মূল গল্প: The Lights Go Out, One by One
আমাদের বলা হয়েছিল, হিমনিদ্রা১ থেকে জেগে ওঠার ব্যাপারটা অনেকটা নবজন্মের মতো। গ্রীষ্মের চমৎকার একটা দিনে একটা স্বচ্ছ সুন্দর হ্রদের গভীরতা থেকে আস্তে আস্তে উপরে ভেসে উঠলে যে অনুভূতি হয়: ঠিক সেভাবেই এক শান্ত আরোহণের অনুভূতি আমাদের গাঢ় অচৈতন্য দশা থেকে চেতনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবে, ফিরিয়ে নিয়ে আসবে জীবিতদের দুনিয়ায়। ঠিক নবজন্মেরই মতো।
ওরা ভুল বলেছিল। নবজন্ম নয়, হিমনিদ্রা থেকে ফিরে আসার ব্যাপারটা আসলে একটা দুঃস্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠার শামিল। অথবা তার চেয়েও ভয়ানক—মনে করুন ব্রেনের একটা অংশ আস্তে আস্তে টের পাচ্ছে যে আপনার নাক, মুখ, শ্বাসনলী দিয়ে তরল ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে— সেটা টের পেয়ে ব্রেন আতঙ্কিত হতে শুরু করেছে, ছটফট করতে করতে সে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠতে চাইছে… আবার একই সঙ্গে তার আরেকটা অংশ চাইছে চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে, স্বপ্নটা শেষ অবধি দেখে নিতে।
অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো এমনটাই হল!
কফিনের মতো হিমনিদ্রাধারে শুয়ে ফুসফুস থেকে পারফ্লুরোকার্বন বেরিয়ে যাওয়া অবধি, সঠিকভাবে শ্বাস নিতে না পারা অবধি যে ক’টা মুহূর্ত কাটল, সেগুলো আমার জীবনের দীর্ঘতম মুহূর্ত। এই সময়টুকুর মধ্যেই আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে এল। সবই মনে পড়ে গেল এক এক করে। আমি কে, আমি কোথায় এবং আমি এখানে আছি কেন…
আমি কে— আমি যুক্ত বিশ্ব সরকারের (যুবিশ) সুদূর মহাকাশ বিভাগের এক কর্মচারী। জন্ম থেকে এটাই আমার পরিচয়, অন্য কিছু কীভাবে হতে হয় বা হলে কেমন লাগে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই আমার নেই।
আমি কোথায়—যুবিশ সূর্যমুখী-৫২ মহাকাশযানে, মিল্কিওয়ে৩ ছায়াপথের পার্সিয়্যুস৪ অঞ্চলের কোথাও একটা, পৃথিবী থেকে হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে।
আমি এখানে কেন— আমি এখানে রয়েছি মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য।
এই কথাগুলো মনে পড়তেই জেগে ওঠাটা আমার কাছে আরও একবার দুঃস্বপ্ন বলে মনে হতে লাগল, ইচ্ছে করতে লাগল আবার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ি।
কারণ, আমার ঘুম ভাঙার অর্থ হল, অন্য সব দলই তাদের অভিযানে ব্যর্থ হয়েছে।
***
টলমলে পায়ে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলাম। পড়েই যাচ্ছিলাম, সূর্যমুখী-৫ এর একটা দেয়াল ধরে সামলালাম নিজেকে। উফ, কী বেজায় ঠান্ডা এই দেয়ালটা! অবশ্য হওয়ারই কথা! যানটা তো এই সবে এই জেড স্পেসের৫ প্রায় পরম-শূন্য৬ তাপমাত্রা থেকে গরম হয়ে উঠতে শুরু করেছে। গত পাঁচ বছরে শক্তি খরচ করে তাকে উষ্ণতা প্রদান করার কোনো প্রয়োজন ছিল না, কারণ দলের সবাই তো হিমনিদ্রায় ঘুমিয়ে ছিল।
আমার ঘুম যেহেতু প্রথম ভেঙেছে, মহাকাশযানের সব সিস্টেম ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে দরকার মতো সেগুলো চালু করার দায়িত্বও আমার। কম্পিউটার অন করা, খাবার আর জলের ভাঁড়ার দেখা, ‘পে লোড’৬ চেক করা। তবে এসবেরও আগে আমায় আরেকটা জরুরি কাজ করতে হবে।
শোয়ার ঘরের বাইরেই বাথরুমগুলো ছিল। দৌড়ে গিয়ে একটা কমোডের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তেই হড়হড়িয়ে বমি শুরু হল। পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে সমস্ত তরল উঠে আসতে থাকে— সে সমস্ত নিরাপদ ‘ইনার্ট কেমিক্যাল’, হিমনিদ্রাধারে থাকাকালীন যা পাকস্থলীতে ভরা থাকে। ঘুম ভেঙে উঠলে বমি করে পেট থেকে কিছু উগরোতে হবে বলেই সেগুলো দেয়া হয়। কিন্তু দেখা গেল যা ছিল তা যথেষ্ট নয়, সব বেরিয়ে যাওয়ার পরেও গা গুলিয়ে খালি পেটেই মোচড় দিয়ে উঠছে বারেবারে। দু’ হাতে ভর দিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করি আমি, অপেক্ষা করি সময়টা কোনোরকমে কেটে যাওয়ার।
এক সময় কিছুটা সুস্থ মনে হয়। যাক বাবা, হয়েছে। প্যানের ঢাকাটা নামিয়ে দিলাম আমি। শব্দ শুনে বুঝি ফ্লাশ কাজ করছে, সাফ হয়ে যাচ্ছে সব। ভাগ্যিস! এই সিস্টেমটা তাও চালু আছে।
বমি করার পর আগের চেয়েও দুর্বল মনে হচ্ছে শরীরটা। ঠান্ডা মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়াই কোনোমতে, এইবার আমার ওষুধগুলোর খোঁজে করতে হবে।
আমার ইউনিফর্মের পকেটেই ছিল ট্যাবলেটগুলো। স্লিপিং কোয়ার্টার, মানে জেগে থাকা অবস্থায় আমাদের যেখানে বিশ্রাম নেওয়ার কথা, সেই ঘরেই রাখা ছিল ইউনিফর্মগুলো। এই স্লিপিং কোয়ার্টার অবশ্য শোয়ার জন্য নয়, সে জন্য আলাদা বেডরুম আছে। যাই হোক, আমি ইউনিফর্মটা আগে পরে নিই, তারপর দুটো ট্যাবলেট একসঙ্গে এক গ্লাস জলে মিশিয়ে গলায় চালান করে দিই। ওষুধ খাওয়া হলে আমি বসে পড়ি, এইবার অপেক্ষা করতে হবে। দেখা যাক!
আঃ! এই তো অনেক ভালো লাগছে।
ভাবতে না ভাবতেই পেটটা জোরসে মোচড় দিয়ে ওঠে, পড়ি কি মরি করে আবার ছুটে যাই বাথরুমে। বমির তোড়ে উগরে দিই সব ওষুধ।
জল ছাড়াই ট্যাবলেটগুলো গিলে খেতে হয় এরপর।
***
আমার পর ঘুম ভাঙল আহমেদের। আমি ওকে হিমনিদ্রাধার থেকে বেরিয়ে বাথরুম অবধি যেতে সাহায্য করলাম। আহমেদ যখন বাথরুমে, আমি ঘুরে ঘুরে গোটা যানটা দেখতে থাকলাম, আলোগুলোও জ্বালিয়ে দিলাম এক এক করে।
আলো জ্বালা হলে ককপিটে ঢুকলাম আমি। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি কন্ট্রোল প্যানেল আর বন্ধ মনিটর স্ক্রিন। জানালাগুলো অন্ধকার, অস্বচ্ছ। কিছুক্ষণ অপলক সেদিকে চেয়ে রইলাম আমি, ভাববার চেষ্টা করলাম এই যান্ত্রিক পর্দার বাইরেটা কেমন দেখতে হতে পারে? কিন্তু ঘুরেফিরে একটা দৃশ্যই আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে থাকে। শেষবারের জন্য পৃথিবীর সৌরমণ্ডলকে দু’ চোখ ভরে দেখার সেই স্মৃতিটাকে আমি কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিলাম না— যেন জানালার দু’দিকে দেখা যাচ্ছে মঙ্গল আর বৃহস্পতি, দুটোই প্রায় এক মাপের দেখাচ্ছিল আলাদা আলাদা দূরত্বের জন্য; আর তাদের মাঝে ক্রমে ছোটো হয়ে যেতে থাকা ফিকে নীল রঙের অর্ধগোলাকৃতি একটা গ্রহ— পৃথিবী! আর বাকি আকাশ জুড়ে ঝকঝকে অসংখ্য তারা— নক্ষত্র সমাবেশ! এদের জন্য এই সমস্যার শুরু!
কম্পিউটার অন করে নির্দেশ দিই আমি। ‘ফুল ডায়াগনস্টিক প্রোগ্রাম’ রান না করা পর্যন্ত মহাকাশযানের বর্তমান অবস্থা বোঝা যাবে না। স্লিপিং কোয়ার্টারে গিয়ে দেখি আহমেদ তার ইউনিফর্ম প্রায় পরে ফেলেছে। তার ফ্যাকাশে মুখে চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে বলল, “ভাবিনি এসব আবার দেখতে পাব।” একটু থেমে আবার আমার দিকে চাইল সে; বলল, “তাহলে, আমাদেরই যা করার করতে হবে?”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“আডান্না?”
“হুঁ?”
“কেমন লাগছে তোমার?”
কেমন লাগছে আমার? কথাটা শুনে আমার মনে পড়ে গেল, সূর্যমুখী-৫, সূর্যমুখী মিশনের চতুর্থ ব্যাক-আপ টিমের সদস্য হিসেবে আমায় যেতে হবে জানার পর আমার ঠিক কেমন লাগছিল। মনে পড়ল, এই ঘটনার কয়েক মাস পরে, হিমনিদ্রাধারে ওঠার সময় আমার কেমন লাগছিল। হিমনিদ্রা! এবং সম্ভবত চিরনিদ্রাও। মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম যে এই ঘুম থেকে জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।
“সত্যি বলতে একটু ভয় ভয়ই লাগছে।” আমি স্বীকার করলাম।
“সেই। আমারও একই অবস্থা।”
“আহমেদ…”
“কী?”
“ওষুধটা জল দিয়ে খেও না।”
“কেন?” আহমেদ অবাক চোখে আমার দিকে চাইল।
“জল খেলেই আবার বমি হবে।”
আহমেদ কথাটা শুনে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ “বাবাগো!” বলে চেঁচিয়ে উঠল, পরক্ষণেই মুখে হাত চাপা দিয়ে পড়িমড়ি ছুটল বাথরুমের দিকে। সময়মতো পৌঁছে যাবে আশা করি! এই দুর্বল শরীরে আবার ওকে মেঝে সাফ করতে সাহায্য করতে হলেই গেছি!
***
এরপর হিমিকো, আর সব শেষে ক্যাপ্টেনের ঘুম ভাঙল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল হিমিকোর ক্ষেত্রে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে, কারণ বাথরুমে আমাদের যতটা সময় লেগেছিল ওর তার চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগল, তারপর ইউনিফর্মটাও ওকে আমাদেরই পরিয়ে দিতে হল। এমনকি ওষুধ খেয়েও খুব একটা লাভ হল না। এরপর কী ঘটতে চলেছে সেটা আমরা সকলেই বুঝতে পারছিলাম, ফলে অদ্ভুত একটা বিষণ্নতা গ্রাস করেছিল আমাদের। সত্যি বলতে আমাদের মধ্যে হিমিকোই ছিল সবচেয়ে হাসিখুশি স্বভাবের। আর তার বেলাই কিনা…
ইতিমধ্যে মহাকাশযানের ইন্টারকম কড়কড় করে উঠল, ক্যাপ্টেন আমাদের ককপিটে আসার আদেশ দিচ্ছেন। আমরা তিনজন এগিয়ে গেলাম সেদিকে। হিমিকোকে অনেকটাই ধরে ধরে নিয়ে যেতে হল দু’দিক থেকে, কারণ সে তার পায়ে কোনো জোর পাচ্ছিল না।
ককপিটের সামনে ক্যাপ্টেন পিছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমরা ঢুকতে এদিকে ফিরলেন। তাঁর ইউনিফর্মে কোনো আলাদা চিহ্ন নেই, তাঁর পদ বা মর্যাদা বোঝার কোনো উপায়ও নেই, কিন্তু তাঁর চালচলনে দেখলেই বোঝা যায় যে উনি আমাদের মতো সাধারণ নন। সেই ক্যাপ্টেনও যে হিমনিদ্রা থেকে জেগে উঠে হাঁটু গেড়ে বসে বমি করেছেন— এ যেন কল্পনাই করা যায় না।
তিনি আমাদের দিকে ঘুরে তাকালেন আর সহসা আমার মনে পড়ে গেল, এই লোকটি আমাদের এই জাহাজের ক্যাপ্টেন শুনে আমি কীরকম চমকে গিয়েছিলাম! সেইসঙ্গে এমন রাগ হয়েছিল না! আমি কোথায় ভেবেছিলাম অবশেষে লোকটাকে চিরকালের মতো পিছনে ফেলে যেতে পারছি! উনি আবার আমায় প্রথম দিনে আলাদা করে ডেকে বলতে এসেছিলেন, কত কষ্ট করে এই পোজিশন বাগিয়েছেন শুধু আমার সঙ্গে থাকার জন্য। সে কথাটা শুনে কী বিরক্ত যে লেগেছিল! নিজেকে রীতিমত প্রতারিত মনে হয়েছিল সেদিন।
তবে সেটা অন্য সময় ছিল। এখন আর লোকটাকে দেখে আলাদা করে কিছু মনে হচ্ছে না। আর আলাদা কোনো ভাবের উদ্রেক যাতে না হয়, সেইজন্য আমিও ক্রমাগত নিজের মনকে শাসাচ্ছি।
“সুপ্রভাত।”
হিমনিদ্রায় যাওয়ার আগে বাঁকা হাসি হেসে শেষ যে কথাটা আমাদের ইনি বলেছিলেন, সেটা ছিল “শুভরাত্রি।” সেটা ছিল পাঁচ বছর আগের কথা। অথচ মনে হচ্ছে ঘটনাটা গতকালের।
“সুপ্রভাত।” আমরা সবাই সাড়া দিই।
“কেমন আছো সবাই?” প্রশ্নটা সকলের উদ্দেশ্য করে হলেও ক্যাপ্টেন সরাসরি হিমিকোর দিকে চেয়ে রইলেন।
আমরা সমস্বরে জানাই যে আমরা ঠিক আছি, যদিও ঠিক আমরা কেউই নেই। পুরোপুরি তো নয়ই। ক্যাপ্টেন মাথা নাড়লেন।
“আমরা জেগে উঠেছি মানে বুঝতেই পারছ, সূর্যমুখী-১ থেকে সুর্যমুখী-৪ অবধি সকলেই তাদের উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হয়েছে। এবার আমাদের পালা।”
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “স্বস্তির কথা হল, আমাদের সিস্টেমগুলো একদম ঠিকঠাক আছে। সব কিছুই নিখুঁতভাবে চলছে, ‘পে লোড’-ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। মহাকাশযানের কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ নেই।”
আমরা চুপ করে অপেক্ষা করছিলাম তাঁর বাকি কথাগুলোর জন্য।
“কিন্তু খারাপ খবরও আছে। এখনও অবধি অন্য চারটে সূর্যমুখী মহাকাশযানের তরফ থেকে আমরা কোনো ইনফরমেশন পাইনি, সেটা যথেষ্ট চিন্তার কথা। কোনো সতর্কবাণী, কোনো মিশন রিপোর্ট, কিচ্ছু না!”
কথাগুলো আমাদের মগজে সেঁধোনোর সময় দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন চুপ করে থাকলেন একটু। তারপর বললেন, “সূর্যমুখী-৪ কেন আমাদের রিপোর্ট পাঠায়নি আমরা জানি না। তবে জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমরা একটা ওয়ার্মহোল খুলে মহাকাশযানটাকে, বা কোনো কারণে সেটা ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকলে তার ব্ল্যাক বক্সটাকে খোঁজার চেষ্টা করতে পারি। পাবই যে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবে চেষ্টা তো করা যেতেই পারে।
“অথবা, আমরা যেখানে আছি সেখানেই থাকি আর নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে থাকি। অভিযানের সাফল্যই হল আসল কথা, আর আমাদের কাছে সময়ও কিছু অঢেল তো নয়! সাধ্যমতো চেষ্টা করতেই হবে আমাদের। তো এই মুহূর্তে আমাদের হাতে দুটো বিকল্প আছে যার মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে— আমরা এখানেই থাকব, নাকি অন্য মহাকাশযানগুলোর পরিণতি কী হল সেটা জানার জন্য অনুসন্ধান করতে যাব?”
এরপর কী আসতে চলেছে, সেটা আমি আগেই আঁচ করেছিলাম।
“সূর্যমুখী-৫ এর ক্যাপ্টেন হিসাবে, আমি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আহ্বান জানলাম…” ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি এইবার আমার ওপর এসে স্থির হল, “আডান্না!”
হিমিকো আর আহমেদের থেকে এক পা এগিয়ে দাঁড়ালাম আমি। গলার কাছে সেই চেনা চাপ, সেই পরিচিত উদ্বেগ। বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা অস্বস্তি। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমায়। এটাই আমার এই অভিযানে প্রধান ভূমিকা, আমি মহাকাশযানের সিদ্ধান্তকারী — দ্য ডিসিশন মেকার। জিনগত অধিকার বলো আর যাই বলো, আমার জিনের বিশেষ গঠনের জন্য, জন্ম থেকেই এই কাজে নির্বাচিত করা হয়েছে আমাকে। অভিযান-সংক্রান্ত জরুরি কোনো সিদ্ধান্ত আমি ছাড়া আর কেউ নিতে পারবে না, এমনকী জাহাজের ক্যাপ্টেনও না।
সূর্যমুখী যানের প্রতিটা অভিযানেই আমার মতো একজন সিদ্ধান্তকারীর অস্তিত্ব ছিল। যুগের পর যুগ ধরে ধরে পৃথিবীর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আর অভিযানে এরকমভাবেই তারা থাকে, ভবিষ্যতেও থাকবে। মনে মনে আমি জানি, এই কথাগুলো ভাবলে আমার মনে জোর আসা উচিত, এমনকি গর্বও হওয়া উচিত, অথচ প্রত্যেকবার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এগিয়ে দাঁড়ানোর সময় আমার বুকের ভেতর ধুকপুক করতে শুরু করে। তখন কিছুই মনে থাকে না, কেবলমাত্র বেজায় নার্ভাস লাগে।
বড়ো বড়ো কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আমার জন্য নির্দিষ্ট প্রশ্নটা করি, “এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো কী কী?”
“আমরা এখান থেকে সরে গিয়ে সূর্যমুখী-৪ বা তার ব্ল্যাক বক্স খোঁজার চেষ্টা করতে পারি।” ক্যাপ্টেন আমাকে উত্তর দিলেন, “তাতে আমাদের সময় আর এনার্জি খরচ হবে ঠিকই, আরও একবার জেড স্পেসের মধ্যে দিয়েও যেতে হবে। কিন্তু এই কাজে সাফল্য পেলে যে তথ্য আমরা পেতে পারি, আমাদের অভিযানে সেই তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম হবে বলেই আমার ধারণা।”
ক্যাপ্টেনের কথায় আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিই, মনে মনে যুক্তিগুলো সাজাই।
“অথবা, আমরা এখান থেকে না সরে, আমাদের যা লক্ষ্য সেদিকেই এগোতে পারি। এখান থেকে সরে গেলে সময়ের হিসেব পুরোটাই ঘেঁটে যাবে, আর যা তথ্য শেষ অবধি পাওয়া যাবে তা হয়তো আদৌ কোনো কাজের হবে না। সেক্ষেত্রে হয়তো আগে মিশনটা শেষ করাই আমাদের পক্ষে উচিত হবে। এই হল দুই পক্ষের যুক্তি।”
ক্যাপ্টেন চুপ করে গেলেন। এবার আমার বলার পালা।
বরাবরের মতো, এই মুহূর্তে আমার আরো একবার মনে হল, এই সিদ্ধান্ত-টিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারটা ভালোভাবে ডিজাইন করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কম্পিউটার দিয়ে করানো হলেই ভালো হত। কিন্তু সে তো হওয়ার নয়! এককালে মানুষের স্বপ্ন থাকা এ.আই. এর বেলুন বহু শতাব্দী আগেই চুপসে গিয়েছে, সিলিকন ভ্যালির ‘ভার্চুয়াল সিজ’ মানে যান্ত্রিক জবরদখল-এর সেই ঘটনার পর থেকেই বাতিল হয়ে গিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। মানুষ টের পেয়েছিল, সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটারের মধ্যে কখনওই রক্তমাংসের মানুষের মতো মানবিকতা বা ঔচিত্যবোধ থাকা সম্ভব নয়।
এদিকে ককপিটের নৈঃশব্দ্য ক্রমেই অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। ক্যাপ্টেন উশখুশ করছেন, তাঁর দু’চোখে অধীর অপেক্ষা।
ভাবো, আডান্না! জলদি ভাবো!
আর সেই মুহূর্তে, উত্তরটা আপনিই মাথায় এসে গেল।
“আমরা পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা ধরেই এগোব। আগের যানগুলোর সঙ্গে যাই হয়ে থাক না কেন, তাদের খুঁজতে গেলে যখন কিছু তথ্য পেতেও পারি, নাও পারি, সে তথ্য আবার কাজে লাগতেও পারে, নাও পারে— এরকম পরিস্থিতিতে এই কাজের পিছনে সময় বরবাদ করার মানে হয় না। অন্য দলগুলোর ব্যর্থতার পেছনে যদি এমন কোনো কারণ থেকেই থাকে যা আমাদের বিজ্ঞানীরা আগে থেকে প্রত্যাশা করতে পারেননি, সেক্ষেত্রে আমাদের অদৃষ্টেও তাই আছে। আগে থেকে সে বিষয়ে জেনেও বিশেষ কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। আমার সিদ্ধান্ত হল— প্ল্যানমাফিক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা।”
ক্যাপ্টেন হাঁফ ছাড়লেন। তাঁর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম সম্ভবত তাঁরও একই ইচ্ছা ছিল। ক্যাপ্টেন সম্বন্ধে আমার মনোভাব যা-ই হোক না কেন, এই মুহূর্তে খানিকটা গর্বিত বোধ করলাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
“সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাপনিরোধক খোলসের নির্মোচনের৭ প্রস্তুতি নাও।”
কম্পিউটারে নির্দেশ দিয়ে তিনি মূল কনসোলের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। আমার সিদ্ধান্তকারীর দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেছে, আমি এখন এই মহাকাশযানের এক সাধারণ সদস্য। হিমিকো, আহমেদ আর আমি ধীরে ধীরে যে যার কনসোলে বসে পড়ি। আমার চেয়ারটা মোটেও আরামদায়ক নয়, শক্ত খটখটে। পৃথিবীর ভবিষ্যত আর মানুষের বাঁচামরা এখন আমাদের হাতে, অথচ একটা ঠিকঠাক বসার গদি অবধি ভাগ্যে জোটেনি। কী কৃপণ এই ‘যুবিশ’!
নির্মোচনের পদ্ধতি শুরু হয়ে গেছে। সূর্যমুখী-৫ এর চারদিকে আটকানো তাপনিরোধক পাতগুলো থরথর করে কেঁপে উঠে, তারপর এক এক করে মহাকাশযানের গা বেয়ে ছিটকে নেমে গিয়ে আরও দূরে সরে যেতে থাকে। আর এই প্রথম, আমাদের সামনে মহাকাশের এমন একটা অংশ ফুটে ওঠে, যা আমাদের আগে আর কোনো মানুষ স্বচক্ষে দেখেনি।
এই মুহূর্তটির জন্যই এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা করেছিলাম আমরা সবাই, অথচ এখন সামনেটা দেখে কিছুটা হতাশই লাগে আমার। আমাদের সামনে যে দৃশ্য উন্মোচিত হচ্ছে, তা যেন পেছনে ফেলে আসা দৃশ্যেরই প্রতিকৃতি মাত্র। এই সৌরজগতের সূর্য, গ্রহগুলো আর নক্ষত্ররা আমাদের সৌরজগতের চেয়ে আলাদা হতে পারে ঠিকই, কিন্তু সত্যি বলতে এই দীর্ঘ সময়ে এত বেশি বিচ্ছিন্ন গোলক আর আলোর কুঁচিকে অন্ধকারে ভেসে বেড়াতে দেখে ফেলেছি যে মুগ্ধতার কিছু আর অবশিষ্ট নেই। মহাকাশ অসীম আর অনন্ত হতেই পারে, কিন্তু তার সবটাই এমন একইরকম দেখতে হলে আর কী লাভ?
পিছনে পায়ের শব্দ পাচ্ছি। জানি, কে এসেছে। পদচালনা থেমে যাওয়ার আগে, সেই ব্যক্তিটির একটা হাত আমার কাঁধে নেমে আসার আগে, এমনকী হালকা মোচড়ে আমার নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় সে হাত শূন্যে থমকে যাওয়ারও আগে আমি ..বুঝে.. গিয়েছিলাম, ..এ ক্যাপ্টেন ছাড়া
কেউ নয়।
“আডান্না…” কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি।
কী বলছিলেন সেটা অবশ্য আর জানা হয় না। হিমিকো এই সময় আচমকা ভীষণ জোরে কাশতে শুরু করে। ঘুরে চাইতে দেখলাম সে ‘কিছুই হয়নি’ ভাব করে জামার হাতায় মুখ মুছছে, কিন্তু হাতাটায় রক্তের দাগ আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছিলাম।
ক্যাপ্টেন থমকে গিয়ে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে থাকেন। কিছু বলতে গিয়েও আর বলেন না। ধীরে ধীরে চোখদুটো মুছে নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে নিজের কনসোলে ফিরে যান।
“পে লোড সিস্টেম প্রস্তুত করো!” ক্যাপ্টেনের গলা শোনা যায়। আমরাও চুপচাপ সে কাজে লেগে যাই।
মিশনের স্বার্থে এখন এই জটিল কাজগুলো আমাকে করতেই হবে। আর সত্যি বলতে, আমি সেই জন্য কৃতজ্ঞ। ভাগ্যিস এইসব কাজে মন দিতে হচ্ছে! কাজের মধ্যে ডুবে থাকার সুবাদে আমি এই কথাটা ভুলে থাকতে পারছি যে এই মুহূর্তে এখানে উপস্থিত প্রত্যেকে, এমনকী হিমিকোও— যে খুব স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে, সেও এর ব্যতিক্রম নয়… এদের মধ্যে আমিই সেই একমাত্র মানুষ যে এই প্রথম থেকেই এই অভিযানে আসতে চাইনি।
***
আগেকার দিনে মহাকাশীয় বিপর্যয় বলতেই মানুষ শুধু একটাই কথা ভাবত। অ্যাস্টেরয়েড! প্রকাণ্ড সব উল্কা– গ্রহাণুর আকার নিয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো রাক্ষুসে, ক্ষিপ্ত, বিধ্বংসী একেকটা পাথরের খণ্ড, যা কিনা বিয়েবাড়িতে অনিমন্ত্রিত দূর সম্পর্কের পিসির মতো হুট করে এসে আছড়ে পড়বে। কিন্তু আসলে উল্কা নিয়ে অত কিছু ভয়ের কিছুই ছিল না। ওগুলো বেশি কাছে আসার আগেই ভেঙে গুঁড়ো করে দেয়া যায়৮। আসল বিপদ ঘনিয়ে এল একেবারে অন্য দিক থেকে, আর সে বিপদ যখন এল…তা উল্কাপাতের চেয়ে ঢের ঢের বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।
অন্য কিছু নয়, একটা ব্ল্যাকহোল।
সাধারণ.. ব্ল্যাকহোল অবশ্য নয়। দুটো পৃথক ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষে তৈরি হওয়া সেই ব্ল্যাকহোলটা ছিল হাজারটা লোহিত দানব৯ সূর্যের চেয়েও বড়ো! প্রায় একটা মহাজাগতিক দৈত্যের শামিল। সেটার নাম রাখা হয়েছিল ‘অ্যাপোলিয়ন’১০, মানে ‘ধ্বংসকারী’।
এই দানবীয় ব্ল্যাকহোল সোজা ধাওয়া করছিল পৃথিবীর সূর্যের দিকে।
বোঝাই যাচ্ছিল, সূর্যকে গ্রাস করার পর ওটা বুধকে খাবে। তারপর গিলবে শুক্রকে, আর তার পরেই আসছে পৃথিবীর পালা। অবশ্য তদ্দিনে আর কিছু যাবে আসবে না, কারণ সূর্য ব্ল্যাকহোলের গর্ভে চলে গেলে অচিরেই পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে। একটা হিমশীতল, উষর, মৃতগ্রহে পরিণত হবে পৃথিবী।
এইরকম একটা পৃথিবীতে আমার জন্ম। আমার বাবা যখন জন্মেছিলেন, তখন সবে এই আতঙ্কের সূত্রপাত। সে সময়েই উত্তেজনার পারদ চূড়া স্পর্শ করেছিল। বাবার সঙ্গে মায়ের যখন দেখা হয়, ততদিনে সারা পৃথিবীর মানুষ বিভেদ ভুলে একজোট হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝে ফেলেছে, যুক্ত বিশ্ব সরকার, অর্থাৎ ‘যুবিশ’ তৈরি হয়েছে। অবশেষে আমি যখন ধরাধামে এলাম, ততদিনে সূর্যমুখী মিশন নিয়ে কাজ শুরুও হয়ে গেছে পৃথিবীতে।
আমি এসবের এত কিছু জানি কেন ভাবছেন তো! আসলে, আমার জীবনটা পুরোপুরি গড়েই উঠেছিল ‘সূর্যমুখী মিশন’-কে ঘিরে। হাঁটতে শেখার বয়স থেকেই ঠিক হয়ে ছিল যে আমার গোটা জীবন বরাদ্দ আছে এই অভিযানের জন্য।
ব্যাপারটা অবশ্য এত সহজও ছিল না। নির্বাচনের বেজায় কড়াকড়ি থাকা সত্ত্বেও, প্রথম দফায় এত বেশি প্রার্থী হয়ে গিয়েছিল যে ‘সুদূর মহাকাশ’ বিভাগ রীতিমত ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছিল। আমার মতো হাজার হাজার বাচ্চার উপর অতরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করা…
কিন্তু শুধু বাচ্চা কেন? কারণ তাদের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার ছিল, কাদের মধ্যে এই অভিযানের উপযুক্ত গুণাবলী একেবারে জন্মগতভাবে আছে, মানে একেবারে ডি. এন. এ-তে ছাপ মারা — সেইটে খুঁজে বার করা। মানবজাতির জন্য এই অভিযানের গুরুত্বকে মাথায় রেখে শুধুমাত্র উপযুক্ত লোককে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়াটাকেই যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয়নি। শেখানো জিনিস ভুলে যেতে পারে লোকে, কিন্তু ‘ইনস্টিঙ্কট’ বা সহজাত প্রবৃত্তির ভুল হয় না। অন্তত বিজ্ঞানীদের মতামত তেমনটাই ছিল।
ফলে, আমাদের ধৈর্য, সহ্যশক্তি, বুদ্ধি সমস্ত কিছু নিয়ে পরীক্ষা চালাত তারা। জানতে চাইত আমাদের মস্তিষ্কের সীমানাকে। খুঁচিয়ে, নেড়েচেড়ে, উল্টেপালটে সবরকম প্রতিক্রিয়া লিখে রাখত ‘সুদূর মহাকাশ’ বিভাগের বিজ্ঞানীরা; আমরা হাসলে, কাঁদলে, হয়তো বা বাথরুম গেলেও সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে নোট লিখত। আর অবশ্যই, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারার পরীক্ষাও ওরা নিয়েছিল, এবং তাতে নাকি আমিই সবচেয়ে ভালো ফল করেছিলাম। (একটা ছয় মাসের বাচ্চার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেউ কী করে মাপে, সেটা যদিও আজ অবধি আমার মাথায় ঢোকেনি। তবে ‘যুবিশ’-এর লোকেরা হয়তো আমার চেয়ে বেশি জানে!)
আমার বাবা অবশ্য বলতেন, তাঁর জানাই ছিল যে আমি নির্বাচিত হব। আমার চোখের দৃষ্টি, বা আমি যে সবার শেষে কাঁদতাম— এসব দেখে তিনি নাকি আগেই সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। হতে পারে— তিনি তো ওই ডিভিশনেই কাজ করতেন। বাবা বারবার বলতেন, যেদিন ফাইনাল লিস্টে আমার নাম এল, যেদিন সইসাবুদ করে আমায় পাকাপাকিভাবে ডিভিশনকে হস্তান্তর করলেন তিনি, সেটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গর্বের দিন ছিল।
এই মনোভাব অবশ্য তাঁর একার ছিল না। বড়ো হয়ে ওঠার প্রতি পদে ডিভিশনের সবাই বার বার বলেছে, আমার কী সৌভাগ্য! মানবতাকে, মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য নির্বাচিত হয়েছি আমি, লাখ লাখ বাচ্চার মধ্যে থেকে এই দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি একমাত্র আমি। কেউ কখনও জানতে চায়নি, এই সুযোগ পেয়ে আমি আদৌ খুশি কিনা! কেউ জানতে চায়নি, নিজের জীবনটাকে নিয়ে আমার নিজের অন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল কিনা! সকলের শুধু একটাই কথা বলার ছিল আমাকে। ইতিহাস আমায় মনে রাখবে, মহান ব্যক্তি হিসেবে আমায় আর আমার সহযাত্রীদের মনে রাখবে মানুষের আগামী প্রজন্ম।
আর সত্যি কথা বলতে আমি জানি, কথাগুলো বড়ো ভুল ছিল না। শুধু, আমায় যদি কেউ একবার এই সিদ্ধান্তটা নিজে নিতে দিত!
***
আমরা ..যেদিন ..রকেটগুলো.. লঞ্চ করতে শুরু করলাম, সেদিনই
মারা গেল হিমিকো। এতদূর এসেও মিশনের শেষটায় ওর আর থাকা হল না। ছত্রিশটা রকেট যাত্রা শুরু করার সময়ে একদম হালকা হয়ে যাওয়া মহাকাশযানের গুরুগুরু কেঁপে ওঠাটাও সে টের পেল না, নিকষ তমিস্রার মধ্যে দিয়ে অতগুলো আলোর বিন্দুর ছুটে যাওয়াও দেখা হল না ওর। দেখে মনে হচ্ছিল যেন একদল উল্কা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মতো একে অপরকে তাড়া করে ছুটছে।
হিমিকো দেখলে কী আনন্দটাই না পেত!
***
রকেটগুলো পাঠানোর পরের দিন মুখের উপরের তালুতে একটা ব্যথা হচ্ছিল। জিভ দিয়ে অল্প খোঁচাতেই রক্ত পড়া শুরু হল। ওষুধ যদিও রোজই খাচ্ছিলাম, কিন্তু অনন্তকাল তো আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলা যায় না!
তার দু’দিন পর গায়ে প্রথম ক্ষতটা দেখলাম। ওষুধের ডোজ দ্বিগুণ করে দিলাম। বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের হাতে সময় আর নেই বিশেষ।
***
চারশো বছর। পৃথিবীর কাছে সেটুকু সময়ই অবশিষ্ট আছে, অ্যাপোলিয়ন এসে হানা দেয়া অবধি। চারশো বছর হাতে আছে, মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত।
পালানোর কথাই ভাবা হয়েছিল প্রথমে। স্বাভাবিক। ত্রয়োবিংশ শতাব্দীতেই মানুষ ওয়ার্মহোল১১ টেকনোলজি করায়ত্ত করে ফেলেছে, ফলে মহাকাশ পাড়ি দিয়ে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করা এখন খুব অভাবনীয় কিছু না। কিন্তু জেড-স্পেস যাত্রার অনেক সমস্যাও আছে, আর তাছাড়া, যাবেটা কোথায়? বাসযোগ্য গ্রহ তো বিশেষ নেই। বিশেষ বলাও ভুল, একটাও গ্রহ জানা ছিল না তখন যা মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু দশ বছর পরে, এক অল্পবয়সী জ্যোতির্বিদ এসে বিজ্ঞানীদের এই ভাবনা আমূল পালটে দিলেন।
সেই মহিলা অ্যাস্ট্রোনমার অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে একটা গ্রহ আবিষ্কার করে বসলেন, পৃথিবীর মতো আকার আকৃতির, অনেকগুলো গ্রহ দিয়ে তৈরি গ্রহমণ্ডলীর একটি— তবে সৌরজগৎ নয়, কারণ কোনো সূর্য নেই তাদের। গ্রহটার ৬০% জল, বরফজমা সমুদ্র হয়ে আছে। তাত্ত্বিক হিসাবে পৃথিবীর সঙ্গে মিল ৯৫%, একটু উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলেই এই গ্রহটা মানুষদের বসবাসের একদম উপযুক্ত হয়ে উঠবে।
দরকার খালি একটা সূর্যের।
***
জানালায় দাঁড়িয়ে সূর্যটাকে দেখছিলাম আমি। এই সেই নতুন সূর্য, যেটা আমরা নিয়ে যেতে এসেছি। যেটার উপর মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এখন কী ছোট্ট দেখাচ্ছে তাকে, যেন আমি হাত বাড়িয়ে তাকে মুঠোয় ধরে ফেলতে পারব।
আমাদের পাঠানো রকেটগুলো পৌঁছাল কি? সব প্ল্যানমাফিক চলবে তো, নাকি কোথাও কিছু গড়বড় হবে আবার?
আদৌ কি কাজটা উদ্ধার করতে পারব আমরা?
***
কয়েকদিন পরে, সবে ঘুমোনোর তোড়জোড় করছি কোয়ার্টারে শুয়ে, এমন সময় ইয়ারফোনটা বেজে উঠল। আহমেদ। বেশ ক্লান্ত ছিলাম, বিরক্তই লাগল প্রথমে। কিন্তু ওর গলা শুনে মনে হল, ব্যাপারটা জরুরি।
“কী হয়েছে?”
“ককপিটে এসো একবার। চোখে না দেখলে কিছুই বুঝবে না।”
এইটুকু বলেই আহমেদ ফোন রেখে দিল। একবার মনে হল, ফোন করে বলি যে ব্যাপারটা কী বলা না গেলে নিশ্চয় সেটা অত জরুরি কিছু না। কিন্তু একদম অকারণে আহমেদ আমায় মহাকাশযানের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ডেকে পাঠাবে না, তাই উঠে পড়ে ককপিটে গেলাম শেষমেশ।
ক্যাপ্টেনও ওখানে উপস্থিত ছিলেন, দু’জন মিলে পাশের একটা জানালা দিয়ে কিছু দেখছিল। আমায় দেখে তারা নিঃশব্দে সরে দাঁড়াল, আহমেদ হাত দিয়ে আমাকে ইঙ্গিত করল জানালায় চোখ রাখতে। আমি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে উঁকি মারলাম।
গত কয়েকদিনে নির্ধারিত ট্র্যাজেক্টরি অনুয়ায়ী আমরা এই সিস্টেমের চতুর্থ গ্রহটার কাছাকাছি এসে পড়েছি। পাথুরে গ্রহটা বৃহস্পতির চেয়ে আকারে সামান্য বড়ো। আমরা গ্রহটার নাম দিয়েছি ‘টার্গেট প্ল্যানেট ফোর’, সংক্ষেপে টিপি ফোর। বুঝতেই পারছেন, নামকরণ ব্যাপারটায় আমরা খুব দড় নই। আমরা এখন সেটার এত কাছে আছি যে বাইরে তাকালেই গ্রহটা চোখে পড়ে। আমি এক ঝলক বাইরে দেখে নিয়ে ফিরে তাকাই।
“কী দেখব?”
“টিপি ফোর। আরে, টিপি ফোরকে দেখো!” আহমেদ বলে।
“তাই তো দেখছি রে বাবা। আলাদাটা কী আছে তাতে…” বলতে বলতেই আমার ব্যাপারটা চোখে পড়ে, আর বাকি কথাটুকু না বলাই থেকে যায়।
সূর্যমুখী মিশনে আসার প্রস্তুতি হিসাবে পৃথিবীতে থাকতে এই নক্ষত্রমণ্ডলের সব গ্রহগুলো নিয়ে আমাদের প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছিল। ওয়ার্মহোলের সাহায্য নিয়ে পাঠানো একাধিক অটোমেটিক ড্রোন বিভিন্ন দিক থেকে নেওয়া এই সৌরমণ্ডলীর অসংখ্য ছবি পাঠিয়ে যেত, আমরাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই ছবিগুলো নিয়ে বসে থাকতাম। ফলে, এই টিপি ফোর-এর পাথুরে রুক্ষ জমি আর তার উপরে মিথেন গ্যাসের সমুদ্র আমার খুব ভালো করে চেনা। স্বচ্ছ, গ্যাসীয় পরিমণ্ডলের অপর প্রান্তে থাকা সেই গ্রহের এক দৃশ্য বারবার দেখে দেখে আমার চোখ পচে গিয়েছিল প্রায়। এছাড়া গ্রহটায় আর কিছুই নেই।
কিন্তু, এই নীল রঙের ছোপটা তো আগে কখনও দেখিনি!
বৃহস্পতির গ্রেট রেড স্পটের১২ কথা মনে পড়েছিল অবশ্যই, কিন্তু এটা তার চেয়ে অনেকটাই বড়ো। প্রকাণ্ড বলাটাই হয়তো ঠিক। এর পাশে বৃহস্পতির ওই লাল তাপ্পিটা বালখিল্য বলেই মনে হবে। গ্রহের এদিকটার প্রায় এক তৃতীয়াংশ এতে ঢাকা পড়ে গেছে। জায়গাটা দেখতে একটা বিচ্ছিন্ন, আনুভূমিক উপবৃত্তের মতো! ধূসর আবহাওয়া আর গাঢ় খয়েরি পাথর দিয়ে তৈরি এই দানবীয় গ্রহের মাঝে নীল রঙের এই বৈশিষ্ট্যহীন ছোপটা জ্বলজ্বল করছে।
মনে মনে ভাবলাম, এটা তো কালও ছিল না!
আহমেদের দিকে ফিরে বললাম, “কী এটা?”
“জানি না।” আহমেদ উত্তর দিল। দুজনের চোখেমুখেই অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। স্বাভাবিক! ওদের দোষ দেয়া যায় না। এমন একটা মিশনে যেখানে প্রতিটি খুঁটিনাটি আগেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়েছে হাজারবার, সেখানে এমন একটা অভাবিত কিছু দেখা গেলে চিন্তা হয় বইকি!
আহমেদ এক পা এগিয়ে জানালায় আমার পাশে এসে দাঁড়াল। চিন্তিতভাবে নিজের দাড়িতে হাত ঘষছিল সে, সেই ট্রেনিং পিরিয়ড থেকে আমি ওর এই মুদ্রাদোষটা দেখে আসছি। তফাতের মধ্যে, দাড়িটা এখন আগের চেয়ে অনেক পাতলা আর খাবলা-খাবলা হয়ে গেছে। যতবার ও দাড়িতে হাত ঘষছিল ততবার আরও খানিকটা করে দাড়ির চুল উঠে আসছিল বেচারার হাতে। এর অর্থ বুঝতে আমার কোনো অসুবিধাই হল না। ‘অর্থাৎ তোমার শরীরেও অবস্থাও আমারই মতো’, আমি মনে মনে ভাবলাম। কিন্তু আহমেদ হাতে উঠে আসা চুলের গোছাকে হয় খেয়াল করছিল না, নয় পাত্তা দিচ্ছিল না।
“এটার কী ব্যবস্থা করা হবে?” আহমেদ জিজ্ঞেস করল।
এটার কী ব্যবস্থা করা হবে? মানেটা কী! আহমেদের আস্পর্ধা দেখে আমি ভড়কেই গেলাম। এখানে আমাদের করণীয় কী? আমরা তিনজন মাত্র মিলে, বৃহস্পতির চেয়েও বিশাল একটা গ্রহের কী ব্যবস্থা করব? আমাদের সে ক্ষমতা আছে নাকি?
“কী ব্যবস্থা করা যাবে ভাবা বাদ দাও!” ক্যাপ্টেন যেন আমার মনের কথা বললেন, “এই জিনিসটা আসলে কী? সেটা আমি আগে জানতে চাই। কী এটা?”
“হয়তো কোনোরকম ঝড়?” আমি বুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা করছিলাম।
“অসম্ভব। এটা মোটেও ঝড় নয়।” ক্যাপ্টেন মাথা নাড়েন।
“টিপি ফোর সম্বন্ধে আমাদের ফাইলে যা আছে বা আমরা যা যা পড়েছি তাতে এমন কিছুই নেই যা দিয়ে এই নীল ছোপটা সম্পর্কে কিছু জানা যাবে।” আহমেদ জোর দিয়ে বলল। আর ও বলছে মানে সত্যিই নেই। ক্যাপ্টেন আমাদের দলকে পরিচালনা করতে পারেন, কিন্তু আমাদের মধ্যে আহমেদের জ্ঞানই সবচেয়ে বেশি।
ক্যাপ্টেন ভ্রূ কুঁচকে ভাবছিলেন। আমি তাঁর মনের দ্বন্দ্বটা বুঝতে পারছিলাম.. দিব্যি, কারণ.. আমরা .তিনজনেই তো আসলে সেই একই কথা
ভাবছি।
পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো ঠিক কী কী?
নীল ছোপটা একদম নতুন একটা ব্যাপার ঠিকই, কিন্তু আমরা জানি না সেটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, অথবা আমাদের মিশনের সঙ্গে তার আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। আমরা ওটা নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে সময় আর এনার্জি ক্ষয় হবে, যে দুটোর কোনোটাই আমাদের কাছে অতিরিক্ত নেই।
অন্যদিকে, এটা যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়, যদি এটা আমাদের, বা আমাদের মিশনের উপর প্রভাব ফেলার মতো জরুরি কিছু হয়…
ক্যাপ্টেন আমার দিকে তাকালেন। মুহূর্তের জন্য পরস্পরের বৈরিতা ভুলে গিয়ে আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আলতো করে মাথা নাড়লাম। তিনিও সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, “চান্স নেওয়া যাবে না। টিপি ফোর-এর দিকে এগোনো যাক। ওটা কী সেটা আমাদের জানতে হবে।”
***
কিন্তু বেশ কিছুদিন ব্যয় করেও ওটা যে কী তা জানা গেল না। তবে অন্য কিছু তথ্য জানতে পারলাম। চতুর্থ গ্রহটি নিজের কক্ষপথে ঘোরে এটা জানা ছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছিল যে ঐ নীল ছোপটা সব সময়ে একদম একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে। মানে, ওটা যাই হোক সেটাও দুরন্ত গতিতে ঘুরছে, আর ঘুরছে একদম গ্রহের ঘূর্ণনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উল্টোদিকে।
এবং, এই ঘূর্ণনের মাঝেও সারাক্ষণ ছোপটা ঠিক আমাদের সামনেই থাকছে।
এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমরা থ হয়ে গিয়েছিলাম বললেও কম বলা হয়। গ্রহটার উপরিভাগ স্পষ্ট দেখতে না পেলেও, যেভাবে নীল ছোপটা ঘুরছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল ওটা পাথুরে জমি আর মিথেনের সমুদ্রের উপর সমান স্বচ্ছন্দে চলতে পারে।
এমনকী আমরা যখন গিয়ে চতুর্থ গ্রহের চারদিকে ঘুরপাক খেতে শুরু করলাম, যখন আমরা গ্রহটার অন্ধকার পিঠের দিকে চলে গেলাম, গ্রহটার ছায়া এসে পড়ল আমাদের মহাকাশযানের উপর— তখনও এই ঘটনার ব্যতিক্রম হল না। সঘন অন্ধকারের মধ্যেও সেই উজ্জ্বল উপবৃত্তাকার নীল আকৃতি সর্বদা আমাদের ঠিক চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে লাগল।
দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল। এক সপ্তাহ পেরিয়ে দুই সপ্তাহ… নীল ছোপটা এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের চোখের আড়াল হল না। কোনো একটা সময়ে আমি ওই নীল ছোপটাকে জীবন্ত এক চোখ বলে মনে করতে শুরু করেছিলাম, আর সেটা মনে করাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল! শুনতে যত অদ্ভুত লাগুক না কেন, আমার মনে হত যেন বা গ্রহটাই নীল চোখ মেলে আমাদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে!
***
এত সময় দিয়ে ব্যাপারটা নিরীক্ষণ করার পরেও আমরা কেউই ভেবে পেলাম না ওটা কী হতে পারে। কীভাবে আর কেনই বা ওটা আমাদের অনুসরণ করে চলেছে, সেটাও আমাদের মগজে ঢুকল না।
তবে গত কয়েকদিন ধরে একটা কথা আমার মাথায় ঘুরঘুর করছিল। হয়তো আজগুবি, ফালতু, কষ্টকল্পিত একটা আইডিয়া। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই যখন হচ্ছে না, এটাও করে দেখতে আর ক্ষতি কী? অনেক ভেবেটেবে শেষ অবধি একদিন বলেই ফেললাম।
“ক্যাপ্টেন!”
ক্যাপ্টেন আমার দিকে মুখ ফেরাতে দেখলাম তাঁর চোখগুলো লাল হয়ে আছে। হয়তো আমার মতোই ঠিক করে ঘুমোচ্ছেন না বলে।হয়তো বা অন্য কিছু…
“কী?”
“একটা কাজ করে দেখতে চাই, অনুমতি পেলে।”
উনি আমার দিকে একটু চেয়ে থেকে মাথা হেলালেন।
আমি এইবার মূল কনসোলে গিয়ে এক এক করে ভার্চ্যুয়াল সুইচগুলো বন্ধ করতে শুরু করলাম। একটা একটা করে মহাকাশযানের আলোগুলো নিভে যেতে লাগল। সমস্ত আলো। আমরা হিমনিদ্রা থেকে জেগে ওঠার পর এই প্রথম সূর্যমুখী-৫ এই প্রথম এরকম সম্পূর্ণ নিষ্প্রদীপ হয়ে গেল।
আহমেদ ভয় পাওয়া গলায় বলল, “করছটা কী?”
“এমনি, দেখছি কী হয়।”
পুরো এক মিনিট অপেক্ষা করে আমি আবার আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলাম। তারপর আবার বাইরে তাকালাম। কিছুই ঘটল না, কিচ্ছু পাল্টাল না। নীল ছোপটা যেমন দেখছি এতদিন ঠিক তেমনি জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে।
“হুম! যাকগে, করে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল, করেছি।” ভাবলাম আমি।
আর তক্ষুণি ছোপটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
কে যে বেশি চমকালাম, আহমেদ, ক্যাপ্টেন না আমি, জানি না। এতটাই চমকে গিয়েছিলাম যে হাঁ করে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারছিলাম না। আমাদের চোখের সামনেই আবার ধীরে ধীরে নীল উপবৃত্তটা ফুটে উঠল, হালকা আভা থেকে বেড়ে বেড়ে আবার আগের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল আমাদের পানে চেয়ে।
“অবিশ্বাস্য!” আহমেদ ফিসফিস করে বলল।
“আবার!” ক্যাপ্টেন যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছেন, “আবার করো!”
আমি আবার আলো নেভালাম সব। জ্বালালাম। নীল ছোপটা আগের মতোই মিলিয়ে গেল, তারপর আবার জ্বলে উঠল। আলো নেভালাম, জ্বাললাম, আবার নেভালাম, আবার জ্বাললাম। নীল ছোপটা মিলিয়ে গেল, ফুটে উঠল, আবার মিলিয়ে গেল, ফুটে উঠল। যেন বা গ্রহটা আমাদের দিকে চেয়ে চোখ টিপছে। সুইচগুলো নিয়ে বাচ্চার মতো খেলা করছিলাম আমি। পাগলের মতো আলো জ্বালাচ্ছিলাম আর নেভাচ্ছিলাম যেন মর্স কোডে টরেটক্কা করছি।
নীল ছোপটা আমার সঙ্গে ছন্দ হুবহু মিলিয়ে জ্বলছিল নিভছিল। মহাশূন্যের মধ্যে একটা দপদপ করতে থাকা ফ্ল্যাশবাতির মতো মনে হচ্ছিল সেটাকে দেখে।
“হে ভগবান!” কেউ একজন বলে উঠল। জানি না কে, আহমেদ হবে। বা ক্যাপ্টেন।
কিংবা আমি নিজেই।
***
আমার.. কিশোরী বয়সে, ..বাবা একবার.. আমায়.. বাইরে আকাশ দেখাতে নিয়ে গিয়ে তারাদের দিকে চেয়ে বলেছিলেন, “দেখো, কী সুন্দর না?”
আমি বাবার কথামতো তাদের সৌন্দর্য দেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার মাথায় শুধু একটা কথাই আসছিল, যে ব্ল্যাক হোলটা আমাদের সূর্যকে গিলে ফেলতে ধেয়ে আসছে, সেটাও কখনও এইরকম ঝিকমিকে একটা তারা ছিল।
বাবা নিশ্চয়ই আমার মুখ দেখে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। হেসে বলেছিলেন, “অ্যাপোলিয়নের কথা ভাবছ, না? ওই আকাশেরই কোথাও সে আছে এখন। আসছে এদিকে। ব্যাপারটায় এত রাগ কোরো না, আডান্না! ব্ল্যাকহোল তো আর জানে না, সে কী করছে? অথবা বলা যায়, সে যা করতে জানে খালি, এখনও সেটাই করছে। তার উপর রাগ করাটা কীরকম জানো? বাঘে কেন হরিণ শিকার করল ভেবে বাঘের ওপর রাগ করা, বা আগ্নেয়গিরি কেন অগ্ন্যুৎপাত করল ভেবে করা করা অর্থহীন গোঁসা…”
“বা আমাদের পূর্বপুরুষরা কেন পৃথিবীর হাল এত খারাপ করে দিয়েছিল, সেটা ভেবে রাগ করা…তাই না বাবা?”
বাবা প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। হেসে উপরের দিকে চেয়েই বলেছিলেন, “একদিন তুমি নিজে যখন ওই তারাদের মধ্যে যাবে, দেখবে পৃথিবীর চেয়েও কত সুন্দর, কত অদ্ভুত মনকাড়া জিনিস আছে এই মহাকাশে।”
আমি বাবার কাছ থেকেই শেখা কায়দায় একটা কৃত্রিম হাসি হেসে চুপ করে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম, লোকটা ফালতু বকছে।
এখন মনে হল, কথাটা আসলে সত্যি ছিল! কতখানি সত্যি ছিল কথাটা!
তখন বুঝিনি, বাবা। তখন ভুল ভেবেছিলাম।
***
শেষ অবধি ক্যাপ্টেন আমাদের সবার মনের কথাটা বলেই ফেললেন।
“আহমেদ, ..আডান্না!” .. শান্ত গলায়.. তিনি বললেন, “এই গ্রহটায় জীবন আছে, আর তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।”
***
“যেটা ভেবেই পাচ্ছি না, সেটা হল ওরা আমাদের দেখতে পাচ্ছে কী করে!” আহমেদ উত্তেজিত স্বরে বলল। গত এক ঘণ্টা ধরে ও টানা বকবক করেই যাচ্ছে। আমরা ডাইনিং টেবিলে বসে আছি, বা বলা ভালো আমি আর ক্যাপ্টেন বসে আছি, আহমেদ সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে। আমি ওর মতো ছটফট করছি না ঠিকই, তবে তার মানে এই নয় যে আমার উত্তেজনা কিছু কম! ককপিট থেকে বেরিয়ে অবধি চিন্তাভাবনা সব ঘেঁটে যাচ্ছে, এক একবার তো নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না যে সত্যি সত্যি এমন কিছু ঘটছে।
ক্যাপ্টেন দু’হাতে মাথা রেখে টেবিলের দিকে চেয়ে বসে আছেন।
পর পর বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশ্ন করে আর নিজেরাই তার উত্তর ভেবে বার করার চেষ্টা করে আমরা ওই গ্রহের জীবদের সম্বন্ধে কিছু সম্ভাব্য ধারণা করেছি। গ্রহটায় যে পরিমাণ মিথেন আছে, তাতে জীবগুলো মনে হয় মিথেনভিত্তিক, অথবা সিলিকনভিত্তিক১৩। কিংবা, যেরকম দ্রুততায় ওগুলো সবরকম তলের উপর দিয়েই চলাফেরা করছে, তাতে এই দুটোর মিশ্রণও হতে পারে।
এর বেশি কিছু বোঝা সম্ভব ছিল না। সূর্যমুখী-৫ মহাকাশ অভিযানের জন্য তৈরি, গ্রহে নামার জন্য নয়। এতে কোনো ল্যাবরেটরিও নেই, কোনো নমুনা সংগ্রহ করার রোভার রোবটও নেই। তাছাড়া, অত ভারী একটা গ্রহে নামতে চেষ্টা করলে অভিকর্ষের টানেই আমরা দুমড়ে ভেঙে শেষ হয়ে যাব।
পুরোটা যেমন মাথা ঘুরিয়ে দেয়া, তেমনি হতাশাব্যাঞ্জক ব্যাপার। প্রথম ভিনগ্রহী খুঁজে পাওয়া গেল—যারা আবার সক্রিয়ভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে— আর আমাদের কোনো উপায়ই নেই ব্যাপারটা ভালো করে খতিয়ে দেখার। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে শুধু দেখছি আর মাথা ঘামাচ্ছি, ব্যস!
“দেখো!” আহমেদ আবার বলল, “ওদের কাছে আমরা তো একটা আলোর বিন্দু বই আর কিছু না, আকাশ জোড়া কোটি কোটি আলোর মধ্যে আরো একটা আলো। তাহলে ওরা আমাদেরই কী করে আলাদা বলে বুঝল?”
এই প্রশ্নটা আমিও নিজেকে করে যাচ্ছি সেই থেকে। যেটা মনে হয়, সেটা হল, ও গ্রহের বাসিন্দারা তাদের আকাশের গ্রহনক্ষত্রগুলোর অবস্থান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চেনে। ফলে ওদের আকাশে আমাদের দেখামাত্র তারা বুঝতে পেরেছে, এটা নতুন কিছু।
বললাম সেটা। আহমেদ তার আরও ফাঁকা হয়ে আসা দাড়ি খামচাতে খামচাতে বলল, “সেটা হতে পারে। কিন্তু তাহলে, ওদের একটা বিরাট বড়ো টেলিস্কোপ বা কিছু লাগবে। আমাদের স্যাটেলাইটের
চেয়ে ঢের ঢের বড়ো কিছু, নইলে এত দূর অবধি দেখা সম্ভব না।”
ক্যাপ্টেন এইবার বলে উঠলেন, “পুরো গ্রহটাই ওদের চোখ।”
আমরা একসঙ্গে আঁতকে উঠলাম শুনে, “মানে?”
ক্যাপ্টেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ভাবো। দুজনেই ভাবো। নীল ছোপটা কত বড়ো ছিল সে তো দেখেছ, কত স্বচ্ছন্দে সেটা সরে সরে যাচ্ছিল সেটাও লক্ষ করেছ। আমরা যেমন ভাবছি তাই যদি হয়, তাহলে ওই সাইজের একটা আলো বানাতে কতগুলো আলাদা জীব লাগবে? আর ওই অতজনের মধ্যে অমন সমানতালে নড়াচড়া করা… কী অসম্ভব ব্যাপার বুঝতে পারছ? এক যদি না…”
আমি বুঝতে পারি এবার, “এক যদি না, প্রত্যেকটা জীবই একটা মস্তিষ্কের সঙ্গে গাঁথা হয়। যদি না তারা গুচ্ছমনস্ক১৪  হয়ে থাকে!”
“একদম! প্রতিটা অংশ যা দেখতে পাচ্ছে, তা আসলে দেখতে পাচ্ছে গোটা মস্তিস্কটাই। এই জীবগুলোর কোষ সম্ভবত কোনোভাবে আলো-সংবেদী, সে তো বোঝাই যাচ্ছে, কারণ আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে সংকেত পাঠাতে ও গ্রহণ করতে তারা সমর্থ। তাহলে, এই সব কিছু মিলিয়ে পুরোটা দাঁড়াচ্ছে, পুরো গ্রহটার আসলে…”
“একটাই চোখ!” আহমেদ নীচু স্বরে বলে উঠল।
ক্যাপ্টেন মাথা নাড়লেন, কিন্তু তাঁকে এখন আগের চেয়েও মুহ্যমান দেখাচ্ছিল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কেন, এরকম ঐতিহাসিক একটা আবিষ্কার করেছি আমরা, লোকটার কি একটুও উত্তেজনা বোধ হচ্ছে না!
ভাবা যায়, এই গ্রহটার উপরিভাগ জুড়ে এক অজানা জীবের দল, যারা সবাই মিলে একটাই মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত! একটাই সংবেদনশীল জাতি, মানে জীবগুলো আসলে একটা বিশাল মস্তিষ্কের এক একটা কোষ। এই অবধি ভাবতে আরেকটা কথা হঠাৎ মনে এল, বলেই ফেললাম, “অন্যরকমও হতে পারে তো?”
ক্যাপ্টেন ভ্রূ তুলে তাকালেন। আহমেদ বলল, “কীরকম?”
“আমরা ধরে নিচ্ছি জীব, বা জীবগুলো গ্রহটার উপরে ছড়িয়ে রয়েছে, ঠিক তো? যেমন যেমন গ্রহটা ঘুরছে, আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা জীবটা, বা সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে জীবের সেই অংশটা জ্বলে উঠছে, ফলে আমাদের মনে হচ্ছে সারাক্ষণই আমাদের দিকেই চেয়ে আছে চোখটা। তাই তো?”
“কী বলতে চাইছ সেটা বলো।” অধৈর্য গলায় ক্যাপ্টেন বললেন।
“কিন্তু যদি… যদি গ্রহটা নিজেই সচেতন হয়? যদি এই গ্রহটাই জীবন্ত হয়?”
সবাই চুপ।
তারপর আহমেদ গলা ছেড়ে হাসতে শুরু করল।
“একটা জীবন্ত গ্রহ! মানে, গ্রহটা একটা জ্যান্ত প্রাণী! উফ, আমি ভাবতেই পারছি না! এ যে অবিশ্বাস্য! অসাধারণ! দুর্দান্ত! আরে, সাংঘাতিক ব্যাপার এটা! ভাবতে পারছ পৃথিবীর লোকজন এটা জানতে পারলে কী হবে…” বলতে বলতে মহা উত্তেজিত হয়ে শূন্যে ঘুষি ছুঁড়তে শুরু করল আহমেদ।
ওর উল্লাসটা আমার মধ্যেও চারিয়ে যাচ্ছিল, আমারও লাফিয়ে উঠে গলা খুলে হাসতে ইচ্ছে করছিল। এমন সময়ে ক্যাপ্টেন খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, “পৃথিবীর কেউ এটা জানবে না।”
আচমকা নীরবতা নেমে এল। ঘরটা খানিক আগে যেমন চুপ হয়ে গিয়েছিল, এখন যেন তার চেয়েও বেশি চুপ হয়ে গেল।
“কী বলছেন কী! আমরা এইমাত্র ভিনগ্রহে প্রাণ আবিষ্কার করেছি! প্রাণ! জীবন! ব্যাপারটা ওদের জানাতেই হবে আমাদের!”
“কীভাবে জানাবে?”
“আমরা ওয়ার্মহোল ব্যবহার করতে পারি। তাড়াতাড়ি করা গেলে সময়মতো পৃথিবীতে পৌঁছনো যাবে…” বলতে বলতে ও নিজের হাতের দিকে চেয়ে চুপ করে গেল। কাছে থাকায় আমিও ওর হাতের নতুন ক্ষতগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম।
“ততটা সময় আমাদের আছে কি? গেলে আমরা টিঁকে থাকব কিনা সেটাও…”
“আরে চেষ্টা তো করতে পারি না কি?” এইবার ঝাঁঝিয়ে উঠল আহমেদ।
“আর, আমাদের মিশন?” ক্যাপ্টেনের এই প্রশ্নটা শুনে আমি বুঝলাম কেন লোকটা অত দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, অমন বিষণ্ণ হয়েছিল।
“মিশন?” আহমেদ পুরো ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গিয়েছিল।
“আহমেদ,” ক্যাপ্টেন খুব নরম গলায় বললেন, “আমরা এখানে একটা কাজ করতে এসেছি তো? একটাই কাজ?”
আহমেদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, “না! না! না! অসম্ভব… এটা জানার পর এখন আর ও-কাজ করা যায় না!”
“সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে, আহমেদ!”
“ওই গ্রহে প্রাণ আছে ক্যাপ্টেন!”
“হ্যাঁ, আছে। কিন্তু, নতুন পৃথিবীর জন্য মানুষদের এই সূর্যটা চাই।”
“নতুন পৃথিবীর জন্য একটা সূর্য চাই। কিন্তু সেটা এই সূর্যটাই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই!”
“দেখো, আমরা জানিও না ওই প্রাণীগুলোর বেঁচে থাকার জন্য আদৌ সূর্যটা দরকার কিনা!” ক্যাপ্টেন এইবার ব্যগ্রভাবে বললেন, “হয়তো সূর্যটা বাদ দিয়েও ওরা দিব্যি বেঁচে থাকবে।”
আহমেদ এইবার কেটে কেটে বলল, “কিছু মনে করবেন না ক্যাপ্টেন, এটা আজ পর্যন্ত আমার শোনা সবচেয়ে দুর্বল যুক্তি।”
“আহমেদ!” ক্যাপ্টেনের গলায় এমন কাতর সুর আমি আগে কখনও শুনিনি, “অন্য সব দল ব্যর্থ হয়েছে তুমি জানো। ব্যর্থ হয়েছে বলেই আমাদের হিমনিদ্রা থেকে জাগানো হয়েছে: অন্য মহাকাশযানের থেকে এই মহাকাশযান সময়মতো সাড়া পায়নি বলেই আমাদের ডেকে তুলেছে তারা। আমরা না পারলে আর কেউ পারবে না। নতুন পৃথিবীরও কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।’’
আহমেদের মুখ কঠোর হয়ে উঠল। বড়ো বড়ো পায়ে ও টেবিলের কাছে এসে আমাদের উপর ঝুঁকে পড়ল, তারপর হাতের এক চাপড় মেরে বলল, “নিজেদের জাতিকে বাঁচানোর জন্য আরেকটা জাতির অস্তিত্বকে মুছে দেয়ার কী অধিকার আছে আমাদের?”
ক্যাপ্টেন ইতস্তত করছেন। আমি জানি এর উত্তর তাঁর কাছে নেই। আহমেদের মুখে তৃপ্তি ফুটে উঠল। ও জানে এই মুহূর্তে ও জিতছে। ও জানে, আমি জানি, আমরা সবাই জানি।
কাজেই, ক্যাপ্টেন যখন আমার দিকে ঘুরে তাকালেন, আমি মোটেও অবাক হলাম না। আমার নাম ধরে ডাকারও আগে আমি বুঝে গেছি কী আসতে চলেছে।
“সিদ্ধান্ত নাও। এই সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে।”
না। আমি নয়!  আজ নয়! আমি সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। আমি এই দায় নিতে চাই না!
কিন্তু আহমেদও দেখি মাথা নাড়ছে। বুঝতে পারি আপত্তি করার আর কোনো জায়গা নেই আমার।
“আমি… আমি পারব না!” আমি তোতলাতে থাকি।
“পারতেই হবে তোমায়। ’’
“কেন?”
“কারণ…” বিষাদের সুর ভেসে ওঠে ক্যাপ্টেনের গলায়, “কারণ আর কেউ নেই, আডান্না!”
হে ঈশ্বর! ক্যাপ্টেনের ক্লান্ত গলার কথায় আমি মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছি কেন!
“পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো কী কী?” ফিসফিস করে বললাম।
“আমাদের ওই সূর্যটা চাই। সমস্ত মানবজাতি আমাদের মুখ চেয়ে বসে আছে।” ক্যাপ্টেন ইতস্তত করে আরও বললেন, “তুমি যা বলবে, আমরা তাই করব। তোমার উপর ভরসা আছে আমার।”
এর চেয়ে হাস্যকর ব্যাপার আর হয় না; কারণ, এই মুহূর্তে আমার নিজের উপর একটুও ভরসা নেই।
“প্লিজ!” আহমেদ কাতর চোখে তাকাল আমার দিকে, “প্লিজ ওই গ্রহ থেকে জীবন শেষ করে দিও না। আমরা জানিও না হাজার বছর পরে ওরা কী হয়ে দাঁড়াবে, কী কী করতে পারবে! মহাবিশ্বে কারা বাঁচবে আর কারা বাঁচবে না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমাদের নেই!”
এটাও হাস্যকর। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে মানুষ কি ঠিক এই সিদ্ধান্তই নিয়ে আসছে না?
দু’ পক্ষের যুক্তি বলা হয়ে যাওয়ার পর আহমেদ আর ক্যাপ্টেন পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল দুজনেই। কিন্তু আমার কোনো ট্রেনিংয়েই এই চরম পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট শিক্ষা দেয়া হয়নি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই!
আমার সমকক্ষরা—মানে অন্যান্য মহাকাশযানে আমার মতো যারা ছিল, তারা এই জায়গায় পড়লে কী করত ভাবছিলাম আমি। তারাও কি আগে এমন কিছুর সামনে পড়েছিল? যে জন্য তারা মিশন শেষ করতে পারেনি?
মনে পড়ল, নীল চোখটা কেমন আমাদের দিকে মিটিমিটি চাইছিল যখন আলো জ্বলা নেভার খেলা খেলছিলাম আমি। উফ! আমার বুকটা ভেঙে দু’ টুকরো হয়ে যাবে, বারবার এমন কেন মনে হচ্ছে আমার!
ক্যাপ্টেনের দু’চোখেও ব্যথার চিহ্ন দেখতে পেলাম। উনি ভালো করেই জানেন উনি আমার সঙ্গে কী করেছেন, আমায় কীসের মুখে ঠেলে দিলেন, আমার কাছে ওর চাহিদাই বা কী? অন্যদিকে আহমেদও কাতর চোখে আমার দলে চেয়ে আছে, তার চোখে উদগ্রীব আশার আলো খেলা করছে।
এই মুহূর্তে দুজনের কারও দিকেই চাইতে পারছিলাম না, তাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। গ্রহটা, আর তার নীল ছোপের উপর চোখ পড়ল। নীল। আমাদের ফেলে আসা গ্রহের রঙ।
আমাদের বাড়ি।
আর কী-ই বা করতে পারতাম এরপর?
***
আহমেদ সেই যে স্লিপিং কোয়ার্টারে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছিল, আমাদের হাজার ডাকাডাকিতেও খুলল না। আমি অনেকবার ধাক্কা দিলাম, ডাকলাম; শেষে যখন বুঝলাম কোনো লাভ নেই, ওকে ওর মতো ছেড়ে দিলাম।
***
কয়েকদিন ..পরে, ..ককপিটে.. বসে ..রকেটগুলোর.. যাত্রার শেষ ধাপগুলো নিয়ন্ত্রণ করছিলাম আমরা। আমরা মানে ক্যাপ্টেন আর আমি। আহমেদ আমাদের ইউনিফর্ম আর ওষুধপত্রগুলো দরজার বাইরে বার করে রেখে দিয়েছিল, কিন্তু নিজে বেরোয়নি। কাজ করতে করতে ভাবছিলাম ও বন্ধ দরজার পিছন থেকে দেখছে কিনা— ছত্রিশটা রকেট তাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় জায়গায় ‘লক’ হল, আর একটা অতিকায় ওয়ার্মহোল খুলে গেল তাদের গণ্ডীর মধ্যে, সেই ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে সূর্যটা আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে থাকল। এই দৃশ্য দেখতে ওর কেমন লাগছিল কে জানে?
ওয়ার্মহোলটা ধীরে ধীরে সূর্যটাকে পুরোপুরি আত্মসাৎ করে নিল। চার মাস লেগে গেল পদ্ধতিটা শেষ হতে। আহমেদকে যে আর দেখা যাবে না, এটা ততদিনে আমরা বুঝে গিয়েছিলাম।
এই সূর্যগ্রাস দেখতে দেখতে আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যাপ্টেনের চোখের কোলেও জল দেখে ফেলেছিলাম একদিন।
***
সূর্যটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর চারদিকে সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।
প্রায় অন্ধকার।
নীল চোখটা তখনও জ্বলছিল। এই চার মাসে একদম ঢিমে হয়ে গিয়েছিল তার তেজ। আগের মতো উজ্জ্বল নীল নয়, মৃদু ফ্যাকাশে একটা নীলাভ দ্যুতি। এই পরিস্থিতিতেও কতটা খেটে, কতটা শক্তি ব্যয় করে যে আলোটা আমাদের দিকে জ্বালিয়ে রেখেছিল ওই গ্রহের বাসিন্দারা, সেটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল। তারা কি বুঝতে পারছিল, কী হয়ে গেল? বুঝছে কি, যে ওরাও মরে যাবে এবার? আচ্ছা, ওরা কি বুঝেছে যে আমরাই এই কাজটা করলাম? যেন না বোঝে, ঈশ্বর, যেন না বোঝে!
আর যদি বুঝে ফেলেই থাকে, তাহলে এটাও যেন বোঝে যে হরিণ ধরার জন্য বাঘকে, অগ্ন্যুৎপাতের জন্য আগ্নেয়গিরিকে যেমন বেশি দোষ দেয়া যায় না তেমনি আমাদেরও এই কাজটার জন্য…
এ…এ আমি কী করলাম?
আমি দুঃখিত। খুব, খুব দুঃখিত।
***
আমরা যা করলাম, তা শুধুই শুরুর ধাপ একটা। আশা করি সূর্যটার ঠিক যেখানে ওয়ার্মহোল থেকে বের হয়ে আসার কথা সেখানেই বেরোবে। তারপর নতুন সৌরজগতের সব গ্রহকে তার চারদিকে পাক খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে, বিশেষ করে নতুন পৃথিবীকে। এখনও অনেক বিপদ হতে পারে, কিন্তু আমাদের অংশটুকু আমরা করে দিয়েছি। এবার অন্য অন্য দলেরা পরের কাজগুলো করবে না হয়! নতুন পৃথিবীর উপরে স্থলভাগ তৈরি করা, আর পুরোনো পৃথিবীর বাকি মানুষেরা গহনকৃষ্ণ আঁধারের মধ্য দিয়ে তাদের এই নতুন বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করবে। তবে সে হবে এমনি মহাকাশযাত্রা, ওয়ার্মহোল ট্রাভেল নয়। কপাল ভালো ওদের।
ক্যাপ্টেন আর আমি আর কখনোই ফেরত যাব না। মিশন সফল হল কিনা শেষ অবধি সেও আমরা জানতে পারব না। যাওয়ার মানে নেই, কারণ আমাদের মৃত্যু নির্ধারিত। মানুষের জানা সমস্তরকম সুরক্ষা-আচ্ছাদন দিয়ে মহাকাশযান ঢাকা থাকা সত্ত্বেও, ওয়ার্মহোলের মধ্যে এতটাই বেশি বিকীরণ থাকে যে তা পুরোপুরি এড়ানো অসম্ভব। ওষুধগুলো আমাদের কাজটা শেষ হওয়া অবধি বাঁচিয়ে রেখেছে বইকি, কিন্তু চিরকাল পারবে না। রেডিয়েশনের প্রভাবে আমার সব চুল আর প্রায় সব দাঁত পড়ে গেছে। বাকি শরীরটাও অচিরে ধ্বংস হয়ে যাবে।
না ভেবে পারলাম না— এমন মৃত্যুই আমার প্রাপ্য!
***
ক্যাপ্টেন ককপিটে বসে আছেন দেখে গায়ে হাত দিলাম। ঠান্ডা। ওষুধের কৌটোটা তাঁর হাত থেকে পড়ে গিয়ে গড়িয়ে প্রায় তলায় ঢুকে গিয়েছিল, তুলে নিলাম। খালি। তাই তো হওয়ার কথা!
হয়তো এখানে কোথাও একটা কাগজে কিছু লিখে গেছেন উনি। আমি সেটা খোঁজার চেষ্টাও করলাম না। সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম ওঁর দিকে। বুকের মধ্যে একটা চীৎকার জমছিল, এলোপাথাড়ি কিলচড় মারার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু আমার আর রাগ হচ্ছিল না।
মজার কথাই বটে। কবে থেকে যে বাবাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম, মনেও নেই। যতদূর মনে পড়ে, জ্ঞান হয়ে ইস্তক তাঁকে ঘৃণা ছাড়া কিছু করিনি। লোকটার ভাবনাচিন্তাগুলো, বড়ো বড়ো বাতেলাগুলো, ডিভিশনের কথায় মানবজাতির কল্যাণে আমাকে উৎসর্গ করে দেয়া— সব, সবকিছুকে আমি ঘৃণা করতাম।
কিন্তু মহাকাশযাত্রার এই অঢেল সময়ে আমি ভাবনাচিন্তারও ঢের সময় পেয়েছিলাম। এখন মনে হয় লোকটাকে আমি হয়তো বুঝতে পারছি কিছুটা। বুঝতে পারছি, উচিত-অনুচিত ব্যাপারটা কাগজের দাগের মতো পরিষ্কার হয় না সবসময়। যা আছে, তার মধ্যে থেকে নিজের বিবেচনায় সেরাটা বেছে নিতে হয়, আর তারপর সেই সিদ্ধান্তের যা-ই ফল হোক, নিজের মনে তার অভিঘাত যা-ই হোক সব সামলে নিয়েই এগোতে হয়।
বড়ো করে নিঃশ্বাস নিই আমি। সেই কথাটা বলি, যেটা আমার আরও অনেক আগেই বলা উচিত ছিল, “বাবা, তোমায় খুব ভালোবাসি আমি।”
তারপর ককপিট ছেড়ে মহাকাশযানের অন্য প্রান্ত অবধি হেঁটে যাই, যেতে যেতে সব আলো নিভিয়ে দিই এক এক করে। শেষ স্যুইচটা নিভিয়ে দেয়ার আগে বাইরে চোখ পড়ে, সেই নীল চোখ এখনও সরাসরি আমার দিকে চেয়ে আছে। আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার বুক থেকে। স্যুইচ নেভাই। শেষ আলোগুলো ঢিমে হয়ে নিভে যায় একদম। এখন মহাকাশযানটা মহাকাশের মতোই নিবিড় অন্ধকার।
নীল চোখটা একটু কাঁপে, তারপর স্তিমিত হয়ে যেতে শুরু করে। আমি চোখ সরাই না। কেউ তো এই শেষ সময়টা ওদের সঙ্গে থাকবে! এইটুকু ওদের প্রাপ্য।
দপ করে একবার উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে চোখটা, তারপর চিরতরে নিভে যায়।
আবার হাতড়ে হাতড়ে ককপিটে ফিরে গেলাম, ক্যাপ্টেনের পাশে গিয়ে বসলাম। অন্ধকারে উনি যখন আমার হাত ধরলেন, আমি আর হাত সরিয়ে নিলাম না। নাকি, আমিই হাত বাড়িয়ে ওঁর হাতটা টেনে নিলাম? কে জানে। কিছু এসে যায় না আর তাতে।
বসার জায়গাটা খুব খটখটে, মোটেও আরামদায়ক নয়। তা হোক।
তাতেও কিছু এসে যায় না আর।
আমরা একসঙ্গে মহাশূন্যে, অন্ধকারে, অনন্তকাল ধরে ভাসতে থাকি। বাইরে চেয়ে দেখতে পাই, সব আলো নিভে গেছে বলে আকাশ জুড়ে সমস্ত তারাদের দল খেলা করতে চলে এসেছে।
টীকা
১) ‘হিমনিদ্রা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি cryosleep শব্দের বাংলা হিসাবে। Cryo-preservation বা cryo-conservation পদ্ধতিটি বিজ্ঞানে পরিচিত, এই পদ্ধতির মাধ্যমে অত্যন্ত ঠান্ডা তাপমাত্রায় জৈব পদার্থকে সংরক্ষণ করা হয়।
Cryo শব্দটির উৎস গ্রীক kruos, যার মানে বরফের মতো ঠান্ডা।
জেমস বেডফোর্ড নামক এক ক্যান্সার রোগে মৃত ব্যক্তির দেহ ১৯৬৭ সালে সংরক্ষিত করা হয়েছিল, এখনও তা সেভাবেই আছে।
২) মূল গল্পে মহাকাশযানটির নাম ছিল Solstice V। Solstice শব্দটি সূর্যের চলন বোঝায়। শব্দটি, বা তার বাংলা রূপ অয়ন/অয়নকাল আর্থগতভাবে তত পরিচিত না হওয়ায় পরিবর্তে সূর্যমুখী শব্দটি ব্যবহার করেছি। সূর্যমুখী ফুল যেমন সূর্যের দিকে মুখ করে রাখে, এ অভিযানের মুখও তেমনই এক নতুন সূর্য।
৩) আমাদের সৌরজগৎ যে ছায়াপথে অবস্থিত, তার নাম মিল্কিওয়ে। এ গল্পে মানুষ মহাশূন্যে বহুদূর যেতে পারে, তারা ছায়াপথের বিভিন্ন অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছে।
৪) মিল্কিওয়ের একটি নক্ষত্রপুঞ্জের নাম পার্সিয়্যুস। এটির আবিষ্কর্তা টলেমি। মেডুসার সঙ্গে যুদ্ধ, অ্যান্ড্রোমিডাকে উদ্ধার ইত্যাদি কীর্তির জন্য বিখ্যাত গ্রীক মিথোলজিক্যাল চরিত্র পার্সিয়্যুস-এর নামে এই নামকরণ।
৫) স্পেস নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানারকম ধারণা করেন। বিভিন্ন মাত্রাযুক্ত স্পেস আছে, এমন মনে করা হয়। আমরা যেমন ত্রিমাত্রিক স্পেস-এ বাস করি, তেমনি দ্বিমাত্রিক স্পেস থেকে দশ বা একাদশমাত্রিক স্পেসের কথাও কল্পনা করা হয়। তাদের প্রত্যেকের চরিত্র আর রূপ ভিন্ন ভিন্ন। জেড স্পেস হল জিরো ডাইমেনশন বা শূন্যমাত্রিক স্পেস। এখানে স্থান বা কাল-এর চিরাচরিত ধারণারই অস্তিত্ব নেই, তাই আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে চলাফেরা করা সম্ভব।
৬) পে লোড– মহাকাশ বিজ্ঞানের নিরিখে Payload কথাটাকে নানা প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। মালবহনকারী জাহাজে ব্যাপারটা ওজন সংক্রান্ত হলেও মহাকাশযানে কথাটা ব্যবহার করা হয় স্যাটেলাইট, স্পেস প্রোব, রোভার ইত্যাদির কথা বোঝাতে, যে সমস্ত যন্ত্রপাতিকে মূল মহাকাশযান থেকে অন্য গ্রহ বা উপগ্রহের মাটিতে নামানো হয়। এদের মাধ্যমে পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করেই গবেষণা করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহাকাশযানের আভ্যন্তরীণ সিস্টেম, যা মিশন ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে, তাদেরও পে লোড বলা হতে পারে।
৭) তাপনিরোধক খোলশ নির্মোচন-হিট শিল্ড জেটিসনিং – মহাকাশযান বা রকেটের নিরিখে Jettisoning
 খুব পরিচিত একটা পদ্ধতি। এর আক্ষরিক অর্থ হল ‘ফেলে দেয়া’। বহুস্তর রকেটে বিভিন্ন অংশ থাকে, প্রতিটা অংশের জন্য প্রয়োজনীয় হিট শিল্ড বা তাপ নিরোধক স্তর দেয়া হয়। রকেট যত জোরে যাবে, এই হিট শিল্ড এর তাপ ততটাই বাড়তে থাকবে। ত্বরিত গতির জন্য জেটিসনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে নিম্নতাপের হিট শিল্ডকে মূল রকেট বা স্পেসশিপ থেকে আলাদা করে দেয়া হয়, ফলে রকেটের গতিও বেড়ে যায় আর নিরাপত্তাও বজায় থাকে।  
৮) উল্কা গুঁড়ো করে দেয়াটা খুব অলীক কল্পনা নয়। পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা উল্কা ঠেকানোর উপায় হিসাবে, সেগুলোকে ধাক্কা মেরে অন্য অর্বিটে পাঠিয়ে দেয়ার কথা এখন ভাবা হচ্ছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি “কমেট ইন্টারসেপ্টর’ নামের একটি প্রোজেক্টে কাজও করছে।
৯) লোহিত দানব বা রেড জায়ান্ট – আয়ুর শেষ দিকের বড়ো নক্ষত্র। বাইরের তাপমাত্রা ৪৭০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তার কম (তুলনায়, সূর্যের বাইরের তাপমাত্রা ৫৫২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের
 আশপাশে)। লালচে-কমলা রঙের দেখতে, তাই এই নাম। 
১0) অ্যাপোলিয়ন – গ্রীক শব্দ। অর্থ ‘ধ্বংসকারী’।
১১) ওয়ার্মহোল – দেশ-কাল-এর মধ্যে একটা ভাঁজ। এটাকে এমন একটা সুড়ঙ্গ হিসাবে কল্পনা করা যায়, যার দুই মুখ দুই আলাদা দেশ-কালে খোলে।
১২) গ্রেট রেড স্পট – বৃহস্পতির বায়ুস্তরে একটা উচ্চচাপ অঞ্চল রয়েছে, যেখানে ক্রমাগত ঘূর্ণনাকারে ঝড় বইছে। এটা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরে আর পৃথিবীর হিসাবে প্রায় ছদিন সময় নেয় একটা পাক সম্পূর্ণ করতে। এটার আয়তন বিশাল, ১৬৩৫০ কি.মি. চওড়া, মানে পৃথিবীর ব্যাসের ১.৩গুণ বেশি। ছবিতে এটা বড়ো লাল ছোপের মতো দেখায় বলে এই নাম।
১৩) মিথেনভিত্তিক বা সিলিকনভিত্তিক – পৃথিবীর সব জীবনই আদতে
কার্বনভিত্তিক। বিকল্প জীবরসায়ন বা কল্পবিজ্ঞান অন্য গ্রহে এরকম অন্য কোনো মৌলনির্ভর জীবন হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলে। সিলিকন সেক্ষেত্রে খুবই সম্ভবপর একটি মৌল বলে ভাবা হয়। এই গল্পে, গ্রহটিতে মিথেন গ্যাসের প্রাচুর্য ও জীবটির বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে ভাবা হচ্ছে যে মিথেনভিত্তিক জীবন হওয়াও সম্ভব।
১৪) গুচ্ছমনস্ক বা হাইভ মাইন্ড – একাধিক ব্যক্তি মিলে একটাই মনের অধিকারী হওয়া। এইচ জি ওয়েলস-এর ‘দ্য ফার্স্ট ম্যান ইন মুন’ (১৯০১) গল্পে ভিনগ্রহী সত্ত্বাদের হাইভ মাইন্ড দেখানো হয়েছে। ডেভিড এইচ কেলার-এর ‘দ্য হিউম্যান টারমাইটস’ গল্পে (১৯২৯) দেখানো হয়েছে একদল মানুষদের মধ্যে এমন সংযুক্ত মস্তিষ্ক। এখনও অবধি এটি কল্পনার স্তরে থাকা একটি ধারণা।তবে একদিক দিয়ে ভেবে দেখলে এই মুহূর্তে ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকা ইনটারনেটকে এমনই একটি গুচ্ছমনের আদি রূপ হিসেবে ধরা যায়।
লেখক পরিচিতি
কোফি ন্যামায়ে ঘানার আক্রা শহরে থাকেন। স্পেকুলেটিভ ঘরানায় লেখা তাঁর নানান গল্প ও নভেলা ম্যানচেস্টার রিভিউ, ক্র্যাকড ও আসিমভস সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। ‘The Lights Go Out, One by One’ প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁকে নিয়ে সাড়া পড়ে যায়, গল্পটি নোমো পুরস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছিল। স্টিফেন কিং-এর ভক্ত এই অল্পবয়সী  লেখক একের পর এক ভালো কাজ করে চলেছেন, যদিও কোফি খুব একটা সামনে আসেন না। লেখা নিয়ে
 পরীক্ষানিরীক্ষা করতে তিনি ভালোবাসেন। এক সাক্ষাৎকারে কোফি জানিয়েছেন, “Safety is the enemy of creative development.” এই মুহূর্তে একটা উপন্যাস লিখছেন কোফি।
অনুবাদক পরিচিতি
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউটের ছাত্রী অনুষ্টুপ শেঠের জন্ম ও পড়াশুনো কলকাতায়; বর্তমানে কর্মসূত্রে মুম্বইনিবাসী। তিনি গদ্য-পদ্য দুই ধারার লেখাই লেখেন। কিশোর ভারতী, নবকল্লোল, শুকতারা, পরবাস, জয়ঢাকসহ নানান পত্রপত্রিকায় ও বিভিন্ন সঙ্কলনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত বই- ‘ভুতোর বই’, ‘মিশন: পৃথিবী’, ‘আতঙ্ক একাদশ’, ‘ভয় রহস্যের বারো’, ‘মুখোশের আড়ালে’, ‘হাওয়াই মিঠাই’, ‘বাঘনখ’, ‘তিতিরপাখির
 গল্প’। নিজস্ব লেখালেখির পাশাপাশি গল্প অনুবাদ করেছেন ‘কল্পবিশ্ব’ ও ‘অনুবাদ পত্রিকা’য়। বর্তমানে এলিজাবেথ বিয়ারের দশটি কল্পবিজ্ঞান গল্প নিয়ে একটি অনুবাদ গ্রন্থের কাজ করছেন।  বইপত্র ছাড়া ভালোবাসেন বেড়াতে ও সমমনস্ক বন্ধুদের সাহচর্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন