অমরত্বের আড়ালে – ব্লেইজ কায়ে। অনুবাদ : অরিন্দম দেবনাথ

অমরত্বের আড়ালে- ব্লেইজ কায়ে। অনুবাদ— অরিন্দম দেবনাথ

মূল গল্প: Diaspora Electronica

আরও একজন আছে আজকের মেট্রোতে।

লোকটা গেটের পাশের সিটে বসে মনোযোগ দিয়ে কী যেন একটা পড়ছে। নীলচে রেক্সিনে মোড়া বাঁধাই বই বা ডাইরি টাইপের কিছু। ঠিক ধরতে পারছি না জিনিসটা কী! তবে বেশ মোটাসোটা। কম করেও হাজারখানেক পাতা হবে। লোকটা ট্রেনে উঠেই দূর থেকে আমায় দেখে হাত নেড়েছিল। আমিও হাত নেড়েছিলাম। খানিক অস্বাভাবিক ঠেকছে। লোকটার কোনো সমস্যা আছে মনে হয়!

সবে সকাল হয়েছে, ঠান্ডাটাও পড়েছে জব্বর। কাঁপিয়ে দিচ্ছে রীতিমত। বেশ মনে আছে, যখন ছোটো ছিলাম তখন শহরে আসার ট্রেনে ভিড়ের চোটে হাতল ধরতে পারতাম না। বাবা আমাকে নিয়ে আসতেন। আবার কোনো কারণে শরীর খারাপ থাকলে বাবাই স্কুল থেকে ফেরত নিয়ে যেতেন। মাঝে মধ্যে বাবা আমাকে খানিক টাকা আর তাঁর জন্য মা-র প্যাক করে দেয়া দুপুরের স্যান্ডউইচের প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে সিনেমা হলে ছেড়ে
 দিতেন। আমি টাকা দিয়ে চকোলেট কিনতাম। আর কিনতাম সিনেমার টিকিট। কখনও দুটো, কখনও তিনটে। বিশাল চেহারার সিনেমা হলের ম্যানেজার আমাকে ভালো করে চিনে গিয়েছিল। লোকটার সবক’টা দাঁতই ছিল বাদামি। আমার কাছে যখন সিনেমার টিকিট কাটার টাকা থাকত না, তখন ভিড়ের ফাঁক দিয়ে টুক করে হলে ঢুকে পড়তাম। ম্যানেজার এমন ভাব করত যেন আমাকে দেখেইনি। কিন্তু আমি ভালো করেই জানতাম সে আমার টিকিট না কেটে ঢুকে পড়াটা ভালোভাবেই লক্ষ করেছে।
 আমার মনে হয় ওর মনে আমার প্রতি কোনো দুর্বলতা জন্মেছিল, কারণ আমি সবসময় একা একাই সিনেমা দেখতে আসতাম।  আবার নাও হতে পারে। 

বহুবছর সিনেমায় যাইনি। তার মানে এই নয় যে সিনেমা দেখতে আর আমার ভালো লাগে না। আমার কাছে পুরোনো দিনের সিনেমার সব কপি আছে। আমি প্রায় রোজ রাতে একটা না একটা সিনেমা দেখি। কিন্তু সিনেমা হলে সিনেমা দেখার মজাই অন্যরকম। আস্তে আস্তে আলো নিভে গিয়ে সামনে একটা বিশাল পর্দা জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুভূতিই অন্যরকম। হলের ভেতরে বসে বাইরে কী হচ্ছে তা টেরই পাওয়া যায় না। স্কুলে কী পড়ানো হয়েছিল, টিচার কী বলেছিল, বন্ধুরা আমায় দেখে মুখ লুকিয়ে হেসেছিল কিনা কিচ্ছু মনে থাকত না হলের ভেতর। তারপর হল গিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে মনের ভুলে জিনিস ফেলে আসা, এই সব কি আর ঘরে বসে হয়? বাবা আমার মনের কথাটা ভালোই বুঝতেন।

শহরে ঢোকার খানিক আগে থেকেই ট্রেনটা মাটির খোঁদল ছেড়ে ওপরে উঠে আসে। শীতের সূর্যের তাপ বড়ো কম। শহরের বাইরে এখন সবকিছুই ছন্নছাড়া। একটা বুড়ো কুকুরকে দেখতে পাচ্ছি পা দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে। খানিক দূর দিয়ে একটা ট্রেন আওয়াজ তুলে চলে যাচ্ছে কিন্তু ও মুখ তুলেও চাইছে না, মাটি খুঁড়েই চলেছে। এখানকার বাসিন্দারা সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়ার পর, টিনের চাল দেয়া কাঠকুটো দিয়ে তাপ্পি মারা ফাঁকা বস্তিবাড়িগুলো সমুদ্রের ঝোড়ো হাওয়ায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। যে কয়েকটা বাড়ি এখনও পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি, সেগুলোকে ফোকলা দাঁতের মতো লাগছে। খানিক আছে তারপর খানিক ফাঁকা, আবার খানিক আছে আবার ফাঁকা। আমার মতো মুষ্টিমেয় যারা এখনও শহরের বাইরে পড়ে আছি আমার মনে হয় সুযোগ পেলেই তারাও অন্য শহরে চলে যাবে।

বইপড়ুয়া লোকটা খানিক আগেই নেমে গেছে। আমি ভেবেছিলাম লোকটাও বোধহয় আমারই মতো ইনস্টিটিউটে যাবে। কিন্তু লোকটা আচমকা কয়েকটা স্টেশান আগে আমার দিকে হাত নেড়ে দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই ও ট্রেন থেকে নেমে পড়েছিল। আমিও হাত নাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছিল।
 লোকটার গলায় একটা স্কার্ফ জড়ানো ছিল। আমারও একটা স্কার্ফ জড়িয়ে আসা উচিত ছিল। 

মেট্রোর সেন্ট্রাল হাবে পৌঁছনোর কয়েকটা স্টেশান আগেই আমার গন্তব্য চলে আসাতে আমি নেমে পড়েছিলাম। বেশ গরম লাগছে। শহরের এই অংশে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের একটা প্রচেষ্টা চলছে।

১৭২ নাম্বার স্ট্রিটের নির্গমন পথ দিয়ে বাইরে বেরোনার সময় নজরে এসেছিল নীল ওভারঅল পরা এক মহিলা প্ল্যাটফর্ম পরিষ্কার করে

চলেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম মহিলাটি
 বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চাইছে। তারপরেই টের পেয়েছিলাম মহিলাটি নিজের মনেই বিড়বিড় করে চলেছে। একই কথা বলে চলছে বারবার।  আমি জানি এটাই ভবিতব্য। সে যত নিজের সঙ্গে কথা বলবে ততই অন্য ভাবনা থেকে দূরে থাকবে। সব আক্ষেপ ছুঁড়ে ফেলার এটাই উপায়। ওর মতো অনেকেই এইরকম ভুক্তভোগী। আমি যে এখনও ওর মতো হয়ে উঠিনি এটাই আশ্চর্যের। ওই মহিলার মতো হয়ে উঠিনি, কারণ আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। 

ইনস্টিটিউটিউটা এত বড়ো যে আশপাশের বিল্ডিংগুলোকে মনে হয় যেন বামনদের থাকার জায়গা। ঝাঁ চকচকে ইনস্টিটিউটের পাশে অন্য বিল্ডিংগুলোকে খুব নোংরা আর কদর্যও লাগে। ইনস্টিটিউটের আশপাশে অনেককিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। না… ওরা কেউই মানুষ নয়। কতগুলো ড্রোন আর রোবট। হালকা আওয়াজ উঠছে ওদের নড়াচড়ায়। যন্ত্রগুলো আমায় দেখেও কিছু করল না। ওরা জানত আমি আসব। পুরো ইনস্টিটিউটের প্রতিটি কোণই জানত আমি আসব। আমি যদি এখানে অনুমতিহীনভাবে আসতাম বা সঙ্গে কোনো অস্ত্র থাকত তাহলে এতক্ষণে যান্ত্রিক রক্ষীগুলো আমার দফারফা করে দিত।

ইনস্টিটিউটের দরজাটা কুচকুচে কালো। এমনকি দরজার লাগোয়া দেয়ালগুলোও কালো! আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারার প্রতিফলন দেখতে পেলাম। চকচকে কালো দেয়াল আর দরজাটা যেন ঠিক যেন আয়না। দরজার সামনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দরজাটা দু’ভাগ হয়ে নিঃশব্দে দুপাশে সরে গেল। নিস্তব্ধতা জমাট বেঁধে আছে চারপাশে।

যখন প্রথমবার সারার সঙ্গে ইনস্টিটিউটে আসি, তখন এটা একটা জলজ্যান্ত ইনস্টিটিউট ছিল। একটা লবি ছিল, লবিতে ইনফর্মেশান ডেস্ক ছিল, ওয়েটিং রুম ছিল, লম্বা লাইন ছিল। ইউনিফর্ম পরা সত্যিকারের মানুষ অফিশিয়ালরা গলায় আইডেন্টিটি কার্ড ঝুলিয়ে কাগজপত্র সামলাতে সামলাতে সবার কথা শুনত, তারপর যথাস্থানে পাঠিয়ে দিত। এখনকার মতো সবকিছু রোবোটিক ছিল না।

আমি প্রথমবার সারার সঙ্গে নিছক কৌতূহলবশেই এসেছিলাম এখানে। এটা জানতে যে ঠিক কী এমন এই ইনস্টিটিউটে হচ্ছে যা নিয়ে সারা সহ সবাই এত উত্তেজিত!
 

সেই লোক-ভরপুর, কথাবার্তার আওয়াজে গমগম করতে থাকা ইনস্টিটিউটের লবি এখন জনশূন্য। নিস্তব্ধ। লবিতে এখন সার সার লকার আর স্নানঘর। মেঝের একটা আলোর রেখা আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল আমার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা লকারের দিকে। আমি লকারের ভেতর ঢুকে আমার সব পোশাক ছেড়ে ফেলে পাশের কাচে তৈরি স্নানঘরে ঢুকে পড়লাম। কাচঘরের ছাদ ও দেয়াল থেকে ব্লিচিং ও অ্যান্টিসেপটিক মেশানো হালকা গরম জল আমাকে ধুয়ে দিতে লাগল। এক যান্ত্রিক মহিলা কণ্ঠ আমাকে নির্দেশ দিল স্নানঘরের দেয়ালের ডিসপেনসার থেকে জেল নিয়ে আমার সমস্ত শরীর ও চুল ধুয়ে ফেলতে।

খানিক পর আপনাআপনি জল পড়া বন্ধ হয়ে গিয়ে গরম হাওয়া ছড়িয়ে পড়তে লাগল ছোটো স্নানঘরে। মিনিটখানেকের মধ্যেই আমার সমস্ত শরীর শুকনো ও জীবাণুমুক্ত হয়ে উঠল। ইনস্টিটিউটের ভেতর একটা ধুলোর কণারও প্রবেশাধিকার নেই।

লকারে রাখা ড্রেসিং গাউনটা গায়ে গলিয়ে নিলাম। সাদা গাউনটার পেছনদিকটা খোলা। কাগজের অন্তর্বাসটা আর পরলাম না। এখানে বেশ কয়েকবার এসে এই একই নিয়ম মেনে চলবার পর এযাত্রা ওটা আর পরার প্রয়োজন মনে করলাম না।

সারার সঙ্গে আমার পরিচয় গান-বাজনার মাধ্যমে। যে কোনো কারণেই হোক আমার মা ভেবেছিলেন পড়াশুনার বাইরে ক্লাসিক্যাল পিয়ানো শেখাটা আমার মনের খোরাক জোগাবে। গল্প-উপন্যাসের মতো সঙ্গীত শুধু কতগুলো ‘অক্ষর’ নয়। ‘অক্ষর’ জিনিসটা মাথায় ঢোকাতে আমার অসুবিধা হত। সঙ্গীত তার বাইরে অন্য এক জগত।  আর যাই হোক, সঙ্গীত
 শুধু কতগুলো ‘অক্ষর’ অবশ্যই নয়।

কিন্তু পিয়ানো বাজাতে শেখাটাও কোনো সহজ কাজ ছিল না। তা বলে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে আমি পিয়ানো বাজানো শিখিনি। আমি নিজের মতো করে বাজাতাম। ওই কাগজের ‘নোটস’ আমার ভালো লাগত না। তবে স্কুলে মুখস্ত বলার মতো কেউ শুনতে চাইলে ওই কাগজি নোটও দিব্যি বাজিয়ে দিতাম। গড়গড় করে কবিতা আবৃত্তি করে যাওয়া কিম্বা মাথা ঝুঁকিয়ে চেনা সুর বাজিয়ে যাওয়া আর তারপর একগুচ্ছ লোকের হাততালি এসব আমার ভালো লাগত না।

সারাই আমাকে সঙ্গীত জগতে আটকে রেখেছিল। এক আবৃত্তির আসরে ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমি ওই অনুষ্ঠানে এক আবৃত্তিকার ছিলাম। অনুষ্ঠানের ফাঁকে সারা হঠাৎ ওর কানে গোঁজা ইয়ার ফোনের বাঁ দিকের স্পিকারটা খুলে আমার হাতে দিয়ে বলেছিল “এটা শোন।” ওটা ছিল আমেরিকান স্যাক্সোফনিস্ট জন কোলট্রেনের একটা পিস। ও চুপ করে আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমার কাছ থেকে কিছু মন্তব্য শুনবে বলে। আমার কোলট্রেন
 পছন্দ কিনা সেটাও যেন বাজিয়ে নিচ্ছিল। কোনো কোনো মুহূর্ত জীবনটাকে অনেকখানি বদলে দেয়। অনেক কিছু শেখায়। সেটা ছিল ওরকমই এক মুহূর্ত। সারার সঙ্গে একসঙ্গে কোলট্রেন শোনা, একের সঙ্গে অপরের হালকা ছোঁয়া আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে আমি এতদিন কত একা ছিলাম। 

একটা ছমছমে অসুস্থতার অদ্ভুত অনুভূতি থাকলেও এই ইনস্টিটিউট কিন্তু কখনই হাসপাতাল ছিল না। তবে হ্যাঁ, এখানে সাইকোলজিস্ট এবং নিউরোফিজিওলজিস্টরা বরাবরই ছিল। ছিল আরও অনেক গবেষক। এদের অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন, ছিলেন মেশিন লার্নিংয়ে ডবল পিএইচডি করা লোকজন। ছিলেন জীববিদ্যায় পারদর্শী আর  আবস্ট্রাক্ট  ম্যাথামেটিক্সে এমবিএ করা মানুষ। এই ইন্সটিটিউট ছিল অসীম কম্পুউটিং শক্তি ব্যবহার করে মানবজাতির জনবিস্ফোরণ ভবিষ্যৎ-এর নিয়ন্ত্রক। বড়ো বড়ো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল এই ইন্সটিটিউট। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সমাধানটাও এরা কর্পোরেট ধাঁচেই
 খুঁজতে চেয়েছিল, ফলে উন্নততর প্রযুক্তি দিয়ে প্রোগ্রাম করা গাণিতিক মডেল আর হার্ডওয়্যার ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।

সারা চলে যাওয়ার আগে, অধিকাংশ স্নাতকের মতোই সে এই ইন্সটিটিউটে কিছুদিন কাজ করেছিল। সারা এখানকার ইমিগ্রেশন অফিসার হিসেবে কাজ করত। অন্তত ওরা ওদের কাজকে ওইভাবেই ব্যখ্যা করত। আমি জানি না আসলে ওদের আসল পদাধিকার তাই ছিল কিনা। লোকজনের ফর্ম ভরতে সাহায্য করত, আর বলে দিত এরপর চূড়ান্ত ছাড়পত্র পেতে কার কাছে যেতে হবে বা কী করতে হবে। আবেদনকারীদের বুঝিয়ে দিত কীভাবে ইমিগ্রেশন করতে হবে।

আমি শহরে চলে যেতাম, আর ও থাকত ইন্সটিটিউটে। আমি আর্ট ডিসট্রিক্টের ছোটো একটা কফি শপের রোজকার অনুষ্ঠানে পিয়ানো বাজাতাম। ভালোই চলছিল দিনগুলো।

তারপর আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। যেদিন বাবা বললেন  এবার তাঁর যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে আমার সে-দিনটা ভালো করে মনে আছে। মা একদিন আমাকে আর সারাকে একসঙ্গে ওঁদের এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে
 ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি একা শহরে চলে যাওয়ার পর মা-বাবা সেই ছোটো অ্যাপার্টমেন্টে চলে গিয়েছিলেন।

দুপুরে খাবার জন্য মা ক্রিম, চিজ আর আলু দিয়ে পট্যাটো ক্যাসারোল বানিয়েছিলেন। রান্নায় দেয়ার জন্য মা তাজা টম্যাটোও কিনেছিলেন, যা আমরা কয়েক বছর যাবত চোখেও দেখিনি। এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাই আবার অল্প অল্প করে পাওয়া যেতে শুরু করেছে টম্যাটোর মতো বিলাসবহুল সব সামগ্রী।

খাওয়ার পর মা সারাকে ডেকেছিলেন কফি বানানোর জন্য হাত লাগাতে, আর বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ছোটো বসার ঘরে। এটা একসময় ব্যালকনি ছিল। ঘরটা থেকে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছাড়ছিল। মনে হয় অনেকদিন দিন ঘরটা খোলা বা পরিষ্কার করা হয়নি।

“আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই,” বাবা বলেছিলেন। জামার কলারটা খানিক নামাতে একটি এক টাকার কয়েনের মাপের একটা ছিটছিট তিল বেরিয়ে এসেছিল। তিলটা ঠিক গোল ছিল না, ছিল শুকনো চামড়ায় ঢেকে থাকা সাদা
 রঙের একটা মাংসের টুকরোর মতো। 

“স্টেজ ফোর মেলানোমা। অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তাররা ইন্সটিটিউটে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বুঝলে! ডাক্তাররা হাসতে হাসতে বলেছিলেন ওই ইন্সটিটিউট নাকি ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদেরও কাজ কেড়ে নিচ্ছে।”

বাবা-মা আমাকে আগে কিছু জানাননি পাছে আমি ঘাবড়ে যাই। কয়েক সপ্তাহ আগেই ওঁরা সারার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্সটিটিউটে গিয়েছিলেন। বাবার মতে সারা-ই ছিল এই ব্যাপারে যোগাযোগের সঠিক লোক।

“জানো সারা ওই ডিপার্টমেন্টেই আছে?”

আমি সব শুনে ক্ষেপে গিয়েছিলাম। সারা এতটা নির্লিপ্ত হল কী করে? এখন আমরা একই ঘরে থাকি, আর আমার বাবা মারাত্মক অসুস্থ, সব জেনেও কিনা সে ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল! আমাকে জানানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন মনে করেনি! পরে মনে হয়েছিল, হয়তো সারাদিন এরকম অজস্র কেস দেখতে দেখতে ও এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ডাক্তাররা ঠিকই বলেছিল। বাবাকে মরতে হবে না। বিশ্বের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রযুক্তির যে উদ্দেশ্য ছিল তাতে মৃত্যুকে স্বেচ্ছামৃত্যুতে পরিণত করা হয়েছে।

“তোমার মা-ও আমার সঙ্গে অন্য পৃথিবীতে যাচ্ছেন।” বাবার কথা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি। দীর্ঘদিন ধরে ওঁরা একসঙ্গে আছেন। 

বাড়ি ফেরার পথে সারা আমাকে বলল, “চলো, তোমার বাবা-মার সঙ্গে আমরাও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই।”

সারার বাবা মা আগেই সেখানে চলে গিয়েছে, বছরখানেক আগেই শেষ সীমানা পেরিয়ে গিয়েছেন তারা। আমাদের পরিচিতরাও প্রতি সপ্তাহে চলে যাচ্ছে। আমি কারণটা বুঝতে পারছিলাম। ওখানে তারা কখনই বুড়ো হবে না, হবে না অসুস্থ, মৃত্যুহীন হয়ে থাকবে চিরদিনের জন্য। উল্টে প্রতিটা আপগ্রেডে ক্লাউডে যত নতুন সার্ভার যোগ হবে, তোমার চেতনাও তত প্রসারিত হবে, তত গভীর হবে।

“ব্যাপারটা ক্রেডিটে ওয়াশিং মেশিন কেনার থেকেও সহজ।” সারা বলেছিল। আমি বলেছিলাম আমায় একটু ভাবতে দাও। আমি হ্যাঁ না বলা পর্যন্ত ও রোজ আমাকে খুঁচিয়ে যেত।

একটা হাতের তালুর মাপের ছোটো ড্রোন আমার দিকে উড়ে এল। পুঁচকে মেশিনটা থেকে গমগম করে উঠল একটা আওয়াজ, “দয়া করে আমার পেছন পেছন চলুন। কিছু সামাজিক বিষয় দিয়ে কাজ শুরু হবে।”

আমি মাথা নাড়িয়ে যন্ত্রটাকে লক্ষ করে এগিয়ে চললাম। মেশিনটা আমাকে একটা খোলা প্ল্যাটফর্মের দিকে নিয়ে চলল, এটা এখানকার লিফট।

হাঁটতে হাঁটতে আমি টের পাচ্ছিলাম জায়গাটা তিরতির করে কাঁপছে। পুরো বিল্ডিংটা একটা আইসবার্গের মতো। যতটা না ওপরে তার থেকেও ঢের বেশি আছে মাটির নীচে। হাজার হাজার ঘর। হাজার হাজার কম্পিউটারে ঠাসা। থরে থরে যন্ত্রপাতি সাজানো প্রতিটি ঘরের তাকে। বিশাল বিশাল মেশিন। একদম তলায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ভূত্বকের ফাটল থেকে বেরিয়ে আসা ভূ-তাপ থেকে। নীচের অংশগুলো আগ্নেয়গিরির মতো গরম। পুরোটাই চালিত হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আর ‘সুখবতী-মেঘ’-এর ভিতরের সেই জায়গাটি! সেই অন্য জগত! সেখানে নাকি সবসময় টিকটক শব্দ হয়েই চলে!

আমার আর সারার একই দিনে মূল্যায়ন হয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম একটা পার্টি দিয়ে বন্ধু বান্ধবদের বলব আমাদের চলে যাওয়ার কথা। আমি ওর জন্য ইন্সটিটিউটের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম।

“৭ জুন…” আমার নাকের সামনে একটা কাগজ নাড়াতে নাড়াতে ও বলেছিল।

“সত্যি?” বলে আমি আমার হাতে ধরা ডাক্তারের দেয়া নীল স্লিপের টুকরোটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিলাম, “আমি কিছু স্নায়ুসংক্রান্ত জটিলতায় ফেল করেছি।”

“বলো কী?” আমার কাগজটা হাতে নিয়ে সারা বলেছিল, “সামান্য ডিসলেক্সিয়া– পড়ার অসুবিধা!”

আশ্চর্য লাগছিল আমার কথাগুলো শুনে। আমাকে জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে যে জানে সে কীভাবে এমন করে কথা বলতে পারে! ‘সামান্য ডিসলেক্সিয়া!’ সবসময় এই ‘সামান্য’ কথাটা কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে? সামান্য চেষ্টা করলেই যেন আমার মগজ নিউরোকমপ্যাটিবল হয়ে যাবে? কাগজের লেখাগুলো আমি কি সামান্য চেষ্টা করলে পড়তে পারতাম না? পড়তে পারলেই তো স্নায়ু পরীক্ষায় পাশ হয়ে যেতাম। কিন্তু কে বোঝে আর কে বোঝায়? সারা বরাবরই ওরকম, মিষ্টি করে কথা বলতে শেখেনি।

এক সপ্তাহ পরে সারা বলেছিল, “টেকনিশিয়ানরা তোমার বিষয়টা নিয়ে কাজ করছে, আশা করা যায় রোগটা ঠিক হয়ে যাবে।”

ততদিনে এটাও জেনে গিয়েছিলাম যে, সারা ওর যাওয়া বাতিল করেনি।

“আমি আরও মাসখানেক আছি, দেখি তোমায় নিয়ে কতটুকু কী করতে পারি।”

“কিন্তু যদি আরও বেশি সময় নেয়, যদি ঠিক করতে না পারে?”

“ননসেন্স!… এর মানে এই নয় যে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব না,” সারা জানিয়েছিল, “আমরা মেইল করতে পারব, ভয়েস চ্যাট করতে পারব। এমনকি তোমায় সঙ্গও দিতে পারব… অবশ্য ছবি হয়ে! যারা এই ইন্টারফেসগুলো নিয়ে কাজ করে তারাই বলেছে, যদি ..কোনো

কারণে তোমার সঙ্গীকে পরে যেতে হয় সেক্ষেত্রে এই সবকিছুই সম্ভব।” 

না যাওয়ার জন্য আমি ওকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। উত্তর পেয়েছি, “তা হয় না, আমি ইতিমধ্যে ইনস্টিটিউটের কাগজে সইসাবুদ সেরে ফেলেছি। তোমার কোনো ধারণা আছে এটা বন্ধ করতে গেলে কত হ্যাপা সামলাতে হবে? একবার কন্ট্রাক্ট বাতিল করে দিলে আর যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে…”

আর কথা বাড়াইনি আমি। পুরো ব্যাপারটা সম্পত্তি হস্তান্তরের মতো হয়ে গেছে। একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে আর ফিরে পাবার সম্ভাবনা কম।

জুন মাসের প্রথমদিন। সারার চলে যাবার আগের শেষ পার্টিটা হয়েছিল আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেই। বন্ধুবান্ধবদের সবাইকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু লোকজন খুব একটা হয়নি। কারণ ইনস্টিটিউটের কৃপায় অধিকাংশই তো চলে গেছে পৃথিবী থেকে। আমার পরিচিত কয়েকজন এসেছিল কফিশপ থেকে আর সারার কয়েকজন সহকর্মী এসেছিল ইনস্টিটিউট থেকে। আমি পার্টি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম। একটা মোটা জ্যাকেট পরে কম্বলমুড়ি দিয়ে বেডরুমের ভিতর বসে জোরে জোরে গান চালিয়ে শুনছিলাম, যাতে অন্য কোনো কথা কানে না আসে।

ঠিক এক সপ্তাহ পরে আমি সারাকে ইনস্টিটিউটে ছেড়ে এসেছিলাম। ব্যাপারটা অনেকটা এয়ারপোর্টে ছাড়ার মতো দাঁড়িয়েছিল। শুধু সঙ্গে কোনো ব্যাগপত্র ছিল না। আমি সারাকে খানিক আঁকড়ে ধরেছিলাম, তারপর ও চলে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্যও ওর চোখ ছলছল করেনি।

আমি কারো চলে যাওয়া কখনো দেখিনি। অবশ্য দেখতে দেবেও না। যদিও সারা আমাকে যাওয়ার পদ্ধতিটা একবার বলেছিল। যে যাবে, তাদেরকে নিয়ে প্রথমে একটা বাক্সে শুইয়ে দেয়া হয়। তারপর সমস্ত শরীর জড়িয়ে দেয় হাজাররকম তার আর যন্ত্রপাতি দিয়ে। যন্ত্রপাতিগুলো নেটওয়ার্কের কোথাও থাকা একটা খালি মডেলের সঙ্গে কানেক্ট করে, তারপর শরীরের
 একটা মিরর ইমেজ তৈরি করে ক্লাউডে থাকা ওই মডেলে। বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে প্রসেস করতে। তারপর আপনি ভাবতে শুরু করবেন, আর ওই প্রতিচ্ছবিটাও আপনার চিন্তাভাবনাগুলো ওর মধ্যে চালান করে নেবে। ব্যস! আপনার প্রতিচ্ছবিটাই হয়ে উঠবে আপনি। 

আপনি অবশ্য বলতে পারবেন না, আপনার প্রতিচ্ছবি কী করছে। কারণ আপনার মন নেটওয়ার্কে চালান হয়ে যাওয়ার পর আপনার শরীর ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসবে। প্রথমে অসাড় হয়ে যাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো,
 তারপর আপনার চোখের নড়াচড়া বন্ধ যাবে। ব্রেন কাজ করা বন্ধ করে দেবে। কারণ প্রসেস করার পর আপনার সব শারীরিক ক্ষমতা ওই প্রতিচ্ছবিতে চলে গেছে। ইয়ে, সারা অবশ্য বলতে পারেনি, পার্থিব শরীরটাকে নিয়ে কী করা হয়! তবে সেটা জানা কী এমন  জরুরি! 

জীবনটা ওখানে নাকি অন্যরকম। ওখানে গিয়েই ওরা প্রথমে একটা মেল পাঠায়। ‘সুখবতী’ জায়গাটা কী-রকম তা ব্যাখ্যা করে। বলে কী করে প্রথমে ওরা পদ্মফুলের কুঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ওখানে!
 তবে ওখানে সবকিছুই নাকি প্রতিচ্ছবি! শুধু আলোক প্রতিবিম্ব চারপাশে। ওখানে যাবার পর তারা নাকি সবাই দারুণ চটপটে হয়ে উঠেছে!  দ্রুত পড়তে পারে, ভাবতে পারে এমনকি তর্ক করতেও চৌকশ হয়ে গেছে। নতুন ধরনের সঙ্গীত আর শিল্পসৃজনে ওরা সিদ্ধহস্ত।

বাবা আমাকে একটা সিম্ফনি কম্পোজ করে পাঠিয়েছিলেন। দেখে মনে হয়েছিল নোটেশানের বকলমে একটা অঙ্ক। ওই সিম্ফনিটা আমি বাজিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে সেটা কতগুলো কর্কশ শব্দ ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। বাবা লিখেছিলেন, এটা আমার ভালো নাও লাগতে পারে, কিন্তু ওদের ওখানে এটাকে অনেকেই এটাকে মাস্টারপিস বলেছে। যিনি এই মাস্টারপিস কম্পোজ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন, সেই আমার বাবা রক্তমাংসের শরীর থাকতে সঙ্গীতের ধারকাছ দিয়ে যাননি। আর এখন ছায়াশরীরে নতুন জীবন পেয়ে সঙ্গীতের বোদ্ধা হয়ে উঠেছেন! অবশ্য কয়েকদিন পর থেকে মেসেজ আসাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো ওখানকার জীবন নিয়ে বড়ো বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আমার কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কারণটা খানিক আমি বুঝতেও পেরেছি। আমি এখনও শরীরী মানুষ, আর তারা… তারা তার চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে অথবা স্বপ্নের ধোঁয়াশায় কিম্বা মিথ্যের আবছায়ায়…

আমার পরীক্ষার পদ্ধতি আগেই নির্ধারিত ছিল, ড্রোন আমাকে পথ দেখিয়ে দুটো চেয়ার রাখা একখানা ঘরে নিয়ে এলো। 

“ডাক্তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে।” বলে ড্রোন উড়ে চলে গেল।

“এখান থেকে বাইরেটা দেখতে দারুণ লাগে, তাই না?” টাকমাথা বছর চল্লিশের ডাক্তারটি ঘরে ঢুকেই বলে উঠলেন।

“ঠিক বলেছেন, দারুণ দৃশ্য!”

“এই জায়গাটা মাটি থেকে আধ কিলোমিটার ওপরে, কেমন অবিশ্বাস্য লাগে তাই না?” জানালার পাশের চেয়ারটার দিকে দেখিয়ে আমায় তিনি বসতে ইশারা করলেন। আমি গিয়ে বসলাম। চেয়ারটা ভীষণ আরামদায়ক।

“আজ ইনস্টিটিউটে আপনিই আমার দেখা একমাত্র মানুষ।” আমি বললাম।

“হুমম, ঠিকই বলেছেন। আসলে গত কয়েকবছর ধরে লোক কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। যারা এখানকার কর্মী ছিল তারা প্রায় সবাই মেঘের দেশে চলে গেছে।” ঠোঁট-এর কোনায় খানিক হতাশার হাসি ঝুলিয়ে বললেন ডাক্তার।

“শুধু আমিই এখন বোধহয় মাঝেমাঝে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য আসি, তাই না?”

“অ্যাঁ! কী বলছেন?”

“না না কিছু না, হঠাৎ মনে এল বলে ফেললাম।”

নিজের চেয়ারটায় নড়চড়ে বসে ডাক্তার বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে।”

আমি জানি এরপর ডাক্তার কী বলবে। “সরি! এবারও আপনি পাশ করতে পারেননি। আপনাকে এখনই পাঠানো যাবে না।”

“এবারেও না?”

“আপনি সব বিষয়েই পাশ করে গেছেন। শুধু এই…”

“আমি বেড়া টপকাতে পারিনি তাইতো? আমি জানতাম তাই হবে।”

“ঠিক তাই, তাই এক্ষুনি আমরা আপনাকে পাঠানোর ঝুঁকিটা নিতে পারব না।”

আমি মুহূর্তের জন্য মেঝের দিকে তাকাই, ডাক্তারের জুতোটা নজরে আসে। এক জোড়া পুরনো বাদামি অক্সফোর্ড, পায়ের সামনের দিকটা ঘষা খেতে খেতে প্রায় সাদা হয়ে গেছে।

“ঠিক আছে,” আমি বলি, “আমি নিজেই ঝুঁকি নিচ্ছি বলে কোথাও সই করলেও হবে না?”

“আমিও একবার ওরকম ভেবেছিলাম… কিন্তু হবে না বুঝলেন, আইনি সমস্যা আছে, আই অ্যাম সরি, আচ্ছা চলি।” আমার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন ডাক্তারবাবু। আমি ঘরে একাকী বসে দেখছি বাইরে আকাশ রাঙা করে সূর্যের বিদায় নেবার প্রস্তুতি। এতক্ষণে টের পেলাম প্রায় সারাটা দিন ইনস্টিটিউটে কাটিয়েছি।

ডাক্তারের ব্যপারটা বুঝতে পারছি না! সবাই চলে গেছে আর উনি কেন এখনও একা পড়ে আছেন এখানে? চুক্তিতে কি কিছু লেখা ছিল? নাকি আরও কোনো গল্প আছে পেছনে? উনিও আমারই মতো স্নায়ুর রোগে ভুগছেন না তো? কয়েকজন বলেছেন তাঁদের আবেদনও নাকি নামঞ্জুর হয়েছে। কেউ তোতলা– আপাসিয়া, কারো বা আমার মতো অক্ষর পড়তে অসুবিধা হয়- ডিসলেক্সিয়া। ইনস্টিটিউট যে কারণেই হোক কয়েকজনকে বাতিল করেছে, কিন্তু তাদের মতো কোনো সমস্যা তো ওই ডাক্তারের নেই! তাহলে? জিজ্ঞেস করাটা কি ঠিক হত? এর পরের বার করব না হয়! আমি শুনেছি কিছু দার্শনিক লোক এর বিরোধিতা করেছে।

নেটওয়ার্কের উল্টোদিকে যা হচ্ছে বলছে সে রকম কিছুই নাকি হয় না। পুরোটাই বুজরুকি। মানুষ মারার ফাঁদ! কিছু অপরাধীকেও এই সিস্টেমে যেতে দেয়া হয়নি। আমার মতো সামান্য কিছু লোকও এখনও রয়ে গেছে এই ঠান্ডায়, যারা এখনও ট্রেনে চড়ে, এখনও সূর্যাস্ত দেখে– হ্যাঁ! তারা অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা!

একটা প্ল্যাটফর্মে চেপে লবিতে নেমে এলাম। এখানকার দেয়া গাউনটা ছেড়ে ড্রয়ার থেকে আমার পোশাকটা বের করে পরে নিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
 বাইরেটা ভীষণ ঠান্ডা। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে চেপে বাড়িতে ফিরে একা থাকতে মন চাইছে না। শহরে থেকে গেলেই তো হয়! সামনেই একটা ইনফরমেশান কিওস্ক, দেখি কাছাকাছি থাকার কোথায় জায়গা পাই। প্রায় সবাই এই ধরা ছেড়ে চলে গেছে নেটওয়ার্কের মাঝে। ইনস্টিটিউট বেশ কিছু থাকার আর খাবার জায়গা তৈরি করে রেখেছে আমার মতো বাতিল হয়ে থাকা লোকেদের জন্য। এখানে থাকতে খেতে কোন টাকা লাগে না। আছিই বা ক’জন? 

দুটো ব্লক পরে হোটেলটা। শীত থেকে বাঁচতে দ্রুত পা চালাই। আগেও থেকেছি এখানে। একটা পুরোনো হোটেল। পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় করে রাখা হয়েছে হোটেলটা। কোনো মানুষ কর্মচারী নেই এখানে। জনহীন ফুটপাতে আমার পায়ের দ্রুত চলার শব্দ নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। ক’জনের পায়ের শব্দই বা আর শোনা যায়? বলা ভালো কয়জনেই বা বেঁচে আছি।

সারা চলে গেছে… আমি প্রতি মাসেই ইনস্টিটিউটে আসব যতক্ষণ না শুনতে পাই “অভিনন্দন, আপনি নির্বাচিত। সুখবতী আপনাকে স্বাগত জানায়।”

তারপর কী হবে, আমি আর ভাবতে চাই না।

আশ্রয়ে পৌঁছে গেছি প্রায়। হলুদ আলো কাচের দরজা দিয়ে রাস্তায় পড়েছে। ভাবতে ভালো লাগছে যদি গিয়ে কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই! কানে এসে লাগে তাদের কথা! তাদের গান…

লেখক পরিচিতি

ব্লেইজ কায়ে একজন দক্ষিণ আফ্রিকান দার্শনিক, প্রোগ্রামার এবং লেখক। তাঁর লেখা গল্প কেপটাউন জার্নাল, টাইপ, কাস্ট, ওমেনানা সহ নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখা গল্প ‘Ndakusuwa’ ‘নোমো’ অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিল। ব্লেইজ খুব সাবলীল ভাবে কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মাঝে সম্পর্ক ও পরিবারের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে দক্ষ। তাঁর লেখায় একটা অদ্ভুত কাব্যময়তা লক্ষ করা যায়। এই সহজ, হিউমানিস্ট স্টাইল নিয়ে ক্রমে ওঁর নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে চলেছেন এই অসামান্য লেখক। ‘Diaspora Electronica’ গল্পটিও এর ব্যতিক্রম নয়। গল্পটি ‘Migration’ সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে এবং এটি এসএসডিএ (দ্যা শর্ট স্টোরি ডে আফ্রিকা) পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও পেয়েছিল।

অনুবাদক পরিচিতি

অরিন্দম দেবনাথ প্রায় তিন দশক ধরে লেখালিখি করছেন। দীর্ঘদিন কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরত ছিলেন, বর্তমানে একটি প্রকাশন সংস্থার অন্যতম কার্যনির্বাহী। তাঁর লেখা গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ বিষয়ক লেখা নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি তিনি অনুবাদও করে চলেছেন সক্রিয়ভাবে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বিচিত্র দুনিয়া (প্রথম খন্ড), বিচিত্র দুনিয়া (দ্বিতীয় খন্ড) ও প্ল্যাটফর্ম নম্বর ৬।

অধ্যায় ১ / ১২

সকল অধ্যায়

১. অমরত্বের আড়ালে – ব্লেইজ কায়ে। অনুবাদ : অরিন্দম দেবনাথ
২. জল হরকরা – ইউজেন বেকন। অনুবাদ : অদিতি সরকার
৩. স্বাদ – চিকোদিলি এমেলুমাডু। অনুবাদ : সোহম গুহ
৪. বালিয়াড়ির গান – সুয়ি ডেভিস ওকুংবোয়া। অনুবাদ : মহাশ্বেতা
৫. অন্তিম সঙ্কেত – ইভর ডাব্লিউ. হার্টম্যান। অনুবাদ : দীপ ঘোষ
৬. অক্সিজেন রণাঙ্গন – ওগিনিকোওয়ে ডোনাল্ড একপেকি। অনুবাদ : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
৭. একে একে নিভিছে দেউটি – কোফি ন্যামেয়ে। অনুবাদ : অনুষ্টুপ শেঠ
৮. তৃষ্ণাভূমি – নিক উড। অনুবাদ : রাজর্ষি গুপ্ত
৯. সমবেত সঙ্গীত স্থাপত্যে মিলনসঙ্গমের দিশা – ডেয়ার সেগুন ফালো। অনুবাদ : সুমিত বর্ধন
১০. দি রিগ্রেশন টেস্ট – ওলে তালাবি। অনুবাদ : শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. কোরিয়ালিস – টি এল হুচু। অনুবাদ : পার্থ দে
১২. শরম – নেরিন ডরম্যান। অনুবাদ : শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন