মূল গল্প: Dune Song
“বালিয়াড়িতে যেও না।” প্রধান ইসিউয়ার মানুষকে বলেন, “শিসের দেবতাদের রাগিয়ে না তুললে তোমাদেরই উপকার।”
তাতে অবশ্য নাটা-র কিছু আসে যায় না। সে আবার পালানোর চেষ্টা করে।
অমাবস্যার বৈঠক১ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে চুপচাপ উঠে বাজারের দিকে চলে যায়। এত সকালেও মরুভূমির আবছায়া কুয়াশা ভারী হয়ে মাটির কাছে জমে থাকে। তাতে চলাফেরার খুব কষ্ট, সবকিছুই এমন থেমে থেমে এগোয়, যেন বালির ভেতর কচ্ছপ। সূর্য উঠে এসেছে আকাশে, তার নরম তাপ অনুভব করা যায়। কিন্তু এখানে খুব বেশি গরম পড়ে না, কারণ ইসিউয়া২ আসলে ঠিক মরুভূমি নয়। অন্তত গাঁওবুড়োরা মরুভূমি বলতে যা বোঝাতে চায়— গোটা দুনিয়া বালিতে ঢেকে যাওয়ার আগে যে ধরনের মরুভূমি ছিল— এটা সেইরকম মরুভূমি নয়।
ইসিউয়ার এই জঙ্গম মরুপ্রান্তর অবিশ্রাম ভনভন শব্দে গুঞ্জরিত হয়, ঠিক যেন বেলেমাছির ঝাঁক। আর তাদের বাজারটাও সেই একইরকম। বাঁশ আর কাপড়ে সাজানো অসংখ্য পথের অপরিচ্ছন্ন কাটাকুটি, দেখে সুরঙ্গের মতো মনে হয়। তার মধ্যে দিয়ে খরখর শব্দ তুলে যাতায়াত করে অজস্র শরীর, ধুলোভরা হাওয়ার হিংস্র ঝাপটা থেকে বাঁচবার জন্য তাদের গায়ে কাপড় জড়ানো।
সেই ভিড়ের ভেতর নাটা-কে কেউ খেয়াল করে না—কখনওই করে না—সে তার নিজের শরীরের থেকেও বড়ো একটা ঝোলা টেনে টেনে নিয়ে হেঁটে যায়। তার ঢলঢলে আলখাল্লার অনেকগুলো ভাঁজ, সেগুলো তার কাঁধ থেকে প্রায়শই পিছলে পড়ে যায়, তখন তাকে থেমে আবার সেটা ঠিক করতে হয়। তার চুল আলুথালু, ডগাগুলো ছিঁড়ে গেছে, না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চোখ দু’খানি রক্তের মতো লাল, কিন্তু কিন্তু ইসিউয়াতে কেউ তাকে লক্ষও করে না।
প্রথমে সে যায় ছাঁচের কারিগরের কাছে। বদলির জন্য তার কাছে যা যা থাকে, তার অধিকাংশই হল গৃহস্থালির নানান বাসনকোশন, সেগুলো এখন আর তার কোনো কাজে আসে না। লোকটা একটাও কথা না বলে তার কাছ থেকে সেই সবকিছু নিয়ে নেয়। বিনিময়ে তার হাতে ধরিয়ে দেয় কয়েকটা আখ। এতে তার ভালোই হয় অবশ্য, কারণ এ- চত্বরে ইদানীং তেষ্টা মেটানোই লোকজনের প্রধান লক্ষ্য। এরপর যেতে হবে ফলের দোকানির কাছে।
এ-যাত্রা সে মাম-এর পুরোনো, বিরাট ধাতব বাক্সটা হাতে করে বাজারে এসেছিল। এইটা দিয়ে আগেকার দিনে মাম গ্রামের লোকেদের জন্য নানান জোড়াতালি দেয়া যন্ত্রপাতি বানাত। ইসিউয়াতে এখন আর কারো কাছে সেসব যন্ত্রপাতি নেই। সেই অদ্ভুত, প্রাচীন সব যন্ত্রপাতি, প্রতিটাই বালির হানাদারির আগেকার যুগে তৈরি। মাম উধাও হয়ে যাওয়ার পর একমাত্র এই বাক্সটাকেই উদ্ধার করতে পেরেছিল সে। এখনও এর মধ্যে মামের সমস্ত যন্ত্রপাতি রয়েছে। এগুলো দিয়ে যেসব জিনিস বানানো বা সারানো হত, সেগুলো বহুকাল আগেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে।
যন্ত্রপাতি সমেত সেই বাক্সটা ইসিউয়ার সবচেয়ে বড়ো ফলের ব্যবসায়ীর সামনে এনে নামিয়ে রাখে নাটা। লোকটা অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেটার দিকে।
“তুমি কিন্তু ফের ধরা পড়বে বলে দিলাম।” সে বলে ওঠে।
“পড়তেও পারি।” নাটা জবাব দেয়, “না-ও পড়তে পারি।”
ব্যাপারী মাথা নেড়ে তার হাতে কিছু লাল চিনি আর শুকনো ফল ধরিয়ে দেয়।
সবার শেষে বিনিময়ের জন্য সে তার সবচেয়ে দামি জিনিসটা বাঁচিয়ে রেখেছে। একটা বড়োসড় চ্যাপ্টা কাঠের পাত। সেটাকে বগলে করে টেনে নিয়ে সে কাঠমিস্ত্রির কাছে গিয়ে পৌঁছায়। এই মহিলাই তাকে পুরোনো একটা গাছের অবশিষ্টাংশ খুঁজতে সাহায্য করেছিল। তারপর মাম সেটাকে খোদাই করে, ঘষামাজা করে, প্যারাফিন দিয়ে পালিশ করে এই পাতটা বানিয়ে দিয়েছিল। কাঠ তো এখন আর একদম পাওয়া যায় না। বালির আগের যুগে অবশ্য প্রচুর নাকি পাওয়া যেত, মাম তাকে সে গল্প বলেছে। এই পাটাতনটা সত্যি সত্যিই নাটার সাত রাজার ধন, তার বুকের মানিক, তার প্রাণ।
কাঠমিস্ত্রি বাড়িতে নেই। কিন্তু তার শিক্ষানবিসরা আছে। তারা তাকে মাটির একটা ঘড়ায় বেশ অনেকটা জল দেয়। একটু দরাদরি করে নাটা কিছুটা রুটি ও পোড়ানো উইপোকাও৩ নিয়ে নেয় তাদের থেকে, তারপর তাদেরকে কাঠের পাতটা দেয় সে। সেটা পাওয়ামাত্র নাটার সামনেই আলোচনা শুরু করে দেয় লোকগুলো, কীভাবে পাটাতনটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে তারপর বিনিময় করবে। নাটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
তার মনে পড়ে যায় কত কান্নাকাটি করে সে মামের কাছে একটা কাঠের পাত চেয়ে বায়না করেছিল। এরকম একটা জিনিস তার চাইই চাই। সে গাঁওবুড়োদের বইয়ে ছবি দেখেছিল জিনিসটার। বইগুলো তারা সংরক্ষণাগারে রাখে, বালির আগের যুগের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য শিল্পকলার সঙ্গে রাখা থাকে সেগুলো। শুধু প্রধান ও তার দীক্ষানবিশদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি আছে। অথচ মাম না জানি কী উপায়ে এরকম একটা বই জোগাড় করেছিল। তার মনে পড়ে সে একসময় কেমন আশা করত যে একদিন, হয়তো শুধু একটা দিনের জন্যই সে বালিয়াড়িতে যাবে, সঙ্গে নিয়ে যাবে কাঠের পাতটা। আর ওই বইগুলোর ছবিতে থাকা বাচ্চাগুলোর মতো কাঠের পাতটার ওপর পা দিয়ে, শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে, সোজা নেমে যাবে পাহাড়ের গা বেয়ে। কিন্তু এখন বড়ো দেরি হয়ে গেছে। এসব আর হওয়ার নয়। ওটা বরং এখন অন্য কারো স্বপ্ন হয়েই থাকুক।
নাটা কাউকে না জানিয়েই রওনা হয়। কাউকে কিছু বলে যাওয়া মানেই ইসিউয়াকে ভালোবেসে বিদায় জানানো। কিন্তু না, সেরকম মনোভাব নাটার মোটেও নেই। বরং সে মনে মনে চায় যে বাঁশের বেড়া পেরিয়ে সে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলন্ত সূর্য ঝুঁকে পড়ুক তাদের মাথার ওপর, আর তারপর একটা আগুনের ঝাপটা নেমে এসে গ্রামটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিক। তারা নাটা আর মামের সঙ্গে যা যা অন্যায় করেছে, তার জন্য তাদের এই শাস্তিই পাওয়া উচিৎ। নাটা মনে মনে প্রার্থনা করে, সেদিন গোটা বালিয়াড়ি একযোগে শিস দিয়ে উঠুক, বাজাতে থাকুক সর্বনাশের বেসুরো সুর। আর অসীম সমুদ্রের মত বালি বয়ে যাক ইসিউয়ার ওপর দিয়ে, গ্রাস করে নিক এই জনপদকে, যাতে আর কখনও কাউকে তার মত কষ্ট পেতে না হয়।
কিন্তু তার আগে তাকে টাসেনোগুয়ানকে খুঁজে পেতে হবে।
***
“বালিয়াড়িতে যেও না।” ইসিউয়ার মানুষকে তাদের প্রধান ডেকে বলে, “দেবতারা তোমাদের শিস দিয়ে মেরে ফেলবে।”
প্রতি কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষে একবার করে বালিয়াড়ির শিস শুনতে পায় ইসিউয়ার মানুষ। প্রত্যেকবারই বালি ইসিউয়ার দিকে একটুখানি এগিয়ে আসে। একটা বিষণ্ণ, বাঁশির মতো সুর শোনা যায় তখন। কোনো প্রাণীর পক্ষে সেরকম এই আশ্চর্য সুরেলা শিস দেয়া সম্ভব নয়, অথচ সেই সুর শুনে তাদের বুকের কান্না জমাট বেধে ওঠে। তীক্ষ্ণ একটা শব্দ, নলের ভেতর দিয়ে বাতাস বয়ে গেলে যেরকম শোনায় অনেকটা সেইরকম। প্রধান বলে ওটা হল দেবতাদের শিস। আরও বলে, দলছুট মানুষকে টেনে নেওয়ার শব্দ ওইটা। যতবার এইরকম কোনো দলছুট মানুষ তার নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে যায় আর বালিয়াড়ির গ্রাসে পড়ে—আর তেমনটা আকছার হয়ে থাকে— ততবার বালি একটু একটু করে এগিয়ে আসে ইসিউয়ার দিকে।
বালির শিস আসলে একটা সাবধানবাণী। এই বার্তা দিয়ে বালি সাবধান করে দেয় গ্রামের মানুষকে, মনে করিয়ে দেয় প্রাক্তন পৃথিবীর পরিণতির কথা। সে দুনিয়ার মানুষ তাকে তোয়াক্কা করেনি বলে বালি তাদের শাস্তি দিয়েছে। প্রধান এই নিয়ে তাদের একটা গল্পও বলেছে। এটা পুরোনো দুনিয়ার সময়েরও আগের গল্প— তখনও মানুষকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। তবে বালির দেবতা নয়, সে শাস্তি তাদের দিয়েছিল জলের দেবতা। ইসিউয়ার এখন একটাই দায়িত্ব— এই সাবধানতার ধারাটাকে বজায় রাখা আর তার মধ্যে দিয়ে পরবর্তী দুনিয়াকে স্বাগত জানানো।
ইসিউয়ার মানুষ তাদের প্রধানকে বিশ্বাস করে। তার কারণ ইসিউয়ার হয়ে সে একটা কঠিন দায়িত্ব পালন করে। তাকে সাহায্য করে গাঁওবুড়োর দল, প্রহরী, ও তার দীক্ষানবিশরা। তার কাজ হল বেড়া ডিঙিয়ে গিয়ে তাদের সমস্যার একটা সমাধান খোঁজা, দেবতাদের পুজো দিয়ে তাদের অনুরোধ করা যাতে তারা গ্রামের এত কাছে বালি ঠেলে না পাঠায়। তাদের এই দলটা অনেক সময় অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস নিয়ে গাঁয়ে ফেরে। তারা বালিতে খুঁজে পেয়েছে সেসব জিনিস। দেখে মনে হয় সেগুলো অন্য কোনো যুগে বানানো। তারপর গাঁওবুড়োরা সেগুলোকে তাদের সংরক্ষণাগারে রেখে দেয়। প্রধান বারংবার এই খোঁজারুদের মনে করিয়ে দেয় যে এটা তাদের বিশেষ কোনো ক্ষমতা বা সুবিধা নয়, বরং বিরাট একটা দায়। কারণ দেবতাদের মুখ দেখে ফেললে আর বেঁচে ফেরা যায় না। তবু প্রত্যেকবার এই যে তাদের দলটা অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে পারছে, এসবই শিস দেয়া দেবতাদের আশীর্বাদ। ইসিউয়ার মানুষ তা শুনে মাথা নাড়ে আর বেড়ার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে; কৃতজ্ঞ বোধ করে এই করুণার জন্য।
অবশ্য নাটা-র মামকে বাদ দিয়ে।
মাম ছিল জন্ম থেকেই জেদি। সে নিজেই মাঝে মাঝে বলত যে, মানুষের মুখ থেকে যা যা বেরোয় তা অত সহজে মেনে নেওয়া উচিৎ নয়। নাটা-র অবশ্য এটা বুঝতে একটু অসুবিধাই হত। কারণ মামের নিজের কথাগুলোও তো তার মুখ থেকেই বেরোচ্ছে। মাম অবশ্য নিজের জীবনেও এই নিয়মটা মেনে চলত। নাটা জানে মাম ঠিক কতবার ইসিউয়ার ওই নিয়ম ভেঙে, বেড়া পেরিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়েছে (ঠিক পাঁচবার)। মাম বলত, ওই শুকনো বাঁশের বেড়া আসলে ইসিউয়ার মানুষকে আটকে রাখে না। বাঁশের বেড়ার ভিতর দিয়ে গলে পালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া বিশ্বাসের পাঁচিলের ভিতর দিয়ে গলে বেরোনো প্রায় অসম্ভব।
মাম এই বিদ্যায়—মানে কোনো কিছুর ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে যাওয়ায় অবশ্য চিরকাল পারদর্শী ছিল। সে বেড়া গলে বেরোনো হোক, স্থান আর কালের ফাঁক দিয়ে পিছলে যাওয়া হোক, বা যুক্তি-তক্কের আনাচকানাচ দিয়ে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়া। সে এত ঘনঘন পালাত যে ইসিউয়ার লোক মাঝেমধ্যে ভুলেই যেত যে সে, আর নাটা, দুজনেই এই গ্রামেরই অধিবাসী। মাঝেমধ্যে তাদের দেখা গেলে, ইসিউয়ার লোক অবাক হয়ে যেত, খুব করে মনে করবার চেষ্টা করত যে তারা কোথা থেকে এসেছে? ভাবত তারা এখনও এখানে কী করছে, দেবতাদের তুষ্ট করবার জন্য এখনও তাদের বলিই বা দেয়া হয়নি কেন?
এমনিতে নাটা আর মামের কথা গ্রামের মানুষের খুব মনে না থাকাই স্বাভাবিক ছিল, থাকলেও হয়তো স্মৃতির এককোণে পড়ে ছিল সে কথা। গ্রামের একদম প্রান্তে থাকত তারা, সে এলাকায় বিছে ভরতি। একমাত্র গ্রামে থাকার অযোগ্য কিছু মানুষকেই ওই জায়গায় ঘর বাঁধবার জন্য জমি দেয়া হত। প্রথম দিকে সে জন্য নাটা মামকেই দোষ দিত। ভাবত তার অপরাধেই এসব হয়েছে, শুধু শুধু গাঁওবুড়োদের সঙ্গে ঝগড়া না করলেই পারত! মাম বলত যে শিস দেয়া দেবতা বলে আসলে কিছু নেই, বলত আসলে এখানে একটা সভ্যতা ছিল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে যা বালির নীচে তলিয়ে গেছে। সে জোর দিয়ে বলত যে এই গ্রামের বাইরেও একটা দুনিয়া আছে, আর সেখানে এখনও অনেক সমৃদ্ধশালী সভ্যতার অস্তিত্ব আছে। সেগুলোকে সে খুঁজে বার করবেই। সময়ের ঘূর্ণিঝড় তাকে সেখানে নিয়ে যাবে। সে জোর দিয়ে বলত যে সে এইসব স্বচক্ষে দেখেছে।
তাই, যখন মাম তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, “চল যাই!” তখন সে সত্যিই ভেবেছিল যে ইসিউয়ার মানুষ আসলে ঠিকই বলে, মামটা একটা আস্ত পাগল। একটা ঘূর্ণিঝড় নাকি তাদের নিয়ে এমন একটা দুনিয়ায় পৌঁছে
 দেবে যেখানে কোনো বালি নেই! আর সেই লোভে স্বেচ্ছায় বালিয়াড়িতে গিয়ে দেবতার গ্রাসে পড়বে তারা!  
যেতে সে রাজি হয়নি একদম। মাম তাকে জোর করবার চেষ্টা করেছিল। অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল সেদিন, দুজনেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল ঘরের ভেতর। মাম বলছিল যে সে শুধু তাদের দুজনের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে, আর নাটা তার উত্তরে বলেছিল যে আসলে তাদের প্রাণ বাঁচানোর কাজটা আসলে ইসিউয়া করছে, আর সে জন্যই এতসব কড়া নিয়ম করা হয়েছে এখানে। মাম বুঝতে পেরেছিল যে নাটা নিজে থেকে আর কখনওই যেতে রাজি হবে না। অতএব সে যখন ঘুমোচ্ছিল তখন মাম তার হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছিল, মুখে কাপড় ঠুসে দিয়েছিল আর তারপর তাকে একটা ঠেলাগাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে ঠেলাগাড়িটাকে তাদের ঘর থেকে বাঁশের বেড়া অবধিও টেনে নিয়ে যেতে পারেনি সে। বাধ্য হয়ে নাটার হাত-পায়ের বাঁধন খুলতেই সে হাওয়ার গতিতে পালিয়ে গিয়েছিল।
মাথা বাঁচানোর খাতিরে অবশ্য ঘরে ফিরতেই হয়েছিল। যাবেটা কোথায়? এসে সে বসেছিল মামের ফিরে আসার অপেক্ষায়। মাম তো ফিরে আসবেই, কারণ সময়ের ঘূর্ণিঝড় বলে আদৌ কিছু নেই, আর বালিয়াড়িতে কোনো মায়াবী ধূলোর ঝড়ও নেই, যা তাদের প্রাণ বাঁচাতে পারবে। তাই, সে অপেক্ষা করতে লাগল।
আরো অপেক্ষা।
আরো অপেক্ষা।
এই অপেক্ষার অবসান হয়েছিল, যখন মরুভূমি থেকে ভেসে এসেছিল সেই শব্দ। সেই শিসের শব্দ। দেবতার শিস।
***
“আমরা সবাই যে যার চরকায় তেল দিই,” প্রধান ইসিউয়ার মানুষকে বলে, “এই জন্যই আমরা এখনও বেঁচে আছি। কারণ আমরা কখনও আমাদের সমর্থ্যের বাইরে কিছু খুঁজতে যাই না।”
নাটা সহজেই টাসেকে খুঁজে পায়। ছোটোখাটো ছেলেটা, প্যাংলা, কনুইগুলো যেন বাক্সের কোণা। চোখ কোটরের এতটাই গভীরে ঢুকে গেছে, যেন তাতে সমুদ্র ধরে রাখা যাবে। গ্রামের বাকি সবার সঙ্গে সে খুব একটা থাকে না। সবসময় অন্য কোথাও ঘুরঘুর করে বেরায় (আর উঠোনে থাকলেও, তার মন অন্য কোথাও উড়ে বেড়ায়)। ইসিউয়ার মানুষ মনে করত যে প্রধানের এরকম একটা ছেলে হওয়াই উচিৎ হয়নি। রোগাভোগা, চোখে সবসময় ভাসা ভাসা একটা দৃষ্টি, যেন চিন্তায় ডুবে আছে। তাই তার এই ঘনঘন পালিয়ে যাওয়াতে কারো কিছু যেত আসত না।
নাটা পুরোনো, ভাঙাচোরা মহল্লাটার কাছে তাকে খুঁজে পায়। ইসিউয়ার যেসব মানুষ বালির শিসের শিকার হয়েছে, এখানে তাদের আস্তানা, জিনিসপত্র সহ সমস্ত কিছু ফেলে দেয়া হয়। মামের সবচেয়ে ভালো যন্ত্রপাতিগুলোও এখানে ফেলে দেয়া রয়েছে। আগের দুনিয়ার যা যা জিনিস সে সংগ্রহ করেছিল, যেগুলো সে গাঁওবুড়োদের সংরক্ষণাগারে রাখতে দেয়নি, সেগুলো সব এখন এখানে। এই সবকিছু তো বটেই, আর সঙ্গে তাদের মাথা গোঁজার ঝুপড়িটাও, যেটাকে ইসিউয়ার লোক ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে রেখেছে, যাতে কখনও আবার সেটাকে নতুন করে বানানো না যায় (পারলে হয়তো আগুনই লাগিয়ে দিত, কিন্তু আজকাল আবার আগুন বড়োই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে)- তার ভগ্নাবশেষগুলোও
টাসে এই আঁস্তাকুড়ের একদম মধ্যিখানে উবু হয়ে বসে ছিল। তার ছাই মাখা পা-দু’খানা ধ্বংসাবশেষের শক্ত কোনো চাঁই-এর ওপর রাখা। হাতে একটা স্লেট। সাদা পাথরের একটা টুকরো দিয়ে সে সেটার ওপর লিখছিল কিছু একটা। টাসে প্রধানের একমাত্র সন্তান। তার জন্মের আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল যে সে দীক্ষানবিশ হবে। তাকে ইসিউয়ার ভবিষ্যৎ হতে দেয়ার সুযোগ করে দেয়াও হয়েছিল। বেশির ভাগ সময় তাকে গাঁওবুড়োদের সঙ্গে দেখা যেত, তার অধিকাংশ সময়ই সে ইসিউয়ার ভাষা শিখত, শিখত তার লিপি ও শব্দের হিজিবিজি সব আকৃতি। কিন্তু প্রহরী অথবা উঠোনের অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে সে একদমই মেলামেশা করত না। বরং ফাঁক পেলে একা বসে বসে লেখা অভ্যাস করত।
নাটা আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে এল। এইবার সে মুখ তুলে তাকায়।
“আমার সঙ্গে যাবি?” নাটা তাকে জিজ্ঞেস করে।
ছেলেটা লেখা বন্ধ করে, তার চোখগুলো তখন কোটরের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে বলে, “কোথায়?”
টাসে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর স্লেটে কিছু একটা লেখে, খুব আস্তে আস্তে। “তোর মা?”
“হ্যাঁ।” নাটা তার উত্তরে বলে।
সে আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “আমার মাকেও খুঁজব?”
নাটা একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। টাসের মায়ের গল্প সবাই শুনেছে। প্রধানের প্রথম স্ত্রী। ইসিউয়ার সমাজ বলে, সে-ও দলছুট মানুষ ছিল, আর নাটার মায়ের মতই পাগলি। সারাক্ষণ বলত অন্য কোথাও চলে যাবে।  ইসিউয়ার
 মানুষ তাকেও বালি দেবতাদের কাছে অর্পণ করেছিল, তাদের ক্রুদ্ধ নিঃশ্বাসের যজ্ঞিকুণ্ডে আহুতি দিয়েছিল তাকে। ইউসিয়ার মতে, এতে কোনো আপত্তি না করাটা প্রধানের পক্ষে উচিৎ কাজই হয়েছে।
নাটা বলে, “খুঁজতেও পারি।”
ছেলেটা আরো কিছুক্ষণ কী সব লেখে, তারপর লেখার সরঞ্জাম মাটিতে রেখে উঠে দাঁড়ায়। পিছনটা হাত দিয়ে ঝেড়ে নেয় একটু।
“বেশ।” সাটা জানিয়ে দেয় এইবার।
নাটা আগে থেকেই জানত যে ঠিক সময় এলে কাজটা ঠিক এতটাই সহজ হবে। টাসে মানসিকভাবে কোনোদিনই এই গ্রামে থাকত না। সে সবসময় অন্য কোথাও ঘুরে বেরাত। শুধু ইসিউয়ার মানুষ সেটা বুঝতে পারত না। নাটা একবার তাকে জিজ্ঞেসও করেছিল সে কেন লিখতে শিখছে। তার উত্তরে সে তাকে বলেছিল যে এখান থেকে যখন সে পালিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে, তখন লেখাপড়া জানলে সুবিধা হবে। তখনই সে বুঝতে পেরেছিল যে ছেলেটা আসলে মামের মতোই, কিন্তু তারও আগে সে তার নিজের মায়ের মতো।
নাটা তাকে বলে, “আমাদের পুরোনো জায়গায় দেখা করব। তুই জানিসই কোথায়। সন্ধ্যের পর আসিস। তখন প্রহরীরা মদ খেয়ে পড়ে থাকে। আর কাউকে বলিস না।”
“সন্ধ্যেবেলা? কিন্তু আজ যে পূর্ণিমা। আজ তো শিস দেবে ওরা।”
“হ্যাঁ। তাই জন্যেই তো আজ যাব।” নাটা তার উত্তরে বলে।
***
“যে পালায় তাকে দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করে দেয়া হয়”, প্রধান ইসিউয়ার মানুষকে বলে, “তাদের আর গ্রামে ফিরতে দেয়া হবে না।”
প্রথমবার নাটা খুব বেশি দূরে যেতে পারেনি। চারিদিকে শুধু রোদ আর বালি। আর দিনের শেষে বালিয়াড়ির লম্বা লম্বা ছায়া তার শরীর ঢেকে ফেলছিল। সে কয়েকটা কঙ্কাল খুঁজে পেয়েছিল, মানুষ ও বিভিন্ন জন্তুর। রোদের তেজে শুকিয়ে গিয়েছিল সেগুলো। আর পেয়েছিল বেশ কিছু শিল্পবস্তু। আগে এরকম কিছু দেখেনি সে। সেগুলো নিয়ে এসেছিল সে। তারপর তার জল শেষ হয়ে গেল। সে মামকেও আর খুঁজে পায়নি, তার মৃতদেহটাও পর্যন্ত পায়নি। এমন কোনো ঘূর্ণিঝড়ও পায়নি যেটা তাকে মামের কাছে নিয়ে যেতে পারত।
বেড়ার কাছে ফিরতেই প্রহরীরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আলখাল্লার তলায় তাদের কপাল চকচক করছিল। তাদের লম্বা মুখগুলোয় বলিরেখার আস্তরণ, কোনো আবেগের চিহ্ন নেই তাদের চোখে মুখে। একটাও কথা না বলে তার তাকে ঘিরে ফেলল। মতের মিল থাকলে কথার আবার কী প্রয়োজন?
তারা তাদের কর্তব্য পালন করল; নাটাকে গ্রামের ভেতর দিয়ে সবাইকে দেখাতে দেখাতে নিয়ে গেল, খোদাই করা আনুষ্ঠানিক পালকিতে চড়িয়ে। সে বলির পাঁঠা, একটা জ্যান্ত সতর্কবার্তা, সোজা দেবতার গ্রাসে নিজেকে ঠেলে ফেলে মৃত্যুবরণ করার একটা অনন্য অভিনয়। ইসিউয়ার মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে প্রহরীদের পিছনে জড় হল। তারা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়াচ্ছিল, ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। তার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছিল। কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে তাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করছিল। হয়তো করুণার বশে, হয়তো বা তাকে সমর্থন করবার জন্য। হয়তো মনে মনে তাকে তারা প্রশ্ন করছিল, “কেন?” প্রহরীরা তার গা থেকে তাদের হাতগুলো ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু লোকগুলো বারবার ফিরে আসছিল।
গ্রামের মধ্যিখানে প্রধানের নিজস্ব উঠোনের ভেতর প্রধানের ঘর। এটাই এখানকার সবচেয়ে বড়ো বাড়ি, একটা নিজস্ব বৈঠকখানাও রয়েছে। সেখানে তারা নাটাকে নিয়ে এসে তার সামনে দাঁড় করাল। ইসিউয়ার সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। প্রধানকে গ্রামের বাকি মানুষের মতই দেখতে, শুধু তার শরীরটা একটু মোটাসোটা, আর তার ভ্রূগুলো যেন চিরতরেই কুঁচকে গেছে। তার পোশাক-আশাকও অন্যদের মতো, আলখাল্লাটা একই কাপড়ের তৈরি, শুধু তার মাথায় একটা পুঁতি দিয়ে বোনা মুকুট। এইটা প্রত্যেক প্রধান তার আগের প্রধানের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পায়।
বিষয়টার ফয়সালা করতে তার বেশি সময় লাগল না। বেশ সরল বিচার হল। গ্রামের নিয়মানুসারে নাটাকে আর গ্রামে ঢুকতে দেয়ার কথা নয়। কারণ ঢুকতে দিলে দেবতারা হয়তো রেগে গিয়ে বালিয়াড়িকে ইসিউয়ার আরেকটু কাছে ঠেলে দেবে। বরং তাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়া হবে বালিয়াড়িতে, সঙ্গে কিছু দেয়া হবে না, গায়ের আলখাল্লাটা পর্যন্ত না। তাতে শিস-দেবতাদের তাকে গ্রাস করতে সুবিধা হবে। এত বছর ধরে, বহু কষ্ট করে বানানো তাদের এই নিয়ম। সেটাকে নিছক ইচ্ছার বসে অবহেলা করেছে নাটা। তার ফলে যাতে গোটা গ্রামকে বিপদে না পড়তে হয়, তাই এই ব্যবস্থা। ..দেবতারা ..ঠিক.. বুঝবেন। .তাছাড়া তারা তো তার উপকারই
নাটা তো পালিয়ে যেতেই চাইছিল।
কিন্তু বাধ সাঁধল একজন, টাসে। সে মাঝে পড়ে সবটা বদলে দিল। বিচারসভার ঠিক মাঝখানে, আদালতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে, সে তার দিকে এগিয়ে গেল। নাটা তখন বৈঠকখানার মাঝখানে তার হাটু গেঁড়ে বসেছিল, তার খুঁজে পাওয়া জিনিসগুলো তার চারধারে ছড়ানো। টাসে তখন আরো ছোটো, তার চেহারাও আরো ছোটোখাটো। সে নাটার চুলটা একবার ছুঁলো, তারপর একটু হাসল। তারপর তার কান ধরে একটু ডলে দিল, তারপর কোমরের পিছন থেকে একটা হাত বের করে তাকে রুটির একটা টুকরো ধরিয়ে দিল। নাটা তখন তার হাত থেকে সেটা নিয়ে, মুখে পুরে চিবোতে
 শুরু করেছিল। 
ইসিউয়ার মানুষ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল তাদের এই কীর্তিকলাপ দেখতে দেখতে। প্রধান যতই চেষ্টা করুক, টাসে কাউকে
খুব একটা পাত্তা দিত না। তার আয়ারাও তাকে দিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনও কিছু করিয়ে নিতে পারত না। সে বড়োই নিঃসঙ্গ। প্রধান মনে মনে মেনে নিয়েছিল যে টাসে তার জীবনটা এইরকমই একা একা কাটিয়ে দেবে। তার মৃত্যুর সময়ও কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেবে না। আসন্ন দুনিয়ায় টাসের কোনো জায়গা নেই। সেখানে একমাত্র জোট বেঁধে, একসঙ্গে থাকতে পারলেই মানুষ বেঁচে থাকবে। টাসের মত মানুষদের কোনো জায়গা নেই সেখানে। মনে মনে এটা মেনে নেওয়া সত্ত্বেও কিন্তু প্রধান তখনও টাসেকে পুরপুরি ত্যাগ করতে পারেনি। টাসেকে দেখলে তখনও তার মনে একটু আশা জাগত। এখন সেই আশাটাই হয়তো সে মুহূর্তে জেগে উঠেছিল আবার।
গলাখাঁকারি দিয়ে উঠল প্রধান। তারপর বলল নাটাকে কয়েদখানায় রেখে দিত। আগামী কাল অবধি তাকে সেখানে রাখা হবে। এতেই নাটা বুঝল যে তাকে আর গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হবে না।
পলাতকদের কখনও এইরকম শুধুই কয়েদ করা হয়নি। বিচার শেষ হওয়ার পর সবসময় তাদের একই শাস্তি দেয়া হত। প্রহরীরা গিয়ে গ্রামের প্রবেশদ্বার খুলে দিয়ে তাদের বারংবার খোঁচাত। খোঁচা খেতে খেতে মানুষটা ক্রমে বাঁশের বেড়া ছাড়িয়ে কিছু দূর এগিয়ে যেত। তখন সে যতই কান্নাকাটি করুক, অনুনয় বিনয় করুক, তার চোখের সামনে গ্রামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হত, আর সে রয়ে যেত বাইরে। তারপরে সে হাঁটতে হাঁটতে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যেত। অনেক সময় হাওয়ার পিঠে করে এদের করুণ আর্তনাদ ভেসে আসত। তারপর সময় হলে বালির দেবতা শিস দিয়ে উঠত, আর হঠাৎ করেই তাদের সেই চিৎকার মাঝপথে থেমে যেত। আর তারপর শুধুই নিঃস্তব্ধতা। ইসিউয়ায় আবার শান্তি নেমে আসত। নিরাপত্তার শান্তি।
পরদিন সকালে আবার তাকে গ্রামের সবার সামনে নিয়ে আসা হল। প্রধান বলল, একে দিয়ে এখনও কাজ হবে। পাগল মাকে অনুসরণ করতে গিয়ে নেহাৎ একটা ভুল করে ফেলেছে। তাই বলে একে শুধু শুধু ফেলে দেয়া উচিৎ নয়। পরের বার বালিয়াড়িতে গেলে প্রধান ও তার দল নাটার হয়ে একটু প্রার্থনা করে আসবে বরং। আর ইতিমধ্যে সে সমাজের কাজ করে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে। কী কাজ? টাসের সেবিকা ও সঙ্গী হবে সে। তাকে সে গ্রামের বাকি মানুষের সঙ্গে মিশতে সাহায্য করবে। যাতে সে ক্রমে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর ভবিষ্যতে অনায়াসে তার উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। 
প্রধানের জ্ঞান, ভবিষ্যৎচিন্তা ও দয়ার এই প্রদর্শন দেখে ইউসিয়ার মানুষ ধন্য ধন্য করে উঠল। দলের সবাই নড়েচড়ে বসল, আর গুনগুন করে উঠল তার প্রশংসায়। আর ঠিক তখনই নাটা বুঝতে পারল যে মাম ঠিক বলেছিল। যে বালিয়াড়ির নীচে আদৌ কোনো দেবতা ছিল না, শুধু মানুষের মনে কয়েকটা মিথ্যে কথা গেঁথে দেয়া হয়েছিল। আর ঠিক এইভাবেই সে ঠিক করে নিয়েছিল যে সে আবার পালাবে।
সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার পর গাঁওবুড়োরা তার কাছ থেকে তার সব জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে তাদের সংরক্ষণাগারে নিয়ে গেল। তখন টাসে তার কাছে এসে ধূলোর ওপর হাটু গেঁড়ে বসল। এত কাছে যে তাদের নাকগুলো ঘষাঘষি খাচ্ছিল প্রায়, টাসের শিশুসুলভ শ্বাসপ্রশ্বাসে অদ্ভুত এক উত্তেজনা।
সে ফিসফিস করে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “গন্ধটা পেয়েছ তুমি তাহলে? বাইরে গিয়ে টের পেয়েছ তুমি? শক্তির গন্ধ?”
***
হাত ধরাধরি করে তারা সন্ধ্যেবেলায় বেরিয়ে যায়। তাদের হৃদপিণ্ডগুলো একই ছন্দে নাচে। রাত হয়ে গেলে মরুভুমিতে তাদের প্রহরীরা সহজে দেখতে পাবে না। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যায় না, দূরে বালির পাহাড়গুলো কালো কালো ছায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। তাদের সঙ্গে কোনো আলো নেই। একমাত্র স্মৃতির ওপর ভর করে নাটা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে রাস্তা খুঁজে বার করে, আর এগিয়ে চলে। পিঠে তার জোগার করা খাবার ও জলের বোঝা। তাদের গায়ে আজ পাতলা আলখাল্লা, যাতে তারা আরও দ্রুত চলতে ফিরতে পারে। নিশীথ রাত্রি, শীতের ছোটে টাসের দাঁত কটকট করতে থাকে।
তারা যেদিকে চায়, শুধু বালি, ধূলো আর হাওয়া। ছোটোবড়ো বালির পাহাড়ের চুড়ো ছাড়া তাদের আশেপাশে যেন আর কিছুই নেই। দূরের আকাশে লালচে, নিভু নিভু আলো, তার সামনে মাথা উঁচিয়ে সারি সারি পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে। সবচেয়ে বড়ো পাহাড়গুলোর নীচে চাপা পড়ে আছে ইসিউয়ার লুপ্ত পূর্বপুরুষদের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। ছোটো পাহাড়গুলোর ওপরে তারা ওঠে না, যাতে তাদের দূর থেকে দেখা না যায়। তাদের পায়ের তলায় বালি ঠান্ডা হয়ে আছে, তাতে তাদের পায়ের ছাপ পড়ে থাকে।
 নাটা জানে যে সকাল হয়ে গেলে তাদের অনুসরণকারীরা তাদের পিছু নেবে। আর ইসিউয়ার একমাত্র উঁটটাকে একটু জোরে দৌড় করালে বেশ সহজেই খুঁজে পেয়ে যাবে তাদের। আর যদি সবচেয়ে চটপটে প্রহরীরা তাদের পিছু নেয়, তাহলে তো আর কথাই নেই।    
টাসে অধিকাংশ সময় চুপ করে থাকে। নাটার চেয়ে অল্প ক’বছরের ছোটো সে। অথচ তার এই নিঃশব্দতা চাক্ষুস করলে যেন মনে হয় তার বয়েসের গাছ-পাথর নেই। মাম তাকে যা বলত, নাটার মনে পড়ে সে টাসেকে সেগুলো সবই বলেছে। তখন সে কিছুই বিশ্বাস করত না, কিন্তু এখন করে। কী বলত তাকে মাম? তুমি একা হলে দেবতা। তুমিই বালিয়াড়ি, আর বালি কখনও নিজেকে গ্রাস করবে না। ইসিউয়ার লোক তোমায় ভুল বোঝাতে চাইলেও তুমি তাদের সেই সুযোগ দিও না।
নাটা টাসের দিকে একবার তাকায়। সে তার আলখাল্লাটা বুকের কাছে টেনে ধরেছে, আর ঠায় তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, তার দৃষ্টি দিগন্তবিস্তৃত বালির পাহাড়ের ঢেউয়ের ওপর নিবদ্ধ। প্রধান যখন তাকে শাস্তি দিচ্ছিল, তখন সে বোঝেনি সে আসলে তার উপকারই করছিল। তার দু’চোখ খুলে দিচ্ছিল সে, তাকে জ্ঞানের আলো দিচ্ছিল। সে ছাড়া আর কেউই টাসের সঙ্গী হতে পারত না। একমাত্র সেই টাসেকে বুঝত। কেন টাসে এইরকম একা একা থাকে? কারণ তাদের দুজনের মনেই একই প্রশ্ন খেলা করত। তারা দুজনেই ইসিউয়ার অনর্গল ফিসফাস কানে নিয়ে বড়ো হয়েছে, সারাক্ষণ নিজেকে প্রশ্ন করেছে তারা আদৌ সুস্থ, না তাদের মায়েদের মতই পাগল! প্রশ্নগুলো তাদের মনের ভেতর গিঁট বেঁধে রয়েছে এখনও। একমাত্র এখান থেকে পালিয়ে গেলে সেই গিঁট খোলা যাবে। তারা চিরকাল জানত যে একদিন, কোনো না কোনো ভাবে, তাদের যারা পেটে ধরেছে, সেই মানুষ দু’টোকে খুঁজে বার করবে তারা। তাদের বুকেও স্বাধীনতার অদম্য আগুন। তাদের সঙ্গে গিয়ে অন্য কোথাও ঘর বাঁধবে দুজনে।
ইসিউয়ার থেকে তারা ক্রমশ দূরে চলে যায়। সোজা পথ ধরে এগিয়ে যায় বালির পাহাড়ের দিকে। কেউ তাদের পিছু নেয় না, এটাই তাদের সৌভাগ্য। নাটা মনে মনে ভাবে যে ভোরের আগে একটা পাহাড়ের কাছে পৌঁছে গেলে ভালো হয়। তাহলে তার ছায়ায় দুপুরবেলাটা কাটাতে পারবে তারা। কিন্তু বালিতে হাঁটতে হাঁটে তাদের পা ক্লান্ত হয়ে আসে। বালির পাহাড় তখনও অনেক দূর, নাটাও বুঝতে পারছে না পাহাড়ের ঠিক কতটা কাছে যেতে পেরেছে তারা। কিন্তু ইসিউয়াকে পিছনে ফেলে তারা যথেষ্ট দূরে চলে এসেছে। এখন একটু বিশ্রাম নিলে ক্ষতি নেই।
সেঁকা উঁইপোকা দিয়ে একটু রুটি খায় তারা। নাটা টাসে কে তার সেইদিনের বরাদ্দ
 একঢোক জল খেতে দেয়, সে নিজে অবশ্য আখ চিবোতে থাকে। চিবোতে চিবোতে ভাবে মামের সঙ্গে আবার দেখা হলে সে কী বলবে! পালানোর প্রস্তুতি নিতে তাকে এত চিন্তা করতে হয়েছে যে সে ভুলে গেছে যে মামের ওপর তার কতটা রাগ। হয়তো মামকে দেখলে একটুও খুশি হবে না সে। হয়তো তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে, হয়তো সে জীবনে তাকে ক্ষমা করতে পারবে না তাকে ফেলে চলে যাওয়ার জন্য। সব কিছু ফেলে ফিরে এসে তাকে নিয়ে যাওয়ার কোনো চেষ্টা না করবার জন্য।
 মাম এই প্রশ্নের যাই উত্তর দিক, সেটা শোনার জন্য সে এখনও প্রস্তুত নয়। তাই হয়তো সে টাসেকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। হয়তো সে আবার শুরু থেকে সবকিছু করবার চেষ্টা করছে, ঠিক যেরকমটা হওয়ার কথা।  
টাসে বলে, “এগোনো যাক।”
নাটা বালির ওপর শুয়ে শুয়ে তাকে বলে, “দরকার নেই। ও নিজে থেকেই আমাদের কাছে আসবে।”
তাই শুনে ভ্রু কোঁচকায় টাসে। নাটা তাই দেখে বলে, “আরে জিনিসটা তো একটা ঘূর্ণিঝড়, তাই না? এদিক ওদিক ঘুরে বেরায়। তাই জন্যই শিসের শব্দ আসে। আমার মা বলত ওটা সুযোগ দেয়ার হাওয়া। একমাত্র নিজেকে তার কাছে এগিয়ে দিলেই সে তোমার কাছে আসবে।”
এবার টাসে তার পাশে শুয়ে পরে, সারা গায়ে আলখাল্লা জড়িয়ে সে বালির মধ্যে প্রায় মিলিয়ে যায়। খানিক পর তারা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর নাটা মামের স্বপ্ন দেখে। সে দেখে তাদের আবার দেখা হয়েছে, কিন্তু মাম তাকে আর চিনতে পারছে না। সে একবার জেগে যায়, আর কিছুক্ষণ সেইভাবেই শুয়ে থাকে, মামের মুখে শোনা সব ঘূর্ণিঝড়ের গল্প মনে করবার চেষ্টা করে, তার পাঁচ-পাঁচবার বেড়া ডিঙিয়ে পালিয়ে যাওয়া আর গ্রামে ফিরে আসার গল্প, সে কী কী দেখেছে তার গল্প। সে বলত এগুলো নাকি স্বাধীনতার ঘূর্ণিঝড়। এতে করে সে ফিরে যেত অন্য একটা সময়ে, যেখানে তার মুখ থেকে কথা বেরোত না, আর তার শরীরও নিয়ন্ত্রণ করা হত, কিন্তু অন্তত শরীরটা তার নিজের ছিল, ইসিউয়ার উদ্দেশ্যে অর্পিত ছিল না।
সে যে সময়ই হোক, নাটার দৃঢ় ধারণা যে মাম সেইখানেই ফিরে গেছে কিন্তু তাকে কথা দেয়া সত্ত্বেও আর ফেরৎ আসতে পারছে না। এবার তাকে বালির শিসের সেই বাঁশি খুঁজতে হবে, আর নিজেকেই বাজাতে হবে।
***
মানুষ যা বোঝে না, তা ধ্বংস করার চেষ্টা করে, মাম একসময় বলত। তাদের হাতও যদি বাঁধা থাকে, তাহলে তারা পারলে তাদের জিভ দিয়ে সেটাকে চাবকে মারবে।
অন্যবারের তুলনায় প্রহরীদের নাটাকে খুঁজতে বেশি সময় লেগেছিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে, কারণ বালিয়াড়ির
 শিস শুরু হয়ে গেছে। 
ঘূর্ণিঝড়টা প্রথম দেখা দেয় শেষরাতে। তার আবির্ভাবের সংকেত হিসেবে শোনা যায় অনেক দূর থেকে ভেসে আসা একটা বিলাপ ধ্বনি, কে যেন বেশ জোরগলায় নালিশ জানাচ্ছে। প্রহরীদের কাছে সেই বিলাপই দৈববাণী রূপে এসে হাজির হয়, কারণ সেই আওয়াজটাকে অনুসরণ করেই এগিয়ে আসে তারা। মশাল হাতে প্রহরীরা এসে পৌঁছায় ঠিক সেখানেই, যেখানে তখন নাটা ও টাসে ক্লান্ত হয়ে আস্তানা গেড়েছে, আর আপাতত ঘুমিয়ে রয়েছে।
প্রধান নিজেও এসেছে প্রহরীদের সঙ্গে। মশালের আলোয় আলখাল্লার ছায়া পড়ে তার মুখটা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। সেই অন্ধকার যেন তার বুকের ভেতরেও বাসা বেঁধেছে, সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, আর তাতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে ঠিক কী চিন্তা করছে, সেটা মুখে বলারও দরকার নেই। এইবার আর কোনো ক্ষমা নয়।
সে শুধু বলে, “ধরে আনো ওদের।”
সামান্য ধস্তাধস্তি হয়, চারিদিকে বালি ওড়ে কিছুক্ষণ, মশালের আলোগুলো ভোরের হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে ওঠে মাঝে মাঝে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সব মিটে যায়। দেখা যায় নাটাকে তারা ঠান্ডা করে ধরে রেখেছে একদিকে, অন্যদিকে আটকে রাখা হয়েছে টাসেকে।
প্রধান প্রথমে তার দিকে মুখ ফেরায়, তারপর তার মাথা বরাবর ঝুঁকে, হাত তুলে একটা প্রবল চড় মারে তার মুখের মাঝখানে। নাকের ভিতরে থাকা সংযোগকারী টিস্যু ছিঁড়ে যায় ভোঁতা শব্দ করে, রক্ত গড়াতে শুরু করে।
“আমাকে বলি দিয়ে দাও।” টাসে বলে ওঠে। জীবনে প্রথম সে এতটা গলা তুলেছে। তার কথা জড়িয়ে আসছে রক্ত, লালা ও শ্লেষ্মায়। “আমাকে বলি দিয়ে দাও, তাতেই আমাদের দুজনের এই দুঃস্বপ্নের শেষ হবে।”
স্তব্ধতাকে খানখান করে শুধু বালিধূলো উড়ে যাওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। কিছু দূরে ঘূর্ণিঝড়টা দেখা যায় এইবার, আস্তে আস্তে শক্তিশালী হয়ে উঠছে সেটা, ঝড়ের মধ্যে যেন আরেকটা ঝড় ফণা পাকিয়ে ফুঁসছে। সূর্যোদয় হতে আর দেরি নেই। তার কমলা আকাশের প্রেক্ষাপটে কালো হাওয়ার একটা ভূতুড়ে কুণ্ডলী গর্জন করে চলেছে।
“না।” প্রধান বলে ওঠে। সে একবার চেয়ে দেখে তাদের দিকে ধেয়ে আসা কালো ঝড়টাকে। আবার বলে, “না।”
আর ইতিমধ্যে, যখন নাটার ওপর থেকে সবার নজর সরে গেছে, সে খুঁজে পায় তার কাঙ্খিত পথ।
সেটা দেখতে পাওয়া মাত্র তিরবেগে ছুটে যায় নাটা। সে এত দ্রুত প্রহরীদের হাত এড়িয়ে ছুট লাগায় যে কেউ কিছু বুঝতেই পারে না। পায়ের নিচ থেকে সরে যাওয়া  বালিতে পা সামলাতেই প্রহরীরা তখন ব্যস্ত, তার মধ্যেই সে পালিয়ে যায়। বালির ওপর ছোটো ছোটো
 পা ফেলে পিছলে যেতে থাকে নাটা… এক পা, পাঁচ পা, একসময় সে প্রহরীদের নাগালের বাইরে চলে যায়। তার পিছন থেকে ভেসে আসছে চিৎকার, চেঁচামেচি, গালাগাল। কেউ বলে, মাথায় ছিট আছে, পাগল মেয়ে; কেউ বলে, মহা স্বার্থপর, গোটা ইসুয়াকে বিপদে ফেলছে। কিন্তু তার কানে তখন কিছুই আর ঢুকছে না আর। কারণ, তার দৃষ্টি তখন আটকে গিয়েছে তার সামনে অপূর্ব, উজ্জ্বল এক আলোর ওপর।
ঘূর্ণিঝড়টাকে এই প্রথম স্বচক্ষে দেখছে সে। আগে তো শুধুমাত্র মামের মুখে গল্প শুনেছে। প্রধান ঠিকই বলে, এটা দেবতার নিশ্বাস। কারণ ঝড়ের ভেতর একটা রূপোলি ঝিলিক ঠাহর করতে পারছে সে। উজ্জ্বল আলোর একটা স্পর্শ, বিদ্যুতের মতো। তাকে জড়িয়ে আছে ঘূর্ণায়মান হাওয়া, সঙ্গে মিশে রয়েছে বালি, ধূলো ও পাথরের টুকরো। ঝড়টা একটা ক্রুদ্ধ মেঘের মতো ঘোরাফেরা করছে মাটির সমীপে এসে। এইবার একবার গর্জে ওঠে, খুব কাছ থেকে, যেন গোটা ঝড়টাই একটা জীবন্ত মুখ। তার পিছনে বালি হিসহিস করে চলে বাঁশির আওয়াজের মত, অনেকগুলো শিস দিয়ে তৈরি একটা যৌথসঙ্গীত, অথবা অজস্র সাপের একটা শোভাযাত্রা।
কী অপূর্ব!
এইবার থেমে যায় সে, ঠিক ঝড়ের নাক বরাবর এসে। তারপর ঘুরে দাঁড়ায়। তার পিছনে ধূলো, আলো ও আওয়াজের একটা দেয়াল এগিয়ে আসছে। প্রধান ও তার প্রহরীরা আর তার পিছু নেয়নি, তারা ঝড়ের পথ থেকে অনেকটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছে, টাসেকে পাকড়াও করে রেখেছে দুজন প্রহরী। এত দূর থেকে সে তাদের মুখ দেখতে পায় না, কিন্তু মশালের ধারালো আলোয়, তাদের ভাবভঙ্গি দেখেই লোকগুলোর মনোভাব বুঝতে কোনো কষ্ট হয় না। তারা বলতে চাইছে: নাটার গোটা অস্তিত্বটাই জঞ্জাল সমান, সে ইসিউয়ার এতদিনের কষ্টের মান রাখতে পারেনি, নষ্ট করে দিয়েছে সমস্ত কিছু।
“বেশ করেছি!” সে মনে মনে বলে, “বেশ করেছি।”
কিন্তু, টাসে?
সে এক-পা এগিয়ে আসে, তারপর দু-পা। মনে মনে প্রার্থনা করে যাতে টাসে বোঝে। আরেকটু এগিয়ে আসে সে। ঝড়ও এগিয়ে আসে তার দিকে আর একটু, কিন্তু সে উল্টোদিকে এগোয়। সে ইচ্ছে করে দেরি করছে। নিজেকে বলে যে তাকে ভালো কাজ করতে হবে, ভালো মানুষ হতে হবে। তার মাও চেষ্টা করেছিল ঠিকই, কিন্তু সে আরো বেশি করে চেষ্টা করবে। করবেই।
দুই প্রহরীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে টাসে। তার দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে চিৎকার করে, শোন! শোন! শোন! বুদ্ধি খাটা একটু!
সে বোধহয় তার কথা শুনতে পায় কোনোভাবে, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে যে তার ঘাড়ের কাছে লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। ঝড় এগিয়ে এসেছে। টাসে নড়ে ওঠে। প্রহরীদের হাত থেকে গলে, সাপের মত হিলহিলে শরীরটা বেরিয়ে আসে তার, তারপর দৌড়। প্রহরীরা সেসব দেখে এতটাই অবাক হয়ে গেছে যে তারা আর কিছুই করে না, দাঁড়িয়ে থাকে স্থির হয়ে। সে তার আলখাল্লাটা খুলে ফেলে দেয় বালির ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে, তার কালো চামড়া অন্ধকারের মধ্যে মিশে যেতে থাকে। তার বাবা, গ্রামের প্রধান তার পিছনে ধেয়ে আসে, চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকে, প্রহরীদের মশালের আগুন তাকে ঘিরে দুলতে থাকে…
এই! এই! নাটা মনে মনে ভাবে, এই তো!
সময়ের ঘূর্ণিঝড়, দেবতাদের ঝড়, সুযোগের ঝড়, স্বাধীনতার ঝড় পিছনে ঝুঁকে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে এইবার। তার চোখ, মুখ, নাক, কান… সর্বত্র ভর্তি বালি। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, আর সেই মুহূর্তে সে টের পায় যে তার পা আর বালির ওপর নেই।
কিন্তু তাও সে হাত বাড়িয়ে রাখে।  
মনে হয় যেন অনেকটা সময় কেটে গেছে, আর অনেক দূরে চলে গেছে সে। তারপরেই হঠাৎ একটা বালিমাখা হাত তার হাতটা এসে ধরে। সে হাতটা ধরে টানতে শুরু করে— তার নিজের দিকে, সেইসব মায়েদের দিকে যারা তার আগে পালিয়ে যাওয়ার সাহস করেছিল, টানতে থাকে প্রাণপণে… ভবিষ্যতের দিকে, শক্তির দিকেও।
এরপর ভেসে ওঠে তারা, একসঙ্গে। এই যুগপৎ যাত্রার কারণ বুঝতে পারে নাটা, কারণ তাদের যৌথ বিদ্রোহের ওজনটা এখনও টের পাচ্ছে সে। সে নিজেকে হাওয়ার কাছে অর্পণ করে দেয়। দুজনেই ভেসে যায়, বালির ফাঁক দিয়ে ভেসে যেতে থাকে। শুধু অন্তত স্রোতে ভেসে যাওয়া, স্থান-কাল-পাত্রের কোনো বোধ আর নেই। এখন তারাই মহাবিশ্বের প্রতিটা একক জিনিস, আর একই সঙ্গে অন্তহীন শূন্যতার পরিচায়ক, কারণ দেবতাদের নিশ্বাসের সেই ঝড়ে এই সব কিছুই সম্ভব। এখন সেই নিঃশ্বাস তাদের দুজনেরও। এই ঝড় তাদের কোথায় নিয়ে যাবে তারা জানে না। কিন্তু একটা কথা তারা জানে। তাদের জিভ, তাদের শরীর ও তাদের মন… এবার থেকে তাদের নিজেদের।
টীকা
১) অমাবস্যার বৈঠক- মূল গল্পে কথাটা নিউ মুন অ্যাসেম্বলি। আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতিদের মধ্যে নিউ মুন ও ফুল মুন অ্যাসেম্বলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত পূর্ণিমার সময় বৈঠক করা হয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা নিয়ে। জ্যোত্স্নার আলোয় দৈবশক্তি থাকে বলে মনে করা হয়, ফলে ছেলেমেয়েদের গা থেকে পোকা বের করা বা বিশেষ স্নান করে নাচগানে অংশ নেওয়া এই সময়েই হয়ে থাকে। কিন্তু অমাবস্যার কাছাকাছি কয়েকদিন নিষ্ক্রিয় থাকার সময়। বৈঠক করে সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হয়, নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করে দেবতাকে যেন কেউ রাগিয়ে না দেয়!
২) ইসিউয়া- এই নামটা দেয়ার একটা উদ্দেশ্য আছে। ইসিউয়া কথাটার অর্থ Center of wealth & prosperity অর্থাৎ বলা যায় সুখ ও সমৃদ্ধির দেশ। কিন্তু গল্পে ইসিউয়ার বর্ণনা শুনলে মোটেও সে কথা মাথায় আসে না। লেখক খুব সূক্ষ্মভাবে এই কথাটা ব্যবহার করে বর্তমান সমাজের বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। 
৩) পোড়ানো উইপোকা- দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় নানান জায়গায় উইপোকা বা ‘এসেনসুন’ খুবই জনপ্রিয় খাবার। বিশেষ করে ‘রোস্টেড টার্মাইট’-এর বিভিন্ন রান্না সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর বলে অনেকেই উইপোকার রেসিপির জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
লেখক পরিচিতি
নাইজেরিয়ান লেখক সুয়ি ডেভিস ওকুংবোয়া দ্রুত সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি সাহিত্যে পাকাপাকি জায়গা করে নিচ্ছেন। সাহিত্য সমালোচকদের মতে শুধু আফ্রিকা নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রতিশ্রুতিবান লেখকদের মধ্যে সুয়ি প্রথম সারিতে থাকবেন। লাইটস্পিড, ফায়ারসাইড, পডকাসেল, দ্য ডার্ক সহ নানান পত্রপত্রিকা ও সঙ্কলনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই ‘David Mogo, Godhunter’ শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের জন্য নোমো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল। ওটাওয়া ইউনিভার্সিটির করেন সুয়ি, ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর শিক্ষক এর সাম্প্রতিকতম উপন্যাসের নাম ‘Son of the Storm’, যা নেমলেস এপিক ফ্যান্টাসি সিরিজের প্রথম বই। এই উচ্চাকাঙ্খী ট্রিলজির দ্বিতীয় বই ‘Warrior of the Wind’ আসতে চলেছে ২০২৩ সালে। প্রাপ্তমনস্কদের পাশাপাশি কিশোর সাহিত্য লিখতেও ভালোবাসেন সুয়ি ডেভিস।
অনুবাদক পরিচিতি
মহাশ্বেতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর লেখা মৌলিক ও অনূদিত গল্প একাধিক পত্রপত্রিকা ও সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়াও ‘থার্ড লেন’ নামক একটা ম্যাগাজিনের সম্পাদনা করেন মহাশ্বেতা। দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে এ-যাবৎ- বারান্দার জানালা(মৌলিক গল্পসংগ্রহ) ও দ্বীপমালার রূপকথা (অনূদিত গল্পসংগ্রহ)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন