মূল গল্প: O2 Arena
ঘামের হিলহিলে ধারাস্রোতেরা… আমার চামড়া আর আঁটোসাঁটো ইলাস্টিক পোশাকের ফাঁকে ফাঁকে নদীর ধারার মত বয়ে যায়। আমার মেরুদণ্ড বেয়ে… আমার বুক বেয়ে… তাকে অনুভব করতে করতে আমি ক্লান্ত, উদাসীন চোখে আমার শত্রুর দিকে চেয়ে থাকি। দৃষ্টি আমার খানিক ঝাপসা, কিন্তু নজরটা তীক্ষ্ণ। আমার লক্ষ্য — একটা খুন করা। খুনটার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আছে। প্রতিষ্ঠান… সে এই খুনের স্বীকৃতি দেয়, তাতে সাহায্যও করে, আবার সেই একই প্রতিষ্ঠান আমাদের সবাইকেই তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আমার সামনে অন্য লোকটা পা ফেলে ফেলে হেঁটে চলেছে। ওর হাবভাবে ক্লান্তির ছাপ। ক্লান্ত আমিও। নিজের শরীরটাকে বইবার মত শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই আমার। ছোটো ছোটো, কাঁপা কাঁপা গ্রাসে হাওয়া গিলে চলেছি আমি… তিক্তমধুর হাওয়া…
তিক্ত, কারণ ওতে আমার সম্ভাব্য মৃত্যুর গন্ধ লেগে আছে। মধুর, কেন না, এ বাতাস আমি বুকে টেনে নিচ্ছি, আমার চাইতে অনেক বেশি যোগ্য একটা জীবনকে বাঁচাবার রসদ জোটাব বলে। আহা বাতাস… মধুর বাতাস বুক ভরে টেনে নিই আমি যেন এক প্রতিজ্ঞার মত, একটা স্বার্থপর ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখবার প্রতিজ্ঞা! স্বার্থপর! হ্যাঁ। কিন্তু ওইটেই আমার সবকিছু যে!
হয়তো সে আমার মৃত্যুর কারণ ঘটবে, অথবা, আমি তার… কিন্তু তবু, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যে আমার শত্রু নয়, সে আমি জানি। আমার আসল শত্রু… আমাদের সমষ্টিগত শত্রু, যাকে হারানোটা আমার প্রকৃত প্রয়োজন, সে কিন্তু অটল, অজর। সে আমাদের সমাজ। আমাদের ভেঙে খান খান করে, আমাদের অস্তিত্ত্বকে অনিবার্য মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়ে চলেছে সে। কখনও ধীরে, কখনও বিদ্যুৎগতিতে সে আমাদের প্রাণহীনতার একটা গভীর গহ্বরে ঠেলে দিয়ে চলেছে। বেঁচে থাকা
বলতে কোনোমতে আজকের দিনটা শ্বাস নেবার কথা ভাবি এখন আমরা… তারপর হয়তো আরো একটা দিন…
লড়াইয়ের এই আখড়ায় এ আমার দ্বিতীয়বার আসা। স্বেচ্ছায় এসেছি আমি… এসেছি… যে সমাজ আমার জন্ম দিয়েছে, তারই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে।
আমার প্রতিদ্বন্দ্বী পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার পাথুরে মুখে একটা নিষ্প্রাণ হাসি খোদাই করা যেন। জবাবে খিঁচুনির মত একটুকরো হাসি ছড়িয়ে গেল আমার মুখেও। তারপর আমি ধেয়ে গেলাম তাকে লক্ষ্য করে… ধেয়ে গেলাম, যদি পারি তো একটা জীবন ছিনিয়ে নিয়ে আরেকজনকে সেইটে উপহার দেব এই স্বপ্ন নিয়ে। আমার বুকের ভেতরে কোথাও একটুকরো ‘আমি’ কাঁদছিল; এভাবে নিজেকে একটা রাক্ষস হয়ে যেতে দেখে চমকে উঠে ফুঁপিয়ে উঠছিল বারবার…
কিছুদিন আগে…
প্রথম বক্তা মঞ্চে ওঠামাত্র ঘরের সমস্ত হইচই কমে এল। মুখের অক্সিজেন মুখোশটা খুলে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। আইন আকাদেমির ছাত্রদের উদ্দেশ্যে উদ্বোধনী বক্তৃতা। আমরা চার হাজার নবাগত ছাত্র নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম। ভদ্রলোক ‘সম্পত্তি আইন’ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। কেন সে প্রতিষ্ঠানে সুযোগ দেয়া হয়েছে আমাদের, সেটাই ব্যাখ্যা করছিলেন তিনি।
শুনতে শুনতে বিরক্তি লাগছিল আমার। এই ২০৩০-এর নাইজেরিয়াতেও একদল লোক বাকি মানুষদের জীবনের উদ্দেশ্য ও কর্তব্য বুঝিয়ে দেয়াটাকে জরুরি মনে করে। যেন নিজেদের জীবনটার উদ্দেশ্য কী সেটা আমাদের জানাও নেই, আর সে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারও নেই আমাদের। যেন, যাদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছে আছে, নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে, তারা অভিশপ্ত জীব। কোনোমতে বেঁচে থাকবার জন্য যতটুকু অক্সি-ক্রেডিট তাদের প্রাপ্য তার চাইতে একবিন্দু বেশি অক্সিজেন যদি তারা দাবি করে তাহলে তাদের শত ধিক!
আমাদের রোজকার বাস্তবটা কীরকম? শুনুন বলি। শ্বাস নেবার জন্য আমাদের ..খরচ করতে হয়। উষ্ণায়নের ..ফলে ..ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন .মরে
হেজে গিয়েছে। ফলে বাতাসে প্রাকৃতিক অক্সিজেন তৈরিতে চূড়ান্ত ঘাটতি। কাজেই নিজেদের জীবনটা নিজেদের খরচে টিকিয়ে রাখাটাই এখানে আইন।
বিভাগীয় প্রধান তাঁর লম্বা বক্তৃতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের জানানো হল, আমরা হলাম আইনের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যবান। শুনে আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, পাঁচ-পাঁচটা বছর গাধার মত খেটে ব্যাচিলর অব ল ডিগ্রিটা পেয়েছি। তারপর এই আইন আকাদেমিতে ঢোকবার জন্য একটা চূড়ান্ত কঠিন পরীক্ষায় পাশ করতে হয়েছে আমাদের। তাহলে এর মধ্যে ওই ‘সৌভাগ্য’ ব্যাপারটা এল কোথা থেকে?
তা, আমাদের জানানো হল, এবারে এই আকাদেমিতে প্রায় মিলিটারি শাসনে আরো একটা কঠিন কোর্সে টিকে থাকতে পারলে ওকালতির মহান পরীক্ষায় বসবার সুযোগ মিলবে আমাদের।       
শুনে মনে মনে ভাবছিলাম, এমন অতিমানবিক মনোবলই যদি দেখাতে হয় তাহলে ওকালতির বদলে মিলিটারিতে ঢুকলেই তো পারতাম আমরা! কিন্তু তারপরই নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হল যে, এখানে আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। আমায় একরকম বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে। এখান থেকে উতরোতে পারলে এই আইনমন্ত্রকই এরপর কোনো একটা একটা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে আমাকে একটা পেশা জুটিয়ে দেবে, যাতে শরীরে জমা কার্বন ডাই অক্সাইড ধুয়ে চলবার মত যথেষ্ট অক্সিজেনের জোগান রোজগার করতে পারি। সাড়ম্বর এই বক্তৃতাটা এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন এ আমার বিরাট সৌভাগ্য, কিন্তু আসলে জায়গাটা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের একটা কারখানা বই আর কিছু নয়।
বিভাগীয় প্রধানের বক্তৃতার পর গুটিকয় ছাত্র — খানিক বুদ্ধুই হবে সেগুলো— জিজ্ঞেস করে বসল, এখানে আমাদের অধিকার বলতে কী কী আছে? জবাবে প্রধান বেশ কড়াভাবেই তাদের জানিয়ে দিলেন, অধিকার বস্তুটার কোনো অস্তিত্ত্ব এখানে নেই। শুনে আমি নিজের মনেই মাথা নাড়লাম একটু। অধিকার-টধিকার চুলোয় যাক, বন্দোবস্ত যা করবার সে আমি ঠিকই করে নেব। সে আমি সব সময়েই করে নিয়ে থাকি। কোর্সটা সফলভাবে শেষ করাটাই হল একমাত্র কাজ। কীভাবে সেটা করছি তাতে কী আসে যায়?
নিজের বক্তৃতা শেষ হতে বিভাগীয় প্রধান আর এক বক্তাকে ডেকে আনলেন। ভদ্রলোক বাণিজ্য সংক্রান্ত আইনের অধ্যাপক। এ-জায়গাটায় অক্সিজেন জেনারেটর বাতাসে অক্সিজেনের জোগান দেয়, ফলে মুখোশের দরকার পড়ে না। এ-ভদ্রলোক তাও নিজের মুখোশটা দেখলাম খুললেন না। মুখোশ পরে থেকেই আমাদের গোটা পাঠ্যক্রমটার মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে গেলেন। যা বুঝলাম তাতে পাক্কা তিন বছরের একটা কোর্সকে আট মাসের মধ্যে ঠেলেঠুলে গুঁজে দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। কোর্স ছোটো রাখলে কিছুদিন অন্তর একাধিক ব্যাচে অনেক বেশি নতুন ছাত্র ঢোকানো যাবে। যত বেশি ছাত্র, আকাদেমির ভাগ্যে তত বেশি অক্সি- ক্রেডিট। কথার ফাঁকে ফাঁকে এই ভদ্রলোকও বারবার সেই একই কথা বলে গেলেন—আমরা কত সৌভাগ্যবান! শুনে আমি মাথা নাড়লাম, তারপর মুখে অক্সিজেন মুখোশটা গলিয়ে হল ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম।
***
বেরিয়ে এসে দেখি ওভোকে-ও বক্তৃতা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আমায় দেখে মুখ টিপে হাসল একটু, তারপর কাছে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। ওকে দেখতে যেমনটা ঠেকে, ওর ছোঁয়াটাও ঠিক তেমনি। ভারী দুবলা, যেন জোরে জড়িয়ে ধরলে পিষে যাবে একেবারে। অথচ, কী এমন আছে ওই দুবলা চেহারাটায় কে জানে! ছেলেগুলো ওর দিকে চাইলে চোখ ফেরাতে ভুলে যায়! একটু বাদে আমিও, খানিক দূরে সরিয়ে ধরে, ভালো করে দেখলাম ওর দিকে। ওর অমন টানটার রহস্য কী সেটা টের পেতেই যেন বা।
আমার বিভ্রান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখে ও একটুখানি হেসে ভুরু কোঁচকাল।
ওভোকে-কে ক্ষ্যাপানোর সুযোগ পেলে আমি কক্ষনো ছাড়ি না। এখনও তার অন্যথা হল না। আমি বললাম, “তোকে দেখবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এমনটা আমি বলতে পারতাম, বুঝলি? কিন্তু ব্যাপার হল, মিছে কথাটা আমার ঠিক আসে না।”
সে হাসল, “হুঁ। আর সেইজন্যই বুঝি আমায় দুহাতে এমন করে ধরে রেখেছিস, হ্যাঁ রে?”
কী জবাব দেব তাই ভাবছি তখন সে নিজেই জবাবটা দিয়ে দিল, “আমি যে আর বেশিদিন বাঁচব না, সেইজন্য বুঝি?”
“ঠিক বলেছিস!” আমি মাথা নাড়লাম। আশা করছিলাম, মনের আসল ভাবটা ওর কাছ থেকে আড়াল করতে পারব, “ওইজন্যেই তো।”
ওভোকে ফের হাসল। তারপর দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে আমরা দুজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ওর সঙ্গ-র উষ্ণতাটুকু গায়ে মেখে নিচ্ছিলাম আমি।
“ছুঁয়ে দেখবি নাকি একবার?” খনিক পরে ভারী সাদামাটা গলায় বলে উঠল সে।
“কী ছুঁয়ে দেখব রে?”
“আমার টিউমারটা। আমার মৃত্যু… আমার ভেতরে বসে আছে। আমি টের পাই, জানিস?”
রেলিং-এর ওপর দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলাম আমি।
এখানে রেজিস্ট্রেশনের সময় ওর সঙ্গে প্রথম আলাপ হল আমার। আলাপের সময়েই ও বলেছিল ওর জরায়ুতে কালব্যাধি বাসা বেঁধেছে। আর কাউকে সে-খবর
 বলেনি ও। যখন গ্র্যাজুয়েশন করছি, তখনও ওকে দেখছি অবশ্য। একই কোর্সের দুই ছাত্রছাত্রী হলেও, আলাপ দূরস্থান, আমাকে সে-সময় ও খেয়ালও করেনি ভালো করে। কিন্তু সে-সময় যারা ওর কাছের বন্ধু ছিল, তাদেরও এ-খবরটা জানায়নি কখনও ওভোকে। এইখানে এসে নতুন বন্ধুদের কাউকেও ও খবরটা দেয়নি, কেবল আমি ছাড়া। তার কারণও আছে।  আমি এখানকার ছেলেগুলোর মত ওকে
নিয়ে কোনো নাচানাচি করি না। উলটে সুযোগ পেলেই ক্ষ্যাপাই, সিরিয়াস কিছু ভাববার সুযোগও দিই না! অনেকটা ভাইবোনের মত।
আসলে ওর সঙ্গে আমার এই ব্যবহারটা ওর খুব পছন্দের। বাকি লোকজন তো ওকে দেখলেই একদম গলে গলে পড়ে, পারলে পোষা কুকুরছানাটার মত লেজ নাড়িয়ে নাক ঘষে দেয় আরকি! এমনকি যখন ওর শরীরটা ভালো থাকে তখনও সে আহ্লাদিপনায় ভাটা পড়ে না। আসলে, ওভোকে-র সত্যিকার রূপ ওদের চোখ এড়িয়ে যায়। সে রূপটা কেবল আমার চোখে ধরা পড়ে- শক্তিশালী, বুদ্ধিমান, প্রচণ্ড দক্ষ একটা মেয়ে। নিজস্ব দাঁত, নখ আর মন আছে ওর। কোনোকিছু নিয়ে ও যখন লড়ে, তখন সবাই মাথা নেড়ে বলে ‘কী সাহস!’ আর আমি তখন ওর মধ্যে দেখতে পাই, যেন একটা তেজি, ভয়ধরানো, হিংস্র জীব… দুনিয়া নামের এই খাঁচাটার এত শক্তি নেই যে ওকে আটকে রাখে!
আর, ঠিক এইজন্যই ও শুধু আমাকেই ওর অসুখটার খবর দিয়েছিল! বলেছিল, “শুধু তোকেই বলেছি জানিস! যে জন্য বাড়ি ছেড়ে এই বিশ্রি হাড়ভাঙা খাটুনির প্রোগ্রামটায় এসে ঢুকেছি, ঠিক সেইজন্যই আর কাউকে আমার অসুখটার কথা বলিনি। জানলেই তো এমন ব্যবহার করতে শুরু করবে, যেন আমি একটা রুগি, আমার জীবনটা শেষ! না রে, মরবার আগের মুহূর্তটা পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকতে চাই।” আর তারপর একটুক্ষণ থেমে থেকে ফের বলেছিল, “ওসব যত্ন-আত্তি, সহানুভূতি-টুতি যদি তোর একটু কম থেকে থাকে, তাহলে সেটাই জানবি আমার পছন্দ।”
কিন্তু… আমি তো ওকে যত্নই করতে চাই! চেয়েছি সব সময়! এমনকি যখন মনে হয়েছে কোনো আশাই আর নেই তখনও… যখন আমার ইচ্ছে হয়নি, এমনকি তখনও…
হঠাৎ খেয়াল হল, টিউমারটা ছুঁয়ে দেখা নিয়ে ওভোকে-র কথাটার জবাব দেয়া হয়নি কোনো। জবাব দিতে ইচ্ছে করছিল না আমার। মৃত্যু নিয়ে ওর সঙ্গে খানিক হাসিঠাট্টা করি বটে, ওতে জিনিসটাকে খানিক অবাস্তব ঠেকে; সেটা ভালো। কিন্তু সরাসরি তাকে ছুঁয়ে দেখা… আমার পক্ষে কঠিন। উঁহু, ব্যাপারটাকে যে আমি মোটেই পাত্তা দিই না সেই ভাবটা আমায় ধরে রাখতেই হবে।
মেয়েটার মনমেজাজ বেশ খারাপ হয়ে আছে। সেটাকে বেশি তোল্লাই না দেয়া উচিৎ, বিশেষ করে আজ, আইন আকাদেমিতে আমাদের প্রথম দিনটায়। সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে আমাদের। কাজেই প্রসঙ্গটা পালটে আমি হালকা চালে বললাম, “মুমু শোন, ভেতরে চল এবারে, নইলে আমাদের না দেখে শেষে এরা না পাহারাওয়ালা পাঠায় খুঁজতে।”
ওভোকে হেসে মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে বাবা, চল!”
হল-এর ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আমরা আমাদের অক্সিজেন মুখোশগুলো খুলে নিলাম। বাইরের রুক্ষ, শ্বাস নেবার অযোগ্য বাতাসকে ফিল্টার করতে ও-জিনিসের দরকার পড়ে। হলের ভেতরে ওর কোনো কাজ নেই।
মঞ্চে তখন বক্তা ভদ্রলোক ক্যাম্পাসের আইনকানুনের গভীরে ঢুকে
পড়েছেন। দেখা যাচ্ছিল এবারে তাঁর খানিক রঙ্গরসিকতার শখ গজিয়েছে। না গজালেই ভালো হত অবশ্য, কারণ ওতে অবস্থা আরো গুরুতর হয়ে উঠেছে তখন।
“ক্লাস চলাকালিন খাওয়াদাওয়া নিষিদ্ধ। এমনকি চিউইং গামও নিষিদ্ধ। অবশ্য কোনো ছাত্রীর পেটে বাচ্চা থাকলে ছাগলের মত গপগপিয়ে খেতে কোনো বাধা নেই, হা হা হা…”
তা এইভাবে তিনি একের পর এক নিয়মকানুনের পাঁচালি পড়ে চললেন। নিষেধ, বারণ, শাস্তির লম্বা তালিকা, মাঝে মাঝে দু’একটা ঠিসিঠাট্টা, তার বেশির ভাগটাই নানান বড়োলোকি টিটকিরি। সেসব বদ রসিকতা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু অনেকেই দেখি সেগুলো শুনে বেশ দেখিয়ে দেখিয়ে হাসছে। বোঝাই যাচ্ছিল এই গাধাগুলো কর্তাদের পশ্চাদ্দেশে চুমু খেয়ে বেশ তাড়াতাড়ি উন্নতি করে ফেলবে।
পরবর্তী বক্তা, সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনের ডক্টর উমেজ। বয়েস চল্লিশের খানিক বেশি। মঞ্চে উঠেই নিজস্ব ধর্মীয় রক্ষণশীল নীতিমালা ও নিয়মাবলী নিয়ে বেশ খানিক কপচে গেলেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, আকাদেমির আইনকানুন যতই কড়া হোক, এই ভয়ঙ্কর নীতিমালা তাদের আইনের বইতে নেই। তা, তাঁর অন্তিম আদেশটা হল, ক্লাস চলাকালিন কারো কাছে ফোন থাকতে পারবে না। যদি সে-সময় কারো কাছে ফোন পাওয়া যায় তাহলে সেটা চিরতরে বাজেয়াপ্ত হবে।
শুনে আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম, “এ আর এমন কী খারাপ হুকুম! ভদ্রলোক পুরোনো ফোন কেনাবেচার ব্যাবসা শুরু করবেন বোধায়, তাই না?”
শুনে ওভোকে আমার কাছে ঘেঁষে এসে কানে কানে বলল, “উঁহু, ফেরৎ দেয় তো! তবে বদলে খানিক ইয়ে…”
ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে সে এবারে খানিক ব্যাখ্যা করল, “বুঝলি না? আরে মেয়েমহলে ও ব্যাটার বেশ নামডাক তো!”
ব্যাপারটা বোঝা গেল। কিন্তু… কয়েক মুহূর্ত বাদে আমি ভুরুটুরু কুঁচকে ফের জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু… শুধু একটা ফোন ফেরৎ পাবার জন্যে…”
“আরে না না, ..খুশি করে দিতে. পারলে ফোন ছাড়া আরো নানান সুযোগ সুবিধে, পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেয়া, সে-সবও আছে তো!”
“ধেৎ!” আমি মাথা ঝাঁকালাম, “এখানে ঘুষটুষ দিয়ে, আকাদেমিকে বোকা বানিয়ে পাশ করে ফেলবার লাইন আমি আগেই ঘেঁটে রেখেছি। খাতায় নম্বর দেয় তো বাইরের প্রফেসররা আর আবুজা-র হেডকোয়ার্টারের লোকজন মিলে। বন্দোবস্ত কিছু করতে গেলে ওখানে করতে হবে। সে-সব এই ‘ফোন চোর’-এর ক্ষমতার বাইরে। ও কাউকে পাশ করাবার গ্যারান্টি কোত্থেকে দেবে?”
“আহা সাধারণ ছেলেপুলেরা আর অত খবর পাবে কোথায়? কাজেই, একদিকে কড়া শাসনের হুমকি আর অন্যদিকে পাশটাশ করিয়ে দেবার ভড়কি, দুয়ে মিলে উমেজ ভালোই রাজত্ব চালাচ্ছে, বুঝলি!”
“তা, তুই এত কথা জানলি কোত্থেকে?”
“আমি মেয়েমানুষ রে। নিজেকে বাঁচাতে এ-ধরনের লোকজনের ব্যাপারে খবর রাখাটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলাম আমি। তারপর ওভোকে আমার রাগমাখা মুখটায় তার আঙুল ছোঁয়াতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নীচুগলায় বললাম, “কখনও যদি ও তোকে এরকম জ্বালাতে আসে, আমি ওকে খুন করে ফেলব।”
“উফ্ফ্ফ্…” ওভোকে মিটিমিটি হাসছিল, “তুই তো যেকোনো মেয়ের স্বপ্নের মানুষ রে! কোনো মেয়েকে বাঁচাবার জন্য খুনও করতে পারে এমন একটা সাইকো বন্ধু কী সহজে মেলে! তা এতই যদি রোখ, তাহলে আমার ক্যানসারটাকে মেরে ফেলে দেখা না!”
“মাপ করো! ওর নাগাল পাবার সাধ্য আমার গুণ্ডাটুণ্ডাদের নেই,” আমি জবাব দিলাম।
“ধেৎ! তুই কোনো কাজের না বুঝলি!” বলে আমার গায়ে একটা আহ্লাদি ধাক্কা দিল ওভোকে। দুজনেই হাসছিলাম আমরা।
মঞ্চে ততক্ষণে মিসেস ওডুওলে উঠে এসেছেন। ইনি আমাদের হোস্টেল ইন চার্জ। শুরুতেই তিনি জানিয়ে দিলেন, পড়াশোনা আর অক্সিজেন তৈরি এই দুটোর জন্য মাঝরাত অবধি হস্টেলের জেনারেটর চালু থাকবে। মাঝরাতের পর থেকে আমাদের নিজের নিজের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে কাজ চালাতে হবে। অতএব যার যার বিছানার পাশে যেন অক্সিজেন সিলিন্ডার সারা রাত মজুত থাকে।
কথাটা অবশ্য উনি ঠিকই বলেছেন। এখানে আমাদের মাইনে খুব চড়া হলেও, ওতে সেন্ট্রাল হলে ক্লাস চলাকালিন অক্সিজেন জেনারেটর চালাবার খরচটাই ওঠে। অক্সিজেন মুখোশ দিয়ে দূষিত বাতাসকে খানিক ফিল্টার করা যায় যদিও, তবে তা দিয়ে বড়োজোর এ-বিল্ডিং থেকে ও-বিল্ডিং-এ যাওয়া, দু’চার মিনিট বাইরে দাঁড়ানো সেটুকুই চলে। অক্সিজেন জেনারেটর না চললে, লম্বা সময়ের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডারই একমাত্র পথ।
জানা গেল, দিনের বেলা, যখন ক্লাস চলে, সে-সময় আমাদের হস্টেলে থাকা কড়াভাবে নিষিদ্ধ। কতটা কড়া? সেইটে বোঝাতে গিয়ে দেখা গেল মিসেস ওডুওলের মাথায় একটাই উদাহরণ এসেছে- কোনো মেয়ের মাসিকের সময় খুব বেশি রক্তস্রাব হতে থাকে যদি, তাহলেও তার দিনের বেলা হোস্টেলে থাকা চলবে না!
এরপর আর একজন বক্তা এসে ভদ্রসভ্য পোশাক পরবার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দীর্ঘ জ্ঞান দিয়ে গেলেন। সেটা করতে গিয়ে উদাহরণস্বরূপ আমাদের মধ্যে থেকে এক
 দুর্ভাগা মেয়েকে বেছে নিয়ে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমাদের বোঝানো হল কোনটা ভদ্র পোশাক নয়, আর এ-বিষয়ে আমাদের কী কী না করা উচিৎ। এই বক্তাটিও একজন মহিলা। তিনি মেয়েটার নেল পলিশ মাখা লম্বা লম্বা নখগুলোকে দেখিয়ে বেশ অঙ্গভঙ্গী করে বললে, “এসব সাজগোজ এখানে চলবে না। ওতে ছেলে, মেয়ে উভয়েরই মনঃসংযোগে বিঘ্ন হয়। মেয়েরা এতে নিজেরাও সাজগোজ করবার জন্য মানসিক চাপ অনুভব করবে। আর পুরুষরা… তারা মেয়েদের কাছে একমাত্র কোন জিনিসটা
 চেয়ে থাকে সেটা তো  আমরা সকলেই জানি।”
কথাটা শুনে ঘরময় একটা চাপা হাসির রোল উঠল। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এরা আকাদেমিতে শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য এ-ধরণের সেক্সিস্ট কথাবার্তা ব্যবহার করে কোন স্পর্ধায়!
তবে ভদ্রমহিলার বক্তব্য তখনও শেষ হয়নি। তিনি বলে চলেছেন, “কখনও কখনও মেয়েরাও মেয়েদের থেকে ওই জিনিস চায়, সে-ও আমাদের অজানা নয়…” এবারে ক্লাসময় হাসির শব্দ আরো খানিক চড়া হল। আর এবারে, মাইক্রোফোনের দিকে একেবারে ঝুঁকে এসে তিনি মেয়েটাকে ফিসফিস করে প্রশ্ন.. করলেন, “তা, এমন ..লম্বা নখ নিয়ে ওসব জায়গায় ধোয়াধুয়িটা কী করে…”
হাসির শব্দ এবারে উদ্দাম হয়ে উঠল হল জুড়ে। বক্তার শিকার মেয়েটা লজ্জায় যেন গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তখন। তাকে সেই অবস্থায় রেখে ভদ্রমহিলা এবারে অন্য প্রসঙ্গে গেলেন। একে নিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
“কীভাবে ধুইয়ে দিল দেখলি? একেবারে পেশাদার কাজ!” ওভোকের দিকে ফিরে নীচুগলায় বলে উঠলাম আমি।  কিন্তু ওভোকের
 দেখি এতে কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। থাকবে কোথা থেকে? নিজের অসুখটা নিয়েই তো জ্বলছে অষ্টক্ষণ।
কেন যে এখনও মেয়েদের এরা এমন চোখে দেখে কে জানে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ নষ্ট হয়ে যাওয়া বাতাসের দুনিয়ায় ফিল্টার আর শ্বাস নেবার বাতাস কেনবার জন্য দমবন্ধ করে গাধার খাটুনি তো ওদেরও খাটতে হয়! তার বিনিময়ে সামান্য সম্মানটুকুও কি পেতে পারে না ওরা? নাকি, প্রজাতন্ত্রের সবচাইতে লাভজনক, সবচাইতে ক্ষমতাবান পেশায় ছেলেদের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করে ঢুকে আসাটা মেয়েগুলোর পক্ষে অন্যায়রকম সাহসের কাজ হয়ে গেছে?
অনুষ্ঠান শেষ হতে বক্তারা মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন একে একে। ছাত্ররা ধৈর্য ধরে যার যার ডেস্কে বসে রইল। আমাদের প্রত্যেকের ডেস্কে একটা করে  ইলেকট্রনিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার আঁটা রয়েছে। ওতে আঙুল ঠেকিয়ে ক্লাসে আসা-যাওয়ার প্রমাণ জমা দিতে হয় আমাদের। নিয়ম হল, গোটা ক্লাসের মিলিত হাজিরা পঁচাশি শতাংশের কম হলে পরীক্ষায়
 বসতে পারবে না কেউ। এতে করে ক্লাশের প্রত্যেকেই বাকিদের হাজিরার ব্যাপারে খেয়াল রাখবে।
খানিক বাদে অধ্যাপকরা সবাই চলে যেতে এইবার ছাত্ররা দলবেঁধে হল থেকে বেরোবার দরজাগুলোর দিকে ছুট দিল। এক নম্বর দরজা ‘বার ১’ ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত। এরা উচ্চবর্গীয় ছাত্র। মুখে অসম্ভব দামি সব মুখোশ। এরা চিন আর আমেরিকায় এলএলবি পাশ করে আকাদেমিতে এসেছে। চূড়ান্ত বড়োলোক বাদে এখানকার কেউ বিদেশি কলেজে আইন পড়তে যেতে পারে না।
 ওসব জায়গায় খরচ যেমন বেশি, তেমন ডিগ্রিটাও মাত্র তিন বছরে হাতে এসে যায়, নাইজেরিয়ার কলেজগুলোর মত পাঁচ বছর ধরে ঘষটাতে হয় না। বিদেশ থেকে এলএলবি করে আসা ছাত্রদের  ‘উৎকৃষ্ট’ ছাত্র হিসেবে মানা হয়। তাদের সঙ্গে আকাদেমির আচার-আচরণও খানিক অন্যরকম। নাইজেরিয়া থেকে পাশ করে আকাদেমিতে আসা ছাত্রদের সঙ্গে তারা বিশেষ মেলামেশা করে না। আসলে CAT, মানে চাইনিজ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতায় চিন সরকার ওদের এই
 দামি মুখোশগুলো দিয়েছে। তাছাড়া, কিছু অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক সুবিধের বিনিময়ে এদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে অক্সিজেন সরবরাহটারও ভার
নিয়েছে ওরা। ফলে দেশের বুকে এহেন মালিকদের কৃপধন্যদের পা যে  মাটিতে ঠেকবে না সে তো বলাই বাহুল্য।
জলবায়ু বিপর্যয়ের পর এদেশে একটা বড়ো বদল এসেছে। BAT, মানে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির নাইজেরিয়ায় যত শেয়ার আর প্রতিষ্ঠান ছিল, সেই সমস্তগুলোই চিন কিনে নেয় ওর পরে। তাদের ওপর
 CAT এর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। উপস্থিত গোটা দেশটাকে দুটো সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছে আমেরিকান আর চিনা বিনিয়োগকারীরা। দুটো দল নিজেদের মধ্যে একটা নড়বড়ে সম্পর্ক বজায় রেখে এদেশের বুকে কাজ চালিয়ে চলেছে ওর পর থেকে। নিজেদের কাজেও বদল এনেছে এরা। তামাকের ব্যাবসা ছেড়ে দিয়ে  বায়ুশোধক, বায়ু নিয়ন্ত্রক, অক্সিজেন মুখোশ হেন বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে সরে এসেছে দ্রুত। জিনিসগুলো এখন মানুষের বেঁচে থাকবার জন্য আবশ্যিক। অতএব
 নিশ্চিত বাজার।
বিপর্যয়টার আগে, যখন, চাও বা না চাও, জীবনের প্রাচুর্য ছিল, সে-সময় ওরা সিগারেট নামের মৃত্যু বিক্রি করত। বিপর্যয়ের পর বাতাস যখন মৃত্যুতে বদলে গেল, পৃথিবীটা বেঁচে থাকবার পক্ষে অযোগ্য হয়ে উঠল, তখন এই পণ্যওয়ালা দলগুলো চোখের পলকে ভোল বদলে ফেলল। এখন পৃথিবীতে মৃত্যুর প্রাচুর্য। জীবনের দাম চড়া। অতএব ওরা এখন জীবন বেচে। অক্সিজেন বেচে। অক্সিজেন এখন জীবনের আমানত। তার বিনিময়ের ভিত্তিতেই আমাদের মুদ্রা-ব্যবস্থা- ‘অক্সি ক্রেডিট’। তোমার যত ঋণ, যত ঘাটতি, তার হিসেব হয় কার্বন ডাই অক্সাইডের মুদ্রায়। যারা সবচেয়ে বেশি দাম দিতে পারে তাদের কাছে অক্সিজেন বেচে এরা। এদের প্রধান খদ্দের হল বিভিন্ন সরকার। তারা তা কিনে নিজেদের কর্মচারীদের জন্য ভরতুকি মূল্যে বিক্রি করে। এদের বাকি খদ্দেররা হল ওপরতলার ধনী মানুষজন। ফলে সমাজের.. .. বাকি মানুষদের জন্য সবসময়েই অক্সিজেনের ঘাটতি থেকে যায়।
এক নম্বর দরজা দিয়ে অহঙ্কারী ময়ূরদের মত সগর্বে বেরিয়ে যাচ্ছে বার-১ গোত্রের ছাত্ররা। আমি তাদের পিছু পিছু সেদিকে পা বাড়াতে যাব, তা ওভোকের হাতটা এসে আমায় আটকে দিল।
“ওদিকে নয় রে। ফালতু ঝামেলা হবে।”
আমি মুচকি হেসে ওকে নিয়ে অন্য একটা দরজা দিয়ে বের হয়ে এলাম। তারপর হোস্টেলের দিকে পা চালাতে চালাতে ওভোকের দিকে ঘুরে দেখলাম একবার। ‘জ্ঞানবাণী’গুলো আমায় যতটা ধাক্কা দিয়েছে ওকে ততটা নয়। শুনতে শুনতে সারাক্ষণ চোখ নাচিয়ে হেসে গিয়েছে মিটমিট করে। তবে আমার মনটা ও ভালো বোঝে। বলল, “চল একটু হাঁটি দুজনে।”
“চল তবে,” আমি জবাব দিলাম, “আজ আর কোনো ক্লাশটাশ নেই। মাথাটা একটু হালকা করে নেয়া যাক।”
শুনে ওভোকে আমার একটা হাত জড়িয়ে ধরল। তারপর দুজনে বাইরের দিকে পা বাড়ালাম।
রাস্তায় একটা পাহারাদারের সঙ্গে দেখা। কাছে আসতেই আমি ওর দিকে একটা অক্সি-২২০ র কার্ড এগিয়ে দিলাম। ওতেই তার সমস্ত কৌতূহলের নিবৃত্তি হয়ে গেল। কার্ডটা বেশ সপ্রতিভভাবে পকেটে পুরে নিয়ে সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। আমরাও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। বিষাক্ত আকাদেমিটার চৌহদ্দির বাইরে তখন শান্ত একটা বিকেলের গায়ে সূর্যাস্তের রঙ ছড়িয়ে পড়ছিল।
***
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। বিষাক্ত প্রতিষ্ঠানটার রোজকার জীবনে মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছি আমরা ততদিনে। হাজারো অ্যাসাইনমোজেক্ট। অজস্র দলগত প্রজেক্ট। গভীর রাত অবধি সেসব কাজ সেরে পরদিন ক্লাশে এনে জমা দেয়ার রুটিনে দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে। মাঝেমাঝেই এখানে আগে থেকে কিছু না বলে যখন-তখন প্রশ্নোত্তরের আসর বসে। সেসব কুইজে ভুল জবাব দিলে সবার সামনে জঘন্যভাবে অপমান করা হয়। সেই লজ্জা আর অসম্মানের হাত থেকে বাঁচতে ক্লাশের পরেও মাথা গুঁজে যথাসম্ভব অতিরিক্ত পড়াশোনাতেও ক্লান্তি ঠেকে না এখন আর। রাতে জেনারেটার বন্ধ হবার পর ভালো করে নিশ্বাস নেবার জন্য অক্সিজেনের মজুতদারি… তার শিক্ষাও হয়ে গেছে আমাদের।
গোটা সপ্তাহ জুড়ে খাটবার পর প্রজেক্ট আর অ্যাসাইনমেন্টের ঠেলায় শনিরোববারগুলোও বিশ্রাম নেয়া যায় না এখানে। তবে, খাটুনিতে কমতি না দিলেও, ব্যক্তিগতভাবে এইসব কাজকর্ম নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা আমার নেই। সপ্তাহের মধ্যেও নয়, সপ্তাহান্তে তো নয়ই।
এই সপ্তাহান্তে ওভোকে আকাদেমিতে নেই। ইকেজা-য় ওদের বাড়িতে গেছে ছুটি নিয়ে। আগামি সপ্তাহের মাঝামাঝি ওর কেমোথেরাপি আছে। ওর অভাবটা ভীষণ টের পাচ্ছি আমি। আসলে, ও থাকলে, ক্লাশে ওর দিকে খেয়াল রাখা, ক্লাশের বাইরে ওর খাবার কিনে আনা, ওর জল ভরে এনে দেয়া, হাসিঠাট্টা, একসঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরে বেরানো এগুলো থাকে। ওতে ওভোকের মনটা ভালো থাকে। সেইসঙ্গে আমিও এখানকার বাকি লোকজনের ভয়াবহ আচরণ সয়ে পাগল হয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা পাই।
ওকে ছাড়া কেমন ফাঁকা ঠেকে সবকিছু। পাতলা, বিষাক্ত বাতাস থেকে টেনে নেয়া প্রত্যেকটা শ্বাস বুকে বাজে আরো বেশি করে। ক্লাশরুম বা হোস্টেলের শোধন করা হাওয়া
 কিংবা  যন্ত্রে বানানো অক্সিজেন… ওতেও তৃপ্তি হয় না। বায়ুমণ্ডল নষ্ট হয়ে যাবার পর এই বিষাক্ত নিষ্প্রাণ বাতাসে শ্বাস নিয়ে দেখতে দেখতে দশটা বছর তো কেটে গেল আমাদের!  তাই, এখানে ওই ওভোকে-ই আমার একঝলক বিশুদ্ধ বাতাস। শুধু ও আছে বলেই এই ভয়ঙ্কর জায়গাটাকে সহ্য করে এখনও টিকে আছি আমি… ক্লাশরুমে, হোস্টেলে, স্টাফরুমে মূর্খতা আর অভব্য আচরণ সইতে সইতে এখনও যে আমি ফেটে পড়িনি সে ওই ওভোকে পাশে রয়েছে বলেই।
ও নেই, তাই ঠিক করলাম আমিও বাড়ির এলাকায় ঘুরে আসি কয়েকদিন। তবে সেজন্য মূল ভূখণ্ডে যেতে হবে। ওখানকার বাতাস অবশ্য এখানকার চাইতেও খারাপ। আমাদের আকাদেমিটা একটা খুদে দ্বীপের মধ্যে গড়া হয়েছে। লাগোস-এর এই চত্বরটা বড়োলোকদের এলাকা। গভর্নর মাইক ওলুওলের সতর্ক নজরদারিতে এ দ্বীপের বাতাসকে যথাসম্ভব শুদ্ধ রাখা হয়। বুঝতেই পারছেন ভালোভাবে শ্বাসটাস নেবার অধিকারটা আসলে বড়োলোকদের।
মূল ভূখণ্ডের ছবিটা অবশ্য আলাদা। প্রচুর মানুষ। প্রচুর দারিদ্র্য। কিন্তু তবু, ওখানেই আমার বাড়ি যে! সাধারণত ওদিকে যেতে হলে আমি আমার ‘টেমপারেচার রেগুলেশন স্যুট,’ মানে ওই TRS, গায়ে চাপিয়ে যাই। গত দশ বছর ধরে ওখানকার উষ্ণতা বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে TRS না পরে ওখানে গেলে হিট স্ট্রোক হয়ে যাবার ভয় থাকে। তবে এযাত্রা আর সেটা সঙ্গে নেবার উপায় নেই। ওভোকে বাড়ি যাবার সময় স্যুটটা ওকে দিয়ে দিয়েছি।
কাজেই খাড়া রোদে চামড়া পোড়ানো গরমে ঘামতে ঘামতে বেশ খানিক অপেক্ষা। তারপর একটা সরকারি বাস এল। দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডের সীমান্ত অবধি যাবে বাসটা। ওর মধ্যে নিজস্ব শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। ভেতরের বাতাসটা দুষিত হলেও খানিক ঠান্ডা তাই। বাইরের গরম থেকে ওর ভেতরে ঢুকে সেই ঠান্ডা ছোঁয়া লেগে বড়ো আরাম হচ্ছিল। আমার সব কষ্ট, সব উদ্বেগ যেন ধুয়ে যাচ্ছিল সেই হাওয়ার ছোঁয়ায়।
মূল ভূখণ্ডের সীমান্ত থেকে আমার বাড়ি পৌঁছোবার পথে বেশ কয়েকবার বাস বদলাতে হয়। বাসগুলোর অবস্থা করুণ। মাঝেমধ্যেই ব্রেকডাউন হয়ে দুর্গতির একশেষ ঘটায়।
খানিক বাদে একটা ড্যানফো বাস আসতে সেটায় উঠে বসলাম। এইবারে কষ্ট শুরু হল আমার।
ড্যানফোর ভাড়া কম নয়। পুরো অক্সি-২১৭ নিল কান মুলে। এ-বাসটায় বায়ুশোধনের একটা চলনসই বন্দোবস্ত আছে, ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট কম হয়। তবে গরমে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে একেবারে।
বাসের বাকি সব সওয়ারদের দেখি তত কষ্ট হচ্ছে না। হাট্টাকাট্টা চেহারার লোকজন সব। দেখে মনে হয় এমন গরম তাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। এরা আসলে মূল ভুখণ্ড থেকে আমাদের দ্বীপে কাজ করতে আসে রোজ। দেশের যত লাভজনক কোম্পানি আর কর্পোরেশন, সবার অফিসই তো এই দ্বীপটায়। আমাদের শ্বাস নেবার বাতাস বেচে যারা সেই CAT-এর অফিসটাও এইখানে। ফলে কাজের খোঁজে মূল ভূখণ্ড থেকে লোকগুলোকে এখানে আসতেই হয় প্রতিদিন। রোজ রোজ নিজেদের এলাকা আর দ্বীপের মধ্যে যাতায়াত করবার ফলে আরাম আর গরম দুই-ই সয়ে গেছে এদের।
ওইংবো পৌঁছে বাস বদলালাম। এ-বাসটা লাগোস বিশ্ববিদ্যালয় অবধি যাবে। ওখানেই গ্র্যাজুয়েশন করেছি আমি। তবে এযাত্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা হবে না অবশ্য। যাব আরো দূরে। কাজেই ইউনিভার্সিটির দরজার সামনে নেমে সেখান থেকে বারিগাগামী অন্য একটা বাস ধরলাম।
একমাত্র উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে আর কারো থাকবার বন্দোবস্ত নেই। কাজেই ইউনিভার্সিটির বাকি সমস্ত লোকজনের থাকবার আস্তানা ওই বারিগা। সেখানেও,
 ভালো হোস্টেলগুলো বিদেশি ছাত্রদের জন্য রাখা। এদের ট্যাঁকের জোর আছে। ফলে হোস্টেলের জন্য মোটারকম অক্সি-ক্রেডিট  দিতে পারে। তারা বাদে ইউনিভার্সিটির লাখখানেক ছাত্রের বেশির ভাগটাই সেখানে বাসা নিয়ে থাকে। অধ্যাপকরাও অধিকাংশই ও-চত্বরে থাকেন। সে ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ছোটোখাটো স্তরের অনেক কর্মচারীও ওখান থেকেই যাতায়াত করে।
বারিগায় বারিগায় নেমে একটা কেকে১ নিয়ে আমি চললাম তার শহরতলির দিকে। জায়গাটা মোটেই খুব একটা নিরাপদ নয়। ওদিকটা ‘বুকানিয়ার’২ আর ‘আই’৩ এই দু’ধরনের ছাত্রগোষ্ঠীর ঘাঁটি।
শহরতলীতে আমায় নামিয়ে দিতে ‘কেকে’ওয়ালাকে অক্সি-২৪ দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে আমি বড়োরাস্তা ছেড়ে পাশের একটা গলিতে নেমে এলাম। গলিটা দিয়ে আমার পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের আস্তানায় যাওয়া যায়। ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় তুলনায় নির্বিরোধী একটা বুকানিয়ার উপগোষ্ঠীর সদস্য ছিলাম আমি। এইখানটায় তাদের আস্তানা।
তবে শুনতে যতটা ভয়ঙ্কর ঠেকে, বাস্তবে ব্যাপারটা তত ভয়াবহ কিছু নয়। বুকানিয়ার গোষ্ঠীটা আসলে টাকাপয়সাওয়ালা পরিবারের ছেলেপুলেদের দল। প্রতিবাদি হবার শখে তারা এই দলে এসে ভেড়ে। কখনো-সখনো বে-আইনি কিছু করবার দরকার পড়লে এরা ‘আই’-এর ছেলেপুলেদের খানিক খরচখর্চা দিয়ে সে-সব সামলায়। অন্যদিকে ‘আই’ –এর লোকজন মূলত গরিব ঘরের নোংরা, গুণ্ডা ছেলেপুলে। চলতি ভাষায় এদের হতচ্ছেদ্দা করে কখনও ‘পাখি’ কখনও ‘কপিকল’ এইসব নামে ডাকা হয়। ঠিকঠাক মজুরি পেলে এরা তার জন্য যেকোনো কাজ করতে সবসময় এক পায়ে খাড়া। ‘ঠিকঠাক মজুরি’ মানে বেশি কিছু নয় অবশ্য। যে যা দিতে পারে সেইটুকুই এদের কাছে ‘ঠিকঠাক’।
আশপাশ দিয়ে কিছু মানুষ পুরোনো, জোড়াতালি দেয়া অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে হেঁটে যাচ্ছিল। সত্যি বলতে কী, মূল ভূখণ্ডেও, বড়ো চাকরি-বাকরি করা লোকজন CAT এর দামি বায়ুশোধক মুখোশ কেনে বটে কিন্তু সাধারণ মানুষজনের তত ট্যাঁকের জোর নেই। কাজেই তারা ওই পুরোনো সিলিন্ডার ভরে ভরে পিঠে বয়ে নিয়ে কাজ চালায়। জনসাধারণের জন্য বায়ুশোধন আর অক্সিজেন সরবারহের ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ যে সংস্থাদের করবার কথা, সেগুলোর একেবারে মুমূর্ষু দশা। এমনিতেই আর্থিক অবস্থা তাদের শোচনীয়, তার ওপর যেটুকু আছে সেটাও সরকারি লোকজন লুটেপুটে নিয়ে বড়োলোকদের দ্বীপটায় গিয়ে হাইরাইজে ফ্ল্যাট কিনে ফেলে।
পথচলতি এই লোকজন, কাজেই, আমার মুখের দামি মুখোশটার দিকে কড়া চোখে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। টের পাচ্ছিলাম, এরা আমায় রাস্তা গুলিয়ে ফেলা কোনো বড়োলোকের
 ক্যাবলা সুপুত্তুর ভাবছে;  আর তার মানে এদের মধ্যে কেউ না কেউ আমার জিনিসপত্র ছিনতাই করবার মতলব করবেই, আর তাতে বাধা দিতে গেলে ভালোরকম চোট পাওয়াও অসম্ভব নয়। তা খানিক বাদেই দেখি আশঙ্কাটা মিথ্যে নয়। পেছনে কয়েকটা লোক মিলে দল বেঁধে আমার দিকে আসছে। দেখে আমি হাত ঘুরিয়ে বুকানিয়ারদের সাঙ্কেতিক চিহ্নটা বানিয়ে দেখালাম। তাতে দেখি সে একটু ঘাবড়াল। এবারে আমি ‘আই’দের হাতের সঙ্কেতটাও করে দেখালাম। এতে করে তাদের বোঝানো
 গেল, আমি লোকটা কম কেউকেটা নই। দেখে দলটার পাণ্ডাটা বেশ সমীহ সহকারে মাথা নেড়ে ইশারায় বলে, “যান কর্তা।”
খানিক বাদে আমি আমার গন্তব্যে এসে পৌঁছোলাম। বাড়িটায় আমার এক পুরোনো বুকানিয়ার বন্ধুর আস্তানা। এখনো সে কলেজ পাশ করেনি। পৌঁছে দেখি সেখানে একগাদা কলেজের ছেলেপুলে আর বারিগা-র স্থানীয় লোকজনের ভিড় হয়ে আছে। দু-ঘরের অ্যাপার্টমেন্টটার কোনো একটা জায়গা থেকে স্পিকারে তারস্বরে বাজনা বাজছে। অ্যাপার্টমেন্টটা পুরোনো, ভাঙাচোরা। এলাকার আর দশটা অ্যাপার্টমেন্টের মতই। অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে একটা জেনারেটার চলছিল। ওই দিয়ে একটা পুরোনো বায়ুশোধক যন্ত্র চালানো হচ্ছে। সেটা হেঁচকি তুলতে তুলতে যেটুকু ভালো বাতাস বের করছে তাতে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরের হাওয়ায় খানিক নিশ্বাস নেয় যায়। তবে মজা হল, ভেতরে খানিক ভালো বাতাসের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে জেনারেটারটা বাইরের বাতাসকে তার চতুর্গুণ দুষিত করে দিচ্ছে। এ যেন রামকে মেরে শ্যামের মুখে খাবার দেয়া। আর শব্দের কথা তো বলাই বাহুল্য। তবে হ্যাঁ, একটু ভালো শ্বাস নেবার জন্য সবকিছু করা যায়।
বাতাসে ‘ইবগো’-র গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি। আজকাল, ও জিনিস বড়ো সস্তা হয়ে গিয়েছে। আসলে এখানে জীবনটাই এত হতকুচ্ছিৎ হয়ে গেছে যে ওর থেকে পালাবার জন্য প্রায় সকলেই মাদক নিয়ে চূর হয়ে থাক। তবে হ্যাঁ। ‘প্রায়’ সবাই। একেবারে সবাই নয়। আমার নিজের ও-জিনিস পছন্দ নয়। ও জিনিসের ধোঁয়ায় নাহক নিজের ফুসফুসটাকে শেষ করবার কোনো মানে খুঁজে পাই না আমি। আর কেবল ফুসফুস নয়। ওর ধোঁয়ায় এই মুহূর্তের সবচাইতে দামি জিনিসটাও তো নষ্ট হতে থাকে- বাতাস! বড়ো অভাব এখন ও জিনিসের! তবে কথা হল, এই বুকানিয়ার কিংবা আই-দের বোধবুদ্ধি থাকবে সেটা আশা করাটাই মূর্খামি।
অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে ‘ইবগো’র ধোঁয়ার গন্ধ ধরে ধরে আমি আমার বন্ধুর ঘরটায় গিয়ে ঢুকলাম। গিয়ে দেখি জাইয়েসিমি একদল বন্ধুকে নিয়ে তাস খেলতে খেলতে ইবগো ফুঁকছে। আরেকটা দল ছক্কাপাঞ্জার জুয়োর আসর বসিয়েছে। এক কোণে একটা ভাঙাচোরা খাটিয়ায় নেশায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে কয়েকজন। আমায় দেখে জাইয়েসিমি মাথা নাড়ল কেবল একবার। হাতের খেলাটা শেষ না করে কথা বলতে পারবে না সে।
ঘরে ঢুকে এসে তার লোকজনকে আমি গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় খানিক সম্ভাষণ করলাম, যাতে ওরা বুঝতে পারে আমি দলেরই একজন। অ্যাপার্টমেন্টে বায়ুশোধক আছে দেখে আমি ঢোকবার মুখেই আমার মুখোশটা খুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু ঘরে ইগবো-র ধোঁয়া এমন ঘন হয়ে ঝুলছিল যে মনে হচ্ছিল প্রাণ বেরিয়ে যাবে। এ অবস্থায় হয় দমবন্ধ হয়ে মাথা ঘুরে পড়ব, অথবা মুখোশটা পরে নিতে হবে। দুটো ক্ষেত্রেই এরা আমায় দুবলা বলে ধরে নেবে। অতএব আমি ইশারায় আমার বন্ধুটিকে জানলাম যে তার হাতের খেলাটা শেষ হওয়া অবধি আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। বেরোতে বেরোতে সামান্য একটু কাশি এসে গিয়েছিল। সেটা চাপতে চাপতেই দেখি মুচকি মুচকি হাসছে সব। একজন তো চাপা গলায় বলেই ফেলল, “ব্যাটা জু ম্যান।”
বাইরে বেরিয়ে মুখোশটা এঁটে আমি আমি বুক ভরে শ্বাস টানলাম খানিকক্ষণ। আঃ, প্রাণ বাঁচল! এই বাতাসটুকুর জন্য আমার ওই ‘জু ম্যান’ ডাক শুনতেও আপত্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই গালগালটার মানে হল ‘ব্যাটা গোষ্ঠীর কুলাঙ্গার। ’ গোষ্ঠীতে থাকলে তার হয়ে দরকারে মারদাঙ্গা করলে তবে সদস্য হিসেবে খানিক সম্মান মেলে। তবে সবাই সে সম্মান পাবার যোগ্য তো হয় না! অনেকেই, কেবল নিজের চামড়া বাঁচাবার দায়ে, কিংবা ঝাঁকের পাখি হয়ে থাকবার আশায়, কিংবা অন্য কোনো অহিংস ধান্দায় গোষ্ঠীতে নামটা লিখিয়ে রাখে, চাঁদাটাদাও দেয়, কিন্তু তার বেশি গা লাগায় না। এদের কপালেও ওই ‘জু ম্যান’ শিরোপা জোটে।
এদের দলে আমি ভিড়েছিলাম যাতে কেউ আমার পেছনে না লাগে সেই আশায়। আসলে এখানে, হয় তোমাকে ঘা খেতে হবে মুখ বুঁজে, নয় ঘা দিতে হবে। এর মাঝামাঝি কোনো জমি নেই আর এখানে। আমি তাই ঘা দেনেওয়ালাদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলাম; একটু আলগাভাবেই অবশ্য।
খানিক বাদে জাইয়েসিমি বেরিয়ে এল। ভেতরে কারো কোনো কথায় তখনো তার মুখে একটুকরো হাসি লেগে রয়েছে। হাতের চুরুটটার শেষ অংশটায় একটা টান দিল সে। তারপর আমার দিকে বাঁকা চোখে একঝলক দেখে সেটাকে নিভিয়ে পোড়া টুকরোটা যত্ন করে পকেটস্থ করল। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। তারপর ও জিজ্ঞাসা করল, “আকাদেমিতে চলছে কেমন রে?”
“ভালোই। তবে সবাই যে ভালো আছে তা নয়।”
“আহা সেরকমটাই তো হবার কথা!” বলতে বলতে একটু হাসল ও, “মাঝেমধ্যে ওখানকার লোকজনের থেকে দু চার কথা কানে আসে তো! এই ইউনিভার্সিটির মতই দশা।”
“তা একরকম ঠিক,” আমি জবাব দিলাম, “পড়ার চাপটা আরো বেশি, উলটপালটা কাজকর্মও বেশি, শুধু সময়টা তুলনায় কম মেলে।”
“হুম,” জাইয়েসিমি বেশ সবজান্তার মত ঘাড় নাড়ল, “খারাপগুলো বেশি, ভালোটা কম।”
“একদম,” আমি জবাব দিলাম, “পড়াশোনার ব্যাপারটাই সবচাইতে জঘন্য। তবে আমি ঠিক সামলে নাব। জানিসই তো ওইটে আমার বাঁ-হাতের খেল।”
জাইয়েসিমি মাথা নাড়ল।
ফের .. ..খানিক চুপচাপ। ..তারপর.. জাইয়েসিমি.. বলে, “তোদের আকাদেমির ওই ডক্টর উমেজ-এর ব্যাপারে কানাঘুষোয় অনেক কিছু শুনি। তোকেও কি জ্বালাচ্ছে নাকি লোকটা?”
“জ্বালাচ্ছে বলতে?”
“আহা বোঝে না যেন,” বলতে বলতে আমার গা ঘেঁষে এল জাইয়েসিমি, “শুনতে পাই লোকটা নাকি জোর করে লোকজনের সঙ্গে শুতে চায়। তা তোকেও কি…”
“আরে দাঁড়া দাঁড়া,” বলতে বলতে আমি ওকে থামিয়ে দিলাম, “তাতে আমার সমস্যা হবে ভাবলি কেন? ও তো মে… ওহো! বুঝেছি। তুই ধরে নিয়েছিস আমি সমকামী আর ডক্টর উমেজও ছেলেদের সঙ্গে…”
জাইয়েসিমি চুপ করে রইল। আমার সন্দেহ হচ্ছিল। খানিক বাদে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ড উমেজ কি ছেলেদের সঙ্গেও… কিন্তু লোকটার তো বউ আছে! বাচ্চাকাচ্চাও আছে। বেশ ধার্মিকও। সমকামী হওয়া তো…”
“…আইনত অপরাধ। ধরা পড়লে এ-চত্বরে হলে চোদ্দো বছরের জেল আর উত্তরের এলাকায় হলে ফাঁসি, এই বলবি তো?” বলতে বলতে চোখ নাচাল জাইয়েসিমি, “ওসব আইন কানুন হল ছোটোলোকদের জন্য। আকাদেমির মাস্টারদের ওপর ওসব নিয়মটিয়ম খাটে না।”
“কিন্তু… লোকটার রীতিমত একটা মেয়েমানুষ বউ আছে তো!”
“আরে তাতে কী কারো আটকায়? না আটকেছে কখনও? লোকটা হয় বাইসেক্সুয়াল, আর না হলে মেয়েবাজির অভিনয়টা করে আসল চরিত্রটাকে ঢাকবার জন্য। তবে যেটাই করুক, আমার কাছে যা খবর আছে তাতে লোকটা ছেলে মেয়ে কাউকেই ছাড়ে না।”
লোকটার ব্যাপারে আমি যা জেনেছি এই ক’দিনে সেই নিয়ে একটু ভাবলাম আমি এবারে। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, “উমেজ তো ধর্মকর্মও করে। চার্চের ডিকন তো!”
“ওইটেই তো ভালো ছদ্মবেশ।”
“আচ্ছা, এখানে বসে বসে তুই আকাদেমিতে কী চলছে সে-সব খবর এত পাস কী করে বল তো? ছুটকোছাটকা খবর হাওয়ায় ভাসে তা ঠিক। কিন্তু তাই বলে আমার বা উমেজ-এর যৌন জীবন নিয়েও এত খবর তুই সত্যি সত্যি পাস? নাকি…”
“পাই, কারণ নিজের সমাজের লোকজন কোথায় কেমন আছে, নিজেদের সমাজে কোথায় কী চলছে, সে নিয়ে খোঁজখবরটা আমি রাখি।”
“আকাদেমিটা আবার কবে থেকে তোর নিজের সমাজ হল রে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। তাতে দেখি সে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। দেখে এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই নিজে সমকামী নাকি?”
প্রশ্নটা সহজেই করে বসলাম, কারণ আমার ধারণা, লোকজনের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে আমি বিশেষ মাথা যে ঘামাই না সে-কথাটা জাইয়েসিমি রাখে। যতক্ষণ সম্পর্কটা সুস্থ থাকছে ততক্ষণ কে সমকামী কে বিষমকামী, কে উভকামী তাতে আমার কী যায় আসে? আমি তার বিচার করবার কে?”
জবাবে ও আমার কাছ ঘেঁষে এল একেবারে, “জবাবটা মুখে না দিয়ে হাতে কলমে দেখাতে পারি। রাজি?”
আমি হাসলাম। বুঝতে পারছিলাম, জাইয়েসিমি ঠাট্টা করছে। আবার ওরই পাশাপাশি মনে হচ্ছিল, হয়তো সত্যিও বলছে একটুখানি। আসলে আমাদের এই সমাজটা এমনই যে এখানে কেউ খোলাখুলি এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলে না। বদনামের ভয় বড়ো ভয়।
“নাঃ। ওতে আর কাজ নেই” আমি মাথা নাড়লাম, তারপর একটা খোঁচা মেরে বললাম, “প্রস্তাব তো ভালোই কিন্তু সমস্যা হল আমার আবার খানিক বুদ্ধিশুদ্ধিওয়ালা পার্টনার ছাড়া পছন্দ হয় না।”
“মাথাটা গেছে তোর!” জাইয়েসিমিও হাসল, “শেষবার যা দেখেছি, তাতে তোর নিজের রেজাল্টের হালও তো পাতে দেবার যুগ্যি নয়। তোর আবার তাহলে বুদ্ধিশুদ্ধিওয়ালা পার্টনার দিয়ে কী হবে? ব্যাটা থার্ড ক্লাস নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে, তার আবার বড়ো বড়ো কথা!”
“আরে, আমি বলেছি বুদ্ধিশুদ্ধিওয়ালা। ভালো রেজাল্টওয়ালা বলেছি নাকি? তাছাড়া, আমি তো তাও গ্র্যাজুয়েটটা হয়েছি। তুই তো এখনো ঘষটাচ্ছিস।”
“তা অবশ্য ঠিক,” জাইয়েসিমি ঘাড় নাড়ল।
“আর তাছাড়া আমি নিজেও ও লাইনের নই…”
“ঠিক।”
ফের দুজন খানিক চুপচাপ। তারপর আমিই প্রথম কথা বললাম ফের, “তাহলে, তোর খবর মোতাবেক ডক্টর উমেজ ছেলে, মেয়ে যাকে পায় তাকেই ধর্ষণ করে তাই তো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।” আমার দিকে না তাকিয়েই কথাটা ছুঁড়ে দিল জাইয়েসিমি।
“হতচ্ছাড়াটাকে মেরে দিলে হয় না?”
জাইয়েসিমি আমার দিকে ঘুরে তাকাল, “খুন করবার মত কবজির জোর আছে তোর?”
“পরখ করে দেখিনি। তবে দেখা যাক! হয়তো…”
আমার দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকিয়ে রইল জাইয়েসিমি।
এইবার আসল কথা। একটু ইতস্তত করলাম আমি, “আমার মেসেজটা পেয়েছিলি তো তুই? অক্সিজেন এরিনা?”
এইবার অবাক ভ্রুদুটো ধনুকের মত বাঁকিয়ে তুলল জাইয়েসিমি, “তুই… সত্যি সত্যিই…”
“হ্যাঁ রে।” আমি মাথা নাড়লাম। একটু বিরক্তিই লাগছিল। এমন একটা ব্যাপার নিয়ে আমি ঠাট্টা করব এ-কথা জাইয়েসিমি ধরে নিল কেমন করে?
“রোজগারের এতই দরকার পড়েছে তোর? কীসের জন্য?” প্রশ্নটা করেই প্রায় একই সুরে জবাবটাও দিয়ে দিল সে, “বুঝেছি। আইন আকাদেমির কোর্স…”
ব্যাপারটা বুঝে নেয়া জাইয়েসিমির পক্ষে কঠিন ছিল না। চেষ্টা করলে পড়াশোনাটা আমি ভালোই করতে পারি। কিন্তু মুশকিল হল, সেই চেষ্টাটাই করবার ইচ্ছে আমার হয় না বিশেষ। পড়াশোনার এই জায়গাগুলো আমার জন্যে একরকম বাধ্যতামূলক অভিশাপ বলা যায়। একরকম জোর করেই চালিয়ে যেতে হয় আমাকে। আমি আঁকতে ভালোবাসি। লিখতে ভালোবাসি। কিন্তু বাড়ি থেকে ওতে রাজি হল না। ওদের একটাই দাবি- সিভিল সার্ভিসে ঢুকে সরকারি অফিসার হবার জন্য পড়তে হবে আমায়। মাস গেলে প্রচুর অক্সি-ক্রেডিট মেলে ওতে। তাছাড়াও প্রচুর অক্সিজেনের জোগানও মেলে।
কিন্তু… শুধু বাঁচবার জন্য বেঁচে থাকার মানেটা কী? অতএব, যেটুকু পারি জীবনটাকে এর মধ্যেই উপভোগ করে নিই আমি। আর তারপর, সুযোগ পেলেই পরীক্ষায় টুকে পাশ করে যাই। টোকবার সুযোগ না পেলে, পড়াশোনাটাও ঠিকঠাক না হলে তখন কতবার তো ঘুষ দিয়েও পাশ নম্বর জোগাড় করে নিয়েছি। ওরই মধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন থার্ড ইয়ারে পড়ছি তখন বাবা চলে গেলেন। বাড়ি থেকে যেটুকু সাহায্য মিলত সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। আর এবারে, এই আকাদেমির পরীক্ষা পার হবার জন্য আগে যা লাগত তার চেয়ে পাঁচগুণ খরচ করতে হবে আমায়। টাকাটা আমার একসঙ্গে চাই। কে দেবে? অতএব সম্বল ওই অক্সিজেন এরিনা।
জাইয়েসিমি আমার দিকে কড়া চোখে তাকাল একবার। ওর দৃষ্টিটা দেখে বুঝতে পারছিলাম, কোনো একটা স্তরে ও-ও আমাকে ‘জু ম্যান’ই ভাবে। অক্ষম একটা ধোঁকাবাজ। মনেপ্রাণে ওদের একজন হতে না পারা, নিজের ধান্দা মেটাবার জন্য দলে এসে ভেড়া একটা কুলাঙ্গার। খানিক বাদে সে বলে, “ভেবেচিন্তে বলছিস তো? তুই সত্যি সত্যিই…”
আমি ঘাড় নাড়লাম।
“ভালো। তোর জীবন, তুই যা খুশি করবি,” বলতে বলতে একবার কাঁধ ঝাঁকাল ও, “দেখি, আমি প্যাপিলোকে ফোন করছি।
***
‘আই’-দের এক ছোকরার সঙ্গে আমি আর জাইয়েসিমি গিয়ে পৌঁছোলাম একটা ভূগর্ভস্থ চত্বরে। জায়গাটাকে ওরা ‘অক্সিজেন এরিনা’ বলে ডাকে। অক্সিজেন রণাঙ্গন! জায়গাটায় ইস্পাতের চেয়েও শক্ত প্লেক্সিগ্লাসের একটা বড়োসড়ো খাঁচা। দেয়ালগুলো স্বচ্ছ। তার ভেতরে, আঁটোসাঁটো কালো বডিস্যুটে শরীর ঢেকে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি। খাঁচার চারপাশ থেকে অজস্র ক্যামেরা সমস্ত সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণ থেকে নজর রেখে চলেছে তাদের দিকে।
আজকাল, আগেকার দিনের সেই কিডনি বিক্রি কিংবা ইনটারনেটের জালিয়াতির জায়গা নিয়েছে এই অক্সিজেন এরিনা। তাড়াতাড়ি কাঁচা পয়সা রোজগারের একমাত্র পথ। সরকার আর CAT-এর গোপন আঁতাতে এই বে-আইনি ব্যাবসাটা চালানো হয়। খাঁচার ভেতরের এই লড়াইগুলোর লাইভ স্ট্রিমিং করা হয়। এ-ধরণের বিনোদনগুলোর পৃষ্ঠপোষকের অভাব নেই। ক্ষমতা আর অর্থবলের চুড়ায় বসে থাকা তেমন বহু লোকজন এগুলোকে স্পনসর করে।
যেকোনো মূল্যে চট করে বেশ কিছু টাকা কামাবার দরকার পড়ে যাদের, তেমন মানুষজন এখানে লড়তে আসে। রাজ্যের ঠগ জোচ্চোর গুণ্ডা এসে ভিড় করে এখানে। অনেক সময় আবার নানান ছাত্রগোষ্ঠীর সদস্যরাও এখানে এসে জড়ো হয়। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির মীমাংসা করতে তারাও এই এরিনাকে বেছে নেয়। কারণ, বাইরে লাশ ফেললে তাতে যে খুন করল আর যে খুন হল তাদের কারোই রোজগার নেই কোনো। এখানে এসে লড়লে, অন্তত যে বাঁচবে সে একদিনে তিরিশ বছরের রোজগারের সমান পরিমাণ কামিয়ে নিতে তো পারবে! পঞ্চাশ হাজার অক্সি-ক্রেডিট! ওতে সারাজীবন ধরে নিশ্বাস নিতে পারবার মত অক্সিজেন কেনা যায়। সেই নিশ্বাস নিতে পারবার স্বপ্ন নিয়ে এরা লড়ে, মরে। আর, আকাদেমির পরীক্ষায় উতরে যাবার জন্য আমিও আজ এই পথেই রোজগার করতে এসেছি এইখানে।
জাইয়েসিমি একটু অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। যেন বুঝে নিতে চাইছে, নিজের জীবনটা নিয়ে এতবড়ো একটা জুয়া আমি ঠিক কেন খেলতে নেমেছি। আমি ওর দৃষ্টিটাকে পাত্তা দিলাম না।
খানিক বাদে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাম ঘোষণা করা হল। খাঁচার কাচের দরজা বন্ধ করে দেয়া হল। ওর ভেতরে এখন বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সরবরাহ হয়ে চলেছে। যাতে ওরা বুক ভরে নিশ্বাস নিতে নিতে লড়তে পারে। মরতে পারে। হত্যা ও মৃত্যুর পথকে সুগম করতে জীবনদায়ী বাতাসের সরবরাহ! ব্যাপারটার মধ্যে একটা অন্ধকার রসিকতা আছে একটা। এ লড়াইয়ের অনলাইন দর্শকরা এই রসিকতাটাকে অনুভব করেন, উপভোগ করেন।
এরিনার ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বীরা এইবার একে অন্যের মুখোমুখি হয়ে লড়াই শুরু করল। খাঁচার মাথার ওপর বসা ঘোষক তাদের প্রত্যেকটা আঘাত আর প্রত্যাঘাতের উত্তেজক বিবরণ দিতে শুরু করেছে। লড়াইটা ক্রমশই দীর্ঘ হচ্ছিল… দীর্ঘ… নোংরা… কুৎসিত!
আমি অপলকে ওদের দিকে দেখছিলাম। মানুষদুটো একে অন্যকে আঘাত করছে… করেই চলেছে… একটা সময়ে এসে পৌঁছে অসহ্য ক্লান্তিতে ভালো করে দাঁড়াতে পারছে না ওরা। ওদের আমি চিনি না। কেন যে ওরা এই এরিনায় খুন করতে বা খুন হতে এসে হাজির হয়েছে তা-ও জানি না। কিন্তু… মানুষগুলোকে আমি বুঝি। ওরা দুজনেই আসলে আমি। আমিই লড়াই করছি ওই দুটো চেহারা নিয়ে। ছাত্রগোষ্ঠীর গুণ্ডা? বদমাশ! উদভ্রান্ত কোনো সন্তান? ভাই? পিতা? হতে পারে। যা খুশি পরিচয় হতে পারে ওদের। কিন্তু, ওরা লড়ছে ওদের নিশ্বাসের বাতাসের অধিকারের জন্য। এ-অধিকারের দাবীতে আর যেকোনো লড়াইয়ের থেকে এ-লড়াইটাও কম নৈতিক নয়।
হঠাৎ পা পিছলে গেল ওদের একজনের। সম্ভবত মেঝেতে ঝরে পড়া ঘামে পা পড়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই অন্যজন লাফিয়ে এসে পড়ে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বীর গায়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলল। খানিক বাদে পড়ে যাওয়া মানুষটার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যেতে তার গলাটা হাতের ভাঁজে চেপে ধরল সে। এবারে, শরীরটার ছটফটানি একেবারে থেমে যেতে বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী উঠে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে জান্তব হুঙ্কার ছাড়ল একটা। তারপর ক্লান্তিতে অবশ হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে।
সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড করা উল্লাস আর হাততালির শব্দে ভরে উঠল গোটা এরিনা। এখানে সশরীরে কোনো দর্শক হাজির নেই। লোকজন বলতে যন্ত্রপাতি চালাবার কয়েকজন কর্মচারী আর কিছু গুণ্ডা-বদমাশ। তাদের কাজ হল লড়বার আশায় আসা লোকজনের থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী বাছাই করা, আর এক একটা লড়াইয়ের পর যে জিতবে তার টাকাপয়সা গুণে দেয়া।
‘আই’দের যে ছোকরা আমাদের সঙ্গে এসেছিল, সে আমার দিকে ঘুরে তাকাল এবার, “দেখাশোনা হল তো হে?”
আমি মাথা নাড়লাম। লড়তে আগ্রহী লোকজন যদি এদের বিশ্বস্ত হয় তবে এরা তাদের এখানে সঙ্গে করে নিয়ে আসে, আগে একটা লড়াই দেখিয়ে দেবার জন্য। যাতে যে লড়তে চাইছে সে ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেবার আগে ভালো করে বুঝে নিতে পারে কীসের মুখোমুখি হতে চলেছে সে লড়াইয়ের এরিনায়।
জাইয়েসিমি অবিশ্বাসের চোখে ঘুরে দেখল আমার দিকে, “এরকম একটা ঝুঁকি তুই নিবি? কীসের জন্য? আকাদেমির পরীক্ষায় উৎরোবার খরচ তুলতে? শোন, তুই পড়াশোনায় ভালো। পাশটা তুই নিজের জোরেই করতে পারবি। তার জন্য কাউকে ঘুষ দিতে হবে না। আর, যদি পাশ না-ও করিস, কী এসে গেল তাতে?”
আমি মাথা নাড়লাম। জাইয়েসিমি বুঝবে না। ফেল করবার ঝুঁকিটা আমি নিতে পারব না। হ্যাঁ, নিজে পড়াশোনা করে নিজের জোরেই পাশ করবার মত ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু ও-পথে একটা ঝুঁকি থেকে যায়। যদি ফেল করে যাই, তাহলে মা আর বাড়ির আর সবার কী হবে? ওদের তো সংসারে একটা আকাদেমি পাশ করা লোক দরকার! তা নইলে অতগুলো ফুসফুসে অক্সিজেন জোটাবার মত রোজগার আমার আসবে কোত্থেকে? তাছাড়া ফেল করলে এমনিতেও সেটা ভারী লজ্জার বিষয় হবে। ওর চাইতে মরা ভালো।
যে ছোকরা আমাদের এরিনায় নিয়ে এসেছিল, সে এবারে জাইয়েসিমির পিঠে চাপড় দিল একটা, “নাঃ। এটা ফালতু!” ও আসলে বলতে চাইছিল, আমার এখানে লড়বার মত মনের জোরটা নেই।
কথাটা ওরা ভুল বলেনি। পরদিন আকাদেমিতে ফিরে যাবার পথে বাসে বসে বসেই আমি সেটা মনে মনে নিজের কাছে স্বীকারও করে নিয়েছিলাম। অমন কাজ আমি করতে পারি এটা ভাবাটা যতখানি সহজ, বাস্তবে সেটা তত সহজ নয়।
কিন্তু সেদিন আকাদেমিতে পৌঁছে মুখোশটা খুলতে না খুলতেই সেই ফোনকলটা এল। আর তারপর, ফের ফিরতি বাসে মূল ভুখণ্ডের দিকে ফিরে যেতে যেতে আমার নিজের নিশ্বাসের শব্দ আমার কানে বাজছিল। মুখোশটা তার কাজ ঠিকই করছিল। বাতাসকে যতটুকু সম্ভব পরিশুদ্ধ করে দিচ্ছিল সে। কিন্তু তাতেও আমার বুকের দুরদুরুনি, আমার ঘন ঘন শ্বাস টানায় কমতি হচ্ছিল না কোনো। কারণ, ওভোকে… আমার বান্ধবী… সে মৃত্যুশয্যায়!
***
ফোনটা আমায় করেছিল ওভোকের ভাই এফেতুরি। বলে, ও আমায় দেখতে চাইছে একটিবার।
অতএব ফের মূল ভূখণ্ডের দিকে যাত্রা। লাগোস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজে পৌঁছে এফেতুরির সঙ্গে দেখাটুকু করেই আমি ছুটলাম ওভোকের খোঁজে। হাসপাতালের বাইরে একটা স্ট্রেচারে শুয়ে ছিল সে। এত প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কেমন যেন শুকিয়ে ছোটো হয়ে গেছে!
এত তাড়াতাড়ি ও এমন শুকিয়ে গেল কী করে? ওর হাড়সর্বস্ব হাতখানাকে মুঠোয় ধরে আমার গালে ঘষছিলাম আমি। যেন, যে ওভোকে-কে আমি চিনতাম, তার একটুখানি ছোঁয়া পেতে চাইছি। ওর আঙুলগুলো উষ্ণ। স্ট্রেচারের পাশে রাখা একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে বড়ো কষ্টে বাতাস টেনে নিচ্ছিল সে ফুসফুসে। সেই পরিশ্রমে তার আঙুলগুলোয় হালকা কাঁপুনি উঠছিল। মুখে আঁটা অক্সিজেন মুখোশের ফাঁক দিয়ে তার ভয়ার্ত চোখের পাতাগুলো কাঁপছিল তিরতির করে। আমি যে এসেছি সেটা কি ও টের পাচ্ছে? কে জানে! বুঝতে পারছিলাম না আমি। পাশে ওর বাবা বসে হাওয়া করছিলেন। আমি ওর হাতটা মুঠোয় ধরে রেখেই বিড়বিড় করে যেন সান্ত্বনা দিতে চাইছিলাম ওকে, “ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।”
ওর বাবার যন্ত্রণা ভরা দৃষ্টি আমার দিকে ধরা ছিল। খানিক বাদে বললেন, এক বছর ধরে ক্যান্সারের জন্য কেমোথেরাপি করে করে পয়সাকড়ি সব শেষ। এযাত্রা তাই আর বেড মেলেনি ওভোকে-র। বাইরেই ফেলে রেখেছে ওকে। জেনারেল বেড-এর ভাড়াই দিনে অক্সি-২২০০। আর আইসিউতে নিয়ে গিয়ে ঠিকঠাক যন্ত্রপাতি লাগিয়ে চিকিৎসা করতে হলে তার চতুর্গুণ খরচ।
ওভোকে-কে ঘিরে বসে রইলাম আমরা। যে কেমোথেরাপির বিষ ওকে বাঁচাবার জন্য ওর শরীরে ঢোকানো হয়ে চলেছে, সেই বিষেই এবার ওর প্রাণ নিতে চলেছে। বেচারার দুর্বল ফুসফুসদুটো আর লড়তে পারছে না।
“কী করবেন এবার?” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
চোখ নামিয়ে নিলেন উনি, “আসলে, আইসিউতে কয়েকটা দিন রাখবার মত কিছু ‘অক্সি’-র বন্দোবস্ত যদি করতে পারতাম… ফুসফুসের সমস্যাটা তাহলে সামলে নিতে পারত মেয়েটা। তারপর ক্যানসারের চিকিৎসাটা ফের শুরু করা যেত। সেটা না করতে পারলে…”
উঠে খানিক দূরে সরে গিয়ে আমি এফেতুরিকে ডাকলাম। তার সঙ্গে কথাবার্তা সেরে ফিরে এলাম যখন, ওভোকে তখন নিশ্বাস নিতে না পেরে ভয়ানক ছটফট করছে। জলতেষ্টাও পেয়েছে ওর বোঝা যাচ্ছিল। মুখোশটা খানিক সরিয়ে ওর মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল দেয়া হচ্ছিল বারবার। মুখোশের মধ্যে দিয়ে যে সামান্য বাতাসটুকু আসছে সেটুকুও টেনে নিতে বড়ো যন্ত্রণা হচ্ছিল ওর। কথা বলবার মতো শক্তিটুকুও আর ছিল না। চোখের দৃষ্টিটুকু দিয়েই যেটুকু বলবার তা বলে দিচ্ছিল ওভোকে। চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে একটুকরো হাসি মুখে টেনে আনলাম আমি; ওর হাড়সর্বস্ব হাতটাকে জড়িয়ে ধরে একটুখানি চাপ দিলাম, “ভালো হয়ে যাবি রে। তোর বাবা বলছিলেন, তুই অপারেশন করাতে রাজি হয়েছিস এবারে। সত্যি?”
জবাবে ও মাথা নাড়ল।
একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল আমার বুক থেকে। ওর বাবার কাছে কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলাম আমি। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠেছিল এক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু বাইরে সে অনুভূতিটা প্রকাশ না করবার চেষ্টা করছিলাম প্রাণপণে।
আসলে এযাত্রা ও কেমো নেবার জন্য আসবার ঠিক আগে আকাদেমিতে আমরা ওর চিকিৎসা নিয়ে খানিক আলোচনা করেছিলাম। কেমো নিতে নিতে ততদিনে মেয়েটার প্রায় প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। গলা ভেঙে গেছে, মাথার চুল উঠে গেছে, ওজন, গায়ের জোর, প্রাণশক্তি সব গিয়ে তলানিতে ঠেকেছে একেবারে। আর এবারে… সামান্য বাতাসটুকু টেনে নেবার শক্তিটুকুও খুইয়ে বসেছে মেয়েটা। বাতাস… ওর, আমার, সকলের কাছে সবচাইতে দামি জিনিস… সেটার অধিকারটুকুও খুইয়ে বসেছে ও! কিন্তু, কদিন আগেও আকাদেমিতে কথা বলবার সময় ওর সামনে একটা বিকল্প রাস্তা ছিল। অপারেশন। ডিম্বকোষ দুটোকে ক্যান্সার সহ কেটে বাদ দিয়ে দেয়া। কিন্তু তখন ও তাতে একেবারে রাজি হয়নি। ভবিষ্যতে কখনও মা হবার সুযোগটাকে হারাতে চায়নি ওভোকে। কথাটা উঠতে বলেছিল, “ও-রকম বেঁচে থাকায় লাভটা কী হবে তাহলে?” ওর বিশ্বাস ছিল, সে-পথ নিলে ওর জীবনটা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। নারীত্বের আসল নির্যাসটুকুই হারিয়ে যাবে ওর।
আমি চেষ্টা করেছিলাম বইকি। ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, মা হবার ক্ষমতাই নারীত্বের একমাত্র শর্ত নয়। সেটাই একমাত্র মূল্য নয় ওর। কিন্তু কথাগুলো উচ্চারণ করতে করতেই টের পেয়ে গিয়েছিলাম, সেগুলো ওর কাছে মিথ্যে স্তোকবাক্যের মতই ঠেকবে। আর, শুধু ওর কানেই কেন, আমি যদি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটায় মেয়ে হয়ে জন্মাতাম তাহলে আমার কানেও তো সেই একইরকম মিথ্যে ঠেকত কথাগুলো।
আমাদের সমাজে পুরুষের সম্মান তার রোজগারের ক্ষমতার জন্য। আর মেয়েদের কাজ বাচ্চার জন্ম দেয়া। কিন্তু এহেন একটা সমাজেও ও যে আমার কাছে ওর নিজের মূল্যেই অনন্যা, আমার সবকিছু, এ-কথা আমি মুখ ফুটে ওকে বলতে পারিনি। কীকরে বলব? ও তো কেবল চাইত আমি ওকে একটুখানি ক্ষ্যাপাই, ওর সবকিছু হালকাভাবে নিই। আমাদের সম্পর্কটা বদলে যাক সে তো ও চায়নি! আর তাই, আমাকে সবসময় ওর সঙ্গে অভিনয় করে যেতে হয়েছে। ভাব করতে হয়েছে যেন আমার কিছুতেই কিছু যায় আসে না। ও বলেছিল, “তাহলে লোকে বলবে আমি একটা অদ্ভুতুরে জানোয়ার। কেউ আমাকে চাইবে না।”
বেচারা তার ভবিষ্যতের অজাত সন্তানের আশায় থেকে শেষে নিজের শ্বাস নেবার অধিকারটাকেও ছেড়ে দিল! সব ছাড়ল ও। জীবন, স্বাস্থ্য, বেঁচে থাকার অধিকার… আর তারপর, অবশেষে ও বুঝেছে যে নিজের ডিম্বকোষদুটোর ওপর আর ওর কোনো দাবি নেই। মেনে নিয়েছে, ওর জীবনের চেয়ে ওদের দাম বেশি নয়। এইবার সে প্রত্যঙ্গদুটোকে বিসর্জন দেবার জন্য তৈরি… যদি খুব দেরি হয়ে গিয়ে না থাকে!
ওর ঘরঘরে শ্বাসের শব্দটা আমার বুকে ধাক্কা দিচ্ছিল। এই মুহূর্তের বাস্তবটার দিকে মুখটাকে জোর করে ঘুরিয়ে ধরে রেখেছিল আমার। ওর আহত ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসা ছেঁড়া ছেঁড়া বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে আমি ওর হাতদুটোকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। মাঝে মাঝে শ্বাস নেবার চেষ্টা করবার ফাঁকে ফাঁকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছিল ও। মা’কে ডাকছিল, আর তারপর মা কাছে এলে ফের ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল তাঁকে।
ওভোকের বাবা আমাদের ওখানে রেখে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। বেশ খানিক সময় বাদে তিনি ফিরে এলেন। সঙ্গে খানিক অক্সি-ক্রেডিট জুটিয়ে এনেছেন। বোধ হয় বাড়ির কিছু একটা বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন ওইজন্য… মানে তখনও বেচবার মত কিছু যদি অবশিষ্ট থেকে থাকে! তবে যেভাবেই অর্থটা জুটিয়ে এনে থাকুন না কেন তিনি, সেটা যে ভালো কিছু নয় সেটা, স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর নীচুগলায় কথাবার্তার ভঙ্গী থেকে বুঝে নিতে অসুবিধে হচ্ছিল না।
এরপর ওভোকে-কে আইসিউ তে নিয়ে যাওয়া হল। এবারে ওর ফুসফুসদুটো একটু ধাতস্থ হবার সময় পাবে। এবারে হয়তো অপারেশনটার জন্য অর্থের চেষ্টাটা অন্তত করবার সময় পাবেন ওর বাবা। তবে, অনেক খরচ ওতে। তার বন্দোবস্ত করাটা ওভোকদের মত পরিবারের কাছে স্বপ্নের বাইরে। কথাটা ভাবতে ভাবতে আমি টের পাচ্ছিলাম, আমায় কী করতে হবে তা আমি জানি!
ভাবনাটা মাথায় আসতে, আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, হাতটা আমার গালে ঠেকালাম একবার। তারপর বললাম,”আমি একটু বেরোচ্ছি। একটা জিনিস নিয়ে ফিরে আসব।” জবাবে দুর্বলভাবে হাতটা নাড়িয়ে আমায় কাছে ডাকল সে। আমি ওর ওপর ঝুঁকে পড়ে মুখটা একেবারে কাছে নিয়ে গেলাম। ওর ছেঁড়া ছেঁড়া নিশ্বাসের ছোঁয়া লাগছিল আমার গালে।
“আমি তোকে ভালোবাসি।” ও আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে উঠল।
আমি প্রাণপণে চোখের পাতাদুটো টিপে ধরে উপচে পড়া চোখের জল আটকালাম। তারপর মুখে ঝলমলে একটুকরো হাসি ফুটিয়ে ওর কপালে ঠোঁটদুটো ছোঁয়ালাম একবার। তারপর, ওকে যে ভালোবাসি সেই কথাটুকু উচ্চারণ না করেই বের হয়ে গেলাম সেখান থেকে। আগে ওর চোখে উষ্ণতা ফিরে আসুক, আগে ওর হাসিতে আলো ফুটুক ফের, তারপর সে-সব বলবার অনেক সময় মিলবে। তখন আমি ওকে বলব। বলব, “ভালোবাসি তোমাকে।” সেদিন ও-কথা শুনে, আমি ওকে করুণা করছি এমনটা আর ভাববে না ও। বুঝবে আমি আশা ছেড়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছি না, রসিকতা করছি না, আমি সত্যিই ভালোবাসি ওকে। হ্যাঁ। বলব আমি ওকে। তবে এই মুহূর্তে আমায় একটা অন্য কাজে মন দিতে হবে।
***
প্রাণের জন্য প্রাণ। #ওভোকেবাঁচাও
ইনটারওয়েবে ছড়িয়ে পড়া এই হ্যাশট্যাগটা, এরিনায় নির্ধারিত লড়াইটার অনেক আগে থেকেই ওর অনলাইন ভিউয়ারশিপে জোয়ার এনে দিয়েছিল। এরিনার জোচ্চোর মালিকের দল টুইটটাকে বারংবার রি-শেয়ার করে মহাসুখে নিজেদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের বাড়বৃদ্ধি মেপে চলেছিল।
আমার সিদ্ধান্তটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল জাইয়েসিমি। ও বিশ্বাস করতে চায়নি যে আমি সত্যিই এরিনায় আমৃত্যু দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে রাজি হয়ে গিয়েছি। এরিনায় আমাদের গাইড- ওর ‘আই’ বন্ধু- সে অবাক হয়ে খানিক সমীহের চোখে ঘুরে দেখেছিল আমাকে।
খাঁচার ভেতরে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী উৎসুক চোখে দেখছিল আমার দিকে। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠছিল বারবার। বুঝতে পারছিলাম, আমাকে নয়, আমার জায়গায় ও একটা অক্সি-ক্রেডিট বোঝাই বস্তা দেখছে। আর আমি দেখছিলাম… জীবনের একচিলতে আশা। আমার এক ভালোবাসার জনের প্রাণটা বাঁচিয়ে দেবার আশা। তার জন্যে আমি চূড়ান্ত মূল্য দিতে তৈরি- সে- মূল্য একটা প্রাণ… খুন, নয় মৃত্যু।
তবে শুধুমাত্র তীব্র আকাঙ্খা আর ভালোবাসা আমাকে লড়াইটা করবার জন্য দরকারি দক্ষতাটা দেয়নি। কারাটের সামান্য শিক্ষা আছে আমার- ওই সবুজ বেল্ট অবধি। কাজেই লড়াই শুরু হতে আমি পোজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা ঘুঁসি ছুড়ে দিলাম প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে। ছেলেটা নির্বিবাদে ঘুঁসিগুলো হজম করল, তারপর আমার ছিটকে যাওয়া হাতটাকে চেপে ধরে মাথা দিয়ে সপাটে ঢুঁ মারল আমার মুখে। নাকটা ভেঙে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল আমার। লড়াইয়ের প্রথম রক্তপাত। ঘা’টা খেয়ে আমি ছিটকে পড়লাম মেঝেতে।
আক্রমণটায় কোনো বিশেষ দক্ষতা ছিল না। কেবল দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর শক্তির প্রমাণ ছিল। মারটা দিয়ে ছেলেটা আমার উঠে দাঁড়াবার জন্য অপেক্ষা করল। লড়াইটা নিতান্ত একপেশে হবে বলেই আশা করছিল মনে হয় ও… দর্শকরা তেতে ওঠবার আগেই শেষ হয় যাওয়া ম্যাড়মেড়ে জয় একটা। আর এইখানেই প্রথম ভুলটা করে বসল ও। কারণ পরের আক্রমণে আমি নাক থেকে বেরোতে থাকা রক্ত নিয়ে ওর চোখে ঘষে দিয়ে, সামলে নেবার আগেই মারের চোটে প্রায় অজ্ঞান করে দিলাম ওকে।
এবারে দুপক্ষই চোট পেয়েছে খানিক। ছেলেটা মারটা খেয়ে কেমন যেন একটু হতভম্ব হয়ে গেছে। হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল চোখে ভালো দেখতেও পাচ্ছে না। দেখে বেপরোয়া হয়ে আমি ফের আক্রমণে গেলাম। পরমুহূর্তেই ওর একটা বাহু আমার গলায় চেপে বসে আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছিল প্রায়, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে মানুষের মাংসের স্বাদ পেল আমার দাঁত। ছেলেটার বাহুতে সর্বশক্তি দিয়ে কামড়ে ধরতে একটা পাশবিক চিৎকার করে উঠে আমার গলাটা ছেড়ে দিয়ে ছিটকে গেল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্পিকার বেয়ে অনলাইন দর্শকদের মিলিত উল্লাসের শব্দ ভেসে এল চারপাশ থেকে। খাঁচার প্লেক্সিগ্লাসের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল ধারাভাষ্যকারের উত্তেজিত গলার আওয়াজ।
বোঝা যাচ্ছিল লড়াইটা কোনো নিয়মমাফিক দ্বন্দ্বযুদ্ধ হবে না। একটা অর্থহীন টিকে থাকবার যুদ্ধ, একটুকরো বাতাসের জন্য লড়াই! ডুবন্ত মানুষের অস্তিত্ত্বের লড়াইতে কোনো প্রথাসিদ্ধ লাবণ্য থাকে না।
কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা তফাৎ টের পাওয়া যাচ্ছিল। আমার সঙ্গে লড়তে এসেছে যে , সে একটা রাস্তার গুণ্ডা। আমি তো তা নই। তার লড়াইয়ের পদ্ধতি আমার অচেনা। এরা প্রথম আঘাতেই খুন করবার জন্য লড়ে। মানসিকতাটাও তাই এদের সেভাবেই তৈরি। আর আমি? আমি আত্মরক্ষার জন্য ছাত্রগোষ্ঠীর গুণ্ডাদের চাঁদা ধরে দেয়া একজন ছাত্র। সহজ কায়দায় পাড় পাওয়া! হাঃ! সারাটা জীবন এহেন হাজারো সহজ পন্থাতেই টিকে থেকে এসেছি আমি। ঠকিয়েছি, মিথ্যে বলেছি, চুরি করেছি। কোনোমতে টিকে থাকা! সেইটে বাদে আর কোনোকিছুরই পরোয়া করিনি। আর আজ! এই এরিনায় এসে দাঁড়িয়েছি… কোনো একজন মানুষের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেবার কিংবা খুন করবার ঐকান্তিক ইচ্ছে নিয়ে।
কোনো একজন!
খুন করবার অন্ধ প্রবৃত্তিটার সঙ্গে আমার আগে আলাপ হয়নি কখনও। কিন্তু এই ছেলেটা, বোঝাই যাচ্ছিল, ওই খুন করবার প্রবৃত্তিটাকে সম্বল করেই তার সারা জীবনটা কেটেছে। কামড়টা খাবার পর সে সাবধান হয়েছে। ঘুঁষির পর ঘুঁষিতে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে দিচ্ছিল সে এবার। প্রত্যেকটা ঘুঁষি মেরেই পায়ের দুলুনিতে আমার নাগাল থেকে দূরে সরে যায়। বেশ বুঝতে পারছিলাম, একবার কামড় খেয়ে এবারে সে আমার কাছে ঘেঁষতে চাইছে না। নিরাপদ দূরত্ব থেকে শেষ করে দিতে চাইছে লড়াইটা।
কিন্তু হাজার মার খেয়েও আমি তখন হার মানতে রাজি নই। যে-কারণটা আমাকে এখানে টেনে এনেছে, একমাত্র সেই কারণটাই আমাকে এত মার খেয়েও হাল ছেড়ে দিতে দিচ্ছিল না, মরে যেতে দিচ্ছিল না। ছেলেটার চোখে তখন বিভ্রান্ত একটা দৃষ্টি ছেয়ে গিয়েছে। শুরুতে যাকে একেবারেই তুচ্ছ একটা চ্যালেঞ্জ ভেবে নিয়েছিল সে, সেটা তখন আর তত তুচ্ছ ঠেকছিল না তার! দৃষ্টির সেই বিভ্রান্তি তার, আস্তে আস্তে একটা হিংস্র ক্ষিপ্ততায় বদলে যাচ্ছিল। খানিক বাদে সব সাবধানতা ভুলে সে ফের ঝাঁপিয়ে এসে গলাটা পেঁচিয়ে ধরল আমার। ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও। অথচ সেই ক্লান্তি সত্ত্বেও তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলতে চাইছে লড়াইটা। লড়াই শেষ করে তার প্রাপ্য গুণে নিতে চাইছে… প্রাপ্য বাতাসের অধিকার… আমার বাতাস… আমার জীবন… ওভোকে-র বেঁচে থাকবার অধিকার… সবকিছু…
খাঁচার কাচের দেয়ালের বাইরে থেকে ‘আই’দের ছোকরাটা হতাশভাবে মাথা নাড়ল একবার। আমার সাহস আছে। কিন্তু আমার আয়ু শেষ। আমার বন্ধু জাইয়েসিমি এরিনার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ও আমার মৃত্যুটা চোখে দেখতে চায় না!
রক্ত, ঘাম, চোখের জল- সব মিলিয়ে শরীরটা মাখামাখি হয়ে উঠেছিল আমার ততক্ষণে। ফলে পেঁচিয়ে ধরা হাতটার খপ্পর পিছলে বেরিয়ে যেতে সমস্যা হল না। আমি ওর মনটা পড়তে পারছিলাম যেন… ভাবছে, এবার আমি ছুটব… উদভ্রান্তভাবে ছুটে ওর হাত থেকে পালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করব একটা।
কিন্তু আমি তা করলাম না। তার বদলে, অপ্রত্যাশিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ওপরে। অপ্রত্যাশিত আক্রমণটায় একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গিয়েছিল সে। তবে ততক্ষণে আমার দম ফুরিয়ে এসেছে। মার খেতে খেতে শরীরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ফলে ওকে হঠাৎ করে হাতের মুঠোয় পেয়েও খুব বেশি কিছু করবার অবস্থা ছিল না আমার।
কিন্তু তবু, ঘা খাওয়া নেকড়ে যতই আহত হোক, সে বিপজ্জনকই হয়। আমার দাঁতগুলো তখনও অক্ষত। ওর অরক্ষিত খোলা গলাটা সে দাঁতের নাগালের মধ্যেই ছিল। কাজেই আর কিছু করতে না পেরে আমি ওর গলায় দাঁত বসিয়ে দিলাম। ওর চামড়া ছ্যাঁদা করে, নোনতা তামাটে মাংসে গভীর হয়ে গেঁথে গেল আমার দাঁত।
দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর। ওর হাতদুটো হিংস্রভাবে বারবার আছড়ে পড়ছিল আমার শরীর জুড়ে। কিন্তু তবু, আমার কামড় আমি ছাড়লাম না। গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্তে মুখ উপচে যাচ্ছিল আমার। পেটে পাক দিয়ে বমি উঠে আসতে চাইছিল বারবার। কিন্তু তবু, আমি প্রাণপণে চোয়াল শক্ত করে রেখে ওর চামড়া, মেদমজ্জায় আমার দাঁত ডুবিয়ে রেখেছিলাম, ওর জীবনের রক্তিম ধারা ভলকে ভলকে উঠে আসছিল আমার জিভ বেয়ে।
আর তারপর, একটা অন্তিম ঝাঁকুনিতে ও আমাকে ছিটকে তুলল বাতাসে। আমার চোখের সামনে ওভোকের মুখটা ভেসে উঠল একঝলকের জন্য… ওভোকে… আমি চেষ্টাটা করেছিলাম রে…
পরমুহূর্তেই ওর হাত থেকে মাটিতে আছড়ে পড়লাম আমি। তারপর… সব অন্ধকার…
***
কয়েকদিন বাদে জ্ঞান ফিরেছিল আমার। বেঁচে আছি দেখে নিজেই বড়ো অবাক হয়েছিলাম আমি। জাইয়েসিমি আমার পাশেই ছিল। সেদিন এরিনায় জ্ঞান হারাবার পরের ঘটনাগুলো ওর থেকেই শুনেছিলাম আমি। আমায় আছড়ে ফেলে অজ্ঞান করে দেবার পর আমার প্রতিদ্বন্দ্বী অতিরিক্ত রক্তক্ষয় হয়ে মারা যায়। আমাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিপুল অঙ্কের অক্সি -ক্রেডিট আমার ব্যাঙ্কের খাতায় জমা হয়ে আমার অপেক্ষায় রয়েছে।
দ্বন্দ্বযুদ্ধে বিজয়ীদের জন্য সংরক্ষিত একটা চিকিৎসাকেন্দ্রে রাখা হয়েছিল আমাকে। তবে সেখানে শুয়ে জয়ের আনন্দ ভোগ করবার মত সময় আমার হাতে ছিল না। কোনোমতে বিছানা ছেড়ে উঠে, জামাকাপড় পরে আমি ওভোকের হাসপাতালের দিকে রওনা হয়ে গেলাম।
পৌঁছে দেখি সেখানে শোকের মেঘ ছেয়ে আছে। সবার মুখ কেমন যেন অসাড়। সবার চোখ লাল। ওভোকের ভাইয়ের মুখটায় গভীর যন্ত্রণার ছাপ। ওর মা বসে বসে কাঁদছিলেন। ওর বাবা, কেমন যেন এক হেরে যাওয়া সেপাইয়ের মত উবু হয়ে বসে। আমায় আসতে দেখে, স্ত্রীর হাত ছেড়ে দিয়ে, কাছে উঠে এসে আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আস্তে আস্তে, একটু একটু করে ওভোকের শেষ সময়টার কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি আমায়। আমি যখন ছিলাম না তখন ওভোকে চলে গেছে আমায় ছেড়ে। অক্সিজেন-বুভুক্ষু শরীরটা ওর আর বেশি লড়তে পারেনি। যেদিন আমি ওকে ছেড়ে লড়তে গেলাম, সেদিন রাতে পরপর তিনবার হার্ট আ্যটাক হয় ওর। ওর পরিবার যে শস্তার শ্বাসযন্ত্র জোটাতে পেরেছিল ওর জন্য, তিনতিনটে স্ট্রোকের ধাক্কা থেকে ওর শরীরটাকে রক্ষা করবার সাধ্য ছিল না তার।
চলে গেছে ওভোকে। তার পলকা, বাঁধনহারা অস্তিত্ব বয়ে গেছে, ভেসে গেছে উদ্দাম বাতাসে। বাতাস! ‘অক্সি’ মুদ্রার জোরে তার থেকে বেঁচে থাকবার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে চলি আমরা। আজ, যেন কোনো অন্ধ নিয়তির রায়ে বাতাস তার বদলা নিয়েছে ওই মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়ে।
আমি লড়াই করেছি……. আমি খুন করেছি… শুধু ওকে একটু শ্বাস
নিতে দেব বলে। একটা তাজা প্রাণকে, হিংস্র পিশাচের মত আক্রমণে অকারণে নিভিয়ে দিয়েছি.. কেবল ওর আলোটুকু জ্বালিয়ে রাখবার রসদ জোগাড় করবার আশায়। এখন আমার পাশবইতে অনেক অক্সি। বিশুদ্ধতম অক্সিজেনে শ্বাস নিতে পারি আমি… যত চাই। শুধু… বুকের পাঁজরের ভেতরে সে অক্সিজেন টেনে নেবার জায়গাটাকে একেবারে খালি করে দিয়ে চলে গেল মেয়েটা!
মেঝেতে ভেঙে পড়ে পাগলের মত কেঁদে যাচ্ছিলাম আমি।
***
আইন আকাদেমির প্রশাসনিক দফতরের একটা অফিসে এসে দাঁড়ালাম আমি। আমার হাত থেকে ফর্মটা জমা নিলেন যিনি, তাঁর বয়স হয়েছে। মাথার চুল সাদা। বয়সের ভারে সামান্য ন্যুব্জ। দেখে বোঝা যাচ্ছিল অবসরের বয়েস পেরিয়ে গেছে তাঁর। সম্ভবত ক’টা দিন বেশি চাকরি করবার লোভে বয়েস ভাঁড়িয়েছেন।
চোখ সরু করে মানুষটার দিকে দেখছিলাম আমি। ওঁর ধূর্ত দৃষ্টি আমার চোখদুটোকে লক্ষ করছিল। এ-রকম একটা জায়গায় কেন যে কোনো মানুষ দরকারের চাইতে বেশিদিন থাকতে চায় সে আমার বুদ্ধির বাইরে। তবে সে- প্রশ্নটা ওঁকে মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা না করলেও, তার উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছিল ওঁর মুখে লেগে থাকা
 নরম হাসিটুকু… বেঁচে থাকা। ওইটুকুর জন্যই মানুষটা এখানে থেকে গিয়েছেন।  নিজের আর প্রিয়জনদের জন্য অক্সিজেনের সামান্য রসদ জুটিয়ে যাবার জন্য কাজ করে চলেছেন এখানে।
তবে, এই ‘বেঁচে থাকা’ ব্যাপারটা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন আমি সেটা বুঝি। কারণ, বেশিদিন বেঁচে থাকলে তোমার প্রিয়জনদের মৃত্যুকে সইতে হবে একে একে।
“বাবা!”
ফর্মটা দিয়ে বেরিয়ে আসতে যাব, তখন মানুষটা ডাকলেন আমায়। তারপর কাগজটা তুলে ধরে বলেন, “বাবা শোন! ফর্মটা কেন ভরছিস বল দেখি? কেরিয়ারটাকে এভাবে শুধুমুদু পিছিয়ে দিচ্ছিস কেন?”
ওঁর দোষ নেই অবশ্য। আমি জীবনটাকে নিয়ে যেন ছিনিমিনি না খেলি, .. ..নিজের .. .. ‘সম্ভাবনা’টাকে ..নষ্ট না ..করে ফেলি, ..এইটুকুই তো চাইছেন কেবল উনি!
আমি ওঁকে বোঝাবার চেষ্টা করতে পারতাম! চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারতাম, এসবের অর্থ হয় না কোনো। বলতে পারতাম, আসলে ওরা এখানে এমন একটা জীবনের ফাঁদে বন্দি, যার মূল্য খুব কম, এমনকি, জীবনটাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য দরকারি অক্সিজেনটুকু কিনতে যতটা অক্সি- ক্রেডিট লাগে, তার চাইতেও সে জীবনের দাম কম। কিন্তু, বুঝিয়ে বললেও উনি বুঝবেন না। উলটে আমার সটান কথাগুলো, তার সততা, আমার এহেন ‘ঔদ্ধত্ব’ চরম একটা আঘাত দেবে ওঁর মনে।
“এ-জায়গাটা আর আমার জন্য নয়।” আমি জবাব দিলাম।
ভ্রু’দুটো কুঁচকে উঠল ওঁর, “কেন?”
কারণটা ওঁকে ভেঙে বলবার চেষ্টা করে খানিক শ্বাস নষ্ট করে লাভ ছিল না কোনো। আমার কাছে অক্সিজেন এখন ঢের আছে, তবু দামি জিনিসটা বৃথা খানিক নষ্ট করে কী লাভ? কাজেই তার বদলে, হাতটা উঁচিয়ে, গলাটাকে ডার্থ ভেডারের মত, কিংবা পাক্কা সিগারেটখোরের মত ফ্যাঁসফেঁসে করে আমি বললাম, “দুনিয়াটাকে জাগাবার জন্য একটা ডাক দেয়া দরকার। সে ডাক তোলবার জন্য আমাদের নিজেদেরই একটা উপযুক্ত রণাঙ্গন গড়ে নিতে হবে।”
বাইরে বের হয়ে এলাম আমি। একটা নতুন অধ্যায়… নতুন একটা দোলাচল শুরু হতে চলেছে।
সাইরেনের শব্দ উঠছিল। আকাদেমির দরজা পেরিয়ে বাইরে পা দিতে দিতে আমি সেই শব্দ শুনছিলাম। রেডিংটনের আ্যম্বুলেন্স আসছে। আজ ডক্টর উমেজ লেকচার দিতে আসেননি। ডাকতে গিয়ে তারা তাঁর রুমের দরজা বন্ধ পেয়েছে। ফোনেও জবাব না পেয়ে এবারে তাঁর দরজা ভেঙে দেখা যাবে, তিনি মেঝেয় মরে পড়ে আছেন। কারণ, তাঁর ঘরটার অক্সিজেন শোধক যন্ত্রটা কোনো রহস্যময় কারণে ব্যাখ্যাহীনভাবে অকেজো হয়ে গেছে।
সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে চলা অক্সিজেন সরবরাহ যন্ত্র থেকে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিলাম আমি। আমার রোজগার করা বাতাস- ওই বাতাসে ভর করে বেঁচে থেকেই আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছোব।
আমাদের বেশির ভাগ মানুষই অক্সিজেন মুখোশের পেছনে নিজেদের মুখ লুকিয়ে কোনোমতে বেঁচে চলেছে। ..আমরা ..ভান করি যেন,
ওগুলো আমাদের শ্বাস নিতে দেয়, তাই ওই মুখোশের আড়ালে মুখ লুকিয়ে জীবন কাটাই আমরা। কিন্তু আর নয়। এবার আমাদের আসল মুখটা দেখবে দুনিয়া। এবারে তার সময় হয়েছে।
বাইরে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে আমি এফেতুরিকে ফোন করলাম। যে-যুদ্ধ আজ ঘোষণা হয়েছে, তাতে ও আমার প্রধান সেনাপতি। খসখসে গলায় আমার দলের যোদ্ধাদের জন্য হুকুম আমি তার কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলাম:
“দুনিয়াজোড়া এই নতুন অক্সিজেন রণাঙ্গণে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।”
টীকা
১) কেকে- নাইজেরীয় অটোরিকশ
২) বুকানিয়ার- ‘বুকানিয়ার’(buccaneer)- ১৭শ ও ১৮শ শতকে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ইউরোপীয় জলদস্যুর দলকে এই নামে ডাকা হত। নাইজেরিয়ার ছাত্রসমাজে বিভিন্ন ‘কনফ্রেটারনিটি’ বা ‘ক্যাম্পাস কাল্ট’ গোষ্ঠীর মধ্যে একটি গোষ্ঠী এই নামটা ব্যবহার করে।
৩) আই- ‘আই’(Eiye) হল এই ধরনের আর একটি নাইজেরিয় ছাত্রগোষ্ঠী। ক্ষেত্রবিশেষে ক্যাম্পাস-হিংস্রতা ও তার বাইরের অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য এদের, বিশেষ করে ‘আই’ গোষ্ঠীর কিছু কুখ্যাতি রয়েছে।
লেখক পরিচিতি
নাইজেরিয়ার বাসিন্দা ওগিনিকোওয়ে ডোনাল্ড একপেকি একজন আফ্রিকান স্পেকুলেটিভ কাহিনিকার ও সম্পাদক। নাইজেরিয়ান ল স্কুল, লাগোস ক্যাম্পাস এবং লাগোস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। দিব্যাঙ্গ এবং ঢিলেঢালা এই মানুষটি নিয়মিত সাইনুসাইটিসে ভোগেন। এ অসুখটি তাঁর নিউমোনিয়া, যক্ষা, ও শ্বাসঘটিত কিছু রোগভোগের প্রতিক্রিয়া। আসিমভস, স্ট্রেঞ্জ হরাইজন, টর ডট কম, এবং অন্যান্য পিত্রিকায় তাঁর লেখা ইতিমধ্যে প্রকাশিত বা প্রকাশিতব্য। আদারওয়াইজ, ব্রিটিশ ফ্যান্টাসি, নোমো (দু’বার), এবং এবছরের নেবুলা সম্মানে সম্মানিত। এবার এবং এর আগেও, হিউগো, নেবুলা, লোকাস, বিএফএসএ, এবং স্টার্জন পুরস্কারের ফাইনালিস্ট হয়েছেন তিনি। টুইটারে তাঁর ঠিকানা @penprince_
অনুবাদক পরিচিতি
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যর জন্ম ও বড়ো হয়ে ওঠা উত্তর চব্বিশ পরগনার নৈহাটিতে। ভারতীয় রেভেন্যু সার্ভিসের প্রাক্তন সদস্য। শিশুদের জন্য প্রথম পূর্ণাঙ্গ ওয়েব ম্যগাজিন ‘জয়ঢাক’ এবং বাংলা সাহিত্যের লাইব্রেরি পোর্টাল ‘পদক্ষেপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। ছোটোদের ও বড়োদের জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ, পত্রভারতী, দেব সাহিত্য কুটির, সৃষ্টিসুখ ও অন্যান্য প্রকাশন থেকে। মৌলিক ও অনূদিত কল্পবিজ্ঞান নিয়েও একের পর এক অসামান্য কাজ করেছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য বই যাত্রী (১,২), ঈশ্বরী, ডারউইনের ডায়েরি, আর্যভটের পুথি, স্বাধীন দেশের মাটি, আপনজন, অন্তিম অভিযান, বিষবৈদ্য সিরিজ, ইতিহাসের রেল, ঠগীর আত্মকথা(অনুবাদ), কাডাথ– একটি স্বপ্নসন্ধান (অনুবাদ), বন বন্দুকের ডায়েরি (অনুবাদ), লাভক্র্যাফট আতঙ্কের জার্নাল (অনুবাদ) ইত্যাদি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন