জল হরকরা – ইউজেন বেকন। অনুবাদ : অদিতি সরকার

জল হরকরা। লেখক— ইউজেন বেকন। অনুবাদ— অদিতি সরকার

মূল গল্প: The Water Runner

খুপরিটার ভেতরে ওদের সঙ্গমের মিষ্টি সোঁদা গন্ধ ভাসছিল। পাকা ডুরিয়ান১.১  ফলের গন্ধের মতো। জ়াওয়াদি ওর পাতলা বিছানার উপর মাপেসার সঙ্গে একটুক্ষণ শুয়ে থাকে। সরকারি আবাসনে ওর এই এক-ঘরের ইউনিটটা অন্য ভাড়াটেদের থেকে একটা পর্দা দিয়ে আলাদা করা। একটা পুরোনো জিনিসের খয়রাতি পোঁটলা থেকে অনেক ঝামেলা করে ওটাকে বাগিয়েছিল জ়াওয়াদি।
 

কোথাও একটা বাচ্চা কাঁদছিল— ঠিক কান্না নয়, বরং গোঙানি বলাই হয়তো ঠিক। খানিকক্ষণ পর বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় সে, টকটকে লাল মরুবালুকার ঝাপটা মুখে এসে লাগে তার। এই ভোরে চামড়ার ওপরে বালির ঘষাটা একটু হলেও হালকা লাগে।

তেষ্টা পাচ্ছিল জোর। জ়াওয়াদি কল্পনায় অনুভব করে তার গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঠান্ডা, পরিষ্কার জল। নয়া ডোডোমার কথা ভাবে সে, অদূরেই অবস্থিত সেই দুনিয়া, যেখানে নাকি ঝিলমিলে শ্বেতপাথর আর সোনালি কাঠ দিয়ে সাজানো চানঘর আছে! মাথার ওপরে বসানো মসৃণ ধাতব কলের মুখ থেকে বৃষ্টির ধারার মতো জল পড়ে হিসিয়ে।

দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ধুলোঢাকনি চাদরটাকে আরও একটু আঁট করে নেয় সে, কনুইয়ে শিয়া বাটারের দুধ১.২ ঘষার কথা ভাবে। কী যে অদ্ভুত, অপূর্ব ওই দুনিয়াটা, যেখানে নাকি চুল কাটতে গেলে তার সঙ্গে বিয়ারও মেলে। ওখানে রাস্তাগুলোর অবধি নাম আছে— মিরিয়াম মাকেবা২ রোড, ফেলা কুটি৩ ড্রাইভ, কিডিয়ো অ্যাভেনিউ৪, মাসেকেলা৫ লেন। ওই দুনিয়ায় উঁচু উঁচু টাওয়ারের সরু চুড়ো উঠে আকাশকে চুমু খায়, যেদিকে তাকাও শুধু জল আর জল, আর জলের ধার দিয়ে হাঁটার জন্য তৈরি সুন্দর সাজানো পথ।

কিন্তু তার আগে, এইখানে, এই পুরোনো ডোডোমার মধ্যে দাঁড়িয়ে, অনেক কিছুই ভাবতে হবে তাকে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঠিকই—কিন্তু অনেকরকম পরিস্থিতি বুঝে, আগুপিছু ভেবে, বিচার করে তার পর। ভাবনার উপসংহারটুকুকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়ার মতো বেপরোয়া কাজ একেবারেই চলবে না।

টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে অনেক কিছুরই উন্নতি হয়েছে, সেটা সত্যি—শুধু আবাসন, আবহাওয়া আর জলের অভাবটুকু ছাড়া। জ়াওয়াদি জুঁইয়ের গন্ধওয়ালা ড্রাই ওয়াশ হাতে মুখে রগড়ে নেয়, ওর ভিতরেই ময়েশ্চারাইজ়ার দেওযা আছে। এরপর মুখ শোধন করার গুঁড়ো চাটতে থাকে, ফলে তার জিভ থেকে বাসি ঘুমের স্বাদ মিলিয়ে আসে, একইসঙ্গে মিলিয়ে যায় মাপেসার শরীরের স্বাদও।

পর্দার দিকে একবার তাকায় জ়াওয়াদি… আইডিয়াটা মাপেসারই। “যত বেশি ভাড়াটে তত বেশি ক্রেডিট!” একসঙ্গে থাকতে শুরু করার অল্প দিনের মধ্যেই বলেছিল মাপেসা।

“এই যে সোনা!” কাজে বেরোনোর জন্য গায়ে ক্লাই-স্যুট চড়াতে চড়াতে সে এবার মাপেসাকে বলে, “তোমার দিনটা কেমন যায় জানিও কিন্তু আমায়।”

“বিন্দাস রেহনে কা ডার্লিং!” মাপেসা জবাব দেয়, তার তরুণ দু’চোখে সোনার কুঁচি ঝিকিয়ে ওঠে। সেই ঝকঝকে মসৃণ হাসিটা আবার হাসে সে, যেটা দেখলেই জ়াওয়াদির হাঁটু নরম হয়ে আসে।

***

‘পিং’ ধরে ধরে এগিয়ে চলে জাওয়াদি। প্রত্যেকটা পিং-এর সঙ্গে তার কো-অর্ডিনেটও আসে। নিজের সৌরশক্তিচালিত শব্দহীন হোভারবোর্ডটাকে ব্লুটুথে জুড়ে দিয়ে ভেসে পড়ে সে।

প্রতিটা দিনই শুরু হয় প্রবল উদ্যম নিয়ে, কিন্তু ক্রমে সেই উদ্যম ধীরে ধীরে দুশ্চিন্তার ভারে একেবারে শূন্য হয়ে মিলিয়ে যায়।

দিনের শেষে পৌঁছতে পৌঁছতে দেখা যায় জাওয়াদির কাছে চলৎশক্তিটুকুও বাকি নেই, বাড়ির কো-অর্ডিনেট অনুসরণ করে লিউম্বুর দিকে উড়তে থাকা হোভারবোর্ডটাই তখন তার সমস্ত প্রশ্নের একমাত্র উত্তর, বাড়ি পৌঁছানো ছাড়া সব কিছুকেই সে সময় অবান্তর বলে মনে হয়।

আজকের প্রথম কলার ছিল পুরোনো ডোডোমার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মালিম্বিলি গ্রাম থেকে। ..একটা.. কুঁড়েঘরে.. গুটিশুটি হয়ে .বসেছিল সেই মহিলা। নি:শেষিত শরীর নিয়ে কাঁদারও ক্ষমতা ছিল না তার, যদিও এই শোকের মুখোমুখি হওয়ার অনেক আগে থেকেই মহিলাটির মুখে চিরস্থায়ী হতাশার ছাপ পড়ে গিয়েছে। তার পাংশু মুখ দেখে জ়াওয়াদির নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছিল, বহু বছর আগে সেই অংকুলুংগুতে দেখা মায়ের মুখখানির কথা। অ্যান্টেলোপ হরিণের মতো মিষ্টি মেদহীন একটি মুখ। কিন্তু এই কুঁড়েঘরের সঙ্গে সেই ডালিম, নারকোল, ডুমুর আর কমলালেবুতে ঠাসা তাজা ফলের সুগন্ধে ভরা কুটিরের কোনো তুলনাই হয় না। জ়াওয়াদির মা ওইসব ফল বাজারে বেচতেন। মালিম্বিলির এই কুঁড়ে থেকে গুয়ে ভরা নর্দমার দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল।

মহিলাটি একটি ছোট্ট পুঁটলি এগিয়ে দেয় জ়াওয়াদির দিকে। তারপর সেটার মোড়ক সরিয়ে বার করে আনে একটি ফুলে ওঠা মুখমণ্ডল, যার মণিহীন চোখ দুটি মৃত্যুর পর খোলাই রয়ে গিয়েছে, ছোট্ট ধূসর মুখটা যেন সরলরেখায় স্থির, বন্ধ। মৃত শিশুটির মা তার শরীরটিকে তাপ থেকে বাঁচাতে শীতল কাপড়ে মুড়ে রেখেছিল। মরে গেলে যে শীত বা গরম লাগে না, এই সহজ যুক্তিটি বোঝার মতো মনের অবস্থা তার ছিল না।

“কী হয়েছিল?” জ়াওয়াদি জানতে চায়।

“না মানে…ও… ও কিন্তু খুবই ছোটো!” মহিলাটি দোনোমনা করতে করতে বলে।

জ়াওয়াদি নিজের যন্ত্রটা বার করে, লগবুকে কাজটা এন্ট্রি করে দিয়ে বলে, “সব সময় ‘না’ দিয়ে কথা শুরু করতে নেই।”

“ওকে সত্যিই নিয়ে যাবে তুমি?” নারীটি গুনগুন শব্দে কথাটা বলে। তার চিটেঙ্গে৬ বার বার কাঁধ থেকে খসে পড়ে একটি দুধচোঁয়ানো স্তনকে অনাবৃত করে দিচ্ছিল।

“ওই দুধও কিন্তু বিক্রি হয়। না শুকোনো পর্যন্ত আমি দুধটা সংগ্রহের বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।” জ়াওয়াদি এইবার সরাসরি মহিলার দিকে তাকায়, “এর মানে বুঝছ তো? তোমার— আর… ওই ওর জন্য অতিরিক্ত কিছু ক্রেডিট, ব্যস!” চিটেঙ্গের পিছন থেকে উঁকি দিতে থাকা আপাদমস্তক ধুলোমাখা ছেলেটির দিকে ইশারা করে দেখায় সে। ছেলেটার মরচে-রঙা চুল অবিন্যস্ত, পেটটাও ফোলা ফোলা।

“ওকে বরং ওই দুধটা খাওয়াও উপস্থিত কয়েকদিন, কোয়াশিওর্কোরে৭ উপকার হবে ওর।”

“সবই দেবতাদের দান। তাঁরা সেই দান ফিরিয়ে নিতে চাইলে ঝগড়াঝাঁটি করে আর কী হবে?” মহিলাটি নিস্তেজ সুরে বলে ওঠে। জ়াওয়াদির কথা তার কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না।

“সে তোমাদের এরকম প্রবাদ বা বিশ্বাস থাকতেই পারে, তবে আর যাই হোক, এটা মোটেও কর্মফল নয়। দেবতাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলে আমি ঠিক জানতে চাইতাম তারা এমন নিষ্ঠুর কেন?”

মহিলাটি উত্তর দেয় না, প্যাডের উপর এক আঙুল রেখে সই করে দেয়।

“শাটল ওকে সংগ্রহ করতে আসা মাত্র ক্রেডিট পেয়ে যাবে।” জ়াওয়াদি জানিয়ে দেয়।

কথাটা বলেই সে এক লাফে আবার নিজের কসমিক হোভারবোর্ডটিতে উঠে পড়ে, যন্ত্রটার দুধসাদা রঙটা প্রতিফলিত হয় তার চোখের কোণে। হোভারবোর্ডে বসে নির্মেঘ, লাল আকাশের নীচে ভেসে চলে সে। আজকের দিনটাও আগুনে একেবারে। শরীরের তো অভ্যেস হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এতদিনে। সরকারের দেয়া ক্লাই-স্যুটটিতে স্ব-নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা আছে, যাতে পরিবেশের সঙ্গে সেটি মানিয়ে নিতে পারে। তবু সেটা পরা সত্ত্বেও জ়াওয়াদির কখনই আরাম হয় না, শীতল অনুভূতি হওয়া তো দূরের কথা। আসলে ওই স্যুটের উদ্দেশ্য আরোহীকে আরাম দেয়া নয়, বরং তাদের সহনশক্তি বাড়িয়ে তোলা।

ট্র্যাফিক আইল্যান্ডে আটকে থাকতে থাকতে জ়াওয়াদি মাপেসার কথা ভাবে। একবারও কল করেনি সে। আজ ওর কেমন কাটছে কে জানে? মাপেসাও জ়াওয়াদির মতোই সরকারের অধীনে কাজ করে। ওর কাজটা হল গ্রুমারের। বয়স্ক লোকেদের ড্রাই-ওয়াশ করে ও। জ়াওয়াদির মতোই ‘পিং’-এর মাধ্যমে নির্দেশ আসে তার কাছে। তবে ওর বাকি কাজটা বায়োকেমিক্যালস আর একটা ছোটো হাতে-ধরা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারই করে দেয়।

***

তিন বছর আগে মাকুলু অয়েস্টারবে-তে আয়োজিত একটা সরকারি কনফারেন্সে দেখা হয়েছিল ওদের। ওয়াটার প্ল্যানিং বা ভবিষ্যতে জল ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে একটা আলোচনা ছিল সেদিন। এইটুকু-টুকু স্যান্ডউইচ পরিবেশন করা হচ্ছিল, সেগুলোর পেটে রাজ্যের ক্রিম চিজ় ঠাসা হয়েছে, সঙ্গে ছিল স্মোকড স্যামন মাছ আর হার্ডবয়েলড ডিম। উর্দিধারী ওয়েটাররা ট্রে-তে সত্যিকারের স্বচ্ছ জলে ভরা পানপাত্র নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। প্রথম যখন মাপেসাকে দেখেছিল জ়াওয়াদি, ওর কোঁকড়া চুলের জট আর চোখের সোনালি ঝিলিক দেখে মুগ্ধ হয়েছিল সে। আর এরপর যখন দীর্ঘদেহী শরীর নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সে, তেরছা হেসে জ়াওয়াদির দিকে তাকিয়েছিল…উফ্। এ যে একেবারে পেশাগত উন্নতির পাশাপাশি ডিভিডেন্ডও পাওয়ার সুযোগ পাওয়া গিয়েছে! বা মূলধনের ওপর চড়া সুদও বলা চলে!

সুদের অংশটা অবশ্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। বাহুতে ছোঁয়া লাগার আগেই জ়াওয়াদির নাকে এসে লেগেছিল ওর শরীরের ভ্যানিলা আর কাঠ মেশানো গন্ধটা। আর দেরি করেনি সে। সরাসরি মাপেসার চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিল জ়াওয়াদি, “আপনার জন্য প্রশ্ন। আমাদের মহান নেতা সম্বন্ধে আপনার মতামত কী?”

এই পরীক্ষায় প্রায় ফেলই করে যাচ্ছিল মাপেসা। সে বলেছিল, “আগে ভাবতাম লোকটা একটা আস্ত বুরবক, তবে এখন মনে হয়…”

‘তবে এখন মনে হয়’… শুনেই জ়াওয়াদি চলে যাওয়ার জন্য পেছনে ঘুরেছিল। “আপনাকে চিনতে আমার ভুল হয়েছে, বুঝতেই পারছি—”

কিন্তু মাপেসার হাতের তালু ওর কনুই চেপে ধরে, আর ওর কথা থামিয়ে দেয় সঠিক উত্তর দিয়ে।

“বোকা! একমাত্র বোকারাই দুই পা জলে ডুবিয়ে নদীর গভীরতা মাপে।”

সত্যিই, এই ‘মহান’ নেতা আদতে একটি আস্ত আহাম্মক ছাড়া আর কিছুই নন। ইতিমধ্যেই একটি ষোড়শীকে নিজের পঞ্চম স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি।

জ়াওয়াদির পরীক্ষা নেওয়ার পালা অবশ্য তখনই শেষ হয়নি। সকলের চোখ এড়িয়ে করিডোরের শেষ প্রান্তের একটা ছোটো ঘরে মাপেসাকে ঢুকিয়ে নিয়েছিল সে। দেখা গেল, সে ঘরটা আসলে রোবট ভ্যাকুয়াম ক্লিনারগুলোকে ঢুকিয়ে রাখার জায়গা। থেকে থেকে এই যন্ত্রগুলোর গোল-গোল সন্দিহান চোখ মিটমিটিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল—ঠিক বিভ্রান্তিতে নয়, বরং অনেকটা যেন ষড়যন্ত্র বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা নাড়াচ্ছিল রোবটগুলো। ওইখানেই, ওই স্টোররুমের ভেতরে, মাপেসা তার জন্য নির্ধারিত রসায়োনের পরীক্ষাটাতেও পাশ করে গেল।

এর পরেও অনেকদিন ধরে জ়াওয়াদি সেই দিনটার কথা ভেবেই চলেছিল। মাপেসার সেই পাগল করে-দেয়া চুমু, ওদের জিভে-জিভে লড়াইয়ের সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, ওর অনুপস্থিতিতে ব্যাকুল কামনায় কাঁপতে থাকা জ়াওয়াদি অধীর ঠোঁট…

জোট বাঁধার পর, প্রায়ই জ়াওয়াদির নিরাবরণ পিঠের শিরদাঁড়া ধরে নিজের সরু লম্বা আঙুল নীচের দিকে নামিয়ে আনত মাপেসা। ব্যাপারটা বড় পছন্দ ছিল জ়াওয়াদির। ‘’আইয়াইয়া!’’ যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হত দেহের ভেতরে। তার পিঠের সঙ্গে জড়িয়ে একেবারে চামচের মতো বেঁকে শুয়ে থাকে মাপেসা, দুজনের দেহ খাপে খাপে বসে যায় তখন যেন! কী ভীষণ ভালো লাগে তার। মাপেসা তাকে নয়া ডোডোমার গল্প বলে—সেখানে সত্যিকারের স্কুলে সত্যিকারের টিচারদের দিয়ে পড়ানো হয়, রোবট দিয়ে নয়। ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের প্রতীক আঁকা ব্লেজার পরে প্রার্থনায় দাঁড়ায়। গল্প বলে সেইসব রাস্তার, যেখানে সংকেত অনুসরণ করে সুর বেজে ওঠে, যে সুর মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় ফুলে ফেঁপে ওঠা এক নোনা সমুদ্রের ধারে, যে সমুদ্র ভরে আছে জ্বলজ্বলে আলো-ঠিকরানো মাছের ঝাঁক।

ওদের শরীরের রসায়নও খুবই ভালো। জ়াওয়াদির ‘সুইট স্পট’…মানে ওর শরীরের সেই বিশেষ জায়গাটা মাপেসা নিখুঁতভাবে চেনে। সেখানে হাত ছোঁয়ালেই জ়াওয়াদির নিতম্বটা শক্ত টানটান হয়ে ওঠে, গোটা শরীর জুড়ে ঠান্ডা-গরমের তাপ প্রবাহ আর ঘন ঘন অগ্নিস্ফুরণ হতে থাকে, আর ভাসিয়ে নেওয়া মুক্তির আগে দু’ পায়ের মাঝে অনুভূত হয় সেই তীব্র দপদপানি।

কিন্তু যখন তর্ক বাধে, আর মাপেসা যখন একটা ভীষণ নাক-উঁচু ভাব দেখাতে থাকে, তখন সেই প্রথম দেখার সময় বলা মাপেসার কথাগুলো নিয়ে আবার চিন্তা করতে শুরু করে জ়াওয়াদি। ভাবতে থাকে সেই দুই পা জলে ডুবিয়ে নদীর গভীরতা দেখা বোকা বলতে ঠিক কাকে বুঝিয়েছিল মাপেসা? মহান নেতাকে, নাকি খোদ জ়াওয়াদিকেই?

***

ট্র্যাফিক সিগন্যালের আলো পালটায়।

এরিয়া সি-র কাজটা আত্মহত্যার কেস। সাত বাচ্চার বাবা নিজেকে শেষ করে দিতে বাধ্য হয় কেন? কোনো কারণ তাকে বাধ্য করে? উত্তর হল—সব কিছু। যে দুনিয়ায় অর্জিত যাবতীয় ক্রেডিটকে একটি নিষ্ঠুর অর্থনীতি গলিয়ে ডুবিয়ে গ্রাস করে নেয়— সেখানে আত্মহত্যার কারণ একটা হবে কী করে? সব কিছুই দায়ী এর জন্য। বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছিল মানুষটা। যদিও বাইরে থেকে লাশটা নিখুঁতই দেখাচ্ছিল, মরণকালীন যাতনায় গুটিয়ে গর্ভস্থ ভ্রূণের মতো গোল হয়ে যাওযা শক্ত লাশ, তবু জ়াওয়াদিকে “না’’ বলতেই হল। লোকটা মরার জন্য মরচেগলানো তরল খেয়েছিল। ওর শরীরে জমা জল বিপজ্জনক হয়ে গেছে।

পরের কাজটা ছিল ইপাগালাতে। অ্যাকসিডেন্ট। আরো ভালো করে বলতে হলে ‘হিট অ্যান্ড রান’। অন্য একটা হোভারবোর্ডের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধেছিল। ভাঙাচোরা থ্যাঁতলানো শরীরটাকে ভালো করে দেখে জ়াওয়াদি— দুর্ঘটনার জায়গায় অবশিষ্ট দেহটার যতটুকু অংশ ছেতরে লেপটে ছিল। লাশটা তাজা, তাই এখনও এই গরমে পচে যাওয়ার তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়েনি।

সেখানে উপস্থিত মুখে গর্ত-গর্ত দাগওয়ালা মহিলাটি অবশ্য প্রথম কেসের মা-টির মতো চুপ করে ছিল না। মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে শোকে গর্জন করছিল সে। আশেপাশে জমায়েত লোকজন সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিল তাকে। জ়াওয়াদি ইতস্তত করে কাজটা লগবুকে তুলেই ফেলল, যদিও তরল খুব একটা বাকি ছিল না। আমাদিউস, ওর ম্যানেজার, আদৌ খুশি হবে না। “আমরা মাদার টেরেসা নই, বুঝেছ?” জ়াওয়াদি ওর তাচ্ছিল্যে বলা কথাগুলো কল্পনা করে, “যা তোমার নয় তার উপরে তোমার কোনো জোরই নেই।”

চ্যাং’ওম্বে-র খুনটা অবশ্য লগবুকে তোলা সম্ভব হয় না, যদিও জ়াওয়াদি লাশ খুঁটিয়ে দেখার একটা ভান করল ঠিকই। জটপাকানো চুলে ঢাকা থ্যাঁতলানো একটা মাথা, খুলিটা ভেঙে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। সেই বসে যাওয়া গর্তটা থেকে খালি মেঝেতে একটা থকথকে বস্তু গড়িয়ে এসেছে। মেয়েটার হাতে পায়ে কাটাছড়ার দাগ, হুইপল্যাশ৪ আঘাতের চিহ্ন।

নাক দিয়ে এখনও রক্ত চোঁয়াচ্ছে।

“এটা পুলিশ কেস। লাশ ছাড়লে আমাকে খবর দিও।” জ়াওয়াদি জানায়।

লাঞ্চের আগে উজ়ুনগুনিতে একটা পোড়ার কেস মেটাতে হল জ়াওয়াদিকে। এই পাড়াটা পয়সাওয়ালা— একটা বেড়া দেয়া কমপ্লেক্সের ভিতরে একরকম দেখতে সারি সারি সাজানোগোছানো তাপনিয়ন্ত্রিত বাংলো। বাড়িগুলো ফেজ-চেঞ্জ বা পর্যায়-পরিবর্তক উপাদান দিয়ে তৈরি, এই জিনিসটা লীন তাপ শুষে নিয়ে বাতাবরণ ঠান্ডা করে দেয়। বাংলো বাড়িগুলোর গিন্নিরা তাদের নিখুঁত ঘাসের লনের ওপর রোবট পুডল কুকুর নিয়ে ধীরেসুস্থে পায়চারি করছিল।

জ়াওয়াদি একটা বাগানের ধার ঘেঁষে হাঁটছিল। বাগান জুড়ে পিয়োনির গোলাপি আভা, গোল গোল লালচে-বাদামি গোলাপের মতো লেপার্ড অর্কিডের হলুদ বিস্তার, লাল ভেলভেটে গিল্টি করা ইমপালা লিলির দুধেলা ছিটে, তুষার-সাদা বেবি’জ ব্রেথ ফুল। এখানে, সস্তাদরের পাড়াগুলোর মতো কোনো অতি কৌতূহলী পড়শির উঁকিঝুঁকি নেই। পর্দা, পালিশ, রং—চৌকাঠ পার না হলে কিচ্ছুটি দেখা যায় না।

একটা বাংলোর ভিতরে গ্যাস চুল্লি ফেটেছে। মহিলাটির দেহ থেকে খসে পড়তে থাকা সিদ্ধ চামড়ার দিকে তাকায় জ়াওয়াদি, গলে যাওয়া প্লাস্টিকের মতো থুতনি আর গলার দিকে, সারা শরীরে দলা হয়ে জমে থাকা পোড়া অঙ্গারের দিকেও নজর দেয়। কিন্তু পুড়ে যাওয়ার ফলে একটা ভালো জিনিস হয়েছে, এঁর জলটা ‘সিল’ হয়ে গেছে— জ়াওয়াদি চটপট কাজটা লগবুকে তুলে ফেলে। মহিলার স্বামী বেশ ভালো ক্রেডিট পাবেন।

মাথা যন্ত্রণা করছিল জ়াওয়াদির। শরীরের সব পেশিতেও যন্ত্রণা। লাগাতার, প্রতিদিন, লাশের পর লাশ। আর কতদিন পারবে টানতে এভাবে? চ্যামউইনোর অফিসে ফিরে নিজের জুতোর বাক্স-মার্কা কুঠুরিটায় ঢোকে জ়াওয়াদি। একটা গুদামের তিনতলায় অবস্থিত এই পুঁচকে খোপটায় গুঁতিয়েগাঁতিয়ে দুটো ডেস্ক আর একটা টিভি আঁটানো হয়েছে। ‘নিউট্রিশন পিলস’ বা পুষ্টি বড়ির উৎপাদন হয় এখানে। গুদামটা যাকে বলে ‘পোঁতা গুদাম’, পুরোনো ডোডোমার বেশির ভাগ কর্পোরেট বিল্ডিং-এর মতোই মাটির তলায় পোঁতা একটা কাঠ আর কংক্রিটের সংকর নির্মাণ— পাথরের গির্জার মতো ঠান্ডা থাকার মতো করে তৈরি করা হয়েছে।

অ্যামাদিউস, জ়াওয়াদির বস, গায়েব হয়ে গেছে। ওরা দুজনে মিলে জলের ব্যাবসাটা চালায়, লাশ সংগ্রাহক, কারখানা, ট্যাঙ্ক আর ব্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে। কিন্তু আর কিছুদিনের মধ্যেই এই সবকিছু রোবটদের হাতে চলে যাবে। সব জায়গাতেই তো ওদের বাড়ন্ত। পপ-আপ ক্লিনিকগুলোয় আজকাল রোবট রোগী দেখে, মুখ দিয়ে প্রেসক্রিপশন ছেপে বার করে দেয়। যে সব বাচ্চারা বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে লেখাপড়া শেখে না তাদের পড়ায় রোবট, আর যারা শেখে তাদের জন্য অনলাইন মডিউল চালায়। ওয়াক-ইন লন্ড্রিও চালায় রোবটই— নোংরা কাপড়চোপড় গিলে নেয় আর ইস্তিরি করা কাপড় বমি করার মতো বার করে দেয় মুখ থেকে। এদের সবার মালিক হল সেই মহান নেতার নিজের কোম্পানি, রোবোটিক্স।

***

লাঞ্চে আজ দুটো লাল: প্রোটিন, ভাইটামিনস, মিনারেল, জল আর কার্ব দিয়ে ঠাসা স্বাদহীন বড়ি। জ়াওয়াদি বড়িগুলো গোটাই গিলে নেয়। তার অন্তত এগুলো কেনার সামর্থ্যটুকু আছে বলে সে কৃতজ্ঞ বোধ করে, যদিও মৃত মানুষদের শরীরের যে জল সে রিসাইকল করে তা কেনার ক্ষমতা তার নেই। বড়িতে থাকা পুষ্টিকণাগুলো তার শরীরে যাওয়া সত্ত্বেও তার তেষ্টা মেটে না। মাথার ভিতরে সংজ্ঞা হারানোর অনুভূতি হচ্ছে, মস্তিস্ক সংকেত দিচ্ছে যে সে ক্লান্ত। অথচ দিনের মোটে অর্ধেকটাই কেটেছে এখনও পর্যন্ত।

যেসব দিনগুলোতে খুব বেহিসেবি হতে ইচ্ছে করে, জ়াওয়াদি সেদিন বেগুনি বড়ি খায়। ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস আর পটাশিয়ামে ভরপুর বেগুনি বড়ি— এই খাবারে তার জলের ভারসাম্য ঠিক থাকে, ত্বক খাদ্য পায়, চুল আর নখ চকচকিয়ে ওঠে, লোহা আর সেলেনিয়ামের ভরপুর মাত্রা তাকে সবল রাখে।

সংযত হিসেবি দিনে (জ়াওয়াদি আর মাপেসা নয়া ডোডোমার জন্য সঞ্চয় করছে) আবার বড়ির রং ধূসর— শুধু অনেকখানি কার্ব, যাতে মস্তিষ্কটা চালু থাকতে পারে কোনোক্রমে। তবে বেশির ভাগ সময়েই নীল দিয়েই চালিয়ে নেয় সে। লালের থেকে সস্তা, তবে ঠিক ততটুকু প্রোটিন দেয়া যতটুকুর খোঁচায় দেহে ঠিকঠাক হরমোন আর অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে সেই বড়িগুলো।

রিমোটটা হাতে তুলে নেয় জ়াওয়াদি। টিভিতে মহান নেতা তাঁর হিপোসুলভ মাথা আর ইঁদুরসুলভ মগজ নিয়ে উদ্‌ভাসিত হয়ে উঠলেন। প্রায় দুই দশক কেটে যাওয়ার পরেও লোকটা আবহাওয়ার পরিবর্তনকে অস্বীকার করে চলেছে।

“আমি ওসব বিশ্বাস করি না।” একজন সাংবাদিককে বলছিলেন মহান নেতা। “সব ধাপ্পাবাজি। এরা হল গিয়ে সর্বনাশের ব্যাপারী। সব ক’টাকে পিটিয়ে মারা উচিত।”

যেমন করে তিনি অর্থনীতিকে পিটিয়ে মেরেছেন। যেমন করে পিটিয়ে মেরেছেন বিরোধী স্বর আর গণতন্ত্রকে। নিজেকে ‘মহান নেতা’ বলে ঘোষণা করেছেন নিজেই, রাশিয়ার কোনো সম্রাটের সঙ্গে দীর্ঘায়ুর গোপন রহস্য নিয়ে কাজ করেছেন, নিজের মূর্খতাকে নিত্য নবজীবন দেয়ার জন্য নতুন চিনের কাছ থেকে ওষুধ কিনে চলেছেন। মাপেসা নিঃসন্দেহে তাঁর একজন ভক্ত। আর আজকাল তিনি বারবার শুধু হার্ভেস্টিং ক্লিনিক নিয়ে কথা বলে চলেন। সরকার নাকি শিশু উৎপাদন করছে।

“কথাটা যদি সত্যি হয়,” জ়াওয়াদি বলে, “তাহলে ওগুলো প্রচার খামার—প্রোপাগান্ডা ফার্ম।”

“উফ, গিভ হিম আ ব্রেক। মহান নেতাকে মাঝেমধ্যে একটু বিশ্বাস করলেও তো পারো। রাষ্ট্র যদি শিশু উৎপাদন করে তাতে ক্ষতি কী?”

“কীসের জন্য?”

“তুমি শুধু একবার নামটা লেখালেই আমরা বড়লোক হয়ে যাব! “আমি মেয়েছেলে হলে কালকেই গিয়ে রেজিস্টার করে আসতাম।”

“আমি কিছুতেই ওই হার্ভেস্টারের কাজ করব না।”

“কতগুলো ক্রেডিট জানো? আড়াই লাখ। নয়া ডোডোমার জন্য দুটো ওয়ান-ওয়ে শাটল টিকিট হয়েও যথেষ্ট বাঁচবে।”

“ডার্লিং!” জ়াওয়াদি বলে, “তুমি বিছানায় খুবই ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিছানার বাইরে আমাদের কথাবার্তাগুলো কি সবসময়ই তর্কাতর্কিতেই শেষ হতে হবে?”

***

শেষ কাজটার শুকনো খটখটে মানুষটাকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিল না জ়াওয়াদি। একজন স্ত্রীলোক গোটা একটা বছর ধরে তার স্বামীকে শস্য গুদামে আটকে রেখেছে, তাকে আংটায় ঝুলিয়েছে, ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে রেখে দিয়েছে যেমন করে শুয়োরের মাংস রাখা হয়। মৃতদেহটা এখনও গোলাপি—কিংবা হয়তো গোলাপি-কমলা, কিন্তু কী রং তা ভেবে কি কোনো লাভ আছে? জ়াওয়াদির শুধু মনে পড়ছিল এক একটা জায়গায় কীরকম খড়খড়ে মোটা হয়ে ছিল দেহটা, পুরনো চামড়ার থেকেও শক্ত। আর মুখটা, হা ঈশ্বর! ওই মুখটা। ওর জল পুরোপুরি শুকিয়ে গিয়েছিল, তবুও জ়াওয়াদি কাজটা লগ করে, কয়েকটা ক্রেডিট ফাঁকেতালে গলিয়ে দেয়। কেন করেছিল বউটা এরকম? লোকটাকে রাখার জন্য না খাওয়ার জন্য? আর এতদিন পর সে ‘পিং’ কেন করল শেষমেশ? কেন জানাতে গেল? মুক্তি না চূড়ান্ত হতাশা? আসলে সকলেরই একটা সহ্যের সীমা থাকে।

“সত্যি আছে?” রাতে লিউম্বুতে বাড়ি ফিরে লাল বড়িগুলো গেলার পরে মাপেসাকে প্রশ্ন করল সে। “হার্ভেস্টিং ক্লিনিক?”

“বোকা বোকা কথা বোলো না তো!” মাপেসা বলে। “অবশ্যই আছে।”

“ওই দ্যাখো কে এসেছে।”

রাফি, ভাড়াটেদের বাচ্চা মেয়েটা। পর্দার তলা দিয়ে নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে বাচ্চাটা। বেড়ালছানার মতো বড়ো বড়ো ধূসর চোখ মেয়েটার। বয়সের তুলনায় মেয়েটার বাড় কম, বোঝাই যায়। হাঁটার বয়স হয়ে গেছে অথচ এখনও পেট টেনে টেনে হামাগুড়ি দেয়। বিশেষ খেলেটেলে না, লিউম্বুর লোকজনের ঘুমোনোর সময়টা জুড়ে খিটখিট করে কাঁদে। কান্নাটাও বাচ্চাদের মতো ওঁয়া-ওঁয়া করে না, বরং শোকাতাপা বুড়িদের মতো টানাটানা নীচু ঘ্যানঘেনে আওয়াজ একটা: “ওওওওহ্‌হ্‌হ্‌হ্।” বাচ্চাটা যে অপুষ্টিতে ভুগছে এটা বুঝতে বিশাল কিছু বুদ্ধির দরকার হয় না। পুঁচকিটা হয়তো শেষ পর্যন্ত আরও একটা জল সংগ্রহের সংখ্যা হয়েই রয়ে যাবে। কথাটা ভাবলেও জ়াওয়াদির কীরকম যেন লাগে।

“এই যে, শিকনিবুড়ি!” জ়াওয়াদি ডাক দেয়।                    

কিন্তু রাফির মা, কুইনি না বিনি কী যেন নাম, ঝাঁপিয়ে ঘরে এসে ঢুকে তুলে নেয় ওকে। ওর চোখে রাগ, মাথা জুড়ে ছোটো ছোটো আঁট বিনুনির লাইন, পরনে শতচ্ছিন্ন চিটেঙ্গে। নীরবে বাচ্চাটাকে কুড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায় সে, পেছনে রেখে যায় অপরিচ্ছন্নতার গন্ধ।

ঠিক নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না জ়াওয়াদি, কিন্তু ওই মেয়েটার স্বামী, জিওয়ে, ওকে দেখলেই কেমন একটা অস্বস্তি হয় যেন। কিছু একটা গোলমাল আছে লোকটার মধ্যে। পুলিশের আসামী শনাক্তকরণের লাইনে এরকম নাক-ভাঙা, কুটিল চোখ, চৌকো মুখের লোকজনদের আকছার দেখতে পাওয়া যায়। মেয়েটাকে দেখলেই মনে হয় প্রবল পিটুনি-খাওয়া। সারাদিন শুধু নিজের ওই ঝিমন্ত বাচ্চাটাকে তাড়াচ্ছে, হয় “অ্যাই” নয়তো “থাম” বলে চিল্লিয়ে যাচ্ছে। যে বাচ্চা কিছু করেই না সে থামবে কী!

জ়াওয়োদি মাঝে-মাঝে ভাবে জিওয়ে কি বউ ঠ্যাঙায়? নিজে অবশ্য কখনও কিছু টের পায়নি, কিন্তু সে তো সারাদিন জল হরকরার কাজে ব্যস্ত থাকে— কে জানে কুঠুরির দেয়ালগুলো কী দেখে? মাঝে-মাঝে জিওয়েকে জাদুকর বলে ডাকে জ়াওয়াদি—অদ্ভুত অদ্ভুত সময় হাওয়া হয়ে যায় লোকটা। মুঠোফোনে ফিসফিস করে, ক্লাই-স্যুট পরে নেয় আর তারপর ভোর পর্যন্ত বেমালুম উবে যায়।

“আমি পারব না,” মাপেসা বলছিল, “কিন্তু তুমি পারবে।”

“কার সঙ্গে কথা বলতে হবে?”

মাপেসা ঝুলন্ত পর্দাটার দিকে মাথা ঝাঁকায়।

“জিওয়ে?”

“তুমি তো বলতে ও হয়তো কালোবাজারি করে?”

“তুমি কথা বলো তো!” জ়াওয়াদি বলে, “এই তর্কাতর্কিতে আমি হাঁফিয়ে উঠেছি।”

“বিন্দাস থাকো! আমিই বলব।” মাপেসা বলে ওঠে। তার চোখে সোনা ঝিকিয়ে নেচে ওঠে।

***

ফিসফিস করে ওদের বলা কথাগুলো শুনছিল জ়াওয়াদি—জিওয়ে আর মাপেসার গলায় ভীষণ তাড়ার ছোঁওয়া। সত্যি, রাতেরও কান আছে। রাফি তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বুড়ি মানুষের কাতরানির সুরে কাঁদছিল। “ওউউউহ্‌হ্‌।” জ়াওয়াদির ইচ্ছে করছিল বাইরে গিয়ে বাতাসের চিৎকারের উষ্ণতা মেখে দাঁড়াতে, চাদর সরিয়ে বিছানা থেকে পা নামিয়েও ফেলেছিল প্রায়। ঠিক তখনই পর্দাটা নড়ল। মাপেসা বিছানায় ফিরে এসেছে।

পিছন থেকে চামচের মতো করে জ়াওয়াদিকে জড়িয়ে ধরে মাপেসা, শিরদাঁড়া বেয়ে আঙুল চালায় আগের মতো। জ়াওয়াদি বিজলিকাঁপন কেঁপে ওঠে। ঘাড়ে মাপেসার কথাগুলো নিশ্বাস ফেলে তার।

“নয়া ডোডোমাতে চব্বিশ ঘণ্টা জল—কল থেকে উছলে পড়ে।”

জ়াওয়াদি পাশ ফিরে শোয়। “নতুন খবর বুঝি—সেটা?”

“দোকান আছে, সব কিনতে পাওযা যায়— চিনি, দুধ, রুটি, বিস্কুট, মায় ক্যানে বিয়ার কি সোডাও! যেমন আমরা বইয়ে পড়ি, অনেক কাল আগে যেমন ছিল সব।”

“জিওয়ে তোমাকে বলল এগুলো?” জ়াওয়াদি বলে। “এর পর তুমি বলবে ওখানে হাসপাতালও আছে, বিছানায় সাদা চাদর পাতা।”

“আছেই তো! ওখানে রেস্তোরাঁও আছে। যাও, বোসো, রাজার মতো পাঁচ কোর্সের মেন্যু দিয়ে ডিনার করো। শুধু সরকারি অনুষ্ঠানের দিনেই নয়, প্রতিদিনই তোমার জন্য কাজ করে দেয়ার লোক আছে ওখানে। তোমায় ওরা পোচড চিকেন এনে দেবে, বোনলেস ভেড়ার মাংস বা বাটারনাট স্কোয়াশের৮ কোফতা এনে দেবে, যেগুলো বড়ির মতো গিলে নয়, চিবিয়ে স্বাদ নিয়ে খেতে হয়।”

এ-কথা মানতেই হবে যে মরা মানুষের শরীর থেকে জল সংগ্রহের জন্য জ্বলাপোড়া মাটি আর পাথরের উপর দিয়ে ভেসে ভেসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল জ়াওয়াদি। এমন একটা জগত দেখতে চাইছিল সে যেখানে রাস্তাগুলো রুপোলি আলোয় ঝলমল করে, লোকজন ক্লাবে যায়। নিয়ন বাতি বা ওইরকমই কিছু জ্বলজ্বল করে। যেখানে মস্ত মস্ত চওড়া গলিতে অসংখ্য ছোটোবড়ো কাফের ভিড়। সত্যিকারের ফুলওয়ালা কোনো বটানিক্যাল গার্ডেনে হাঁটতে ইচ্ছে করে ওর, আর সত্যিকারের কুকুরওয়ালা—ছাঁটা ঘাসের উপর গর্বিত শেখদের মতো নাচতে থাকা রোডেশিয়ান রিজব্যাক৯, কিংবা ছিপছিপে আজ়াওয়াখ১০।

“এই জিওয়েটা কত ক্রেডিট চায় আমাদের কাছ থেকে?” মাপেসার কোঁকড়ানো চুল নিয়ে খেলা করে জ়াওয়াদি, “ক্লিনিকের সঙ্গে লাইন করিয়ে দেয়ার জন্য ওকে কী দিতে হবে আমাদের?”

“আমি দিয়ে দিয়েছি যা দেয়ার। শুধু তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে আমায়, ব্যস। একটা সপ্তাহ, তার পরেই আমরা দুজন নয়া ডোডোমায় বসে ককটেলে চুমুক দিচ্ছি।”

“একটা সপ্তাহ?”

“এর নাম টেকনোলজি। ডিম্বাণুগুলোর ট্রিটমেন্ট করা হয়ে গেছে। ইমপ্ল্যান্ট করার পর থেকেই, গর্ভধারণের সময়টা ওই যাকে বলে ত্বরান্বিত হয়ে যাবে।”

“আর আমার এই জল হরকরার কাজটা কে করবে?”

“আমাদিউসের সঙ্গে কথা বলতে পারি আমি। তোমাকে সিক লিভ দিয়ে দেবে ও আরামসে— শ’য়ে শ’য়ে অস্থায়ী কর্মী কাজের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।”

শুয়োরের মতো টাঙিয়ে রাখা স্বামীটার কথা ভাবে জ়াওয়াদি। বউটার কথা, তার অন্তর্মুখী দৃষ্টির কথা, যেন নিজের আত্মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার চোখ। হরেদরে বিচার করলে, হার্ভেস্টিং ব্যাপারটা এখন ততটাও খারাপ শোনাচ্ছিল না তার কাছে। একেবারেই না।

“সোনা!” জ়াওয়াদি বলে। “এই সবে রাজি হওয়ার জন্য আমাদিউসকে তুমি কত ক্রেডিট দেবে তাহলে?”

***

একটা হোভারবোর্ডেই ভেসে পড়েছিল ওরা দুজনে— হোভারবোর্ডটা মাপেসার। জ়াওয়াদি এমনভাবে মাপেসাকে জড়িয়ে রেখেছিল যেন ওর শরীরটা হাত-পা নয়, অসংখ্য শুঁড় দিয়ে তৈরি। মাপেসার সঙ্গে একটা মানসিক সংযোগ খুঁজছিল ও, কিন্তু তার বদলে কাঠের টুকরো আঁকড়ে রাখার মতো অনুভূতি হচ্ছিল যেন। শুধু সেই কাঠ আর ভ্যানিলার চেনা গন্ধ, আর খেলোয়াড়দের মতো আঁটোসাঁটো গড়ন।

ইস্পাতের ফটক, বৈদ্যুতিক বেড়া, ডবল-সিকিউরিটি দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল ক্লিনিকটা। বিস্ময়করভাবে, সাদা চাদর বিছানো হসপিটালের খাট ছিল ওখানে। জ়াওয়াদিই একমাত্র রোগী, আর ওয়ার্ডে একজনই মাত্র প্রসূতি বিশেষজ্ঞ। সত্যিকারের ডাক্তার, রোবট নয়। অথবা হয়তো মানবশরীরের মোড়কে একটি নিখুঁত সাইবর্গ। পোড়খাওয়া পুরুষ একজন— যার তুষারশুভ্র চুল, অনেক কিছু জানা চোয়াল আর কিচ্ছু না বলা চোখ।

জ়াওয়াদির তেষ্টা পাচ্ছিল। ..মাপেসা ..বোকাটে ..হাসিমুখে ..ঘুরঘুর করছিল— সেই ঝকঝকে মসৃণ হাসিটা নয়। এটা একটু অন্যরকম লাগছিল, হাসলেও চোখে কোনো উজ্জ্বলতা ছিল না তার। অবশ্য ভালো করে দেখলে—নাহ্, বোকাটে হাসিও নয়। এটা কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজা হতে চলা এক ভিখারির চওড়া গ্যালগেলে হাসি আসলে। কাগজপত্র পড়তে পড়তে আর সই করতে করতে সেই বিশ্বাসঘাতক আমাদিউসের কথা ভাবে জ়াওয়াদি, যে নাকি মাদার টেরেসাকে নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয় আর কয়েকটা ক্রেডিটের বিনিময়েই যে তার কর্মচারীকে অনায়াসে যার তার কাছে বেচে দিতে পারে!

আলো-ঝিলমিলে ঘরটায় ডাক্তারের দিকে মুখ তুলে তাকায় জ়াওয়াদি। রুপোলি বৃষ্টি আর প্রাণবন্ত হইচইয়ে ভরা একটা শহরের কথা ভাবে। যেখানে জল তার হাতের মুঠোয়। জ়াওয়াদি পরিষ্কার বোঝে যে, ঠিক সেই মুহূর্তে মাপেসাকে যতই অপছন্দ করুক সে, স্বপ্নটা কিন্তু তারও। সে নিজেও এমন একটা জগতে ঢুকে পড়তে চায় যেখানে নিয়ন-উজ্জ্বল রাস্তারা সালিফ কেইতা১১ আর ইভন চাকা চাকা১২-এর মতো নামগুলোকে ফিরিয়ে আনে।

সে নিজের ক্লিনিকে আসার সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করতে চায়, কিন্তু তার মন তাকে উৎফুল্ল ছবি দেখায় ফান পার্কের, যেখানে সে টিকিট কিনে ঢুকে পড়ছে বিরাট ক্লাউনের মুখের ভেতর, সটান চলে যাচ্ছে আয়না-ধাঁধার ঘরে, কিংবা চড়ে পড়ছে স্পাইডার রাইডে১৩ অথবা বিশাল উঁচু সুপারনোভা রাইডে১৪, যেখান থেকে আকাশে ছিটকে যেতে যেতে তীব্র আনন্দে চিৎকার করে উঠছে সে।

জ়াওয়াদি জানত যে তার উচিত কিছু প্রশ্ন করা, অন্তত এইটুকু জানতে চাওয়া যে ইমপ্ল্যান্ট করা ডিম্বাণুগুলো এল কোথা থেকে, কে নিষিক্ত করল সেগুলোকে আর বেবিগুলোরই বা কী হবে? রাষ্ট্রের প্রচারযন্ত্রেরই অংশ কি সেগুলো, মহান নেতার পাগলামির আরেক নমুনা?

হঠাৎই একটা কথা মনে হয়ে তার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে— জল সংগ্রহের উৎস নয় তো বাচ্চাগুলো? কিন্তু সে জোর করে নিজের মনের দরজা বন্ধ করে দেয়, নীতি আর উচিত-অনুচিতের চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসা প্রচণ্ড আতংককে আটকে রাখে বাইরেই। যে চিরন্তন খরা তার ভেতরটাকে কুরে-কুরে খেতে খেতে সেটাকেই প্রায় স্বাভাবিক ভাবতে শিখিয়েছে তার থেকে চূড়ান্ত মুক্তির স্বাদ কল্পনা করতে থাকে সে। জ়াওয়াদি মেনে নেয় যে জল হরকরা হিসেবে তার প্রতিটা দিনকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া খুবই অপরিণামদর্শিতার নিদর্শন এবং বোঝে যে তাকে বাঁচাবার জন্য সে নিজে ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউই নেই। এই জগত থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজেকে নিজেই একজোড়া ড্রাগনের ডানা দিয়ে যেতে হবে তাকে।

আর কোনোদিনও তার তেষ্টা পাবে না।

তাই, যে প্রশ্নগুলো তার করতে ইচ্ছে করছিল সেগুলো না করে ডাক্তারের চোখে চোখ রাখে সে, কিন্তু সে চোখ কালো ভেলভেট।

“ব্যথা লাগবে, খুব?”

“বোকার মতো কথা বোলো না তো, কিচ্ছু টেরও পাবে না।”

মাপেসা বলে।

“আপনার শরীরের অ্যাক্টিভিটি একদম কমিয়ে রাখার জন্য কোমায় নিয়ে যাব আপনাকে আমরা।” ডাক্তার বলেন।

ভেন্টিলেটরের সঙ্গে জুড়ে দেওযা হয় ওকে, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভেতরটা হালকা লাগে হঠাৎ। এক লহমার জন্য তীব্র আতঙ্ক ছেয়ে ফেলে জ়াওয়াদিকে— নিজের শরীরের ওপর থেকে এর মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল সে। কিন্তু ডাক্তারকে থামতে বলার আগেই গ্যাসের বাষ্প কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিল। শব্দরা ক্রমশ মিলিয়ে আসতে থাকে।

মাপেসার ঠোঁট নড়ছিল। জ়াওয়াদি বুঝতে পারছিল ও বলছে “তোমাকে ভালোবাসি,” বা “আমি আছি,” অথবা “হয়তো তুমি…”

মাপেসা কি ভয় পাচ্ছে, ভাবছে জ়াওয়াদি আর ফিরে আসবে না? এই শেষ চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই মাথাটা ঝপ করে নীচে পড়ে যায় ওর, অন্ধকারের বিকট হিংস্র একটা হাঁ-মুখ ওকে পুরোপুরি গিলে নেয়।

টীকা

১.১) ডুরিয়ান- অনেকটা কাঁঠালের মতো দেখতে এবং তীব্র গন্ধযুক্ত বড়ো গোলাকার ফল।

১.২) শিয়া বাটারের দুধ- আফ্রিকান শিয়া গাছ (Vitellaria paradoxa)-এর ফলের বীজ থেকে তেল বের করে নানারকমের ক্রিম ও ময়শ্চারাইজার তৈরি করা হয়। রুক্ষ হাত পা মোলায়েম করতে সাধারণত শিয়া বাটারের দুধ ও পাম গাছের তেল বিশেষ উপকারী।

২) মিরিয়াম মাকেবা- বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী দক্ষিণ আফ্রিকান গায়িকা, গীতিকার এবং অভিনেত্রী (১৯৩২-২০০৮)

৩) ফেলা কুটি- নাইজিরীয় বাদ্যযন্ত্রী, রাজনৈতিক কর্মী (১৯৩৮-৯৯৭)

৪) কিডিয়ো- এখনও পর্যন্ত পাঁচবার গ্র্যামি পুরস্কার বিজয়িনী পশ্চিম আফ্রিকান গায়িকা, অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী, আঞ্জেলিক কিডিয়ো  (১৯৬০-)

৫) মাসেকেলা- দক্ষিণ আফ্রিকান জ্যাজ়ের জনক, বিখ্যাত ট্রাম্পেটবাদক, গায়ক ও সুরকার হিউ মাসেকেলা (১৯৩৯-২০১৮)

৬) চিটেঙ্গে- দীর্ঘ বস্ত্রখণ্ড, আফ্রিকান মহিলারা কোমরে বা বুকে পেঁচিয়ে পরে থাকেন।

৭) কোয়াশিওর্কোর- একটি প্রোটিনের অভাবঘটিত অপুষ্টি রোগের নাম।

৮) বাটারনাট স্কোয়াশ- অনেকটা পাকা কুমড়ো জাতীয় একটি সবজি।

৯) রোডেশিয়ান রিজব্যাক- দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিখ্যাত হাউন্ড-জাতীয় কুকুরের প্রজাতি।

১০) আজ়াওয়াখ- পশ্চিম আফ্রিকার একটি বিখ্যাত কুকুরের প্রজাতি; এরা উঁচু ও নির্মেদ শরীরের অধিকারী হয়।

১১) সালিফ কেইতা- পশ্চিম আফ্রিকার রিপাবলিক অফ মালি-র রাজপরিবারের সদস্য, গায়ক ও গীতিকার, গোল্ডেন ভয়েস অফ আফ্রিকা নামে পরিচিত (১৯৪৯- )

১২) ইভন চাকা চাকা- দক্ষিণ আফ্রিকান গায়িকা, গীতিকার, অভিনেত্রী, মানবাধিকার কর্মী ও শিক্ষিকা; প্রিন্সেস অফ আফ্রিকা নামে পরিচিতা (১৯৬৫- )

১৩) স্পাইডার রাইড- অ্যামিউজমেন্ট পার্কের গোলাকৃতি উত্তেজনাময় রাইড।

১৪) সুপারনোভা রাইড- অ্যামিউজমেন্ট পার্কের অনেক উঁচুতে নিয়ে যাওযা

উত্তেজনাময় রাইড।

লেখক পরিচিতি:

ইউজেন বেকন পেশায় কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট। সমসাময়িক আফ্রিকান লেখকদের মধ্যে ইউজেন অন্যতম তো বটেই, স্পেকুলেটিভ ঘরানা ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য ধারায় তাঁর অবাধ বিচরণ। নন-ফিকশন প্রতিবেদন ও কবিতা লেখাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত, অভিজ্ঞ সম্পাদিকা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি আছে। এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকলেও ইউজেনের জন্ম তানজানিয়ায়, ফলে ইংরেজি ও সোয়াহিলিতে সমান দক্ষ তিনি। তাঁর লেখা বহু গল্প আন্তর্জাতিক স্তরে পুরস্কৃত হয়েছে। বির্ডপোর্ট প্রাইজ, নোমো অ্যাওয়ার্ডস ফর স্পেকুলেটিভ ফিকশন বাই আফ্রিকান্স, আদারওয়াইজ, অস্ট্রেলিয়ান শ্যাডোজ, ব্রিটিশ সায়েন্স ফিকশন অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএফএ) অ্যাওয়ার্ডস, কপিরাইট এজেন্সি প্রাইজের মতো অসংখ্য পুরস্কারের চূড়ান্ত তালিকায় ইউজেনের লেখা একাধিক গল্প মনোনীত হয়েছে বারবার। ‘দ্য ওয়াটার রানার’ গল্পটি ট্রানজিট লাউঞ্জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ‘Danged Black Thing’ সঙ্কলন থেকে নেওয়া, যা প্রকাশ পেয়েছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে।

অনুবাদক পরিচিতি

অদিতি সরকারের জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীতে। লেখাপড়া ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে, পেশা বাণিজ্যিক অনুবাদ। প্রথম ছোটো গল্প প্রকাশ পেয়েছিল সানন্দা পত্রিকায়, ২০০৯ সালে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সানন্দা, উনিশ কুড়ি, দেশ, ফেমিনা বাংলা ইত্যাদি একাধিক প্রথম সারির পত্রিকায় ও বিভিন্ন ওয়েবজিনে অদিতির গল্প প্রকাশিত হয়ে চলেছে। শুধু বড়োদের জন্যই নয়, ছোটোদের জন্যও অদিতি সরকারের কলম চলে আমপাতা জামপাতা, রংবেরঙ প্রভৃতি মুদ্রিত পত্রিকায় এবং জয়ঢাক, ম্যাজিক ল্যাম্প, একপর্ণিকার মতো জনপ্রিয় ওয়েব ম্যাগাজিনে। প্রথম গল্প সঙ্কলন ‘মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর’, প্রকাশ ২০১৮, কলকাতা বইমেলা। উল্লেখযোগ্য বই ‘সাদা গল্প কালো গল্প’ (একপর্ণিকা প্রকাশনী) ও ‘হাজার টাকার বউ’ (অন্তরীপ পাবলিকেশন)।

সকল অধ্যায়

১. অমরত্বের আড়ালে – ব্লেইজ কায়ে। অনুবাদ : অরিন্দম দেবনাথ
২. জল হরকরা – ইউজেন বেকন। অনুবাদ : অদিতি সরকার
৩. স্বাদ – চিকোদিলি এমেলুমাডু। অনুবাদ : সোহম গুহ
৪. বালিয়াড়ির গান – সুয়ি ডেভিস ওকুংবোয়া। অনুবাদ : মহাশ্বেতা
৫. অন্তিম সঙ্কেত – ইভর ডাব্লিউ. হার্টম্যান। অনুবাদ : দীপ ঘোষ
৬. অক্সিজেন রণাঙ্গন – ওগিনিকোওয়ে ডোনাল্ড একপেকি। অনুবাদ : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
৭. একে একে নিভিছে দেউটি – কোফি ন্যামেয়ে। অনুবাদ : অনুষ্টুপ শেঠ
৮. তৃষ্ণাভূমি – নিক উড। অনুবাদ : রাজর্ষি গুপ্ত
৯. সমবেত সঙ্গীত স্থাপত্যে মিলনসঙ্গমের দিশা – ডেয়ার সেগুন ফালো। অনুবাদ : সুমিত বর্ধন
১০. দি রিগ্রেশন টেস্ট – ওলে তালাবি। অনুবাদ : শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. কোরিয়ালিস – টি এল হুচু। অনুবাদ : পার্থ দে
১২. শরম – নেরিন ডরম্যান। অনুবাদ : শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন