মূল গল্প: The Regression Test
অধিবেশনের ঘরটা ফ্যাটফেটে সাদা, আকারে বেশ বড়ো আর একেবারে শ্রীহীন।
শ্রীহীন যে আসলে কেন, সেটা বোঝানো অবশ্য মুশকিল– ক্যাটক্যাটে রঙের চটকদার আসবাবপত্র, রুচিহীনভাবে ঝুলিয়ে রাখা শিল্পসামগ্রী অথবা বমি পেয়ে যাবে এমন সবজে-হলদে দেয়াল- কোনোটাই এখানে নেই। প্রকৃতপক্ষে ঘরটা একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু ঘরের ভেতরটা দেখলে মনে হয় সব কিছুই কেমন আঁশে ঢাকা, দেয়ালটা যেন কোনো রোগাক্রান্ত অ্যালবিনো প্রাণীর চামড়ার মতো ঝুলে আছে, যেন ঘরের সমস্ত উপাদান সেই আলগা খোসার মতো লেগে থাকা আঁশ দিয়ে বানানো। অবশ্য আমি জানি যে আজকালকার সমস্ত আধুনিক আসবাব সজ্জাই নাকি এরকমই দেখতে। এই শৈলী— ওরা নাম দিয়েছে ‘স্ল্যাটটেক্স’— বিশেষ করে এইরকম উচ্চপ্রযুক্তির অফিসগুলোতেই ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে দেয়াল, দরজা জানালা এমনকি ছোটোখাটো আসবাব অবধি এমনভাবে তৈরি হয় যাতে সব্বার মধ্যে একটা সরাসরি সাযুজ্য থাকে, তবু আমার এই ধরনটা ঠিক ভালো লাগেনি। আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানকার ব্যাপারটা শেষ করে এই ঘরটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে। ফিরতে চাই আজায়১, দুশো বছরের পুরোনো আমার সেই সুন্দর ইটের বাংলোটায়, যেখানে দেয়ালগুলো আজও সত্যি সত্যি দেয়াল বলেই মনে হয়, এরকম আগামীদিনের কুষ্ঠরোগির চামড়ার মতো দেয়াল আমার দরকার নেই।
“তো, বুঝতে পেরেছেন তো আপনি এখানে কেন এসেছেন আর আপনাকে কী কী করতে হবে, ম্যাডাম?” ডক্টর দিমেজি আমায় জিজ্ঞাসা করল।
জোর করে হাসলাম একটু, বললাম, “নিশ্চয়ই— আমি এখানে রিগ্রেশন পরীক্ষার মানুষী নিয়ন্ত্রণের জন্য এসেছি।”
ডক্টর দিমেজি পালটা হাসল না। লোকটাকে দেখে আমার আগামা২ গিরগিটির কথা মনে হয়। মুখটা লম্বাটে, সরীসৃপের মতো আর মাথার মাঝখান দিয়ে সামনে থেকে পেছন অবধি একটা হাড়ের মতো উঁচু অংশ রয়েছে। চোখগুলো বসা কিন্তু সবসময়ই এদিক-ওদিক, নানাদিকে ঘুরছে, একবারের জন্যও আমার ওপর স্থির নেই। লোকটার একচোখের তারার চারপাশে তীব্র নীল গোলাকার একটা দাগ থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছে যে তার চোখে একটা কৃত্রিম সুবেদী উদ্দীপক লাগানো আছে।
“সোরাইটস রিগ্রেশন টেস্ট।” দিমেজি বলে ওঠে; যেন নিখুঁত নামটা উচ্চারণ করাটা খুবই জরুরি, অথবা আমি জানিই না যে ওটাকে কী বলে। আমি অবশ্য খুব ভালো করেই জানি ব্যাপারটা– ওদের দেয়া সেই বিরক্তিকর ডেটাপ্যাকটা আমাকে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়েছে যতক্ষণ না ওর মধ্যে থাকা অর্থহীন প্রযুক্তি-বুকনিগুলো ক্রমে কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমি চোখ ঘুরিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, আমি এখানে সোরাইটস রিগ্রেশন টেস্টের মানুষী নিয়ন্ত্রণের জন্যই এসেছি।”
“বেশ,” ও একটা লাল চোখ আঁকা কালো পুঁতির দিকে— অধিবেশন ঘরের মাঝামাঝি টেবিলের ওপরের রাখা সেই বস্তুটা সম্ভবত কোনো রেকর্ডিং যন্ত্র— ইঙ্গিত করে বলল, “আপনি প্রস্তুত হলেই, ওটার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আপনার নাম, বয়স, সূচক এবং কেন আপনি আজ এখানে রয়েছেন সেটা বলবেন। পারবেন তো ম্যাডাম?”
দেখে তো মনে হয় লোকটা হয়তো স্মৃতিসত্তাবিদ্যা বা ওইরকম কিছু একটা বিষয়ের অধ্যাপক, ওই ‘এ আই’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই উজবুক সংস্করণকে ওরা আজকাল যে নামে ডেকে থাকে আর কি… কিন্তু বয়সে সে আমার চেয়ে অনেকটাই ছোটো, কম সে কম সাত দশক তো হবেই, বেশিও হতে পারে। নিজের চেয়ে বয়েসে বড়ো কারো সঙ্গে কথা বলার সময় তাচ্ছিল্যের ভাবটা ত্যাগ করা আর ‘প্লিজ’ শব্দটা ব্যবহার করার শিক্ষাটা অবশ্য ওর নেই, শেখানো উচিত ছিল কারোর। ওর টোকো হাবভাবটা একেবারে ওর মুখের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়, একদম আমার নাতি টুনজির মতোই, সে আবার এখন এই লেগবাটেক-এর গবেষণা বিভাগের কার্যকরী অধিকর্তা হয়ে বসেছে। তা সে-ও দেখি সবসময় গোমড়া মুখ করেই থাকে, এমনকি পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতেও, সবসময়ই কোনো না কোনো কাজ নিয়ে বা যা হোক কিছু একটা নিয়ে মগ্ন। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো আবার দেখি নিজেদের বড্ড বেশি গুরুত্ব দেয়। টুনজি তো আজকাল আবার শুনি খুব ধার্মিক টার্মিকও হয়েছে। প্রতি রবিবার নাকি গির্জায় যায়। জানি না আমার মেয়ে আর জামাই কী করে এমন ছেলেকে মানুষ করতে পারল।
“আমি ঠিক বাইরেই অপেক্ষা করছি, আপনার কিছু দরকার হলে দেখব।” ডক্টর দিমেজি দরজাটা খুলতে খুলতে বলল। আমি কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়লাম, পাছে হুট করে ওর বাড়িতে থাকা শিক্ষাদীক্ষার অভাব বা ‘অশিক্ষা’ নিয়ে কোনো বাঁকা কথা বলে ফেলি। ও বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল আর আমিও তালার ‘খুট’ আওয়াজটা শুনতে পেলাম। একটু বেয়াড়া লাগলেও ব্যাপারটাকে আমি পাত্তা দিলাম না। এই ঝুটঝামেলা তাড়াতাড়ি শেষ হলে বাঁচি!
“আমার নাম তিতিলোপ আজিমবি।” আমি বলি, আমাকে দেয়া নির্দেশটা মনে করতে থাকি, বলেছিল আমি যেন যতটা সম্ভব বিস্তারিত তথ্য দিই। “আমার বয়েস একশো ষোলো বছর। ইন্দ্রিয়-সত্তা সূচক এইচ এম ০৩৩-২০২১-এইচ কে-৭৬৭৭৬। আজ আমি লেগবাটেক ইন্ডাসট্রিজ-এর ইকো অ্যাটলান্টিক অফিসে সোরাইটস রিগ্রেশন টেস্ট-এর মানুষী নিয়ন্ত্রণের-এর কারণে উপস্থিত আছি।”
“ধন্যবাদ মিসেস আজিমবি।” ঘরের প্রতিটা জায়গা থেকে একটা মহিলা কণ্ঠ বলে উঠল আমায়। এও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা চরিত্র বটে, সে সর্বত্রব্যাপী। “রিগ্রেশন টেস্ট শুরু হচ্ছে।”
আমি চেয়ারে এলিয়ে বসলাম। শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র চালু থাকার ফলে ঠোঁট চেটে নিতে হল। ওদের এত জটিল ব্যাপারস্যাপারের মাঝে পড়ে বেচারা অতিথিসেবক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনও এমন আদর্শ তাপমাত্রা খুঁজেই পায় না, যা মানুষের জন্য আরামদায়ক। ওরা বুঝতেই পারে না যে এটা কোনো নিখুঁত মান নয়, যা অঙ্কের হিসেব করলেই বের করা যাবে। এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাও বিরল, কারণ মানুষের কাঙ্খিত তাপমাত্রা সময়ের সঙ্গে বদলাতেই পারে। একটু কম বা একটু বেশি, আদর্শ বলে কিছু নেই। ‘ব্যাপারটা কখনওই নিখুঁত হয় না, কমবেশি একটু সবসময়ই থাকে। ’ আমার মা তো এ কথাটা প্রায়ই বলত।
অধিবেশন ঘরটার অন্যপাশে এইবার সার-সার আলো জ্বলে উঠল আর তীক্ষ্ণ, আপাতভাবে এলোমেলো গতিতে নাচানাচি শুরু করল। আলোগুলো একসময় থামল, তারপর ফট করে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর ঠিক তার পরেই টেবিলের চারপাশে, যেখানে আমার চেয়ারের মতো আরো চেয়ার রাখা যেত ইচ্ছে হলে সেখানে, আটটা মসৃণ কালো চৌকো স্তম্ভ ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকল, যেন মেঝে ফুঁড়ে উঠছে। আমিও অতশত না ভেবে, আমার চেয়ারটা ঘুরিয়ে দেখছিলাম কোত্থেকে আসছে ওগুলো; কিন্তু কীই বা আসে যায় তাতে।
স্ল্যাবগুলো সাত ফুট মতো বেড়ে ওঠার পর গিয়ে থামল। এইবার, আমার ঠিক উল্টো দিকে উত্থিত স্ল্যাবটা টেবিলের ওপর একটা লাল আলোর ম্যাট্রিক্স প্রক্ষেপ করল। তাতে এত অসংখ্য চিহ্ন আর অক্ষর, এত খটোমটোভাবে আর ঠাসাঠাসি করে ঘুরছে যে দেখে বিমূর্ত শিল্পের মতো মনে হচ্ছিল। অঙ্কের ভাষায় বললে, ম্যাট্রিক্সটা হল ত্রিমাত্রিক, আর ওর মধ্যে নকশার ছবি যেগুলো ফুটে উঠছে সেগুলো দুরূহ, সুন্দর এবং নিজের মতো করেই মনোমুগ্ধকর। নকশাগুলো এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে স্থায়িত্বের একটা ভ্রম তৈরি হচ্ছে, আর তা প্রক্ষেপের সৌন্দর্যকেও বাড়িয়ে তুলছিল। ওই স্ল্যাবটাই এসব দেখাচ্ছে আসলে। আমি আন্দাজ করলাম এটা সম্ভবত স্মৃতিসত্তা প্রতিলিপির একটা আবরণ যার ওপর রিগ্রেশন পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হচ্ছে, সব ঠিকঠাক আছে কিনা!
সোরাইটস রিগ্রেশন টেস্ট আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাকে নির্ধারিত করার জন্যই ডিজাইন করা হয়েছে। একজন বাস্তব মানুষের চিন্তাভাবনার প্যাটার্ন-এর নথিভুক্ত নমুনার ওপর নির্ভর করে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংস্করণ তৈরি হয়, তাতে সেই চিন্তাধারার কিছু নমুনাকে আরো বেশি প্রসারিত করা হয়। পাশাপাশি ‘কনটেক্সট অপটিমাইজেশন’ অর্থাৎ বিষয় সম্পৃক্ত ভাবনাকেও স্থান দেয়া হয় এই পদ্ধতিতে। রিগ্রেশন টেস্ট আসলে দেখতে চায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন সংস্করণটি সেই বাস্তব মানুষটির চিন্তা-ভাবনার ধরন থেকে খুব বেশি সরে গিয়েছে কিনা?
মূলত আগের একাধিক এ আই সংস্করণগুলি — অপেক্ষাকৃতভাবে যে সংস্করণগুলোর অভিজ্ঞতা কম ছিল — ‘তারা’ একেবারে হালফিলের সংস্করণটিকে প্রশ্ন করে দেখে যে নানান বিষয়ে যেমন গাণিতিক, ঘটনা-বিজ্ঞান এবং দার্শনিক প্রশ্নগুলিতে তার দেয়া উত্তরে আগের সংস্করণগুলো সহমত হচ্ছে কিনা। কিন্তু কেবলমাত্র উত্তরের সঙ্গে সহমত হওয়া নয়, বস্তুত.. তাদের ..জ্ঞাননির্ভর ..উত্তর খোঁজা এবং তাকে পেশ করার পন্থাটাও কতটা একরকম, সেটাও অনুধাবন করতে হয়।
পরীক্ষার শেষে, আগের সংস্করণগুলি বিচার করে যে নতুন সংস্করণের দেয়া উত্তরগুলি, তারা যা উত্তর দিতে পারত তার যথেষ্ট কাছাকাছি— অর্থাৎ হালফিলের সংস্করণটি সমেত ‘তাদের’ এখনও একগোত্রীয় বলা যায়— না সম্পূর্ণ ভিন্ন এক যান্ত্রিক সত্তা হলেও এই উত্তরগুলো দিতেই পারত। পরীক্ষাটা সাধারণত শেষ হয় এমন একটা লোককে দিয়ে যে মূল মানুষটিকে চিনত— এক্ষেত্রে সেই মানুষটা আমি— যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রশ্ন করে ওই একই ব্যাপার নিশ্চিত করবে। অথবা টুনজি যেভাবে একবার সংক্ষেপে বলেছিল, এই পরীক্ষাটা আসলে যাচাই করে নেয় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সত্তা ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকলেও তার একেবারে ভেতরের মর্মস্থলটা নিজের এবং অন্যান্যদের কাছে চেনা ঠেকছে কিনা।
বাকি সাতটা স্ল্যাবের প্রত্যেকটা লাল ম্যাট্রিক্সটার কেন্দ্রে একটা করে হলদে আলোর রেখা ফেলে রেখেছে। মনে হয় সেটাকে পড়ার চেষ্টা করছে। হলদে আলোর রেখাগুলো ওর মধ্যে গুটিগুটি ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাট্রিক্সটা প্রসারিত হচ্ছিল, এইবার তার কেন্দ্রটা বেলুনের মতো ফুলে উঠে হঠাৎ করে ভেঙে গিয়ে মূল আকারের চারগুণ হয়ে পড়ল। তারপরেই সেটা নিজের চারপাশে ভাঁজ হয়ে এমন একটা আকার নিল যে আমি আবছাভাবে আন্দাজ করলাম ওটা একটা ‘হাইপারকিউব’ বা অতিঘনক। একসময় অবধি অঙ্কটঙ্ক যথেষ্টই ভালোবাসতাম, এধরনের ব্যাপার-স্যাপার বোঝার চেষ্টাও করতাম, সেই জ্ঞান থেকেই ব্যাপারটা অনুমান করলাম। স্ল্যাবগুলোর চটকদার আলোর সজ্জা এখন টেবিলের অর্ধেকটা দখল করে ফেলেছে, আমিও আর বুঝতে পারছি না ঠিক কী দেখছি। হঠাৎ যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটা আমায় মনে করিয়ে দিল আমি এখানে কেন উপস্থিত, তখনও আমি ওই আলোর খেলা দেখে আমি পুরোপুরি বিহ্বল হয়ে আছি।
“মিসেস আজিমবি, প্লিজ আপনার মাকে একটা প্রশ্ন করুন।”
ওই কথাটা শুনেই চটকাটা ভেঙে গেল আমার। পদ্ধতিটা বুঝিয়ে দেয়ার সময় যেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছিল সেগুলো তখনও আমি মনে করে উঠতে পারিনি। তবে যত নির্দেশই দেয়া হোক না কেন, এই.. ব্যাপারে ..আমার.. ভূমিকার গুরুত্ব সম্বন্ধে আমার মনে এখনও যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গিয়েছে।
“কে হে তুমি?” আমি জিজ্ঞাসা করি, যদিও সেটা আমার করার কথা নয়।
আলোর ম্যাট্রিক্সটা আবার নতুন করে আকার নিল, বিভিন্ন অংশগুলো দ্রুত এমনভাবে নড়াচড়া করতে করতে শান্ত হয়ে এল, যেমন বরফের ওপরে গরম জল ঢালা হলে হয়। তারপর একটা উত্তর শুনতে পেলাম আমি। সেই ভাবলেশহীন ভাঙা ভাঙা কন্ঠস্বরকে বর্ণনা করতে হলে আমাকে বলতেই হয়, গলাটা আমার মায়ের।
“আমি ওলুসোলা আজিমবি।”
আমি খাবি খেলাম। নিপুণ যান্ত্রিক কৌশলে সৃজিত, সেই ক’টা শব্দ আমার মনের সবচেয়ে নরম আর দুর্বল স্মৃতিতে গিয়ে এমনভাবে আঘাত করল যে আমার চোখে প্রায় জল এসে গেল। গলাটা আমার খুবই কাছের। ওই গলাটাই কাছিমের গল্প শোনাতে শোনাতে আমার চুল বেঁধে দিত, আমাদের গোটা বাড়ি জুড়ে গমগম করত সে গলা। ওই কণ্ঠস্বরটাই নীচের তলা থেকে আমায় ডেকে বলত তাড়াতাড়ি করো, যাতে আমার ইস্কুলে দেরি না হয়ে যায়। ওই গলাটাই আমায় বকাবকি করেছিল যখন জানিয়েছিলাম পিএইচডি ছেড়ে দিয়ে কেপটাউনে একটা কাজ নিচ্ছি আমি। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক নিউজের সাক্ষাৎকারে সমস্ত প্রশ্নের যথাযথ ও বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরও দিয়েছিল ওই স্বরটাই, যদিও তখন একটু অস্থিরভাব ছিল গলার স্বরে। হাসপাতালে যখন আমার সোনা সিমিওলুয়া জন্মেছিল আর ওকে প্রথমবার কোলে নিয়েছিলাম, ওই গলাটাই কাছে এসে আমার কানে কানে বলেছিল, “কী সুন্দর!” প্রথম হার্ট অ্যাটাক হলে পর যখন বলেছিলাম এবারে অবসর নাও, ওই স্বরের অধিকারিণীই আমাকে বলেছিল ওকে একলা থাকতে দিতে। সত্যিই মজার কথা, একটা মাত্র উদ্দীপনা কীভাবে একগাদা স্মৃতি আর আবেগজাগিয়ে তোলে।
আমি এইবার চেয়ারে সোজা হয়ে হাঁটুদুটো জড়ো করে বসলাম আর বোঝবার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা: একটা সফটওয়্যারের কার্যকরী ক্ষমতার বিশেষ মূল্যায়ন চলছে এখানে। আমার মা, ওলুসোলা আজিমবি—“আইনস্টাইনের আফ্রিকীয় জবাব” নামেই পত্রপত্রিকায় ডাকা হত যাকে— আজ আটত্রিশ বছর হল মারা গেছে আর ওর স্মৃতিসত্তার প্রতিলিপিগুলো লেগবাটেক-এর গবেষণায় পরামর্শ ও সহায়তা করে আসছে গত চল্লিশ বছর ধরে। এই বিশেষ ‘এ আই’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটি মায়ের তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকের পর বানানো হয়েছিল। এই প্রযুক্তি আর কিছুই নয়, তার স্মৃতি আর চিন্তাভাবনার নকশার একটা টেমপ্লেট মাত্র যা বহুবছর হল তার মূল প্রতিলিপি থেকে সরে এসেছে। আর সেই সম্ভাব্য পরিবর্তনটা যাচাই করাই আজ আমাকে এখানে নিয়ে আসার একমাত্র কারণ।
টুনজি যখন প্রথম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, ও বলেছিল যে লেগবাটেক-এ সে আর তার টিম একটা চমৎকার গবেষণার নতুন দিক আবিষ্কার করেছে—সেটা নিয়ে বিশদে আমায় বলা স্বাভাবিক কারণেই সম্ভব নয়, তবে গবেষণার জন্য ফান্ডিং তোলার চেষ্টা চলছে। মূল্যায়ন-পরিষদ অবশ্য মনে করছে যে এই গবেষণাটার অভিমুখের মূল ভাবনায় গলদ আছে এবং তারা বলেই দিয়েছে যে এটা নিয়ে আর না এগোনোই ভালো। এদিকে আমার মায়ের স্মৃতিসত্তার প্রতিলিপি কিন্তু জোর দিয়ে বলেছে গবেষণাটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। এদিকে, কেবলমাত্র ওর প্রাথমিক প্রতর্কগুলো পরীক্ষা করতেই কোটি কোটি নাইরা (নাইজেরীয় মুদ্রা) লেগে যাবে। ওরা আমার সাহায্য নিয়ে দেখতে চায় যে এই স্মৃতিসত্তার প্রতিলিপিটা এখনও সত্যি সত্যি আমার মায়ের মস্তিষ্কের প্রতিনিধিত্ব করছে, না পর পর সংস্করণ আসার ফলে ওটার মূলে এতটাই বদল ঘটে গেছে যে ‘এ আই’ এখন এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা নির্দেশ দিচ্ছে যেটা মা হলে কখনওই মঞ্জুর করত না। আমায় বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়ার সময় বলা হয়েছিল অতীতে করা দার্শনিক আলোচনা বা তর্ক দিয়ে কথা শুরু করতে, যাতে দেখা যায় মায়ের মূলভাবনাগুলির প্রতি ওটার অবস্থান আর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে কিনা? আমি মহাবিশ্বের উৎস বিষয়টাই বেছে নিলাম। এই একটা বিষয়, যেটা নিয়ে ভাবতে মা খুব মজা পেত।
“মহাবিশ্ব কীভাবে তৈরি হয়েছিল?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“বর্তমান বৈজ্ঞানিক ঐকমত্য হল যে–”
“না।” আমি দ্রুত থামিয়ে দিলাম, দেখে অবাক হয়ে যাই যে ওর দেয়া প্রথম জবাবটা সাধারণ উত্তরের চর্বিতচর্বণ মাত্র। আমি নিশ্চিত নই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সব কিছুতেই বিশ্বাস রাখতে পারে কিনা আর সে সব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করাও হয়তো আমার উচিত নয়, কিন্তু মানুষী নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা তো এজন্যই রাখা, তাই না? এমন প্রশ্ন করা যা অন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনও ভাববেই না করবার কথা, যাতে আমার মায়ের এই বৈদ্যুতিন প্রলম্বনটিকে অপরীক্ষিত ক্ষেত্রে নিয়ে আসা যায় আর লক্ষ করা যায় যে প্রতিনির্মিত চিন্তার ম্যাট্রিক্সটা টিকে থাকে, না ভেঙে পড়ে।
“তুমি কী ভাবো সেটা বলতে হবে না, যেটা বিশ্বাস করো সেটা বলো।”
ছোট্ট একটু বিরতি। এটা যদি সত্যিই আমার মা হত তাহলে এতক্ষণে মুচকি মুচকি হাসত, আলোচনাটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত। এবারে কণ্ঠস্বরটা আবার বলে উঠল, “আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান বৈজ্ঞানিক ধারণা এবং যা তথ্য যা আছে, তার নিরিখে দেখতে গেলে, কীভাবে জগৎ-সংসার তৈরি হয়েছিল সেটা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি আমরা কখনওই ব্যাপারটা জানতে পারব না। যে সূত্রই খুঁজে পাই না কেন, সঙ্গে সঙ্গেই সেই সূত্রের উৎসের প্রশ্নটাও চলে আসবে। আমরা যদি একজন ঈশ্বরকে খুঁজে পাই, আমরা তখন অবশ্যই প্রশ্ন করব এই ঈশ্বর কোথা থেকে এলেন। আমরা যদি প্রসারিত মহাবিশ্বটাকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে একটাই মহাকণিকার কথা ভাবি, আমরা তখুনি জিজ্ঞাসা করব এই কণাটাই বা কোত্থেকে এল। এইভাবেই চলতে থাকবে। সুতরাং, আমি বিশ্বাস করি এটা জ্ঞানাতীত এবং অনির্দিষ্টকাল ধরে এমনটাই চলতে থাকবে।”
আমার শুনে বেশ ভালো লাগল কী পরিচিত ঢঙে যুক্তিগুলো বলা হল, তোতাপাখির মতো করে একেবারেই নয়। মনে পড়ল সৃষ্টিবাদীদের কাছাকাছি থাকতে হলে মা সবসময়েই কেমন অস্বস্তিতে পড়ত। ধর্মপ্রচারক খ্রিস্টান পরিবারে বেড়ে ওঠার ফলে প্রথম থেকেই তার সমস্ত প্রশ্ন আর পরীক্ষিত সত্য সংক্রান্ত আলোচনাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছিল, দাবি জানানো হয়েছিল শর্তহীন ভাবে ঈশ্বরের আনুগত্য স্বীকার করার জন্য। এর ফলে ধর্ম সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল তার, সেটা সক্রিয়ভাবে ফুটে বেরোত ওর ব্যবহারেও।
“তো তুমি বিশ্বাস করো যে ঈশ্বর থাকতেও পারেন?”
“এটাও সম্ভাব্যতার পরিসরের মধ্যে পড়ে, যদিও না হবার সম্ভাবনাই প্রবল।”
আরেকটা পরিচিত উত্তর, সঙ্গে শুধু একটু মোচড় আছে।
“জাদুতে বিশ্বাস করো তুমি?”
এটা ..ছিল.. একটা ..চালাকির প্রশ্ন। মা জাদুকরদের এবং তাদের ভেলকিবাজি দেখতে পছন্দ করলেও সত্যিকারের জাদুতে একেবারেই বিশ্বাস করত না।
“কোনো জাদুর ঘটনা কখনও রেকর্ড করা হয়নি। আধুনিক পৃথিবীতে সব জায়গাতেই ক্যামেরা রয়েছে তবু একটাও প্রমাণসাধ্য, অকৃত্রিম এবং পুনরাবৃত্তিযোগ্য জাদু কোথাও দেখানো যায়নি। ফলে এই অসম্ভাব্যতা লক্ষ করলে, যুক্তিযুক্তভাবে বলাই যায় যে সত্যিকারের জাদু বলে কিছু হয় না।”
উত্তরটা বেশ কাছাকাছি ঠিকই কিন্তু এরকম বিষয়ে কথা বলতে গেলে মা নিজের ভাবনাচিন্তাগুলো যেভাবে প্রকাশ করত, এই সংলাপে সেই মজা করার ভঙ্গিটা একেবারেই নেই।
একসময় ঠিক করলাম, স্ট্রাটেজি বদলাতে হবে। আসলে পপ ফিলোসফি৩ বা জনপ্রিয় দর্শনের বিষয়টা নিয়ে কথা হলে এ আই প্রকৃত মগজের বিন্যাসের এত নিঁখুত প্রতিকৃতি তৈরি করে যে আমি সে সংক্রান্ত প্রশ্ন করেও দুইয়ের মধ্যে কোনো গুরুতর তফাৎ ধরে ফেলতে পারব না। যদি বিচ্যুতি কিছু থাকেই, সেটা থাকবে আবেগের জায়গায়। মানুষী সমীকরণে সবচেয়ে পরিবর্তনশীল সমাধান স্থল হল এই আবেগপ্রবণতা।
“তুমি কি তোমার পুতি টুনজিকে পছন্দ করো?”
একেবারে নিরেট প্রশ্ন, কিন্তু উসকানিমূলক। টুনজি কখনও ওর দিদার মাকে বেঁচে থাকাকালীন দেখেইনি, ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিতর এই বিষয়ের কোনো স্মৃতিই নেই যা বিশ্লেষণ করে সে উত্তর দিতে পারবে। সুতরাং উত্তরটা অতি অবশ্যই নির্ভর করবে এখন টুনজি আর মায়ের কৃত্রিম স্মৃতিসত্তার মধ্যে যতটুকু সংলাপ বিনিময় হয়েছে তার ওপর; আর নির্ভর করবে মুখ-গোমড়া লোকেদের
 প্রতি মায়ের স্বভাবগত বিতৃষ্ণার ওপর। এই স্বভাব অবশ্য আমিও পেয়েছি। টুনজি আমার মেয়ের ছেলে, আর রক্তের সম্পর্ক যতটা ভালোবাসা সে দাবি করে ততটা ভালোওবাসি ওকে; কিন্তু মানুষ হিসেবে  টুনজি সত্যিই অসহ্যকর। সে এমন গম্ভীর, কেজো লোক হয়ে উঠবে কে জানত? আমি মনে মনে চাইছিলাম মাও আমার এই ভাবনার সঙ্গে একমত হোক।
“টুনজি একজন যথাযথ সক্ষম কার্যকরী অধিকর্তা।”
একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে কথার মারপ্যাঁচ মেরে আমার প্রশ্নটাকে পাশ.. কাটাচ্ছে, সেটা জানতে ..পেরে আমি একইসঙ্গে কিছুটা হতাশ আর খানিকটা খুশি হলাম।
“আমার কোনো সন্দেহই নেই তাতে।” আলোকিত ম্যাট্রিক্সের মধ্যে উজ্জ্বল নকশা সরে সরে যাচ্ছে খেয়াল করতে করতে আমি বলে উঠলাম, “আমি যা জানতে চাই তা হল তুমি ওর সম্পর্কে কী ভাবো? তুমি পছন্দ করো ওকে? সোজা হ্যাঁ বা না-তে উত্তর দাও।”
“হ্যাঁ।”
এটা আশা করিনি। আমি চেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম ও বলবে— না। সম্ভবত টুনজি এই স্মৃতিসত্তাটার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছে, মতবিনিময় আর সংলাপের আদান-প্রদান করেছে, আর আমি যা ভাবছি তার চেয়েও বেশি সখ্য গড়ে তুলেছে এ আই-এর সঙ্গে। যাইই হোক, এই স্মৃতিসত্তাটা গত চল্লিশ বছর যা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, তা যত সূক্ষ্মই হোক না কেন, আমার মাকে প্রতিনিধিত্ব করে যে যান্ত্রিক সিস্টেম গঠন করা হয়েছিল, তার ভেতরে পরিবর্তন এনেছে। ভাবনা-ম্যাট্রিক্সে একটা সামান্য পরিবর্তন, মা মূলত যা ছিল তাকে বদলে দেবে না ধরে নেওয়া যায়, অন্তত তার ভাবনাচিন্তার মূল পথগুলিকে।
কিন্তু, একটা চালের স্তূপ থেকে একটা একটা করে দানা সরাতে থাকলে, ক্রমাগত সরিয়ে যেতেই থাকলে, একসময় সমস্ত চালই নিঃশেষ হয়ে যাবে। ফলে স্তূপটা আর স্বাভাবিকভাবেই স্তূপ থাকবে না। এই পদ্ধতিটা চলতে থাকলে একটা না একটা সময় এও তো জেনে ফেলা সম্ভব যে ঠিক কখন আর স্তূপটা প্রকৃত স্তূপ নেই? কখন এটা অন্য কিছু হয়ে গেছে? হয়েছে কী আদৌ? কে ঠিক করে দেবে ক’টা দানা মিলিয়ে একটা ‘স্তূপ’ হয়? কয়েকটা মাত্র চালের দানা পড়ে থাকার সময়ও কি ওটাকে একটা স্তূপ বলব? বলব না তো? তাহলে ঠিক কখন ওটা একটা স্তূপ থেকে পরিবর্তিত হয়ে অন্য কিছু হয়ে গেল যা কিনা আর চালের স্তূপ নয়? কখন আমার এই ‘মায়ের-হুবহু-প্রতিলিপি’ বদলে ‘মায়ের-হুবহু-প্রতিলিপি-নয়’ হয়ে গেল?
আমি মাথা নাড়ালাম। আমি সেই দার্শনিক আপাতবিরোধিতার মধ্যেই পড়ে যাচ্ছিলাম যার সমাধানসূত্র হিসেবেই এই পরীক্ষাটা তৈরি করা এবং নামকরণ করা হয়েছে। খুব জটিল একজন মহিলার বছর চল্লিশ আগের স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে নেওয়া আমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে এই পরীক্ষাটা। আমিই কি এখন সেই পুরোনো মানুষটা আছি যখন আমি তাকে জানতাম? চল্লিশ বছর আগে যে অণুকণা দিয়ে আমি তৈরি ছিলাম এখন মোটেই হুবহু সেই অণুতে গড়া নই। কোনোকিছুই তো ধ্রুব নয়। আমরা সবাই একটা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে চলেছি। আমার নিজের ব্যক্তিসত্তাটি কি এতটাই দূরে সরে গেছে যে আমারই আর জানার ক্ষমতা নেই যে মা কী ভাবত? নাকি এখানে একেবারে অন্যরকম কিছু চলছে?
“শুনে ভালো লাগল,” আমি সপাট মিথ্যে বললাম। “এবারে বলো, এই ঘরের তাপমাত্রা কত?”
“একুশ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস।” মায়ের গলার ভাবলেশহীন প্রতিচলনটি আমার ওপর তার অনুভূতির প্রভাবটা হারিয়ে ফেলেছিল।
“আমার বয়েস আর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী, এইটা কি আমার আরামের জন্য সঠিক তাপমাত্রা?”
“হ্যাঁ, এইটাই সবচেয়ে ঠিকঠাক।”
জোর করে টেনে একটা শ্বাস নিলাম, ‘ঘোঁৎ’ করে একটা শব্দ বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রায়। “ওলুসোলা!” আরেকবার না হয় চেষ্টা করে দেখি, বেশ আবেগ দিয়ে, আমার সন্দেহটাকে আরেকটা সুযোগ দিই হারাকিরি৪ করার জন্য। “যদি তুমি এখানে, আমার পাশে, হাতে একটা নিয়ন্ত্রক যন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তাহলে ঘরের তাপমাত্রাটা ঠিক কত রাখতে?”
“এই এখনকার যথাযথ তাপমাত্রাটা, একুশ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস।”
এই তো।
“ধন্যবাদ। এখনকার মতো আমার রিগ্রেশন পরীক্ষা শেষ।”
টকটকে লাল অধিঘনক ম্যাট্রিক্স এবং হলদে রেখার মতো আলোগুলো গুটোতে গুটোতে যেন সংকুচিত হয়ে পরীক্ষার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে, এবং তখনই, সেটা মাঝপথে দুম করে অদৃশ্য হয়ে গেল; যেন ওদের স্রেফ কেউ নিভিয়ে দিল। সংখ্যা আর চিহ্নের বিচিত্র সুন্দর ক্যালাইডোস্কোপ, যা মিটমিট করছিল, বয়ে যাচ্ছিল, খেয়ালি বাধায় জ্বলজ্বল করে উঠছিল, কিচ্ছুটি নেই, ঠিক স্বপ্নের মতো যেন। বয়স্কা মেয়েরা কি তাদের বৈদ্যুতিন মায়েদের স্বপ্নে দেখে?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
স্ল্যাবগুলো.. ধীরে.. ধীরে মাটিতে ফিরে যেতে থাকে আর এবারে আমি চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে ভালো করে দেখি ওগুলো খোলসের মধ্যে ঢুকছে, ঠিক মেঝে ফুঁড়ে উঠে আসেনি, স্ল্যাটটেক্স দিয়ে তৈরি হলে অবশ্য তাইই হত। ওরা আমার চোখের সামনে থেকে নেমে গেল, ফেলে রেখে গেল একটা অদ্ভূত নীরবতা। যে নীরবতা বজায় ছিল ওরা উঠে আসার পর থেকেই। ব্যস! রিগ্রেশন পরীক্ষা শেষ।
খুট করে একটা শব্দ শুনলাম আর দরজাটা অর্ধেক খুলে গেল। ডক্টর দিমেজি ঢুকল, হাতে একটা ট্যাব। “মনে হয় ভালোভাবেই হয়েছে,” ঢুকতে ঢুকতেই বলল সে। ওর চলাফেরাটা কেমন সাপের মতো আর ভীতিজনক। অথবা আমিই এমনটা ভাবছি হয়তো। আমি ভাবছিলাম আর কে কে আমায় পর্যবেক্ষণ করছিল আর এই যা ঘটল তা নিয়ে তারা ঠিক কী ভাবছে? মনে আছে, আমার ডেটাপ্যাকে বলা ছিল যে রিগ্রেশন পরীক্ষার ছক সাধারণভাবে তিনজনের একটা দল তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু এখানে আসা অবধি আমি তো ডক্টর দিমেজি ছাড়া কাউকেই দেখিনি। ফের মনে করে দেখলাম, ঠিক। রিসেপশনেও কেউ ছিল না, যা খুবই অস্বাভাবিক।
“আপনার প্রশ্ন কমই ছিল, কিন্তু ভালো, প্রত্যাশাও সেরকমই ছিল। কয়েকটা দার্শনিক, কয়েকটা আবার ব্যক্তিগত। আমি ঠিক নিশ্চিত নই তাপমাত্রা নিয়ে আপনার শেষ প্রশ্নটা করে ঠিক কী জানতে চাইছিলেন? তা যাকগে। তো, বলুন ম্যাডাম, এক থেকে দশের মধ্যে, এই পরীক্ষিত ভাবনা-প্রতিরূপ যে ঠিক আপনার মায়ের মতোই চিন্তা করে, সে সম্বন্ধে আপনার আত্মবিশ্বাসের পরিমাপ কতটা?”
“শূন্য।”
“বেশ বেশ!” আমি কী বলেছি তা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই ডক্টর দিমেজি শান্তভাবে মাথা নেড়ে হাতের ট্যাবলেটে খুটখুট করে নোট নিতে থাকে, কিন্তু এরপরেই এক ঝটকায় মাথাটা তোলে সে, ওর মুখের ভাবখানা বিভ্রান্ত।
“দুঃখিত। কী বললেন?”
“ওই যুক্তি-যন্ত্রটা আমার মা নয়। কোনো বিষয়ে মা যা ভাবতে পারত এটা সেটাই ভাবে বটে, কিন্তু যে পদ্ধতিতে ভাবে মা কোনোকালেই সেভাবে ভাবত না।”
ডক্টর দিমেজির মুখটা কুঁচকে গেল, কপালে ভাঁজ পড়ল, তাতে ওর সরীসৃপের মতো চেহারাটার অদ্ভুত ভাবখানা বদলে অলুক্ষুণে বলে মনে হতে লাগল আমার কাছে।
“আপনি কি নিশ্চিত?” সোজা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। তার সরু চোখ দুটো আরো কুটিল বলে মনে হচ্ছিল এইবার। আমরা যে এখানে একলা আছি সে কথাটা হঠাৎ আমার বুকের ওপর ভারী পাথর চাপার মতো করে চেপে বসল। যে ভাবনাটা আমাকে আরো অসুস্থ করে তুলল, সেটা হল যে আমি জানি না যে ও যদি আমায় কিছু করেও আমি সাহায্যের জন্য চেঁচালে আদৌ কেউ এখানে আসবে কিনা। আমি মোটেও এই বিচ্ছিরি ঘরটায় মরতে চাই না। এই গিরগিটি-মুখো লোকটার হাতে তো নয়ই।
“এইমাত্র তো তোমায় বললাম আমি, বলিনি?” আমি একটু খেঁকিয়ে উঠলাম, “প্রাথমিক ভাবনাচিন্তাগুলো মোটামুটি ঠিক কিন্তু কিছু একটা বুনিয়াদি তফাৎ আছে। এটা অনেকটা মায়ের মনের সঙ্গে অন্য কারো মন মিলিয়ে একটা নতুন মন তৈরি করা।”
“ও, আচ্ছা।” ডক্টর দিমেজির কোঁচকানো-ভুরু এবারে মুচকি হাসিতে বদলে গেল। যাক, তবু খানিকটা মানুষের মতো অভিব্যক্তি চোখে পড়ল। আমি একটু হাঁফ ছাড়লাম।
কানের কাছে গুণগুণ করে কীসের শব্দ হচ্ছে খেয়ালই করিনি, যতক্ষণ না ওই জিনিসটা আমার মাথার পেছনে ঘাড়ের ঠিক ওপরটায় হুল ফুটিয়ে দিল। স্পষ্ট দেখলাম ডাক্তারের মুখের হাসিটা ঘোরালো হয়ে উঠল। আমি ব্যথায় কঁকিয়ে উঠতে গেলাম কিন্তু কোনো শব্দ বেরোলো না, গলাটা যেন কেউ চেপে ধরেছে। আমার শরীরটাও কাজ করছে না যেমনটা করা উচিত। হাতগুলোয় খিঁচুনি ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল আর শক্ত কাঠের মতো হয়ে উঠল। ভেতরে ভেতরে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেও আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কিন্তু স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু আমার শরীরটা আর আমার বশে ছিল না। কেউ বা কিছু যেন আমার দেহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল। সবকিছু কেমন বোঁদা মেরে গেছে।
একটা লোক আধখোলা দরজাটা দিয়ে ঢুকে এল আর ওকে দেখেই আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল।
আহ্! টুনজি।
ও.. একটা.. ধূসর.. রঙের.. বানানো স্যুট পরে ছিল, যেরকমটা ও চিরকাল পছন্দ করে। আমায় উপেক্ষা করে ও ডক্টর দিমেজির দিকে হেঁটে গিয়ে লোকটার ট্যাবলেটটা দেখল। ছিপছিপে ছেলেটাকে শেষ যবে দেখেছি তার চেয়েও বেশই কালো দেখতে লাগছে।  ওখানে প্রায় তিরিশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল সে, তারপর বলল, “তুমি এটা ঠিক করোনি।”
“কিন্তু এটা রিগ্রেশন টেস্ট-এ পাস হয়ে গেছে। পাস হয়েছে তো।” ডক্টর দিমেজি প্রতিবাদ করে উঠল।
টুনজি কটমট করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ না ও চোখ নামিয়ে নিল। এখন ওর নজর পায়ের দিকে, মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ইতিমধ্যে সমস্ত শক্তি দিয়ে কিছু বলতে চাইলাম, টুনজিকে ডাকতে চাইলাম, চেঁচিয়ে বলতে চাইলাম– ‘টুনজি এখানে এসব কী হচ্ছেটা কী?’ কিন্তু মুখটা একটু কোঁচকানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না।
“উনি যদি বলতে পারেন যে একটা তফাৎ রয়ে গেছে,” টুনজি দিমেজিকে বলছিল, “তাহলে এটা রিগ্রেশন টেস্ট পাস করেনি, করেছে কি? এখানে মানুষী নিয়ন্ত্রণ করানোর পিছনে একটা কারণ আছে। ওঁকে এখানে আনার ব্যাপারে যে বোর্ড জোর দিয়েছে তারও একটা কারণ আছে: কারণ উনি ওঁর মায়ের সম্পর্কে যা জানেন তা আর কেউ জানে না। সুতরাং ফালতু বোলো না যে এটা রিগ্রেশন টেস্ট পাস করে গেছে কারণ অন্যান্য কোডগুলো তুমি চালাকি করে সামলেছ। আমি চাই তুমি ওঁর পরীক্ষার প্রশ্নগুলো আরেকবার খুঁটিয়ে দেখো আর ঠিক ঠিক আমায় বলো যে আমার চিন্তা-ছকের ঠিক কোন অংশগুলোকে উনি ওখানে ধরতে পেরেছেন এবং সেটা কীভাবে। বুঝেছো? আমরা কোনোরকম ঝুঁকি নিতে পারি না।”
দিমেজি মাথা নাড়ল, ওর গিরিগিটির মতো চেহারাটার সঙ্গে এই মাথা নাড়ার ভঙ্গিটা একেবারে মানানসই, স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছিল।
আমার মনের মধ্যে বোধশক্তির অনুভূতিটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ছিল। টুনজি আসলে আমার মায়ের স্মৃতিসত্তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটির মধ্যে ওর নিজের ভাবনা-ছক ঢুকিয়ে দিয়ে নয়া গবেষণার গতিমুখের বিষয়ে মায়ের সম্মতি আদায় করতে চাইছিল যাতে ওর ভাবনার একটা বৈধতা আসে। আপাতভাবে ও এমন একটা জিনিস বানিয়েছে যেটা হয় হাস্যকর অথবা মৌলিক অথবা দুটোই, ফলে বোর্ড রিগ্রেশন টেস্ট করানোয় জোর দিয়েছে। সুতরাং ও এখন আমাকে ব্যবহার করে কাজটা হাসিল করতে চাইছে। রিগ্রেশন টেস্টকে বোকা বানাতে হলে এছাড়া গতি নেই।
“আর চটপট করো। আবার শুরু করার আগে আমরা ওর শর্ট টার্ম মেমরি মুছে দিতে পারি, কিন্তু এক ঘণ্টার বেশি স্মৃতি মুছে দেয়া সম্ভব নয়।”
টুনজি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর শান্তভাবে দিমেজির কাছ থেকে আমার দিকে ঘুরল। ওর মুখটা শক্ত। দয়ামায়াহীন চোখে আমার দিকে তাকাল সে। “সরি দিদা!” ঝকঝকে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা ওর কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম আমি, “এটাই একমাত্র রাস্তা।”
‘ওমো আলে জাতি জাতি!’৫ বজ্জাত ছেলে কোথাকার। আমি অভিশাপ দিলাম, রাগের চোটে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠছিল। আমি জীবনে কাউকে এভাবে খুন করার কথা ভাবিনি, কিন্তু এও জানি আমি সেটা পারব না। তবু আমি ওদের এইভাবে পার পেতে দেব না। আমি মস্তিষ্কের সমগ্র চেতনা একাগ্র করে একটা কথায় মনোনিবেশ করলাম, যে কথাটা ওরা আশা করি কখনওই বুঝতেই পারবে না। আমার মা তাঁর উচ্ছ্বল, রিনরিনে গলায় সে কথাটা প্রায়ই বলত। মানুষের সাধ মেটানোর প্রসঙ্গে বলা সেই ছোট্ট কথাটা আসলে একটা প্রায়শই বলা আধা-রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু এখন সেটাই আমার স্মৃতির ভরসাবিন্দু।
‘ব্যাপারটা কখনওই নিখুঁত হয় না। কমবেশি একটু সবসময়ই থাকে’।
টুনজি সরে দাঁড়াতেই ডক্টর দিমেজি ক্লান্তভাবে আমার দিকে এগিয়ে এল, ভাবলেশহীন চোখ। টুনজি! অপদার্থ ছেলে কোথাকার। এ নাকি আমারই রক্তমাংসে গড়া! ‘গাছ থেকে আপেলটা কতদূর পড়েছে।’ আমি এই শব্দগুলো ক্রমাগত মনের মধ্যে আওড়াতে থাকলাম যাতে এখনকার এই মুহূর্তটির সঙ্গে আমার মায়ের সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতির একটা নিরপেক্ষ যোগসূত্র তৈরি করতে পারি।
ব্যাপারটা কখনওই নিখুঁত হয় না। কমবেশি একটু সবসময়ই থাকে।
ডক্টর দিমেজি সামনের দিকে ঝুঁকে এল। ধূসর রঙের একটা রক্তমাখা জিনিস আমার ঘাড়ের পেছন থেকে টেনে বার করে কীসব কারিকুরি করল সে। প্রবল অস্বস্তি ছাড়া আর কিছুই বোধ করছি না। এমনকি ওর কারিকুরি শেষ করে আবার ঘ্যাঁচ করে ওটা ঘাড়ে ঢুকিয়ে দেয়ার পরেও না।
ব্যাপারটা কখনওই নিখুঁত হয় না। কমবেশি একটু সবসময়ই থাকে।
আমি মনের মধ্যে শব্দগুলো আওড়াতে থাকি, বার বার, বার বার… ভাবতে থাকি চেতনা হারিয়ে চারপাশে অন্ধকার নেমে এলেও ওরা আমাকে নিয়ে, বা আমার স্মৃতিকে নিয়ে, কিংবা ওই জিনিসটা যেটা আমার মায়ের স্মৃতিমাত্র… তাকে নিয়ে যা খুশি তাই করুক না কেন, আমি শুধু মনে রাখব এই প্রশ্নটা মাকে করার কথা।
ব্যাপারটা কখনওই নিখুঁত হয় না। কমবেশি একটু সবসময়ই থাকে। আর উত্তরটা শুনে বিস্মিত হতে কক্ষনো ভুলব না।
টীকা
১) আজাহ- নাইজিরিয়ার লাগোস রাজ্যের এক ছোট্ট
 শহর আজাহ। এককালে জেলেদের গ্রাম হিসেবে গড়ে ওঠা এই ছোট্ট জায়গার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বড়ো কম নয়। 
২) আগামা গিরগিটি- সরীসৃপের এই প্রজাতি আফ্রিকার নানান অঞ্চলে পাওয়া যায়। শান্তশিষ্ট, উজ্জ্বল রঙের এই গিরগিটিগুলোকে অনেকেই পোষেন। এ-গল্পে দিমেজিকে সেই পোষ্যর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
৩) পপ ফিলোসফি- পপ ফিলোসফি বলতে সাধারণত পপুলার ফিলোসফিই বোঝানো হয়। কিন্তু আসলে এই দর্শনের সঙ্গে নান্দনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি জড়িয়ে আছে। সংক্ষেপে, রাজনীতি ও সমাজের নিরিখে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সততা এবং উদারতা, গণতান্ত্রিক আদর্শ, বাণিজ্য এবং প্রতিশ্রুতির মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাভাবনা করার ফলে এই দর্শন গড়ে ওঠে।
৪) হারাকিরি- জাপানি সামুরাইদের প্রাচীন প্রথা, কোনো কাজে ব্যর্থ হলে হারাকিরি অর্থাৎ পেট চিরে আত্মহত্যা করার চল ছিল।
৫) ওমো আলে জাতি জাতি- ইয়োরুবা ভাষায় এই শব্দবন্ধটি সাধারণত ব্যবহার করা হয় অল্পবয়সী ও অবাধ্য ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্য করে, যদিও আক্ষরিক অর্থ বিচার করলে ‘son of a bastard’ কথাটাকে অপমানজনক বলেই মনে হয়। কিন্তু অর্থ নিয়ে বিশেষ কেউ মাথা ঘামায় না। ইয়োরুবা সংস্কৃতিতে ওমো আলে জাতি জাতি, ওলোরি বুরুকু, সে ওন সেপে ফান এ’ কথাগুলো কয়েকযুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে, ঠিক আমাদের ভাষায় ব্যবহৃত অপশব্দের মতোই।
লেখক পরিচিতি
ওলে তালাবি নাইজেরিয়ার লেখক। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, লেখালেখি ছাড়াও সম্পাদনা করেন। কর্মসূত্রে মালয়েশিয়াতে থাকেন। তাঁর লেখা বিভিন্ন গল্প দ্য  ম্যাগাজিন অফ ফ্যান্টাসি এন্ড সাইন্স ফিকশন(F&SF), লাইটস্পিড ম্যাগাজিন, আফ্রো এস এফ ভলিউম থ্রি, ওমেনানা, ম্যানচেস্টার রিভিউ এবং অন্যান্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ওলে দুটি রচনাসংগ্রহের সম্পাদনা করেছেন আর যৌথভাবে একটি নাটক লিখেছেন। তাঁর লেখা একাধিক গল্প বিভিন্ন
 আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য জন্য মনোনীত হয়েছে। এছাড়াও নরওয়েজিয়ান, চিনা এবং ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ওঁর গল্প। ‘The Regression Test’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। আফ্রিকান স্পেকুলেটিভ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য নোমো অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়েছিল গল্পটিকে, পাশাপাশি গল্পটি আফ্রিকান সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার কেইন প্রাইজের জন্যও মনোনীত হয়। গত পাঁচ বছরে অসংখ্য পুরস্কার জয় ও পাঠকপ্রিয়তা
 পেয়ে এই গল্পটি বিশ্বসাহিত্য ‘কাল্ট’ হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত ওলের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘Incomplete Solution’ ও ঝড় তুলেছিল সাহিত্য সমালোচক ও পাঠকদের মধ্যে। সে বছরের সেরা নভেলার নোমো অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় এই বইটি। 
অনুবাদক পরিচিতি
শান্তনু বন্দোপাধ্যায় লেখালিখি করছেন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। মূলত কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর গদ্য লেখার হাত ঈর্ষণীয়। তাঁর লেখা ছোটোগল্প, ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিকথা পড়লে তাঁর ভাষাজ্ঞান ও বিষয় সচেতনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়াও শান্তনুর আরেক পরিচয়, তিনি অসামান্য অনুবাদক। বিভিন্ন ঘরানার গল্প তিনি অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে অনুবাদ করেছেন। ভালোবাসেন পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে। উল্লেখযোগ্য কাজ জয়ঢাক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত
 পাহাড়ি গ্রামের গল্প (ভ্রমণ কাহিনি), বনভ্রমণ মনভ্রমণ (ভ্রমণ+স্মৃতিকথন), মানচিত্রের সন্ধানে (কবিতা সংগ্রহ), ঈশ্বর: এক নিঃসঙ্গ ফিনিক্স (সম্পাদনা) এবং সুচেতনা থেকে প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ কাপ্তান সুরেশ  (সুরেশ বিশ্বাস) ও ভারত ভ্রমণ (দীন মহম্মদ)।   
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন