কণিষ্ক – ১

অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

মনের মধ্যে অদ্ভুত এক চাপা উত্তেজনা নিয়ে ভোর বেলায় জেগে উঠলেন সম্রাট কণিষ্ক। বিশাল কক্ষে শূন্য শয্যায় নিজেকে বড় একাকী বলে মনে হলো তাঁর। কক্ষের কপাট ভেজানো। বাইরে রক্ষিণীরা পাহারায় রয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঘর শূন্য। শয্যায় একাকী-নিঃসঙ্গ। সম্রাজ্ঞী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হলো। তাঁর মৃত্যুর পর সম্রাট আর সংসার জীবনে ফিরে যেতে চাননি। নারী-জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রজারা সম্রাটের ভাবান্তরের দুটি কারণ নির্দেশ করে। এক, সাম্রাজ্ঞীর প্রতি ভালোবাসা সম্রাটকে দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহণ করতে বাধা দিয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি আরও জোরালো। বেশ কিছু বছর হলো, সম্রাট বুদ্ধের শরণাগত হয়েছেন। বুদ্ধতেই মনপ্রাণ নিবেদন করেছেন। বুদ্ধের মহিমা প্রচারের জন্য এক সুউচ্চ স্তুপ আর তার সঙ্গে লাগোয়া এক মহাবিহার নির্মাণে হাত দিয়েছেন। সম্রাটের ইচ্ছা, এই স্তুপ আর মহাবিহার যুগযুগ ধরে মানুষকে সত্যের পথ দেখাক, সত্যের পথে পরিচালিত করুক। এই বুদ্ধপ্রীতিই সম্ভবত তাকে আবার সংসার জীবনে প্রবেশ করা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এই দ্বিতীয় কারণটিই সম্ভবত একমাত্র সত্য। স্ত্রীর প্রতি অনুরাগের প্রমাণ কোথাও তিনি রাখেননি।

সম্রাটের অবসর কালীন সাহচর্যে আসেন বৌদ্ধ দার্শনিক অশ্বঘোষ, বসুমিত্র, সংঘরক্ষিত আদি বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা।

মথুরা বিজয় সম্পন্ন করে তিনি পাটলিপুত্রের ওপর চাপ দিয়েছিলেন যাতে তারা অশ্বঘোষকে তাঁর হাতে সমর্পণ করে। অশ্বঘোষ তখনও এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। পাটলিপুত্রের চাপে এবং সম্রাটের বিনীত অনুরোধে অশ্বঘোষ শেষ পর্যন্ত কণিষ্কের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরম সমাদরে সম্রাট তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন পুরুষপুরে। তাঁরই কাছে দীক্ষিত হন বৌদ্ধধর্মে। সেই থেকে অশ্বঘোষ পুরুষপুরেরই অধিবাসী। এই বৌদ্ধ সংসর্গ ক্রমশই সম্রাটকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কামনাহীন এক জগতে। ক্রমেই তিনি প্রবল থেকে প্রবলভাবে যুক্ত হয়ে পড়ছিলেন সংঘের সঙ্গে। প্রজারা কিন্তু সম্রাটের এই আচরণ ঠিক পছন্দ করেনি। তারা সিংহাসনে এক সন্ন্যাসীকে দেখতে চায়নি। বুদ্ধেরও তো গৃহীশিষ্য ছিল। সম্রাট অশোকও গৃহী ছিলেন। তবে অসুবিধা কোথায়?

এই রাজপ্রাসাদ এবং সম্রাট সংক্রান্ত বিষয়ক মন্ত্রী হচ্ছেন অকৃতদার মহামিশ্র। সম্রাটকে তিনি ছায়ার মত অনুসরণ করেন এবং সম্রাটের পরম বিশ্বাসভাজন ও প্রিয়তম মন্ত্রী। যদিও একমাত্র তিনিই জানতেন সম্রাটের নারী-বিরাগের প্রকৃত সত্যটি—তবু তিনিও সম্রাটের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিলেন দ্বিতীয় বিবাহের জন্য।

সম্রাট বলেছিলেন, “বিবাহযোগ্যা নারী কোথায়?”

মহামিশ্র বলেছিলেন, “ঠিক আছে। আমি একটি ব্যবস্থা করছি। আমি সমাজের অভিজাতদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি—যদি তাঁদের কোনো রূপবতী কন্যা থাকে তবে তারা এই প্রাসাদে প্রাসাদ-রমণী হিসাবে কিছুকাল বসবাস করে সম্রাটের নানান সেবার কাজে লাগুক। ভবিষ্যতে সম্রাটের নারীপ্রিয়তা যদি ফিরে আসে তবে সম্রাট তাদের মধ্য থেকেই ভবিষ্যৎ সম্রাজ্ঞীকে বেছে নেবেন। অন্যরা উপপত্নী হিসাবে ভবিষ্যতে প্রাসাদে থেকে যেতেও পারে। অথবা আপন আপন গৃহে অক্ষত-যোনী হিসাবে ফিরে যেতেও পারে। সম্রাজ্ঞী বা সম্রাটের উপপত্নী হওয়াটা শ্লাঘার বিষয়। আশা করি কোনো অভিজাত কন্যাই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হবে না—তাদের অভিভাবকরাও।”

সম্রাট তাঁর প্রিয় মহামিশ্রকে নিরাশ করতে চাননি। অশ্বঘোষ প্রমুখদের কাছে নির্দেশ চেয়েছিলেন। তাঁরাও সম্মত হয়েছিলেন সাম্রাজ্যের স্বার্থে। অতঃপর মহামিশ্র বারোজন সুন্দরীকে প্রাসাদ রমণী হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন। তারা সম্রাটের কক্ষে যাওয়ার অলিন্দ পথের দুধারের কক্ষগুলিতে বাস করে। সম্রাটের জন্য রন্ধন, ভোজন, সম্রাটের কক্ষসজ্জা, পরিধেয় সব কিছুর ওপর দৃষ্টি রাখে। সম্রাটের ভোজনের সময় তারা সারবদ্ধ ভাবে অবস্থান করে। দাসীরা তাদের আদেশে সম্রাটের পরিচর্যা করে। কিন্তু সম্রাট কারোর প্রতি এখনও পর্যন্ত কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেননি। কাউকে উৎসাহিতও করেননি। রাত্রে কোনো কাজে কাউকে তাঁর কক্ষে আহ্বানও জানাননি। তবু সম্রাটের দৃষ্টির সামনে আসার জন্য প্রাসাদ-রমণীদের মধ্যে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। সম্রাটের শয্যার শূন্যস্থান পূরণ করার বাসনায় তারা প্রায় সকলেই উদগ্র!

সম্রাট কণিষ্ক আপন মনেই শয্যার ওপর উঠে বসলেন। চোখ বন্ধ করে অমিতাভ বুদ্ধকে প্রণাম জানালেন। তারপর শয্যা থেকে নেমে ধীর পায়ে বাতায়নের কপাট খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামনেই রাজকীয় উদ্যান। আরও পেছনে কুবা নদী ছুটে চলেছে সিন্ধুনদের উদ্দেশ্যে।

সম্রাটের হঠাৎ মনে হল, কিছু বছর আগে তাঁর ধর্ম কী ছিল? তাঁর দেবতাই বা কে ছিল? কেউ না—কেউ না। তাঁর বা তাদের ধর্ম বলে কোনো বোধই ছিল না। এক বর্বর যাযাবর জাতির ধর্মবোধ কী হতে পারে? তাঁর আদি পুরুষরা বাস করতেন চৈনিক সাম্রাজ্যের কান-সু ও নিং-শিয়া প্রদেশে। স্থানটি মধ্য এশিয়ার বিস্তৃত তৃণাঞ্চল। অন্যান্য কয়েকটি যাযাবর জাতিও সেখানে সহাবস্থানে ছিল। জাতিগত পরিচয়ে তাঁরা ছিলেন ইউ-চি। বাস করতেন পশুচর্মের তাঁবুতে। পরিধেয় ছিল পশুচর্ম। ঘোড়ার পিঠেই তাদের দিন কাটত। ঘোড়ার পিঠে বসেই খাওয়া-দাওয়া! কিন্তু শান্তি ছিল না। প্রতি নিয়ত সংঘর্ষ হত অন্যান্য যাযাবর গোষ্ঠীর সঙ্গে এলাকা নিয়ে। কে কত বেশি এলাকা নিজেদের কুক্ষিগত করবে! তলোয়ারের শক্তির ওপর নির্ভর করে তাদের বেঁচে থাকতে হত।

কুবার বুক থেকে ভোরের শীতল বাতাস ছুটে আসছিল হু-হু করে। স্নিগ্ধ-মনোরম। আশ্চর্যজনক ভাবে সম্রাটের মনে পড়ে গেল দুটি নদীর কথা—শিরদরিয়া আর আমুদরিয়া বা অক্ষু নদী। চোখের সামনে ভেসে উঠল বিস্তীর্ণ সেই তৃণাঞ্চল। সম্রাটের মস্তিষ্কে জেগে উঠল ইউ-চি তথা কুষাণ জাতির ইতিহাস।

সেবার অঞ্চল দখলের লড়াইতে এগিয়ে এল হিউং-নু বা হুণ নামে এক যাযাবর গোষ্ঠী। তারা ছিল সংখ্যায় গরিষ্ঠ আর ইউ-চিদের তুলনায় আরও শক্তিশালী। ঘোরতর সংগ্রাম আর রক্তপাতের পর ইউ-চিদের নিরাপদ স্থানের জন্য পিছু হটতে হলো। ইউ-চি সমাজে সেই সময়কার এক কিংবদন্তী আজও জীবিত রয়েছে। হুণ আক্রমণে ইউ-চি দলপতি নিহত হয়। হুণ গোষ্ঠীপতি নিহত ইউ-চি নেতার মাথার খুলি দিয়ে তার পানপাত্র তৈরি করে! নৃশংসতায় অবশ্য কোনো যাযাবর গোষ্ঠীই কম ছিল না। মানুষের জীবন তাদের কাছে কীট-পতংগের মতোই ছিল। একে অন্যকে হত্যা করতে তারা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হতো না।

হুণ শক্তির কাছে তারা শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে আরও পশ্চিমে আশ্রয়ের খোঁজে এগোলেও দুর্ভাগ্য তাদের পিছু ছাড়ল না। তারা তখন তাকলামাকান বা গোবি মরুভূমির উত্তরে চলে এসেছে। পথিমধ্যে উ-সুং নামে আর এক যাযাবর গোষ্ঠী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইউ-চিরা তখন মরিয়া। তারা মরণ কামড় দিল। ঘোরতর যুদ্ধের পর উ-সুংরা পিছু হটল। তাদের রাজা মারা গেল। এরপর তারা ইসিকুল হ্রদের তীরে উপস্থিত হয়। তবু অঞ্চলটি নিরাপদ নয় মনে করে ইউ-চিরা পশ্চিমের দিকে তাদের গতি অব্যাহত রাখল। ইউ-চিদের বৃহত্তর অংশটি ইসিকুল হ্রদ ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে এগোতে থাকল। অন্যেরা দক্ষিণে নেমে এসে তিব্বতের কাছে স্থিতু হল। ইতিহাসে এরাই ছোট ইউ-চি গোষ্ঠী। ক্রমে বড় অংশটি শিরদরিয়া নদীর উপত্যকায় এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। সেই অঞ্চলে বাস করছিল ‘শক’ নামে আরও একটি দুর্ধর্ষ গোষ্ঠী। পশু থেকে মানুষ কেউই তার অধিকৃত অঞ্চল ছাড়তে চায় না। ফলে আবার তীব্র সংঘাত। রক্তপাত। মৃত্যু। তবে আশ্চর্যজনক হলেও ‘শক’রা সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারল না। তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। ইউ-চিরা অধিকার করল শিরদরিয়া উপত্যকা। শকেরা ঢুকে পড়ল ভারত তথা আফগানিস্তানের কপিশা-লমপাক-গান্ধার অঞ্চলে।

শিরদরিয়ার নদী মাতৃক প্রভাব দীর্ঘ কুড়ি বছরে ইউ-চিদের যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছিল, উপরন্তু তারা কল্পনাও করতে পারেনি যে কুড়ি বছর আগে পরাজিত উ-সুংরা তাদের প্রতিশোধের আগুন বুকে চেপে রেখে শক্তিবৃদ্ধি করেছে এবং তারা হুণদের নিয়ে আবার হানা দেবে। রক্তে শিরদরিয়ার জল লাল হয়ে উঠল—তবু ইউ-চিদের পিছু হটতে হল। কিন্তু এবার কোন নতুন ঠিকানায়? নদীমাতৃকতা তাদের রক্তে কুড়ি বছরে অনেক ছাপ ফেলেছে। তারা শুষ্ক তৃণাঞ্চল ছেড়ে কোনো শ্যামল অঞ্চলে নতুন বাসস্থান গড়ে তুলতে চায়—যেখানে পাওয়া যাবে শান্তি—গড়ে উঠবে সমৃদ্ধি। কিন্তু কোন সেই অঞ্চল? কোথায় নদীর আকারে বয়ে চলেছে বিপুল জলধারা! পিছু হটতে হটতে একদিন তারা পৌঁছে গেল অক্ষু নদীর বা আমুদরিয়া নদীর উপত্যকায়। শিরদরিয়ার স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ফিরে এল তাদের মধ্যে। অক্ষু উপত্যকাতেই তারা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেল এক স্থায়ী ঠিকানা। এখানে বাস করত তা-হিয়া নামে এক জাতি। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে যতটা দক্ষ ছিল—যুদ্ধবিদ্যায় ততটা নয়। ফলে ইউ-চিরা সহজেই তাদের পরাজিত করে সামন্তে রূপান্তরিত করল এবং অক্ষু নদীর উত্তরে নিজেদের রাজধানী স্থাপন করল সোগাদনিয়ায় (বুখারা)। নদীর পরশে তারা পরিবর্তিত হতে থাকল। সুখ শান্তিতে মোটামুটি প্রায় একশ বছর কেটে গেল অক্ষু উপত্যকায়। যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করে তারা কৃষি সমাজে পরিবর্তিত হয়েছে ততদিনে। অন্যদিকে যুদ্ধ—হানাহানি বন্ধ হয়ে যাবার পর তাদের বহুগুণ সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই তারা বিবর্ধিত হতে হতে পাঁচটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ল, হিউ-মি, কুই-সাং, হি-থুম, চুং-মো এবং কাউ-ফু অর্থাৎ কুষাণ। শক্তিশালী ছিল এই কুষাণেরা। তাদের দলপতি ওয়াং বা রাজা উপাধি নিয়ে ইউ-চিদের অন্য চারটি গোষ্ঠীকে একই পতাকাতলে নিয়ে এসে এক প্রবল শক্তি গড়ে তুললেন। ইউ-চিরা তখন বর্বর যাযাবর নয়। একশ বছরের স্থিতু শান্তিময় জীবন তাদের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে—তাদের জীবন যাত্রায় এবং চিন্তার ক্ষেত্রে। রাজ্য গড়ে তোলার এক আকাঙ্ক্ষা তাদের পেয়ে বসল।

কারোর পায়ের শব্দে কণিষ্কের চিন্তা বাধা পেল। সম্রাট মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন, পুত্র বাসিষ্ক ঘরে ঢুকছে। বাতায়ন ছেড়ে তিনি ঘরে ঢুকে পুত্রকে বললেন, “এস। বস।”

বাসিষ্ক একটি আসনে বসে প্রশ্ন করল, “রাতে সুনিদ্রা হয়েছিল কি? বাতায়নে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? কিছু ভাবছিলেন?”

কণিষ্ক হেসে বললেন, “তেমন কিছু নয়। একটু অপেক্ষা কর। শৌচাগার থেকে ফিরে এসে বলছি।” কক্ষ সংলগ্ন শৌচাগারে ঢুকে গেলেন সম্রাট। সামান্য পরে ফিরে এসে পুত্রের মুখোমুখি বসলেন। বললেন, “হ্যাঁ। হঠাৎ জানি না কেন আমার আমাদের জাতির উত্থানের ইতিবৃত্ত মনে পড়ে গেল। নিজেদের ইতিহাস না জানলে, তার থেকে শিক্ষা না নিলে কোনো জাতিই বড় হয়ে উঠতে পারে না।” বাসিষ্ক বিনয়ের সঙ্গে বলল, “সে তো সত্য কথা।”

“তুমি পাঠ করেছ কি আমাদের জাতির ইতিবৃত্ত? যদিও আমরা এখন অংশত ভারতীয়। তবু পূর্বকথা ভুললে তো চলবে না। বিশেষত তোমরা এখন নবীন। তোমাদের বিশেষ করে জানতে হবে। আচ্ছা বলত, আমাদের জাতির প্রথম প্রাণপুরুষ কে?”

“কেন। সম্রাট প্রথম কুজুল কদফিস!”

“ঠিক। কী আশ্চর্য ক্ষমতা, অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা ছিল মানুষটির মধ্যে! তিনি অন্য গোষ্ঠীগুলিকে নিজের অধিকারে এনে পার্থিয়ার পহ্লবদের পরাজিত করলেন। এরপর তার অধিকারে এল কাবুল উপত্যকা। কাবুল উপত্যকায় ছিল যবনদের রাজত্ব। পহ্লবেরা কাবুল অধিকার করে নেবার পরেই কদফিস পহ্লবদের হাত থেকে ঐ উপত্যকা কেড়ে নেন এবং পহ্লবদের দূর করেন। আশি বছরের পর তিনি মারা গেলে পুত্র দ্বিতীয় কদফিস ওয়াং বা রাজা হলেন। তক্ষশিলা জয় করলেন। পরে পহ্লবদের ও শকদের পরাজিত করে সিন্ধুদেশ জয় করে ভারত ও বহির্ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর সাম্রাজ্য পারস্যের সীমান্ত থেকে সিন্ধু ও বিতস্তা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তক্ষশিলাও তার সাম্রাজ্যের ভিতর ছিল।”

বাসিষ্ক বললেন, “বাবা, আপনার কৃতিত্বও তো কম নয়। আপনি পামির আর তিব্বতের মাঝে খোটান থেকে ভারতে ঢুকে কশ্যপপুরা (কাশ্মীর) থেকে বারাণসী পর্যন্ত এক সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় কদফিসের মৃত্যু হলে ছোট ইউ-চিদের ছোট কুষাণ শাখার প্রতিনিধি হিসাবে সমগ্র কুষাণ সাম্রাজ্যের অধিকারী হলেন। অক্ষু নদীর উত্তরে রাজধানী তা-হিয়ায় আপনার প্রতিনিধিই রাজ্যশাসন করছে। আপনিই এই বিস্তৃত ভূভাগের সম্রাট।”

কণিষ্ক হেসে বললেন, “পুত্র! এই বিশাল সাম্রাজ্য ভবিষ্যতে তোমাকেই পরিচালনা করতে হবে। তাই, আমার ভারতীয় সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ যদিও শাসন করছে মহাক্ষত্রপ খারপল্লান এবং ক্ষত্রপ বনস্পর। তবুও আমি তোমাকে তাদের মাথার ওপর রেখেছি। কারণ, তুমি নবীন। তোমার শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। এমনিতেই মথুরা ইত্যাদি স্থানে পরাজিত শক ও নাগবংশীয়দের নিয়ে অশান্তি রয়েছে। পাটলিপুত্রের অবশিষ্ট শুঙ্গরাও যথেষ্ট বিপজ্জনক। সুতরাং, সম্রাটের হয়ে তোমাকে সেখানে প্রতিনিয়ত দৃষ্টি রাখতে হবে।”

বাসিষ্ক বলল, “তা আমি রাখছি। আমি গুপ্তচর বিভাগকে নতুন করে গড়ে তুলেছি। পূর্বাঞ্চলের সামাজিক ও সংস্কৃতির জগতেও আমি জড়িয়ে পড়েছি। সেখানে অর্থাৎ মথুরাকে কেন্দ্র করে এক নতুন শিল্পকলাকেও প্রোৎসাহিত করছি। মথুরার নতুন কলার শিল্পীরা আপনার একটি মূর্তি তৈরি করছে। সঙ্গে সঙ্গে ভূতপূর্ব সম্রাটেরও একটি পূর্ণায়ব তৈরি হচ্ছে।”

সম্রাট বললেন, “সাম্রাজ্যের দুই প্রান্তে গড়ে উঠুক দুই শিল্পকলা, গ্রীক-রোমক-ভারতীয় মিলে গান্ধারে গান্ধার শিল্প, আর মথুরায় মৌর্য-শুঙ্গ ও আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলা মিলে বেড়ে উঠুক মথুরার শিল্পকলা।”

বাসিষ্ক বলল, “দু’টি ক্ষেত্রেই আপনাকে পৃষ্ঠপোষক বলে ইতিহাস স্বীকার করবে।”

কণিষ্ক বললেন, “থাক ওসব কথা। বল, সকালেই কেন তুমি দেখা করতে এসেছো? কিছু বিশেষ প্রয়োজন আছে কি?”

বাসিষ্ক বলল, “গতকাল বিকালে আমি আপনার মহাবিহারের নির্মাণ কাজ দেখতে গিয়েছিলাম। এতো বিশাল আয়োজন! সারা ভারতভূমিতে এমন সুউচ্চ স্তুপ আছে বলে তো মনে হয় না। মহাবিহারও মহা-ই! যবন এজিসিলাওস অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে সব কিছু নির্মাণ করেছে। মুগ্ধ হলাম গান্ধার শিল্পকলার নমুনা দেখে। গান্ধার শিল্পীরা বিহার এবং চৈত্যের গায়ে জাতকের উপাখ্যান কোথাও অঙ্কন করেছে—কোথাও বা খোদাই করেছে! অপূর্ব!”

“আরও অনেক কিছু নির্মাণ বাকি আছে। যেমন বুদ্ধের পবিত্র চিহ্নগুলি যে পেটিকায় ভরে স্তুপে প্রোথিত করা হবে সেটির নির্মাণ এখনও বাকি।”

“বাবা!”

“বল।”

“যত কাজই থাকুক না কেন—আর দুমাস! অজস্র শিল্পী-শ্রমিক যেখানে কাজে ব্যস্ত।”

“তা থাকুক। কিন্তু তুমি কি চাইছ?”

“আমি মহাবিহারের উদ্বোধন পর্যন্ত এখানে থেকে যেতে চাই।”

“এখানে……থাকবে বলছ?” চিন্তান্বিত দেখাল কণিষ্ককে।—”কিন্তু!” কণিষ্কের কথা শেষ হলো না। দেখা গেল দ্বারদেশে থেকে মহামিশ্র বলছেন, “সম্রাটের জয় হোক!”

“মহামিশ্র! তুমিও এই প্রভাতে!”

“সম্রাট! একটি গুরুতর সংবাদ রয়েছে। তাই—।”

“কী সেই সংবাদ?”

মহামিশ্র কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “কুমারও রয়েছেন। ভালই হল। গুপ্তচর প্রধান নীলাকার একটি গুরুতর সংবাদ জানিয়েছেন। মথুরায় শক আর নাগেরা মিলে একটি অশান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ খুঁজছে। কুমারের উচিত হবে অবিলম্বে ফিরে যাওয়া।”

সম্রাট হেসে বললেন, “কুমার যে উদ্বোধনের দিন পর্যন্ত এখানে থাকতে চাইছিল।”

শুষ্ক হয়ে গেল বাসিষ্কের মুখ।—”আমার কপালে নেই। বুদ্ধ হয়ত চান না, আমি উদ্বোধনে উপস্থিত থাকি।”

কণিষ্ক বললেন, “সেটা সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য। আমি আমার সক্ষম পুত্র থাকতে মহাক্ষত্রপ খারপল্লান আর ক্ষত্রপ বনস্পরের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না।”

বাসিষ্ক বলল, “সম্রাটের আদেশ মান্য করা হবে। তবে আমাকে আগামীকাল প্রাতে যাত্রা করার অনুমতি দিন। পুরুষপুর আমার জন্মভূমি। মায়ের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর আমি এখানে এলাম। মায়ের স্মৃতি! আজ আমি সারা পুরুষপুর, পুরুষপুরের বাইরের অঞ্চল দেখে বেড়াব। অনেক পুরোন দিনের কথা সেখানে জড়িয়ে আছে।”

মৃত স্ত্রীর প্রসঙ্গ উঠতেই সম্রাট একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “সে তোমার ইচ্ছা। আমি অনুমোদন করলাম। কাল প্রাতেই তুমি যাত্রা কর। কোনো অসুবিধে আছে কি, মহামিশ্র?”

মহামিশ্র বললেন, “না। কুমার স্বচ্ছন্দে কালই যাত্রা করুন।”

বাসিষ্ক আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তবে আজ্ঞা দিন, আমি আমার কাজে যাই।”

“এস!”

বাসিষ্ক চলে যেতে কণিষ্ক মহামিশ্রকে বললেন, “কেমন দেখছ বাসিষ্ককে? আমার দায়িত্ব সে নিতে পারবে তো?”

মহামিশ্র হেসে বললেন, “নিশ্চয় পারবে। তবে অনেক দূরের ব্যাপার। ততদিনে কুমার আরও পরিপক্ক হয়ে উঠবেন। আপনি তো মাত্র মধ্য চল্লিশ। মনে করুন, সম্রাট প্রথম কুজল কদফিস কতদিন বেঁচে ছিলেন!”

সম্রাট হঠাৎই বললেন, “তা অবশ্য। তবে অত আয়ু আমার হবে না। যতদিন বাঁচব—ততদিনই ব্যাধি এবং নানা রকমের যন্ত্রণা সহ্য করা। বুদ্ধ তার অনেক আগেই আমাকে নির্বাণের পথে নিয়ে যাবেন।” সম্রাট করজোড়ে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকালেন।

মহামিশ্র বললেন, “সম্রাট! আমি কামনা করি, আপনি বহুকাল জীবিত থাকুন। এই ভারতবর্ষ এক সর্বজাতির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠুক।”

সম্রাট বললেন, “ঠিক আছে। তোমার কামনা তুমি কর, এখন বল আজ রাজসভায় বিশেষ বিশেষ কাজ কী কী আছে?”

মহামিশ্র বললেন, “রোম সম্রাট ট্রোজানের দূত এসেছে। তারা মূলত রোম, খোটান, কাশগড়, ইয়ারকন্দ হয়ে চিন পর্যন্ত যে রেশম পথ রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করবেন। যেখানে শুল্ক বিষয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে নিম্ন-সিন্ধুর বন্দরগুলি থেকে যেসব পণ্য অর্থাৎ মসলিন, মশলা, নানান ধাতু প্রভৃতি রোমের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়—সেখানেও অধীনস্ত শক-পহ্লবেরা কিছু সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। কাথিয়াবাড়, সৌরাষ্ট্রেও এই সমস্যা। সেখানকার প্রতিনিধরাও এসেছেন।”

সম্রাট বললেন, “কুষাণ সাম্রাজ্যের ধনলক্ষ্মী এসব স্থানে জড়িয়ে আছেন। আজ রপ্তানীর জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর স্বর্ণ এদেশে ঢুকছে। রেশমপথের অধিকারের ফলেও কুষাণ সাম্রাজ্য আজ ধনাঢ্য। সুতরাং এগুলি গুরুতর বিষয়। মহামিশ্র তুমি আমার প্রাতরাশের আয়োজন কর। দাসীদের বল, আমার স্নানঘর প্রস্তুত করতে। তুমিও প্রস্তুত হয়ে নাও। সভায় যাবার সময় হয়ে এল।”

মহামিশ্র বললেন, “যথা আজ্ঞা, সম্রাট। আমি সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছি। আপনার প্রাতরাশ নিয়ে প্রাসাদ-রমণীরা প্রস্তুত। আপনি স্নান সেরে পোশাক পরিবর্তন করে নিলেই তারা উপস্থিত হবে।”

সম্রাট যেন একটু বিরক্ত হয়ে অনুযোগ করলেন, “মহামিশ্র! তুমি কেন এই প্রাসাদ-রমণীদের আবর্তে আমায় ফেললে! অপেক্ষা করতে করতে ওদের যৌবন একদিন শেষ হয়ে যাবে। সংসার-জীবনে আমি আর ফিরব না।”

মহামিশ্র বললেন, “প্রজাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি প্রার্থনা করছি- এ সুযোগ আমাকে দিন, সম্রাট! আমরা কোনো প্রাসাদ-রমণীকে বন্দী করে রাখিনি। স্বইচ্ছায়—স্বজ্ঞানে তারা এসেছে। প্রয়োজন হলে তারা চলে যেতেও পারে। কেউ তাদের বাধা দেবে না।”

সম্রাট বললেন, “বেশ। নিজেদের কর্মফল তারা ভোগ করুক, আমার কী!”

কক্ষ ত্যাগ করতে করতে মহামিশ্র মনে মনে বললেন, তাঁর সঙ্গে সম্রাটের সম্পর্কটা অনেকটা গভীর বন্ধুত্বের পর্যায়ে। সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর পর সেই সম্পর্ক আরও ঘনীভূত হয়েছে। ফলত, তিনি যেমন সম্রাটের কাছে স্বচ্ছন্দ—এ সাম্রাজ্যে অন্য তেমন কেউ নেই। সম্রাট জানেন, মহামিশ্র নির্লোভ। নিজের জন্য কিছু প্রার্থনা করেন না। তিনি ঐকান্তিক এবং প্রগাঢ় সম্রাটসেবী। সম্রাট বৌদ্ধ—তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মী। তবু বিবাদ কোথাও নেই।

অধ্যায় ১ / ২০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন