শরম – নেরিন ডরম্যান। অনুবাদ : শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

শরম। লেখক— নেরিন ডরম্যান। অনুবাদ— শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

মূল গল্প: Shame

“একটা মরা কুকুর, থুলানী। ভগবান! ওটার জন্য কেন তুমি…”

থুলানী অস্বাভাবিক গাড়িটাকে থামাল। পাথুরে রাস্তায় আচমকা অত জোরে ব্রেক কষার ফলে গাড়িটা থামার আগে নুড়িপাথরগুলোকে পিষে রাস্তার একধারে পিছলে সরে গেল। ও যে একগুঁয়েপনা করছে সেটা আমি ওর উঁচিয়ে রাখা শক্ত চোয়াল দেখেই বলতে পারি। ওকে গোঁয়ের গণ্ডার বলেছি ঠিকই কিন্তু যখন ও কোনো ব্যাপারে জেদ ধরে ফেলে তখন অন্য কিছুতে ওকে জুততে যাওয়াটা বোকামো ছাড়া কিছু নয়, এও জানি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ওর পিছন পিছন গাড়ি থেকে নামলাম। আমি যদি অন্তত ওর পক্ষ নেওয়ার ভান না করি, পরে সেই নিয়ে বিচ্ছিরি ঝামেলা বাধবে। কিন্তু ওরকম মড়া ঘাঁটা আমার একদম পোষায় না, উফ! থুলানীর সঙ্গে থেকে গত দু’বছরে রাস্তার ধারে অনেক মরা জীবজন্তু দেখতে হয়েছে। প্রত্যেকবার এরকম মরতে বসা জীব রাস্তায় দেখলেই বাবুর মাথায় ন্যায়পরায়ণতার ভূত চাপে। বেচারা জীবটাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার সাধ জাগে। রাস্তার মাঝ থেকে ধারে সরিয়ে দেয়, যাতে বার বার গাড়িচাপা না পড়ে।

মৃতদের প্রতি আচরণ দেখলে মানুষের সম্পর্কে কিছু নিশ্চয়ই বলা যায়, কিন্তু এ কী বাপু! জীয়ন্ত মানুষদের প্রতি তো আগে একটু দরদ দেখা! আমি বলেছি ওকে আগে কয়েকবার। তাতে শুধু ভ্রুই কুঁচকেছে ও।

কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে, কাজটা ও ঠিকই করে। কুকুরটা-বেড়ালটা কারও তো পোষ্য ছিল। কেউ না কেউ তো ওটার মৃত্যুতে দুঃখিত হবেই, পোষ্যদের জন্য তাদের মন কেমন করাটাও খুবই স্বাভাবিক।

দুপুরটা ঠিক পার করে সূর্য এখন এই এন-১ কেটে বেরোনোধুলোমাখা রাস্তায় আমাদের ওপর ঢলছে। রোদ খাঁ খাঁ করছে চারিদিকে। এই কাঁচা রাস্তাটা এন-১ হাইওয়ের পাশেই। পিয়েনার্সভ্লেক্ট শহরটা হ্যানোভার আর পশ্চিম বিউফোর্টের মাঝামাঝি অবস্থিত, কারুয়া অঞ্চলের অন্তত ষাট কিমি ভিতরে। দিনের এই সময়ে কোনো প্রাণীই ছায়ার বাইরে বেরোতে চায় না। যেটুকু খুদকুঁড়ো অবশিষ্ট আছে, তাদের ফ্যাকাশে রোদেজ্বলা রঙ দেখে বোঝাই যায় যে ওগুলো থেকে জীবনের চিহ্ন পুরো ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে।

কুকুরটা পড়ে রয়েছে বটে, কিন্তু আশেপাশে কোনো ভেড়ার পাল চোখে পড়ল না। কুকুরটা এখানে করছিলটা কি? কারও পোষা বলেও তো ঠিক মনে হচ্ছে না।

“বেঁচে আছে এখনও।” বলল থুলানী।

আমার পেটের ভিতরটা কেমন একটা গুলিয়ে উঠল। তাও আমি একটু কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।

একটা সাধারণ শহুরে হাউন্ড। লম্বা লম্বা চার পা, ছুঁচলো নাক, পাতলা বাদামি লোম। কুকুরটা একপাশ ফিরে পড়েছিল। একটা চোখ পরিষ্কার করে কিছুতে খুবলে খেয়েছে বোঝা যায়, দাঁত খিঁচিয়ে পড়ে রয়েছে প্রাণীটা। কিন্তু, ব্যাটা নড়াচড়া করছে তাও। প্রাণটা দপদপ করছে এখনও, বুকের হাড়ের খাঁচা সপসপে শ্বাসে কাঁপছে। আমার ছায়া ওটার উপর পড়তেই কুকুরটা হাল্কা গরগর করে উঠল।

“ওরেবাবা!” আমি পিছিয়ে এলাম।

থুলানী ঝুঁকে কুকুরটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

“হাত দিয়ো না!” বললাম আমি।

ততক্ষণে ওর রামপাঞ্জা কুকুরটার মাথায়। ওই মায়াময় চোখের দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আমারও বুকটা মুচড়ে ওঠে। বারবার। প্রতিবার। জুলু ভাষায় কিছু স্বস্তিবাচক শব্দ বলে ও কুকুরটাকে সাবধানে কোলে তুলে নিল। আমি খেয়াল করলাম, কুকুরটার পিছনের অংশটা ভেতরে ভেতরে কেমন যেন বাকি শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। থুলানী জীবটাকে একটা ছোটো কাঁটাঝোপের ছায়ায় নামিয়ে উবু হয়ে ওটার সামনে বসল।

“এটাকে এভাবে ছেড়ে যাই কীভাবে!” বলল ও।

“আরে, মরতেই তো বসেছে!” আমি বেশ বুঝতে পারছি, রোদে আমার ফ্যাকাশে চামড়া লাল হতে শুরু করেছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। গলায় যেরকম শুকনো ধুলো আটকানোর মত ভাব হচ্ছে, মনে হচ্ছে না গাড়িতে রাখা আমার বোতলের গরম জল খেয়ে সেটা যাবে। আমি অসহায়ের মত হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। এখানে এত মাছি যে কোথা থেকে আসে! হয় চোখে পড়ে নজর আটকায় আর নয় ঠোঁটে সুড়সুড়ি দিয়ে মুখে ঢুকে যাওয়ার জোগাড় হয়।

থুলানী ওর হাতের মুঠোর মতো বড়ো একটা পাথরের দিকে হাত বাড়াতেই আমি বুঝলাম কী হতে চলেছে– coup de grâce অর্থাৎ করুণানিধন। বাঁ হাত দিয়ে গলার পাশটা চেপে ধরে ও ডান হাতে অস্ত্রটা উঁচু করে ধরল। আমি হাতে মুখ ঢেকে ঘুরে দাঁড়ালাম। না, কোনো হতভাগা জীবকে যে ও প্রথমবার এইভাবে মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বার করে দয়া দেখাচ্ছে তা নয়। আমি জানি কী হতে চলেছে। কিন্তু, পাথরের সঙ্গে মাংসের সংঘর্ষের আদিম ‘ঠ্যাপ’ শব্দটা এল না।

কুকুরটা আবার গুঙিয়ে উঠল। থুলানী চাপা গলায় একটা গালাগাল দিল। আমি সাহস করে ভয়ার্ত আঙুলের ফাঁক দিয়ে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলাম।

দেখি, ও লাফিয়ে পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে। পাথরটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছে, আর বাঁ হাতটা পেটের ওপর চেপে ধরেছে। শাদা জামায় লাল রক্তের দাগ স্পষ্ট।

“আরে! কী হল!” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। যদিও এ প্রশ্নের প্রয়োজন ছিল না।

“শালা, বজ্জাত কুকুরটা কামড়ে দিয়েছে।”

থুলানী রাগত চোখে তাকিয়ে রইল কুকুরটার দিকে, কিন্তু ওটা নড়াচড়া করল না। এমন ভাব, যেন ওই শেষ কামড়ে ওর যাবতীয় জীবনশক্তিটুকু বেরিয়ে গেছে। বুকের খাঁচাটাও একটুও ওঠা-নামা করছে না আর। কিন্তু, আশ্চর্য, কুকুরটার ধারে কাছে একটাও মাছি ঘুরছে না। আমার মনে হল, মাছিগুলোর তো আমার থেকে ওই কুকুরটায় বেশি স্বাদ পাওয়া উচিৎ।

কিন্তু, এখন ওসব ভাবার সময় না। আহত হয়েই থুলানীর পরোপকারের ভূত নেমে গেছে। আমি ওকে গাড়ির দিকে নিয়ে গেলাম, ব্যাগের অতল হাতড়ে দেখলাম ব্যান্ড-এড আছে নাকি।

“মায়ের কাছে অ্যান্টিসেপটিক থাকবে।” বললাম আমি। কিন্তু কামড়ানো জায়গাটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভালো লাগল না। দেখলাম, ওর হাতের বুড়ো আঙুলের গোল মাংসে শ্বদন্ত বসে যাওয়ার দাগ। সেলাই করতে হবে এমন না, কিন্তু জলাতঙ্কের ইঞ্জেকশন তো নিতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমার ইচ্ছে হল চিৎকার করে কটা গালাগালি করি। কিন্তু চুপ মারলাম। পিয়েনার্সভ্লেক্টে এই শনিবারের দুপুরে কোথায় আর খোলা পাব ডাক্তারখানা? থোড়ি এখন রাগবি দেখা ছেড়ে ডাক্তার উঠবে। পাশের কালোদের অঞ্চলে ডাক্তার আছে নাকি তাই তো জানি না।

“আমি ভাবতেই পারিনি মালটার মধ্যে এখনো কামড়ে দেয়ার মত শক্তি আছে।” থুলানী চিন্তিত চোখে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে কুকুরটার দিকে তাকাল।

“যাক, যেতে দাও এখন।” আমি ওকে বারণ করলাম। আমি ওকে আগের পাঁচ-ছ’বার কামড় খাওয়ার কথা আর মনে করাতে চাই না। থুলানীর একটা সরল বিশ্বাস আছে যে এরকম আর হবে না আর পরের বার ‘গুড সামারিটান’১ হওয়ার সময়ে কিছু হলে ও সময়ের আগেই তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।

অন্তত আমার সঙ্গে এটা নিয়ে তর্ক আর করল না এবার। আরও অবাক কাণ্ড, আমাকে শহরে ঢোকার আগে শেষ দশ কিলোমিটার গাড়িও চালাতে দিল।

আমার একদম ইচ্ছে ছিল না- ইচ্ছে ছিল না আমার পুরনো দেশে ফিরে আসার। মা আর বাবা— সে ছাড়া আফ্রিকানে আমি ওঁদের আর কোনো নামে ডাকতে পারব না— সিদ্ধান্ত নিল যে এই কারুয়া দরপিতে এসেই শেষ জীবনটা থাকবে। কারণ বাবা এখানেই বড়ো হয়ে উঠেছে আর তার বাবা এখানে একটা জেনারেল স্টোরের মালিক ছিল।

ওরা আমার আর থুলানীর সম্পর্কের ব্যাপারে জানে অবশ্য। তার মানে এটা নয়, যে ওরা মেনে নিয়েছে, কিন্তু আমি আমার অতীতকে আমার ভবিষ্যৎ থেকে আলাদা রাখতে পারব বলে আশা করে আছি। কবে কোন রাজার রাজত্বে ঘি খেয়েছিল সেই ঘিয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কারো পক্ষেই যে সারাটা জীবন দেয়া সম্ভব নয়, সেই কথাটা থুলানী আমাকে বহুবার মনে করিয়েছে- “তোমার শরম লাগে? আমার পরিচয় দিতে লজ্জা করে তোমার? আমাকে নিয়ে আমি তো আমার বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছি তোমাকে। তাহলে তোমার সমস্যা কী? বাবা-মা ও নিশ্চয়ই আমাকে তাঁদের সন্তান হিসেবে মেনে নেবেন।”

“লজ্জা করে তোমার?” এইটেই হল আসল. কথা। আমি এই পুরুষমানুষটাকে সত্যিই পাগলের মতো গভীরভাবে ভালোবাসি, সে ওর সব গতানুগতিক বেয়াড়াপনা সমেতই। ঠিক বোঝাতে পারব না। যখন আরও ছোটো ছিলাম, ভাবতাম আমি একজন সোনালি চুলো অসামান্য রূপবান রূপকথার রাজকুমারকে ডেট করব। কিন্তু থুলানী ওর শান্ত স্বভাব, ওর সম্ভ্রমবোধ দিয়ে আমার অজান্তেই আশ্চর্যভাবে কখন যেন আমাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিল। ভালোবাসার সঙ্গে তোমার সেখানেই দেখা হবে ঠিক যেখানটায় তুমি কখনও খোঁজনি তাকে।

বাকি দেশ যখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে গেছে, সেখানে এই পিয়েনারসভ্লেক্ট ষাঁড়ের গোঁ নিয়ে পুরনো সময়কে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। অধিকাংশ লাল–ইটের বাড়িগুলোই চৌকোপানা, ব্লকের মতো দেখতে বাড়ির কাঠামোগুলো রেললাইনের আঁকাবাঁকা পথকে অনুসরণ করে এগিয়েছে। ভোররাতে ট্রেনের ধাতব ঝনঝনানি আর একলা, কানমাথা ফুঁড়ে নিস্তব্ধ শূন্যতাতে ঠোক্কর দিতে দিতে বেরিয়ে যাওয়া হর্ন শুনতে শুনতেই বাবা বড়ো হয়েছে। কিন্তু সব কার্গোই এখন গাড়ি করেই যায়, রাস্তাও আছে, রেলপথ বলতে গেলে একরকম ত্যাজ্যই হয়ে গেছে। কিন্তু এ-শহরের লোক হল কারুয়ার উদ্ভিদের মতোই একানড়ে, এদের শিকড় ওপড়ানোর পক্ষে অনেক গভীরে চলে গেছে। শয়ে শয়ে বছর ধরে বেঁচে থাকা আদিম মহাদ্রুমের মতো এরা সবরকম ঝড়বাদলই সহ্য করে নিতে পারে।

মা-বাবা থাকে শহরের একেবারে প্রান্তে। ওখানে বাগান বলতে তেমন কিছু নেই। মফস্বলী কুয়োর সাবেকি জল শৌখিন গাছের পক্ষে বোধহয় একটু বেশিই নোনা। কিন্তু তাও দু’খানা দৈত্যাকৃতি পিপারগাছ তাদের সবুজ বিষণ্ণ ডাল ঝুঁকিয়ে অশ্রুজল ফেলছে বাড়ির সামনের অংশটায়। পর্দাগুলো ফেলা। সবসময়েই ফেলা থাকে, যদ্দুর আমি মনে করতে পারছি। আমার বাবা-মা একটা ঝাপসা হয়ে আসা গোধূলিতে জীবন কাটাচ্ছে।

“জামাই আদরের মতো লাগছে না কিন্তু!” থুলানীকে বললাম আমি।

থুলানী কাঁধ ঝাঁকাল। “খালি খারাপ দিকগুলো ভেবে ভেবে তুমি ব্যাপারটাকে আরও ঘোরালো করে তুলছ, আমি নিশ্চিত। ছাড়ো তো এসব! চলো।”

ও গাড়ি থেকে বেরিয়েই একটা সাফসুতরো টি-শার্ট গলিয়ে নিল, কিন্তু আমি আরও কয়েক ধুকপুক বসে রইলাম স্টিয়ারিং আঁকড়ে। নিজের অশান্তির মূল কারণটা আমি খুঁজে বার করতে চাইছিলাম। এখানে ছাড়া আমি অন্য যে কোনো চুলোয় থাকতে রাজি। বাঁচোয়া যে একটাই রাত থাকছি– কাছের একটা হোটেলে ঘরভাড়া করেই রেখেছি আমি। বাপের বাড়িতে একরাত থাকা যাবে কিনা, এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কথা ভাবিইনি আমি।

বাইরের দরজাটা ঠোঁটটেপা অবস্থায় বিশ্রীভাবে দাঁড়িয়ে আছে, আমি নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কী আশা করেছিলাম আমি? আমার বাবা একটা দার্দি কাফিরকে২ তাড়াবার জন্য শটগান হাতে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে? কথাটা যে খিস্তি, সে কি আর জানি না? ঠিক নিগ্রো বলার মতোই অসাংবিধানিক।

থুলানীকে দেখে অবশ্য মনেই হল না যে ও আমার আশঙ্কা নিয়ে আদৌ চিন্তিত। বরং আমার দিকে হেসে ও আমার হাতটা নিজের অক্ষত হাত দিয়ে কষে জড়িয়ে ধরল। আমরা সদর দরজার দিকে এগোলাম।

আমাদের পিছনে চিঁহি শব্দের অ্যালুমিনিয়াম গেটটার ধড়াম করে বন্ধ হওয়া গুলির মতোই মনে হল আমার।

দ্বিতীয়বার ধাক্কা দিতে যাব, এমন সময় বাবা দরজাটা খুলল।

“বাবা!” ডাকলাম আমি, “কেমন আছো?”

বাবার হাসিটা
 অনিচ্ছুক। আমাকে আদরে জড়িয়ে ধরা বা চুমুগুলোও দায়সারা।                  

থুলানী হাত বাড়াল। “মেনিয়ের ক্যুটজিয়।” ওর আফ্রিকান উচ্চারণ নিঁখুত। পুরনো দিনের খুব কম মানুষই এটা আশা করে ওর থেকে, অন্তত প্রথমবার ও মুখ খোলবার আগে। বাবা আপাদমস্তক দেখল ওকে, কিন্তু বাড়ানো হাতটা ধরল না। আফ্রিকানে বলল, “এসো, ভেতরে এসো।”


শাফলিং নাচের৩ মতো বাবার টলমলে চেহারাটা লাউঞ্জ পর্যন্ত অনুসরণ করলাম আমরা। শেষ এসেছিলাম তিনবছর আগে, কী করে এই তিনবছরেই এত ঝুঁকে-পড়া বুড়ো থুত্থুড়ো হয়ে গেল মানুষটা? আমরা পৌঁছোতেই মা ঝমঝমিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। তারপর একটা বড়ো দফা জড়ামড়ি আর চুমুটুমুর পালা চলল।

যেখানে বাবা একেবারেই উন্নাসিক হয়ে আছে, সেখানে মা অন্তত চেষ্টা করছে থুলানীর সঙ্গে মেশবার। ওর বাড়ানো হাতটা যদিও দোনোমোনো করে ছুঁল একবার, তাও বরফ একটু হলেও তো গলছে! আর থুলানী তো মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ‘যেরকম সুন্দরী মেয়ে,
 তেমনই চমৎকার তার মা!’-এর মতো কথাগুলো মা চকোলেটের টুকরোর মতো গিলছে, ওদিকে বাবা আরামকেদারায় বসে গুমরোচ্ছে। বাবা লোককে হ্যাটা করায় ওস্তাদ, আরামকেদারার হাতদুটো শক্ত করে ধরে আমাদের দিকে রাগী চোখে দেখছে। থুলানী বসতে গিয়ে অল্প কাতরে উঠল, আর তখনই কুকুর কামড়ানোর কথাটা আমার মনে পড়ে গেল। 

“মা, থুলানীকে এদিকের রাস্তায় আসার সময় একটা কুকুর কামড়ে দিয়েছে। তোমার কাছে ব্যান্ডেজ আর অ্যান্টিসেপটিক আছে?”

একটা বু্কচাপা অস্বস্তিকর মোলাকাত শুরু করার কী দারুণ কায়দাই না আমি বার করলাম! বাবা চেয়ারেই পড়ে রইল, মা ঝটপট করে আমাদের আগে আগে বারান্দা ধরে এগিয়ে গেল। ধড়ফড় করে যাবার সময় মায়ের চটপটে হাতগুলো ডানা ঝাপটানো চড়ুইয়ের মতো ফ্যাৎফ্যাৎ সাঁইসাঁই করছে। থুলানী মাকে কিছুটা ভয় পাইয়ে দিয়েছে। সম্ভবত বাড়িতে এই প্রথমবার কোনো কালো মানুষ এসেছে অতিথি হয়ে। ভদ্রতা রক্ষা করে মুখ ফুটে কিছু বলার জন্য মা এখনও নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেনি।

দেয়ালের কালো-সাদা ফ্রেমে আমাদের মৃত পূর্বপুরুষেরা চোখ ফালা করে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। তাঁদের মাঝখানে আমাদের এই হঠাৎ আগমণে তাঁরা কী যে ভাবছেন সেটা কল্পনা করার মতো শক্তি নেই আমার।

থুলানী বাথটাবের ধারে বসল, মা ফার্স্ট-এইড বাক্সের সন্ধান চালাচ্ছে বেসিনের নীচের দেরাজে। থুলানী যেভাবে নিজের বাঁ হাতটা খামচে ধরেছে, আর ঘামের একটা ক্ষীণ রেখা মুক্তো হয়ে ওর ওপরের ঠোঁটে টুলটুল করছে, সেটা আমার ভালো লাগছে না।

“ঠিক আছো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে।

ও ঘাড় নাড়ল, “ওই যে, ওষুধপত্র দেখলেই আমার যে ফোবিয়া ধরে, সেইটা।” একটা নিষ্প্রাণ হাসি হাসার চেষ্টা করল ও।


“এটা এই সামান্য একটুখানি লাগবে”, মা বলল বটে কিন্তু তারপরেই থেমে গেল। থুলানীর দিকে তাকিয়ে থাকা আমার মায়ের মুখের ভাবটা ঠিক ধরা গেল না। কিন্তু হাতে ধরে রাখা ওষুধের বাক্সটা আমার হাতে দমাস করে গুঁজে দিল মা। “এই যে, মারীচা, তুই কর। আর হয়ে গেলে রান্নাঘরে আয় আমাকে চা-টা বানাতে সাহায্য করতে।”

বলেই মা এক ঝটকায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

“অদ্ভুত তো।” আমি মন্তব্য করলাম।

“কীরকম?”

“মা-ই সাধারণত কেউ আহত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আশ্চর্য লাগছে যে…”

“সম্ভবত তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চান না উনি।” ও উত্তর দিল।

“না, এটা সেটা না।”

আমার যে মনে হচ্ছে মা ওকে ছুঁতে চায় না, কিন্তু এটা আমি ওকে বলতে চাইছি না।

কামড়ের জায়গার আশেপাশের চামড়াটা নিজের আকারের দু’গুণ ফুলে গেছে। ওটাতে মারকিওরোক্রম থুপে থুপে দিলে থুলানী হিসহিসে আওয়াজ করছে।

“এটার অবস্থা ভালো ঠেকছে না আমার।” ক্ষতটায় অ্যান্টিসেপটিক লাগাতে লাগাতে আমি বললাম। “এবার সত্যিই ডাক্তার দেখানোর দরকার।”

“সোমবার পর্যন্ত ঠিক কাটিয়ে দেব দেখো।”

“জানি না।”

“কাল বিকেলে ফেরবার সময় আমরা মেডিকেল-ক্লিনিকের ইমারজেন্সি ইউনিটে একবার থামতে পারি।” ও আমাকে বলল।

“সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে।” ক্ষতে নতুন ড্রেসিং কাপড়টা ভালো করে মুড়লাম আর আজ আজকের রাত আর কালকের সকালের জন্য বেশ খানিকটা ওষুধপত্র নিজের কাছে নিয়ে রাখলাম। মা নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না।

ও পেইনকিলার খেতে চাইল না কিছুতেই, তবে আমি এই পরিস্থিতিতে যতটা সম্ভব কাজের কাজ করতে পেরে খুশি। থুলানী লাউঞ্জে বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য ফিরে গেল, আর আমি গেলাম মায়ের কাছে, রান্নাঘরে।

“ও সব করার পর ভালো করে হাত-মুখ ধুয়েছিস কি?” মা যেন বেশ খানিকটা রেগেই কথাটা জিজ্ঞেস করল।

“একদম মা।” আমার বয়স আর বারোয় আটকে নেই। মা রান্নাঘরের নিজস্ব গর্ভে কী আশ্চর্যভাবে নিজের আরেকটা সত্ত্বা দেখাবার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে।

মা আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার কাঁধটা চেপে ধরল। রাগী চোখে চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, “ওর টেস্ট হয়েছে?”

“টেস্ট?”

কীসের টেস্ট? মায়ের প্রশ্নের মাথামুন্ডু কিছুই না বুঝে তাকিয়ে রইলাম।

“আরে, এইডস-এর! আমি কি জানি না, এরা সারাক্ষণ কী সব করে বেড়ায়!”      

“মা!” আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরোতে চাইল না।

“আজকালকার যুগে কোনো গ্যারান্টি নেই বাবা, সাবধানের মার নেই।”

আমি এক ঝটকায় মা’র কাছ থেকে সরে গেলাম, “তুমি কারও সম্পর্কে এরকম বলতে পারো না, মা। থুলানী কোনো রাস্তার ভ্যাগাবন্ড টোটসি৪ নয়। আমার বরং বেশি চিন্তা হচ্ছে কুকুর কামড়ানোর ফলে ওর জলাতঙ্ক না হয়ে যায়!”

“তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, শ্লাক আর আমার পক্ষে তোমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া কতটা কষ্টকর। ছেলেটা নিশ্চয়ই ভালো, না হলে তুমি আর কী আর…” মা আর কথাটা শেষ করার মতো শব্দ খুঁজে পেল না।

“আমি ওকে ভালোবাসি, মা। সেটা কি যথেষ্ট নয়? আর ও-ও আমায় খুবই ভালোবাসে।”

“অ্যাড্রিয়ানের কী হল? ও তো ডাক্তারি পড়ছিল।” মা জিজ্ঞাসা করল।

“অ্যাড্রিয়ান আমায় না জানিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘুরছিল, মা!” আমি যতই বোঝাই না কেন যে ও ছেলেটা একেবারে খারাপ, মা’র খালি একই কথা— ও ছেলে ডাক্তার হবে, নামের আগে ডাক্তার বসবে। যেন তাতেই ওর সব দোষ ধুয়ে যাবে।

মায়ের যে আরও অনেক বক্তব্য ছিল সেটা বুঝতেই পারছিলাম, কিন্তু সেই মুহূর্তে আর কিছু না বলে মা আমাকে দিয়ে রান্নাঘরের নানা কাজ করাতে লাগল। সে জন্য আমি কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞ রইলাম তার কাছে। আবার সেই পুরানো দিনে ফিরে গেলাম যেন। সব কিছু নিঁখুত হওয়া চাই। ট্রে-এর উপর নকশা করা ক্রোশে৫ কাপড়, সবচেয়ে ভালো কফি কাপগুলো তার উপর সাজানো। একটা আলাদা জাগে দুধ, চিনির পটের উপর সুন্দর কাপড়ের কাজ করা ঢাকনা। এমনকী, দুধের কেক পর্যন্ত রয়েছে। কিন্তু সে সবের মাঝে দেখি একটা তোবড়ানো টিনের কাপ এখনও রাখা, আর আছে একটা কানা ভাঙা প্লেট। মা নিশ্চয়ই বাগানের মালিকে এসবে করেই খাবার দেয়।

চা নিয়ে বসার ঘরে এসে দেখি, আমার বুড়ো বাপটা প্রায় সোজা হয়ে বসেছে। শুধু তাই নয়, সামনে একটু ঝুঁকে, হাত কোলে রেখে থুলানীর কথাও শুনছে। মুখের খর ভাবটাও অনেকটা কমেছে। থুলানী একটা এন-জি-ও সংস্থার হয়ে শহরের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকাগুলোতে আর-ডি-পি৬ প্রোগ্রামের মাধ্যমে কোথায় কোথায় বিনিপয়সায় বাড়ি তৈরি হবে তা ঠিক করে দেয়। সে সব কথাই বলছিল সে।

বাবা আগে দেশের বড়োবড়ো নির্মাতা কোম্পানিতে জনসংযোগের কাজ করত। থুলানীর কথার সঙ্গে বাবা নিশ্চয়ই কোথাও নিজেকে মেলাতে পারছিল। আমার দেখে ভালো লাগল, কিন্তু নিজের স্বস্তিটা আমি প্রকাশ করলাম না বরং সবাইকে চা আর কেক বিলি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

মা মাঝে মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের “তোমাদের লোকজন” বলে ফেলছিল বটে থুলানীর সামনে। তা শুনে আমি লজ্জায় প্রায় গুটিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু থুলানীর দেখি কোনো হেলদোল নেই। হাসিমুখে কথা চালিয়ে যাচ্ছে সে। দেখে আমি একটু আশ্বস্ত হলাম। পরে নিশ্চয়ই এসব নিয়ে আমার কানে কিছু সুধাবর্ষণ হবে, সে যাক। কিন্তু, এই পুরো বিকেলটা আরও অনেক, অনেক খারাপ হতে পারত। অন্তত আমার ভাইটা এখানে কথায় কথায় ক-বাচক৭ শব্দটা ব্যবহার করার জন্য উপস্থিত নেই! থুলানীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জানার পর থেকে ও আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। ভাইঝিগুলোর সঙ্গে দেখা করতেও আর দেবে না বোধহয়, কখনও।

আমি বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলাম, তাই থুলানীর হাতটা ধরে বসেছিলাম। আর ও-ও আমার হাতটা সামান্য চেপে ধরে গল্প করছিল। বলছিল, কীভাবে একদিন বর্ষার জলের নালা থেকে এক পরিত্যক্ত শিশুকে উদ্ধার করে এনেছিল। ওর হাতটা একটু ঠান্ডা বলে মনে হচ্ছিল আমার। চামড়াটাও কীরকম স্যাঁতস্যাঁতে লাগছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু ওর শরীর খারাপ লাগছে এরকম কোনো ইঙ্গিত পেলাম না। ও কি একটু একটু কাঁপছে? ঠিক বুঝতে পারলাম না।

এক সময়ে যা হওয়ার তাই হল। আমাদের কথা ফুরিয়ে গেল।

বাবা-মায়ের কাছে দুনিয়া আরও ছোটো হয়ে গেছে। খবরের কাগজে যা পড়ে আর টিভি-রেডিয়ো থেকে যা কানে আসে তার বাইরে ওরা কোনো খবরই রাখে না। এই পিয়েনার্সভ্লেক্ট এলাকায় সেলফোনেরই টাওয়ার ধরে না প্রায়, ইন্টারনেট আর থাকবে কীভাবে। মা প্রতি বৃহস্পতিবার বাইবেল নিয়ে আলোচনা করতে যায়, আর রবিবার করে যায় চার্চে। বাবা মাঝেমাঝে অন্য অবসরপ্রাপ্ত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শিকার করতে যায়। ওদের ছোট্ট শহরের বাইরের সবকিছু নিয়ে এমন ভাবেই কথা বলে, যেন বাইরের সবকিছুই কোনো শত্রুপুরীর অংশ। কয়েকমাসের মধ্যে বাবা কিছু শারীরিক পরীক্ষার জন্য পশ্চিম বিউফোর্টে গিয়েছিল, সেইটুকুই।

ডিনারের সামান্য আগেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমি আশা করেছিলাম যে ওরা রাত্রে খেয়ে যেতে বলবে আমাদের, কিন্তু সে কথা কেউ জিজ্ঞাসাই করল না। মা অনুযোগ করল যে মাথা ধরেছে। আমি জানি না মিথ্যে বলল কিনা, কিন্তু সেটা নিয়ে বিবাদে জড়াতে আর মন চাইল না। রান্নাঘরে তখন যা সব বলছিল, তার রাগ এখনও পড়েনি আমার।

“যাক, যা আশা করেছিলাম তার থেকে অনেকই ভালো গেল ব্যাপারটা।” থুলানী গাড়ীতে উঠে বলল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলিয়ে বসল চালকের আসনে।

আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম আর ওর মাংসপেশীতে একটা কম্পন টের পেলাম। “কী গো, ঠিক আছ?”

“আরে, গলাটা একটু ব্যথা করছে শুধু।”

আমি পিছন ফিরে সদর দরজার দিকে তাকালাম -ফাঁকা। বাবা-মা কেউই সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। বার্তা পরিষ্কার; দেখা করতে এসেছিলে, হয়ে গেছে, এবারে ফোটো।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট কামড়ালাম। হ্যাঁ, ওদের জন্য এটা চাপের ব্যাপারই ছিল বটে। কে জানে, পরে কখনও আবার দেখা করতে আসতেও পারি। কিন্তু, আপাতত থুলানীর শরীরটা ভালো নেই আর আমরা ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে পড়ে আছি।

“এই, আমাকে চালাতে দাও না। আজ রাতেই কেপ টাউনে ফিরে যেতে পারব তাহলে। রাস্তায় পেট্রল পাম্পে দাঁড়িয়ে কড়া একটা কফি নিয়ে নেব, কোনো অসুবিধে হবে না।”

আজকের বিকেলের ঘটনা নিয়ে কোনো আলোচনা করতে আমি এখনও প্রস্তুত নই।

ও মাথা নাড়ল, আর মিষ্টি হেসে তাকাল আমার দিকে, “সোনা, আমরা আজ প্রায় সারাদিন রাস্তাতেই কাটিয়েছি। আজ রাতের মতো চলো হোটেলে, একটু বিশ্রাম নিয়ে কাল সক্কাল সক্কাল উঠেই বেরিয়ে যাব। এক রাতে তো আমার হাত খসে যাবে না রে বাবা!”

“কী অবস্থা এখন, দেখি?” আমি ওর হাতটা ধরার জন্য হাত বাড়াতেই ও ঝট করে সরিয়ে নিল।

“আরে, একটু অবশ লাগছে কিন্তু ঠিক হয়ে যাবে।” ও ইগনিশনে চাবিটা ঘোরাল। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার, এই নিয়ে আর কোনো আলোচনা চলবে না। কিন্তু স্টিয়ারিংটায় চাপ দিতেই যে ও একটু কেঁপে উঠছে, সেটা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।

কারুয়াতে প্রত্যেক ছোটো শহরেই একটা করে রয়্যাল হোটেল আছে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে পিয়েনার্সভ্লেক্টও তার ব্যতিক্রম নয়। হোটেলটার দেয়াল বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে মোজাইক নকশা করা আর সামনে অনেকগুলো মাঝারি ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। যা বুঝলাম, এটাই শহরের একমাত্র বারও। যদি না কেউ গরিবদের এলাকার চোলাইয়ের ঠেকগুলোয়৮ যেতে চায় আদৌ। তবে এই শহরের সাদাচামড়াগুলো কোনো অবস্থাতেই ওখানে যাবে না।

আমরা আমাদের বড়ো ব্যাগগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে গাড়ি লক করে দিলাম। রিসেপশনের দিকে এগোলাম। এখানেও মেঝেতে সেই হোটেলটার দেয়াল বড়ো বড়ো স্ল্যাস্টো৯ স্ল্যাব দিয়ে সত্তর দশকীয় মোজাইক নকশা করা। দেয়ালগুলোর হাল্কা রঙ দেখে মনে হচ্ছে যেন সেই “তোমার নাম, আমার নাম” দশকেই শেষ তুলির পোঁচ পড়েছে। দরজায় কমলা রঙের শার্সিও ততধিক পুরোনো। ঘরের কোণে একটা পাতা-ঝরা ফার্ণ গাছ, আর। সামনের ।ডেস্কে ।একটা। পোকায় কাটা মোষের মাথা দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

হলের উল্টোদিক থেকে হল্লা ভেসে এল। বুঝলাম, বারটা ওদিকেই। ওখানে নিশ্চয়ই একদল লোক বসে বিয়ার খাচ্ছে। টিভির আওয়াজ থেকে বুঝলাম, রাগবির ম্যাচ চলছে। হঠাৎ আবার মাতালদের উচ্ছসিত হাসির আওয়াজ ভেসে এল। ডেস্কে কেউ ছিল না, আমরা বোকার মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।

থুলানী একটা নকল চামড়া জড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ারে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। “মনে হচ্ছে টিভিতে পুরনোদিনের সিনেমায় যেমন দেখায় সেরকম চিরগোধূলির অতীতে১০ এসে পড়েছি।”

“আমি বারের দিকটায় গিয়ে দেখি কাউকে পাই নাকি।” আমি বললাম।

“আচ্ছা, তাই করো তাহলে!” ও যন্ত্রণার শব্দ করে বলে ফেলল। নাকের গোড়াটা চেপে ধরে আমাকে ম্যানেজারের কাছে খোঁজ করতে বলল ব্যথা কমানোর কোনো ওষুধ হবে নাকি। এবারে ওষুধ না খেয়ে থুলানী ছাড় পাবে না। ‘সব ঠিক আছে’ মার্কা হাবভাব দেখিয়ে আর কোনো লাভ নেই।

বারে গিয়ে দেখি, ঘরের আবহাওয়া সিগারেটের ঘন ধোঁয়া আর খোলা বিয়ারের গন্ধে ভারী হয়ে রয়েছে। জনাদশেক লোক ঘোলাটে চোখে উপরে ঝোলানো টিভিটা মনোযোগ সহকারে দেখছে। একে ওদের এলাকায় ঢুকে পড়েছি, তায় আবার মেয়ে। ওরা আমায় দেখেও না দেখার ভান করল। বারের ওয়েটারও দেখি ওদের মতোই মন দিয়ে খেলা দেখছে।

“এই যে, একবার শুনবেন?” আমি অন্তত তিনবার বললাম, তবে গিয়ে লোকটা ঘুরে আমাকে দেখল।

“বলুন?” কথা শুনে মনে হল না, আমার কথা শোনার জন্য লোকটা খুব একটা উৎসুক।

“আপনি বলতে পারবেন ম্যানেজারকে কোথায় পাব?”

“আপনি আমাকেই বলুন যা বলার।”

আমি শঙ্কিত হয়ে ঢোঁক গিললাম। “আমি ক্যুটজিয়র নামে বুকিং করেছিলাম, দু’জনের জন্য।”

“ওহ, হ্যাঁ।” সিগারেটটা থাবড়ে নিভিয়ে লোকটা বারের পিছন থেকে বেরিয়ে এল। ওফ! এর থেকে বেশি উৎসাহী হওয়া কি সম্ভব! লোকটাকে দু’টো কথা শোনানোর খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু চেপে গেলাম। আপাতত নিজেদের ঘরে গিয়ে বাথরুমে ঢুকতে পারলেই হল। থুলানীর হাতের অবস্থাটা না দেখলেই নয়।

থুলানীকে দেখেই লোকটা থমকে দাঁড়াল। “আপনি?” লোকটার গলায় বৈরিতা স্পষ্ট। “আমি ওঁর সঙ্গে আছি।” থুলানী দুর্বল হেসে আঙুল দিয়ে আমার দিকে দেখাল।

“ও!” লোকটা হাত-পা নেড়ে ডেস্কের পিছনে চলে গেল। একটা নোংরা ডায়েরি বের করল, আর আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আজকের দিনের পাতাটায় কিছু কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং-মার্কা এন্ট্রি দেখতে লাগল। আমার দিকে চোখ ছোটো করে তাকিয়ে বলল, “ওই নামে তো কোনো বুকিং নেই।”

“কিন্তু, আমি তো টাকা জমা দিয়ে বুকিং নিশ্চিত করেছিলাম।”

“না হবে না, দুঃখিত।” বলার সময় লোকটার গলায় একবিন্দুও অনুশোচনা ছিল না অবশ্য। “আর আমাদের কোনো ঘরও খালি নেই।”

“কী মিথ্যেবাদী রে!” আমি ডেস্কের উপর ঝুঁকে পড়লাম। পাতায় পাকানো অক্ষরে কোনোমতে আমার পদবীটা পড়তে পারলাম। আঙুল দিয়ে লোকটাকে দেখালাম, “ওই যে। আমার নাম লেখা আছে।”

লোকটা দড়াম করে খাতাটা বন্ধ করে দিল। “আপনি কী উল্টোপাল্টা বকছেন, কিছুই লেখা নেই।”

থুলানী হাত তুলে দিল। “আরে দাদা, আপনি কিছু তো ব্যবস্থা করতেই…”

লোকটা মাঝপথেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপনারা আসুন তো দেখি এবারে। আপনাদের মতো লোকজন এখানে আসুক আমরা চাই না। যান, নাহলে কিন্তু পুলিশ ডাকব।”

আমার মাথাটা গেল গরম হয়ে। ঝুঁকে পড়ে লোকটার কলার চেপে ধরতেই যাচ্ছিলাম, থুলানী ময়ালের মতো আমার কোমর জাপটে ধরে আমাকে আটকে দিল।

“আচ্ছা ভাই, বুঝলাম।” ও এমনভাবে হেসে লোকটাকে বলল, আমি হলে তো পাতালে প্রবেশ করতাম।

“থুলানী!” আমি ওকে আটকাতে গেলাম।

“বাবু, প্লিজ আর কিছু বোলো না।”

ওর মেজাজ ।এত ঠান্ডা ।আছে কীভাবে? আমার চোখের কোণে একটা জ্বালা টের পাচ্ছিলাম। একটু বাধা দেয়ার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু শেষমেষ হাল ছেড়ে দিলাম। থুলানী আমাকে ধরে আমাদের ব্যাগের কাছে নিয়ে এল।

“এবারে কী করি?” আমি বুঝতে পারছিলাম যে রাগে, লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেছে। “ওই লোকটাকে এরকম ভাবে ছেড়ে দেব! এটা একদম ঠিক হল না।”

“ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই।” থুলানী বলল। নিজের ভারী ব্যাগটা একহাতে তুলতে গিয়ে একটু কেঁপে উঠল, কিন্তু আমার হাতটা ছাড়ল না। আঁকড়ে ধরে দরজা পর্যন্ত নিয়ে এল।

“তুমি লোকটাকে আমাদের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে জাস্ট মাড়িয়ে বেরিয়ে যেতে দিতে পার না কিন্তু।”

“আরে, ঠিক আছে ঠিক আছে। চলো এখন এখান থেকে।” ও বিড়বিড় করে বলল।

আমার প্রায় কান্না পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওর সঙ্গে ঝগড়া করতেও ইচ্ছে হল না। এইসব পরিস্থিতিতে বিবেকের চরিত্রে থুলানীই আসরে নামে। আমি এরকম সময়ে ওর সিদ্ধান্তে বিশ্বাস করতে শিখেছি। তাই চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম।

***

গাড়িতে ঢুকে সিটে এলিয়ে বসল ও কয়েক মিনিট। ভারী নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে এল। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ীর চাবি ঘোরাল ও।

“আমি সোমবার জিয়ান্ডার সঙ্গে কথা বলব। এরকম ঘটনা নিয়ে ও কাজ করেই থাকে। ও আর ক্রিস এসব নিয়ে তদন্ত করতে খুবই ভালোবাসে, ওরা নিশ্চয়ই আরও তথ্য সংগ্রহ করে ওদের কাগজে ছাপাবে। তারপর স্যোশাল মিডিয়া তো আছেই ঝড় তোলার জন্য। একদম চিন্তা কোরো না!” বলল ও।

ওর কথা শুনে আমার মনে পুলক জাগল খানিক। চোখ মুছে বললাম, “হুঁ। কিন্তু তাহলেও, এখন আমরা কী করতে পারি, বলো? তাতে এই মুহূর্তে তো কোনো সুরাহা পাচ্ছি না।”

“চলো আপাতত শহরের দিকে যাই, কারোর সঙ্গে কথা বলে রাত্রে থাকার বন্দোবস্তটা তো করতে হবে।”

“কিন্তু এখানে তো কাউকে চিনিই না আমরা!”

“আরে এত ভেবো না। তুমি এখন আমাদেরই একজন।”

শহরের যে অংশে সাধারণ মানুষের বাস, সেটা পিয়েনারসভ্লেক্ট এর বাইরের দিকে, রাস্তার দুই পাশে। এ’দিকে পিপার (ঝাল ক্যাপ্সিকামের গাছ) জন্মায় না (এই গাছ পঞ্চাশ ফুট অবধি লম্বা হতে পারে, এবং বড়ো অংশ জুড়ে পত্রবিস্তার করে), রাস্তার আলোর জন্য চতুর্দিক ঝাঁঝালো কমলা আলোয় আলোকিত। ফলে, সূর্যাস্তের পরেও অন্ধকার পুরোপুরি নেমে আসে না এই চত্বরে। সারি সারি ছাইয়ের ইঁটের বাড়ী নিয়মিত আকারে সাজানো রাস্তার দু’পাশে, অধিকাংশের সঙ্গেই রয়েছে টিনের চালে ঢাকা ছোটো ছোটো উঠোন।

যদিও পিয়েনারসভ্লেক্ট অঞ্চল এর মধ্যেই শুনশান হয়ে গেছে, জিঙ্গিসা অঞ্চল মানুষের কলকাকলিতে পরিপূর্ণ। বাচ্চারা চারপাশে খেলে বেড়াচ্ছে, বড়োরা হেঁটে চলে নানাদিকে যাওয়া আসা করছে। পুরোনো শিপিং কন্টেনার কেটে তৈরি গুমটি দোকানের চড়া আলো এসে লাগছে চোখে।

এর মধ্যে আমাদের ছোটো সবুজ টয়োটা ইয়ারিস সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল বটে, কিন্তু থুলানী গাড়িটা আস্তে করল, তারপর জানালার কাচ নামিয়ে দিল। তারপর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক দঙ্গল তরুণের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দিল।

আমি ওদের কথার দশটা শব্দের মধ্যে মেরে কেটে একটা করে বুঝতে পারলাম বটে, কিন্তু বক্তব্যের সারমর্মটুকু পরিষ্কার ছিল আমার কাছে। মাত্র কয়েক বাক্যেই থুলানী হোটেলে আমাদের অভিজ্ঞতা ওদের বুঝিয়ে দিল— ছেলেরা বেশ আমোদ পেয়েছে বলেই মনে হল শুনে। ততোধিক দ্রুততায় ওরা আমাদের কয়েক ব্লক দূরে নোসিফো দ্লাদলা (Dladla) নামে এক মহিলার হদিস দিল, আর জানাল ওঁর বাসায় একটা ঘর খালি থাকলেও থাকতে পারে।

“ও আমার ‘উমলুঙ্গু’, আমার সাদা চামড়ার বন্ধু১১, এত দুশ্চিন্তা কোরো না তো!” একটু আমোদের সঙ্গেই আমাকে বলল ও, “তোমাকে সকলে সাদরেই আমন্ত্রণ জানাবে।”

গাড়ি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলতে লাগল। অবশেষে যখন নোসিফোর সন্ধান পাওয়া গেল, দেখলাম তিনি এক সত্তরোর্ধ মহিলা। থুলানীর টাকার পরিবর্তে তিনি আমাদের একটা বিছানা ছেড়ে দিতে রাজি হলেন, ওদিকে ওঁর এক দঙ্গল নাতি-নাতনিও ওঁর বিছানায় একরাত শুতে বাধ্য হল। আমরা ওদের বাইরের ঘরে বসলাম। ওই বাইরের ঘরটাই ওদের ডাইনিং রুমও বটে, আবার রান্নাঘরও বটে। ফলে আমাদের চারিদিকেই নোসিফোদের জীবনের চলচ্চিত্র ঘটমান বর্তমান হয়ে উঠতে লাগল।

ওদের ঘরের ভেতরে মেঝের পালিশের মত একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। আর ঘরের বাইরেটা যতই সাদামাটা হোক না কেন, দেয়ালে টাঙানো ছিল বড়ো একটা ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি। এই ছোটো বাড়িগুলো আমি যতবারই দেখি, অবাক হই। বাইরে থেকে যতই ছোট্টখাট্টো লাগুক না কেন, ভেতরে এলে মনে হয় জায়গা যেন অনেক। বাচ্চাগুলোর নাম আমি ঠিকঠাক জানতে পারলাম না বটে, কিন্তু ওদের অনুসন্ধিৎসু আঙুলগুলো মাঝে মধ্যেই আমার চুল পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। অবশেষে নোসিফো এক হুঙ্কার ছেড়ে ওদের বাধ্য করল আমায় নিয়ে খেলা বন্ধ করতে।

ঘর খালি হওয়ার পর আমরা ঢুকলাম সেখানে, আর থুলানী শব্দ করে বিছানায় গিয়ে পড়ল। “ওফ, কী দিনটাই না গেল!” চাদরে মুখ গুঁজে ও স্বগোতক্তি করল।

আমি ওই সরু খাটটার এক ধারে বসলাম। এখন এই বিছানাতেই আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে শুতে হবে। আমি ওর কাঁধে হাল্কা ম্যাসাজ করতে গেলাম, দেখলাম ওর টি-শার্টটা ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে, আর ও হাল্কা হাল্কা কাঁপছে।

“আমাদের বোধহয় আজ রাতেই কেপ টাউনে চলে যাওয়া উচিৎ।” বললাম আমি।

“না, ওই গাড়িটায় আর এক মুহূর্ত কাটানো সম্ভব না আমার পক্ষে। আপাতত আমায় বিশ্রাম করতে দাও, ললনা। কালকের ব্যাপার কাল দেখা যাবে।”

“কিন্তু, তুমি যে অসুস্থ! এই অবস্থায় একটা অচেনা জায়গায় রাত কাটাতে আমার একদম মন চাইছে না।”

কোনো উত্তর পেলাম না। থুলানী এর মধ্যেই হতক্লান্ত ঘুমে ঢলে পড়েছিল। আমি কোনোমতে ওকে ঠেলে বিছানায় তুলে দিলাম, যাতে যথাসম্ভব আরামে ঘুমোতে পারে। বিছানায় আর জায়গা নেই বললেই চলে, আর ওর গা এত গরম লাগছে যে ওর গা ঘেঁসে শুতেও অস্বস্তি হবে। ঘরের ভিতরটা স্যাঁতস্যাঁতে, আর জানালাটাও খোলার উপায় নেই— ঝালাই করে বন্ধ করা সেটা। নোসিফোর পরিবার ঘুমাতে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। আমি বেশ খানিকক্ষণ ধরে ভাবলাম, নোসিফোর কাছে অল্প জল চাওয়া উচিৎ হবে কিনা। কিন্তু ভাষার বিভাজনটা প্রায় অনতিক্রম্য বলে বোধ হল।

এই হল অবস্থা। দুই অচেনা অতিথি, যাদের মধ্যে একজন আবার অসুস্থ। সব কাজ মিটিয়ে নোসিফো এসে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ল, আমরা কেমন বোধ করছি দেখতে।

আমি ফিসফিস করে ভাঙা ভাঙা খোসায়১২ নোসিফোকে বললাম যে থুলানী ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে, আর আমাদের রাতে থাকতে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানলাম।

আমি নড়বড়ে আরামকেদারাটায় বসলাম গিয়ে, কিন্তু ঘুম এল না। থুলানীও দেখলাম বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কয়েকটা বাড়ি পরেই একটা চোলাই এর দোকান, সেখানে ক্বাইটো১৩ বাজাচ্ছে কেউ একটা। রাস্তায় লোকজন কথা বলতে বলতে চলছে, হাসাহাসি করছে। এরই মাঝে একটা কুকুর চিৎকার করতে শুরু করল, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আশেপাশের কুকুরগুলোও সঙ্গত ধরল—সবরকম শব্দ মিলিয়ে এক অদ্ভুত ভয় আমার আত্মা চিরে চেপে বসল। সেই নাপাক রবে আমি কেঁপে উঠলাম, আর অযাচিত ভাবেই মনে ড্রাকুলার একটা লাইন মনে পড়ল—রাত্রির শিশুদের সুন্দর সুরঝঙ্কার সম্পর্কে। সে সুরঝঙ্কার আমার যে সুন্দর লাগেনি, তা বলাই বাহুল্য।

হঠাৎই একজনের চিৎকার ভেসে এল, আর শব্দগুলো কমে এল। শুধু দূর থেকে একটা স্টিরিও চলার ভারী গুমগুম আওয়াজ ভেসে আসছিল। মানুষ এর মধ্যে ঘুমোয় কীভাবে? নাকি শুধু সপ্তাহান্তেই এরকম উৎপাত চলে? পাশের ঘর থেকেও নানা শব্দ ভেসে আসছিল। ওই পাতলা দেয়ালে কি আর শব্দ আটকায়!

থুলানী নিঃশব্দে গুঙিয়ে উঠল। ওর আঘাতপ্রাপ্ত হাতটা চাদরের বাইরে ছিল, তাই আমি চট করে একবার আলোটা জ্বালিয়ে দেখলাম ড্রেসিংটার অবস্থা। গজকাপড়টায় কিসের যেন একটা ধূসর দাগ লেগেছে দেখলাম, আর পচা মাংসের গন্ধ নাকে এল জায়গাটা থেকে। হে ভগবান, গ্যাংগ্রিন না হয়ে গিয়ে থাকে আবার! ও আমাকে ক্ষতস্থানটা পরিষ্কার করার সুযোগই দিল না ড্রেসিং করার আগে, আর এখন ঘুমিয়ে পড়েছে, এখন ওকে বিরক্ত করতেই মন চাইল না।

ওকে ঘুম থেকে তোলাই উচিৎ আমার।

কিন্তু ওকে জাগালে নোসিফারাও সেই আওয়াজে জেগে যাবে। নিজের মনেই খানিক গালিগালাজ করলাম নিজেকে। আমার ওকে সোজা কেপ টাউনে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়া উচিৎ ছিল, ওর আপত্তি শোনা ঠিক হয়নি। কিন্তু এখন আর হাত কামড়ানো ছাড়া উপায় নেই।

আমি কল্পকর্ণে মায়ের উপদেশ বাণী শুনতে পেলাম— এই পরিবারকে এমন বিপদে ফেলা আমার উচিৎ হয়নি, মা আমাকে নিজের সমস্যা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার শিক্ষা দেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই।

বোকা, বোকা, বোকাগাধা আমি!

আলো নিভিয়ে, চোখ বুজলাম। বেশ কয়েকবার লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিলাম। মনে মনে ভেড়া গুণলাম, যদি ঘুম আসে! কিন্তু এরই মধ্যে আবার প্রকৃতির ডাক আসছিল। উফ! থুলানীর সঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়ার আগে একবার বাথরুমে যাওয়া উচিৎ ছিল। আর হ্যাঁ, অবশ্যই আমি যাইনি।

কত কিছুই না করা উচিৎ ছিল।

ফোনে দেখলাম, সবে বারোটা বাজতে পাঁচ। মানে, অন্তত ছ’ঘণ্টা এখানে চুপচাপ পড়ে থাকতে হবে। তার আগে তো সবাইকে জাগিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায় না! কিন্তু এতক্ষণ চুপচাপ পড়ে থাকাও সম্ভব না। বাথরুমটা না গেলেই নয়, আর জলতেষ্টাও পেয়েছে।

ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, যে এই আর ডি পি-তে তৈরি বাড়িগুলোতে ঘরের মধ্যেও একটা ছোটো বাথরুম থাকে। কারণ, বাইরের খাটা পায়খানাটা ব্যবহার করতে গেলে যা হত, সে আর বলার নয়। তাতেও, শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে তবে আরামকেদারা থেকে উঠলাম। কোনোমতে বিছানাটা পাশ কাটিয়ে দরজা অবদি গিয়ে পৌঁছে কান পাতলাম। মনে হল, অর্ধশতক ধরে আমি শুধু কান পেতে রই! কিন্তু, নোসিফোর হাল্কা নাসিকাগর্জন আর বসার ঘরের ঘড়ির টিক-টিক ছাড়া কিছুই কানে এল না।

বাথরুমটা হলের উলটোদিকে। দরজাটা দেখলাম পুরো বন্ধ নয়, কিন্তু ঠেলা দিতেই ক্যাঁচ করে উঠল। আমি সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলাম, কেউ যদি উঠে যায়! কিন্তু থুলানী শব্দ করে পাশ ফেরা ছাড়া মনে হল না আর কারো এই আওয়াজে অসুবিধা হয়েছে বলে।

ভিতরে ঢুকে আমি আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। বাথরুমটা ছোটো, স্নান করার ছোটো একটা বাথটব, একটা বেসিন আর কমোড ছাড়া কিছুই নেই। বাথটবটার ধারে দেখলাম ছোটোদের খেলনা সার দিয়ে রাখা— কিছু হাত-পা ভাঙা পুতুল, চড়া রঙের প্লাস্টিক বল, রিং ইত্যাদি।

ফ্রেশ হয়ে আমি বেসিনটায় গরম জল দিয়ে ভর্তি করলাম। জার্সি জ্যাকেটটা খুলে তার কিছুটা ভিজিয়ে নিলাম, যাতে ভিজে তোয়ালের মত ব্যবহার করা যায়। কাল হয়তো পুরো পরিষ্কার লাগবে না, কিন্তু মুখ হাত মুছে আজকের সারাদিনের ঘাম-ক্লান্তি তো কিছুটা দূর করা যাবে।

গরম জলে গা হাত মুছে কিছুটা আরাম বোধ হল। এভাবেই যদি আমার পরিবারের সঙ্গে চা-পান আর তার পরের হোটেলের ঝামেলার স্মৃতিটাকেও মুছে আবছা করে দিতে পারতাম! আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম একটা ক্লান্ত মুখ, গালগুলো লাল হয়ে রয়েছে। যেন কোনোভাবে থুলানীর জ্বরের লক্ষণ আমার মধ্যেও ফুটে উঠেছে।

না, আমি নিশ্চয়ই কল্পনা করছি। আমি তো কুকুরের কামড় খাইনি।

আমি যখন প্লাগটা খুলে বেসিনটা খালি করতে যাচ্ছি, তখন হঠাৎ সামনের দরজাটা হাট করে খুলে যাওয়ার আওয়াজ পেলাম। কেউ কি চুরি করতে এল নাকি!

আমি জামা-কাপড় ঠিকঠাক করে কি করব বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। খুবই অস্বস্তিকর লাগে এরকম সময়ে। কি যে করা উচিৎ, কি যে বলা উচিৎ, এখানে কিরকম ব্যবহার করা উচিৎ, কিছুই ঠিকমত বুঝছি না। দুশ্চিন্তায় মনে হল হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে এসে ধুকপুক ধুকপুক করছে। চেষ্টা করলাম একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে হৃদস্পন্দন নিয়মিত করার। মনে হল, কেবল যদি এক পলকে এই সব কিছুকে একটা দুঃস্বপ্ন বানিয়ে দিতে পারতাম! আমার মনে হল যেন বমি উঠে আসবে, দম বন্ধ লাগছিল।

“কে ওখানে?” নোসিফোর ডাক শুনতে পেলাম।

আমি জবাব দিলাম, “আমি, বাথরুমে।”

তারপর কিছু ফিসফাস শব্দ কানে এল, নোসিফোর পায়ের আওয়াজ পেলাম ঘরের মধ্যে। বাচ্চাগুলোর অনুযোগও কানে এল। বাথরুম থেকে বেরিয়েই সামনের গলিপথে নোসিফোর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। দু’জনেই চিন্তিত, কারণ সামনের দরজা খোলা কিন্তু কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলাম না।

“হাই গো!১৪ আমার যেন মনে হচ্ছে আমি দরজা ভালো করেই বন্ধ করেছিলাম!” নোসিফো দরজার দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতে এগোতে বলল।

আমি দেখলাম নোসিফো উঁকি মেরে বাইরেটা দেখল, তারপর দরজাটা বন্ধ করে তালাটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল।

“এ তো ভারী অদ্ভুত ব্যাপার!” আমি বললাম।

“চাবিটা ভেতরের দিকেই লাগানো ছিল।” নোসিফো ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল।

অবশেষে আমার সম্বিত ফিরল। “থুলানী!” চাপা গলায় ককিয়ে উঠলাম আমি। ঘুরে গিয়ে ঘরটায় ঢুকে পড়লাম ছুটে।

বিছানাটা দেখি লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে, কিন্তু থুলানীর কোনো চিহ্ন নেই ঘরে। আমি নিশ্চল হয়ে বেকুব বনে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাহ তেরি! হঠাৎ ওর হল কী? এরকম দৌড়ে পালিয়ে গেল? হঠাৎ শুনলাম দূরে কুকুরদের পাগলের মত চিৎকার। একজন মহিলাও হঠাৎ কারো উদ্দেশ্যে চেঁচাতে শুরু করলেন।

“ও কি কোনো চোলাইয়ের ঠেকে গেল নাকি?” নোসিফো আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

“এই মাঝরাত্তিরে?” আমি অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম। মনে হচ্ছিল বলি, যে থুলানী মদ প্রায় ছোঁয়ই না, কিন্তু আর বললাম না।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে নোসিফো আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেল। আমি খালি বিছানার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো ব্যাপারটাই একেবারে ঘেঁটে গিয়েছে। একটু আগেই যে মানুষ ক্লান্তি আর জ্বরে আধমরা হয়ে ছিল, সে হঠাৎ এরকম উঠে বেরিয়ে যাবে কেন? বিপদের মাঝে একা ফেলে রেখে এরকম কখনও আগে চলে যায়নি তো ও!

এখন আমার উচিৎ জ্যাকেট-জুতো গলিয়ে ওকে খুঁজতে বেরোনো।

কিন্তু… আমি একা। কালো মানুষদের এলাকায়। রবিবারে মাঝরাতে। এখন তো রাস্তায় মাতালগুলো ঘোরাঘুরি করছেই।

নোসিফোর থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। আর উনি কীই বা করতে পারেন। কল্পনা করলাম আমরা দু’জন বাড়িগুলোর ফাঁকে ফাঁকে থুলানীর নাম ধরে ডাকাডাকি করছি। হাস্যকর।

আমি আমার টপটার একটা অংশ মুঠোর মধ্যে নিয়ে বিছানায় বসে দুলতে লাগলাম। এবার আমি কী করব? আমি তো পুলিশ ডাকতে পারব না, ওরা তাচ্ছিল্য করা ছাড়া কিছুই করবে না। আমি যেন শুনতে পাচ্ছি, ওরা নিজেদের মধ্যে “কালা চামড়ার প্রেমিক-ওয়ালা সাদা চামড়ার পাগলী’টাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।

কিন্তু, ও বাইরে কোথাও আছে। একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

“ধুর শালা!” নিজের মনে আরও দুটো গালাগালি দিয়ে আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। আমি বাড়ি বাড়ি উঁকি মারতে পারব না বটে,

কিন্তু গাড়িটা তো নিয়ে যেতেই পারি।

ওকে খুঁজে পাই, তারপর আর একটা কথাও বলতে দেব না। সোজা এখান থেকে বেরিয়ে কেপ টাউনের দিকে রওনা হব।

***

কোনো লাভ হল না। পূর্বের আকাশ ঘুঘুর ডানার মত ফ্যাকাশে

হয়ে এসেছে, মোরগগুলো অন্তত এক ঘণ্টা হল ডাকাডাকি শুরু করেছে, কিন্তু থুলানীকে খুঁজে পাওয়া গেল না। দু’বার আমি পুলিশের টহলদারির সামনে দিয়ে গেছি, পুলিশের নীলবাতির আলোয় চত্বরটা নীল হয়ে উঠেছিল। সত্যি বলতে কি, আমি জানতেও চাই না ওরা কী নিয়ে তদন্ত করছিল।

হয়তো ঘরোয়া অশান্তি? বা খুন? বা দু’টোই? যদি থুলানী তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে থাকে? ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। আমি আর পুলিশগুলোর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাই করলাম না। পুরো শরীর যেন অসাড়। আমি যেন একটা ভূত, উঁকিঝুকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি আড়াল থেকে কোথায় কী হচ্ছে।

বোকা সাদা মেয়ে, কী করছিস তুই এরকম একটা জায়গায়? কী করছিস? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম আমি।

এরকমভাবে চলতে পারে না। ছ’টা বাজল। সূর্য সবে দিগন্ত পেরিয়ে উঠবে উঠবে করছে। তখন আমি ঠিক করলাম, এবার অন্য কোনো রাস্তা দেখতে হবে। বাড়িই ফিরে যাই, বাবা মা’র কাছে।

আমি বাবা-মা’র সঙ্গে থাকতাম না বটে, কিন্তু বছরে এতবার যেতাম বলে মা আমার জন্য একটা ঘরে আলাদা করে বিছানা পেতেই রাখত, যদি আমি কখনও এসে পড়ি! বাড়িটায় আমি অভ্যস্ত, সেই পুরনো দেয়ালঘড়ি বসার ঘরে টিকটক করে; সী পয়েন্টের পুরানো বাড়িটার পূব-দেশী কার্পেটই এখনও পাতা আছে খাওয়ার ঘরে। কাজেই, এই মুহূর্তে শহরের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বাড়ি বা বাড়ির কাছাকাছি বলতে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে ওটাই।

বাবা আমাকে দেখে অবাকই হল। বাগানে দাঁড়িয়ে কাল্পনিক ঝরা পাতা ঝাঁট দিচ্ছিল, ভোরবেলা বাড়ি থেকে বের হওয়ার একটা দার্শনিক বাহানা। আমাকে গেটের বাইরে দেখেই থেমে গেল, দৌড়ে এল আমার দিকে। “কী হয়েছে!”

এরপর কী হল, তার সবটা আর মনে নেই। এখনও পর্যন্ত আমি নিজেকে ধরে রেখেছিলাম। চুপচাপ যা হয় দেখছিলাম, অপেক্ষা করছিলাম— মনের আবেগ বুঝতে দিইনি। কিন্তু এইবার আর চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলাম না, কোনোমতে বললাম কী হয়েছে।

বাবার মমতার প্রকাশ বিরল বলাই ঠিক, কিন্তু এখন বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরল, কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে দিল। বাবার পোশাক থেকে হালকা ন্যাপথলিনের গন্ধ পাচ্ছিলাম, কিন্তু সেটা ছাপিয়েও গন্ধ পাচ্ছিলাম বাবার গায়ের। মনে হচ্ছিল, যেন সেই ছোটোবেলায় ফিরে গেছি; পাঁচ বছরের সেই ছোট্ট মেয়েটা সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে বাবার কোলে মুখ লুকিয়েছে। ততক্ষণে মাও চলে এসেছে বাইরে, এসে তাড়াতাড়ি আমাদের রান্নাঘরে নিয়ে গেল। আমাকে বসিয়ে হাতে মিষ্টি দেয়া চা ধরিয়ে দিল।

আমি দ্বিতীয়বারের মত সবকিছু বিশদে বললাম। এবার, ধীরে ধীরে সময় নিয়ে বললাম সব কথা।

মা মাথা নাড়ল। “তোর আমাদের কাছে আসা উচিৎ ছিল। ওই নোংরা জায়গায় গিয়ে ঠিক করিসনি। জানিস, গত মাসেই ওখানে একটা নাবালিকা কিশোরী মেয়ের গ্যাং-রেপ হয়েছিল?”

কিশোরীদের গণধর্ষণ তো সব জায়গাতেই হচ্ছে, আমি বলতে চাইলাম। কিন্তু তার বদলে বললাম, “আমরা চাইনি কোনো ঝামেলা হোক।” আর আমি তো জানি আমার বাবা-মা কালো মানুষদের কী চোখে দেখে।

“এখন আর কি, ঝামেলা তো হয়েই গেছে।” বাবা বলল।

“এখন আমরা কী করি, বলো?” মা জিজ্ঞাসা করল।

বাবা মাথা নাড়ল, বলল, “পুলিশের কাছে তো আর যেতে পারব না। আমি বরং বার্টাসকে ফোন করে দেখি, ও যদি ওর মালিটাকে দিয়ে কোনো খোঁজ খবর করতে পারে। আমি চাই না আমাদের মধ্যে কেউ ওই এলাকায় যাক।”

আমার একবার মনে হল বলি, যে ওই এলাকাটার একটা নামও আছে। জিঙ্গিসা।

অগত্যা, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী? বাবা ফোন করছিল, কিন্তু তখন সবার গির্জায় যাওয়ার সময়। মা আমাকে একটা বড়ি খাইয়ে দিল, স্নানের পর যাতে ঘুমোতে পারি।

“একটু বিশ্রাম কর, বাবা সব ঠিক করে দেবে।”

আমি মায়ের কথা শুনলাম। ছোটো সাদা বড়িটা গিলে নিলাম। শান্তির ঘুম, আর পৃথিবীর সমস্যা থেকে স্বল্পক্ষণের জন্য মুক্তি। একটু বিশ্রাম নিলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

***

বাবা মায়ের চাপা কথোপকথনের শব্দ কানে যেতে আমার ঘুম ভাঙল। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। দূর থেকে পুলিশি সাইরেনের আওয়াজ ভেসে আসছিল। আমি কিভাবে বাড়ির বিছানায় এসে পৌঁছলাম সেটা ঠাহর হতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। গত চব্বিশ ঘণ্টায় যা কিছু ঘটেছে মনে পড়তেই আমার প্রায় দম আটকে এল।

থুলানী!

আমি উঠে দৌড়ে বসার ঘরে গেলাম। দেখলাম, বাবা-মা জানালার ভারী পর্দা অল্প ফাঁক করে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে বাইরে কী হচ্ছে দেখতে পারে।

“কেমন লাগছে এখন, মামনি?” মা আমার দিকে ঘুরে মিষ্টি সুরে জিজ্ঞাসা করল। আলতো করে আমায় ধরে সোফার দিকে নিয়ে গেল।

“আমি ঠিক আছি। এরমধ্যে থুলানীর কোনো খবর পেলে?” আমার ইচ্ছে হচ্ছিল জানালার বাইরে কী হচ্ছে দেখি। কিন্তু ঘুমের ওষুধের ক্রিয়া এখনও কাটেনি, মাথাটা ভার হয়ে রয়েছে। মায়ের কথা শোনাই এখন শ্রেয়।

বাবা পর্দাটা টেনে দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “ব্যাপার ভালো ঠেকছে না।”

“কী?”

সাইরেনের আওয়াজ প্রায় শোনা যাচ্ছে না আর, কিন্তু সাইরেন বাজছে। সেই আওয়াজে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে এক ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। ওই শব্দ আমায় আবার মনে করিয়ে দিল যে সব কিছু মোটেই ঠিক নেই। থুলানী ওই এলাকাতেই কোথাও আছে। ও আহত, যদি ওর কিছু হয়ে যায়! কিছু কি ইতিমধ্যেই…

“জিঙ্গিসা অঞ্চলে জোর গণ্ডগোল বেধেছে। গোটা টাউনশিপ জ্বলছে।” বাবা এমন্ করে কথাটা বলল, যেন খুবই সাধারণ ব্যাপার।

“আজ সত্যিই খুব ঝামেলা হয়েছে ওখানে।” মা যোগ করল। “বলছি শোনো, সব ওই যুবলীগের কাণ্ড। ওই ক্লিনিকের ব্যাপারটা নিয়েই নাকি প্রতিবাদ করছে লোকগুলো। আন্দোলন না ছাই! অকৃতজ্ঞ সব! আগে বাপু এরকম হত না।”

একটা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে এত? হতেই পারে না। সম্ভবই না। আজ আমি যখন চলে আসছিলাম তখনও সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। কোনো তাপ উত্তাপ নেই, রোজকার মতোই পরিবেশ। ওখানকার লোকজনও শান্তিতে জীবন কাটাতে চায়, সাতেপাঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই তাদের নেই। আমি জানালার ধারে গিয়ে দেখলাম, আকাশে ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। সর্বনাশ! সর্বনাশ হয়েই গেছে তবে। এই বাড়িটা ওখান থেকে এতটাও দূরে নয় যে পর পর গ্যাসের সিলিণ্ডার ফাটার আমাদের কানে আসবে না।

ওই ধোঁয়ার উৎস আমি জানি। জ্বলছে, বাড়ির পর বাড়ি জ্বলছে ওখানে। পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।

“তুমি যে বললে বার্টাসকে ফোন করবে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“বার্টাস জ্যাকোকে ফোনে পাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পায়নি।”

যাহ। ব্যাপার সুবিধের ঠেকছে না মোটেই।

নীলবাতি জ্বালিয়ে একটা পুলিশের ভ্যান দেখি ধীরে ধীরে রাস্তা দিয়ে আসছে। বুকে ধুকপুকুনি জাগিয়ে আমাদের সামনে দিয়েই চলে গেল গাড়িটা।

আমরা বাড়ির বাইরে চলে এলাম। পিয়েনার্সভ্লেক্টে এত উত্তেজক ঘটনা গত কয়েকমাসে অন্তত ঘটেনি। সাধারণত এরকম কিছু হলে আমি বেশি কিছু জানতে চাই না, কিন্তু এবারের ঘটনার সঙ্গে যে আমার জীবন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। হে ভগবান, থুলানীর যেন কিছু হয়ে না যায়!

আমরা দেখলাম, রাস্তার দুই দিকে একজন করে পুলিশ অফিসার, তাঁরা প্রত্যেক বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ছেন, এবং সাড়া পেলে তাদের সঙ্গে চাপা গলায় কথাবার্তা বলছেন।

“এই, তোমরা দু’জন ভেতরে যাও দেখি,” বাবা বলল।

আমি বললাম, “বাবা, আমি শুনতে চাই ওঁরা কী বলছেন।”

মা আমার হাত ধরে হাল্কা টান দিল, “মারীচা, চলে আয় মা, বাবার কথা শোন!”

আমি এক মুহূর্তের জন্য ভাবলাম, বিদ্রোহ করি। কিন্তু তারপর ভাবলাম, আমার সঙ্গে বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অনুযোগ করলে সেই কথাটাই ঠিক প্রমাণ করব আমি। অতএব, আমি হাল ছেড়ে বাধ্য মেয়ের ভূমিকায় অভিনয়ে নামলাম।

কান গরম হয়ে গেছে। ঠিক করলাম, পুলিশ যখন আসবে তখন আমি বসার ঘরেই থাকব। তবে কথাবার্তা যা হল তার অনেকটাই শুনতে পেলাম না, কিন্তু লোকটা যেরকম হাবভাব করল আর বারবার পিস্তলের হোলস্টারে হাত দিল, আমি টের পেলাম গুরুতর কিছু হয়েছে।

“কী বলল?” বাবা বাড়িতে ঢুকতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“বিশাল ব্যাপার, বুঝলি? বিরাট ঝামেলা।” বাবা লোহার দরজাটা সশব্দে, বাড়ি কাঁপিয়ে বন্ধ করতে করতে বলল।

মা-ও চলে এল, জিজ্ঞাসা করল, “কী হচ্ছেটা কী?”

“জিঙ্গিসাতে বিক্ষোভ হচ্ছে। ওরা পশ্চিম বিউফোর্ট থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ডেকেছে।” বাবা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল; যেন আর কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না।

“এবার?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“আমরা চুপচাপ বসে থাকব।” বাবা কিছুক্ষণ ভেবে বলল।

“যতক্ষণ না শুনছি গোলমাল মিটেছে, আমরা কোনো কারণেই ঘরের বাইরে পা দেব না।” বাবা ঋজু কুজকাওয়াজের ভঙ্গিতে আমাদের পাশ কাটিয়ে শোয়ার ঘরে চলে গেল।

ভারী লকার খোলার শব্দে মা আর আমি পরস্পরের দিকে অস্ফুট চোখে তাকালাম। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি বাবা দোনলা বন্দুকটার নিশানা ঠিক করছে।

“কোনো কাফির আমাদের ঘরে ঝামেলা করতে এলেও এটা ডিঙোতে পারবে না!” বাবা বলল।

“বাবা, এরকম তুমি বলতে পারো না ওদের!” আমি বললাম।

বাবা এমন ভাবে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল, যে আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম কথাটা বলা ঠিক হয়নি। “বাড়িটা আমার, আর এখানে আমি যা ইচ্ছে তাই করব। তুমি ভেবো না, তোমার শহুরে কাফির প্রেম দেখে আমি গলে যাব।”

“শ্লাক!” মা কিছু একটা বলতে গেল।

“এই যে, যাও দেখো গ্যারেজের দরজাটা ঠিক করে বন্ধ করা আছে নাকি!” বাবা মাকে নির্দেশ দিল।

মা নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমিও তাই করাই ঠিক করলাম।

আমার ঠান্ডা লাগছিল এবার। আমি ঘরে গিয়ে আমার জ্যাকেটটা নিলাম, তারপর বসার ঘরে গিয়ে টিভিটা খুললাম। দেখা যাক, টিভিতে কিছু খবর দেখাচ্ছে কিনা। কিন্তু, নাহ। এখানে সামান্য যে কটা চ্যানেল আসে তাতে এইসব নিয়ে টুঁ শব্দটি নেই। আমার বাড়ির লোকের ডি-এস টিভির খবরে কোনোই আস্থা নেই, আর যা এস-এ-বি-সি চ্যানেল এখানে আসে তাতে সবকিছু এতই মিষ্টি মিষ্টি, সুন্দর প্রোগ্রাম দেখানো হয় যে মাঝে মাঝে ভাবি ওরা আদৌ কিছু নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে পারে না কি।

মরিয়া হয়ে শেষে আমি আমার ফোনের ইন্টারনেট চালাতে গেলাম, যদি গুগলবাবা কোনো সন্ধান দিতে পারেন! কিন্তু দেখি নেটের সিগন্যাল নেই। কমিউনিকেশন ব্ল্যাকআউট। নিশ্চয়ই জ্যামিং চলছে। এই না-জানাটা আরও অস্বস্তিদায়ক। বাইরের দুনিয়া গোল্লায় যাচ্ছে, আর আমি এই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী। হঠাৎ শুনি, আবার নতুন করে সাইরেন বাজছে।

বাবা এসে একবার জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাইরে কী হচ্ছে। আমার দিকে তাকালও না। জনরোষের সামনে বাবার ওই সবেধন দোনলা বন্দুক কিস্যুই করতে পারবে না। কেপ টাউনে এরকম বিক্ষোভকে খুব কম সময়ে ভয়াবহ আকার নিতে দেখেছি আমি। যখন বোধহীন উন্মত্ত জনতা পথে নামে, তাদের সামনে থেকে সরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

রাত হল ক্রমে। মা আমায় রান্নাঘরে ডাকল। আমি ডিনার বানাতে সাহায্য করলাম কিছুটা, যাতে মনটা একটু সরানো যায় বাইরের এই ঝামেলা থেকে। টোস্ট, চিজ, বরফে জমানো সবজিকে গরম করে তৈরি স্যুপ– অন্য যে কোনো রবিবারের মতই, যখন আমি বন্ধুদের নিয়ে রান্না খাওয়াদাওয়া করে বিকেলটা কাটাই।

তফাৎ শুধু এটাই, যে এই রবিবারের সন্ধ্যেটা অন্যবারের মতো নয়। থুলানীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা কিছুতেই আমায় শান্তি দিচ্ছে না। কথাটা বুকের ভিতরে বাসা বেঁধে ব্ল্যাকহোলের মতো আমার সমস্ত আনন্দ আর শান্তি শুষে নিচ্ছে।

ইতিমধ্যে দেখি বাবা দোনলা বন্দুকটা রান্নাঘরের পিছনে তাকের উপর নিয়ে এসে রাখল। বন্দুকটার নলটা এমন চকচকে আর কালো যে আমি ওটাকে একটা মাম্বা সাপ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারলাম না, যেন কাছে গেলেই ছোবল দেবে। বাবা গায়ের জ্যাকেটটা একটু উঁচু করে রেখেছে, যাতে কোমরের পিস্তলটা দেখা যায়। দেখেই মনে হচ্ছে, যেকোনো বিপদের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত। আমার ভয়ের কোনো কারণ নেই।

তাহলে, আমি ভয় পাচ্ছি কেন?

আমরা সবে খেতে বসেছি, এমন সময় একটা কাচ ভাঙার চাপা শব্দ আমাদের তিনজনকেই ঝাঁকুনি দিয়ে থামিয়ে দিল। ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বাবা বলল, “আওয়াজটা মনে হচ্ছে পাশে স্টিভির বাড়ি থেকে এল।”

মা কিছুই বলল না, কিন্তু চেয়ে দেখি মায়ের ঠোঁট বিস্ময়ে, ভয়ে সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। কে জানে, আমার চোখদুটোও মায়ের মতই গোল হয়ে রয়েছে কিনা!

বাবা চেয়ারটা সশব্দে পিছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াল; এতই জোরে, যে রান্নাঘরের মেঝের লিনোলিয়ামে দাগ পড়ে গেল।

“যাই, গিয়ে দেখি ব্যাপারটা কী।”

“যেয়ো না গো!”, মা বলতে গেল, “পুলিশ যে বলল…”

“পুলিশ যে কোনোই কম্মের না, সে তো তুমি ভালোমতই জানো।” বাবা খিঁচিয়ে উঠে মাকে চুপ করিয়ে দিল।

আমি বাবার পিছন পিছন গেলাম। বাবা এমনভাবে বন্দুক উঁচিয়ে রেখেছে, যেন শত্রু দোরগোড়ায় চলেই এসেছে।

যখন ছোটো ছিলাম, প্রতি রাতে দেখতাম বাবা আলমারি থেকে পিস্তলটা বের করছে। রাতে বাবা ওটা হাতের কাছে রেখেই ঘুমাত, যদি ঘরে চোর আসে! আমার মনে পড়ে না, বাবা আগে কখনও ঘরের মধ্যে বড়ো দোনলা বন্দুকটা বের করেছে বলে। এ দৃশ্য ঠিক কতটা উদ্বেগজনক, কতটা, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

আমি বাবার সঙ্গে বাইরে বেরোতে যাচ্ছিলাম। বাবা বাধা দিয়ে বলল, “যা, তুই মায়ের কাছে থাক। দরজাটা বন্ধ করে দে, আর অন্য কেউ এলে খুলবি না। কোনো পরিস্থিতিতে…” বাবা একটু থামল। তারপর অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে কথাটা শেষ করল আমার দিকে চেয়ে, “কোনো পরিস্থিতিতেই ঘরের বাইরে পা রাখবি না। যাই শুনিস না কেন। বুঝেছিস?”

সায় দিয়ে মাথা নাড়া ছাড়া আমার কিছুই করার ছিল না, কিন্তু আমার হৃদপিণ্ডটা এতই জোরে ধুকপুক করছিল যে মনে হচ্ছিল যেন এবার ফেটেই যাবে।

বাবা খুবই দৃঢ়চেতা পুরুষ, কিন্তু বয়স তো হয়েছে। সেটা যেন এই প্রথম লক্ষ করলাম আমি। ছোটোবেলায় আমাকে কাঁধে ঘরে সর্বত্র ঘুরে বেড়াত এই মানুষটা, কিন্তু এখন আমি বাবার সমান সমান লম্বা। বাবা টর্চ বের করে আলো জ্বালাল। টর্চটা নিশ্চয়ই এতক্ষণ পকেটেই ছিল। শেষবারের মতো বাবাকে দেখলাম, যখন টর্চের কম্পমান আলোর মাঝে দৃশ্যমান বাবার সিলুয়েটের ছায়াটা সামনের গেটটা খুলে পাশের বাড়ির দিকে মিলিয়ে গেল।

আমি তবুও কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। শোনার চেষ্টা করলাম, যদি কিছু কানে আসে। যতক্ষণ ওখানে দাঁড়ানো উচিত তার চেয়েও হয়তো একটু বেশি, ইন্দ্রিয়গুলো নিংড়ে নিয়ে রাতের কালিমায় কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলাম বারবার। অন্ধকার রাত,
 বাতাসে পোড়া প্লাস্টিকের গন্ধ ভাসছে, জিঙ্গিসার দিকের নরক লাল আকাশের অনুজ্জ্বল আভা আমার শরীরের অনেকটা গভীরে ঢুকে এসে কাঁপ ধরিয়ে দিল। আরো একবার। 

ভগবান, থুলানীর যেন কিছু না হয়! ও যেন ঠিক থাকে!

কিন্তু, যুক্তিবুদ্ধি বলছে, ও আর যেমনই থাক, ঠিক কোনোমতেই নেই।       

এসব চিন্তাকে আমি মনে ঠাঁই দিতে চাইলাম না। যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যিটা না জানছি, সেটাকে উপেক্ষার ভান করাই যায়।

হঠাৎ তিনটে বাড়ি পরে একটা কুকুর এমন কেঁউ কেঁউ করা কান্না শুরু করল, যেন প্রলয়ের সূচনা হয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে সব ধ্বংস হয়ে চলেছে। সেই আওয়াজ কানে যেতেই আমি ঠকাস করে গেটটা বন্ধ করে দিলাম, আর খুব ভালো করে দেখে নিলাম গেটের চাবিটা ঠিক করে বন্ধ হয়েছে কিনা।

এমন সময়ে, আচমকা সমস্ত আলো নিভে গেল, আর মা রান্নাঘর থেকে চিৎকার করতে শুরু করল।

“মা!” বলে চিৎকার করে আমি দৌড়ে ভেতরে চলে গেলাম। তাড়াহুড়োয় ঠিক সময়ে রান্নাঘরের দিকে বাঁক না নিতে পারার ফলে দেয়ালে দড়াম করে এক ধাক্কা খেলাম, তাতে আমার দম বেরিয়ে গেল প্রায়।

“দেখ কারেন্টও চলে গেল!” মা প্রায় কেঁদেই ফেলল।

“আরে, ঠিক আছে, ঠিক আছে, কারেন্টই তো গেছে। বিল ঠিকঠাক দিয়েছিলে তো?”

“শুক্রবারই তো দিলাম।” মা বলে উঠল।

“তাহলে হয়তো কিছুক্ষণের জন্যই গেছে, দেখো।” আমি পকেট থেকে ফোনটা বের করে টর্চটা জ্বেলে দেখলাম ফিউজটা উড়ে গেছে নাকি। কিন্তু দেখলাম, সবই ঠিকঠাক আছে। “নিশ্চয়ই ট্রান্সফর্মার গেছে, মা। এখন ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নেই।”

“না রে, ব্যাপার ভালো ঠেকছে না।” মার গলায় আশঙ্কা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।

“সে তো আমারও না। কিন্তু কী করি, বলো? মোমবাতিগুলো নিয়ে আসি বরং।” আমি মানতে চাইছি না, কিন্তু এই জমাট অন্ধকার যেন আমার গলা টিপে। ধরছে, । পাষাণের মতো ভারী শরীর নিয়ে আমার ওপর উঠে

এসেছে, প্রবল শক্তিতে আমাকে চেপে ধরতে চাইছে মেঝেতে।

“লম্বা করে শ্বাস নে, মারীচা! নিশ্বাস নিতে থাক!” নিজেকেও বোঝালাম আমি।

দেশলাইটা জ্বালাতে গিয়ে আমার হাত কেঁপে উঠল, কিন্তু ক্ষণিকের জন্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখে একটু স্বস্তি বোধ হল ঠিকই। মোমবাতির আলোয় আমাদের লম্বা, ভুতূড়ে ছায়া পড়ল দেয়ালে।

“ওরে, তোর বাবা ঠিক আছে, বল?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বাবার হাতে দোনলা বন্দুক, কিচ্ছু হবে না।” আমি বললাম।

পুরো বাড়িটা এতটাই বিরক্তিকরভাবে নিস্তব্ধ হয়ে ছিল যে আমি ফ্রিজের হাল্কা ঘুরঘুরানির আওয়াজটারও অভাব বোধ করলাম। শুধু গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটার অনন্ত টিক-টক শব্দটা ব্যতিক্রম। মনে হচ্ছিল অন্ততকাল ধরে চলবে সেই টিকটক শব্দ, যতক্ষণ পর্যন্ত ঘড়িটায় দম দেয়ার কেউ আছে।

মা বসার ঘরে যেতে চাইল, যাতে অন্তত জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়। আমি বাতিদানটা টেবিলে রেখে মাকে ভারী পর্দাটা সরাতে সাহায্য করলাম। বাইরের অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে খান পাঁচেক ধুকপুক লাগল। লক্ষ করলাম, পুরো পাড়া জুড়ে কারেন্ট নেই।

এমন সময় খেয়াল করলাম, রাস্তায় কারা যেন রয়েছে। পাঁচজন লোক মাতালের মত টলতে টলতে চলছে। দেখা মাত্র আমি দৌড়ে গিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলাম। ঠিক বলতে পারব না কোন সহজাত প্রবৃত্তির বশে কাজটা করলাম, কিন্তু লোকগুলোর টলতে টলতে এগিয়ে চলার মধ্যে কিছু একটা ছিল, যা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল।

“এই, বাতিটা নেভালি কেন?” মা জিজ্ঞাসা করল।

“শশশশ!” মাকে চুপ করিয়ে জানালার দিকে হাত দেখালাম। “রাস্তায় কয়েকজন আছে। আমার ভালো লাগছে না।”

মা আর কিচ্ছুটি বলল না। যদিও আমরা দু’জনই একইরকম ভাবে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছি, তবু মা সটান আমার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় একটু ভরসা পাচ্ছিলাম।

ঠিক তখনই পাশের বাড়িতে বন্দুক চলার আওয়াজ শুনে আমরা

দু’জনেই লাফিয়ে উঠলাম।

বাবা!

মা চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠল। আমি মাকে চেপে জড়িয়ে ধরলাম। “সব ঠিক আছে, মা, সব ঠিক আছে।” মায়ের কানে ফিসফিস করে বলয়াম আমি। মা আমার গাল বেয়ে গড়ানো জলের ধারাটা দেখতে পাচ্ছে না, এটাই এখন যা সান্ত্বনা।

একটা লোকের অসংলগ্ন চিৎকার শুনতে পেলাম, কিন্তু ঠিক কী বলছে সেটা বুঝতে পারলাম না। আবার কাচ ভাঙার শব্দ পেলাম। আবার শব্দ হল গুলি চালানোর।

রাস্তার ওই লোকগুলো এবার দিক বদলে স্টিভির বাড়ির দিকে পা বাড়াল। বাবাও ওখানেই আছে, আর আওয়াজে শুনে তো মনে হচ্ছে কাউকে গুলিও করে ফেলেছে। আমি গুটিগুটি সদর দরজার দিকে এগোনোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু মা আমাকে এত জোরে চেপে ধরল যে আমার পা আটকে গেল।

“ওরে, যাস না।” মা বলল, “তোর কোনো ক্ষতি হোক, সেটা তোর বাবা চায় না।”

“কিন্তু স্টিভি? বাবা? কী হচ্ছে ওখানে? আমাকে দেখতে দাও গিয়ে!”

“না মা, যাস না, কথা শোন! এখানেই থাক আমার পাশে।”

“আমায় কিছু তো একটা করতে হবে, বলো?” আমি ছটফট করছিলাম।

“তাহলে তুই থানায় ফোন কর একটা।”

“ওরা নিশ্চয়ই এখন খুব ব্যস্ত।” বলতেই বলতে আমি টেলিফোনের দিকে পা বাড়ালাম।

যাক, অন্তত জরুরি ফোন নম্বরগুলো ফোনের পাশেই একটা কার্ডে লিখে রাখে বাবা আর মা। আমি আমার মোবাইলটাও দেখলাম, ব্যাটারি আছে এখনো অনেকটা। যাক বাবা!

কিন্তু ফোনে সিগন্যাল নেই। কারেন্ট যাওয়ার সঙ্গে মনে হয় ফোনটাও বিগড়েছে একই কারণে।

“ধুরছাই, হলটা কী?” আমি বিড়বিড় করলাম। ভেতরখোঁড়া ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। অজান্তেই গলা দিয়ে একটা আর্ত শব্দ বেরিয়ে এল। এই বাড়িতে এক মুহূর্ত থাকতে আর মন চাইছে না, কিন্তু বাইরে যাওয়াও তো সম্ভব নয়। ওই অন্ধকার ঘুরঘুর করতে থাকা টলমলে ছায়াগুলো কি…

আমি যে কতক্ষণ হাতে ফোনের বিকল রিসিভারটা নিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম, নিজেও জানি না। শুধু মনে আছে, খুব মন দিয়ে নিজের নিশ্বাস প্রশ্বাস লক্ষ করছিলাম আমি। জানি না এখন আমি কী করব? কিচ্ছু জানি না।

সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। আগে কখনও কোনো সমস্যা হলেই বাবা সেটা গিয়ে মেটাত। সে গাড়ির টায়ার ফুটো হলেই হোক বা কারও চোটই লাগুক, বাবা সব সময়েই জানে কী করতে হবে। কিন্তু এখন বাবাই এখানে নেই। এতদিন থুলানীর সঙ্গে থেকে আমি ওর উপরও অজান্তেই কখন যেন নির্ভর করতে শুরু করেছিলাম। সেটা এই মুহূর্তে অনুভব করে আরও বেশি খারাপ লাগল।

মোমবাতির আঁকাবাঁকা শিখার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে নাচতে মায়ের ছায়াটা এগিয়ে এল আমার দিকে।

“কী রে। সব ঠিক আছে তো?”

“মা, লাইনটা মনে হচ্ছে… ‘ডেড’।”

কথাটা বলতেই মায়ের চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখতে পেলাম।

“এবারে কী করি? শ্লাক ঠিক আছে কিনা খোঁজ নিতে হবে তো?”

“জানি, মা…” আমি ঠকাস করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। চুলের মধ্যে আঙুল দিয়ে টানলাম খানিক। ব্যথা লাগলে হয়তো মনটা অন্যদিকে ঘুরতে পারে! কিন্তু বলাবাহুল্য, ওতে কাজের কাজ কিছুই হল না।

এমন সময় শব্দটা শুনতে পেলাম। সামনের ঘরে বসে থাক সত্ত্বেও থেকেও পিছনের দরজায় ধাক্কার আওয়াজটা এত জোরে এল, মনে হল কেউ যেন দরজাটা কবজা থেকেই উপড়েই নেবে। হাতলটা এমন পাগলের মতো নড়ছিল, যেন এক অধৈর্য্য শিশু ভেতরে আসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।

মা চেঁচিয়ে উঠল ভয়ে। মনে হল, মোমবাতিটা হাত থেকে পড়েই যাবে এবারে।

“বাবাই এল নাকি?” বলে উঠলাম। কিন্তু বলে নিজেরই বিশ্বাস

হল না। বাবা ওরকম পিছন দিকে থেকে এসে দরজা খটখট করে ভয় দেখাবে কেন?

আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম, আর বাইরে যে ছিল সে হঠাৎই দরজা

দুম দুম করে ঠুকতে শুরু করল। ভাগ্যিস, দরজাটা মোটা কাঠের তৈরি!

“কে? কে ওখানে?” আমি ডাক দিলাম।

একটা গোঙানির শব্দ শুনতে পেলাম শুধু, তারপর আবার দরজা ঠোকা শুরু হল। শুনতে পেলাম, দরজায় নখের আঁচড়ের শব্দ, কাঠের চোঁচ বেরিয়ে যাচ্ছে মনে হল। সত্যিই শুনলাম, না সবটাই আমার কল্পনার ফসল?

মা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়, হাতে ধরে রাখা মোমবাতিটা হেলে গিয়েছিল। মোম গলে গলে মেঝেতে পড়ছিল।

“কে, রে? কে ওখানে?”

“উঁহু! বাবা তো মনে হচ্ছে না!” আমি ঢোঁক গিললাম জোরে। চোখ বুজে কান্নাটাকে আটকাতে চাইলাম। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল প্রায়। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো লাগছিল নিজেদের।

মরব, মরব। আমরা নিশ্চিত মরতে চলেছি।

“ভেতরে আসতে দে…!” গলাটা এমনই শুকনো আর কর্কশ, যেন পুরোনো খবরের কাগজ মোচড়ানোর মতো শব্দ করছে কেউ।

“ওটা বাবা নয়!” আমার আদিম সহজাত প্রবৃত্তি আমাকে বলছে, চুপচাপ পিছিয়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দে। বন্ধ করে দে দরজা। কিন্তু, কী লাভ? কতক্ষণ?

কাঁপতে কাঁপতে আমি বেসিনের দিকে এগোলাম। জানালার পর্দাটা অল্প ফাঁক করে ফোনের টর্চের আলোটা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু, জানালার কাচে নিজের আবছা প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।

হঠাৎ একটা হাত এসে শার্সিতে ঘা দিল। জানালার কাচের উপর চেপে বসল একটা মুখ।

সে মুখে গালের চামড়া দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা খোলস। চোখদুটো মরা মাছের মতো যেন। মুখ দিয়ে রক্তমাখা লালা গড়িয়ে শামুকের পথচলা আঠার মত দাগ রেখে গেল জানালায়।

আমি কোনোমতে জানালা থেকে পিছিয়ে গেলাম, ধাক্কা লেগে একটা চেয়ার পড়ে গেল উল্টে। আমার চিৎকারে মায়ের হাত থেকে মোমবাতিটাও পড়ে গেল। হাত থেকে ফোনটা যে পড়েনি, এই ভাগ্যি!

“মা, এখান থেকে পালাতেই হবে। এখানে থাকা আর নিরাপদ না।” এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কথাগুলো বলে আমার হাসিও পাচ্ছিল। কিন্তু মুখ থেকে কেবল কান্নার গোঙানিই বেরিয়ে এল। আর পারা যাচ্ছে না। এসব আর নিতে পারছি না। হে ভগবান, সত্যিই এ সব কী হচ্ছে আমাদের সঙ্গে!

মা উবু হয়ে হাঁটুর ফাঁকে মাথা দিয়ে, হাত দিয়ে মাথা ঢেকে আহত পশুর মত কাঁদছে। “শ্লাক, ওগো, কোথায় চলে গেলে? আমার যে খুব ভয় করছে এবার!”

কিন্তু, বাবা এখানে নেই। থুলানীও নেই। এই শহরে যে পাগলামির ভূতই চাপুক, না আমাদের আর এখানে থাকা উচিৎ, না আশা করা উচিৎ যে কেউ এখানে আমাদের বাঁচাতে আসবে।

মরে গেছে। থুলানী মরে গেছে। আর বেঁচে নেই ও। তুই তো জানিস সত্যি করে কী হয়েছে। আমার মনের ভিতরের অন্ধকার প্রবৃত্তি ক্রমাগত কু গাইতে লাগল।

“চুপ কর। চুপ করে থাক।” আমি নিজেই নিজের মনকেই ধমকালাম।

তারপর, আমি সত্যিই হাসতে শুরু করলাম।

উঠে বসলাম। হাতটা গ্রিলের উপর ঘসে যাচ্ছিল, সেটাকে পাত্তা দিলাম না। বাবা আর কিছু করুক বা না করুক, বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিন্তু ঢেলে সাজিয়েছে। যতই হোক, এটা আফ্রিকা।

আমি আগে মজা করে বলতাম, এতরকম দরজা গ্রিল লাগিয়েছে যে ঘরে আগুন লাগলেও দৌড়ে পালাতে পারব না। এখন মনে হচ্ছে, এগুলো লাগিয়ে আসলে ভালোই করেছিল।

“ভেতরে আসতে দে!” পাগলটা হাপড়ের মতো নিশ্বাস নিতে নিতে বলছে, “কী অসম্ভব ক্ষিদে…”

“যা এখান থেকে!” আমি চেঁচিয়ে বললাম। তারপর, যথাসম্ভব শান্ত গলায় মাকে বললাম, “মা, চলো। এবার পালাতে হবে।”

মা কোনো উত্তর দিল না, শুধু বাবার নামটাই বার বার বলতে থাকল।

আমি বুঝলাম, আর কিচ্ছু করার নেই। কোনোমতে গাড়িতে উঠে পালানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এই বাড়িতে আর থাকা যাবে না। অন্য কেউ আমাদের হয়ে সব করে দেবে, সে আশাও দুরাশা। আপাতত আমি মাকে ছেড়ে নিজের জিনিসপত্র নিতে গেলাম। গুছিয়ে নেওয়ার মত কিছু না, ব্যাগে ঠুসে ভরে নিলাম কেবল।

পিঠে ব্যাগ, হাতে চাবি, ফোন। মায়ের জন্য একটা জ্যাকেট, আর মায়ের হাতব্যাগটাও নিয়ে নিলাম। দেখলাম, মা-বাবার শোয়ার ঘরের জানালায় আরও কটা আঙুল মাকড়সার মত চলাফেরা করছে। পাত্তা দিলাম না আর।

তার মানে, একজন কেউ–  হয়তো আরও একজন কেউ– রয়েছে বাড়ির ধারে। আর হাতে বেশি সময় নেই। এই লোকগুলোর হয়েছেটা কি? চামড়া ওরকম খোলসের মত ফুলে উঠেছে
 কেন? ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

নিশ্বাস নিতে গিয়েও বুকে ব্যথা করে উঠল। বাইরে কালো অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। কেউ আমাদের দিকে এলেও আমি বুঝতে পারব না।

হাতদুটো জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। তখন কেন জানি না মনে পড়ল, বাবা উহুরুর গল্প বলেছিল– লম্বা ছুরিগুলোর রাত– মাদিবা১৫ মারা গেলেই সব কালো মানুষরা একজোট হয়ে সাদা চামড়ার নিপীড়কদের হত্যা করবে।

নাহ, ও সব গল্পকথা। বাবা সারাজীবনই এরকম ঘটনার জন্য তৈরি হচ্ছে। ঘরে বন্দুক রাখা থেকে শুরু করে এরকম লোকদের গুলি করে মারার হুমকি পর্যন্ত সবই শুনেছি। কিন্তু এসব গল্পকথা শুনে আমি কাউকে ক-বাচক শব্দে সম্বোধন করে অসম্মান করব না।

কিন্তু তবুও, জানালার বাইরে ওই কালো হাতটা তার মালিককে এই বাড়িতে প্রবেশ করার পথ উন্মোচন করার চেষ্টা করছে, সেটাই বা ভুলি কীভাবে!

আমি সব জিনিস নিয়ে দরজার কাছে রাখলাম। তারপর রান্নাঘরের দিকে গেলাম মাকে নিয়ে আসতে। মায়ের গায়ে কোনোমতে জ্যাকেটটা চাপিয়ে দিলাম। মা ছোটো বাচ্চাদের মত কাঁদছিল, আর চেষ্টা করছিল আমার কাঁধে মাথাটা গুঁজে দিতে।

সবসময়ে আমাকেই সব সময়ে শক্ত থাকতে হয় কেন? ভয় তো আমারও করছে! আমার হাতের আঙুলগুলো এতই কাঁপছিল, আমি মায়ের

জ্যাকেটের চেনটাও টানতে পারছিলাম না ঠিক করে।

আর ঠিক তখনই দরজার বাইরের বারান্দায় কারো পা টেনে টেনে চলার শব্দ কানে এল।

“সর্বনাশ!” আমার চাপা গলা থেকে ছিটকে এল শব্দটা। হাতে গাড়ির চাবিটা এত জোরে চেপে ধরেছি, যেন সেটা আমার হাতের তালু কেটে বসবে এবার। আমি ফোনের আলোটা নিভিয়ে দিলাম, দুজনেই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি শ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছি, আর মা আমার প্রায় উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে যে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বোঝার জন্য চোখ দিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই। কেউ বাইরে অপেক্ষা করছে। সে জানে, আমরা এখানে রয়েছি, একা। বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়িয়ে। মা ককিয়ে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে চুপ করিয়ে দিলাম। “মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আছি তো আমি।” কানে কানে বললাম।

আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এসে মায়ের চুল ভিজিয়ে দিল। “আমায় ঢুকতে দে রে!” এবারে বাবার গলা পেলাম, কিন্তু বাবার গলা শুনে মনে হল কিছু একটা ঠিক নেই। যেন মানুষটাই বদলে গেছে। আমি কিছুতেই আলো নেভার আগে রাস্তায় যে ছায়াগুলো দেখেছিলাম তাদের কথা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলাম না।

বাইরে থাকা শরীরটা দরজায় আছড়ে পড়ল এবার। কাঠের সঙ্গে মাংসের সংঘর্ষের শব্দ এল। মা আর আমি দু’জনেই চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলাম।

“খুউউউউব ক্ষিদে…”

“যাও এখান থেকে!” আমি চিৎকার করে উঠলাম। “তুমি আমার বাবা নও! কী করেছ তুমি বাবাকে?”

অর্থহীন এই প্রশ্ন। জানি আমি। কিন্তু, কিছু তো আমাকে বলতে হত। কিছু তো করতে হত।

“আমাকে ভেতরে আসতে দে!” কথাগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এল, “আর তোর কোত্থাও পালানোর জায়গা নেই।”

“না!” আমি খুব চেষ্টা করলাম কান্না আটকে এই একটা শব্দ উচ্চারণ করার। মনে হল, আমার পুরো জীবনটাই এই একটা মুহূর্তের

উপর দাঁড়িয়ে আছে।

“কেন? তোর শরম লাগে?”

মা আমার হাতে এলিয়ে পড়ল। আমি কোনোমতে ধরে নিলাম মাকে। এখন আর মা আমাকে বাঁচাতে পারবে না। কেউই পারবে না।

টীকা

১) গুড সামারিটান- বাইবেলে (গসপেল অফ ল্যুক ১০:৩৩) যিশু বর্ণিত আব্রাহামীয় দর্শনে বিশ্বাসী, লেভান্তের এক ভালো মানুষ শ্রেণী যে/যারা ভালো-খারাপ, অচেনা, অজানা নির্বিশেষে সবসময় যে কোনো জীবকে সাহায্য করে।

২) দার্দি কাফির- আরবি ‘কাফের’ শব্দ থেকে উদ্ভুত এই কাফির শব্দটি। যার আদি অর্থ অবিশ্বাসী। এক্ষেত্রে বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকার কালোমানুষদের প্রতি অসম্মান দেখিয়ে প্রয়োগ করা হয়। উল্লেখ্য, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ প্রভুরা মূলত বান্টু প্রজাতির মানুষদের উল্লেখ করতে কাফ্রি শব্দটিও ব্যবহার করতেন। এর সামগ্রিক অর্থে বোঝাতে চাওয়া হয় এক অশিক্ষিত, বন্য, অসভ্য জাতিকে, যারা নাকি দাস হওয়া ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা রাখে
 না। এই চূড়ান্ত অবমাননাকর শব্দটি দুহাজার সালে দক্ষিণ আফ্রিকান পার্লামেন্টের দ্বারা বন্ধ (মূলত ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানো রুখতে) করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

৩) শাফলিং নাচ (Shuffle Dance)- মেলবোর্ন শাফল, বা শাফল নাচ শুরু হয় ৮০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ায়। এতে পা দুটিকে বিশেষ ভঙ্গিতে বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে তালে তালে টলমলে ভঙ্গিতে নাচতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়।  

৪) টোটসি (tsotsi)- ঐতিহাসিকভাবে
 পঞ্চাশের দশকে কালো চামড়ার কোনো অসামাজিক, অপরাধী, গুণ্ডা বা মাফিয়াকে বোঝানো হত। পরে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির ক্রীড়ানক হিসাবে এই শব্দ কালোমানুষদের লক্ষ্য করেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। তবে মূলতঃ শহুরে অপরাধীদের জন্যই এটি ব্যবহার করা হয়। 

৫) ক্রোশে- মূল লেখাটিতে ক্রোশে শব্দটি রয়েছে। এটি বিশেষ ধরণের সুতোর কাজ। ফরাসী ক্রোশে থেকে এই শব্দটি এসেছে যেখানে এর অর্থ ছোটো হুক। এই হুক ব্যবহার করেই এই সেলাই করা হয়ে থাকে। অভিজাত পরিবারগুলিতে এই কাপড়ের ব্যবহার হত।

৬) আর ডি পি (RDP)- Reconstruction and Development Programme, এটি একটি আর্থ-সামাজিক গঠন যা আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস ও অন্যান্য সহযোগীরা মিলে তৈরি করেছেন সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য।

৭) ক-বাচক শব্দ- কাফ্রি, কাফির। ২ নং সূত্র দ্রষ্টব্য। 

৮) সিবিন (Shebeen)- আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশগুলিতে দেশজ
 উপায়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে (ফারমেণ্টেশন প্রক্রিয়ায়) তৈরি মদ। উল্লেখ্য দক্ষিণ আফ্রিকাতে দেশজ এই মদ্যপানের জায়গাকেও একই নামে অভিহিত করা হয়। এটি তাৎপর্যে সাধারণত নিন্দনীয়/ নীচুমানের মদ্যজনিত বিষয় বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়। মূল গল্পে এই সিবিন শব্দটিই ছিল। কিছুটা বাংলাকরণের উদ্দেশ্যে এই শব্দের অনুরূপ বাংলা “চোলাই” ব্যবহার করা হয়েছে।  

৯) স্লাস্টো (Slasto)- একটি বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকান টালি যা মেঝে, দেয়াল বা অনুরূপ গৃহসজ্জায় ব্যবহার করা হয়। মূলত আঞ্চলিক শিল্প। বিশেষভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার মফস্বলী সজ্জাবৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। কাছাকাছি শব্দ হিসাবে মোজাইক ব্যবহার করা হয়েছে।

১০) চিরগোধূলির অতীত (Twilight Zone)- দক্ষিণ আফ্রিকার পরিপ্রেক্ষিতে একটি রক্তাক্ত কালো অধ্যায়কে নির্দেশ করা হচ্ছে এক্ষেত্রে। মোটামুটিভাবে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে নব্বই-এর দশক পর্যন্ত, সাদা চামড়ার সাম্রাজ্যবাদী শাসক, প্রধানত আফ্রিকায় সাদা ও কালো মানুষদের মধ্যে যে চূড়ান্ত বিভেদনীতি তৈরি করে ও বজায় রাখে, তাকে অ্যাপারথেইড বা বিভেদকরণ বলেই দুনিয়া জানে। কালো মানুষদের এই সময়ে সমস্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা থেকে শুরু করে তাদের শারীরিক তথা ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে আটকে রাখা, হত্যা, শ্লীলতাহানি, তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে মিথ্যা আখ্যান রচনা (যা আদতে বিখ্যাত তাত্ত্বিক সাইদের দ্বারা লিখিত Orientalism গ্রন্থটিতে বিশদে বলা হয়েছে,
 এবং এর পরবর্তীতেই ওরিয়েন্টালিসম একটি বিশেষ অর্থবাহী শব্দ অর্থাৎ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শাসকের দ্বারা লিখিত বা কথিত অনৃত-ইতিহাস হিসাবেই পরিগণিত হয়)-এই সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।  

১১) উমুলুঙ্গু (Umulungu)- বান্টু উপজাতিদের ভাষা থেকে আহৃত এই শব্দটি মূলতঃ সাদা চামড়ার মানুষদের উল্লেখ বা সম্বোধন করতে কালো মানুষরা ব্যবহার করে। (বন্ধুত্বপূর্ণ, পরিচিতকে বা তাচ্ছিল্য বোঝাতে)

১২) খোসা (Xhosa)- ।।জুলুদের পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ

ভূমিপুত্র শ্রেণী। খোসাদের দ্বারা ব্যবহৃত বাণ্টু ভাষা দক্ষিণ আফ্রিকায় সরকারিভাবে স্বীকৃত।

১৩) ক্কাইটো (Kwaito)- দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষ ধরণের দেশজ গান।

হিপহপ জাতীয় পশ্চিমী বাদ্যযন্ত্র সহযোগে লঘুগানে সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিখ্যাত ও বহুল প্রচলিত।

১৪) হাইবো (Haibo)- অবাক হওয়া বা আতঙ্ক মিশ্রিত বিস্ময় বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করে খোসারা (সূত্র ১২ দ্রষ্টব্য) উল্লেখ্য, বাংলা অনুবাদে এর অনুরূপ “হাই গো” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণত বাংলায় অসংগঠিত কায়িক শ্রমিকদের মধ্যে বহুল প্রচলিত।

১৫) মাদিবা (Madiba)- খোসা ভাষায় প্রাক্তন আফ্রিকান রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলাকে সম্মানার্থে এই নামে সম্বোধন করা হয়।

লেখক পরিচিতি

দক্ষিণ আফ্রিকার স্পেকুলেটিভ সাহিত্যের জগতে নেরিন ডোরম্যান পরিচিত নাম। লেখকের পাশাপাশি সম্পাদক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি কম নয়। নেরিনের লেখা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকা ও সঙ্কলনে প্রকাশিত হয়েছে। ওমেনানা পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প ‘On the Other Side of the Sea’ ২০১৮ সালের নোমো পুরস্কারে মনোনীত হয়, ২০১৯ সালে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘The Firebird’ সেরা নভেলার জন্য পুরস্কৃত হয় নোমোতে। ‘Sing down the Stars’ উপন্যাসটি
 লেখার পর কিশোর সাহিত্যেও রীতিমত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন নেরিন, পেয়েছেন পার্সি ফিটজপ্যাট্রিক ও সানলাম পুরস্কার। সাই ফাই বা আরবান ফ্যান্টাসি ঘরানার লেখকদের নিয়ে বছরে একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তিনি, SFF authors’ co-operative Skolion ও নির্মিত হয় তাঁর হাত ধরেই। তাঁর লেখা  উল্লেখযোগ্য বই ‘Khepera Rising’, ‘Khepera Redeemed’, ‘The Namaqualand Book of the Dead’ ইত্যাদি। মজার কথা হল, এই সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত
 ‘Shame’ গল্পটি পড়ে প্রথমে অনেকেই পছন্দ হয়নি, কিন্তু গত কয়েক বছরের মধ্যে গল্পটি পাঠকদের মধ্যে তুমুল সাড়া ফেলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপার্টহেড রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এমন গতভাঙা, ওয়েল ক্রাফটেড, বহুস্তরীয়, ভয়ের গল্প সম্ভবত আগে আর লেখা হয়নি।

অনুবাদক পরিচিতি

জন্ম কদমতলা, হাওড়ায়।  কল্প-গল্পের লেখালেখি করছেন বেশ কয়েক বছর। ছোটোদের জন্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে “ম্যাজিক ল্যাম্প”, “জয়ঢাক” ইত্যাদি ওয়েবজিনে। কবিতা লিখেছেন ‘টার্মিনাস’, ‘বর্ষালিপি’, ‘পরবাস’, ‘কৌরব’, ‘শব্দলেখা’ ইত্যাদি পত্রিকায়। এছাড়াও থ্রিলার, ডার্ক, রহস্যগল্প প্রকাশিত নবকল্লোল, কিশোর ভারতী, প্রসাদ, কচিপাতা, নভোরজ পত্রিকায়। প্রবন্ধ, পদ্য প্রকাশিত ‘বিচিত্রপত্র’, ‘অন্তরীপ’-এ। রহস্য-রোমাঞ্চ ও সাই-ফাই
 গল্প প্রকাশিত ‘রহস্যের-৬-অধ্যায়’ (অরণ্যমন প্রকাশন), ‘আতঙ্কের অমানিশা’ (তুহিনা প্রকাশনী), ‘ভয়ঙ্কর বিশ’(পালক পাবলিশার্স), ‘অপরাজিত ইতিহাস’, (বেঙ্গল ট্রয়কা) ‘হরর টাইম’ (অরণ্যমন প্রকাশন), ‘কল্পবিশ্ব’, ‘কল্পবিজ্ঞান’ (পলান্ন প্রকাশনী) ইত্যাদি সঙ্কলনে। এছাড়াও কবিতা, ফিল্ম এবং বই রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন পত্রপত্রিকায় (অবসর, অভিব্যক্তি আড্ডা নিউ জার্সি, উদ্ভাস, অপার বাংলা, দীপশিখা ইত্যাদি)। শপিজেনে
 প্রকাশিত প্রেমের নভেলা “যক্ষের গান” (ই-বুক)। উল্লেখযোগ্য বই ‘অন্ধকার ও অনুরাগের আখ্যান’ (পলান্ন, সেপ্টেম্বর, ২০২২)

অধ্যায় ১২ / ১২

সকল অধ্যায়

১. অমরত্বের আড়ালে – ব্লেইজ কায়ে। অনুবাদ : অরিন্দম দেবনাথ
২. জল হরকরা – ইউজেন বেকন। অনুবাদ : অদিতি সরকার
৩. স্বাদ – চিকোদিলি এমেলুমাডু। অনুবাদ : সোহম গুহ
৪. বালিয়াড়ির গান – সুয়ি ডেভিস ওকুংবোয়া। অনুবাদ : মহাশ্বেতা
৫. অন্তিম সঙ্কেত – ইভর ডাব্লিউ. হার্টম্যান। অনুবাদ : দীপ ঘোষ
৬. অক্সিজেন রণাঙ্গন – ওগিনিকোওয়ে ডোনাল্ড একপেকি। অনুবাদ : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
৭. একে একে নিভিছে দেউটি – কোফি ন্যামেয়ে। অনুবাদ : অনুষ্টুপ শেঠ
৮. তৃষ্ণাভূমি – নিক উড। অনুবাদ : রাজর্ষি গুপ্ত
৯. সমবেত সঙ্গীত স্থাপত্যে মিলনসঙ্গমের দিশা – ডেয়ার সেগুন ফালো। অনুবাদ : সুমিত বর্ধন
১০. দি রিগ্রেশন টেস্ট – ওলে তালাবি। অনুবাদ : শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. কোরিয়ালিস – টি এল হুচু। অনুবাদ : পার্থ দে
১২. শরম – নেরিন ডরম্যান। অনুবাদ : শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন