কোরিয়ালিস – টি এল হুচু। অনুবাদ : পার্থ দে

কোরিয়ালিস। লেখক— টি এল হুচু। অনুবাদ— পার্থ দে

মূল গল্প: Corialis

পৃথিবী কখন জেগে উঠবে সেটা বলা সহজ। ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বজ্রপাত, খরা আর ব্যতিক্রমী দুর্যোগ। অশুভ ইঙ্গিতগুলি যেন অনিবার্য। কিন্তু কীভাবে এগুলোর সূত্রপাত তা বোঝা বেশ কঠিন, কারণ এই গ্রহগুলি সময়ের গভীরে নিদ্রাগত আর এদের ভিতরের রোষাগ্নি খুব ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যদি একটা ঘড়ি হয় তবে পৃথিবী তথা গ্রহগুলি তার ঘণ্টার কাঁটা, আর আমাদের পার্থিব জীবনের গতি সেই ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার টিক টিক চলনে মাপা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই আমাদের পরিপার্শ্ব আর পরিবেশকে চিনতে ভুলে গেছি। আমরা বাতাসের শব্দকে শুনেও শুনি না, পায়ের তলার নরম মৃত্তিকার স্পর্শ যেন আমাদের অসাড়-হয়ে-আসা অনুভূতিকে ছুঁতে পারে না, আত্মার অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত সঙ্গীত, যা মানবের জীবন-মৃত্যুর ঘাটগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, তাও আজকাল আমাদের হৃদয় নজর-আন্দাজ করে চলে। আমি নতজানু হয়ে বসি, আমার হাতের পাতাগুলি দিয়ে ধুলোমাটি স্পর্শ করে এই জায়গার স্পন্দনটুকু নিই।

“তলিয়ে যাচ্ছে,” গারান্দে বলল। মাটিতে বিন্যস্ত যোগাযোগের কলকব্জাগুলো সে পর্যবেক্ষণ করছিল, দৈত্যাকার আকৃতির চকচকে ধাতব কলকব্জাগুলো যেন চোরাবালির মধ্যে অর্ধেক ডুবে আছে। ঢাউস স্তম্ভটা মাটির ওপর সূক্ষ্মকোণে হেলে কোনোক্রমে পতন রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তলায় একটা বড়ো বাক্স, যা ক্রমাঙ্কিত মাপযন্ত্রে ঠাসা।

“এটা এখানে বসানোর আগে আমরা গোটা জায়গাটায় বিশদে জরিপ করে দেখেছিলাম। এমন তো হওয়ার কথা নয়!” আমি বললাম, “পরিবর্তনশীল রাশিগুলোর কোনোটা দশমিকের পর এক লক্ষ কোটিতম স্থানে পরিবর্তন হলে এটা হতে পারে, অর্থাৎ চেতনার স্তরে আর যোগাযোগ সম্ভব নয়। আমরা আর বাড়িতে ফোন করে কথা বলতে পারব না। আমাদের ঘরবাড়ি তো পাঁচশ আলোকবর্ষ দূরে। ব্যাপারটা একদম ভালো হল না।”

“এখন আমরা কী করি বলো তো, থান্ডেকা?”

“এই জায়গাটা মোটেই ভালো ঠেকছে না, কী যেন একটা নেই, তুমি বুঝতে পারছো?” আমি নতজানু অবস্থা থেকে সোজা খাড়া হয়ে উঠে বলি।

গারান্দে ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল। একজন জীববিজ্ঞানী হিসেবে সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে এমন বস্তুতে আগ্রহী; তার লেখাজোখার মধ্যেও সূক্ষ্ম অনুভূতির রেশ কমই থাকে। কিন্তু গারান্দে এত মৃদুভাষী যে সে কী ভাবছে তাও বলে উঠতে পারে না, তার নীরবতাই যা বলার বলে দেয়। মাথার উপর মেঘমুক্ত ঝলমলে গোলাপি আকাশ, যেন পলকাটা পদ্মরাগমণির ভিতর থেকে আকাশটাকে দেখছি। একটা ভিজে ভিজে কস্তুরিগন্ধী বাতাস বইছে পুবদিক থেকে। সদ্য ভোর হয়েছে আর আমরা গ্যাসের তৈরি গ্রহটার তলায় আছি, যেটাকে আমাদের চাঁদটা আবর্তন করে। বিপরীত পৃষ্ঠে গোটা আকাশ জুড়ে জ্বলজ্বলে সুবিশাল হলুদ সূর্যটা। গারান্দে তার পেটের উপর হাতখানি রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ধনুকের মতো বাঁকা তার মেরুদণ্ডটা উঁচিয়ে আছে, ওটাই ওর পিঠব্যথার কারণ।

“আমি চিফের সঙ্গে কথা বলে বিশদে কাজটা বুঝে নেব, যাতে এই সংযোগ ব্যবস্থার টাওয়ারটা এখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও স্থাপন করা যায়।” আমি শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে বলি, দু’হাতের ধুলো ট্রাউজার্সে মুছে ফেলি। “এখন এই স্তম্ভটাকে নিষ্ক্রিয় করে শীতঘুমে পাঠিয়ে দেব, তারপর এটাকে বেঁধেছেঁদে আবার স্থিতিশীল করে তুলতে হবে।”

আমি ঘাড় হেলিয়ে সায় দিই। ওর ভাষাতেই ওকে বোঝাই।

“আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু…” সে তার হাতখানা পেটের উপর থেকে সরিয়ে একটু ইশারা করে ফের হাতজোড়া ওখানেই রাখল।

“অসুবিধা হবে না, ঠিক হয়ে যাবে।” কোমরে যন্ত্রপাতি রাখার বেল্টটা ঠিক করতে করতে আমি বললাম। এই ভোরবেলা আমাদের যানটা পশ্চিমদিক থেকে উদয় হওয়া সূর্যের আলোর বিপরীতে সুবিশাল আকৃতির ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। যানটির কাঠামোর গায়ে এখানে সেখানে অনেক ছিদ্র, যেখান থেকে নানা যন্ত্রপাতি অন্য নির্মাণের জন্য খুলে নেওয়া হয়েছে।

যানটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা ক্ষতবিক্ষত তিমি সমুদ্রতটের বালিতে এসে পড়ে আছে। আমি ভাবছি, যতক্ষণ না এগুলো স্থাপন করার বিকল্প জায়গার হদিশ পাচ্ছি, ততক্ষণ যোগাযোগের কলকবজাগুলো দৈত্যাকার স্তম্ভটার ওপরে তুলে রেখে গেলে ভালো হয়।

***

আমাদের বসতি অঞ্চলের সারবাঁধা ছাউনিগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি। গোটা বিশেক ছোটো ঘর, স্থানীয় পাথর খাদান থেকে আনা ব্যাসাল্ট পাথর আর আমাদের যানটার জানালার ভাঙা টুকরো দিয়ে তৈরি হয়েছে। ব্যাসাল্ট পাথরগুলো ঘন কালো রঙের, বেশ কসরত করে এগুলোকে নির্মাণের টালির আকার দেয়া হয়েছে। মুসিকাভানুর১ নেতৃত্বে আমরা মধ্য-আফ্রিকার হ্রদ অঞ্চল থেকে এসে মহান জিম্বাবোয়ে গড়ে তুলেছিলাম, সেই সময় থেকেই আমাদের গোষ্ঠীর লোকজন পাথর খোদাইয়ের দক্ষ ভাস্কর হয়ে উঠেছিল। কথিত আছে, আমাদের কাটাছেঁড়া করলেও নাকি পাথরের টুকরো পাওয়া যাবে! সার বেঁধে দাঁড়ানো ঘরগুলোর দেয়ালে স্থানীয় কিছু লতাপাতা গজিয়ে উঠেছে, যেমন সামুদ্রিক জাহাজের খোলে কম্বোজ
 জাতীয় প্রাণীদের খোলস গজিয়ে ওঠে। তাদের সবুজ, লাল আর সোনালি রঙ ঘরগুলোর কালো ব্যাসাল্টের গায়ে বেশ বর্ণময় হয়ে উঠেছে। মাটির তলা দিয়ে যাওয়া তারগুলো এই ঘরগুলোকে ফিশন ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত করেছে, যেটা আদতে একটা পাওয়ার-স্টেশনে পরিণত করা হয়েছে, যাতে আমরা আগামী একশ বছর এখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুৎ পেতে পারি। 

“ইওয়ে!” আমাকে দেখে সেকাই জানালা দিয়ে তার হাতের যন্ত্রটা নেড়ে চেঁচাল। “আমি মারাপাসি বেল্টে আমার বাবার সঙ্গে কথা বলছিলাম, আচমকা সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, কী ঝামেলা হল বলো তো?”

“দাঁড়াও, ঠিক করে দিচ্ছি।” আমি বললাম।

“আমরা চলে আসার পর বাবা এখন একা, বয়সও হয়েছে। আমার পক্ষে এক মিনিট সময়ও নষ্ট করা সম্ভব নয়।”

“আমি দুঃখিত, কিন্তু ঠিক করতে একটু সময় তো লাগবেই।”

“ধুত!” মেয়েটা দাঁত খিঁচিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল।

আবার কেউ জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে অভিযোগ করার আগে আমি পা চালিয়ে এগিয়ে চললাম। আমি পাঙ্গানাইয়ের মিঠাইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে ফুটপাত ধরে বসতি ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম খামারবাড়ির দিকে। আমার কেমন পরিশ্রান্ত লাগছে। অমাবস্যা শুরুর সময় আমাদের মধ্যে যে উচ্ছলতা এসেছিল, তা এখন কেমন যেন মিইয়ে গেছে। সুদীর্ঘ তিন বছর কেটে গেছে, সবাই এখন প্রাত্যহিক কাজকর্মের জাঁতাকলে পড়ে জেরবার। একটা সময় পরে আমিও, আকাশের যে সৌরমণ্ডল থেকে এসেছিলাম তার দিকে তাকানো বন্ধ করে দিয়েছিলাম আর এখানেই শিকড় গেড়ে স্থায়ীভাবে থাকব ঠিক করেছিলাম।

“মারারাসেইকো২.১?” সূর্যের ঝলসানো আলোর থেকে নিজের চোখটা ঢেকে চিফ ওয়ামাম্বো হাঁক পাড়লেন। লোকটা লম্বা, কৃষ্ণকায়, ওর কাঁধ থেকে উরু পর্যন্ত জড়ানো চিতার চামড়াটা দেখেই ওঁদের গোষ্ঠীর টোটেম চেনা যায়।

“তারারা মারারাওয়ো!২.২” আমি বললাম।

“কিন্তু তোমার চোখের চারপাশের কালো দাগটা কিন্তু অন্য কথা বলছে, বুঝলে মেয়ে!” উনি বললেন।

চিফ মানুষটা চট করে সব কিছু ধরে ফেলেন। আমি কয়েক রাত ভালো করে ঘুমোইনি। এখানকার আকাশের বহুবিধ চন্দ্রকলার সঙ্গে শরীর-মনকে সইয়ে নেওয়া বড়ো কঠিন। এখানকার সংখ্যালঘু মানবগোষ্ঠীর পক্ষে কোরিয়ালিসের ছয় ঘণ্টার প্রদক্ষিণ সময়ের সঙ্গে শরীরের সার্কার্ডিয়ান ছন্দকে মেলানো খুব কঠিন। তার উপরে ঘন ঘন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার ধকল তো রয়েছেই।

“আমাদের সংযোগ টাওয়ার আলফা-কমস একদম হেলে পড়েছে, যে কোনো সময় হুড়মুড় করে পড়ে যেতে পারে। ওটাকে ওখান থেকে সরানোর জন্য আমার সঙ্গে তিনজন লোক দিন।”

“তুমি কি জানো দুটো শ্যাওলার চৌবাচ্চা লিক করছে? যদি সমস্যাটা ন্যাসিফ্লেক্সের জন্য হয়ে থাকে তবে আমাদের সব ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। ওই যন্ত্রের ডিজাইনটা অন্তত এক দশক ঠিক ভাবে চলার কথা ছিল।” চিফ ওয়ামাম্বো বললেন, “আমি চক্কর দেয়ার সময়েই আলফা-কমসের অবস্থাটা দেখেছি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“কোথাও বড়ো একটা গণ্ডগোল হয়েছে…”

“থান্ডেকা, টাওয়ার বসানোর জন্য ওই জায়গাটা তুমিই বেছে নিয়েছিলে। স্তম্ভগুলো নির্মাণের কাজটাও তোমার পরিচালনায় হয়েছিল। আর এখন বলছ, তোমার ভুলের খেসারত দিতে আমাকে অন্য কাজের জায়গা থেকে লোক সরিয়ে এনে তোমাকে জোগান দিতে হবে!” চিফের গলার স্বর ন্যামাভুভুর৩ বাতাসের চেয়েও ঠান্ডা শোনাল।

আমি তাঁকে বোঝাতে চাইলাম, এখানে ইদানীং যে যান্ত্রিক সমস্যা, ছোটোখাটো দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো মোটেই স্বাভাবিক নয়। এই সংকেতগুলো আসলে বুঝিয়ে দিচ্ছে এই ধরিত্রী ক্রমেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছে। এখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য এখুনি কিছু করা উচিত। কিন্তু চিফ ওয়ামাম্বো আমাদের যানের ক্যাপ্টেন, মানুষটা বিজ্ঞানসম্মত আর প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণেই বিশ্বাস করেন, আমার কথাগুলো তাঁর কাছে আজগুবি মনে হতে পারে, তাই আমি চুপ করে গেলাম।

আমাদের কাছের চৌবাচ্চাটায় কর্মরত খাকি পোশাক পরা চাষীরা চিফের বিরক্তিভরা উচ্চারণে সজাগ হয়ে তাকাল, কারণ সংযোগ ব্যবস্থার টাওয়ারে কোনো গণ্ডগোল হলে তারা কারিনা-রুরেগেরেরোতে ছেড়ে আসা প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। চিফ তাদের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাতেই চাষীরা ফের কাজে মন দিল। একটা মানবসভ্যতা বিজ্ঞানী আর বুদ্ধিজীবীরা তৈরি করে না, তাকে শ্রমদান করে তিল তিল করে গড়ে তোলে শ্রমিক, শিক্ষক আর গেরস্থালির কাজ করা ও শিশুদের প্রতিপালন করা মেয়েরা। যারা নিজেদের শ্রম আর স্বেদ দিয়ে গড়ে তোলে এই সভ্যতা, তারা আমার মতো সাধারণ মানুষ।

“এটা আমারই গাফিলতি, এর পুনরাবৃত্তি হবে না আর।”

“তুমি সাহায্য করার লোক পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি বারবার তোমার এই জঞ্জাল সাফ করতে পারব না, বুঝেছ?” চিফ ওয়ামাম্বো ফের ন্যাসিফ্লেক্সের চৌবাচ্চার দিকে মন দিলেন, যেগুলো থেকে জমিতে সরবরাহ করা হয়।

***

হালক্যাম বন্দরের কাছে দেখা গেল মহাকাশের অনন্ত অন্ধকার বিস্তারের প্রেক্ষাপটে নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলোগুলো ছুটে চলেছে। কোনো মহাকাশযানেই আসল জানালা নেই, কিন্তু ভিতরের পর্দাগুলোর দৃশ্য দেখে জানালা বলে ভ্রম হয়, যেন বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিই বাইরে উঁকি দিলে অস্পষ্ট সাদা আলো ছাড়া কিছু দেখা যায় না। অবশ্য পর্দার এই কৃত্রিম দৃশ্যগুলোর জন্য মেডিল্যাবের ভিতরকার দমবন্ধ করা ব্যাপারটা নেই। মেডিল্যাবের ভিতরের পরিসরে রয়েছে একটা রূপোলি ইউনিট, পর্দা, বিপ বিপ শব্দ ভেসে আসছে আর চতুর্দিকে রাখা আছে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি।

ক্ষুরটা আমার মাথার খুলির চামড়া স্পর্শ করে ঘষটানি দিতেই আমি আঁতকে উঠলাম। ক্ষুরের প্রচণ্ড কুররর শব্দটা আমার মাথার খুলি ভেদ করে যেন ঢুকে গেল। জলের বেসিন থেকেও ক্ষুরের খুটখাট শব্দটা আসছে, গারান্দে ক্ষুর থেকে ফেনাটা ধুয়ে ফেলছে। আমার মাথার লাল চুলগুলো বেসিনের জলের তরঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। ক্ষুরটা ঝাড়ছে, মুছছে, ফের ক্ষুর চালিয়ে চুল কাটছে, আমার মাথার চড়াই-উতরাই বরাবর।

“বেশ মজার না! এই যানের ভিতর এত উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও মাথা কামানোর জন্য এই পুরোনো দিনের ক্ষুরের মতো ভালো কিছু নেই।” গারান্দে বলল।

“আমার এই চুল ছাড়া আফ্রিকান মাথাটা কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে না?” আমি বললাম। 

“তোমাকে ই.টি-র পোঁদের মতো লাগছে।” ও খ্যাকখ্যাক করে হাসল।

“হাসছ কেন গো!” আমি ওর পায়ের উরুতে একটা ঘুষি মেরে বললাম।

“তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।” সে বলল, নীচু হয়ে আমার মাথার চুলহীন ন্যাড়া অংশটায় চুমু খেয়ে বলল, “তোমার বড়ো বড়ো বাদামি চোখদুটো আমার খুব ভালো লাগে।”

“বাহ, এই তো দিব্যি আবার ভালো ভালো কথা বলছ, নাও আবার কাজে লেগে পড়ো দেখি।”

আমার ন্যাড়া মাথাটায় ঠান্ডা লাগছিল, যখন ও আমার মাথাটা পুরো কামিয়ে দিল, তখন আমার মাথাটা জন্মের সময়ের চেয়েও বেশি মসৃণ হয়ে উঠল। আমার শরীরের প্রতিটি রোম— মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত, ভুরু, চোখের পাপড়ি, নাকের চুল সহ সব কামিয়ে আর তুলে ফেলা হল যতক্ষণ না আমার শরীর সম্পূর্ণ রোমহীন হল। চুলগুলো ফের গজাতে শুরু করলে কাঁটার মতো খোঁচা লাগবে জানি, কিন্তু এসব এভাবেই করতে হয়।

গারান্দে আর আমি একটা প্রমাণ সাইজের আয়নার সামনে সোজা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের দেখতে লাগলাম, যতক্ষণ না ডাক্তার এসে পৌঁছয়।

“বাহ্, বেশ বেশ, তোমরা তাহলে পরের ধাপের জন্য তৈরি।” আমাদের পর্যবেক্ষণ করে ড. নগুলুবে বললেন। ডাক্তার মধ্য-চল্লিশের এক মহিলা, এই মহাকাশযানের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। “ডিকন্টামিনেশন ইউনিটের দিকে এগিয়ে চলো।”

“অবশ্যই, অবশ্যই, ক্যাপ্টেন।” মুখে বোকা বোকা হাসি টেনে গারান্দে বলল।

ড. নগুলুবের নির্দেশ একটু রুক্ষ শোনালেও সেটা তাঁর উদার প্রকৃতিকে মোটেই আড়াল করেনি। তিনি একটা ক্লিনরুম স্যুট পরে ছিলেন, তাই মুখটা দেখা যাচ্ছিল না, শুধু তাঁর চোখদুটো দৃশ্যমান। আমাদের মিশনকে সফল করার পথে এটাই সবচাইতে কঠিন ধাপ। ঠান্ডা মেঝেটার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে আমার খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার পায়ের নখগুলো খুব ছোটো করে কাটা। যখন কমলা রঙের আলোটা আমার ওপর এসে পড়ল, আমি তখন দম আটকে চোখজোড়া বুঁজে ফেললাম। ঘুরন্ত নলের মুখ দিয়ে চতুর্দিকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল রাসায়নিক, অ্যালকোহল আর টপিক্যাল অ্যান্টিবায়োটিকের বাষ্প।

“এবার একটা একটা করে পা তোলো। হাতের আঙুল আর পায়ের পাতা টানটান করে মেলে ধরো।” ইন্টারকমের অপর প্রান্ত থেকে ড. নগুলুবে বললেন। “একটু কাত হয়ে বোসো, প্লিজ। গালদুটো দু’পাশে টেনে ধরো। ধন্যবাদ।”

রাসায়নিকের বাষ্প ছিটানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঘরের বাষ্প টেনে বের করে দেয়ার জন্য ভ্যাকুয়ামের সুইচও অন করা হল। আমি যখন শ্বাস নিলাম, বাতাসটা যেন খামচে ধরল। গারান্দে আমাকে সাহায্য করতে হাত বাড়াল।

“উঁহু, ছোঁবে না!” ড. নগুলুবে বললেন, “সরি।”

“ঠিক আছে।”

“এক নম্বর পরিশোধন কক্ষের দিকে যাও। এখানে তোমাদের এক সপ্তাহ.. থাকতে ..হবে। দয়া করে তোমার বাঁদিকে টেবিলের উপর রাখা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রথম কোর্সটা খেয়ে নাও।”

ওটা পেটে ঢুকতেই এতক্ষণে সত্যিই মনে হল আমরা এটা করছি। পরের তিনমাস ধরে গারান্দে আর আমি সাতটা পরিশোধন কক্ষের মধ্যে দিয়ে যাব। আমাদের ধমনীর মধ্যে দিয়ে অনেকগুলো কড়া অ্যান্টিবায়োটিকের ইনজেকশন নিতে হবে, চামড়ায় অনেক রকমের অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম ঘষতে হবে। অ্যালকোহল জেল আর ডিকন্টামিন্যান্ট মেখে চান করতে হবে, অতিবেগুনি রশ্মি নিতে হবে, আমাদের মুখ, পায়ু আর শরীরের যত ছিদ্র আছে সব জায়গায় নল ঢোকানো হবে। আর এসব চলবে ততক্ষণ, যতক্ষণ না আমাদের শরীরের ওজনের যে এক শতাংশ অনুজীব রয়েছে সেগুলো থেকে আমরা মুক্ত হচ্ছি। কিন্তু ওই প্রোবায়োটিক অবস্থায় পৌঁছনোর আগেই অপুষ্টিজনিত কারণে আমাদের শরীরের ওজন অনেক কমে যাবে। তারপরে আমাদের শরীরের ভিতর উপযুক্ত মিথোজীবী অনুজীব ভরে দেয়া হবে, যেগুলো কোরিয়ালিস গ্রহের আদিম অনুজীব, তার ফলে আমাদের শরীরের ভিতরে এক নতুন জীবমণ্ডল তৈরি হবে!”

আমার মনে হচ্ছিল যেন আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করার যন্ত্রের মধ্যে ঠেসে ঢোকানো হয়েছে, তারপর সেই টুকরোগুলোকে কুচিয়ে কিমা বানিয়ে ঝাল লঙ্কার সসে ডোবানো হয়েছে। আমার স্নায়ুতন্তুগুলো যেন জ্বলছিল, ব্যথা কমানোর মলম ঘষেও কাজ হওয়ার নয়। আমার অন্ত্রের মধ্যেকার উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো না থাকায় খাবারদাবারও হজম হচ্ছিল না, ঘন ঘন উদরাময় হচ্ছিল। সারাক্ষণ ভীষণ অবসন্ন লাগছিল। আমাকে আগে সাবধান করে বলা হয়েছিল পদ্ধতিটা যন্ত্রণাদায়ক হবে, কিন্তু সেটুকু শুনে তো বোঝার উপায় ছিল না পদ্ধতিটা কতটা নিদারুণ যন্ত্রণার হতে চলেছে। বারবার পেট পরিষ্কার করা আর অন্ত্রের ভিতর জল ঢুকিয়ে ওয়াশ করা।

মানসিক অবসাদ আর উদ্বেগ আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। পদ্ধতিটার মাঝপথে এসে আমার ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা, কিন্তু বেরোবার উপায় নেই, আমি যে ফর্মটা স্বাক্ষর করে সম্মতি জানিয়েছিলাম! এই একমুখী যাত্রাপথের থেকে পিছনদিকে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না।

***

ঠিক গোধূলির সময় আমাদের লাল দৈত্যাকার গ্রহটার আয়নীভূত মেরুপ্রদেশের মাথায় ইলেক্ট্রিক ব্লু রঙের অরোরা ফুটে ওঠে, সেই আলো ঘোরে, ঝলমল করে। আলফা-কমস এখন বেশ সুরক্ষিত এবং আগামীকাল ভোরের আগে ওখানকার কর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠবে না। তাই আমি গারান্দেকে খুঁজে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। ক্যালসাইটের ফুল ফুটে আছে যেন চতুর্দিকে। মহাকাশ থেকে কোরিয়ালিসকে বেগুনি-গোলাপি রঙের রত্নের মতো দেখায় কারণ গ্রহের গা থেকে প্রতিফলিত আলো চারদিকের বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে প্রতিসৃত হয়। দেখে মনে হয় যেন রঙের মাতন লেগেছে, রামধনুর বর্ণালীর ছটায় ভেসে যায়। কোরিয়ালিস এক নতুন পৃথিবী আর আমি তার উচ্ছল শক্তি টের পাই প্রতিদিন ঘুম ভেঙে বিছানা ছেড়ে ওঠার মুহূর্তে। এখানকার ফুলগুলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হয় এক রঙবেরঙের ক্যালাইডোস্কোপ ভাস্কর্যের উদ্যানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। আমরা ওগুলোকে ফুল বলি, লম্বা লম্বা আকৃতির গড়নগুলোকে বৃক্ষ বা গুল্ম ভেবে নিই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এখানকার উদ্ভিদজগত পৃথিবীর প্রবালপ্রাচীরের মতো। এখনও পর্যন্ত কোরিয়ালিসে আবিষ্কৃত সব জীবগুলিই এককোষী। এখানে ডাঙায়, জলে কিংবা ভূগর্ভের ভিতরে পাওয়া কোনো জীবই বহুকোষী বা জটিল গড়নের নয়। এই সমস্ত এককোষী প্রাণীদের দেহ-ক্ষরণেই তৈরি হয়েছে চতুর্দিকের ল্যান্ডস্কেপ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আগ্নেয়গিরির নির্গমণ পথ, জ্যামিতিক আকৃতি, লম্বা নলাকৃতি, লিলি-সদৃশ চাকতি আর নীহারিকাপুঞ্জের মতো এইসব অদ্ভুত গড়ন।

আমি দেখতে পেলাম গারান্দে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে তার মাল্টিমিটারে খুব মনোযোগ সহকারে রিডিং নিচ্ছে। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত ও আমাকে লক্ষ করেনি। দেখলাম ওর হাতের যন্ত্রটা আটকানো আছে প্যাঁচানো আকৃতির বাদামি, নীল এবং হলুদ রঙের পাঁচমিশালি শ্যাওলাগুলোর সঙ্গে, যেগুলো থোক থোক পশমের মতো গোটা প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। যেন কাঁথার উপর কোনো সূচীকর্ম। তার যন্ত্রপাতিগুলো ধুলোর মধ্যে রাখা। নানারকমের পরিমাপ রেকর্ড করে সে জোরে জোরে উচ্চারণ করছে যন্ত্রটার দিকে।

“এই থান্ডেকা, ডেটা রেকর্ডিং বন্ধ করে এই রিডিংগুলো দেখো।” সে তার যন্ত্রের স্ক্রিনটা ঘুরিয়ে ধরে স্ক্রল করে করে সেখানে লেখা পরিমাপ আর লেখচিত্রগুলো দেখাতে শুরু করল।

“কী দেখচ্ছ এটা?”

“আরে, আমি এখানকার জীবভরের স্পন্দন মাপছিলাম, ফলাফল অবিশ্বাস্য।” গারান্দে অন্য একটা রেখাচিত্র এগিয়ে ধরল, আঁকাবাঁকা প্যাঁচানো প্যঁচানো রেখাগুলো। “স্বাভাবিক একটা স্নায়বিক রেখাচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখ, এটা অনেক বেশি জটিল। শুরুর পক্ষে, এই সক্রিয়তার স্তর কোনো একটা মস্তিষ্কের সক্রিয়তার স্তরকেও ছাপিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এর ভিতরে অনেক তথ্য নিহিত রয়েছে, একসঙ্গে এর মধ্যে অনেকগুলো প্রক্রিয়া সমান্তরালে ঘটে চলেছে, কিন্তু ওই অবিশুদ্ধ ফিডব্যাক লুপগুলোর মধ্যে রহস্যটা লুকিয়ে রয়েছে।”

“ইঙ্গা।”

“এবারে দেখ, যদি আমি…” সে একটা বড়োসড়ো যন্ত্র নিল, সঙ্গে যুক্ত কম ভোল্টের ব্যাটারি আর তার, এবার শ্যাওলাগুলোর গায়ে শক দিল।

“এবার মাল্টিমিটারের রিডিং কত উঁচুতে উঠছে, খেয়াল করেছ? এটা আমার যন্ত্রের সংকেত ভিতরে যাচ্ছে, কিন্তু তারপরেই এই স্বাভাবিক সংকেতটা বিরতি নিয়ে থেমে যাচ্ছে… একটু অপেক্ষা করে দেখ। আমার যন্ত্রের রিডিংটা শূন্যতে নেমে আসছে… একটু অপেক্ষা কর… এই দেখ এবার— দেখতে পাচ্ছ? একটা খুব কম কম্পাঙ্কের সংকেত একদিকে চলে যাচ্ছে, ফের ঘুরে আবার অন্যদিকে যাচ্ছে। আর এটা ক্রমাগত হয়েই চলেছে যেন কোনো একটা বিশেষ তরঙ্গ খুঁজছে। আমি যদি আবার বিদ্যুৎ চালাই, টেস্ট সিগন্যালের কম্পাঙ্ক বদলে যাচ্ছে। এবার এটা ভালো করে দেখো, আমি যে কম্পাঙ্কের ইনপুট দিয়েছিলাম অবিকল সেটাই ফিরে আসছে।”

“তার মানে এটা উদ্দীপনায় সাড়া দিচ্ছে। সব জীবই তো এমন করে।”

“থান্ডেকা, আমার মনে হয় এই ডেটা থেকে বোঝা যাচ্ছে পরস্পর সংযুক্ত এই এককোষী জীবগুলোর ভিতরে একটা অনুভূতিহীন বুদ্ধিমত্তা তৈরি হচ্ছে। এমন তথ্যগুলো চাঁদ পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।”

“সূর্যের আঁচ কমে আসছে, চলো এবার ঘরে ফিরে মাহেয়ু৪ পান করে ঠান্ডা হওয়া যাক!” আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওকে তোলার জন্য হাত বাড়িয়ে বললাম।

গারান্দে আমার দিকে মর্মভেদী দৃষ্টিতে তাকাল, ওর এরকম তাকানো আগেও দেখেছি, দেখলে বুঝতে পারি ওর মাথার ভিতর কোনো একটা মতলব এসেছে। ও আমার হাত ধরে কোঁত করে একটা শব্দ করে গাত্রোত্থান করল। ওর ঢোলাঢালা জামাকাপড়ে ধুলোবালি লেগে আছে, ভুঁড়ির ওপর হাতটা আড়াল করে রেখেছে। ও একটা হাওয়াই চটি পরে আছে, ওর পাগুলো এতটা ফুলেছে যে পায়ে জুতো গলানো যাচ্ছে না। আমি ওর যন্ত্রপাতিগুলো গুছিয়ে তুলে নিলাম। ও ততক্ষণে আদিগন্ত বিস্তৃত হোন্ডে উপত্যকা ধরে বাড়ির পথে এগিয়ে চলেছে। সামনে বিছানো প্রস্তরভূমি পেরিয়ে দিগন্তের কাছে সুউচ্চ পর্বতমালা দৃশ্যমান।

***

গারান্দে আর আমিই প্রথম কোরিয়ালিসের ব্যাকটেরিয়া খেয়েছিলাম। যদিও পৃথিবী থেকে আনা বিভিন্ন জীবজন্তুর ওপরে এই পরীক্ষা চলেছিল, তবুও এগুলোর প্রভাব মানুষের শরীরে কেমন হতে পারে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা তৈরি করা যাচ্ছিল না। আমি আর গারান্দে মরে গেলে আমাদের মৃতদেহগুলো মহাকাশে ছুঁড়ে দেয়া হত।

কতরকমের প্রজাতির অনুজীব যে ব্যবহার করা হয়েছিল! কিন্তু তখন কারিনা রুরেগেরোতে ফিরে যাওয়ার আর উপায় ছিল না। মহাকাশের অসীম শূন্যতায় বাকিদের বাঁচার চেষ্টা করতে হত নয়তো মরতে হত, কারণ সংক্রমণের বড়ো ঝুঁকি তো ছিলই, তাছাড়া ফিরে যাওয়াও অসম্ভব ছিল, কারণ আমাদের ধারেকাছে কোনো ম্যাগনেটার নিউট্রন স্টার ছিল না, যেটা আমাদের মহাকাশযানকে বাড়ির পথে একটা বেগবান ঝাঁপ দিতে সাহায্য করবে। সক্রিয় ম্যাগনেটার খুবই বিরল আর ক্ষণজন্মা, এই মহাবিশ্বের বিশ হাজার কোটি নক্ষত্রের মধ্যে এদের সংখ্যা মাত্র শ’দুয়েক।

“এটা গ্রিক ইয়োগার্টের মতো খেতে।” আমার দিকে এক চামচ এগিয়ে দিয়ে গারান্দে বলল। ওর হাতটা মৃদু কাঁপছে, যেন শিউরে উঠছে। হাতের রোমগুলো ফের গজাতে শুরু করেছে।

“ইঃ বিচ্ছিরি খেতে!” আমি বললাম।

“আরে খা খা, এই নতুন গ্রহটায় যা যা আছে তা আমরা দুজনেই প্রথম খেয়েছি। তুই কি আবার এটা রান্নাঘরে ফেরত পাঠাতে চাস?”

আমি একবার চোখ তুলে ঘরের চতুর্দিকে লাগানো নজরদারি ক্যামেরাগুলোকে দেখলাম।

সেন্সরগুলো আমাদের দেহের পরিবর্তনগুলোও স্ক্যান করে রাখছে। “আমি এই ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশনগুলো আর সহ্য করতে পারছি না, কখন যে কঠিন খাদ্যবস্তু জুটবে।”

“আর আমি চাই আমাদের আসন্ন সন্তান প্রথম নেটিভ কোরিয়ালিয়ান হয়ে জন্মাক।” ওর গলার স্বরে এক নিষ্পাপ উত্তেজনা ছিল, যা আমাকেও সংক্রামিত করল। ও যেভাবে আমার দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকাল, তাতে ওর আত্মার মাধুর্যটি ফুটে উঠল, আমিও অপলক তাকিয়ে রইলাম।

“থান্ডেকা, আমরা দুজন হলাম পথিকৃৎ, ওরা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে আমাদের নাম লিখে রাখতে বাধ্য, প্রতিষ্ঠাতা পিতা… এবং মাতা।”

গ্রহদের খুঁজে পাওয়া সোজা। একসময় পৃথিবীতে বসবাসকারী আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভাবতেন, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র ওই গ্রহটাতেই বুঝি প্রাণের অস্তিত্ব  রয়েছে। কয়েক সহস্রাব্দ বাদে
তারা অন্য গ্রহদের কথা জানতে পারল, তা সত্ত্বেও সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে তাদের মনে সন্দেহ রয়ে গিয়েছিল। আমাদের ছায়াপথের বিশ কোটি নক্ষত্র আর এক লক্ষ কোটি গ্রহ, উপগ্রহের দিকে তাকিয়ে তারা ভাবত পৃথিবীতে বুঝি আচম্বিতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু তারা ভুল ছিল। এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথেই প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। আমরা এতই নগণ্য এবং প্রান্তিক যে সে খোঁজ করার ক্ষমতাই আমাদের নেই। অথচ আমাদের ছায়াপথের মধ্যেই বাসযোগ্য অন্য পৃথিবীর সন্ধান ছিল… অথবা একসময় আমরা এরকম ভাবতাম।

যখন প্রথম বসতি স্থাপনকারীরা দোতিতো গেল, তখন তারা দেখতে পেল পৃথিবীর মতোই একটা গ্রহ হলুদ নক্ষত্রকে বেষ্টন করে আবর্তন করছে। সেখানে প্রচুর জল ছিল, আর বায়ুমণ্ডলে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন ছিল। পৃথিবীর সঙ্গে এত মিল যে মনে হবে এটা পৃথিবীরই যমজ। উদ্ভিদ। প্রাণী। আর কার্বন যৌগের পরিচিত জীবজগত দেখে তারা ভেবে নিয়েছিল দোতিতো এক আশ্চর্য উপহার।

লক্ষ লক্ষ মানুষ দফায় দফায় সেখানে গিয়ে বসতি গড়ল। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই দোতিতো সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠল। কিন্তু তারপরেই ভয়াবহ মহামারী নেমে এল, সেই নতুন পৃথিবীতে মানুষ কাতারে কাতারে মরতে শুরু করল যখন ইউরোপীয়রা গিয়ে তাদের গ্রহে পৌঁছল। সেই মড়ক থেকে কেউ নিস্তার পেল না, কোনো প্রতিরক্ষা হল না। মহামারী চলতেই থাকল, যতক্ষণ না গ্রহের শেষ মানুষটিও মারা যায়।

এই সমস্যাটা জানা গিয়েছিল সেই ১৮৯৭ সাল থেকে যখন এইচ জি ওয়েলসের ‘ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ওয়েলসের মঙ্গলগ্রহীরা হয়তো পৃথিবীর মানব যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল কিন্তু তারা মারণ-ব্যাকটিরিয়াদের বিরুদ্ধে জিততে পারেনি কারণ তাদের শরীর ব্যাকটেরিয়া-বিরোধী প্রতিরক্ষা লাভ করতে পারেনি। তাই পৃথিবীর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ জয়লাভের আগেই তারাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। সৃজনশীলতার দিক থেকে এটা গল্পের সঠিক উপসংহার নয়, যেখানে অলৌকিক পরিত্রাতার দ্বারা পৃথিবীকে বাঁচিয়ে দেয়ার গাঁজাখুরি প্রস্তাব এনে একটা উপভোগ্য গল্পকে শেষ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওয়েলস ভিনগ্রহী জটিল আকৃতির জীবজন্তু, জনপ্রিয় ধারণার ভীষণদর্শন দৈত্যদানবের প্রস্তাবনা করে বুঝিয়েছিলেন পৃথিবীর মতো অন্য গ্রহে মানুষের উপনিবেশ গড়ে তোলা অসম্ভব নয়।

দোতিতো আবার আমাদের শিক্ষা দিয়েছিল যে তার মতো নির্দিষ্ট কয়েকটি গ্রহ প্রতিকূল অনুজীবের উপস্থিতির জন্য আমাদের জন্য অনুপযুক্ত। অন্যদিকে দোতিতোর ঘটনার কয়েকশো বছর পরে কারান্ডার ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের বুঝিয়েছিল, আমাদের নিজস্ব অনুজীব, যা আমাদের ত্বক, অন্ত্র আর শরীরের অন্যান্য স্থানে রয়েছে তা এক নিরীহ নতুন পৃথিবীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে গ্রহটার অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। একটা সজীব প্রাণশক্তিপূর্ণ গ্রহ মরে গিয়ে বিষাক্ত ধুলোর গোলকে পরিণত হয়েছিল।

গারান্দে একবার আমাকে বলেছিল প্রাচীন মানুষেরা, যারা এক ভাষায় কথা বলত, তারা যখন সম্পূর্ণ নতুন কোনো স্থানে গিয়ে বসতি গড়ত, তখন তারা সেখানকার সামান্য মাটি নিয়ে জলে গুলে গিলে নিত। তারা বিশ্বাস করত এর ফলে নতুন জায়গাটার সঙ্গে তাদের একটা দৈহিক-আত্মিক সংযোগ তৈরি হবে। একবিংশ শতকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে ক্ষণজন্মা প্রথম জিম্বাবোয়ে প্রজাতন্ত্র ভেঙে পড়ে, তখন শোওনা গোষ্ঠীর মানুষেরা ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর যখন আফ্রিকার বাইরে নির্বাসিত এই মানুষদের সন্তানেরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তাদের ঘরে ফিরে আসে, তখন উদরাময় ও অন্যান্য পেটের অসুখের জন্য সেই মাটি-গোলা-জল সেবনের উপযোগিতা টের পাওয়া গিয়েছিল।

“আমি মনে হয়, এখুনি, গত কয়েকমাসের মধ্যে প্রথম বায়ুত্যাগ করলাম,” দইয়ের পাত্রটা নামিয়ে রেখে গারান্দে বলল।

“তিনিয়ারেও, শা!৫” আমি বললাম। “বেশি তথ্যের কচকচি অপ্রয়োজনীয়।”

আমাদের জন্য একমাত্র সমাধান হল এই নতুন গ্রহটার সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে ওঠা। আমাদের পুরোনো পৃথিবীর জীবমণ্ডল থেকে নিজেদের বের করে এনে নতুন গ্রহের জীবজগতকে গ্রহণ করতে হবে। আশ্রয়দাতা নতুন পৃথিবীর সঙ্গে মিথোজীবীতার পরিণতিও চমকপ্রদ হতে পারে। ধলোধলো-৪ গ্রহের মানুষদের আয়ু বেড়ে পাঁচশো বছর হয় গিয়েছিল। আবার মাপুনগুবে গ্রহের বাসিন্দা হওয়া মানুষদের উচ্চতা আট ফুট ছুঁয়ে গিয়েছিল। আবার স্নায়বিক সক্রিয়তা ত্বরান্বিত হওয়ায় চিপাদচে গ্রহের চন্দ্রের মানুষেরা চলমান কম্পিউটার হয়ে উঠেছিল, কঠিন কঠিন অঙ্ক কষে দিত ঝট করে। আবার নয়া নাটালে গ্রহের বাসিন্দারা রঙিন জিনিস দেখার ক্ষমতা হারিয়েও নিজেদের অক্ষমতা পোষাতে এমনভাবে অভিযোজিত হয়েছিল যে নক্ষত্রের রশ্মি বিকিরণ সহ্য করার ক্ষমতা লাভ করেছিল। এই পূর্বপুরুষেরাই নির্ভীক মহাকাশযাত্রী হয়ে উঠেছিল।

আমি আমার স্বামীর পাশে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমাদের নতুন ঠিকানার স্বপ্ন দেখছিলাম। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, কোরিয়ালিস না জানি আমাদের জন্য কোন বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে।

***

আজ আকাশের চতুর্থাংশ নক্ষত্রের আলোয় ঝলমল করছে। একটা উত্তল রেখা জ্যা-এর মতো আকাশটাকে দু’ফালি করে দিয়ে গেছে, তার ভিতরে ঘন অন্ধকার। সেখানে কিছু নেই, শুধু অপরিসীম শূন্যতা। আমাদের চন্দ্র এখন দু-রাতের ঋতুতে প্রবিষ্ট হয়েছে, যখন আমরা সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত হয়ে বিশাল গ্যাসের গ্রহটার পিছনে চলে এসেছি। আমরা যে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে আবর্তন করি তা সূর্য থেকে গ্রহের দূরত্ব ও অবস্থান অনুযায়ী ছ’টা ঋতুর সৃষ্টি করে। দ্বি-রাত্রির চেয়ে দর্শনীয় কিছু নেই, যা দু-মাসব্যাপী আমাদের গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছু দেয় না, তখন দিনগুলো হয় দু-রাতের– একটা রাত নক্ষত্রের আলোয় ঝলমল করে, অন্য রাতটা গাঢ়তম অন্ধকারের রাত। আমাদের চাঁদটা তখন উপচ্ছায়া অংশে চলে গিয়ে সূর্যের সমস্ত আলো শুষে নেয়।

বাইরে তখন যে বৈদ্যুতিক আলোগুলো জ্বলে তারা একটা তীব্র সাদা আলোর আভা তৈরি করে।

গারান্দে পাশের ঘরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আমি ওকে পিছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আদর করলাম, ওর এই অবস্থায় এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। গারান্দে এখন শুধু কাত হয়ে শুতে পারে। আমি রাতে ঘুমোতে পারি না। গারান্দে ঘুমিয়ে পড়লে আমি চুপিচুপি শোওয়ার ঘরছেড়ে বসার ঘরে চলে যাই, কোনো গান বাজাই, একা একা বসে ভাবি। আমি মাবেরিকোয়াজভো মারিম্বা অর্কেস্ট্রা পছন্দ করি। ওদের গানে ভারি সুন্দর একটা সুর আছে, বাজলে যেন সময় থমকে দাঁড়ায়, মনকে মহাকাশে ভাসিয়ে নিয়ে চলে।

আমি এক গেলাস ঝরনার জল পান করি।

অ্যামোনিয়ার গন্ধ লেগে আছে বাতাসে। কম্পোস্ট সারে সবুজের পরিমাণ বেশি হলে গন্ধটা যেমন হয়, অনেকটা সেই রকমের। গন্ধটা অস্বস্তিকর, আমি এটার মধ্যে অন্য একটা সংকেত খুঁজে পেলাম। আমি সংকেতের অর্থোদ্ধারের চেষ্টা করে চলেছি, কিন্তু আমাদের শোওনা গোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই আছে যারা মাউরি দেবতায় শুধু বিশ্বাস করে। এমনকি আমার স্বামী যে যন্ত্রপাতি আর পরিমাপে ঘোর বিশ্বাসী, সে-ও। তাই বেশিরভাগ দিনই আমি অনুভব করি এই অতিসচেতন অবস্থা, আমার ভেতরের যে সত্তাটাকে দুনিয়ার পরিচিত নকশার ভিতর আঁটাতে পারি না, তাকে আমি লুকিয়েই রাখি। এই রাতের প্রহরে আমি একটু নিজের মতো একা থাকতে পারি। আমার হাত নেড়ে সামনের টিভির পর্দার সুইচ অন করে সেকুরু সিবান্ডাকে ডেকে নিতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেরিয়ে আসেন। সাদা চুল আর খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ির এক বৃদ্ধ মানুষ। মাথায় কালো পালক গোঁজা মুকুট। খালি গা, গলায় পুঁতির মালা ঝুলছে, তিনি ধোঁয়াচ্ছন্ন এক গুহার ভিতর বৃষচর্মের আসনে বসে আছেন। সামনে জ্বলন্ত কাঠের অগ্নিশিখা দুলে দুলে উঠছে, যার আভায় তাঁর মুখখানি একবার আলোকিত হচ্ছে, পরক্ষণে গুহার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আমাদের পরম্পরা অনুযায়ী আমি বামহাতের উপর ডানহাত দিয়ে তালি বাজিয়ে তাঁকে ডাকলাম এবং কথা বলার জন্য মুখ খুললাম কিন্তু তিনি ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিলেন।

“আর ইও, মাবিরে ওয়েকওয়ামাসু তার ভাই মাবিরে মুকোনোওয়েউইজার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে ঠিক করেছিল তার নিজের গোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে পশ্চিমে চলে যাবে,” তাঁর জলদগম্ভীর কন্ঠ গুহার দেয়ালে অনুরণন তুলল, “মাবিরে ওয়েকওয়ামাসুর উচিত হয়নি তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। সে আসলে ভাইয়ের গৌরব হজম করতে পারেনি, তাই শান্তি স্থাপন করতে চায়নি।”

সেকুরু সিবান্ডা মেঝে থেকে একটা লাউয়ের পাত্র তুলে নিলেন। তারপর কয়েক টিপ নস্যি নিয়ে নাক দিয়ে টেনে ‘হ্যাঁচ্চো’ বলে খানকয়েক হাঁচি ঝাড়লেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে তাঁর ভিতরের মোন্দোরো আত্মাকে সম্মান জানলাম।

“যখন সে রাতের বেলা গোষ্ঠীপ্রধানের এলাকা থেকে চুপিচুপি পালিয়ে গেল, তার অনুগামী লোকজন তাকে অনুসরণ করল, কারণ ওরা তাকে বিশ্বাস করত। ওরা বিদায়বেলায় একবারও জমির প্রভুদের বলে আসেনি, যাদের দেখা যায় অথবা যায় না, যাদের ফিসফিসানি হাওয়ায় ভেসে আসে। আসার আগে তারা মদ খেয়েছে শুধু নিজেদের কথা ভেবে। মাবিরে ওয়েকওয়ামাসু তার পূর্ব পুরুষদের শিক্ষা ভুলে গিয়েছিল। ‘নাতসাকওয়াউনোবা, কোয়াউনোয়েন্দা, হুসিকু’৬। কারণ তার মনে ভাইয়ের প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ জন্ম নিয়েছিল। তাই সে লোকজন নিয়ে পশ্চিমদিকে যাত্রা করেছিল, সেখানে গিয়ে মুসিকাভানুর মতো বিশাল সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল।”

সেকুরু সিবান্ডা তাঁর মাথাটা নাড়লেন, কিন্তু তখনই সম্প্রসারণে একটা ছোট্ট গড়বড় দেখা দিল, ফলে তাঁর প্রতিবিম্বের চলনে অসঙ্গতি দেখা দিল। কারণ এটা আসল সেকুরু সিবান্ডার নিউরো-ম্যাপড AI সংস্করণ। সেকুরু সিবান্ডা হলেন পবিত্র নজেলেলে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত যাঁর মধ্যে দিয়ে স্বয়ং দেবতা মাউরি কথা বলেন অর্ধ-ছায়াপথের দূরত্ব থেকে। আসল মানুষটা অত্যন্ত ব্যস্ত তাই যারা তাঁর মধ্যস্থতার মাধ্যমে কথা বলতে চায়, তাদের জন্য প্রতি সপ্তাহে তাঁর AI সংস্করণটি সাম্প্রতিক হালচাল শোনায়, অবিকল আসল সেকুরু সিবান্ডা যেভাবে শোনান সেভাবেই। তিনি সমস্ত নক্ষত্রমন্ডল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা উবুন্তু সম্প্রদায়ের বিশ্বাসী মানুষদের ব্যক্তিগত ন’অঙ্গা হিসেবে কার্যকর।

আমি ওঁকে কিছু প্রশ্ন করতে চাইছিলাম, কিন্তু উনি মাঝেমধ্যেই হেঁয়ালি, পদ্য, বাণী, সুভাষিত বলেন, যেমন আজকেই নীতিগর্ভ রূপক কাহিনি আর অতীতের গল্প শোনাচ্ছিলেন। কখনও কখনও উনি সরাসরি শ্রোতাদের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন, কখনও আবার দেন না। গওকে-তে ওরা এখনও মাবিরে ওয়েকওয়ামাসু এবং তার স্বজনদের জন্য কেঁদে যায়, কারণ ওরা পশ্চিমে গিয়ে কালাহারিতে লাল বালির এক সমুদ্র ছাড়া কিছু পায়নি। এক ফোঁটা জলও খাওয়ার উপযুক্ত নয়। ফলে এখনও ওরা দেবতাকে জল উৎসর্গ করতে পারেনি, বোকার মতো ওরা পশ্চিমে সূর্যাস্তের দিকে হেঁটেছিল।

প্রথমে প্রচণ্ড গরমে ওদের শিশুরা হাঁসফাঁস করে মারা গেল। তারপর, একে একে মেয়ে মরদ সবাই মারা গেল, ওদের ফেলে যাওয়া পথে কঙ্কালের হাড়গোড় পড়ে রইল।

ওই নরকটুকুই ওদের হয়ে থাকল, কারণ সে মাটিতে ওদেরই হাড় থেকে গিয়েছিল। মাবিরে ওয়েকওয়ামাসু তার ভাইয়ের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে পারেনি, তাদের মাটিতেও শান্তি স্থাপন করতে পারেনি, তাই ওর গোষ্ঠীর মানুষেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

দুঃখের কথা হল, যাদের পূর্বপুরুষ হিসেবে গৌরবান্বিত হওয়ার কথা ছিল, তারা তপ্ত হাওয়ায় প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের বংশরক্ষার জন্য একজনও বেঁচে রইল না এবং…”

সেকুরু সিবান্ডা ফের কিছু বলার জন্য মুখ খুললেন, কিন্তু তাঁর মাথাটা বুকের দিকে ঝুলে পড়ল এবং মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। আমি হাততালি দিয়ে তাঁকে ডাকলাম, কিন্তু তাঁর ঘুম ভাঙল না। তিনি ভোঁসভোঁস করে নাক ডেকেই চললেন। আমার অনেক প্রশ্ন ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু সেকুরুকে আর জাগানো সম্ভব নয়। ভাবছিলাম, আমার AI ভার্সান ন’অঙ্গাও ঘুমিয়ে পড়েন, কিন্তু আমি ঘুমোতে পারি না।

***

“তুমি শুনেছ, গতরাতে ফাঁড়িটার কাছে বান্দার ঘরের চাল উড়ে গেছে?” আমার পাশে ফুটপাতে বসে ন্যায়রাই বলে, “বাপরে বাপ, কী ঝড় ছেড়েছিল!”

“কী খারাপ খবর! আমাদের এই দিকে অমন খারাপ ঝড়-বাদলের কথা আগে বাপু শুনিনি। টোন্ডে আর ডেলিওয়ে কোথায়? ওদের তো আমাদের সঙ্গে কাজে আসার কথা ছিল।”

“ডেলিওয়েকে তো সেকাইয়ের সঙ্গে ফাঁড়িতে পাঠানো হয়েছে। আর টোন্ডে… ও আবার কবে সময় মতো কাজে এসেছে?”

আমরা কাজ শুরু করার আগেই একজন লোক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অশুভ সংকেত সর্বত্র। আলোও আজ খুব কম কারণ আমরা এখন আংশিক সূর্যগ্রহণের অঞ্চলে আছি। এই গ্রহটা সূর্যকে গ্রাস করেছে। এদিকে খুব ঠান্ডা হাওয়া ছেড়েছে। ঝোড়ো বাতাস বাড়ির চাল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার বুকের ভিতর একটা বিশ্রী আড়ষ্ট ভাব যা কিছুতেই আমি উপেক্ষা করতে পারছি না। এদিকে আমরা যতই আলফা-কমসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, আমার যন্ত্রপাতি আঁটা বেল্টটা আমার উরুর উপর শক্ত হয়ে কেটে বসছে।

পলিফিনের সুবিশাল গঠনটা পঁচাত্তর ডিগ্রি কোণে হেলে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে গঠনগত সীমানা ঘেঁষে রয়েছে, কারণ পলিফিন বেশ শক্ত আর নমনীয়। আরেকটু বেশি হলেই কেলেঙ্কারি হত— সেজন্য আমি ওর তারগুলো মাটিতে গুঁজে নোঙরের মতো ধরে রেখেছি। আপাতত সাহায্যের জন্য আমার সঙ্গে একজোড়া বাড়তি হাত রয়েছে। ন্যায়ারাই সাধারণত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কাজ করে এবং সে দক্ষ কাজের মেয়ে হিসেবে নিজের কাজের বাইরে বাড়তি দায়িত্ব পালন করে। ওর বোন সেকাই এখানকার প্রধান কারিগর, কিন্তু এখানকার প্রায় সবাই নিজের কাজের বাইরে বাড়তি দায়িত্ব পালনে সক্ষম।

আমি নিজের অ্যাপারাটে স্ক্রল করে টোন্ডের নম্বরে বার্তা পাঠাই—- ‘এখুনি এখানে হাজির হওয়া চাই!’ ওর বয়স মাত্র আঠেরো বছর, আর এই বয়সে ঘুম ভেঙে বিছানা ছেড়ে ওঠাটা খুবই যন্ত্রণার।

আলফা-কমসের স্তম্ভটা কম করে বিশ মিটার উচ্চতার। উপরের অংশটা আমাদের রেডিও সিগন্যালের বুস্টার হিসেবে কাজ করে। যন্ত্রগুলো সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে যদি একে অপরের সীমানার মধ্যে থাকে, তা সত্ত্বেও আমাদের রিলে করার দরকার হয়। টাওয়ারের রেডিও সংকেতের যন্ত্রপাতির তলায় একটা ব্ল্যাক-বক্সে বিপরীতমুখী কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন সিস্টেম মডিউল রাখা থাকে। Q বা কোয়ান্টাম মডিউলটা ঢাকা থাকে তারজালির ভিতরে, খুব কম লোকই ওটা খোলার কোডটা জানে। সেটাই এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কারণ এটার মাধ্যমেই ছায়াপথের বাকি অংশের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে অতি-লৌকিক সংযোগ গড়ে তোলা যায়। এখান থেকে পাঠানো সংকেত আলোকবর্ষ দূরত্বের সংকেত-গ্রহীতার কাছে পাঠাতে যে সময় লাগে তা একটা ছোটো ঘরের একটি কোণ থেকে অন্য কোণে পাঠানো শব্দতরঙ্গের সময়ের চেয়েও কম। যেটুকু সামান্য বিলম্ব হয় তা যন্ত্রপাতি দিয়ে দুটি প্রান্তের বৈদ্যুতিন তথ্যকে ডিকোড করে ব্যবহারযোগ্য তথ্যে পরিণত করার জন্য হয়। এই প্রযুক্তির সারসংক্ষেপটিতে সেভাবেই ব্যাখ্যা করেছে। আরে, আমি তো আর এই যন্ত্রটা বানাইনি— আমি স্রেফ একজন আজ্ঞাবাহী যে যন্ত্রটা চালায়।

“আরে এ তো পুরো আগাপাশতলা কাজ!” ন্যায়ারাই মাথা তুলে দেখে নিয়ে বলল, “এখানে আলোও যথেষ্ট নেই।”

“ওই ট্রেলারে সব জিনিস নিয়মানুযায়ী আছে। সবকিছু পুনঃস্থাপন করতে আমাদের অসুবিধা হবে না।”

“চারজন লোকের দুদিনের কাজ, আমাদের তিনদিন তো লেগে যাবেই।”

“কেরামতিটা হল প্রযুক্তিটার ক্ষতি না করে কাজটা সারা। এই টাওয়ারটাকে ভেঙে ফেলার কাজ তো জলভাত,” আমি নিজের সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে বললাম। “টুকরোগুলো নীচে নামানোর জন্য আমাদের কপিকলের মতো কিছু একটা লাগবে।”

“তোমার যেমন ইচ্ছে করো। আমি তো শুধু তোমায় সাহায্য করতে এসেছি।”

আমি যত লোকের সঙ্গে কাজ করেছি তার মধ্যে ন্যায়ারাই সবচাইতে সহজ সাদাসিধে। একটু ধীরস্থির স্বভাবের, কিন্তু পরিশ্রমী। কোনো কাজের মধ্যে ওর অহংবোধ নেই। ও গুনগুন করে একটা লোকগীতি গাইছিল। এই প্রেমের গানটা ক্যাসিওপিয়া অঞ্চলের সমুদ্র-গ্রহ গুংওয়া-রামাসারের মানুষেরা গায়। ন্যায়ারাইয়ের গানের গলাটা সুন্দর, গাইতে গাইতে ফুরফুরে মেজাজে কাজ করে। ফলে কাজের সময়টা খুব ভালো কাটে।

“তোমাদের বাচ্চাটার প্রসবকাল কবে? আমি রোজ দেখি গারান্দে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে হেলেদুলে যায়।” আমি বেয়ে বেয়ে টাওয়ারটার মাথায় ওঠার সময় নিচ থেকে ন্যায়ারাই চেঁচিয়ে বলল।

“আরও দু-মাস বাকি আছে।” আমি খানিক দমছুট গলায় উত্তর দিই। এই উচ্চতাটা বেয়ে ওঠা বেশ কঠিন, তার উপরে আমার কোমর থেকে ভারী যন্ত্রপাতিগুলো নীচের দিকে ঝুলছে, আর হাতদুটো যেন ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে।

“তুমি বাচ্চাটার জন্য তৈরি তো?”

“কেউ কখনও তৈরি থাকে?” আমি বলতেই ও হাসল। “বাচ্চাটা ও চেয়েছে, তাই প্রয়োজনের সময় ন্যাপি পাল্টানোর কাজটা ও-ই করবে।”

“আমি তো আমার প্রথম বাচ্চাটাকে কারিনা-রুরেগেরেরোতে রেখে এসেছি। আমাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না, বুঝতে পারছো তো? আমাকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। এখন আমরা রোজ কথা বলি, মানে আবার বলব… যখন তোমার এই Q আবার কাজ করতে শুরু করবে। কারিনা-রুরেগেরেরোতে ওরা নিশ্চয়ই ভাবছে এদিকে কী হল!”

“আর একটা সপ্তাহ লাগবে, তারপরে আবার যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের জায়গায় ফিরে আসবে।” আমি বললাম। কিন্তু ওর স্বামীকে ছেড়ে আসার পর ওর কোনো অনুশোচনা হচ্ছে কিনা সেকথা আর জিগ্যেস করলাম না। কিছু প্রশ্ন করতে নেই, এভাবেই অনুক্ত থাক। ন্যায়ারাই খুব ভালো করেই জানে একবার এখানে চলে এলে ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কোরিয়ালিস একটা ম্যাগনেটারের থেকে বহু বহু দূরে। তাই এই জীবদ্দশায় কোনো বড়ো রকমের প্রযুক্তিগত পরিবর্তন না হলে আপাতত ভিডিও কলই যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে ভালো। আমরা দুটি বড়ো প্রকোষ্ঠযুক্ত মহাকাশযানে এসেছিলাম, মূল মহাকাশযান আর একটা নির্বীজকৃত প্রবেশ-প্রকোষ্ঠে। আমাদের পরিশোধিত করে শরীরে নতুন বাস্তুতন্ত্র সংযুক্ত করার পর সেই নির্বীজ করা প্রবেশ-প্রকোষ্ঠে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যেটা চন্দ্রের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের জন্য বিশেষভাবে তৈরি। মূল মহাকাশযানের বাকি কলুষিত অংশ তার ভিতরের বায়ু আর জল মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলে তার ভিতরের অংশকে সুরক্ষিত করে ফের একটা স্বয়ংক্রিয় যান হিসেবে আরও দূরের নক্ষত্রমণ্ডলের মানচিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। আমরা যদি আবার একটা প্রবেশ-প্রকোষ্ঠযুক্ত মহাকাশযান পুনর্নির্মাণ করতেও পারতাম, তাহলেও যে ইঞ্জিনগুলো এখন আমাদের জন্য শক্তি উৎপাদন করে সেগুলো আমাদের গ্রহে ফেরার জন্য সেই মহাকাশযানকে যথেষ্ট শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফের মহাকাশে ফেরত পাঠাতে পারত না।

আমি টাওয়ারের উপর উঠে শরীরের বেল্টের সঙ্গে লাগানো আঁকশিটা আটকে নিলাম। এবার আমি কপিকলের মতো বস্তুটায় টুকরোগুলোকে চাপিয়ে নীচে নামাব। ন্যায়ারাই আমার ঠিক তলায় দাঁড়িয়ে নিচ থেকে ঘাড় হেলিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সকালের বাতাসে তামার মতো একটা ঝাঁজ লেগে আছে। খানিকটা রক্তের গন্ধের মতো। আমি এক হাতে পলিফিনের টাওয়ারটা ধরে অন্য হাতে আমার যন্ত্রপাতির বেল্টের ভিতর অ্যাডজাস্টেবল রেঞ্চটা খুঁজতে লাগলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল প্রথমে ট্রান্সমিটারটা খুলে নিয়ে তারপরে ভারবাহী স্তম্ভটার কাজ শুরু করব। টোন্ডে হারামজাদাটা এখনও এসে পৌঁছয়নি। এলে আজ কড়া করে দু-কথা শুনিয়ে দেব। আমি রেঞ্চটা বাগিয়ে প্রথম নাটবল্টুটা আঁকড়ে ধরলাম। একটু চাপ দিয়ে ঘোরালেই খুলে আসবে, কিন্তু ওটা সহজে খুলছে না। এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় সম্ভবত পলিফিনের সংকোচন হয়েছে। আমি শরীরের ভারটা দিয়ে ওটাকে চেপে ঘোরানোর চেষ্টা করলাম। নাটবল্টুটা ঠান্ডায় জমে শক্ত হয়ে বসে গেছে, আমি জোরে টান দেয়ার চেষ্টা করতেই রেঞ্চটা আমার হাত থেকে ফসকে গেল।

“ন্যায়ারা—!” আমার চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই নীচে থেকে একটা আর্তনাদ তুলে ন্যায়ারাই মাটিতে ছিটকে পড়ল।

“সব্বোনাশ! এটা কী করলাম! ওহ, না না না। প্লিজ। তুমি ঠিক আছো, ন্যায়ারাই?” আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই। “আমি… আমি খুব দুঃখিত। আমি খুব দুঃখিত, প্লিজ।”

এই স্বল্প আলোয় উপর থেকে রেঞ্চটা যে পড়ছে সেটা ও দেখতে পাবে না। আমি আবার ওর নাম ধরে চিৎকার করলাম। দেখতে পাচ্ছি ন্যায়ারাই মাটিতে পড়ে আছে। ওর পড়ে থাকার ধরনটা বড়ো অদ্ভুত। আমি বোধহয় ওকে মেরেই ফেললাম! হায় ভগবান! আবছা আলোয় কাকে যেন আমাদের দিকেই ছুটে আসতে দেখছি। অবশেষে টোন্ডে আসছে। আমি ওকে চেঁচিয়ে বললাম ন্যায়ারাইকে দেখার জন্য শিগগিরই যেন ড. নগুলুবেকে ডেকে আনে। টাওয়ার বেয়ে নীচে নামতে আমার আরও কয়েক মিনিট লেগে যাবে। ভয়ে আমার হাতদুটো ঠকঠক করে কাঁপছে।

আমি আঁকশিটা খুলে নিয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম। ভয়ে দুশ্চিন্তায় আমার পেটের ভিতরে পাক দিচ্ছে।

***

আমাদের মহাকাশযানটা আমাদের নতুন ঠিকানার দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন সবাই হালক্যামের ফিড-এ আঠার মতো চোখ সেঁটে দেখছিল। আমাদের দশ-বছরের দীর্ঘ যাত্রাপথের অবসান ঘটছিল। আমাদের যানে শক্তিশালী ইঞ্জিন থাকা সত্ত্বেও আমরা এত দ্রুতগতিতে চলছিলাম যে থামার জন্য আমাদের উনিশবার বিভিন্ন গ্রহের পাশ দিয়ে যেতে হচ্ছিল যাতে তাদের অভিকর্ষজ বল আমাদের গতি কমিয়ে দিতে পারে। তাদের মধ্যে পাঁচটা গ্রহ বৃহস্পতির মতো বড়ো ও অধিক ভরসম্পন্ন। তাদের সম্মিলিত অভিকর্ষজ বল এবং সূর্যের অভিকর্ষ মিলে আমাদের যানের গতি কমিয়ে ভেসে চলার সাধারণ গতিতে নিয়ে এসেছিল।

আমি গারান্দের সঙ্গে পর্দার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, দৃষ্টি ছিল মহাকাশের অনন্ত বিস্তারের দিকে। আমাদের গ্যাস-দৈত্য গ্রহটা তার সৌরমণ্ডলের মাঝামাঝি এমনভাবে বসেছিল যেন দেখে মনে হচ্ছিল এক মুরগি-মাতা তার ডিমগুলোকে আড়াল করে বসে আছে।

গারান্দের হাতটা তখন আমার কাঁধটাকে আলতো করে চেপে ধরেছিল।

“এরকম কোনোকিছু আগে কখনও দেখেছ, থান্ডেকা?” ও প্রশ্ন করেছিল। আমি নেতিবাচক মাথা নেড়ে নিজের মাথাটা আলতো করে ওর কাঁধে রেখেছিলাম।

“এগুলো প্রমাণ করছে যে একটা প্রাণস্পন্দনে ভরপুর ছোটো চন্দ্র রয়েছে।” গারান্দে বলেছিল, ওর চোখ পর্দার ফিডের দিকে। “আমি ফিডগুলো খুব ভালো করে দেখেছি— এরকম কোনো জায়গা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। সাতশো বছর ধরে ভানহু জানে কোরিয়ালিসের কথা, আর আমরা প্রথম এখানে অবতরণ করব, এখানে বসতি গড়ে তুলব।”

আমি টের.. পাচ্ছিলাম ..এক অদ্ভুত শ্রদ্ধাবোধ আর অ্যাড্রিনালিন-তাড়িত উত্তেজনায় গারান্দে কাঁপছে। আমাদের মহাকাশযানটা গন্তব্যের দিকে বাঁক নিয়েছিল, ইঞ্জিনের সিলিন্ডারগুলো তখন যানের গতির বিপরীতে সক্রিয়। গারান্দে তখন উত্তেজিত হয়ে বোঝাচ্ছিল এই নতুন গ্রহটা প্রতিকূল অবস্থা থেকে অনুকূল অবস্থায় পরিবর্তিত হচ্ছে। অনেকটা প্রাচীন পৃথিবীর মতো। এই নতুন গ্রহের সব জীব—প্রোক্যারিওট, ইউক্যারিওট, আর্কিয়া, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস, আদ্যপ্রাণী— যা আমাদের বিজ্ঞানের কাছে নতুন, সেইসব নতুন জীবদের ছুঁয়ে, পরীক্ষা করে দেখার জন্য গারান্দের আর তর সইছিল না। ও চেয়েছিল প্রথম আবিষ্কারক হিসেবে নাম করতে।

এই জায়গাটা ছিল অসীম সম্ভাবনার স্থল। যারা আমাদের মহাকাশযানে উঠেছিল, তাদের অনেকেই ফের জীবনটা নতুন করে শুরু করতে চাইছিল— তাদের অনেকেই পুরোনো সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসছিল, নিজেদের কুকর্মগুলো পিছনে-ফেলে-আসা জীবনে রেখে। আবার অনেকে অমূল্য সব খনিজ আর রত্নরাজি খুঁজে বড়োলোক হওয়ার আশায় এখানে এসেছিল। কিছু মানুষ আবার স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় এসেছিল। গারান্দে এসেছিল এক তীব্র অনুসন্ধিৎসা নিয়ে, তার নিজের গবেষণার ক্ষেত্রে যশোলাভের আশায়।

এই আগ্রহগুলো আমার আর নেই। কেন আমি এসেছিলাম এখানে? মহাকাশযানে চড়ে ছায়াপথের অর্ধেক রাস্তা চষে হাজির হয়েছিলাম এই জীবানু-অধ্যুষিত গ্রহটায়? কেন? কীসের জন্য?

আমি তো চাংগামিরে ডোম্বো-তে দিব্যি সুখেই ছিলাম।

কোনোরকমের ভাগ্যান্বেষণে আসার ইচ্ছে আমার মোটেও ছিল না—- দিনে একবেলা পেটভরে খেতে পাচ্ছিলাম, সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি এই এতটা পথ এসেছিলাম শুধু গারান্দের সঙ্গে একসঙ্গে থাকব বলে, আমাদের নিজেদের পরিবার শুরু করব বলে।

গারান্দে আমার কপালে একটা চুমু খেয়েছিল; তখন নক্ষত্র, উপগ্রহ আর অসীম অনন্ত মহাকাশ আমাদের যানের বাইরে ছুটে যাচ্ছিল।

***

যন্ত্রগুলো থেকে বিপবিপ শব্দ উঠছে, পর্দায় রিডিংগুলো দপদপ করে ভেসে যাচ্ছে, যখন আমি হাসপাতালে প্রবেশ করলাম। মাথার উপর থেকে উজ্জ্বল আলোগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ঝকঝকে সাদা দেয়ালে। আমি জুতোর মসমস শব্দ তুলে জীবানুমুক্ত মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে গেলাম। ঘরের এককোণে একটা আরামকেদারায় সেকাইকে বসে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম।

বললাম, “আমি খুব দুঃখিত।”

“বোকার মতো কথা বোলো না থান্ডেকা। এরকম ঘটনা যে কারও সঙ্গেই হতে পারতো, এটা স্রেফ দুর্ঘটনা।” সেকাই বলে, ইশারায় তার পাশের চেয়ারটায় আমাকে বসতে বলে।

সেকাইয়ের চেহারা বেশ পেশীবহুল, যেন পাথর আর অন্যান্য নির্মাণের বস্তু কুঁদে তৈরি হয়েছে। তার ঠোঁটের কোণাদুটো নীচের দিকে এমনভাবে বেঁকে থাকে যে দেখে মনে হবে যেন সে বিরক্ত হয়ে ভ্রূকুটি করছে, সে বিরক্ত না থাকলেও মনে হয়।

“আবার সংযোগ ব্যবস্থা ঠিক হতে কতদিন লাগবে? বাবাকে এই বিষয়টা জানাতে হবে, চিন্তা করছেন। ওর ভাগ্য যে রেঞ্চের সামনেটা শুধু ওর কপাল ছুঁয়ে গেছে। মাথাটা কাঁধের উপর ধাক্কা লাগায় কয়েকটা হাড় ভেঙেছে। ড. নগুলুবে বলছে, কয়েক হপ্তার মধ্যেই ও ঠিক হয়ে যাবে।”

সেকাই এই গ্রহে এসেছিল তার বোনের সঙ্গে থাকার জন্য। ন্যায়ারাইয়ের দেখভালো করার জন্য।

আমি কাজটাকে সত্যিই আরও কঠিন করে তুলেছি।

সেকাইয়ের প্রশ্নের জবাবে বললাম, “আরও দিনদুয়েক লাগবে।”

“টাওয়ার সরানোর কাজটায় আমি তোমাকে সাহায্য করব, ঠিক আছে?” সেকাই বলে, “শুধু খেয়াল রেখো, পরেরবার হাতের যন্ত্রপাতিগুলো যাতে একটু শক্ত করে ধরা থাকে।”

ও জোরে হেসে উঠল, আর আমি কোনোমতে মুখে একটা হাসি ফোটালাম। ন্যায়ারাই বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। পেইনকিলার খেয়ে ওর অবস্থা বেশ কাহিল। আমি মনে মনে সংকল্প করলাম সংযোগ ব্যবস্থাটা দ্রুত সারিয়ে ফেলব, যাতে ন্যায়ারাই তার বাচ্চাটার সঙ্গে কথা বলতে পারে।

***

দিন.. যত গড়িয়ে গেল, আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।

সংযোগ ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেলে আমি সেকুরু সিবান্ডাকে জিগ্যেস করব, আমার কী করা উচিত। উনি বড়ো মৌন থাকেন। শেষবারে তাঁকে দেখে মনে হয়েছে বেশি বুড়িয়ে গেছেন, ওঁর মুখে চোখে প্রচুর ভাঁজ বেড়েছে, মাথার চুলও সাদা পশমের মতো হয়ে গেছে।

“এক বা দুই প্রজন্মের পর ওরা তোমাকে ভুলে যাবে, অবশ্য সেটাই হওয়া উচিত।” কথাগুলো বলে সেকুরু মাথা নোয়ান।

“দয়া করে আমার স্বামীকে জানান আমি কোথায় গিয়েছি আর কী করেছি।” আমি মিনতির সুরে হাতজোড় করে বলি।

তিনি ঘোঁত করে একটা শব্দ করে নাকে এক টিপ নস্যি নেন।

আমি উঠে পড়ি, দ্রুত শোওয়ার ঘরে ফিরে যাই, যেখানে গারান্দে ইতিমধ্যেই ঘুমে কাতর। আমি তার সামনে নতজানু হয়ে বসে তার মুখখানি পর্যবেক্ষণ করি। ওর বুকটা শ্বাসপ্রশ্বাসের তালে তালে উঠছে আর নামছে। ওর নিঃশ্বাসের বাতাস বুক ভরে টেনে নিই, তারপর ওকে চুম্বন করি, ওর পেটে চুমু খাই। ও একটু নড়ে ওঠে, আমার ভয় হয় ওর ঘুম না ভেঙে যায়। ওর ঘুম ভাঙে না। এক প্রশান্তভাব বিরাজ করছে ওর মুখে। আমি উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। কিন্তু চৌকাঠে পৌঁছে ওকে পিছন ফিরে দেখার ইচ্ছে আমাকে বিহ্বল করে তোলে।

আমার পা-জোড়া স্থানু হয়ে যায়, কিন্তু আমি তাদের সামনের দিকে ঠেলি। জ্যাকেটটা গায়ে গলিয়ে নিই, কারণ বাইরে খুব ঠান্ডা, আমার যন্ত্রপাতির বেল্টটাও নিই অভ্যাসবশত। ঘরের বাইরে পা রাখার আগে আমি ছোটো কাষ্ঠল লাউয়ের পাত্রটা তুলে নিই, যার মধ্যে পাঙ্গানাইয়ের এক পানীয়ের দোকান থেকে কেনা বিয়ারের কিছুটা রয়েছে।

আমি হাঁটতে হাঁটতে ঘর আর নতুন কারখানাটা পেরিয়ে যাই। আমার পায়ের তলার মাটি নরম আর ভেজা। মরশুমি নদী আর ঝরনার জলের ধারা নির্গত হচ্ছে, চন্দ্রের জোয়ার সঞ্জাত তরঙ্গের চাপে ভূগর্ভস্থ সমুদ্র থেকে ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত বিস্তৃত অসংখ্য প্রণালী বেয়ে লবণজল উঠে আসছে।

অসংখ্য গোলাপি আর লাল কণার দমকে বাতাস ঝিলমিল করছে, যেন বহু যুগ আগে শুরু হওয়া অগ্নিকাণ্ড এখন স্তিমিত হয়ে আসছে। দ্বি-রাত্রির ঋতু শুরু হয়েছে।

আমি হোন্ডে উপত্যকায় পৌঁছাই, যেখানে বিস্তৃত ভূমিখণ্ড ভেসে যাচ্ছে অপূর্ব বায়োলুমিনিসেন্টের আলোয়। প্রাণবন্ত সবুজ, মোলায়েম নীল, বেগুনি, পীতাভ স্ফটিকের মতো রেখা আর বিমূর্ত ধাঁচের ছবি ভাসছে প্রান্তর জুড়ে। আকাশে নক্ষত্র নেই একটিও। একমাত্র অস্পষ্ট আলো যা আসছে তা বহুদূরের গ্রামের বিদ্যুতের আলো অথবা প্রান্তর জুড়ে ছোটো ছোটো জীবের বায়োলুমিনেন্সের আলো। এ দৃশ্য বুঝিয়ে দেয় সাধারণ দিনগুলি শেষ, আসতে চলেছে দ্বি-রাত্রির ঋতু, চন্দ্রও ধীরে ধীরে গ্যাস-দৈত্যের পিছনে মুখ লুকোচ্ছে। আমরা আগামী দুমাস ধরে সূর্যের দেখা পাবো না, যে জীবকুল সাধারণ ঋতুতে গুরুভোজন করেছে এতদিন এখন তারা সেই খাদ্য শরীরে দগ্ধ করে উদ্ভূত শক্তি দিয়ে কাজ চালাবে।

মাথার উপরে নিকষ কালো আকাশ।

আমার হাতের টর্চলাইট প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আভাযুক্ত লোহিত ও ধূসর শ্যাওলার মধ্যে দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আমি সেই পথ ধরেই চলি যা একদিন গারান্দে আমাকে দেখিয়েছিল, বুড়বুড়ি কাটা উষ্ণ প্রস্রবণ পেরিয়ে, হলুদ গন্ধকের বালুকাময় সমভূমি ছাড়িয়ে, নুনের টিলাগুলো ছাড়িয়ে। অবশেষে মুতুঙ্গাগুরে পর্বতের গুহাগুলোর কাছে গিয়ে হাজির হই।

শ্যাওলাদের বর্তনীঘেরা পথ ধরে এক গুহায় গিয়ে প্রবেশ করি। গুহার উপরের ছাদ থেকে স্ট্যালাকটাইট চুঁইয়ে নেমেছে নীচের দিকে। গুহার দেয়ালগাত্রে বাতাস এসে গুমরে মরছে। আমি গুহার অভ্যন্তরে একটা দীপ্যমান জলাশয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। রঙিন জলের ঘূর্ণি দেখে মনে হয় যেন লাভাস্রোত বয়ে চলেছে ঘুরে ঘুরে। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য।

“নেভারিদজি ভেনিইকা, আমি এসেছি শান্তি স্থাপন করতে।” আমি বিড়বিড়িয়ে বলি। গুহার মেঝেয় নৈবেদ্যর মতো ঢেলে দিই সঙ্গে আনা বিয়ার।

গারান্দে আমাকে বলেছিল, এই মথিত হওয়া জলাশয় প্রাণের স্পন্দনে পরিপূর্ণ। ওরা এখানে গ্রহের সমস্ত জায়গা থেকে আনা জিনগত উপাদান, যা সৃষ্টির বীজ, তার মিশ্রণ ঘটায়। এ মৃত্তিকা প্রাপ্ত বস্তু গ্রহণ করতে পারে আবার নাও পারে, সেটা ঋতুর উপর নির্ভর করে। অনেক গভীরে সেগুলি পৌঁছে যায়, তবে কতটা গভীরে যায় তা জানা নেই, সম্ভবত ভূগর্ভস্থ সমুদ্রে পৌঁছে যায় কিছু কিছু।

আমি আমার পোশাক খুলে ফেলি, দূরে স্তূপাকার করে রাখি, সঙ্গে আনা যন্ত্রপাতিও ছুঁড়ে ফেলি। তারপর ধীরে ধীরে সেই জলাশয়ে নেমে যাই। আমরা শুধু নিই, নিই আর নিয়েই যাই, কিছুই ফিরিয়ে দিই না। কিন্তু আমাদের এই জীবনচক্র তো দেয়া-নেওয়ার। গ্রহণ-প্রদানের। আমাদের পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে। ধরিত্রী মাতা হয়তো আমাদের সহ্য করেছেন, কারণ আমরা ছিলাম তাঁর বেজন্মা সন্তান, কিন্তু কোরিয়ালিস আমাদের চেনে না, আমাদের চেনার কোনো পবিত্র দায় নেই তার।

“আমার নৈবেদ্য গ্রহণ করো। এসো, একটা সওদা করা যাক।”

আমার হৃদপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে উঠেছে। জলাশয়ের জল গুড়গুড় করে ফুটতে শুরু করেছে। আমাকে যেন কে জলের গর্ভে টেনে নিচ্ছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, আমার শরীরে গলন্ত ধাতুর স্পর্শ, আমার মুখে, ফুসফুসে ফুটন্ত লাভার দংশন। আমার শরীর থেকে যেন সবকিছু বেরিয়ে যাচ্ছে, পা-দুটো জেলির মতো গলে যাচ্ছে, আমার অনুভূতিগুলো অবশ হয়ে আসছে, যেন একটা নেশার মতো অনুভূতি, আমার ভিতরটা গলে মণ্ড পাকিয়ে যাচ্ছে, যন্ত্রণা, অজস্র সূচীমুখ যেন বিদ্ধ করে চলেছে। কোরিয়ালিস আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে নিচ্ছে, যেন এক অবুঝ শিশু তার খেলনার ভিতরের যন্ত্রপাতি ভেঙে টিকটক ঘড়িটা বের করে নিতে চায়। অফুরন্ত সংযোগ, চমকপ্রদ জটিলতার জৈব আর অজৈব কার্বোনেট যৌগ দিয়ে তৈরি হয় অসংবেদী বুদ্ধিমত্তার ধাত্র যা পরস্পর নির্ভরশীল এককোষী জীবদের বেঁধে বেঁধে রাখে। আমি শান্তির কথা ভেবে অনুমতি দিলাম, যাতে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে কোনো ভূখণ্ডের আদিপুরুষের জন্ম হয়। জীবিত আর মৃতরা আসলে এক অবিচ্ছিন্ন বর্তমানেরই অংশ, শুধু আমাদের বিভ্রমের কারণে পৃথক মনে হয়।

ধীরে ধীরে যন্ত্রণা সরে গিয়ে শীতল, আনন্দময় বেহালার সুরের তরঙ্গ জেগে উঠছে, ভেসে বেড়াচ্ছে উচ্ছল মবিরার মূর্চ্ছনা, হার্পসিকর্ডের সুর, ছন্দ আর সুর ভেদ করে যাচ্ছে সুতীব্র আলোকের পাত্রখানি, যা কোনো অর্কেস্ট্রার চেয়েও শক্তিশালী, জটিল আর বৈচিত্র্যময়। আমি জলের আরও গভীরে তলিয়ে যাই। আমার শরীরের প্রতিটি অংশ টুকরো হতে হতে এক-একটি কোষে রূপান্তরিত হয়। আমি ক্রমেই বহু সত্তাবিশিষ্ট চৈতন্যশক্তির আধার কোরিয়ালিসের গভীরে বিলীন হয়ে যাই। আমার সমস্ত মনন, আশা, অভিলাষ… আমার যা কিছু আছে আমি সব তাকে সমর্পণ করি।

পরিশেষে, আমরা তো এই পৃথিবীরই অংশ। কোরিয়ালিসের যে বাস্তুতন্ত্রকে আমরা ভেঙেছিলাম, তা আবার পুনরুদ্ধার হল। জীবনের পরিবর্তে জীবন। সমস্ত জীবকুলের হয়ে আমিই আজ কোরিয়ালিসের সঙ্গে মধ্যস্থতা করে সব বৈরিতা মিটিয়ে নিলাম।

যখন গারান্দে আর চিফ আমাকে খোঁজার জন্য অনুসন্ধান-দল পাঠাবে, ওরা আমাকে আর খুঁজে পাবে না। যদি ওরা বিচক্ষণ হয় তবে আমার ইঙ্গিতপূর্ণ চিহ্নগুলো দেখতে পাবে। ক্যালসাইটের ফুলের উপর আমার স্তনবৃন্তের গড়ন। মসজাতীয় উদ্ভিদের গুচ্ছ আমার কুঞ্চিত আফ্রো চুলের মতো। মেঘের মধ্যে আমার ফুটে ওঠা মুখাবয়ব। ওরা শ্বাসপ্রশ্বাসে যে বায়ু টেনে নেবে আমি তার মধ্যেই থাকব, যে মাটি মাড়িয়ে ওরা চলে যাবে সেখানেই তো মিশে থাকব আমি। যখন ওদের পানপাত্র থেকে বিয়ার চলকে পড়বে মৃত্তিকায়, আমি তা পান করে নেব। যখন ওরা উদ্দাম বাজাবে নেহোশো ড্রাম, আমি অন্তরীক্ষে নেচে নেচে বেড়াব আর ওদের জন্য পাঠিয়ে দেব কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। আর যখন ওদের মৃত্যু হবে আর কোরিয়ালিস তার ভাগটুকু চেয়ে নেবে, তখন যেন ওরা ভয় না পায়, কারণ ওরা তখন আমার সঙ্গে এসে মিলিত হবে এই পূর্বপুরুষদের সমাধিক্ষেত্রে। আজ থেকে এই পৃথিবীই আমাদের ঠিকানা।

টীকা

১) মুসিকাভানু- মুসিকাভানু হলেন সৃষ্টির সর্বোচ্চ দেবতা। তাঁকে মুসিকি, তিঞ্জে, ইসে আর মাউরি নামেও ডাকা হয়ে থাকে। শোওনা উপজাতির মানুষের বিশ্বাস, এই সর্বশক্তিমান দেবতার প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, মাটির উর্বরাশক্তি আর বর্ষচক্র পরিচালিত হয় তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী। ম্বারি বা মুসিকাভানুর আরাধনার মাধ্যমেই একেশ্বরবাদের ধারণা প্রচলিত হয় আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, সে ইতিহাস বহু প্রাচীন। বর্তমান জিম্বাবোয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মোজাম্বিকের আচার অনুষ্ঠানেও মুসিকাভানুর প্রভাব লক্ষ করা যায়।

২) মারারাসেইকো- শোওনা ভাষা থেকে যথাযথ অনুবাদ করা কঠিন। ভাবানুবাদ করলে খুব কাছাকাছি অর্থ হল, “ভালো ঘুম হয়েছে?” উত্তরে “তারারা মারারাওয়ো!’ বলাই রেওয়াজ। অর্থ হল, “আমার ভালো ঘুম হয়েছে, যদি তোমার ভালো ঘুম হয়ে থাকে!”

৩) ন্যামাভুভু- অগাস্টের মাসকে শোওনা ভাষায় ‘ন্যামাভুভু’ বলে ডাকা হয়। কথাটার আক্ষরিক অর্থও হল ‘জোর হাওয়া দেয়া’। বাস্তবিকই জুলাই-অগাস্ট মাসে ওই অঞ্চলে জোর শীত পড়ে, সারাক্ষণ হিমেল হাওয়া বয়ে যায়।

৪) মাহেউ- জনপ্রিয় আফ্রিকান পানীয়! ভুট্টার গুঁড়োকে জলে মিশিয়ে দইয়ের মতো করেই ফার্মেন্টেশন করানো হয়। অ্যাল্কোহলিক ড্রিংক এড়াতে অনেকেই সকাল বিকেল মাহেউ পান করে।

৫) তিনিয়ারেও, শা- ভাবানুবাদ করলে কথাটার অর্থ—লজ্জা হওয়া উচিত, স্যার!

৬)নাতসাকওয়াউনোবা, কোয়াউনোয়েন্দা, হুসিকু- এই শব্দবন্ধের ভাবানুবাদ হল, তুমি কোত্থেকে এখানে এসেছ আর রাত্রি ঘনালে তুমি কোথায় যাবে?

লেখক পরিচিতি

জিম্বাবোয়ের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সবচাইতে শক্তিশালী লেখক হিসেবে টি এল হুচুর উত্থান। তিনি পূর্বে টেন্ডাই হুচু নামে বড়োদের জন্য বই প্রকাশ করেছেন, কিন্তু দ্য এডিনবার্গ নাইট সিরিজ হল তাঁর লেখা প্রথম জঁর ফিকশন। তার আগের বইগুলি (দ্য হেয়ারড্রেসার অফ হারারে অ্যান্ড দ্য মাইস্ট্রো, দ্য ম্যাজিস্ট্রেট অ্যান্ড দ্য ম্যাথেমেটিশিয়ান) পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং তার ছোটোগল্প বহু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জিতেছে। টি এল হুচু আফ্রিকান সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় দারুণ সাফল্য পেয়েছেন, তবু এটা পাঠকদের জন্য সৌভাগ্য যে, উনি কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসি গোত্রের সাহিত্যে ওঁর ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। তাঁকে টুইটারে ফলো করার ঠিকানা হল @TendaiHuchu.

অনুবাদক পরিচিতি

কল্পবিজ্ঞান, সামাজিক-রাজনৈতিক, রহস্য-রোমাঞ্চ সহ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লেখায় স্বচ্ছন্দ পার্থ দে। লেখালিখি করছেন বিগত তেরো-চোদ্দ বছর। মৌলিক লেখার পাশাপাশি অনুবাদও করেন। বাংলাভাষার বিভিন্ন নামী ও উল্লেখযোগ্য পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। অদ্যাবধি প্রকাশিত তাঁর মৌলিক বইয়ের সংখ্যা আটটি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘চাঁদের উপত্যকা’, ‘মনন শীল’, ‘ফিল গুড গাড়ি’, ‘অরূপকথারা’, ‘দেশ হারিয়ে যায়’, ‘রুধির ধারায় রহস্য’। অনূদিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘১০৫ নং রুমের মেয়েটি’, ‘রামধনুদের ওঠা দেখো’। তিনি ২০২২ সালের অনীশ দেব স্মৃতি সম্মান প্রাপক।

সকল অধ্যায়

১. অমরত্বের আড়ালে – ব্লেইজ কায়ে। অনুবাদ : অরিন্দম দেবনাথ
২. জল হরকরা – ইউজেন বেকন। অনুবাদ : অদিতি সরকার
৩. স্বাদ – চিকোদিলি এমেলুমাডু। অনুবাদ : সোহম গুহ
৪. বালিয়াড়ির গান – সুয়ি ডেভিস ওকুংবোয়া। অনুবাদ : মহাশ্বেতা
৫. অন্তিম সঙ্কেত – ইভর ডাব্লিউ. হার্টম্যান। অনুবাদ : দীপ ঘোষ
৬. অক্সিজেন রণাঙ্গন – ওগিনিকোওয়ে ডোনাল্ড একপেকি। অনুবাদ : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
৭. একে একে নিভিছে দেউটি – কোফি ন্যামেয়ে। অনুবাদ : অনুষ্টুপ শেঠ
৮. তৃষ্ণাভূমি – নিক উড। অনুবাদ : রাজর্ষি গুপ্ত
৯. সমবেত সঙ্গীত স্থাপত্যে মিলনসঙ্গমের দিশা – ডেয়ার সেগুন ফালো। অনুবাদ : সুমিত বর্ধন
১০. দি রিগ্রেশন টেস্ট – ওলে তালাবি। অনুবাদ : শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. কোরিয়ালিস – টি এল হুচু। অনুবাদ : পার্থ দে
১২. শরম – নেরিন ডরম্যান। অনুবাদ : শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন