছড়িয়ে রয়েছে। ওদিকে লিভিংস্টোনের বাইরের বস্তিতে শুনছি নাকি লাখো লাখো বুভুক্ষু মানুষের ভিড় জড়ো হয়েছে। তারা ধুঁকতে ধুঁকতে দেখছে তাদের খাবার বাক্সবন্দী হয়ে চলে যাচ্ছে সমুদ্রের পারে এসইউভি আর ট্যাঙ্কদের খাদ্য হতে। আমি অবশ্য অন্য পথ দিয়ে ঘুরে এসেছি ওই দৃশ্য এড়াব বলেই—কাজেই জানি না ব্যাপারটা সত্যি নাকি ওয়েবে ভেসে বেড়ানো আরও একটা ভুয়ো খবর। সিরিলও সেটা জানাতে পারবে না, কারণ শুনছি নাকি ফুয়েলকর্পস ওভারহেড স্যাটেলাইটগুলোকে সেন্সর করেছে। আর তাছাড়া এই সব খবরের আজকাল বাজারে কোনো দামও নেই। এমন কী শেষ অফিশিয়াল নিউজ এজেন্সিগুলো পর্যন্ত এসবকে পাত্তা দেয় না।

<ধ্যার! আমি বঙ্গানিকে বলছি আমাদের অনলাইন খদ্দেরদের মধ্যে কাউকে মুর্গি করে তোমার ওই গুষ্টির পিণ্ডি ছবি আর ক্লিপিংসগুলো গেলানো যায় কি না দেখতে! এ যা ছাল ছাড়ানো কাকের ছানার মতো লিভিংস্টোনের ছবি হয়েছে, আমাদের চীনে স্ট্যানলিরা অন্তত এর মুখদর্শন করতে চাইবে না। আমি গেলাম। দু প্রিজ আউট।

বস বেরিয়ে গেলেন। তাঁর তীক্ষ্ণ গলা শুনে আমার মুখ কুঁচকে উঠল। কিন্তু উত্তর দেয়ার মতো আর এনার্জি নেই আমার। অবশ্য বস কারো উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষাও করেন না কখনও। দোষ যেন আমারই। আর এক ঢোক জল খেলাম। কানের মধ্যে আবার বিপবিপ। কে আবার নিউরাল ওয়াইফাই দিয়ে কানেক্ট করতে চাইছে? না, লিজেট না। ধুর—মরুক গে যাক, এখন ধরব না।

‘আপনার লেটেস্ট সি-২০ মডেল নাকি?’

প্রশ্নটা করেছে স্মার্ট খাকি সাফারি স্যুট পরা একজন লোক। গায়ে চাপড়া করে ফ্যাক্টর ১০০ সান ব্লক ক্রিম লাগানোর পরও তার চামড়া ঝলসে লাল হয়ে গিয়েছে। উচ্চারণ মোটামুটি গোটা ইয়োরোপের স্ট্যান্ডার্ড উচ্চারণ। ঘামে ভেজা পিথ হেলমেটের নিচ থেকে উঁকি মারা কয়েকগাছি পাতলা কাঁচাপাকা চুল থেকে চুলের আসল রঙ বোঝা যায় না। দাঁত বের করে হেসে লোকটা আবার বলল, ‘আমি লেটেস্ট সি-২০ ইনস্টল করে নিয়েছি। পুরোটা চিন্তাভাবনা দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বুঝলেন—মুখে বলে কম্যান্ড দেয়ার দরকারই পড়ে না। ’

‘আমার পুরোনো সি-১২,’ কথাটা বলেই আমার চোখ চলে গেল লোকটার পিছনে খাড়া পাহাড় আর নীচে পূর্বদিকে আদিগন্ত ছড়িয়ে থাকা সবুজ ভুট্টাক্ষেতের দিকে। ক্ষেতগুলো যেন সবুজ নদীখাত আর জঙ্গলকে গলা টিপে ধরতে চাইছে। এই জায়গাটা পরে এডিট করে দেব না হয়। এখন এই লোকটার সামনে মুখে নির্দেশ দিয়ে শুট এডিট করতে একটু কেমন কেমন যেন লাগছে। আর লোকটাও বকর-বকর করে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই! মুখ থেকে বিয়ার আর মাংসের গন্ধ বেরোচ্ছে। আমার মনে হল লোকটা যে প্রাণীটার মাংস খেয়েছে সেটাকে নিশ্চয় আগে ওষুধ দিয়ে বুঁদ করে তারপর শিকার করেছিল। সাফারিতে তো এ জিনিসের ব্যবস্থা আকছারই হচ্ছে।

“আমার রিগ চীনের লেটেস্ট ওয়েব ডিজাইনগুলোর সঙ্গে কম্প্যাটিব্ল, বুঝলেন? আর তার সঙ্গে চোখের নার্ভে সিক্স ফ্যাক্টর জুম ফাউ।”

“বাঃ! দারুণ। আমারটা ওই মোটামুটি কোনো রকমে চলে যায়।”

ঠিক তখনই আমি দেখতে পেলাম ওদের। জঙ্গলের গাছপালার একদম ধারে—যেন এগিয়ে আসা ইলেক্ট্রিক তারের হাত থেকে বাঁচতেই ওই ওখানে মুখ লুকিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ওরা। জানি বস এসব চায় না—বস মেরে ফেলবে আমাকে এসব ‘ছাইপাঁশের’ ভিডিও তুলতে দেখলে—কিন্তু এত বড়ো হাতিদের সমাধিস্থান আমি জীবনে কোনোদিন দেখিনি। জ্যান্ত হাতিই যে শেষ কবে দেখা গিয়েছে তাই-ই কেউ মনে করতে পারে না। ভেঙে ফেলা বৃদ্ধ জাহাজের পাটাতন আর মাস্তুলের মতো ছড়িয়ে আছে বিপুল হাড়ের স্তূপ। সাদা অর্ধচন্দ্রাকৃতি হাড়গুলো অনেকটা জায়গা জুড়ে পড়ে আছে। মহান মৃত্যুকে হাতির যোগ্য শান্ত রাজকীয়তায় আবাহন করে আনার এর চেয়ে ভালো জায়গা বোধ হয় আর কিছু হতে পারে না।

দু প্রিজ তো নড়েচড়ে বেড়ানো ‘জ্যান্ত শিকার’ ছাড়া ভিডিও নেবে না—কিন্তু আমার অত বাছবিচার করলে চলবে না।

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘুরে তাকিয়ে লোকটা বলল, “আরে ধুর! আমি ভাবলাম আপনি সত্যিকারের জ্যান্ত কোনো জন্তুজানোয়ার দেখতে পেলেন বুঝি। একটু একঘেয়েমি কাটত তাহলে। যা বলছিলাম—জানেন কি, সি-২০ অ্যামিগডালা-হিপ্পোক্যাম্পাসের সঙ্গে এমন ওয়্যারিং করা থাকে যে আপনার সব অনুভূতির তিরানব্বই পার্সেন্ট পর্যন্ত আবার নতুন করে মগজের মধ্যে ফিরে দেখতে পারবেন আপনি। হুঁ হুঁ বাবা!”

“বটে?”

গত কয়েক বছর ধরে আমার মনে হয় যেন আমার নিজেরই সব অনুভূতিগুলো গলে গলে খসে পড়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে রয়ে গিয়েছে শুধু তাদের পড়ে থাকা খোসাগুলো। সেই আমাদের পুরোনো ভিডিও ক্লিপিংগুলো—তাজা কাঁচা আবেগে ভরপুর সেই ছবিগুলো, তারুণ্যের চনমনে রক্তে দৌড়াচ্ছে যাদের শিরা বেয়ে —সেগুলো আবার বের করে খুলে বসলে হয় না একদিন? গত বিশ বছর হল বোধ হয় আমি আর লিজ আমাদের পুরোনো হ্যান্ড-হেল্ড ভিডিওগুলো দেখি না… আমি, লিজ আর মার্ক… মার্ক অ্যাকাউন্টেন্সির চাকরি নিয়ে ওজ-এ চলে গিয়েছে সেও তো আজ তিন বছর হয়ে গেল… তিন বছর… তার আগে সেই হাইজ্যাক যাতে মার্কের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা গেল। মার্ক হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে কেবল ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল অক্ষতদেহে বেঁচে ফেরার জন্য। তিন বছর… এই তিন বছরে বাড়ির বাইরে পায়ে হেঁটে বেড়াতে বললে আমার প্রাণে বিকট ভয় উপস্থিত হয়, কিন্তু কাজের সুবাদে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোয় কোনো ভয় হয় না… অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? আর দু প্রিজ নিজের খরচে আমার মাথায় সিরিল নামের রিগটা বসিয়ে দিয়েছে সে তো এই সবে বছরদুয়েক হল। সিরিলের কাজ আমার সব চেয়ে নতুন স্মৃতিগুলোকে ঝকঝকে তকতকে করে রাখা। আর, ইন্সটলেশনের পর থেকেই আমার এই অনন্ত জলতেষ্টা। রিগ বসানোর নিউরোসার্জারি করার সময়ে ওরা আমার জলতেষ্টার নার্ভটায় নিশ্চয় কিছু গড়বড় করে দিয়েছে। কিন্তু কী করব? এখন সার্জনরা সে কথা ..মানতে ..চায় না। আমারও বলার কিছু নেই। বারো পাতা লম্বা ইনশিওরেন্সের কাগজ কে পড়ে?

লোকটা আবার মুখ খুলল। তার নাকের ডগায় ঘাম টলমল করছে। বোঝাই যাচ্ছে স্মার্ট স্যুট তার দেহের গরম কমানোর নিদারুণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। ফিক করে হেসে ফেললাম দৃশ্যটা দেখে। তারপর কিছু না বলে—বিদায়টুকুও না জানিয়ে—মুখ ঘুরিয়ে চলে এলাম। পুরোনো অনুভূতিগুলোকে খসে পড়া পাতার মতো শুকিয়ে যাওয়ার জন্য একা ফেলে যাওয়াই ভালো। বিড়বিড় করে বললাম—‘কম্যান্ড—কাট!’

ওর রিগটা তাহলে আমার চেয়ে ভালো। আমার চেয়ে বড়ো। বাঃ! দারুণ! তাতে পৃথিবী কিনে নিয়েছে একেবারে! লোকটা আফ্রিকান তো নয়। ফ্যান্সি টুরিস্ট কোথাকার! গায়ের চামড়ার উপর যে দেশের রোদটাও সহ্য করতে পারে না সেখানে এসেছে চকচকে জামা পরে কেত মারতে! হালফ্যাশনের ইমপ্ল্যান্ট বসিয়ে ফুটানি মারছে! পয়সা দেখাচ্ছে শালা!… আর আমি কী করছি?

চোখ বন্ধ করলাম। দু’চোখের তলাতেই লাল আলোর বিন্দু। বেশ। সিরিল চোখের উপর দিয়ে কী সব ব্লগ-টগ গড়িয়ে দিল, পার্কিং লটের দিকে হেঁটে যেতে যেতে আমি খেয়ালও করলাম না। কার-পার্কিং, পাবলিক টয়লেট, এয়ারপোর্ট হোটেল, আর তারপর কাল সকালের ফ্লাইটে বাড়ি।

বাড়ি… আর লিজ…

***

বাড়ি ফেরার পথে এই শেষ অংশটাই সব থেকে লম্বা আর ক্লান্তিকর, তাই গাড়ি থেকে যতখানি পারা যায় স্পিড আদায় করে নিতে হয় এই অংশটুকুতেই। রাস্তার ধারের ঢেউ খেলানো করোগেটেড শিটের চালের পাশের রাস্তা বেয়ে অনন্ত সময় বয়ে চলেছে। ডানদিকের পথ দিয়ে ডিংগানে স্টেডিয়ামের মুখের দিকে হুড়হুড় করে চলেছে জনস্রোত। বেশির ভাগই পুরুষ। দিনের কাজে বেরোনোর সময় ফ্লাইওভারের নীচে জটলা পাকাচ্ছে—চলন্ত বাক্কি কিংবা ট্রাক যদি তুলে নিয়ে যায় তবে খানিকটা সময় বাঁচে। একটা বুড়ো লোক ফ্যাকাশে হাতের পাতা খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল—কিন্তু আমার এসব ভিক্ষেটিক্ষে আর পরনির্ভরশীলতা কোনোকালে পোষায় না। এটা আফ্রিকা বাবা! গাড়ির দরজা এঁটে, জানালা তুলে দিয়ে বসে রইলাম।

রাস্তার ধারে পাহাড় জমি খরখরে শুকনো খয়েরি। হাড়জিরজিরে গোরুছাগলের দল ঘাস খেয়ে খেয়ে ধুলো ছাড়া আর কিছু রাখেনি। চরে বেড়ানো পশুগুলোর উপর নজরদারী করতে থাকা একই রকম হাড্ডিসার ছেলেগুলোর হাতে লাঠি। পিঠের সঙ্গে বাঁধা চীনে পিএলএ টি-৭৪ উঁচিয়ে রেখেছে বটে, কিন্তু ওগুলো ফাটলে ছেলেগুলোই উড়ে যাবে।

উঁহু, বৃষ্টির নামগন্ধও নেই এদিকে—পোড়া কপাল রে আমার! লিজেট, আমাদের কপাল তো তবু কিছুটা ভালো, বুঝলে?—একটু জল অন্তত লুকিয়ে জমিয়ে রাখতে পেরেছি। আগুন দরে বিকোবে প্রাইভেট মালিকানার জল—তার সামনে অন্তত কিছুদিন তো ওই জমানো জল দিয়ে কাটানো যাবে। স্রোতের মুখে খড়কুটো অন্তত…

কাউন্সিল ইলেক্ট্রিক কম্পানির পাইলন আর ট্রান্সফর্মার থেকে বিদ্যুৎবাহী তারের ঝাঁক মাথার উপর দিয়ে গিয়ে ঢুকেছে রাস্তার ধারে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কুঁড়েঘরগুলোয়। সবই চুরি করা বিদ্যুৎ, তারগুলো মাথার উপর জট পাকিয়ে জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে। রোজ সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে কম্পানির লোকেরা তারগুলো কেটে দেয়, আবার সূর্য ওঠা মাত্রই ম্যাজিকের মতো তারগুলো নিজের জায়গায় ফিরে আসে। মজার ব্যাপার বটে! কোনোই মাথামুণ্ডু নেই! ক্ষিদের জ্বালায় ভুঁয়ে-মুয়ে হয়ে যাওয়া একদল লোক—তাদের বিদ্যুতের টোপ গেঁথে গেঁথে তুলছে, আর তারা বুঝতেও পারছে না? ওরে গাড়লের দল, এদিকে বিনেপয়সায় এত এত রোদের আলো মেলে, সেটা তোদের নজরে পড়ে না? কোনো মানে হয়?

দু’পাশের আখের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এবড়োখেবড়ো রাস্তা চলে গিয়েছে। অটো-মোডে দিয়ে রাখা গাড়ি নাচতে নাচতে চলেছে আমাদের বাড়ির দিকে। ‘কোপ্স ফলি’ নামের ফার্মহাউসটা দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে ছিল, এককালে আমাদের হাতে একটু পয়সা জমতেই ওটা কিনে ফেলেছিলাম… ‘সাধারণ গ্রামের বুকে ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়’-এর লোভে… হুঁ!

চোখ বন্ধ করে আবার মেসেজ পাঠালাম— একপ্রকার কাতর আকূতিই বলা চলে—

<লিজেট! আমি বাড়ি ফিরে এসেছি!>

কোনো উত্তর নেই। বাঁ চোখের নীচে লাল আলোর বিন্দুটা দপদপ করে ..জ্বলতে.. জ্বলতে.. মাথা ..ধরিয়ে ..দিচ্ছে। ..তারপর হঠাৎ করেই লাল

আলোটা সবুজ হয়ে গেল।

<এতক্ষণে সময় হল তাহলে, মিস্টার গ্রাহাম মেসন? হতচ্ছাড়া কোথাকার!>

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এখনও রেগে আছে আমার উপর তাহলে। যাক গে, নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো।

গাড়ির দেয়া পাসওয়ার্ড পৌঁছাতেই কালো ইলেক্ট্রিক গেট দুপাশে হাট করে খুলে গেল।

লিজ বুকের উপর আড়াআড়ি হাত রেখে কটমট করে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পায়ে গামবুট, পরনে ঢোলা মলিন জামা, সর্বাঙ্গে ময়লা লেগে আছে। পাশে এক ঠেলাগাড়ি ভর্তি গাজর। বেশ ‘সুস্বাদু দেখতে’ গাজরগুলো, নির্ঘাৎ ওপাশের টাউনশিপের কো-অপারেটিভে বেচতে যাচ্ছে। যেদিন থেকে আমরা এখানে এসেছি সেই থেকেই ও সবজি ফলাতে শুরু করেছে আর কো-অপে যাচ্ছে। গালে গাল ঠেকিয়ে যেটা হল আমাদের সেটাকে আর যাই হোক চুমু বলা চলে না। ওর চোখে চোখ রাখতে অস্বস্তি হচ্ছিল আমার, বুকের ভিতরে কেমন যেন মিশ্র একটা অনুভূতি কাজ করছিল। লিজের লম্বাচওড়া চেহারা, রং ঘন কালো। মুখের উপর ঝামড়ে এসে পড়া কোঁকড়া চুলের অবাধ্যতা লাল অ্যালিস ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে শাসন করে রেখেছে। ইদানীং চুল পাকছে লিজের—তাতে ওর ভ্রূক্ষেপ নেই, বরং লাল ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে যেন রুপোলি রেখাগুলোর রূপ আরো খোলতাই করে নিয়েছে। বাদামি চোখদুটো কী সুন্দর! আমার উপর রেগে থাকলেও একবার আড়চোখে ওর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না। কিন্তু রাগ… না তো… রাগ যেন অনেকটা পড়ে এসেছে। তার বদলে… হ্যাঁ, এ তো রাগ নয়, এ যে উদ্বেগের চাহনি!

লিজি ভয় পাচ্ছে! এ যে অবিশ্বাস্য! আমি না থাকলে ও একা একাই কো-অপে যাতায়াত করে, পথঘাটের বিপদ-আপদ সম্পর্কে আমি হাজার বারণ করলেও কান পাতে না—এহেন ডাকাবুকো লিজি ভয় পাবে? নাহ্, আমারই ভুল হচ্ছে। লিজি নার্ভাস হতে পারে না—হতেই পারে না।

লিজি ঠেলাগাড়ি ঘুরিয়ে গাজরগুলো শেডের মধ্যে রেখে আসতে গেল। আমি ভিতরের দিকে পা বাড়ালাম। ঘরের শেষ প্রান্তে ইয়া বড়ো এ.জি. (‘অলমোস্ট গ্রিন’) এয়ারকন্ডিশনারটা থাকা সত্ত্বেও বসার ঘর যেন গরমে তেতে কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে আছে। ঘরে আমার উপস্থিতি টের পেতেই মেশিনটা ‘ক্লিক’ শব্দ করে চালু হয়ে গিয়ে গোঁগোঁ করে চলতে থাকল। ঘরের এক কোণে ওয়েবপোর্টালখানা সন্তর্পণে মুখ গুঁজে পড়ে আছে—ঠিক যেমনটি ও চেয়েছিল যখন ওটা আমি ওরই সুবিধে হবে বলে লাগিয়েছিলাম—কিন্তু কন্ট্রোলের আলোগুলো টকটকে লাল হয়ে জ্বলছে। এমনটাই জ্বলে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত আর লক্ড হয়ে পড়ে থাকলে। কিন্তু আমি বাড়ি ঢোকার ঠিক আগেই তো ও আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, তাই একটা শৌখিন ধাঁচের স্ক্রিন সেভার স্ক্রিনের উপর গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে খেলে বেড়াচ্ছে। কিচেনের দিকে যেতে যেতে ফুলো-ফুলো গুঁড়ো-গুঁড়ো পার্টিক্ল দিয়ে তৈরি অবয়বটার পুরো চেহারাটা আমি ধরতে পারলাম না। আমাকে এখন আমাদের দুজনের জন্য চিজ স্যান্ডউইচ বানাতে হবে। আর একটু জল খেতে হবে।

ফিরে এসে দেখি ও চেয়ারে বসে আছে। ‘থ্যাংকস’ বলে আমার হাত থেকে প্লেটটা নিল, কিন্তু নিয়ে পাশের ছোটো টেবিলে রেখে দিল—যেন ক্ষিদে নেই ওর। আমি উল্টোদিকের কাউচটায় বসলাম। লিজ চোখ নামিয়ে রেখেছে মাটির দিকে।

ওফ্, ভগবান! আবার সেই এক ঘ্যানঘ্যানানি-ঝগড়াঝাঁটি শুরু হবে নাকি? যাওয়ার আগেও সেই এক ক্যালরব্যালর চলছিল। ‘কাছেপিঠের কাজ নিলে কী হয়? এত দূরে যাওয়ার কী আছে? কোনোকালে তো দু প্রিজ-এর মুখের উপর একটাও কথা বলতে পারো না…’ হ্যানা ত্যানা!

আমারও হঠাৎ যেন ক্ষিদেটা চলে গেল। চিজ স্যান্ডউইচের প্লেট নামিয়ে রেখে আড়ষ্টতার জমাটবাঁধা বরফ ভাঙার জন্যই বললাম, “বৃষ্টি না হলেও এবারে সবজিপাতির ফলন বেশ ভালোই হয়েছে, কী বলো?”

মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে হাসল ও। বলল, “হ্যাঁ, আমাদের সোলার কুয়ো-পাম্পটা খুব কাজে দিয়েছে। তবে আমি সবসময় খেয়াল রেখেছি জল যেন বেশি নেমে না যায়, কুয়ো যেন সব সময় অন্তত পৌনে-ভর্তি থাকে।”

ওকে একটু রিল্যাক্সড হতে দেখে আমার মুখেও হাসি ফুটল। বললাম, ‘ভাগ্যিস তুমি সার্ভেয়রকে ডেকেছিলে। ওটা বাঁ*  আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই না। সত্যি লিজি, তোমার ইনট্যুইশনের মাইরি জবাব নেই!’

মুখ কুঁচকে উঠে দাঁড়িয়ে ত্বরিত-পায়ে ওয়েব পোর্টালের কাছে চলে গেল লিজি। যাহ্ বাবা, কী আবার ভুলভালো বলে ফেললাম! ওহ্, ওই গালাগালি নিশ্চয়… লিজি খিস্তিখামারি একদম পছন্দ করে না। নিত্যদিন চার্চে গেলে যা হয় আর কী। ও কোনোদিন ‘হতচ্ছাড়া’-র উপরে উঠতেই পারেনি, তাও সেটাও সবে মাত্র গত কয়েকবছরের ব্যাপার।

লিজি যখন ঘুরে দাঁড়াল তখন দেখি ওর দুচোখ জলে ভরে উঠেছে। পাতলা কম্পিউটার স্ক্রিনের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই ওর আঙুলের চাপে স্ক্রিনে ঘুরে ঘুরে ভাসতে থাকা অবয়বটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা ছবি। খালি পা, মলিন ছেঁড়াখোঁড়া হলুদ রঙের জামা পরা একটা কালো বাচ্চা মেয়ে মুখ তুলে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যন্ত্রণায় মেয়েটার মুখ বেঁকে গিয়েছে। ছবিটা… ছবিটা আমাদের গেটে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার রিল থেকে ক্রপ করে নেওয়া মনে হচ্ছে…

কাঁপা গলায় লিজেট বলল, “ওর নাম থান্ডি। তুমি চলে যাওয়ার পর কাল সকালে ও এসেছিল… গলা শুকিয়ে গিয়েছিল ওর। জিভ পুরু হয়ে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ও কিছু গিলতেও পারছিল না। তেষ্টায় ও মরে যাচ্ছিল গ্রাহাম… মরে যাচ্ছিল… হা ঈশ্বর! মাত্র সাত বছর বয়স, ওইটুকু ছোট্ট-ছোট্ট হাত-পা—মরে যাচ্ছিল ও! পরিস্থিতি যে এতটা খারাপ হয়ে পড়েছে আমি বুঝতেই পারিনি… আমাকে ওর মুখ ফাঁক করে আস্তে আস্তে জল খাইয়ে দিতে হল… উফ্ফ্!”

উঠে দাঁড়ালাম আমি।

“কলের জল দিলে না ফ্রিজের জল?”

“না গ্রাহাম। আমি ওকে আমাদের জমিয়ে রাখা জল থেকে খেতে দিয়েছি। তারপর ওদের গোষ্ঠীপ্রধানকে ডেকে পাঠিয়ে বললাম মেয়েটার মা’কে খবর দিতে, আর… আর… জলের কথাটাও ওদের সবাইকে জানাতে। ওরা… ওরা অনেকজন আছে গ্রাহাম। ওই হতচ্ছাড়া রাস্তাটার ওধারেই… অনেক, অনেকজন। গোষ্ঠীপ্রধান দুমিসানেকে বলেছি যে আমাদের পৌনে-ভর্তি কুয়োর বাকি জলটুকু ওরা ব্যবহার করতে পারে।”

“অ্যাঁ! কী? না না না না! লিজি তুমি… তুমি করেছটা কী? ওটা… ওটা আমাদের জল…! তুমি আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করতে পারলে না? আজ তিন বছর ধরে আমার মাথায় তুমি অবাধে ঢুকতে পারো—ফ্রি অ্যাক্সেস দিয়ে রাখা আছে। ও হ্যাঁ, তুমি আমার কল ধরছিলে না কেন? ঘুরিয়ে তো কলও করতে পারতে। ঠিক আছ কি না সেটা তো অন্তত জানতে পারতাম!”

“অবাধ! ফ্রি অ্যাক্সেস! ধুৎ! আমি খালি সেটুকুই শুনতে পাই যেটুকু তুমি আমাকে শোনাতে চাও। আর তোমাকে বললে তুমি কী বলতে আর কী করতে, মিস্টার গ্রাহাম মেসন?”

লিজ উঠে দাঁড়িয়ে কঠোর চোখে আমার দিকে তাকাল। এতক্ষণ পরে এইবার যেন সে আসল নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। মুহূর্তখানেক ইতস্তত করে বললাম, “আমি হলে ওকে ফ্রিজের জল দিতাম আর তোমাকে মনে করিয়ে দিতাম যে আমাদের কুয়োর কথাটা যেন কাকপক্ষীতেও টের না পায়। আমাদের নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই ওই কুয়োর ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকা উচিৎ, জানো না তুমি? নইলে কোয়াজুলু-নাটালের প্রতিটি জল-ডাকাত আর ৎসত্সির১ নিশানা হয়ে যাব আমরা!”

“এই—এই যে! দেখছ তো কেন বলিনি তোমায়? জানতাম তুমি ঠিক এইটাই বলবে আর আমাদের ঝগড়া হবে। তোমার মুখ না দেখে ঝগড়া করতে পারি না আমি! তোমাকে কিচ্ছু জানাইনি, তুমি উদ্বেগে হাঁসফাঁস করছিলে—আমি দুঃখিত তার জন্য। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তটা একা আমাকেই নিতে হত। দুমিসানে ভালো লোক, কাউকে কিচ্ছু বলবে না… আমার চোখের সামনে রাস্তার উপর বাচ্চাগুলো একফোঁটা জল না পেয়ে মরে যাবে আর আমি বসে বসে তাই দেখব বাঁ—!”

চিৎকার করতে করতে লিজি হঠাৎ সশব্দে হাতের তালু দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল। তারপর হাত নামিয়ে বড়ো করে নিঃশ্বাস টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলা শেষ করল—“না—কক্ষনো না!”

লিজি কোনো দিনও গালাগালি দেয় না, আর আফ্রিকান্স বলতে শুরু করে একমাত্র একেবারে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলে তবেই। ও ঝুঁকে পড়ে নিজের শরীরের দুপাশ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। পিছনে হলুদ জামা পরা মেয়েটা স্ক্রিনের উপর ঘুরে ঘুরে নেচেই চলেছে। লিজি নিজেও তো একটা মেয়েই চেয়েছিল…

আমার রাগ চলে গিয়ে তার জায়গা নিচ্ছিল অসহায়তা। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। ওকে বুঝিয়েসুঝিয়ে স্ক্রিনের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে। লাভঅ্যান্ডপিস ডটকম থেকে মন-ভালো-করা বেশ কয়েকটা ইমোটি-মেসেজ পাঠিয়ে দিলে হয় না? তাহলে মনে হয় ও শান্ত হবে।

কিন্তু.. .. ওর চোখে.. চোখ.. পড়তেই.. আমি জমে গেলাম। কালো, মোহময়ী, কোণে একটু ভাঁজ-পড়া একজোড়া ভয়ঙ্কর হিংস্র চোখ। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানিয়ে দিল যে এই মুহূর্তে যদি আমি ওর গায়ে হাত দিয়ে ওকে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার এতটুকুও চেষ্টা করি তবে ও চিৎকার করে আমাকে আঁচড়ে-কামড়ে লাথি মেরে দরজার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেব। ওর চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, যে জায়গায় ও পৌঁছেছে সেখান থেকে আর ও ফিরবে না। আমার হাতজোড়া থতমত খেয়ে অসহায় হয়ে শরীরের দু’পাশে ঝুলতে লাগল, আর ওর গনগনে আগুনের মতো চোখ দিয়ে দরদর করে ঝরে পড়তে লাগল অশ্রুজল।

ধুত্তেরি! এখন কী করব আমি? খানিক কিন্তু-কিন্তু করে দু হাত বাড়িয়ে ওর কাঁপতে থাকা আড়ষ্ট শরীরটা জাপটে জড়িয়ে ধরা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।

ওর হাতগুলো কঠিন হয়ে উঠে এক মুহূর্ত যেন আমাকে বাধা দিতে গেল, আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল। পরক্ষণেই যেন হাল ছেড়ে দিল ও, আর ওর গলার মধ্যে থেকে উঠে এল এতক্ষণ ধরে দলা পাকানো কান্নার আওয়াজ। ওর ঝুপসি কালো চুল আমার চোখমুখময় ছড়িয়ে পড়ছিল, সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। হঠাৎ কী জানি কোনো অজানা আবেগে আমারও চোখদুটো জ্বালা করতে শুরু করে দিল। ওর মাথা থেকে ভেসে আসছিল নারকেলের সুবাস… আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই দিনগুলোর কথা যখন প্রথম-প্রথম যখন আমরা দেখা করতে যেতাম—সে বোধ হয় আজ প্রায় বছর ত্রিশেক আগের কথা… শালা! আমরা শেষ কবে একে অপরকে এরকম জড়িয়ে ধরেছি, হ্যাঁ? মনেই তো পড়ে না!

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মার্ক চলে যাওয়ার পর থেকে আর ধরিনি।

আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে লিজি বলল, “এসো।”

তারপর আমাকে সামনে টেনে নিল ও। আমার জামার হাতা ওর মুখে লেগে থাকা জল মুছিয়ে দিতে লাগল।

অ্যাঁ!… ওহ্…!! আমি তো ভাবলাম ও বুঝি আমাকে সবজিবাগানের ফসল দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে…!

হে ভগবান! আমি তো ভুলতেই বসেছিলাম কী প্রচণ্ড, বিপুল, সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া নারী আমার স্ত্রী!

আর.. সব ..শেষে ..দেখলাম.. আমার ভয়টাও একেবারেই অমূলক

ছিল। সীমাহীন জলতেষ্টা সত্ত্বেও আমি শুকিয়ে যাইনি।

***

আমি যখন উঠলাম তখনও ও ঘুমোচ্ছে।

হাত-পা ছড়িয়ে চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে। ইয়াবড়ো হলুদ বালিশের উপর বিস্রস্ত চুলের ঢাল ছড়িয়ে পড়েছে। অল্প অল্প নাক ডাকার আওয়াজও ভেসে আসছে। শান্ত, শিথিল, নিশ্চিন্ত আরামের একটি নিটোল প্রতিমূর্তি। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনের ভিতরে হঠাৎ কেমন যেন একটা ব্যথা জমাট বাঁধতে লাগল। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ গ্রাস করে ফেলতে লাগল আমাকে। বড়ো অদ্ভুত, বুঝলেন? এতদিন আমরা একসঙ্গে রয়েছি, কই এমন তো কখনও হয়নি! আমি চুপচাপ বিছানা ছেড়ে শার্ট আর ট্রাউজার্স গলিয়ে নিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।

পাল্লায় ঝিলিক খেলে গিয়ে দরজাটা দুলতে লাগল। দরজার স্বয়ংক্রিয় রক্ষাব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় হতে হতে রান্নাঘর থেকে এক গ্লাস জল খেয়ে এলে কেমন হয়? না, একটুখানি সময় জল না খেয়ে থাকলে কেউ কখনও মরে যায় না। আমি দরজার পিছনে লাগানো অস্ত্রের তাকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে একটা টেসার-রড তুলে নিয়ে কোমরের বেল্টে গুঁজে নিলাম। একটা মৃদু ‘ক্লিক’ শব্দের সঙ্গে বাইরের দেয়ালের বড়ো গেটটা খুলে গেল।

এই শুকনো গরম মাঝ-বিকেলে গত গ্রীষ্মের ঘাম-প্যাচপ্যাচে গুমোট আর্দ্রতার চিহ্নমাত্রও নেই। মন থেকে ভয় কাটানোর জন্য দশটা লম্বা শ্বাস নিয়ে থপথপে আড়ষ্ট পায়ে গেটের বাইরে বেরোলাম। আবার ‘ক্লিক’ শব্দ—এবারে আমার পিছনে গেটটা বন্ধ হবার নির্দেশ। ঘড়ঘড় শব্দ করে গেট বন্ধ হতেই আমার নজরে পড়ল রাস্তার ওপারে ঝাঁকড়া ওকগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে থাকা স্পোর্টস কারটা। গাছের ছায়ার জন্য চালককে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এখন আর গেট খোলা চলবে না—খুললে আমাদের বাড়ি আর লিজির নিরাপত্তা বলে কিছুই থাকবে না, পরিষ্কার বুঝতে পারছি। আমি নিঃশব্দ বেড়াল-পায়ে পিছু হেঁটে গিয়ে গেটের গায়ে হেলান দিয়ে পকেটের মধ্যে রাখা হ্যান্ড প্যানেলটা যত জোরে পারি চেপে ধরলাম। কাঠের বেড়ার মধ্যে দিয়ে চলা বিদ্যুৎকে বন্ধ করতে হবে, নইলে বেড়া টপকে বাড়িতে ঢুকতে পারব না। আর একই সঙ্গে বেল্ট থেকে হাতে তুলে আনলাম টেসার-রডখানা। ইস্, কেন যে বন্দুকটা নিয়ে এলাম না!

গাড়ির দরজা খুলে একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে হাতদুটি কোমরে রেখে দাঁড়াল। হাতদুটো খালি। মেয়েটির পরনে শ্রমিকদের মতো নীল ওভারঅল, কাঁধে ঝোলানো ডাফ্লব্যাগ, মাথার চুল একেবারে বাটিছাঁট দিয়ে খুলির সঙ্গে লেপ্টে কাটা।

“কুন্জানি২, মিস্টার মেসন। আপনার জলের ব্যাপারে এসেছি।”

বাহ্, এতটুকুও সময় নষ্ট করা নেই! দারুণ! দুর্দান্ত!

“ন্গিয়াফিলা, উন্জানি ওয়েনা?”৩ টেসারখানা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“ভালো আছি,” মেয়েটি বলল বটে, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল যেন। মেয়েটা কি এবার আমার ভাঙা-ভাঙা ইসিজুলু ভাষার জ্ঞান পরীক্ষা করতে নামবে নাকি? নাহ্, আমাকে আশ্বস্ত করে মেয়েটা পরের কথাটা ইংরেজিতেই বলল।

“আমি বুসিসিওয়ে এম্চুনু। পেশায় হাইড্রোজিওলজিস্ট, ফ্রিফ্লো কর্পোরেশনে চাকরি করি। কিন্তু পেশাদার কাজের বাইরে নিজের গোষ্ঠীর জন্যও কিছু কাজ করে থাকি। একেবারেই গোপনে অবশ্য—বুঝতেই পারছেন।”

মেয়েটার সঙ্গে হাত মেলালাম। আফ্রিকান মতে করমর্দন—হাতের তালুতে তালু ঠেকানো, তারপর বুড়ো আঙুলে বুড়ো আঙুল জড়ানো, তারপর আবার হাতের তালু। উরেব্বাস, মেয়েটার পাঞ্জার জোর আছে তো বেশ!

“আচ্ছা। আমি গ্রাহাম মেসন। আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল। হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।”

“আমি এসেছি আপনার জমিতে জল পরীক্ষা করতে। সাদা চামড়ার লোকেরা আসার আগে এই সমস্ত জমিই আমাদের ছিল, জানেন নিশ্চয়?”

“এটা কী?… চাপা হুমকি নাকি?”

মেয়েটা চাপা শব্দ করে হেসে উঠল।

“ঘাবড়াবেন না মিস্টার মেসন। আমরা আমাজুলুরা হুমকি ‘চাপা’ রেখে দিই না। কথাটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্যি, তাই বললাম। আপনার স্ত্রী আমাদের খেয়াল রাখেন তাই আমরাও আপনার খেয়াল রাখতে এলাম।”

“হ্যালো! আপনি কে?”

লিজেট গেটের ওপার থেকে মুখ বাড়িয়েছে। তার পরনে আবার সেই ঢলঢলে ট্র্যাক প্যান্ট আর শার্ট। বুসিসিওয়ে গেটের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “আমি গোষ্ঠীপ্রধান দুমিসানের হয়ে জলের ব্যাপারটা দেখাশোনা করি মিজ ব্যাসন। আমাকে বুসিসিওয়ে বলেই ডাকবেন।”

গেটের উপর দিয়ে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে লিজ বলল, “আপনার সঙ্গে দেখা করে ভালো লাগল বুসিসিওয়ে। আমি লিজেট।”

আমার হাত থেকে কন্ট্রোল প্যানেলটা নিয়ে লিজ হাসল। হড়বড় করে কী সব বলে গেল—মনে হল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ইসিজুলু ভাষায় বুসিসিওয়েকে স্বাগত জানাচ্ছে। মেয়েটাও একই রকম উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিচ্ছে দেখলাম।

বুঝলাম দুটিতে দুর্দান্ত পটবে—খোড়ো চালের বাড়ি আর আগুন যেমন। বললাম, “আমি একটু হেঁটে আসছি।”

গেট খুলে যাচ্ছে। লিজ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সাবধানে যেও।”

সাবধান? হ্যাঁ, জানি, সাবধান হতেই হবে। এই পথেই তো মার্কের উপর আক্রমণ হয়েছিল। ওর মুখ ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গিয়েছিল। কতবার নিজের মাথার মধ্যে সেই ফালা ফালা হয়ে যাওয়া মুখের ছবি ফিরিয়ে ফিরিয়ে চালিয়ে দেখেছি আমি। কিন্তু আজ যে আমাকে এটা করতেই হবে… যদি আদৌ পারি করতে…

পথ বেশি লম্বা নয়। কিন্তু আমার পা দুটো যেন ভয়ের ভারে আর নড়তেই চাইছে না। দু’পাশে আখের খেতে বল্লমের ফলার মতো উঁচিয়ে রয়েছে গাছগুলো। ভয় হয়, এই বুঝি সেগুলোর আড়াল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল কেউ। চার বছর আগে যখন এ-পথে শেষ এসেছিলাম তখনও রাস্তাটা এমনই ডানদিকে বাঁক নিয়েছিল।

একটু গিয়েই পথটা সোজা ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে উপত্যকায়। সেখান থেকে শহরের একটা দারুণ ভিউ পাওয়া যায়। দিকচক্রবাল বরাবর পরিষ্কার আকাশের গায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে উদ্ধত গগনচুম্বী বাড়ির ঝাঁক। তবে আজকের এই এত শুকনো গরমেও কোথাও আগুন জ্বলছে না।

ওইখানে পথের ধারে পড়ে আছে সেই ভাঙা, এবড়োখেবড়ো পাথরের চাঁইটা। চার বছর আগে আমরা দুজনে এই বাড়িটা কিনব ঠিক করার পর আমি আর লিজি এসে বসেছিলাম এটারই উপরে।

আজ ..ওটার ..উপরে ..বসামাত্র পিছনে ছ্যাঁকা লাগল যেন। পিঠের ঠিক মাঝখানে নিষ্ক্রিয় টেসার রডখানা খোঁচা দিচ্ছে। আমার চোখের সামনে অন্ধকার গায়ে মেখে পড়ে রয়েছে শহর ঘিরে রাখা মিডল্যান্ড পাহাড়শ্রেণীর অতিকায় এক-একটা চূড়া। এগুলোই উমগেনি উপত্যকার দক্ষিণাংশের সীমা নির্দেশ করে।

চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে ডিংগানে স্টাড—আগে লোকে যাকে ‘স্লিপি হলো’ বলে ডাকত, আর সাদা চামড়ার আফ্রিকানাররা ডাকত ‘পিটারমরিৎসবার্গ’৪ নামে।

“সুইচ অফ!”

মাথার মধ্যে বসে থাকা যন্ত্রটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমার চোখের নীচে কোনো লাল আলো এখন দপদপ করে জ্বলছে না। শুধু মধ্যাহ্নসূর্যের প্রখর তাপ আমার বোজা চোখের পাতার হিলিবিলি রক্তজালিকাগুলো চুঁইয়ে ঢুকে আমার চোখের উপরে এক লাল আভা ছড়াচ্ছে। খুব সাধারণ, স্বাভাবিক এই লাল, গরম আভা।

দু’বছর আগে আমার মাথায় অপারেশন করে এই যন্ত্রটা বসানো হয়েছিল। দু’বছর পরে আজ আমি আবার একা হলাম। একা—বাইরের পৃথিবী-মোড়া ইলেক্ট্রিক জাল থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন—সম্পূর্ণ একলা!

এখানে কোনো অশরীরী নজরদার কন্ঠস্বর নেই, সিরিল নেই—আছে শুধু আমার নিজের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা চিন্তাভাবনা আর আমি।

আমার শার্ট থেকে ঘাম গড়াচ্ছে। গালে কুটুস করে যে মাটাবেলে পিঁপড়েটা কামড়াল আমি বুড়ো আঙুলের চাপে সেটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলাম। তীব্র টক-টক একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু না, আশেপাশে কোথাও পিঁপড়ের ঝাঁক নেই। পাথরের নীচে পিঁপড়ের লুকোনো বাসাও নেই।

এটা থাকার পক্ষে অত্যন্ত খারাপ একটা জায়গা, আমি জানি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি এটাও জানি যে আমি এই জায়গাটাতেই মরতে চাই। এইখানেই আমি আমার দেহভার, আমার এই হাড়মাসের বস্তাটা চিরতরে নামিয়ে দিতে চাই… সেই হাতিগুলোর মতো…

কেন? কে জানে! বলতে পারব না। হয়তো ওই দূরে বনপাহাড়ে জ্বলে.. ওঠা ..আগুনগুলোর.. জন্য।.. কিংবা ..হয়তো ওই মাটাবেলে পিঁপড়ের

কামড় আর মৃত্যুগন্ধ আমার নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে…

ফাঁদে ধরা পড়া পশুর মতো চিন্তাগুলো—আমার একান্ত আপন, একান্ত নিজস্ব চিন্তার দল—আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে যেতে লাগল।

কোথাও যাওয়ার পথ নেই তাদের আর।

বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম। পাগুলো থেকে আড়ষ্টতা অনেকটা বিদায় নিয়েছে এখন, যদিও টেনশন যে খুব একটা কেটেছে তা বলতে পারি না। আবার বাইরের জগতের জন্য তৈরি হতে হবে। মৃদু স্বরে বললাম, ‘সুইচ অন!’

<ওই, এতক্ষণ ছিলে কোথায়? আজকের ভিডিও ক্লিপ্স—ভিক ফল্সের ভিডিও—কে আপলোড করবে শুনি?>

শালা খা*** ** দু প্রিজ! মালটার আর কোনো কাজ নেই?

ঘড়ি দেখলাম। চারটে বেজে গিয়েছে।

<কাল করে দেব। আজ কাজের সময় পেরিয়ে গিয়েছে। >

<এক্ষুনি করবে! তুমি তো আচ্ছা ইয়ে! লোকে কাজের সময় ঘুমিয়ে পড়ে শুনেছি, তুমি তো আরো এক কাঠি ওপর দিয়ে যাও হে! শুলে তো শুলে একেবারে বৌয়ের সঙ্গে!>

কেস খেয়েছে! আমি রিগটা সুইচ অফ করতে ভুলে গিয়েছিলাম নাকি? নিশ্চয় তা-ই… সারাদিনের ধকলের পর আর… মালটা সব দেখে ফেলেনি তো?

<তুমি কি…>

আমি জিজ্ঞাসা করলাম বটে, কিন্তু ওপাশ থেকে দু প্রিজ চুপ করে রইল। কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছি যে ও জানে আমি ঠিক কী জিজ্ঞাসা করছি।

<জাহান্নামে যা তুই দু প্রিজ! কাট অফিস!>

দাঁড়িয়ে পড়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে লাগলাম। আর চলতে পারছি না। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে আমার।

***

পথের শেষ বাঁকটা ঘুরতেই দেখলাম গাছের ছায়ার মধ্যে মিশে বুসিসিওয়ের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। আমাকে আসতে দেকে

দুজনেই এদিকে ফিরল। লিজেট দু’পাশে মাথা নাড়ল। আমি বুসিসিওয়ের দিকে তাকালাম।

“মাটির নীচে মিষ্টি জলের অগভীর স্তর,” বুসিসিওয়ে বলল, “জল

যা জমিয়েছেন আপনারা সে এমন কিছু বেশি নয়। বৃষ্টি না হলে খুব বেশি দিন চলবে না ওইটুকু জলে।”

লিজেট নির্নিমেষ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার ইচ্ছে হল ওকে বলি—এটা আফ্রিকা। তুমি যেটা করতে চাইছ তাতে তোমার বিবেক সাময়িক ভাবে শান্ত হতে পারে বটে, কিন্তু তাতে আসল লাভের লাভ কিছুই হবে না, কোনো সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হবে না।

কিন্তু ওর দেখেই বুঝতে পারলাম যে খুব ভালোই আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া কথাগুলো বুঝতে পারছে। আমার আর ওর মাঝে সিরিলের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বুঝতে পারছে—আরো কাছাকাছি আসার ভ্রান্ত আশায় যে সিরিল ইনস্টল করে নেয়ার জন্য বারবার ওকে চাপ দিয়ে গিয়েছি আমি।

কেমন এক অনিশ্চিত, হাল-ছেড়ে-দেয়া চাহনি ওর চোখে। আমরা, আমরা যা কিছু গড়ে তুলতে চেয়েছি—সে সব কিছুই যেন হঠাৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, পড়েছে। ওর চোখে যেন ভয়ের অক্ষরে স্পষ্ট লেখা আছে সব শেষ হয়ে যাবে—আমরাও শেষ হয়ে যাব… হ্যাঁ, আজ সকালের ওই ঘটনার পরেও শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ওর বড়ো বড়ো কালো চোখে।

মুখ খুলতে খুলতে আমি জেনেই গিয়েছিলাম যে আমার মুখ থেকে বেরোতে চলা শব্দগুলো আমাদের জীবন ছারখার করে দিতে পারে। কিন্তু তাও বুসিসিওয়ের দিকে ফিরে আমি বললাম, “ঠিক আছে, তাও সাহায্য করব আমরা।”

“ন্গিয়াবোংগা—ধন্যবাদ,” বুসিসিওয়ে বলল।

লিজেট আমার বাহুর মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে জড়িয়ে ধরল। আমাদের চামড়া একে অপরের সঙ্গে ওম্ বিনিময় করছে।

এই মুহূর্তটা দীর্ঘজীবী হোক।

কতক্ষণ এই সময়টুকু টিকবে আমি জানি না। কেবল এইটুকু জানি যে কোনোরকম শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য আমি এখন প্রস্তুত নই। আর এও জানি যে বৃষ্টি আসতে এখনও অনেক, অনেক দেরি।

আরো একটা ভীষণ অদ্ভুত ব্যাপার—আমার কিন্তু আর একদম জলতেষ্টা পাচ্ছে না। এই অনুভূতিটাও অক্ষয় হোক তবে।

টীকা

১) ৎসত্‌সি- দক্ষিণ আফ্রিকার টাউনশিপগুলির উঠতি মস্তান, ছিঁচকে চোরডাকাত, অসংগঠিত অপরাধীদের ‘ৎসত্‌সি’ নামে ডাকা হয়।

২) কুন্‌জানি- জুলু ভাষায় আলাপচারিতা শুরুর সময় ‘কুন্‌জানি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দটির ব্যবহার ইনফর্মাল। অনেকটা বাংলায় ‘কী খবর?’ বা ‘সব চলছে কেমন?’ জিজ্ঞাসা করার মতো।

৩) ন্গিয়াফিলা, উন্জানি ওয়েনা- জুলু ভাষায় এই কথাগুলি অপরিচিত সম্মানীয় ব্যক্তির সঙ্গে দূরত্বব্যঞ্জক, সম্ভ্রমসূচক আলাপচারিতা শুরু করতে গেলে বলা হয়। অর্থ হল একেবারেই ‘আমি ভালো আছি, আপনি ভালো তো?’

৪) পিটারমরিৎসবার্গ- ১৮৩৮ সালের গোড়ার দিকে শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রী পিটার মরিৎস রেটিফ সদলবলে নিহত হন জুলু উপজাতির হাতে। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জুলুদের রাজা ডিংগানে। রেটিফের নামকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কোয়াজুলু-নাটালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের নামকরণ করা হয় তাঁরই নামে—‘পিটারমরিৎসবার্গ’। আফ্রিকান্স ভাষায় ‘স্টাড’ শব্দের অর্থ ‘শহর’। অদৃষ্ট, অজানা ভবিষ্যতের পটভূমিকায় লেখা এই গল্প এক অন্য পৃথিবীর অন্য রাজনীতি আর অন্য ইতিহাসের কথা বলে। ইতিহাস পাল্টানোর সঙ্গে নাম পাল্টে দেয়ার যে কী গভীর সম্পর্ক তা আমরা সকলেই জানি।

লেখক পরিচিতি

নিক উড জন্মেছেন জাম্বিয়ায়, তাঁর শৈশব কেটেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। গত চার দশক ধরে সাহিত্যের নানান ধারায় লেখালিখি করছেন তিনি। আটের দশকে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা অ্যাপার্টহেড নীতি ও বৈষম্যমূলক রাজনীতিকে পিছনে ফেলে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে, সেই সময় নিক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা ব্ল্যাক টাউনগুলোতে ঘুরে ঘুরে কাজ করছেন। তাঁর অনেক লেখাতেই সে অভিজ্ঞতার কথা পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে। পেশায় ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট হলেও নিক কোনোদিনই লেখালিখি থেকে বিরতি নেননি, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কলম আরো প্রাসঙ্গিক, আরো শক্তিশালী, আরো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তাঁর লেখা গল্প নানান পত্রপত্রিকা আর সঙ্কলনে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকপ্রিয় এই লেখকের উল্লেখযোগ্য একক বই ‘Azanian Bridges, ‘Water Must Fall’ এবং ‘The Stone Chameleon’.

অনুবাদক পরিচিতি

রাজর্ষি গুপ্তর জন্ম ১৯৯০ সালের ২৩শে জুন, বেড়ে ওঠা হাওড়া-হুগলির প্রান্তবর্তী ডানকুনিতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ও এম.ফিল করেছেন, এখন ওই বিভাগেই গবেষণারত। পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। কলকাতা ও কলকাতার বাইরে বিভিন্ন কলেজে পড়ানোর পর বর্তমানে কলকাতাতেই গুরুদাস কলেজে অধ্যাপনা করছেন। সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মাধ্যম হিসেবে সাহিত্যকে দেখা থেকেই অনুবাদ সাহিত্যে আগ্রহ। পছন্দের বিষয় সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা, ইতিহাস, নন্দনতত্ত্ব। লিখতে ভালোবাসেন গল্প, প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য। উল্লেখযোগ্য অনূদিত গল্প সঙ্কলন ছায়া কায়া ভয়: এম আর জেমসের অলৌকিক গল্পের সটীক অনুবাদ (ঋত প্রকাশন) ও ভয় সমগ্র- ই এফ বেনসন (বুক ফার্ম)

সকল অধ্যায়

১. অমরত্বের আড়ালে – ব্লেইজ কায়ে। অনুবাদ : অরিন্দম দেবনাথ
২. জল হরকরা – ইউজেন বেকন। অনুবাদ : অদিতি সরকার
৩. স্বাদ – চিকোদিলি এমেলুমাডু। অনুবাদ : সোহম গুহ
৪. বালিয়াড়ির গান – সুয়ি ডেভিস ওকুংবোয়া। অনুবাদ : মহাশ্বেতা
৫. অন্তিম সঙ্কেত – ইভর ডাব্লিউ. হার্টম্যান। অনুবাদ : দীপ ঘোষ
৬. অক্সিজেন রণাঙ্গন – ওগিনিকোওয়ে ডোনাল্ড একপেকি। অনুবাদ : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
৭. একে একে নিভিছে দেউটি – কোফি ন্যামেয়ে। অনুবাদ : অনুষ্টুপ শেঠ
৮. তৃষ্ণাভূমি – নিক উড। অনুবাদ : রাজর্ষি গুপ্ত
৯. সমবেত সঙ্গীত স্থাপত্যে মিলনসঙ্গমের দিশা – ডেয়ার সেগুন ফালো। অনুবাদ : সুমিত বর্ধন
১০. দি রিগ্রেশন টেস্ট – ওলে তালাবি। অনুবাদ : শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. কোরিয়ালিস – টি এল হুচু। অনুবাদ : পার্থ দে
১২. শরম – নেরিন ডরম্যান। অনুবাদ : শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন