মূল গল্প: Convergence in Chorus Architecture
এক
১
আঘাত
যুদ্ধের অসি আর আগুন থেকে পালানোর ফলশ্রুতি, ওসুপার জন্ম। ইলে-ইফে১ শহরের যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা বিভিন্ন উপজাতির জনা ষাটেক সদস্য মিলেমিশে ওসুপা। তাদের টিকে থাকার, শ্রীবৃদ্ধির জমি ওসুপা। শুকনো কলাপাতার পুরু পরতে পরতে ছাওয়া, রোদে পোড়া কঠিন মাটির চোদ্দটা গোল কুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিখুঁত সমকোণ চতুর্ভূজ ওসুপা।
ওসুপার কেন্দ্রে দেবস্থান। মাটির তৈরি একটা বড়ো বাক্স, মাথায় তার খোড়ো ছাউনি, ভেতরে ভর রাখা আছে ছোটো ছোটো বহু গাছের গুঁড়ির ওপর। এখানে বাস করেন তিন আয়ো মেটা২- ফাটোনা, ফাগবেজা আর আওজোবি। চৌকো কুঁড়ের মাটির দেয়াল খড়িতে আঁকা ছবিতে ঢাকা। চাঁদ আর তিন ওরিশা- এসু, ওরানমিলা আর ওবাতালা৩। প্রত্যেকের হাতে ধরা ইফার দ্রষ্টা যন্ত্রে তাঁদের ভূমিকা বোঝানো বস্তুটি। দৈবাদেশ-স্থানটি দেখানো নেই, কারণ দেবস্থানে প্রবেশ করলেই মিলবে তার দর্শন।
গাছ আর কাঁটাভরা ঝোপের দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে থাকা ওসুপার মসৃণ কঠিন জমির সন্ধান পেয়েছিল তারা। সে দেয়ালের মধ্যে শিশুরা কেঁদে ওঠে পূর্ণিমার চোখধাঁধানো আলোয়, তাদের পেছনে তখন আকাশ চুম্বন করে বোমা আর আগুন।
ওসুপাতে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে ইফা৪। আও মেটাদের গলা দিয়ে কাশির মতো শব্দে কথা বলেছিল, তাদের চোখ দিয়ে দেখেছিল, সে ইফা স্বয়ং। রাত পেরিয়ে, জঙ্গলের দাঁতের মধ্যে দিয়ে, তাদের হাঁক, তাদের সাদা পোশাকের দোল, তাদের খোঁচা লাঠিকে অনুসরণ করে সবাই অবশেষে এসে পৌঁছয় সেই সমতল জমিতে। যেন তাদেরই জন্যে তৈরি করে রাখা, যেন তাদেরই অপেক্ষায় থাকা। সে খালি জায়গাটার ঠিক মাঝখানে আও মেটারা মাটিতে পুঁতে দেয় তাদের লাঠি, আর তাকে নাম দেয় ওসুপা, মানে চাঁদ।
উৎসর্গ হিসেবে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ইফার দেবস্থানের জন্যে চৌকো করে মাটি খোঁড়ে ওসুপার লোকেরা। তবে জেগে থাকে আয়ো মেটারা। অধিকারে নেওয়া জমিকে মন্ত্রপূত করে তার চারপাশ ঘিরে সাজিয়ে দেয় আলোর বৃত্তের রক্ষাকবচ ‘আবো’। এতে দাস আর টাটকা শিকারের খোঁজে ইফে থেকে বেরিয়ে ঘুরে বেড়ানো দানব, ভাড়াটে সেনা আর রক্তে মাতাল সিপাহীদের কাছে অগোচর হয়ে পড়ে তারা। পুরুষরা সংখ্যায় মেয়েদের অর্ধেক। তাদের আয়ো মেটারা দেখিয়ে দেয় জমির বিস্তার, কোথায় থাকবে ক্ষেত, কোথায় উঠবে রসুইয়ের চালাঘর। ঘর তোলা আরম্ভ করতে গাছের ডাল কাটা আর খড় জোটানোর কাজে লেগে পড়ে পুরুষেরা। আলোর বৃত্তের বাইরে একটা হ্রদ, কাদা তাতে প্রচুর। যেসব লাউকুমড়োর খোলে এককালে থাকতো তাদের পোশাক-আশাক আর নিজস্ব জিনিসপত্র, তাতে করেই মেয়েরা কাদা বয়ে নিয়ে আসে হ্রদ থেকে।
ঘর তুলতে তুলতে সবাই ভুলে থাকে মরে যাওয়া মানুষগুলোর কথা। কিন্তু তাদের ঘর আর দেবস্থান তোলা হয়ে যেতেই ওসুপা জুড়ে উঁচু আওয়াজে কাঁদতে থাকে স্বামী হারা স্ত্রীরা, স্ত্রী হারা স্বামীরা, শিশু হারা মায়েরা আর সরলতা হারানো শিশুরা।
প্রতি সাতদিনে আয়ো মেটারা দেবস্থানে জমায়েত ডাকতে শুরু করে। ওসুপার মানুষদের শেখায় চলে যাওয়া মানুষদের বিদায় দেবার গান, ভালো হয়ে ওঠার গান আর চাঁদের জন্যে গান। সে গান যখন গায় সবাই, তাদের হৃদয়ের বিশাল শব্দ উঠে আসে তাদের মুখ দিয়ে, পাড়ি দেয় রাতের কালোর মধ্যে দিয়ে, যেন স্পর্শ করে মাথার ওপরের তারা জ্বলা আকাশপটকে।
তিনটে পূর্ণিমা পেরিয়ে আপন ছন্দ খুঁজে পায় ওসুপা। স্বামীহারারা খুঁজে পায় নতুন স্বামী আর সহোদরা, স্ত্রীহারারা খুঁজে পায় নতুন স্ত্রী আর সহোদর। শিশুদের যারা ভালোবেসে ফেলে, তারাই দত্তক নেয় তাদের। মেলে বুনো ইঁদুর আর রাঙালু আর লঙ্কা আর নুন। ওসুপা বসতির সবাই মিলে আগুন ঘিরে খাওয়াদাওয়া, নাচগান করে, টিকে থাকার জন্যে জয়জয়কার করে ওলোডুমারে৫ আর ইফার- এ দৃশ্য দেখা যায় নিত্যই। এভাবেই দৃঢ়ভাবে বজায় থাকে আবো। প্রেমিকার উষ্ণ স্পর্শের নীচে মিলিয়ে যেতে থাকা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় যুদ্ধকে। সবই কাটে ভালোভাবে, শান্তিতে থাকে মানুষ। তাদের ঘর আর দেবস্থান নিয়ে খুশিতে থাকে দ্রষ্টা আর তিন বাবালায়ো৬।
যতদিন না ফাগবেজার চালা কড়ি ঝলসে ওঠে গাঢ় বেগুনি রঙে, দেবস্থান ভরিয়ে দেয় কালো ধোঁয়ায়।
যতদিন না ঝড়টা আসে।
***
আসন্ন ঝড়ের কথা ওসুপার মানুষদের বলে না আয়ো মেটারা। তার বদলে তারা বলে, ওলোডুমারে দেখতে আসছেন। সবাইকে সাদা কাপড় পরায় তারা, মাথায় আর চৌকাঠে লেপায় বুনো হাঁসের রক্ত। আর তারপর সবাইকে দিয়ে গান গাওয়ায় ওলোডুমারের উদ্দেশ্যে, যিনি সব কিছুর নির্ঝর, সমস্ত কিছুর শিশুশয্যা।
আয়ো মেটারা আংশিক বিশ্বাস করে তাদের নিজেদের মিথ্যাকেই। অনুমান করে তাদের জমিকে বৃষ্টিতে, প্লাবনে ধুয়ে সাফ করতে দিতে ঝড় নিয়ে আসছে কোনো ছোটো ওরিশা৭। সে রাতে কালো হয়ে পশ্চিমে ওঠে বিশাল ফোলাফোলা মেঘ। তাদের থেকে চুঁইয়ে পড়া গাঢ় বেগুনি বিদ্যুৎ আর ঠান্ডা বাতাসে কাতর আর্তনাদ করে ওঠে অরণ্য। বৃষ্টি শুরু হতে নিজেদের কুঁড়েয় কুণ্ডলী পাকিয়ে ওলোডুমারের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে ওসুপার মানুষ।
***
ভোরের আলো ফুটতেই ঠান্ডা হয়ে আসে ঝড়। ভিজে ভারী হয়ে আছে সব। জল হাঁটু অবধি উঠে এসে ঢুকে পড়েছে, ঘরে, ভাসিয়ে তুলেছে খাবারের ঝুড়ি আর পোশাক-আশাক, ডুবিয়ে দিয়েছে রসুই চালাঘরের চাল। ঝড়ে উপড়ে গেছে কিছু ঘর, চুরমার হয়ে পড়ে আছে বাকি ঘরগুলোর দাঁড়িয়ে থাকা সারি থেকে খানিক তফাতে।
জলের মধ্যে তাদের জিনিসপত্র হাতড়াতে আরম্ভ করে ওসুপার মানুষ। দেবস্থান দাঁড়িয়ে থাকে অবিচলিত ভাবে। বাবালায়োদের মধ্যে সবচাইতে বড়ো আয়োজোবী। দীর্ঘদেহী, ঘাড় অবধি বিনুনী করা লম্বা চুল, চোখে মাখানো প্রাণীবিষ আর সুরমা। সব অল্পবয়স্কদের একসঙ্গে ডাকে সে, ভার দেয় খামারের ক্ষয়ক্ষতি দেখে আসতে। বয়স্করা হাত লাগায় ভাঙা ঘর সারাই করতে। পুরনো আবো নষ্ট হয়ে গেছে ঝড়ে, আয়ো মেটারা তৈরি হয় নতুন আর একটা গড়তে।
ঝড় নিয়ে আসা মেঘগুলো ভারী হয়ে থাকে আকাশে, ছায়াচ্ছন্ন করে রাখে ওসুপাকে।
***
ওসুপাতে অল্পবয়স্ক বলতে জনাকুড়ি ছেলেমেয়ে। বেশির ভাগই নতুন বাপ-মা খুঁজে পাওয়া অনাথ। এইসব অল্পবয়স্কদের মধ্যে সব চাইতে চুপচাপ আকানাবি নামে এক তরুণ। যেখানেই যাক, মাথায় তার সর্বদা চাপানো থাকে তার বাবার দেয়া একটা সোনালি সবুজ আবেটি আজা৮। সেটা এমন এক বিরল, ভারী সুতোয় বোনা যে শক্ত হয়ে খাড়া থাকে।
অল্পবয়স্কদের দলটাকে ওসুপার কিনারায় খেতের দিকে নিয়ে যায়ে আকানাবি। ঠিক তার পেছনে হাঁটে দুই যমজ বোলাহান আর বেমিসোলা ওলোহান, গলার স্বর তাদের স্বর্গের ভেরির মতো। বাকি অল্পবয়স্করা ঝুড়ি নিড়ানি নিয়ে হাঁটে কিছুটা পেছনে। একই ক্ষয়ক্ষতি যাদের বেঁধেছে আত্মীয়তার বাঁধনে তারা ছাড়া কেউ কথা বলে না পরস্পরের সঙ্গে। ভালো ফসল হলে রাতের প্রার্থনার সময় ছাড়া কাছাকাছি আসে না এরা।
খেতের কিনারায় থামে আকানাবি। ঢালের কাছে খেতের জমি ডুবে গেছে হ্রদের পাড় ছাপানো জলে। নিস্তরঙ্গ জলের ওপর মাথা উঁচিয়ে থাকে কেবল পাকা ভুট্টার ডগাগুলো, জট পাকানো আলোর তালের মতো।
“যুদ্ধ থেকে নিয়তিকে এড়িয়ে আমাদের পালানোর জন্যে ওলোডুমারে রেগে গেছেন আমাদের ওপর,” বোলাহান ওলোহান ততটাই বিষাদগ্রস্ত, যতটা একমাত্র এত সুন্দর চেহারার কেউ হতে পারে।
“আমাদের কপাল ভালো কেউ মারা যায়নি,” তার যমজ বোন বলে, “আমার মনে হয় আয়োরা আমাদের যা বলেছিল তাতে উপকার হয়েছে। হাঁসের রক্তটা… আমরা নিরাপদ। আমাদের অতীতের পিতামাতাদের কৃপায়।” দলের বাকিরা এসে পড়ে সজোরে শ্বাস টানে সামনের দৃশ্য দেখে। কেউ কেউ বিড়বিড় করে অভিসম্পাত করে অরিশাটাকে আর ওলোডুমারেকে।
“আমায় ঝুড়ি এনে দাও,” আকানাবি বলে, “আর যারা সাঁতার জানো, আমার পেছনে পেছনে এসো।”
এতো ছোটোখাট আর লাজুক চোখের কোনো মানুষের পক্ষে তার গলা আশ্চর্য রকমের গভীর। অদ্ভূত রকমের বিনয়ী আকানাবে। দারুণ সব গল্প বলতে পারে ওরিশা আর এলেমিদের৯ নিয়ে, ওলোডুমারের স্পর্শ পাওয়া মানুষদের নিয়ে। উদ্ভট ভয়ানক সব গল্পের মাঝে মধ্যে জুড়ে দেয় মুচকি হাসি আর চোখের ঝিকমিক। হলফ করে বলে, সেই ওরানমিলার সময় থেকে বংশানুক্রমিক রক্তপ্রবাহে পুনর্জন্মের ধারা আছে এমন একটা পরিবার থেকে এসেছে বলে, সে এত কিছু জানে।
ঝুড়ি নিয়ে খেতে নেমে যায় আকানাবি। জলে ডুব দেয় শব্দহীনভাবে জল ছিটিয়ে। জলের ওপরে ঝুড়ি তার পেছনে ভাসে আচার-অনুষ্ঠানের নৌকোর মতো। তার পিছু নেয় তিনজন আরো সাঁতারু। বেমিসোলা সাঁতার কাটতে পারে, বোলাহান পারে না। তার মনের গোপনে চিন্তা, সে হয়তো মারা যাবে জলে ডুবে। বাকিদের সঙ্গে খেতের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার পাশে দুটো মেয়ে ঝড়ের ক্রোধ আর ওরিশার ক্ষমতা নিয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলে।
হাল্কা বৃষ্টির ঝিরিঝিরি গুঁড়ো পড়া শুরু হয়। এক সারি ভুট্টাগাছের মাঝখানে জলের নিচ থেকে মাথা তোলে সাঁতারুরা।
ঝোড়ো মেঘ ভাসে, ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সরে, কলেবরে বড়ো হয়, তার মাঝে কেবল বিদ্যুৎ, বাজের আওয়াজ নেই।
***
ভুট্টার ভিজে শিষে আর বড়ো বড়ো লঙ্কায় ভরে ওঠে ঝুড়িগুলো। ডুবে যাওয়া খেতে সাঁতারুরা ভাসে শ্লথ ভাবে, শ্বাস নিতে উঠে আসে জল আর দুলতে থাকা সবুজ ডাঁটির পাতালে ফের ডুব দেয়ার আগে।
ওপরে, আকাশের যে অংশ মেঘে ঢাকেনি, সেদিকে সকালের আলো ঘোলাটে। জলের নীচে আলো নেই বললেই হয়। তবুও নরম ফসল দেখতে পাওয়া আর তোলার পক্ষে যথেষ্ট পরিষ্কার।
সকালটাকে আরো ঠেসে ধরে ঝোড়ো মেঘ, গড়গড় করে নতুন বাজের শব্দে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি আরো জোরে নামবে আন্দাজ করে ফিরে আসার জন্যে সাঁতারুদের ডাকতে থাকে পাড়ে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েরা। ম্লান হয়ে আসে আলো, বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসের আগের রাতের মতো। তিনটে বোঝাই ঝুড়ি নিয়ে চার সাঁতারু পাড়ের দিকে আসতে আরম্ভ করে। পা ছোঁড়ে তারা, এক হাতে ধরে থাকে ঝুড়ি, অন্য হাত চালায় বৈঠার মতো। বিক্ষুব্ধভাবে ঘুরপাক খেতে থাকে ঝড়টা, শুরু না হয়েও খেয়ে ফেলে বাকি সকালটাকে।
চমকে ওঠে বিদ্যুৎ, এক মুহূর্তের জন্যে মনে হয় সবকিছু যেন সাদা পাথরে গড়া। ফিরতি বাজের শব্দে কেঁপে ওঠে ধরণী, অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা নীচু করে ফেলে সবাই। বোলাহান ওলোহান তার বোনকে ডাক দেয় তাড়াতাড়ি করার জন্য। জল থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে হলে তাদের তখনও জলের নীচের পিচ্ছিল ঢালটা দিয়ে হেঁটে এসে ঝুড়ি নামাতে হবে।
দুজন সাঁতারু, যুদ্ধের আগে ওসান নদীর কাছে বাস করা লম্বা চেহারার দুই ভাই, বেরিয়ে আসে সবার আগে। আকানাবি আর বেমিসোলা জলে অপেক্ষা করে ঝুড়িগুলোকে ডুবে যাওয়া থেকে আটকাতে। হাল্কা বৃষ্টির টুপটাপ থামার সঙ্গে সঙ্গেই শক্ত জমিতে পা রাখে দুই ভাই। অবশিষ্ট আলোর পালিশ বিদ্যুতের মতো হয়ে ওঠে। ডুবে যাওয়া খেতের কিনারায় দাঁড়ানো ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে ভাবে মেঘেরা বয়ে এনেছে যে রাত, তাতে তাদের চামড়া জ্বলজ্বল করছে কিনা।
ওপর থেকে একটা শাখায়িত বিদ্যুত-রেখা এসে পড়ে ওসুপার ওপরে। নিষ্কলঙ্ক, ফেনিল। ফিরতি বাজের আওয়াজ জমিকে কাঁপিয়ে দেয় আরো গভীর থেকে। সে শব্দে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যায় দাঁড়িয়ে থাকা সবাই। ঝুড়ি আর ঝুড়ি ধরে থাকা সাঁতারুরা গড়িয়ে নেমে যায় খেতের তলায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে তারা শ্লথ বিদ্যুৎকে ছোটো ছোটো উজ্জ্বল হাতে আকানাবি আর বেমিসোলা ওলোহানের মাথা স্পর্শ করতে দেখেছিল।
***
শক্তি ..বাঁচাতে ..শব্দটুকু… না. করেই.. গ্রামের দিকে দৌড়য় তারা, তাদের ভেজা আর বিদ্যুতের আঘাত পাওয়া ফসল নিয়ে। নেতিয়ে গেছে আকানাবি আর বেমিসোলার শরীর, তাদের চোখ উলটে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কেবল সাদা অংশটুকু। সাঁতারু ভায়েরা আর বোলাহান তাদের দেবস্থানে নিয়ে যায় আয়ো মেটাদের কাছে। তারা তখন ডুবে ভবিষ্যৎ দেখতে চাওয়ার এক অসামান্য প্রচেষ্টার গভীরে। বাবালায়োদের সামনের চ্যাটালো কাঠের ডালি ঢাকা মিহি সাদা বালিতে। তাতে টানা এক-একটা দাগ আর জোড়া দাগের লম্বালম্বি সারি বহু ভবিষ্যৎ বোঝায়। তার কোনাকুনি বসে থাকে আয়ো মেটারা, তাদের শরীর ঋজু, চোখ নামানো।
সাহায্য চেয়ে প্রথম চেঁচায় বোলাহান। আতঙ্কে এমন হাহাকারের মতো শোনায় তার গলার শব্দ, যে একাগ্রতা ভঙ্গ হয় ফাগবেজা আর ফাটোনার। আয়োজোবি উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে মসৃণ ভঙ্গীর এক টানে, এক মুহূর্তে তালগোল পাকানো শরীরগুলোর পাশে পৌঁছে গিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। দুই ভাই বেমিসোলা আর আকানাবির শরীরদুটো মাটিতে নামিয়ে দিয়ে পেছনে সরে যায়। বোনের ওপর নিজেকে ছুঁড়ে দিয়ে কাঁপতে থাকে বোলাহান, কখনও ফোঁপায় আর কখনও চুপ করে যায়।
“কী হয়েছিল?” জানতে চায় আয়োজোবি। ততক্ষণে ঠিক হয়ে গেছে ফাটোনা আর ফাগবেজা, তারা দাঁড়িয়ে থাকে তার পাশে। তাদের তিনজনের
 সমষ্টিকে  অবিনশ্বর মনে হয়, যেমন মনে হয়ে আসছে ওসুপা পত্তন করার দিনটা থেকে। সামনে এই অবস্থা দেখে চোখ কঠিন হয়ে আসে তাদের।
“বিদ্যুৎ!” বোলাহান চিৎকার করে ফাগবেজার দিকে। “ওরা যখন জলে ছিল, তখন বিদ্যুৎস্পর্শ লাগে ওদের। আহ্হ্হ্ ! কিছু করো।”
সর্বত্র সাদা চুলে ঢাকা ফাগবেজা ছোটোখাটো হলেও শক্তপোক্ত। বোলাহানকে বেমিসোলার ওপর থেকে টেনে তুলে সে তার ভিজে গালে গোটাকতক হাল্কা চড় মারে। নিজের ধবধবে সাদা চাদরটা দিয়ে বোলাহানার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে শক্ত হতে। বলে, শরীর শক্ত করো!
আসন্ন ঢেউগুলোকে গিলে ফেলে বোলাহান, চিৎকার করে আতঙ্কে, “ওকে মরতে দিও না আয়ো !”
ততক্ষণে গুঁড়ি মেরে বসে পড়েছে আয়োজোবি। তার ডান হাতের লম্বা আঙুলগুলো পড়ে থাকা দুজনের বুক আর রগের ওপর রাখে সে। ফাটোনা আয়োজোবির মতোই লম্বা, তবে তার মাথায় একটাও চুল নেই। দুই সাঁতারু ভাইকে একপাশে নিয়ে গিয়ে ঘটনার আগে আলো আর বাতাসের প্রকৃতি নিয়ে আরো নানান প্রশ্ন করে সে। তারা যখন উত্তর দেয়, তার চোয়াল নেমে আসে হতভম্বভাবে। আয়োজোবির দিকে তাকালে, সায় দিয়ে মাথা দোলায় সেও।
বাকি ওসুপা ইতিমধ্যেই জড় হয়ে গেছে দরজার কাছে। কেউ উঁকি দেয়, কেউ কী হয়েছে সেই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করে। কাজ ফুরিয়ে গিয়ে মিলিয়ে যায় ঝোড়ো বাতাস, সমস্ত কিছুতে চুঁইয়ে ঢোকা জলকে তাপ দিয়ে শেষ করে দেয়ার সুযোগ দেয় বেলা বেড়ে ওঠা সকালের সূর্যকে।
আকানাবির অভিভাবক এক বুড়ি। যুদ্ধ থেকে পালাতে পালাতেই তার সঙ্গে আটকে রয়েছে, তাকে সাহায্য করে এসেছে আকানাবি। দেবস্থানে এঁকেবেঁকে এসে ঢোকে সে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যায় যেখানে আকানাবি পড়ে আছে। মুখে হাত রেখে সে দাঁড়িয়ে দেখে ফাগবেজা দরজাগুলো থেকে লোকজন সরিয়ে দিয়ে নামিয়ে আনছে কাজ করা সাদা কাপড়ের থানগুলো।
“কী হয়েছে আয়ো আয়োজোবি?” শান্তভাবে প্রশ্ন করে সে। ফাটোনা আর ফাগবেজা তখন মাটিতে মাদুর আর পুরনো কাপড়ের পরত বেছায় বিছানার জন্যে।
“কিচ্ছু না, আকানাবির মা,” উত্তর দেয় আয়োজোবি। একটা তেতো শেকড় চিবোতে চিবোতে মুখ কালচে সবুজ হয়ে আসে তার। “দেখার জন্যে ছেলেমেয়েদের ডাক পড়েছে কেবল। ওরা ঝলমলে স্বপ্ন দেখছে।” আকানাবি আর বেমিসোলার শিথিল শরীর দুটো তুলে দুটো লম্বা কাপড়ের ওপর শুইয়ে দেয় দুই বাবালোয়া।
“স্বপ্ন?” জানতে চায় আকানাবির মা।
“তুমি এখনি ঠিক বুঝবে না, মা।” তার কাঁধে হাত রেখে তাকে হাওয়ায় ফুলে ওঠা দরজাটার দিকে নিয়ে যায় আয়োজোবি। সেখানে বোলাহান নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে, চোখ বোনের শুয়ে থাকা শরীরের ওপর।
“মা, ছেলেদের বলো যতটা শুকনো আগুনের কাঠ, তেল আর পাতা খুঁজে পায় নিয়ে আসতে।” মাথা দোলায় বুড়ি, তখনও হতচকিত হয়েই, তারপর বেরিয়ে যায় কাপড়ের দরজা দিয়ে। রয়ে যায় বোলাহান। তার বোন ..আর ..আকানাবির ..জন্যে.. যে বিছানা পেতেছিল ফাটোনা আর ফাগবেজা, তার চারপাশে অদ্ভূত সব গুঁড়ো ছড়ায় তারা।
“যাও, ওদের শুকনো কাঠ খুঁজতে সাহায্য করো বোলাহান।” মুখের তেতোটা থু থু করে মাটিতে ফেলে দেয় আয়োজোবি, “তুমি এখানে থাকতে পারো না।”
***
ওসুপার যে দুটি ভবিষ্যৎ দেখতে পায় আয়ো মেটারা, তার একটিতে সদলবলে পলায়ন, অন্যটিতে বিস্তার। বিদ্যুতে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া, আর তারপর ওলোডুমারের মনের ভেতরটা দেখতে ডাকা দুটি এলেমির জন্ম তারা দেখতে পায় না১০।
স্বপ্নে মগ্ন দুজনের মাথার কাছে যে আগুন তারা জ্বেলেছিল, তাকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করে আকানাবি আর বেমিসোলার চিন্তায় ক্লান্ত তিনটি মানুষ। সারাদিন ঘুমোয়নি তারা, আর এখন এসে পড়েছে রাত। তারা দেখতে পায় তাদের দেবস্থানের বাইরে টহল দিচ্ছে ওসুপার মানুষদের লণ্ঠন। সে আর ছেলেদের দল মিলে খানিকটা ভিজে কাঠ আর শুকনো খড় নিয়ে ফেরৎ আসার পর থেকেই বাইরে রয়ে গেছে বোলাহান। তারা শুনতে পায় তাকে ডাক দেয়, সান্ত্বনা দেয় মানুষ।
মাথার ওপরের রাতে চাঁদের রূপোর সরু ফালি।
ফাগবেজা ওস্তাদ অ্যালকেমিস্ট আর রসায়নের পাচক। যে আগুনের উষ্ণতা আকানবি আর বেমিসোলার হঠাৎ হঠাৎ আসা কাঁপুনি থামিয়ে দিয়েছে, তার ওপরে একটা কালো পাত্রে সুরুয়া ফোটায় সে। মিষ্টি, ঝাঁঝালো।
পোশাক ছাড়ে আয়োজোবি আর আকানবি। কোমর আর বগল থেকে খুলে ফেলে তাবিজ আর আলাদা আলাদা মন্ত্রপূত বস্তু। বগল আর মুখের ভেতরে বাইরে ধুয়ে নেয় নুন জলে, ধবধবে সাদা চাদরে জড়িয়ে নেয় শরীর। সাঁজোয় সাজ সম্পূর্ণ করে হাতে বোনা সাদা রঙের আসো-ওকের শালে কাঁধ মাথা জড়িয়ে।
ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে ফাগবেজা। সারা মুখ খড়িগোলায় ঢেকে সে স্বপ্নের রসায়ন তৈরি করে। বাঁদিকের চোখের চারপাশে একটা বৃত্ত এঁকে নেয় আয়োজোবি। নিজের ব্রহ্মতালু থেকে চোয়াল অবধি একজোড়া লাইন টানে ফাটোনা, নাকের ওপর দিয়ে টেনে আনে দুটো আঙুল। ফাগবেজার পাশে দাঁড়ায় তারা। ফাগবেজা লাল কয়লার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তুলে নেয় পাত্রটাকে, সাবধানে সেটাকে বসিয়ে দেয় মাটির ওপর।
“এ পর্যন্ত যা বানিয়েছি, এটা তার মধ্যে সবচাইতে কড়া,” বলে ফাগবেজা। “একটা বড়ো ঢোঁক খেয়ে ফেললে, আত্মা চিরকালের মধ্যে আটকে পড়বে শরীরের বাইরে, লটকে থাকবে বহু স্বপ্নের মধ্যে। আমরা প্রত্যেকে মাত্র ছ’ফোঁটা করে নেব। ওদের কাছে পৌঁছে দেবার পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু এতো বেশিও নয় যে আমরা আর আমাদের শরীরের বাসস্থানে ফিরতে পারবো না।”
আলো বুনতে পারা আয়োজোবি বয়সে সবার বড়ো, নিরবচ্ছিন্ন সমাধিতে থাকে সে ইতিমধ্যেই। সবার আগে গিয়ে আগুনের উল্টোদিকে খালি জমিতে শুয়ে পড়ে সে-ই। পেটে একটার ওপর আর একটা হাত রেখে বন্ধ করে ফেলে চোখ। মুখটা খোলে সে, আর ফাগবেজা ছটা ফোঁটা ফেলে তার জিভের ওপর। ভয়ানক তিক্ত সেই রসায়নে প্রথমে মুখ কুঁকড়ে যায় বুড়ো পুরোহিতের, তার তরলতা যেন চটচটে কালো করে দেয় তার জিভ আর গলাকে, কিন্তু তার পর আরামে শিথিল হয়ে আসে তার মুখ। তার পেট ভরে ওঠে উষ্ণতায়, তার জিভ থেকে ঝরে পড়ে মধুর চাইতেও মিঠে লালা। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
ফাটোনা চিকিৎসক, শরীর তার মাকড়সার জালের চাইতেও সংবেদনশীল। আয়োজোবির ডানদিকে শুয়ে পড়ে জিভে ফোঁটা নেয় সে। তার ভেতরটা ভরে ওঠে তিক্ততায়, তারপর ঘুমের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে মিষ্টতা।
সব শেষে যায় ফাগবেজা। নিজের জিভে ছটা ফোঁটা নেওয়ার আগে শুয়ে পড়ে কোমরের কাছে রাখে পাত্রটা। তার খড়ি মাখা মুখটা কুঁচকে যায়, আর সেও ঘুমিয়ে পড়ে মিষ্টতার স্বাদ নিয়ে।
***
মৃদু শব্দে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে মধ্যরাত্রি আসে। দেবস্থানে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে পাঁচটা শরীর। ছেলেটা আর মেয়েটা তিনরাত্রির ঘুমে পড়ে থাকে ডানদিকে, শরীর তাদের গরম আডিরে১১ কাপড়ের থানে ঢাকা। তাদের পাশে একটা অগভীর গর্তে কয়লা জ্বলে, স্বপ্নে ডুবে থাকা শরীরগুলোর ওপর ছড়িয়ে দেয় কোমল সূর্যাস্তের আভা। গর্তের বাঁদিকে শুয়ে থাকে বাবালায়োরা, ন্যাড়া জমির ওপর তিনটে কাঠের গুঁড়ির মতো শক্ত হয়ে।
যেন কোথা থেকে এসে পড়া নিদ্রাতে আচ্ছন্ন ওসুপা। বোন জেগে ওঠার আশায় দরজায় দাঁড়িয়েছিল যে বোলাহান ওলোহান, এমন কি সে-ও ঘুমোয় তার পাশে। ওপরের আকাশে, সরু চাঁদের হাসির নীচে পাক খায় তিনটে প্যাঁচা।
২
কবর খোঁড়া দুঃস্বপ্নে
আয়োজোবি সবার আগে ঘুমিয়ে পড়েছিল বটে, কিন্তু যৌথ স্বপ্নে জেগে ওঠে সবার পরে। সে তার সহোদর বাবালায়োদের সঙ্গে হাজির ঝকঝকে ঘাসে ঢাকা এক অন্তহীন প্রান্তরে। সামনের দিকে, স্বপ্নের উৎসকেন্দ্রে আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো একটা স্তূপ থেকে সে ঘাস যেন নিখুঁত মাপা ছন্দের তরঙ্গে দূরে সরে সরে যায়। আলো ঝিকমিক করে তাদের চারপাশে, নীল-নির্মেঘ আকাশ থেকে যেন ঝরে পড়ে ধুলোর মতো। ডাকে না কোনো পাখি, বয় না কোনো বাতাস।
ইতিমধ্যেই ফাটোনা হাঁটা দিয়েছে কেন্দ্রের বস্তুটার দিকে। জিনিসটা একটা পিচ্ছিল, কালো বিশাল ছোপের মতো, স্বপ্নের উজ্জ্বল বুনটকে ঢেকেছে কালিমায়, ফেলেছে আছাড়িপিছাড়ি ছায়া। জিনিসটা বেড়ে উঠেছে জমির গভীর থেকে, আকাশের দিকে উঠতে উঠতে পড়ছে ছড়িয়ে। ঠিক তার মুখের কাছে দাঁড়িয়ে আকানাবি আর বেমিসোলা ওলোহান, তার কাছে খাটো হয়ে তুচ্ছতায় পর্যবসিত।
ফাটোনার ঠিক পেছনেই ফাগবেজা, কাঁধে তার একটা প্যাঁচা। রূপোলী জরি ছেটানো সাদা আসো-ওকের১২ সূক্ষ্ম, ভারী আগবাদা১৩ তাদের পরণে। আয়োজোবি পিছু নেয় তার ভাইদের। ঘাসের মধ্যে দিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে যায় কিলবিল করে অস্তিত্বকে খণ্ডিত করতে থাকা কালো জিনিসটার সামনে, স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পিঁপড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আকানাবি আর বেমিসোলার দিকে। তার ষাট বছরের ধ্যান-ঘোরের মধ্যে এইরকম কিছু দেখেছে কিনা মনে করতে চেয়েও মনে করতে পারে না সে।
প্রান্তরের তরঙ্গকে অনুসরণ করে ফাটোনা। বেড়ে ওঠে কালিমার আয়তন, দূষিত করে ওপরের নীলকে, প্যাঁচা চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ফাটোনার। চিকিৎসক হিসেবে সে বেশ বুঝতে পারে যে জিনিসটা একধারে গর্ভ এবং ক্ষত, অন্য এক জগৎ-এর দ্বারপথ। কালিমার সেই বিশৃঙ্খলাকে এবারে ভেতর থেকে ঠেলতে শুরু করে কিছুতে। কালিমার মধ্যে থেকে অলস ভাবে যেন স্বপ্নের সূক্ষ্ম পর্দাকে ফাঁপিয়ে তুলতে তুলতে বেগুনি রঙে ঝলসে ওঠে তার অবয়ব।
লাফিয়ে ওঠে আয়োজোবি, উড়ে যায় স্বপ্নের ওপর দিয়ে। প্যাঁচার মতো ডানা পেয়েছে সে। সাধারণ মাপের সেই ডানারা ঝাপটায় তার- আগাবাডার পেছনের দিকটার একচুল ওপরে। ফাটোনা আর ফাগবেজাকে ছাড়িয়ে তাকে আকাশ দিয়ে উড়ে যেতে সাহায্য করে আকানাবি আর বেমিসোলার পেছনের জমিতে।
আকানাবি আর বেমিসোলার মাথা ঘোরানো সেই কালিমার দিকে। তাদের ঘাড় এঁটে বসানো। তাদের পা মাটিতে ডোবানো, পায়ের হাড় থেকে অঙ্কুরিত হয়েছে পাতা আর কুঁড়ি। চোখ তাদের কালির পুকুরের মতো কালো। তাদের ছুঁয়ে দেখতে সরে আসে আয়োজোবি।
…ছিঁড়ে যায় সূক্ষ্ম পর্দা, ভেসে বেরিয়ে আসে এক অতিকায় আকার। মোচড়ানো, পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া, পুরনো হাড়ের মতোই ভারি। ঝিকিমিকি আলো আর প্রাণ ভরপুর সবুজ ঘাসের মাঠ অদৃশ্য হয়ে যায় তার ছায়ায়। কালিমার বিন্দু থেকে ছেঁড়া পর্দাটা চড়বড়ো করে ওঠে আগুনে পড়া চর্বির মতো। সমস্ত আকাশটা টগবগিয়ে পরিণত হয় নক্ষত্রহীন রাতে।
অন্ধ হয়ে যায় আয়োজোবি। নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় ফাগবেজার। তার পিঠের প্যাঁচাটা কেবল একটা বাঁধন-দড়ি, ওসুপাতে যেখানে তারা পড়ে আছে, সেই অন্য দিকটাতে কি হচ্ছে তার সংবাদদাতা। ফাটোনা তার প্যাঁচা চোখ দিয়ে দিয়ে দিনের মতো দেখতে পায় বটে, কিন্তু যেখানে দুই স্বপ্নদর্শী দাঁড়িয়ে সেখান থেকে সে অনেকটা দূরে। ছুটতে শুরু করে সে।
একই সঙ্গে মুখ খোলে আকানাবি আর বেমিসোলা। নিজের অজানা সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে আরম্ভ করে আকানাবি। পেটের তলা থেকে শব্দহীন গান গায় বেমিসোলা। স্বপ্নের বাতাসের মধ্যে বেসুর প্রতিধ্বনি ওঠে তাদের কণ্ঠস্বরের।
ঘাড় ঘুরিয়ে সেই অতিকায় অস্থিপোতের ভাসার পথ দেখতে গিয়ে ফাটোনা তার প্যাঁচা চোখে দেখতে পায় এক জীবন্ত ভাষা। নিজের গড়া রাত্রির শূন্যতাতে বেগুনি হয়ে জ্বলতে জ্বলতে ধীরে ধীরে চলেফিরে বেড়ায় সেটা।
আকানাবি আর বেমিসোলার শব্দ অনুসরণ করে তাদের কাছে পৌঁছে যায় আয়োজোবি। তাদের নিশ্চল করে রাখতে আঁকড়ে রাখে তাদের কাঁধ, যতক্ষণ না এসে পৌঁছয় ফাগবেজা আর বাঁধন-দড়ি। তারপর সঙ্গে সঙ্গে উলু দিতে আরম্ভ করে, অস্থিপোতকে ডাক দিতে থাকে এক অজানা ভাষায়।
বাবালায়োরা ছুটতে শুরু করে তাদের রোগীদের দিকে। টের পাওয়া যায় না এমনভাবে অস্থিপোত ভেসে আসে স্বপ্নের কেন্দ্রে, রঙে রঙে মিশে যায় অন্ধকার আকাশের সঙ্গে, রাতের প্রেক্ষাপটে যেন গভীরতর রাত। আরম্ভ হয় একটা খাঁকারি দেয়ার মতো চিৎকার, পাখির ডাকের মতোই বিক্ষিপ্ত, প্রতিধ্বনিত হয় কাছের আর দূরের নানা বিন্দু থেকে। প্রতিটা কণ্ঠ একটা চিৎকারকে থেমে যেতে দেয়, তারপর আর একটা উঠে আসে রোম খাড়া করার মতো উচ্চগ্রামে। তারা যেন গলা ফাটায় অস্থিপোতের বিরুদ্ধে, চেঁচায় যেন ভক্ষ্য হতে যাচ্ছে একটা অতিকায় পশুর আঠালো দংষ্ট্রায়।
আরো জোরে দৌড়য় ফাগবেজা। তার ফিসফিসানি প্রার্থনা ঘাসের মধ্যে কেটে তৈরি করে দেয় পথ। তার কাঁধের প্যাঁচা এবার নীচু হয়ে ওড়ে তার মুখের সামনে, পথ দেখায় আয়োজোবিকে।
আসে প্রথম ছোঁ মারা টান। দাউদাউ বেগুনি আগুনে মাঝপথেই স্তব্ধ হয়ে যায় একটা চিৎকার, একটা গলা ফাটানো শরীর বিষ্ফোরিত হয় বাতাসে। পুড়িয়ে সুতোর মতো সরু একটা রেখা বানায় দূরের প্রান্তর থেকে অস্থিপোতের অন্তঃস্থল অবধি। মাঝপথে থেমে যায় পরের আর্তনাদটাও। বাবালায়োরা যেখান দিয়ে দৌড়োয় তার কাছে মাটি ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে আর একটা শরীর, জ্বলতে থাকে অস্থিপোতের দিকে ছিটকে যেতে যেতে।
পায়ের নীচের মাটির মদতে দৌড়তে থাকে ফাটোনা আর ফাগবেজা। যে আকাশে নিশ্চল হয়ে ভাসে অস্থিপোত সেখানে এবারে বিষ্ফোরিত থাকে বেগুনি মিসাইল। যে সমস্ত শরীর যেন পোঁতা ছিল স্বপ্নের মাটির গভীরে, মাটি ফাটিয়ে আকাশে উঠে যেতে যেতে তারা চিৎকার করে উঠে বোবা হয়ে যায়। অন্ধ চোখের দৃষ্টি অস্থিপোতে আটকে আয়োজোবি, আকানাবি আর বেমিসোলা যেখান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জীভ দিয়ে এক অদ্ভূত ঢেউ খেলানো শব্দ করে, সেখানে পৌঁছে যায় ফাটোনা। তার প্যাঁচা চোখে সে দেখতে পায় চুরি করা শরীরের জ্বলন্ত মিসাইলের পাশাপাশি তাদের ঠোঁটের ফাঁক থেকে সবেগে বেগুনি প্রবাহ উঠে যায় অস্থিপোতের দিকে। জীবন্ত ভাষা পড়ছে তারা।
আগবাডা থেকে একটা চুম্বক পাথর বের করে আনে ফাটোনা। সাদা পাথরের একটা নিখুঁত ঘনক সেটা। এসে পড়ে ফাগবেজা আর তার বাঁধন-দড়ি প্যাঁচা। ফাটোনার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলায় সে। ঘনকটা ছুঁড়ে দেয় ফাগবেজা, হাত রাখে আয়োজোবির কাঁধে। সাদা আলোয় বিষ্ফারিত হয় চুম্বক পাথরটা। ভাসে সূর্যের মতো নিশ্চল হয়ে, দপদপ করতে থাকে যেন তাতে ঠাসা জলের কুঞ্চিত লহরের ছায়া। ফাগবেজা এক হাত রাখে ফাটোনার পিঠে, অন্য হাতে আঁকড়ায় প্যাঁচার পা।
উড়ে যায় বাঁধন-দড়ি, তাদের তুলে নেয় শুকনো পাতার মতো। স্বপ্ন থেকে তাদের বের করে ভরে নেয় চুম্বক পাথরে।
তাদের অনুপস্থিতিতে জারি থাকে দুঃস্বপ্ন। আত্মার ফসল লুঠ হয়ে যায় জমি থেকে।
***
ওসুপার দেবস্থানের ভেতর খুলে যায় চুম্বক পাথরের ঘনক। তার চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতা থেকে চুপচাপ বেরিয়ে আসে সাপের মতো যত আকৃতি, সরে সরে যাওয়া আলোয় উজ্জ্বল। দেয়ালে ছায়া ফেলে ভারহীন অবস্থায় ঘোরে-ফেরে তারা। বাতাসে সাঁতার কেটে চুপচাপ ঢুকে পড়ে পাঁচ নিদ্রিতের মুখে। চুম্বক পাথরটা ধ্বসে পড়ে গুটিয়ে যায় আলোর এক ঝকঝকে বিন্দুতে।
বোলাহান ওলোহান জেগে উঠে যে কয়েকটা নিঃশ্বাস নেয় তার সময়টুকুর জন্যে সে আলোটা টিকে থাকে বাতাসে, এতই উজ্জ্বল সেটা। দেবস্থানে উঁকি দিয়ে বোলাহান দেখতে পায় জেগে উঠছে বাবালায়োরা। প্রত্যেকে জোরে জোরে ঘষে তাদের চোখ আর পিঠ আর কান, যেন অশুচিতা সাফ করতে চেয়ে। মিলিয়ে যায় ঝিকমিক। একটা সাদা প্যাঁচা উড়ে বেরিয়ে যায় দেবস্থান থেকে।
তাদের শরীরের গুরুভারে ফিরে এসে নড়াচড়া করে ককিয়ে ওঠে বেমিসোলা ওলোহান আর আকানাবি। যখন চোখ খোলে তারা, তাদের চোখের তারা রুপোলী হয়ে রয়েছে ঘুমে। যখন মুখ খোলে, আসে না কোনো শব্দ।
৩
ঘোষণা করো স্থপতিদের
উঠে দাঁড়িয়ে দেবস্থানের ভেতরে হেঁটে চলে বেড়াতে বেমিসোলা আর আকানাবির লেগে যায় তিনদিন। মুখে কথা ফোটে না তাদের। তাদের জেগে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে পরামর্শ করে, ভবিষ্যৎ গণনা করে আয়ো মেটারা। পালা করে ওপেলে১৪ ছোঁড়ে ডিম্বাকার বোর্ডের ওপর, লাইন টানে সাদা বালিতে। ইফা কিছুই দেখান না, কিছুই বলেন না। তাও তারা লেগে থাকে দৈব ইচ্ছা নির্ধারণে আর তাদের মূক রোগীদের সেবায়। আয়োজোবি জানে কী হতে চলেছে। পৃথিবীতে সিঁধ দেবে অন্য দুনিয়ার কোনোকিছু। এমন কিছু যার শক্তি আর ক্ষুধা মানুষের বোধের অগম্য। আকানাবি আর বেমিসোলার স্বপ্নভূমে তাদের কাঁধ ছুঁয়েছিল সে, শুনেছিল, দেখছিল, তাদের ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তাদের মতো যে কথা বলেছিল তা তার মনে পড়ে না। সেই জ্বলন্ত বেগুনি ভাষা, যেন তা খোলার অপেক্ষায় থাকা এক বার্তা- একটা আহ্বান, একটা ডাকে আসা পত্র।
টানা স্থান-কালের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে আকাশ-পাতালের নানা ভুবন দেখা তার বাবালায়ো জীবনে এর মতো অদ্ভূত কিছু দেখেনি আয়োজোবি। এ-কথাও জানে আয়োজোবি যে ইফা তাদের তিনজনের সঙ্গে কথা বলছেন না। তাঁর কাজের জন্যে তিনি বেছে নিয়েছেন যে দুটো কন্ঠস্বর, তারা আপাতত মূক। বেমিসোলা আর আকানাবি টলতে টলতে ফিরে গিয়ে মাটিতে শুয়ে না পড়া অবধি তাদের ঘিরে কাজ করতে থাকে ফাটোনা আর ফাগবেজা। ফাগবেজা তার জৈবিক রসায়ন আর সুবাসিত গাঢ় চুবোনোর তরল নিয়ে, ফাটোনা তার ঠান্ডা ঠান্ডা হাত আর নীরব অশ্রু নিয়ে। সাদা চাদরে মোড়া আয়োজোবি এক কোনে বসে তাকিয়ে থাকে দেবস্থানের মাঝখানের অগ্নিকুণ্ডের দিকে, চোখে দেখে বেগুনি।
***
যে রাতটা জেগে থেকে আকানাবি আর বেমিসোলার ওপর নজর রাখে তিন বাবালায়ো, তার পরের সকালে লুকিয়েচুরিয়ে দেবস্থানে এসে ঢোকে বোলাহান। চেষ্টা করে তারা যৌথ স্বপ্নে যা দেখেছে তাদের কাছ থেকে তার ব্যাখা আদায় করার। অস্থিপোত কি কেবল ওসুপার বসতির জন্যে আসছে, না সারা দুনিয়ার জন্যে? ইলে-ইফের যুদ্ধ আর রক্তপাতই কি এই ক্ষুধার্ত বস্তুটাকে টেনে আনছে এই জগতে?
বেমিসোলা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে সদ্যোজাতর মতো দৃষ্টি নিয়ে, মুখে তার একটা অদ্ভূত মজার হাসি। বিছনায় ফিরে গিয়ে অঘোরে ঘুমোয় আকানাবি, ভ্রুণের মতো গোল হয়ে কুঁকড়ে।
সূর্য উঠতে উঠতে আয়ো মেটারা ঘুমে ঢলে পড়ে দেবস্থানের কেন্দ্রের অগ্নিকুণ্ড ঘিরে। বেমিসোলা পুরোপুরি জেগে থাকে বটে, কিন্তু কথা বলতে পারে না। কথা বলতে চাওয়ার চেষ্টায় বিষ্ফারিত হয়ে ওঠে তার চোখের তারা।
মোরগের প্রথম ডাকে ঘুম ভাঙে বোলাহানের, দেখতে পায় আয়ো মেটারা ঢুলে পড়েছে ঘুমে, জেগে কেবল বেমিসোলা। বোনকে জীবিত দেখতে পেয়ে আনন্দ ধরে রাখতে পারে না বোলাহান। বাবালায়োদের নাক ডাকা শুরু হতে না হতেই দেবস্থানে দৌড়ে ঢোকে সে, জড়িয়ে ধরে বোনকে। কিছুক্ষণ স্থির থাকে বেমিসোলা, তারপর ছটফটিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তার আলিঙ্গন থেকে। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে তারা। বেমিসোলার চোখ পূর্ণ আতঙ্কে, বোলাহানের ক্লান্তি আর ভালোবাসায়।
“বেমি, এতো … ভয় পেয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম তুমি আর ফিরে আসবে না।”
মুখ ফিরিয়ে সরে যায় বেমিসোলা, হাত বুকের চারপাশে জড়ানো। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকায় বোলাহানের দিকে। তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে একটা হাত রাখতে চেষ্টা করে বোলাহান, কিন্তু তাকে সে ছোঁয়ার আগেই সরে যায় বেমিসোলা।
“বেমিসোলা? আমরা এখানে, এখনও  বেঁচে। কথা বলো আমার সঙ্গে !”
কুটিরের আরো ভেতরে সরে যায় বেমিসোলা, আকানাবির পাশে পাতা তার বিছানার কাছে, যেখানে অচেতন হয়ে পড়ে আছে আয়ো মেটারা, কয়েকদিনের ব্যবধানে তাদের প্রথম নিদ্রায়। বোলাহান তার দিকে এগোনো বন্ধ করতে সেও থামায় পিছু হাঁটা।
দেবস্থানের ছাদের মধ্যে দিয়ে আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বেমিসোলা। প্রথমে ঘুরতে শুরু করে বৃত্তাকারে, তারপর থেমে যায় বোলাহানের জন্যে, তারপর থেমে যায় বোলাহানের জন্যে…এই আশায় যে সে তার কথা বুঝতে পারবে।
বোলাহান বুঝতে পারে না বটে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হলে তারপর আদানপ্রদান করতে কষ্ট হলে সাধারণতঃ যা করে থাকে সে, এবারও তাই করে। কন্ঠস্বর নামিয়ে রেখে একটা গানকে বেরিয়ে আসতে দেয় তার ঠোঁট থেকে। উষ্ণ সুর দিয়ে আবেদন করে, আলিঙ্গন করে।
বোন।
বলো। কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
কী স্পর্শ করেছিলে ?
দেখেছিলে কি দেবতাদের সার বেঁধে দাঁড়াতে
আকাশে বৃত্তাকারে, তোমাকে অভ্যর্থনা জানাতে
গাও, বোন। বলো।
যারা ঘুমিয়ে তারা যাতে উঠে না পড়ে, তাই কন্ঠস্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে বোলাহান। দেখতে থাকে, শুনতে থাকে বেমিসোলা। ঘুমিয়ে থাকা দুজন নড়ে ওঠে বটে, কিন্তু তাদের ঘুম ভাঙে না। স্মৃতির প্লাবন ডাকে বেমিসোলার মনে, বিস্ফারিত হয়ে ওঠে তার চোখ। সঙ্গীত ছিল তাদের প্রথম ভাষা। পেছন ফিরে সে দৌড় দেয় ফুলে ওঠা পর্দার দরজা দিয়ে দেবস্থানের পেছন দিকে। ছোটোবেলায় যখনই তারা গান গাইত, আর তার পালা পড়ত জবাব দেয়ার, ছুট দেয়ার একটা রাস্তা খুঁজে বের করত সে যাতে বোলাহানকে তার নিরাপদ আশ্রয় থেকে বের করে এনে এমন একটা জায়গায় টেনে আনতে যেখানে সে সর্বোত্তম হয়ে উঠতে পারে।
রান্না করার, গল্প করার, সাফসুতরো করার, চুম্বন করার, খাওয়াদাওয়া করার সকালের ছন্দে ব্যস্ত মানুষে পরিপূর্ণ ওসুপার মাঝখান। বেমিসোলা ওলাহান দেবস্থান থেকে সকালের আলোয় ছুটে বেরোতে একটা নৈঃশব্দ নেমে আসে তাদের ওপর। ভাজা মিঠে আলু পড়ে যায় ভেষজ তেলে, দাঁত মাজার জড়িবুটি পড়ে যায় মুখ থেকে। বেমিসোলা তাকিয়ে দেখে তার চারপাশের মানুষের দিকে। পরণে তাদের আলুথালু সকালের চাদর, গালে আঁক কাটা, নাক বলিষ্ঠ চোখে আশা। প্রত্যাশা নিয়ে চারদিকে তাদের দিকে তাকায় বেমিসোলা। সবচেয়ে বেশি সে তখন দেখতে চায় তার মা কে, কিন্তু সেখানে মেয়েদের মধ্যে তাকে পায় না।
ওপর দিকে তাকায় বেমিসোলা, তার যমজের গান তখনও প্রতিধ্বনিত হয় তার কানে আর তার বুকের মধ্যে। পরিষ্কার আকাশে পাতলা মেঘের আঁচড়, তাদের প্রান্তগুলো সূর্যোদয়ের আলোয় গোলাপি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে। কালো অস্থিপোত ভাসে অনেক ওপরে, বাজপাখির মতোই ছোট্ট। কোনো ছায়া নেই তার, কারণ সে ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না সেটাকে।
মুখ খুলে গেয়ে ওঠে বেমিসোলা,
চলো দরজায়, চলো দরজায়, যেখানে তারা জন্ম দিয়েছিল আমাদের।
চর্মহীন দুইজন : একজন তূর্যনিনাদ একজন মলম।
ওবাতালা এবং অন্যজন আসন্ন তস্কর
আমাদের নিজেদের মাঝে ধরে রেখে ছিল অপেক্ষায়
যতক্ষণ না সেই তস্কর আমাদের ছিনিয়ে নিতে শুরু করে আমাদের প্রাচীন ঘর থেকে।
যেখানে ফসল যায়, সেখানে থাকে না শান্তি,
কেবল কোলাহল, কেবল স্মৃতিস্তম্ভ, কেবল বালি, কেবল –
গলা বসে যায় তার, দম বন্ধ হতে শুরু করে তার।
বোলাহান দৌড়তে শুরু করে তার দিকে। কাশি থামিয়ে বেমিসোলা কথা বলতে আরম্ভ করে এমন এক বসা গলায় যে তার চোখ উলটে যায়। শ্রোতারা ভাবে এর বদলে সব চুপচাপ হয়ে গেলে ভালো হত – কান চাপা দেয় তারা। কান চাপা দিয়ে টলতে টলতে পিছিয়ে যায় বোলাহানও। তার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমন্ত মানুষের পেটের মত তার পায়ের নীচের মাটি পালা করে ফুলতে আর ঢিলে হতে শুরু করে। তাকে ওঠায় আর নামায় আলতো করে। তার শূন্য চোখের দৃষ্টি আটকে আকাশের সেই বস্তুটার দিকে, যা কেবল দেখতে পায় সে-ই। গলা তার আঁকড়ানো তার দুহাতে, যেন নিজের ভেতরে থেকে উপচে আসা শব্দটাকে বন্ধ করতে চায় সে।
খরগোশের আকারের একটা মন্ত্রপূত বস্তু উড়ে আসে দেবস্থানের দিকে থেকে, আঘাত করে বেমিসোলার কাঁধে। নিথর, আড়ষ্ট হয়ে যায় সে। সে মাটিতে পড়ার আগেই তাকে ধরে ফেলে বোলাহান।
আয়ো মেটারা এগিয়ে আসে দুই যমজের দিকে, চোখ তাদের ঘুমে ভারী। মেয়েটাকে ধরে তারা বয়ে নিয়ে যায় কুঁড়েতে, যেখানে তখন মড়ার মতো ঘুমোয় আকানাবি।
কেউ দেখতে পায় না, আকাশে অনেক ওপরে বন্ধ হয়ে যায় চোখের আয়তনের একটা কালিমা।
***
এই ঘটনার পর জল কিম্বা খাবার ছাড়াই টানা সাতদিন ঘুমোয় বেমিসোলা আর আকানাবি। উদ্ধার কাজের জন্যে ফের নিজেদের স্বপ্নে ডুবে দেয়ার বড়ো একটা ইচ্ছে দেখা যায় না আয়ো মেটাদের। তাদের সবরকমের ক্ষমতার ব্যবহার করে তারা – মন্ত্র পড়ে, হাত বোলায়, ঘুমিয়ে থাকা দুজনের দাঁতের ফাঁকে ঢেলে দেয় মিষ্টি তেতো পাঁচন। কিন্তু তারা কেবল খিঁচুনি দিয়ে হাত-পা ছোঁড়ে আর বিড়বিড় করে। একবার, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই আকানাবি উঠে বসে বলে, “আমি আর বেশি খুঁড়ে নিজেকে ভেতরে ঢোকাতে পারছি না।”
কৌশল পালটায় আয়ো মেটারা। ঠিক করে পরের পদক্ষেপ হবে নিরাপত্তা দেয়া, যতক্ষণ না স্বপ্নের বাঁধন ছেঁড়া যাচ্ছে। দেবস্থান ঘিরে আবোর একটা দ্বিতীয় গণ্ডি দেয় তারা, সমস্ত অবাঞ্ছিত, প্রেত মানুষ আর জীবকে রুখে দিতে। এমনকি বোলাহান ওলোহানের পক্ষেও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় দেবস্থানে নীচের দিকের অর্ধেকটা ঘিরে পাক খেতে থাকা কুয়াশার চাদরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা।
ফের যে বৃষ্টি হয় না, শুকিয়ে যায় পোশাক আর কুটির আর ফসল তাতেই কৃতজ্ঞ থাকে ওসুপার মানুষ। দুই ঘুমন্ত মানুষ ডুবে যেতে থাকে তাদের ঘুমের আরো গভীরে, আয়ো মেটারা থাকে তাদের কাছাকাছি। বোলাহান একা একা সময় কাটায় গাছের ডালের মধ্যে। চিন্তা করে তার জন্যে গাওয়া বেমিসোলার গানের কলিগুলো নিয়ে, যাতে সে সময়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে।
আয়ো মেটারা বেমিসোলার গানের শেষটুকু শুনেছিল কেবল। বেমিসোলা আর আকানাবির সঙ্গে তাদের যৌথ স্বপ্নে তারা যা দেখেছিল তাই নিয়ে ফের চিন্তা করে তারা। তাদের অদ্ভূত সব জগৎ আর বস্তু আর আকাশে অভিজ্ঞতা থাকলেও এইটাতে অস্বস্তি হয় তাদের। বিশেষত যখন মাটি থেকে উপড়ে অস্থিপোতে অদৃশ্য হয়ে যায় শরীরগুলো।
নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা করে না তারা বটে, কিন্তু বেমিসোলা জেগে ওঠার পর তার লক্ষণ থেকে তাদের বুঝতে অসুবিধে হয়না যে বেমিসোলা একজন ঘোষক। সাধারণত ওরিশা আর অন্তরীক্ষের বহু দুনিয়ার জীবেদের পৃথিবীতে আগমনের আগে আবির্ভাব হয় ঘোষকদের। কিন্তু ঘোষকরা এতক্ষণ ঘুমোয় না। তারা কেবল আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে নাচে আর গানে কখনও বা হাতের জটিল মুদ্রায়। তারা যখন অন্য ভাষায় কথা বলে তখন তারা পায়ের নীচে মাটিকে তালে তালে ওঠা পড়া করায় না। তাদের নিদ্রাও আবদ্ধ হয়ে থাকে না একটি মাত্র দুঃস্বপ্নের বারংবার আবর্তিত চক্রে।
নিদ্রিত দুটি মানুষের পাশে নিদ্রাহীন অবস্থায় বসে আয়ো মেটারা চিন্তা করে অস্থিপোত আর বেমিসোলার গান নিয়ে, দুশ্চিন্তা করে ভবিষ্যৎ নিয়ে। অতি ধীরে ধীরে আশঙ্কার কাঁটায় কণ্টকাকীর্ণ হয়ে ওঠে তাদের বুক।
তার সহোদরদের পথ দেখিয়ে ওসুপা প্রতিষ্ঠা করেছিল আয়োজোবি, মানুষকে বাঁচাচ্ছে ভেবে নিয়ে তাদের এনেছিল সেখানে। কিন্তু তার বদলে খুব শিগ্গির যুদ্ধের চাইতে ভয়ানক হয়ে উঠতে চলা এক প্রহেলিকার মধ্যে তাদের এনে ফেলেছে, এই অপরাধ বোধ আর অনুশোচনা গ্রাস করে তাকে। টান লেগে আকাশের ওই পচনের মধ্যে পড়ার থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচাইতে সঠিক পথ কোনটা তাই নিয়ে চিন্তা করে সে।
মানসিক ক্ষত আর দফায় দফায় তীব্র উন্মত্ততার কবলে না পড়ে তার নতুন আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অক্ষমতার কথা চিন্তা করে ফাগবেজা। অন্তরের বিশৃঙ্খলার অতটা কাছাকাছি এসে পড়াটা অসহ্য লাগে তার। কাপড়ের ভাঁজে একটা বিষের গুটি রাখতে শুরু করে সে। যদি মাথার ওপরের আকাশটা স্বপ্নের মতো সত্যিসত্যি ভেঙে ফাঁক হয়ে যায় কখনও, ..সেসময় ..যাতে.. সেটাকে গালের মধ্যে ফাটিয়ে দিতে পারে।
অস্থিপোতের মালিক কি চায় সে কথা চিন্তা করে ফাটোনা। সে কি আসলে ছদ্মবেশি ওলোডুমারে, একটা পরীক্ষা নিচ্ছে এই উদ্বাস্তু বস্তির, যাতে উত্তীর্ণ হলে তাদের উপহার দেবে আরো সুন্দর এক ভবিষ্যৎ? না। যৌথ স্বপ্নে ফাটোনা যা দেখেছে তার পর এ হতে পারে না। বাণী দিতে, উপহার দিতে তাঁর সৃষ্টিতে কখনোই পচনকে আনবেন না ওলোদুমারে। ঠিকই বলছে মেয়েটা, আসছে কোনো তস্কর।
***
রাতে তন্ত্রমন্ত্রের লগ্নে তস্কর আসে।
জেগে ওঠে বেমিসোলা ওলোহান, ছিটকে খুলে যায় তার চোখের পাতা। কাঁদতে শুরু করে সে, প্রতি তিনটি নিঃশ্বাসের পর, টানা স্বরে, যারা শুনতে পায় তাদের ডাক দিতে শুরু করে। এসে গেছে ওরা।
হাল্কা বেগুনি আলোয় ঝলসে ওঠে ওসুপার ওপরের আকাশ। বেমিসোলার পর উঠে পড়ে আয়োজোবি আর ফাগবেজা। এগিয়ে যায় যেখানে বেমিসোলা শরীর কাঠের মতো শক্ত করে চিৎ হয়ে মাদুরের ওপরে যেন আটকে পড়ে রয়েছে। “ওরা এসে গেছে,” বারংবার আউড়ে যায় সে।
ধুলোময়লা লাগা সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক মুড়ে, মাটির দিকে মাথা নামিয়ে, তার কথা যাচাই করতে যায় আয়োজোবি। মাথা তুলে বেগুনি আলোর কুঞ্চিত লহর খেলে যাওয়া একটা আকৃতিবিহীন গহ্বর দেখতে পেয়ে, পিঠ ফিরিয়ে ওসুপা থেকে বিদায় নেয় সে। এসে গেছে ওরা। তাকে আর এরপর কোনোদিন দেখা যায়নি।
বেমিসোলা ওলোহানকে নড়িয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয় ফাগবেজা। এছাড়া আর কী করতে হবে সে বুঝতে পারে না। বেমিসোলার শরীরে আর একটা মন্ত্রপূত বস্তুর আঘাত তার চিরস্থায়ী ক্ষতি করে দিতে পারে। দাঁড়ায় বটে বেমিসোলা, কিন্তু নিটোল শান্তির কয়েকটা মুহূর্তের ফাঁকে ফাঁকে তারস্বরে চিৎকার করা করা থামায় না। ওরা এসে গেছে।
তার চিৎকারে নড়ে উঠে জেগে ওঠে ফাটোনা। বেমিসোলার চোখ বড়ো করে খোলা, সামনের বাতাসে নিবদ্ধ তার কঠিন দৃষ্টিতে.. ফাগবেজা অগোচর। ওরা এসে গেছে।
ফাগবেজা বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ওসুপার মানুষ ঘুমন্ত অবস্থাতেই হেঁটে বেরিয়ে আসছে তাদের কুটির থেকে। তার পেছনে উত্তোরত্তর বাড়তে থাকে বেমিসোলার ব্যাকুল চিৎকার। ওপরের আকাশে ফাগবেজা দেখতে পায়, সেই যৌথ স্বপ্নের মতোই, রাতের ওপর ময়লা ছোপ ফেলা এক কালিমা, অস্তিত্বের দেহমাংসে এক শূন্যতার আবির্ভাব। আরো তেজি হয় সে-শূন্যতার অন্তঃস্থল থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া সেই বেগুনি আলো। অবশেষে ফাগবেজা শুনতে পায় সমস্যাটা কী। রাতটা যেন পাথরের মতো নিস্তব্ধ। কোনো পোকা বা ব্যাঙ বা পাখি সামান্যতম শব্দটুকুও করে না। ওরা এসে গেছে। পেছন ফিরে হ্রদের দিকে পা চালায় সে, ওসুপার বাইরে। তার মাথা আর হৃদয় টগবগ করে উন্মত্ততার সদা অপরিচিত কর্কশ অর্থহীনতায়। বিষের গুটিটা দাঁতে রেখে থেঁতো করে ফেলে সে। গিলে ফেলে হ্রদের নেমে হাঁটতে হাঁটতে, ভুট্টার মাঠার মতো রঙের জলের নীচে শুয়ে পড়তে চেয়ে। ওরা এসে গেছে।
ফাটোনা দেখে বেমিসোলা হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে দেবস্থানের বাইরে, ঘাড় তার কাঁধে শক্ত করে আটকানো। তার শক্তি আর উত্তেজনা কোনোভাবে কমেছে বলে মনে হয় না। গলাও তার ভাঙে না, বসে যায় না। তার বদলে আরো জোর হয় সেই কন্ঠস্বর, তার সমস্ত শরীর বেয়ে কম্পিত হয়ে বেরিয়ে আসে তার চারপাশের বাতাসে। ওরা এসে গেছে। থরথর করে কেঁপে ওঠে ফাটোনা। সময় হয়েছে। তার করার মতো আছে যৎসামান্যই।
পাথরের মতো ঘুমিয়ে থাকা আকানাবির দিকে ফেরে ফাটোনা, আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে সে বেঁচে আছে কিনা দেখতে। বেঁচে সে রয়েছে বটে, কিন্তু অদ্ভূত ভাবে ফাটোনার ত্যাগ করা প্রতি ছটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে সে নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে একটা। তাকে এক সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে বেমিসোলার অনুসরণ করে ফাটোনা। বেমিসোলা তখন দেবস্থানের পালের মতো ফুলে ওঠা কাপড়ের দরজা দিয়ে ধীরে ধীরে রাতের মধ্যে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওরা এসে গেছে।
বেমিসোলার পেছনে দেবস্থান থেকে বেরিয়ে আসে ফাটোনা, দেখতে পায় দুপায়ে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় অপেক্ষা করে ওসুপার মানুষ। ওরা এসে গেছে। নজরে পড়ে না আয়োজোবি আর ফাগবেজা। সে ঠিক দেখছে কিনা নিশ্চিত হতে পেছন ফিরে দেবস্থানে ভেতরে যায় ফাটোনা। হ্যাঁ, বিদায় নিয়েছে তার সহোদরেরা।
“উঠে পড়ো।” ঘুমিয়ে হাঁটা লোকগুলোর মধ্যে ছুটে গিয়ে চেঁচায় ফাটোনা, আতঙ্ক চেপে বসে তার ওপর। হাতে তালি দেয়, বোলাহান ওলোহানের দুই কাঁধ ঝাঁকায়, বেমিসোলা আর আকানাবির ওপর যেদিন নেমে এসেছিল আঘাত, তাদের দেবস্থানে বয়ে এনেছিল যে দুই সাঁতারু ভাই, তাদের গালে চড় মারে। ওরা এসে গেছে।
কিছুই হয় না।
“উঠে পড়ো!” ফের তারস্বরে চেঁচায় ফাগবেজা। বাতাসের সুরের মূল অংশ হয়ে উঠেছিল যে বেমিসোলার কণ্ঠস্বর, সে চুপ করে যায়।
তার দিকে তাকায় ফাটোনা। ওপরে আকাশে ক্রমশ বাড়তে থাকা শূন্যতার দিকে তোলা তার মুখ। জলের ওপর লহরিকা তোলা মধ্যরাতের সূর্যের মতো বেগুনি আলোর ঔজ্জ্বল্য লহর তোলে মাটিতে, কুটিরে আর ওসুপার মানুষের শরীরে। ফাটোনা দেখে তার চারপাশের সমস্ত ঘুমিয়ে হাঁটা মানুষগুলো চোখ বুজেই মাথা তোলে আকাশটাকে দেখতে।
কাঁচা কাঠকয়লার মত কালো অস্থিপোতের সামনের অংশটা শূন্যতার উপরিতল ছেদ করে। ভেসে আসে ঠিক সেই স্বপ্নের মতোই, অতিকায়, ভারহীন, সুশ্রী, অষ্টাবক্র। তার অবয়বের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে খোদাই করা যৌথ স্বপ্নে দেখা সেই জীবন্ত ভাষা। দ্রুত দপদপানি, ঝলসানিতে বেগুনি আগুনে জ্বলে, স্ফূলিঙ্গ ছড়ায় সে ভাষার সঙ্কেত-চিহ্ণগুলো। কোনো শব্দ করে না সেটা, এমনকি তার সঙ্কেত-চিহ্ণগুলোও শব্দহীন ভাবে জ্বলে। সম্পূর্ণ জেগে থাকে ফাটোনা। অস্থিপোতের গায়ে খোদাই করা ভাষা দ্রুত ঝকঝক করে ঝলসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে শূন্যতার মধ্যে থেকে সেটা ভেসে এসেছে, সেটাও বেগুনি আলোয় ঝিলমিল করতে থাকে।
ঘুমন্ত চোখ খুলে অতিকায় আকারটাকে দেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে ওসুপার মানুষ। নীলচে-লাল আগুনে জ্বলে উঠে অস্থিপোতের পেটের মধ্যে ছিটকে যায় সর্বপ্রথম বেমিসোলা ওলোহান। জাহাজটা দেখে ফাঁদে পড়বার মত নড়াচড়া করতে, এমনকি চোখ বন্ধ করতেও অসমর্থ হয়ে পড়েছে যারা, তাদের মতো চিৎকার করে না সে। ভেসে উঠে যায় নীরবেই।
সে.. জাহাজে.. প্রবেশ ..করার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের গায়ের সমস্ত সঙ্কেত-চিহ্ণগুলো একই সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়ে আলোর তরঙ্গ ছড়িয়ে দেয় আকাশের বুকে। তারপর নিভে যায় সম্পূর্ণভাবে। জাহাজটা এবার ঠান্ডা কয়লার মতোই কালো।
জ্বলে ওঠে একটিমাত্র সঙ্কেত-চিহ্ণ, নিজের জগৎ থেকে উৎপাটিত হয়ে জাহাজের অন্তঃস্থলে যেতে যেতে চিৎকার করে ওঠে একজন মানুষ। ইতস্ততঃ দপদপ করে উঠতে থাকে সঙ্কেত-চিহ্ণগুলো, আগুনে জ্বলে উঠতে থাকে মানুষ, উড়ে যেতে থাকে অস্থিপোতে। ওসুপার কিছু মানুষ অবশ্য সুন্দর আগুনে জ্বলে উঠে ছাই হয়ে যায় জাহাজে উড়ে না গিয়ে।
আলোর সামান্যতম রেখাটুকু টেনে সবাইকে জাহাজের অন্তঃস্থলে উঠে যেতে দেখে ফাটোনা। প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে থাকে উদাস, নির্লিপ্ত ভাবে, ঠিক সেই মুহূর্তটা অবধি। সেই মূহূর্ত যখন তাদের একটি মাত্র হাহাকার বেরিয়ে আসে আর জ্বলতে জ্বলতে তারা উঠে যায় জাহাজের কালো শরীরে। কোনো বাছবিচার ছাড়াই অস্থিপোত গিলে নেয় সবাইকে – যুদ্ধ থেকে পালানো নারী, যুদ্ধ করতে অস্বীকার করা পুরুষ, শিশু যারা যুদ্ধের ক্ষতের কথা জেনেছে জীবনের অনেক পরে।
টলতে টলতে ফাটোনা পিছিয়ে যায় ফসল তোলা থেকে। যে মুহূর্তে সে বুঝতে পেরেছিল কি ঘটছে, তারও যে পালিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল তার সহোদরদের মতো, সে সিদ্ধান্তে তার মন বড়ো দেরিতে পৌঁছোয়। আয়োজোবি বলত বাবালায়োর পক্ষে তার হৃদয় বড়ো কোমল। আর তিনজন মাত্র পড়ে তারা – আকানাবির অভিভাভবক, একটা অনাথ মেয়ে যে মাটির মাথা বানিয়ে সেগুলোর সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসে, আর সে। সে দেখে, মেয়েটা এমন একটা চিৎকার করে ওঠে যে তার কান ঝনঝন করে ওঠে, আর তার পরেই তার শরীরে জিভ ছড়ায় সেই ক্ষুধার্ত আগুন যার ভেতরটা সাদা আর বাইরেটা নীলাভ লাল। আকাশে উঠে গিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যায় অস্থিপোতের মধ্যে। স্তুতির ভঙ্গীতে হাত তোলে আকানাবির মা। আগুন তাকে গ্রাস করে টেনে তুলে নেওয়ার সময় চিৎকার করে ওঠে সে।
ওসুপার চারপাশে তাকায় ফাটোনা। চতুর্দিক শূন্য। বিষাদে পূর্ণ হয়ে ওঠে সে, ভয় করে তার। ওপর দিকে তাকায় না সে বটে, কিন্তু মাটিতে আটকে পাক খেয়ে যায় এক চক্কর। তার মাথার ওপর নীরব থাকে অস্থিপোত।
আকানাবির কথা মনে পড়ে যেতে সে পা বাড়ায় দেবস্থানের দরজার দিকে। এই দুর্জ্ঞেয় ডাকাতির স্তব্ধতায় নিশ্চল সেটা।
যুগপৎ ঠান্ডা আর গরম একটা জোলোআগুন১৫ তার পেটের মধ্যে ফুটে উঠে হৃৎপিণ্ড অবধি বেয়ে উঠে বেরিয়ে আসে বন্যার মতো। ডুবে যায় তার চামড়ায়, মুড়ে দেয় তার দীর্ঘ সাদা চাদরকে। মাথা পেছন দিকে ছিটকে আবিষ্ট যন্ত্রণায় এমন তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে সে যে মনে হবে তার গলা যেন চিরে যাবে।
অসাড় হয়ে যায় সে, তার অন্ধত্বের মধ্যেই নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায় সে।
দুই
১
নিদ্রাহীন
ছিটকে খুলে যায় আকানাবির চোখ।
কাপড়ের পরত বিছানো বিছানার ওপর পাশ ফিরে সে দেখতে পায় যে সে একলা।
কমে এসেছে কুণ্ডের আগুন, কয়লাগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে ছাইয়ের চাদরের নীচে। বাতাস সম্পূর্ণ স্তব্ধ। আকানাবি শুনতে পায় তার শরীর থেকে পিছলে ঢুকছে বেরোচ্ছে নিঃশ্বাস।
কীসে তার ঘুম ভাঙিয়েছে মনে করার চেষ্টা করে আকানাবি। আকাশের কালো জাহাজ গ্রাস করে নিচ্ছে একের পর এক শরীর এটাই তার শেষ স্মৃতি। সমতল সবুজ জায়গাটায় তাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিল বেমিসোলা। একা একা সে ডাক দিয়ে দৃষ্টিপাত করেছিল চারপাশে, পাল্লা দিয়ে স্বপ্নটা ফেরৎ গিয়েছিল সেই নিষ্কলুষ, উজ্জ্বল প্রান্তরে। শ্বেত পোশাকের বিশাল মানুষটা আকাশে দাঁড়িয়েছিল তার দিকে করুণা মাখা চোখে তাকিয়ে, বস্ত্র তার সূর্যের মতো উজ্জ্বল। বিশাল মানুষটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর ঢেউ খেলতে শুরু করে বাতাসে, শূন্যতার কালিমা ছোপ ফেলতে শুরু করে স্বপ্নের বুনটে।
আরো একবার ফিরে এসেছিল বেমিসোলা, কিন্তু তখন তার ঠোঁটে আর গান নেই। তার পরিবর্তে শরীরগুলো অস্তিপোতে উঠতে উঠতে জ্বলার সময়ে কাঁদছিল সে। দুঃস্বপ্নটা কালো হাড়ের ক্ষতে ফেরৎ গিয়ে ক্ষত বুজে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছতেই এক লহমায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সে। তার উধাও হওয়াটা খেয়াল করেছিল আকানাবি, কিন্তু হাড়টা যাওয়া না অবধি সে ঘাড় ঘোরাতে পারেনি।
দেবস্থানে উঠে বসে আকানাবি। তার শরীরের সবকটা হাড় যেন একযোগে মটমট করে ওঠে। তীব্র বেদনা তার পেট থেকে ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে তার মাথা। কাতরাতে কাতরাতে মনে পড়ে যায় তার। বিশাল মানুষটি অবশেষে কথা বলেছিল তার সঙ্গে। বার বার বাজতে থাকা তার কন্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি পাক খেয়েছিল বৈচিত্রহীন আকাশ আর প্রান্তর জুড়ে। “উঠে পড়ো আকানাবি। অবিলম্বে তোমায় অনুসরণ করতে হবে তোমার লোকেদের।”
খুব কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায় আকানাবি। তার মাথা এক ভয়ানক যন্ত্রণার কবলে ঘুরপাক খেয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দেয়ার উপক্রম করে। সামনে ঝুঁকে ওয়াক তোলে সে। তার ওপর যে সাদা চাদর চড়িয়ে দিয়েছিল ফাটোনা তা তখনও রয়ে গেছে তার কাঁধে। ফোঁপাতে আরম্ভ করে আকানাবি, তার শরীরের অস্বস্তি অসহ্য বোধ হয়। কেঁপে ওঠে মাটি, সশব্দে, আর মাত্রই কিছুক্ষণের জন্যে। যেন একপাল হাতি ওসুপার মধ্যে দিয়ে দৌড়ে গেলো বুনো ইঁদুরের গতিতে।
সব ব্যথা ভুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় আকানাবি। বাইরে তখনও অন্ধকার। সামনে বেমিসোলার বিছানার দিকে এগিয়ে যায় সে, অবসন্ন শরীরে টলতে টলতে, দুলতে দুলতে।
ওসুপা যে খালি হয়ে গেছে সে কথা আকানাবির অজানা নয়। কিন্তু সেই বোধটার বাস্তবতাকে অনুভব করে, তার ফের ইচ্ছে হয় ঘুমিয়ে পড়তে। বাইরের রাত মুখব্যাদান করে অনিশ্চয়তায় আর বহিরাগত এই নতুন কম্পনে। দেবস্থানের একদিক থেকে আর এক দিকে পেরিয়ে যায় সে, একটা টলোমলো পা আর একটা পায়ের সামনে রেখে।
দেবস্থানে ঝোলানো নানা সাদা কাপড়ের ফালি, সুতোয় বাঁধা শিঙ আর দাঁত। কাঠ, চুন আর মাটিতে তৈরি তুকতাকের বস্তুর পোঁটলা দোল খায় ছাদে বাঁধা থলিতে। দেবস্থানের ঠিক মাঝখানের বেদীটা পেরিয়ে যায় সে। কাঠের ছিলকের ওপর ত্রিভুজের আকারে দাঁড় করানো তিনটে মূর্তি – হাল্কা সোনালি, কালো আর কালচে লাল রঙের কাঠের। তাদের হাঁটুর কাছে আরো কিছু তুকতাকের জিনিস, একটা সোনালি পিরামিড আর সাদা মার্বেলের কয়েকটা ঘনক। মূর্তিগুলো মোটা দাগে খোদাই করা, অতিরঞ্জিত তাদের চেহারার খুঁটিনাটি। মূর্তিগুলোর পাশে তুম্বা ভরা খড়িগোলা জল। বেদীর পেছনে ঝোলে পুরোপুরি কড়িতে ঢাকা একটা সাদা কাপড়। বেদীর পাশে পড়ে আকানাবির খোঁচা তোলা টুপিটা। নীচু হয়ে সেটা তুলে নেয় আকানাবি। দেবস্থানের মধ্যে দিয়ে এবার বয়ে আসা বাতাসে খটখট করে ওঠে কড়িগুলো। গন্ধ আসে মিষ্টি, চান না করা শরীরের, পচা মাছের আর বৃষ্টির পর মাটির।
টলমল করতে করতে বেদী পেরিয়ে ফুলে ওঠা কাপড়ের দরজার দিকে এগোয় আকানাবি। থেমে যায় ঠিক তার আগেই। কাপড়টা ওড়ে তাকে ঘিরে, বুকের মধ্যে তার হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করে সজোরে। বড়ো ওরিশা তাকে রক্ষা করছে কিনা, প্রশ্ন জাগে তার মনে। শক্তি প্রার্থনা করে সে, চোখ বোজে, তারপর এগিয়ে যায় সামনের রাত্রে।
ফের যখন সে চোখ খোলে, ওসুপা তার প্রত্যাশা মতোই জনশূন্য। দেবস্থানকে বেড় দিয়ে রাখা কুঁড়েগুলো ফাঁপা, আগুনের আলো আর মানুষের কথোপকথন অনুপস্থিত সেখানে। ভালো করে দেখে আকানাবি বুঝতে পারে মাথার ওপরের নিভু নিভু চাঁদের কমে আসা আলো কিছুটা আলাদা। অল্প সময়ের জন্যে কেন সশব্দে কেঁপে উঠেছিল মাটি, তা দেখতে পায় সে। মাটিতে একটা গর্ত, যেন খোলা মুখ, লাল, কালো আর ভেতরটা পিচ্ছিল। সেই মুখ বেয়ে উঠে আসছে ভারী কিছু। ধুপ, ধুপ, ধুপ, ধুপ।
ছোটো পায়ের শেষ ধুপ শব্দটা ওফিলিগাঙ্গাটাকে১৬ নিয়ে আসে মাটির পেটের বাইরে, যেখানে বোনেদের সঙ্গে বাস করে সে। ভালোভাবে ওসুপার জমিতে সে হেঁটে পৌঁছতেই তিন পা পেছনে হটে যায় আকানাবি। দৈর্ঘ্যে সে আকানাবির তিনগুণ বড়ো, প্রস্থে কোনো পূর্ণবয়স্ক গাছের মতোই। অধিক পেকে যাওয়া কমলালেবুর রঙের ভিজে চামড়া চর্বির পরতে পরতে ঝোলে তার চওড়া শরীর ঘিরে। কেঁচোর মতোই নগ্ন সে। তার ভারী চেহারাটাকে টেনে এনে অবশেষে থামতে থলথল করে আস্তে আস্তে কাঁপে তার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি। মাথা তার ন্যাড়া। চোখ আর মোটা মোটা ঠোঁট দখল করেছে মুখের দুটি অর্ধাংশ, তাদের মাঝে নাকটা কলমের নিবের মতো।
কী বলতে হবে আকানাবি বুঝতে পারে না। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন ..অনন্তকাল ধরে। এতক্ষণ যে আকানাবি বুঝতে পারে
ভোর আসছে। ওফিলিগাঙ্গার সরে সরে যাওয়া কালো কাচের স্বচ্ছ পুকুর চোখ দুটো বিচলিত করে তোলে আকানাবিকে। টুপিটাকে শক্ত করে চেপে ধরে আকানাবি, ক্ষুধার নতুন লহরের বান ডাকে তার শরীরে। হাতদুটো তুলে শরীরের দুপাশে ছড়িয়ে দেয় ওফিলিগাঙ্গা, দৃষ্টি তার তখনও আকানাবি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে। একটা তালিতে হাত দুটো একসঙ্গে নিয়ে আসে সে! শিউরে ওঠে বাতাস। আকানাবির হাড়গুলো বালির মতো মনে হয়, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে।
“খোকা। ন্লা ন্লা১৭ ডাকছে তোমায়।” উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে আকানাবি। কী হচ্ছে সে কিছু বুঝতে পারার আগে তার পেটই তাকে খেয়ে নেবে।
“শুনতে পেলে খোকা? নীচে চলো এবার।” গলা তার ভারী, খসখসে। আকানাবির মনে হয় সে যেন হঠাৎ ঘেরা পড়েছে ধোঁয়ায়। মাথা দোলায় আকানাবি। মাটির ওপরের পিচ্ছিল লাল মুখটার দিকে ফেরে ওফিলিগাঙ্গা, আকানাবির মাথার ওপর দোল খায় এক একটা পাথরের চাঁইয়ের মতো তার নিতম্ব।
“আমার পেছনে এসো।” তার গলার প্রতিধ্বনি ওঠে গহবরে, ধুপধাপ করে ভেতরে ঢোকে সে।
আবেটি আজা মাথায় গলিয়ে নিয়ে তার পিছু নেয় আকানাবি। ওফিলিগাঙ্গার পিছু পিছু পৃথিবীর পেটের মধ্যের চটচটে উষ্ণতায় পিছলে নেমে যাওয়ার আগে একবার দেখে নেয় ওসুপার শূন্য জায়গাটা।
২
অস্থিপোত
ওসুপা থেকে চুরি করে আনা শরীরের সংখ্যা পঞ্চান্ন। ভ্রূণের মতো কুঁকড়ে, অস্থিপোতের পেটের মধ্যেকার শূন্যতায় ঝুলতে থাকা স্বচ্ছ ডিমের আধারের মধ্যে আটকে থাকে তারা। প্রতিটি ডিমের গায়ে আটকে পড়া বিদ্যুতের মতো জ্বলতে থাকা শিরা উপশিরার আঁচড়। নিস্পন্দ মানুষগুলোর গলা অবধি গিয়ে মাথা পাক দিয়ে রাখে প্রতিটি শিরা। তাদের পুষ্টি যোগাতে অথবা.. আহার করতে করতে দপদপ করে তারা। তাদের শরীরের পোশাক ধীরে ধীরে রেণু রেণু হয়ে পরিণত হতে থাকে রঙীন মেঘে।
ওসুপার মানুষ ঘুমোয় না, স্বপ্নও দেখে না। এদিকে গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্রমা আর নক্ষত্ররেণুর ঘূর্ণি চোখের অজস্রতার মধ্যে দিয়ে সবেগে ছিটকে যেতে থাকে অস্থিপোত। প্রক্রিয়া আর বিশৃঙ্খলা, সম্ভাবনা আর শৃঙ্খলার সমুদ্রে একটি বালিকণার মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে তরঙ্গ আর দ্বারপথ বিদীর্ণ করে যেতে যেতে। সূর্যগ্রাসীদের সর্পিল অবয়বের তোলা স্রোত পাড়ি দেয় সেটা, পেরিয়ে যায় দূরের মণ্ডলীতে নীরবে ঝলসে ওঠা যুদ্ধের নিচ দিয়ে।
অবশেষে এতো তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করে যে মনে হয় যেন একবারে চলছেই না। জ্বলতে শুরু করে তার অবয়বের কালো কয়লা, অকল্পনীয় মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তিনটে মাত্র নিঃশ্বাসে ফাঁকে। আলোর গতিতে ছুটলেও কম্পিত হতে হতে গরমে সাদা হয়ে ওঠে একটা স্থির হয়ে দাঁড়ানো বিন্দুতে। তারপর অদৃশ্য হয়ে যায় সেটা। অথবা আদতে আলোর গতি থেকে সেটার উত্তরণ হয় চিন্তার গতিতে। থেমে যায় সমস্ত মহাবিশ্ব, অস্থিপোতের উড়ানের যাত্রাপথ আর সরলরেখা বরাবর থাকে না। চোখ ধাঁধানো গতিতে লাট্টুর মতো ঘোরে সেটা, মহাবিশ্বের শূন্যতায় খোদাই করে দেয় সাদা আগুনের বৃত্ত। মহাবিশ্বের শরীরের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে তার গতি হয়ে ওঠে আরো বন্ধুর, আরো এলোমেলো। চোখের নিমেষে পেরিয়ে যেতে থাকে একসঙ্গে বিশটা ছায়াপথ।
কিছুক্ষণ বাদে অস্থিপোত আচমকাই অস্তিত্ব থেকে উধাও হয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে।
৩
ওফিলিগাঙ্গার বাসায় আকানাবি
পৃথিবীর মধ্যের গলাটা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে সশব্দে নাম ওফিলিগাঙ্গা। আকানাবি হড়কে, পিছলে, ছুটতে থাকা দানবীর পেছনে যেতে যেতে বাতাস হয়ে আসে আরো জোলো, নানা চড়া গন্ধে আরো ভারী। তার পায়ের নীচে মাটি তখন কাদাতে ভিজে লাল। সুড়ঙ্গের অন্তিম প্রান্তে পৌঁছে লাফ দেয় ওফিলিগাঙ্গা। তার পেছন পেছন ঢাল দিয়ে হড়কাতে হড়কাতে একেবারে ঠিক সময়ে পৌঁছে আকানাবি দেখে হাঁ হয়ে যায় কেমন করে তার বিশাল ভার তুচ্ছ করে একটা বলের মতো শরীর গুটিয়ে একটা বিরাট কূপের মধ্যে পড়ে যায় ওফিলিগাঙ্গা। তাকে অনুসরণ করে আকানাবি, ছুঁড়ে দেয়া কোনো বস্তুর মতো কিনারা টপকে পড়তে থাকে শূন্যতার মধ্যে দিয়ে।
চিৎকার করতে চেয়েও করেনা আকানাবি। পৃথিবীর ভেতর একটা ফুটো দিতে পড়ার অনুভূতিটা তার পেটের কোমল উষ্ণতা চেঁচে তাকে করে তোলে শীতল আর ফাঁপা। মাথা নীচু করে পড়তে পড়তে মাথার আবেটি আজা চেপে ধরে থাকে সে, শ্লথ হয়ে আসে তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, বেড়ে যায় তার পেটের অসুস্থ শীতলতা। কিছু পড়ার ধুপ শব্দের বিরামহীন ভাবে বারংবার ছড়িয়ে যাওয়া প্রতিধ্বনি শুনতে পায় সে। বুঝতে পায় শব্দটা ছড়িয়ে যাচ্ছে একটা বিরাট গুহার মধ্যে দিয়ে। শক্ত জমির ওপর গিয়ে পড়েছে ওফিলিগাঙ্গা। নিজের শরীরটাকে ঘোরাতে, পাকাতে চেষ্টা করে আকানাবি, কিন্তু তার পড়ার বেগ এতই দ্রুত যে কেবল মাথায় হাতটাকে রাখা ছাড়া সেটা তাকে আর অন্য কোনো রকম নড়াচড়ার সুযোগ দেয় না।
আর একটা অনন্ত মুহূর্ত ধরে পড়ার পর আকানাবি হঠাৎ টের পায় মাটিটা ছুটে আসছে তার মুখের দিকে ধাক্কা খেতে। মাটি থেকে উঠে আসা মাথাটা থেকে এটা বুঝতে পারে সে। চিৎকার করতে আরম্ভ করে সে, সজোরে, ভেঙেভেঙে। কিন্তু আওয়াজ করতে করতেই একটা নরম ঢিপির সঙ্গে ধাক্কা খায় সে, তাকে চুপ করিয়ে দেয় সেটা।
ঢিপিটা তাকে ধীরে ধীরে টেনে নেয় এমন কিছুর মধ্যে যাকে মনে হয় গভীর, উষ্ণ আটার তাল, টাটকা কাদার চাইতেও নরম। আকানাবির চারপাশ ঘিরে ধরে সেটা, কিন্তু তাও তার পড়া শেষ হয় না, তার মধ্যে ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে সে। তারপর হঠাৎ পড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। সেই ভারী উষ্ণতা তাকে জড়িয়ে রাখে চারপাশ থেকে। সে শুনতে পায় একটা পরিচিত শব্দ ঘিরে ফেলছে তাকে। ডিম, ডিম, ডিম, ডিম, ডিম, ডিম। হৃৎস্পন্দন। ঢিপিটার বসে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তার ওপর দিকে ভেসে উঠে আসে আকানাবি, টের পায় তাকে ঘিরে রেখেছে চামড়া, সে ডুবে রয়েছে একটা বিশাল শরীরের মাংসের মধ্যে। উঠে বসার চেষ্টা করে সে, কিন্তু লাভ হয় না। শরীরটা অত্যন্ত নরম, ঠিক করে হাঁটু গাড়ার আগেই হাল ছেড়ে দেয় তার পা দুটো।
তার কোমর ধরে টান দেয় একটা হাত, তাকে হাওয়ার মধ্যে দিয়ে তুলে ফের রেখে দেয় শক্ত জমিতে। খানিক টলে স্থির হয়ে যায় আকানাবি। আলোকহীন যে কূপে সে পড়েছে তাতে ধীরে ধীরে সয়ে আসে তার চোখ। সে দেখতে পায় অজস্র খুব নিভুনিভু আগুন জ্বলে তার চারদিকে ঘুমিয়ে থাকা শরীরে। ডিম, ডিম, ডিম, ডিম স্পন্দন হয় তাদের মধ্যে। একটা ওফিলিগাঙ্গার বাসা। তার চারপাশে সাদা কালোর পরতে পরতে তাদের বিশাল গাবদাগোবদা শরীরগুলো লাঙল দেয়া পাহাড়ি উপত্যকার মতোই ওঠা নামা করে।
“চলে এসো খোকা।” যে ওফিলিগাঙ্গা তাকে নিয়ে এসেছে তার সামনেই দাঁড়িয়ে সে। চারপাশে পড়ে থাকা শরীরের স্তূপের মধ্যে থেকে তাকে আলাদা করে চেনা দায়। এখানে পৃথিবীর ভেতরে তার স্বর যেন আরো গভীর।
“খোকা আওয়াজ কোরো না, তা হলে বোনেরা উঠে পড়বে আর তোমার মোটেও সেটা পোষাবে না।” মাথা দোলায় আকানাবি।
“খোকা কোথায় পা দিচ্ছ খেয়াল রেখো।”
চারপাশের শরীরগুলোর উষ্ণতায় মানিয়ে নিতে থাকা তার নিজের শরীরটা আস্ত আছে কিনা দেখে নেয় আকানাবি। যথাস্থানে বসানো আছে তার আবেটি আজা, আর ওসুপাতে সে জেগে উঠেছিল যে সাদা চাদরের নীচে, সেটাও জড়ানো তার কাঁধ আর গলার চারপাশের।
“বহুদিন আমরা খেলনা দেখিনি।” বলতে বলতে, ঘুমন্ত ওফিলিগাঙ্গাদের শরীরের বানানো পথ দিয়ে মার্জারের মতো সামনের দিকে হাঁটে ওফিলিগাঙ্গা। সম্পূর্ণ নীরব তার পায়ের শব্দ।
অনুসরণ করে আকানাবি। ঢেউ খেলে যাওয়া মাংসের গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বাড়তে থাকে চারপাশের শরীরগুলো। সংখ্যায় তারা শত শত। তাকে যে নিয়ে এসেছে তার কাছে এটা স্বাভাবিক মনে হলেও তার কাছে এ যেন হাত পা আর নিতম্বের এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা, যেন ঘুমন্ত চামড়ার এক সৌধ।
খানিক বাদে তাদের উষ্ণতাকে পাশ দিয়ে সবেগে বয়ে যাওয়া এক অদৃশ্য নদীর মতো মনে হয় আকানাবির। খুঁটিনাটি সামান্যই দেখতে পায় সে, বুঝতে পারে না সে হাতের আঙুল দেখছে, না পায়ের আঙুল, না বুজে থাকা চোখ। সে দেখতে পায় নড়তে থাকা পেটে আর শুনতে পায় নিশ্বাসের শোঁ শোঁ শব্দ।
থেমে যায় ওফিলিগাঙ্গা। বাসার শরীরের বানানো লম্বা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে তারা হাজির হয়েছে একটা খোলা জায়গায়। এখানে এই বৃত্তে দানবীদের শরীরের বিন্যাস আরো গোছানো আর পরিচ্ছন্ন। খোলা জায়গার ঠিক মাঝখানে বসা কয়লার মতো কালো চামড়ার পাঁচজন ওফিলিগাঙ্গার একটা দলের হাত পাল্টায় ডিম ডিম ডিম ডিম শব্দ করা একটা কমলা রঙের আগুন। দানবীরা তাদের হাতে ধরা আগুনটাকে আগুনে-লিলির স্তবকের মতোই আলিঙ্গন করে, চুম্বন করে। যে ওফিলিগাঙ্গা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে আয়তনে তারা তার দ্বিগুণ বড়ো, আর তাদের শরীরগুলো একইসঙ্গে যেন আরো নরম আর আরো শক্ত। কুঁকড়োয় না, ফোশ্কা তোলে না, ভাঁজ হয় না তাদের নিঁখুত ভাবে মসৃণ আর কেশহীন চামড়া। তাদের মাঝখানে হেঁটে যায় যে ওফিলিগাঙ্গা আকানাবিকে নিয়ে এসেছে।
“কী চাই ছোটো বোন? তুমি ভালোই জান যে উষ্ণতার সময়ে বৃত্ত ভাঙতে নেই।” প্রশ্ন করে জড়ো হওয়া ওফিলিগাঙ্গাদের একজন।
“ছেলেটাকে নিয়ে এসেছি, ওপর থেকে।”
“কোথায় সে?”
অল্পবয়স্ক ওফিলিগাঙ্গা আকানাবিকে ঠেলে দেয় খোলা জায়গাটার মাঝখানে। হাতে হাতে আগুন পাল্টাতে পাল্টাতে সেখানে দানবীদের চামড়া চকচক করে।
“কাছে এসো।”
এগিয়ে যায় আকানাবি, দেখতে পায় তাদের চোখের আগুন।
“ঘুমন্ত খোকা, “আকানাবিকে পরীক্ষা করতে করতে বলে বয়স্ক ওফিলিগাঙ্গা, “তোমার পিতা অপেক্ষা করছেন পৃথিবীর মধ্যে। খোঁজো গিয়ে তাকে। আমাদের শরীরকে ব্যবহার করো।” ঠোঁটের মধ্যে উধাও হয়ে যায় আগুন। কামড়ানোর আর শীৎকারের শব্দ ছড়িয়ে যায় একজন থেকে আর একজনে। আগুন খাচ্ছে ওফিলিগাঙ্গারা।
দেখতে পায় না এমন কিছুর টানে সামনের দিকে সরে যায়া আকানাবি। এসে পড়ে কুঁড়ের মতো উঁচু দুটো উরুর মাঝে। যেখানে তারা পরস্পরের ওপর ঠেস দিয়ে সেখানে খুলে যায় একটা কালো গুহা। হাঁটু গেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে শূন্যতায় প্রবেশ করে আকানাবি।
আগুন খেতে থাকে ওফিলিগাঙ্গারা আর আকানাবি গিয়ে পড়ে একটা গর্তের মধ্যে।
৪
চিন্তাগতি থেকে চুপচাপ এক অনন্ত সমুদ্রে বেরিয়ে আসে অস্থিপোত। নিথর সে সমুদ্র খাঁটি বৃক্ষরসের মতো সাদা। মাপাজোপা গতি বন্ধ হয়ে যায় অস্থিপোতের, ভাসতে ভাসতে পাক খেতে আরম্ভ করে সেটা। সাদার মধ্যে নড়ে না কিছুই। আসে না কোনো শব্দ।
শ্বেত সমুদ্রের কেন্দ্রে ভাসে এগারোটা শরীরের একটা বৃত্ত। তৈরি তারা কর্কশ করাতের মত হাড়ে, মাথার জায়গায় তাদের বসানো মুকুট, যেন ডালপালা ছাড়া হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়া মৃত গাছ। মুখ নেই তাদের, তার বদলে মুকুটের নীচে তাদের পরানো রয়েছে লম্বা লম্বা গজাল থেকে বানানো অর্ধগোলক। তাদের মধ্যে দপদপ করে উজ্জ্বল বেগুনি আলো। চোখ ধাঁধানো সূর্য বসানো তাদের জায়গায়, তাদের আলোও অতিবেগুনি বর্ণের। বড়ো বড়ো হাড়ের তক্তি আর অজস্র গজাল আর আঁশে ঢাকা তাদের হাত-পা অকেজো হয়ে ঝোলে।
এরা মূক তস্কর, আর ওই শ্বেত সমুদ্র এদের মনোভূমি।
যেন অনন্তকাল ধরে ভেসে অস্থিপোত অবশেষে ধরা দেয় সমুদ্রের নীচে, একমাত্র গতিতে, তস্করদের ঘিরে পাক খেতে থাকা বৃত্তের মধ্যে বৃত্তাকার আবর্তে। তস্করের মাথার অষ্টমাংশের আয়তনের তাদের শরীরের কণ্টকমিনারকে ঘিরে ভাসতে ভাসতে অবশেষে সেটা চুপচাপ ঢুকে পড়ে তাদের কেন্দ্রে, যেখানে বসানো সমুদ্রের চোখ। এইবার এখানে আটকে যায় অস্থিপোত, স্থির হয়ে যায় ছবির মতো।
তস্করদের মুখের লম্বালম্বি অর্ধগোলকগুলো এবার দ্রুত ঝলসে উঠতে শুরু করে। প্রতিটি তস্কর সৃষ্টি করে ঝলসে ওঠার আর দপদপ করার আপন আপন নকশা। কথা বলে তারা নিজেদের মধ্যে আর অস্থিপোতের সঙ্গে। তার মালিকদের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে, অস্থিপোতের চামড়া চকচক করে ওঠে, ফোশ্কা দিয়ে ওঠে জ্বলন্ত সঙ্কেতচিহ্ণে।
ঝলসানো বন্ধ হয় তস্করদের মুখে। এগারোটা ভাগে ভেঙে টুকরো হয়ে যায় অস্থিপোত। যে সব ডিমের মধ্যে হতচেতন অবস্থায় পড়ে ওসুপার অধিবাসীরা, তারা আস্তে করে পড়ে যায় সমুদ্রের দুধে। অস্থিপোতের টুকরোগুলো ভেসে যায় এগারোটা দিকে। তস্করদের মুখাবয়বে যেখানে মুখ থাকার কথা, প্রত্যেকটা ঢুকে যায় সেখানে।
সমুদ্রের মধ্যে একান্নটা ডিম ঘিরে ফেলে পরস্পরকে, ধাতুর ওপর চুম্বকের মতো আটকে গিয়ে তৈরি করে একটা গুচ্ছ। আবার তাদের মুখ ঝলসাতে আরম্ভ করে মূক তস্করেরা, আর শুদ্ধ আলোর সরু রেখা তাদের
বুক থেকে ছিটকে এসে ডিমগুলোকে ঢেকে দেয় এক অন্তিম আগুনে।
ভেঙে খুলে যায় ডিমগুলো। থোকা অবস্থাতে বেরিয়ে আসে মানুষগুলো, অস্থিহীন, নগ্ন অবস্থায় ভাসে সদ্যজাতের মতো। বন্ধ থাকে তাদের চোখ। তাদের গুচ্ছ থেকে ভেসে বেরিয়ে এসে তস্করদের হৃদয়ে জ্বলতে থাকা একটা সূর্যের দিকে ভেসে যায় বেমিসোলা ওলোহান। ক্রমশ ছোটো হতে থাকে সূর্যটার কাছে যেতে যেতে, অবশেষে একটা কণার মতো আয়তন হয়ে সে হারিয়ে যায়, গ্রাস করে নেয় তাকে অতিবেগুনি।
***
নীল আকাশে ভাসা একটা ঘনকের ওপর বসে বেমিসোলা ওলোহান। নীচে কিছু নেই তার, চারপাশে শুধু নীলচে সবুজ বর্ণ। তখনও নগ্ন সে, কিন্তু তার সামান্যটুকু পরোয়া নেই তার। দৃষ্টি তার আটকে সামনে এগিয়ে আসতে থাকা একটা মেঘের স্রোতের দিকে। আসতে আসতে যেন সাপের মতো নাচে সরু লম্বা মেঘটা। তার প্রতিবার চোখের পলক ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আরো কাছে এগিয়ে আসে মেঘটা। অবশেষে এসে পড়ে সেটা তার সামনে, আর তার পরিচ্ছন্ন কুয়াশা স্নান করিয়ে দেয় তার শরীর। চোখ বন্ধ করে ফেলে বেমিসোলা, বুঝতে পারে তার প্রতিটি কোষ, প্রতিটি স্নায়ু গেয়ে উঠছে পরমসুখে। সে যখন চোখ খোলে, মনে হয়ে যেন সে তাকাচ্ছে আয়নার মধ্যে।
“তুমি কোথায় মনে হয়?” নিজেকে প্রশ্ন করে বেমিসোলা। কন্ঠস্বর তার নীচু, দৃষ্টি তার শান্ত। সে যা দেখতে পায় তার চাইতেও  ক্লান্ত আর বয়স্ক দেখায় তাকে।
“শেষ যা মনে আছে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। তারপর আমার ঘুম ভাঙল আর আকাশটা খেয়ে নিল আমায়। এটা কি আর একটা স্বপ্ন?”
“তুমি ক্যানেটিস নিক্স-এ১৮ আছ,” একটা কন্ঠস্বর তাকে বলে। “আমরা ক্যানেটিক্স নিক্স। তোমাদের শরীরগুলো আমাদের দরকার, তাই তোমাদের নিয়ে এসেছি এখানে।”
“এর মানে কী? এখানে তোমাকে নিয়ে এসেছি? এটা কি স্বপ্ন নয়?”
“তুমি ঘর থেকে অনেক দূরে, বাছা,” উত্তর দেয় কন্ঠস্বর, “তোমরা যাকে শব্দ বলো তার জন্যে তোমাদের কন্ঠগুলো আমাদের দরকার, কারণ এই শব্দ আমরা নিজেরা সৃষ্টি করতে অসমর্থ।”
“আমায় যেতে দাও।” বেমিসোলা বলে। শরীরটা নাড়ানোর চেষ্টা করে সে, কিন্তু পারে না, “এখানে কী হচ্ছে আমাকে বুঝতে হবে।”
“এর আগে অনেক কিছু ঘটে গেছে, এর পরেও অনেক কিছু ঘটবে। স্বপ্নের দৃশ্যপটের মধ্যে দিয়ে তোমাকে দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে কী করতে হবে, কিন্তু তোমাদের দুনিয়ার আদিবাসী এক উজ্জ্বল সত্তার উপস্থিতি আটকে দেয় আমাদের।”
“আকানাবি?” বেমিসোলা খেয়াল করে তাকে অতদিন বন্দী করে রাখা স্বপ্নটা তার তখনও মনে আছে। তার মনে আছে সে ছেলেটার কথা যার সঙ্গে স্বপ্নটা ভাগাভাগি করে নিয়েছিল সে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করার আগে কি হয়েছিল তার ওপর মনটাকে ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করতে স ধোঁয়াটে লাগে। ওসুপা বলে একটা জায়গা। সে কি সবসময় স্বপ্ন দেখছিল? সে শরীরধারণ করলই বা কী ভাবে?
আকাশে যেখানে সূর্য না থাকলেও আলো দিনের মতোই, সেখানে ক্যানেটিস নিক্সের মুখ নড়ে, দেখতে পায় সে।
“হ্যাঁ, সে সেই সত্তার। সত্তা তার সঙ্গে স্থূলদেহে যোগাযোগ করা চেষ্টা করে ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন তোমার সঙ্গে আমরাও একই চেষ্টা করছিলাম।”
“কেন?”
“কন্ঠস্বরগুলো। তোমাদের কণ্ঠস্বরগুলো আমাদের প্রয়োজন। আমাদের জীবজন্তু মজুত করার জন্যে সঠিক একটা জগৎ খুঁজে পেয়েছি আমরা। কিন্তু সেটা আকারহীন, ধুলোয় পরিপূর্ণ। কেবল এই শব্দই তাকে ফের আকার এনে দিতে পারে।”
“কন্ঠস্বর…গুলো?”
“উপস্থিত আছে তোমার প্রজাতির আরো সদস্য। এই জগতটাকে ফের আকার দিতে আমাদের একটার চাইতে বেশি সুর চাই।”
“তোমাদের যদি সাহায্য করি আমরা কি কোনোদিন ঘরে ফিরতে পারব? নাকি এখন আমরা তোমাদের দাস?”
“কী অদ্ভূত একটা শব্দ! ক্যানেটিস নিক্স এইরকমের নিয়মের আওতায় কাজ করে না। তোমাদের কাজকে একটা ধার করা শারীরযন্ত্র হিসেবে মনে করো। ওই কাজটা হয়ে গেলে তোমাদের ফেরৎ দিয়ে দেয়া হবে।”
“মানে আমাদের তোমার নিয়ে এসেছ আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, যেমন খুশি ব্যবহার করা জন্যে।”
“আমরা তোমাদের নিয়ে এসেছি মিলনসঙ্গমে তোমরা নেতৃস্থানীয় বলে, তোমাদের কণ্ঠস্বর যেখানে যাবে, বাকিরাও অনুসরণ করবে তাদের।”
আবেগের একটা গিঁট তার বুকের মধ্যে জট পাকায় টের পায় বেমিসোলা। তার সামনের জিনিসটার মতো নিস্তরঙ্গ থাকে তার মুখ, যেন আয়নার প্রতিফলন। ঘনকের কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে দুজনেই। বুক চাপা দিয়ে হাত রাখা হৃদয়ের ওপর। পিঠ তাদের ঋজু, চোখ বড়ো করে খোলা। একজনের চোখে বিভ্রান্তি, অন্যজনের চোখে শীতল বুদ্ধি।
“দয়া করে যেতে দাও আমাদের। আমরা এখানে থাকতে চাই না। দয়া করে…”
“তুমি কী করে জানো তুমি কোথায় থাকতে চাও? তুমি তো সেটা এখনও  দেখনি। তোমাদের এই শব্দের ক্ষমতা তুমি এখনও  অনুভব করনি। তোমাদের নবীন প্রজাতিকে তোমাদের স্রষ্টাদের
 স্বপ্নের অতীত এক উদ্দেশ্য পূরণের সুযোগ দিচ্ছি আমরা। তুমি আর তোমার সঙ্গী মানুষদের থেকে তৈরি করছি আমরা এক নতুন আকারের স্থাপত্য।”
প্রতিফলিত বেমিসোলা ওলোহান উঠে দাঁড়ায় ঘনকের ওপর।
কণ্ঠস্বর বলে “আমাদের সঙ্গে এসো, মহিমাণ্বিত হও।” পেছন দিকে পড়ে যায় ক্যানেটিস নিক্স, আকাশের নীলিমা নিয়ে যায় তার সঙ্গে।
৫
ওরিশার উপহার
দু’হাতে খুলতে থাকা একটা ঠান্ডা, কাদা চটচটে সুড়ঙ্গ দিয়ে হামা দেয় আকানাবি। সেই আলোকহীনতায় ভুগর্ভের মাটির নরমের মধ্যে ঢুকিয়ে তাকে ছিঁড়ে আলাদা করতে করতে অসাড় হয়ে আসে তার আঙুলগুলো। সে দেখতে পায় তার মাথার ওপর আগুনকে হাত থেকে হাতে থেকে দিতে দিতে তার ভাগ্য নিয়ে কথা বলছে সম্পূর্ণ স্থূল ওফিলিগাঙ্গারা। তাদের গোল গালগুলো জানিয়ে দিচ্ছে তাকে ওসুপা থেকে নিয়ে যাওয়া মানুষদের বাঁচাতে হবে। বেঁচে থাকতে হলে, উদ্ধারের কাজ আরম্ভ করতে হলে পৃথিবীর পেটের আরো গভীরে যেতে বলে তারা তাকে। মানুষের পক্ষে যে কোনো কাজ একেবারে ঠিক করে অসম্ভব, সে কথা বলে দুষ্টুমির হাসি হাসে তারা।
নিঃশ্বাস ফুরিয়ে থামে আকানাবি। ওসুপার ঝড়ের রাত্রে সে যে সোকটোটা১৯ গায়ে চড়িয়েছিল, তা পরা তার শরীরের নিম্নভাগে। হারিয়ে গেছে তার আবেটি আজা। সে ঝিমোয় আর মাটি খোঁড়ে, ঝিমোয় আর মাটি খোঁড়ে, এবং অবশেষে নিঃশ্বাস নিতে থাকে ছন্দে ছন্দে।
***
সুড়ঙ্গ থেকে বার হয়ে আকানাবি পড়ে একটা সাদা ঘরের মধ্যে যা ওলোডুমারে ইলে আই২০ সৃষ্টি করার সময় থেকে আছে। মানুষ আর জন্তুদের বিভিন্ন প্রজাতির সাদা করে তোলা শিরদাঁড়ায় তার দেয়াল সাজানো এমন এক সর্পিল নকশায়, যে চোখ ভুল করে তাতে গতি দেখে। নিহারীকা পাক খাওয়া একটা নীলচে লাল মাদুর পাতা ঘরের মাঝখানে। পবিত্র আগুনে জ্বলে পাহাড়ের মতো কড়া সাদা কাপড়। পবিত্র আগুনের রঙ জলের মতোই নীল।
ঘরের তলা বেয়ে পরিচ্ছন্ন তরঙ্গে বয়ে যাওয়া ছড়ানো সাদা বালিতে তার খুলিটা ধাক্কা খেতে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে ওঠে আকানাবি। ডেলা বাঁধা মাটির একটা আচ্ছাদনের নীচে থেকে শীতল কাঁপুনি যেন ছিঁড়ে খায় তার মেরুদণ্ড আর পেট।
উজ্জ্বলতার দিকে তিন কদম এগিয়ে ধ্বসে পড়ে সে মাটিতে। একটা ছায়া দোল খায় ঘর জুড়ে, যেন একটিবার হাত নাড়া বাহু, আর খুলে যায় উজ্জ্বলতা।
জ্বলতে থাকা কাপড়ের মধ্যে নড়ে ওঠে কিছু। সেই কড়া কাপড়ের খড়খড়ির মধ্যে দিয়ে পার হয় একটা আকার। এক চিলতে কালো মাংস, নীল সোনালি একটা চোখ, মেঘ টেনে আনা একটা হাত।
“আকানাবি,” ফিসফিস করে একটা কণ্ঠস্বর। আগুনে কাপড় দপদপ করে ভারী প্রতিধ্বনিতে, “উঠে পড়ো আকানাবি। উঠে দাঁড়াও। কাজ করতে হবে আমাদের।” সিংহের চিৎকারের থেকে নীচু আর গভীর হলেও সে কণ্ঠস্বর ধরে রাখে তার উষ্ণতা।
চোখ ..খুলে ..আবার ..উঠে দাঁড়ায় আকানাবি। ফিরে আসে তার কাঁপুনি। সে টের পায় তার প্রতিটি নিঃশ্বাস লড়াই করছে ফুসফুসে থাকার জন্যে। পাক খায় ঘরটা, সাপের মতো পিছলে যায় মেরুদণ্ডগুলো।
“তাড়ি নাও।”
ওবাতালার চোখ দেখতে পায় আকানাবি, তাকে অনুসরণ করে ওরিশার সামনে হাওয়ায় কালো হয়ে ভাসতে থাকা একটা ফেনা উপচে পড়া শিঙা অবধি। হাঁপাতে হাঁপাতে সে নিজেকে টেনে তোলে শিঙা পর্যন্ত। তার কিনারায় ঠোঁট লাগিয়ে টান দিতে থাকে একটা খালি শব্দ পৃথিবীর অভ্যন্তরে সেই সাদা ঘরে বেজে না ওঠা অবধি।
“দেখো।” ওরিশাটি দাঁড়িয়ে তার পেছনে। তাড়ি তার ভেতরের ওপর-নীচ ভালোবাসার উষ্ণতার মতো বান ডেকে বয়ে যেতে ফিরে দেখে সে। সে দেখতে পায় এক কয়লা কালো এশিনেমির২১ ওপর সে সওয়ার হয়ে ছুটে চলেছে আকাশ ভরা তারার মধ্যে দিয়ে, বাতাসে সোনালি দাগ টেনে।
“রনকেতে২২ চড়ে আমাদের তস্করদের সাদা ঘর অবধি তোমাকে সওয়ারি করতে হবে। সেখানে হয়তো তোমার লোকেদের শেকল তুমি ভাঙতে পারবে।”
সবেগে মাথা নাড়ায় আকানাবি। তার গালে ওরিশার আঙুল তাকে পৌঁছে দিয়েছে এমন এক নিস্তব্ধতায় যা যেন তার নোঙর খুলে দিয়েছে। ফের নিজের সম্ভাবনা টের পায় সে।
হয়তো ইফের আগুন তাকে নিয়ে এসেছে এখানে, ওলোডুমারের এক অংশভাবের উপস্থিতিতে, তার গালের ওপর যার বুলিয়ে দেয়া হাত তাকে ভরে তুলছে এমন সব আবেগে যার কোনো শব্দ নেই। রোনকের কথা জিজ্ঞেস করে আকানাবি।
“ওই এশিনেমি? তোমার বোধগম্যের বাইরে ওটা। ভালোভাবে চড়ো ওতে, আর কথা বলা আরম্ভ করলে পালিয়ে যেও না।”
“আমি কেন?”
তার গাল থেকে সরে যায় ওবাতালার হাত। মেরুদণ্ড, মাদুর আর উজ্জ্বলতা সমেত উধাও হয়ে যায় সাদা ঘর। ইরোকো গাছ ধরতে পারে এমন একটা উঁচু সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে আকানাবি। হাতের তালুতে তার ধরা একটা সাদা পাথরের মূর্তি, আর বহুদুরে জ্বলে আগুনের প্রান্তর।
তিন
১
গায়িকা
যে চিন্তার সমুদ্রে মূক তস্করদের বাস, সেখান থেকে শূন্যতা আর তারাদের কালো ঝকমকানির মধ্যে দিয়ে উড়িয়ে আনা ওসুপার একান্নজন মানুষ ইলে আয়ি থেকে তাদের ক্যানেটিস নিক্সের আবহাওয়ায় এনে ফেলা অস্থিপোতের বাইরে ভেসে আসে। নামতে নামতে ধীরে ধীরে ধীরলয়ে ঘুরন্ত একটা হাড়ের চক্রের ওপর নগ্ন, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা সবাই। তাদের মাথার চারপাশে বেড়ে ওঠে অনচ্ছ ঝিল্লী, রামধনুর আভা লাগা বাল্ব্-এর মতো, তাদের নিঃশ্বাস নেওয়ার আর তাদের কন্ঠস্বরকে বাড়িয়ে তোলার জন্যে।
ক্যানেটিস নিক্সের আলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বায়ুমণ্ডল পূর্ণ করে রাখা তরঙ্গায়িত কুয়াশাকে মনে হয় যেন গোল হয়ে পাক খেতে থাকা শুদ্ধ আলোর চাদরের মতো।       
 হাড়ের মঞ্চ থেমে যায় মাটি থেকে একফুট ওপরে। সেখানে মাটিতে থাকাটা যেন সীমাহীন এক সাদা বালুকা বেলার ওপর থাকা, যা তার চাইতেও সাদা বালির এক সমুদ্রের সংলগ্ন। এক নিস্তব্ধতা ভরিয়ে রাখে বাতাস। সে নৈস্তব্ধ যেন নিয়ন্ত্রণ করে বাতাসকেও। কারণ ওপরের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে পেছনে না হটে কেবল বিরামহীন ভাবে আছড়ে পড়তে থাকার মতো ঢেউয়ের একটা দূরের শীতল গর্জন থাকলেও মাটিতে কোনো নিঃশ্বাস পড়ে না।
মঞ্চ থেকে প্রথমে নেমে আসে বেমিসোলা ওলোহান। তার শরীর স্থূল, ত্বক বল্কল ছাড়িয়ে নেওয়ার মতো মসৃণ। তার পিঠে, যেখানে কাছাকাছি এসেছে কাঁধের হাড়, মিহি চুনাপাথরে তৈরি কাঁটা কাঁটা খোলাযুক্ত জলজ প্রাণীর মতো কিছু একটা আটকানো তার মেরুদণ্ডে। চব্বিশটা গাঁটে গাঁটে ভাগ করা উপাঙ্গ অনুসরণ করে তার পাঁজর আর উরুর অস্থির ধারা, হুল বিঁধিয়ে রাখে চামড়ার আধ ইঞ্চি নীচে। গলায় শুরু হয়ে উরুসন্ধির ভেতরে শেষ হওয়া এক ছুঁচালো ডিম্বাকারে এসে থামে তারা। কন্ঠার হাড়ের ওপরে চিমটি কেটে রাখে দুটো উপাঙ্গ, ঠিক কণ্ঠমণির নীচে।
ক্যানেটিস নিক্সের রেণুতে পা দেয় বেমিসোলা ওলোহান, প্রতি কদমে তার পা ডুবে যায় গোড়ালি অবধি। চিন্তা করতে থাকে যেমন সে করে করে এসেছ বিদ্যুতের আঘাত পড়া অবধি, এ সব কিছুই স্বপ্ন কিনা। তার পিঠের ওলোরিন২৩ তার শরীর জুড়ে শক্ত করে সেটার মুঠি, হোঁচট খেয়ে বুক আর কোমরের মাঝের অংশ ধরে রাখে বেমিসোলা। তার মধ্যে কিছু গড়িয়ে পড়ে, বেড়ে ওঠে- তার শরীরের বেঁধা হুলের আগায় জ্বলা বিষগুলো খালাস করে দিচ্ছে তাদের বিষাক্ত রসায়ন।
ওলোরিন থেকে বেরনো বিন্দুর ধারা এসে পড়ে রক্তস্রোতে, বেমিসোলা অনুভব করে নিজের মধ্যে দিয়ে সেটাকে বয়ে যেতে। তারপর অনুভব করে তার ত্বক আর হাড়ে শিহরণ। সেই ব্যথাকে একটি বিন্দুতে একত্রিত করলে তা পালানোর চেষ্টা করে, মহাশূন্য থেকে টেনে আনতে চেষ্টা করে নতুন জিনিস। বিষাক্ত রসায়ন বেমিসোলার বুকে শিহরিত হয়ে ওঠে এমন উল্লাসে যার প্রতিধ্বনি হয় তার সমস্ত ত্বক জুড়ে।
আনন্দের গান গাইতে শুরু করে বেমিসোলা। ক্যানেটিস নিক্সের ওপরদিকের বায়ুমণ্ডল পূর্ণ হয়ে ওঠে গমগমে প্রতিধ্বনিতে। প্রতিক্রিয়া জানায় সেটা বেমিসোলার পরিষ্কার উঁচু কণ্ঠের আর যেভাবে সে গলার বদলে পেট থেকে গানটাকে টেনে আনে তার। তাকে ঘিরে থাকা বাতাসে জড়ো হতে থাকে কম্পন। যখন বেমিসোল স্বরগ্রামের একেবারে তলদেশে পোঁছে যায়, কম্পনগুলো খুলে যায় বাতাসে। ওসুপার বাকি চুয়ান্নজন মানুষ দেখতে পায় মিহি বালির লতা পাক খায় তাকে ঘিরে, তার চাইতে লম্বায় চওড়ায় দশগুণ বড়ো যে শব্দগোলকের কেন্দ্রে সে দাঁড়িয়ে, দেখিয়ে দেয় তার অবয়ব রেখা। ডুবে যায় তার পায়ের চারপাশের সাদা রেণু। যে হাড়ের মঞ্চ তাদের নিয়ে এসেছিল তার মত চওড়া এক বৃত্ত। খাদের স্বর থেকে স্বরগ্রামের আরো ওপরের স্তরে উড়ে যায় বেমিসোলা, যেন মৃত্যুমুখী পাখি। বালির কণা অনুসরণ করে তার কণ্ঠের শব্দ আর গুঞ্জন, পেশীর মতো লেপ্টে, তরঙ্গায়িত হয়ে, পেঁচিয়ে যায় গানের কম্পনের চারপাশে।
গান শেষ করে সামনে এগিয়ে যায় বেমিসোলা, ফেরৎ আসে তাদের লোকেদের সঙ্গে দাঁড়াতে। তার প্রতিধ্বনি হতে থাকে যেন এক অনন্তকাল ধরে। পেছনে তার দাঁড়িয়ে এক গোলকের মতো আকার, সুতো আর মোটা পেশীতে তৈরি ফাঁপা বলের মতো।
দাঁড়িয়েই থাকে স্থপতি। পেছনে ঘুরে তাকায় আকারটার দিকে। তার রক্তের আনন্দ তাকে হাসায়, যদিও যে গোলকের মধ্যে থেকে সে এখনই ..বেরিয়ে ..এসেছে তার দিকে তাকালে তার নিজের বাইরে থাকার
জোরালো অনুভূতি হয়।
দেখতে দেখতে বুঝতে পারে চুয়ান্নজন মানুষও। শব্দ আর এই জায়গার পদার্থ যেন চুম্বক আর লোহা, হাত আর মাটি। ছটফটিয়ে ওঠে তাদের পিঠের ওলোরিন, বিষের উল্লাস ভরিয়ে তোলে তাদের পেট। হাড়ের মঞ্চ থেকে নেমে পড়ে তারা, শব্দের গতিতে সেটা মিলিয়ে যায় আবহাওয়া মণ্ডলে। হেঁটে যায় তারা বেমিসোলা ওলোহানের কাছে। সে তখন দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আকারটার দিকে, খোদাই করা বালিতে পড়তে থাকে নিজের কথা।
মিলনসঙ্গমের মানুষের চারপাশে গড়ে ওঠে বৃত্ত, শুরু হয় প্রথম সমবেত সঙ্গীত।
২
রনকে
নীল আগুনের যে সব প্রান্তর গেছে পৃথিবীর কেন্দ্র অবধি, ওবাতালার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া তাড়ির কল্যাণে তারা ঝলসে দেয় না আকানাবিকে। কিন্তু তাও তাদের মধ্যে দিয়ে ভয়ে ভয়ে হাঁটে সে, মাটি ঢাকা ভাঙা কয়লার ওপর এমন করে পা রাখে যেন সেটা তাকে পুড়িয়ে দেবে। মাইলের পর মাইল জুড়ে কিছু নেই, কেবল কঠিন, কালো পাথর থেকে বেড়ে ওঠা ঘাসের মতো আগুন। ওপরে কোনো আকাশ নেই, মেঘ নেই। শুধু নীচের প্রান্তরের আভার প্রতিফলন। আগুন থেকে ধোঁয়া বেরোয় না।
একটা গলিত লাভার নদীর কাছে পৌঁছয় আকানাবি, গুনগুন করে ওঠে তার হাতের মূর্তিটা। নদীর প্রবাহ অনুসরণ করতে থাকে সে, পেরিয়ে যায় সারির পর সারি লেহন করতে থাকে উষ্ণ জিভ, যেন তাদের জমিতে চাষ করে বসানো হয়েছে।
নদী ফুরিয়ে যায় একটা আগুনে হ্রদে এসে। সামনে সে হ্রদ ভাগ হয়ে গেছে ছোটো বড়ো আরো পুকুরে। হ্রদ শান্ত, যেন উপচে পড়া লাল হলুদ ঝোল। তার চারপাশের মাটি নিষ্প্রাণ, কালো, কোনো ধোঁয়া নেই তার থেকে।
এভাবেই আকানাবি দেখতে পায় রনকেকে। ক্ষুর ডুবিয়ে সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে পাড় থেকে। উচ্চতায় সে তার দুগুণ, তাজা নারকোলের মতো সাদা, মাথার দুপাশে উঁচুত একজোড়া সাপের মতো চোখ। সাপের মতো চোখের নীচে একজোড়া চাঁদ, লম্বা খুলিতে বসানো। তবে তার মাথার মাঝখানে চমকানো হিরের মতো যা বসানো তাতেই আটকে যায় আকানাবি।
আকানাবি তার কাছে এগিয়ে যায়, সেও হ্রদ থেকে এগিয়ে এসে মাথা নামায় যাতে আকানাবি সেটাকে ছুঁতে পারে। সোকোটো থেকে মূর্তিটাকে বের করে আকানাবি রেখে দেয় তার জিবের ওপর। সে সেটাকে কড়মড়িয়ে কামড়ায়, চিনির মতো।
“আমার পিঠে চড়ে পড়ো, “আগাম ঘোষণা ছাড়াই তার গলা আকানাবির মাথার মধ্যে এসে পড়ে। “তোমাকে শুভ্রতার মধ্যে নিয়ে যাই
চলো। তোমার বন্ধুদের দেখতে পাচ্ছি। তারা খাঁচা বানাচ্ছে।”
তার মাঝখান অবধি হেঁটে যায় আকানাবি, বুঝতে পারে তার নিজের মাথাটা পৌঁছচ্ছে তার পেট অবধি। নীচু হয়ে শুয়ে পড়ে রোনকে, কালো পাথরের ওপর তার সাদা পেট রেখে। তার পিঠে উঠে পড়ে আকানাবি। সে দাঁড়িয়ে পড়ে, আর আকানাবি উঁচু থেকে দেখতে দূরের আগুনে মাঠ আর বহু পুকুর।
“আমার গলা চেপে ধরো।” কন্ঠস্বর বলে।
সামনের দিকে ঘষটে সরে যায় আকানাবি, তার লম্বা গলাটার যতটা সম্ভব চেপে ধরে। রনকে মাছের মত ঠান্ডা, চুনা পড়া পালকের মতো আঁশে ঢাকা তার শরীর। চোখ বন্ধ করে আকানাবি। তার কিছু ভাবারও নেই, চাওয়ারও নেই। সে কেবল নির্দেশ অনুসরণ করছে, আর তাতে প্রয়োজন শুধু তার বিশ্বাস। আগুনে প্রান্তরের ওপরের রাত পেরিয়ে এশিমেমি টগবগিয়ে ছুটতে শুরু করে হাওয়ায়। আকানাবি টের পায় তার একটা ইচ্ছে আছে গল্প হয়ে বলার।
৩
সমবেত সঙ্গীত স্থাপত্য
যে কোটি কোটি সেকেন্ড ধরে ওসুপার পঞ্চান্ন জন মানুষ গায়, তার মধ্যে তারা খাড়া করে ফেলে পাঁচ হাজারের ওপর গোলক যা ধ্বংস করা যায় না। গোলকগুলো ক্যানেটিস নিক্সের জমিতে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে কোনো দখলদার প্রজাতির বাসার মতো। তাদের আয়তন আকৃতি সব আলাদা হলেও প্রতিবার গান গেয়ে তাদের বাড়িয়ে তোলার সময়ে যে শব্দ গোলক তাদের চারপাশে ভেসে বেড়ায়, তারা আটকে থাকে তার আকারের মধ্যেই।
ওলোরিন তাদের শরীরে বসে যায় আরো গভীর ভাবে, আরো বেড়ে ওঠে তাদের চরম আনন্দ। সাধারণত চিৎকার, চেঁচামেচি গর্জনের প্রয়োজন হয় তাদের আকারগুলোকে বড়ো করতে। তার যাতে গলা ফাটানোর মতো সবল থাকে তা নিশ্চিত করে ওলোরিন।
জলদি, দূরে, ক্যানেটিস নিক্সের সর্বদা দিন হয়ে থাকে আকাশে, হাজির হয় মূক তস্করেরা স্বয়ং, যেন আধ টুকরো করা সামুরাই। বেমিসোলা ওলোহান আর বাকি চুয়ান্নজনের শরীরে এবার দেখা দেয় ওলোরিনের রঙের বুকের বর্ম, আর কঠিন লাল পাথরের মতো গলা। প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে আসে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাদের একাত্মতা। তাদের হাড়ে প্রবেশ করে তাকে বানিয়ে দেয় অতি কম্পনশীল বস্তু, পাঁজরের খাঁচাগুলোকে বানায় অতিকায় প্রতিধ্বনির কামরা, আর তাদের গলাকে অস্ত্র।
এটা কীভাবে কাজ করে তারা জানে। ক্যানেটিস নিক্সের ক্ষমতায় তার ঘুরে বেড়ায়, মিলনসঙ্গমের বিন্দু খুঁজতে। কেবল বেমিসোলা চেনে সেসব বিন্দু, যেখানে বাতাস আর আকাশ আর বালি তাদের গান দিয়ে আকার দেয়ার জন্যে খুঁজে পেয়েছে যথেষ্ট ভারসাম্য। একবার খুঁজে পেলে তারা তখন সঙ্কেতচিহ্ণ হয়ে ওঠে। বৃত্ত এবং বিন্দু। সমবেত সঙ্গীত এবং মিলনসঙ্গম। তারপর ওলোরিন তাদের রক্ত ভরিয়ে দেয় আনন্দে, আর উঠে আসে তাদের শব্দহীন সঙ্গীত, আর তারপরে আসে ক্যানেটিস নিক্সের রেণু।
বালির প্রবাহকে অলঙ্করণ করতে তার ব্যবহার করে সুর। রূপটান দিতে গর্জন করে পশুর মতো। তারসপ্তক আনে সূক্ষ্মতা। মন্দ্রসপ্তক গড়ে ভিত। স্বরভাগ বাড়ায় ঘনত্ব। তারা এখন স্রেফ যন্ত্র, তাদের ওলোরিনে গজিয়ে ওঠা শুঁড় জুড়ে দেয় শরীর, মন আর কন্ঠস্বর। ক্যানেটিস নিক্সে ঘুরে বেড়ায় তারা, তাদের কণ্ঠস্বর দিয়ে গড়ে, উড়ে যায়, হারিয়ে যাওয়া অথচ খুঁজে পাওয়া।
শেষ আকারটা তারা গড়ার পর আবির্ভাব হয় মূক তস্করদের। বিভিন্ন আয়তনের হাজার হাজার অস্থিপোত পাঠিয়ে দেয় তারা। এই সব জাহাজ থেকে আসে একটা চিড়িয়াখানা। খোঁচা খোঁচা বর্ম আর বেগুনি আভা নিয়ে মূক তস্করদের ক্ষুদে সংস্করণরা পথ দেখিয়ে, বয়ে, তুলে নিয়ে আসে এমন সব বিকৃতি যা মিলনসঙ্গমীদের দৃষ্টির বিশ্বাসের বাইরে।
এসব তারা পুরে দেয় পঞ্চান্নজন মিলে বানানো খাঁচার মধ্যে। তারপর ওলোরিনেরর একটা হূলের খোঁচা আর কন্ঠস্বরের স্বল্প পথ পাড়ির পর সীল হয়ে যায় খাঁচা।
তারপর মূক তস্করেরা পঞ্চান্নজনকে ক্যানেটিস নিক্সে একা ফেলে চলে যায়। মরে যাওয়ার জন্যে নয়, তবে কখনও ছাড়া না পাওয়ার জন্যে। কারণ তারাও জোগাড় করে আনা জীব।
৪
প্রতিধ্বনি
টগবগিয়ে উঠে আসে রনকে আর আকানাবি, বন্দুকের গুলির মতো শব্দে, ভূত্বকের নীচের অন্ধকার থেকে ক্যানেটিস নিক্সের পালিশ করা মরুভূমিতে। যতদূর চোখ যায়, সেখানে থাকে থাকে উঠে এসেছে বাসার আদলে বানানো গোলকের মতো স্থাপত্য।
এই অদ্ভূত খেতের মধ্যে বিদ্যুৎবেগে ছুটে যায় রনকে। তার ঘাড় চেপে ধরে দেখার জন্যে চোখ ছোটো ছোটো করে আকানাবি। যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে তেমন করে রনকে থেমে যাওয়াতে ছিটকে সোজা হয়ে বসে সে।
ক্যানেটিস নিক্সের জমির ওপর টোল খাওয়ার মতো গর্তে বসানো কুড়িটা মানুষের আয়তনের ডিম। তারা দপদপ করে, আর তাদের অনচ্ছতার পেছনে ছটফট করে লাল মাংসল কিছু।
“আমাদের বড়ো দেরি হয়ে গেছে, “রনকে বলে তার মাথার মধ্যে, “এরা এখন পরিবর্তনের অবস্থায়।”
রনকে অনেক বেশি জানে। আকানাবির সন্দেহ হয়ে যে সে হয়তো আর এক রূপে ওবাতালা। তারা ঠান্ডা শরীর থেকে ক্যানেটিস নিক্সের উত্তাপে নেমে পড়ে আকানাবি, এগিয়ে যায় ডিমের থোকার কাছে।
“কী ভাবে?” প্রশ্ন করে আকানাবি।
“এখানে আসতে যা সময় লেগেছে তোমার কাছে তা কয়েকদিন মনে হয়েছে, কিন্তু এদের কাছে তা এক দশক। ওরা নিশ্চই চোরেদের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে এই অবস্থায় পেয়েছে।”
ডিমগুলোকে শঙ্খবৃত্তের মতো প্যাঁচে সাজানো। তাদের চারপাশের
সাদা মরুভূমির জমি ঢেকে রাখা বিশাল কাঁটা বসানো গোলকগুলোকে নিশ্চল মনে হয়। তাদের মধ্যের মহাজাগতিক জীবনের কথা আকানাবির অজানা – ক্ষুধার্ত, ছটফটানো, হারানো গৃহের উদ্দেশ্যে ডাক দিতে থাকা।
ব্যর্থ মনে ডিমগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আকানাবি। সে বুঝতে পারে তার লোকজন, ওসুপার লোকজন, আছে ওখানে। সে অনুভব করতে পারে তাদের হৃদয়ের স্পন্দন আর ঘ্রাণ পায় তাদের রক্তের তিক্ত মিষ্টতার।
ডিমের খোসার চটচটে রামধনু আভার পেছনে রয়েছে মুখ। বোলাহান। দুই যমজ। ফাটোনা। দল বেঁধে একসঙ্গে দুঃখকষ্ট থেকে সেরে উঠতে থাকলেও এদের মধ্যে কাউকেই চেনে না আকানাবি। সারা জীবন সে একাই ছিল।
যারা তাকে পাঠিয়েছিল তাদের কাজে ব্যর্থ হয়ে সে এখন হারিয়ে গেছে তার জগতে। অবস্থাটার অস্বস্তি জোরে ধাক্কা দেয় তাকে, ডিমগুলোর থেকে রনকের দিকে ফেরে সে। তার ইচ্ছে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যেতে।
“রনকে, আমি যেখানে যেতে চাই সেখানে কি আমাকে নিয়ে যাবে?”
“না। আমরা এখানে এসেছি এই মানুষগুলোকে বাড়ি নিয়ে যেতে। এরা জেগে ওঠা অবধি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এসো, আমার পেটের ওপর বিশ্রাম নাও। তুমি ঠিকই করছো। এরপর ওবাতালা তোমার সঙ্গে ফের দেখা করবে।”
আকানাবি দেখতে পায় এশিমেমিটি আনন্দ করে শুয়ে আছে মরুভূমির গরমে। তার কাছে গিয়ে তার নরম ঠান্ডা পেটের ওপর শুয়ে পড়ে অপেক্ষা করে সে। স্বপ্নহীন প্রত্যাশার এক অনন্ত সময়ের পর ডিমগুলো খুলে যায়।
৫
মিলনসঙ্গম
মূক তস্করদের ভবিষ্যদ্বাণীর বিপরীতে গিয়ে ওলোরিন আর মানুষ জুড়ে একটি জীব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বেরিয়ে আসে তাদের অণ্ড থেকে। তারা সুরের নতুন সিপাহী, পিঠ তাদের করাতের মতো, চোখ তাদের শূন্যতার পুকুর, তাতে দেখা যায় শব্দ। তাদের কোমল গলাগুলো লাল টুকরো হয়ে যাওয়া বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন ফালা করা ফল। টম্যাটো-লাল ঝাঁঝরের মতো খোলসের তক্তিতে ঢাকা তাদের মাথা, বুক আর উরু। এই খোলসের নীচে তার সুন্দর, মাংসহীন দেহ। আর মানুষ নয়।
রস পড়া খোলাগুলো থেকে তারা চুপচাপ গরমে বেরিয়ে আসতে টলতে টলতে পিছু হটে আকানাবি। চিরস্থায়ী রোদে পড়ে শুকোয় তারা, অপেক্ষা করে সবচাইতে বড়ো ডিমটা। রনকে কিছু বলে না। তার মাথার পেছন থেকে দেখে আকানাবি। একপাশে ভর দিয়ে বসে থাকে এশিমেমি, দেখতে থাকে জন্মের প্রক্রিয়া।
গান গাইতে শুরু করে সদ্যোজাতরা। অদ্ভূত ভাবে সে যেন মানুষের মতো আওয়াজ, যেন মানুষের গানের স্মৃতি। তারা পাক খায় বেমিসোলাকে ঘিরে, তাদের সঙ্গম-কেন্দ্র, তাদের না জন্মানো রানি। দুটুকরো হয়ে যায় তার ডিম, উপচে পড়ে বেমিসোলা। তার খোলস নেই, কাঁটা নেই। রানি যখন হাওয়ায় নিজেকে মেলে ধরে তখন আকানাবির মনে হয়ে সে হয় কুসুম কিম্বা গর্ভফুল দেখছে, যেন অর্থহীন শব্দের এক শ্লেষ্মা সর্প।
তার নাড়াচাড়াতে শুরু হয়ে যায় সুরবাদন, বাতাস গান গায় নিজের জন্যে। লম্বা হয়ে নিজেকে সূর্যের দিকে বাড়িয়ে ধরে সে, তার প্রতিটি পরমাণু ফুটে ওঠে ঐকতানে, লম্বা পাখনা গোল হয়ে পাক খায় মাটির ওপরে।
সসম্মানে দাঁড়িয়ে পড়ে রোনকে। সমবেত সঙ্গীতের উনিশজন, সব পুরুষে রূপান্তরিত, তাকায় তাদের রানির দিকে। প্রত্যুত্তরে সে তাকায় ক্যানেটিস নিক্স পেরিয়ে, বেরিয়ে আসতে দেয় একটা আওয়াজ, যেন পাক খুলে আলগা হয়ে যাওয়া পাখির গান।
আকাশে আবির্ভাব হয় একটা বৃত্তের। মিলনসঙ্গমের বিন্দু, এখান থেকে কোথাও নয়। এখান থেকে সর্বত্র। রানি উড়ে যায় আকাশে, মিলনসঙ্গমের দিকে, ধোঁয়ার মতো মৃদু।
তার সমবেত সঙ্গীতের দল অনুসরণ করে।
টীকা
১. ইলে-ইফে- আক্ষরিক অর্থে বিস্তৃতির-গৃহ। নাইজেরিয়ার এক প্রাচীন শহর, কিংবদন্তী অনুযায়ী সমস্ত ইয়েরুবা দেশের উৎপত্তি স্থল।
২. আয়ো মেটা- পুরোহিত-ত্রয়। আধ্যাত্মিক গুহ্যরহস্যে দক্ষ আয়ো-মেটারা ওরানমিলা ও ওবাতালার পূজারী একটি কাল্ট।
৩. তিন ওরিশা (এসু, ওরানমিলা আর ওবাতালা)- এসু সন্ধিক্ষণের ধূর্ত দেবতা। ওরানমিলা ইফার জনক, প্রথম আয়ো, ওবাতালার দ্বারা পৃথিবীতে প্রেরিত। ওবাতালা শ্বেতজন, ওরিশার পিতা, ওলোডুমারের ডানহাত।
৪. ইফা- আয়োদের ব্যবহৃত একটি প্রাচীন ধর্ম ও ভবিষ্যৎ দর্শনের পদ্ধতি।
৫. ওলোডুমারে- পরমেশ্বর
৭. ওরিশা- ওলোডুমারের দূত, দেবী বা দেবতা
৮. আজা- পরম্পরাগত কান ঢাকা টুপি
৯. এলেমি-আত্মা আছে যাদের
১০. মানুষ থেকে ওলোডুমারের স্পর্শপ্রাপ্ত এলেমি সৃষ্টির প্রক্রিয়া
১১. আডিরে- ইয়োরুবা মহিলাদের দ্বারা ছোপানো রঙীন কাপড়
১২. আসো-ওকের- ইয়োরুবা জাতির পরম্পরাগত হাতে বোনা কাপড়
১৩. আগবাদা- আলখাল্লা
১৪. ওপেলে- তুকতাকে ব্যবহৃত মালার ছড়া
১৫. জোলোআগুন- নীল রঙের আগুন
১৬. ওফিলিগাঙ্গাটা- অতি স্থূল দানবী
১৭. ন্লা- বড়ো, Ìyá Nlá বা ‘গ্রেট মাদার’ ইয়োরুবা মাইথলজিতে সমস্ত সৃষ্টির দেবী, তাকে অনেক সময় বড়ো মা বলে ডাকা হয়।
১৮. ক্যানেটিস নিক্স এর অর্থ অর্থহীন শ্রুতিকটু আওয়াজ।
১৯. সোকটো- প্যান্ট
২০. ইলে আই- জীবনের গৃহ, প্রকৃতির দেশ, আমাদের জীবন্ত পৃথিবী
২১. এশিনেমির- ঘোড়া প্রেত
২২. চিন্তায় লালন কোরো আমাকে
২৩. ওলোরিন- গায়ক
লেখক পরিচিতি
মসাময়িক নাইজিরিয়ান সাহিত্যে ডেয়ার সেগুন ফালো এক বিস্ময়ের নাম। ‘নাইজিরিয়ান উইয়ার্ড’ ঘরানায় তাঁর কলম একের পর এক ম্যাজিক দেখিয়ে চলেছে। ছোট্ট এক কামরার ঘরে বাবা মা ভাই বোনকে নিয়ে থাকেন ফালো, বিদ্যুত চলে যাওয়া সেখানে প্রায় রোজকার ব্যাপার। কিন্তু কলম ধরলে তাঁর সেসব সমস্যার কথা মনে থাকে না।
হরর আর ফ্যান্টাসি ধারার সাহিত্য নিয়ে লেখালিখি করতে করতেই ডেয়ার নিজস্ব এক জগত বানিয়ে ফেলেছেন। ইয়োরুবা দর্শন, ‘নলিউড’ ও পাল্প ফিকশনের ছায়া তাঁর লেখায় হামেশাই দেখা যায়। নাইজিরিয়ার লোককথা ও প্রচলিত বিশ্বাস নিয়ে অগাধ পড়াশুনা আছে এই তরুণ লেখকের, সঙ্গে আছে অসামান্য প্রতিভা। তাঁর লেখা গল্প ‘What Not to Do When Spelunking in Anambra’ পড়ে গোটা সাহিত্য জগত নড়েচড়ে বসেছিল।
এরপর ‘We are born’, ‘Ku’gbo’ আর ‘Convergence in Chorus Architecture’ এর মতো বেশ কিছু গল্প ও নভেলা লিখে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
ম্যাগাজিন অফ ফ্যান্টাসি অ্যান্ড সায়েন্স ফিকশন, ব্রিটল পেপার, দ্য ডার্ক আর সারবার মতো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। তাঁর নতুন বই ‘Caged Ocean Dub’ ২০২৩ সালে থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে অ্যান্ড্রয়েড প্রেস প্রকাশন।
অনুবাদক পরিচিতি
বাংলা কল্পবিজ্ঞানের নতুন ধারায় সুমিত বর্ধন পাঠকপ্রিয় লেখক। একসময় ফ্যান্টাস্টিক পত্রিকায় প্রচুর লেখালিখি করেছেন, পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কয়েকদিনের জন্য বিরতি নিয়েছিল তাঁর কলম। কল্পবিশ্ব ওয়েব পত্রিকা প্রকাশ পাওয়ার সময় তিনি আবার কলম তুলে নেন এবং পাঠকদের একের পর এক চমৎকার সব লেখা উপহার দিতে থাকেন। বাংলা কল্পবিজ্ঞানকে কিশোর অ্যাডবেঞ্চারের শিকল থেকে বের করে আনার যে কাজ সম্প্রতি কল্পবিশ্ব আর অন্যান্য কিছু ম্যাগাজিন শুরু করেছে, তাতে সুমিত বর্ধনের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার প্রথম স্টিমপাঙ্ক থ্রিলার ‘অর্থতৃষ্ণা’ থেকেই সুমিতবাবু পর পর চমক দিচ্ছেন। একদিকে ‘নক্ষত্রপথিক’ গ্রন্থে ‘বিয়নন্ড আর্থ’ ঘরানায় তাক লাগানো গল্প বুনেছেন, অন্যদিকে জাপানি জিদাইগেকি শৈলিকে নিয়ে এসেছেন ‘অসিশপ্ত’ উপন্যাসে। এরই মাঝে চলছে ছোটোগল্প ও অনুবাদের। রে ব্র্যাডবেরির ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড ম্যান’-এর আধিকারিক অনুবাদও সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কলম ধরেই। বইয়ের নাম ‘চিত্রবিচিত্র মানুষ’; সুমিত বর্ধন অনূদিত এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে কল্পবিশ্ব পাবলিকেশন থেকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন