ছিন্নপত্র-১

প্রখরতা হারিয়ে আলো এখন শান্ত হয়ে এসেছে। শরীর সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের। কানে কম শোনেন। চোখের দৃষ্টি আবছা। কালিম্পং থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ফিরেছেন কিছু কাল হল। সমগ্র দেশ তাঁর সুস্থতা প্রার্থনা করছে। মূত্রযন্ত্রের গোলমালটা ক্রমশ জটিল। বিধানচন্দ্র রায়ের মতো স্বনামধন্য চিকিৎসকদের মত, অস্ত্রোপচার করতেই হবে। বিশ্বকবির আরও কিছু দিন বেঁচে থাকা দরকার জাতির প্রয়োজনেই। গোটা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধান্ধ আবহাওয়া। ভারতবর্ষেও স্বাধীনতার লড়াই বিচিত্র আকার ধারণ করেছে। এই সন্ধিক্ষণে সর্বজনমান্য কবিগুরুর মৃত্যু-সম্ভাবনা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। কালিম্পং থেকে অসুস্থ হয়ে কলকাতায় ফিরবার পর; জোড়াসাঁকোয় কবির রোগশয্যার পাশে গাঁধীজির চিঠি নিয়ে মহাদেব দেশাই উপস্থিত হন। স্বয়ং গাঁধীজির প্রার্থনা—“প্রিয় গুরুদেব, আপনাকে এখনও কিছু কাল বাঁচিতেই হইবে। বিশ্বমানবের জন্য আপনার প্রয়োজন।” চিনের প্রেসিডেন্ট-পত্নী মাদাম চিয়াং কাইশেক, নেহরুজি, উদয়শঙ্কর, লর্ড বিশপ, অসগড়ের রাজা, সেরগুজার মহারাজা, নেপালের মহারাজা, বাংলার গভর্নর—মান্যগণ্যদের মধ্যে কে ব্যাকুল হননি? সকলেই চান রবীন্দ্রনাথের আরোগ্য। কিছুটা ভাল তিনি ইতিমধ্যে হয়েছেনও। কিন্তু কবি যে কিছুতেই অস্ত্রোপচারে সম্মতি দিচ্ছেন না। জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে তিনি উদয়নে উঠেছেন। রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমা দেবী পাশেই থাকেন। নিরন্তর পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যার কারণেই তাঁকে এখানে নিয়ে আসা। অগণিত মানুষের ভিড় থেকে তাঁকে আড়াল করে রাখাও উদ্দেশ্য। কারণ চিকিৎসকরা মনে করেছেন, সামান্য উত্তেজনাও কবিকে ফের কাহিল করে ফেলবে। রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি অনিল চন্দ বিবৃতি প্রকাশ করতে বাধ্য হন—“…গুরুদেব আশ্রমে ফিরিবার নিমিত্ত অত্যধিক আগ্রহ প্রকাশ করায় এবং শান্তিনিকেতনের মনোরম পরিবেষ্টনী এবং সুখপ্রদ আবহাওয়া তাহার স্বাস্থ্যলাভের অনুকূল হইবে—চিকিৎসকগণ এইরূপ অভিমত প্রকাশ করায় তাঁহাকে এখানে আনা হইয়াছে। তিনি এখনও ঘরের বাহির হন না এবং বর্তমানে তাঁহার নিয়মিত চিকিৎসা চলিতেছে। তিনি আগন্তুকগণের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিতে অথবা নিজে চিঠিপত্রের উত্তর দিতে সক্ষম নহেন। সুতরাং বন্ধুগণকে অনুরোধ করিতেছি, তাঁহারা যেন কবিগুরুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত শান্তিনিকেতন না আসেন অথবা উত্তর পাইবার আশা করিয়া তাঁহার নিকট কোন পত্র না লেখেন।”

শরৎকালে শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ফিরলেন যখন, ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে। বোলপুরে শীতের প্রকোপ কলকাতার থেকে বেশি। গৃহবন্দি কবির সৃজন কিন্তু থামেনি। ‘রোগশয্যা’র কবিতাগুলি এই সময়েই রচিত। কিছু জোড়াসাঁকোয় থাকাকালীন লিখেছেন, বাকিগুলি লিখলেন শান্তিনিকেতনে ফিরে। উৎসর্গ করলেন নন্দিতা ও অমিতাকে। রবীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে মীরাদেবীর মেয়ে এই নন্দিতা কৃপালনি। অমিতা ঠাকুরবাড়ির বউ, অজিতকুমার চক্রবর্তীর মেয়ে। এঁরা গুরুতর অসুস্থ কবির নিরলস সেবিকা। তাঁকে দিনরাত দেখভাল করছেন আরও সব ভক্ত মানুষ— অনিল চন্দ, রানী চন্দ, সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, সুরেন কর, রানী মহলানবিশ, মৈত্রেয়ী সেন, বিশ্বরূপ বসুরা। সবাই অবাক হয়ে দেখেছেন, যাঁর জন্য দেশবাসী উদ্বিগ্ন, তিনি কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না রোগযন্ত্রণা তাঁকে কেমন কষ্ট দিচ্ছে। বরং নিজেই ক্লান্ত গলায় হাসি-ঠাট্টা করছেন। আসলে রবীন্দ্রনাথ কারও সেবা গ্রহণ করতে সংকোচ বোধ করতেন। কিন্তু এখন তো তাঁর কিছু করার নেই। অসহায় ভাবেই তাঁকে সব মেনে নিতে হচ্ছে। ফলত, হাস্য-পরিহাস চালিয়ে নিজেকে চাপমুক্ত রাখতে চাইতেন তিনি। এমনকী বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। অস্তাচলকেও দেখতে পাচ্ছেন মানসচক্ষে। বলছেন, “মন ক্লান্ত হয়ে গেছে রে। এবার বিদায় নিলেই হয়।”

শুনে শিউরে উঠছেন ভক্তরা। প্রবল আপত্তি করছেন। এভাবেই শীতকাল কেটে গেল। বসন্ত-সম্ভবা হয়ে উঠছে শান্তিনিকেতন আশ্রম। এখন কিছুটা ভাল তিনি। কেদারায় বসে, বিছানায় শুয়ে বিচিত্র ভাবনা নিয়ে দিন কাটছে তাঁর। জীবনের শেষ সাতই পৌষ ঘরের বাইরে যেতে পারেননি। সাতই পৌষের ভাষণটি মুখে বলেন, লিখে নেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। ‘আরোগ্য’ নামের সেই বক্তব্যে বলেছিলেন, “আজ আমি রোগের দশা অতিক্রম করছি বলেই আরোগ্য কাকে বলে সেটা বিশেষ ভাবে অনুভব করি…”। জীবনের প্রতিটি পর্বকেই তিনি অর্থময়, ব্যঞ্জনাময় হিসেবে দেখেছেন। শেষ বয়সের অসুস্থতাকেও দার্শনিক দিক থেকে দেখছেন, ছোট কবিতায় লিখলেন, “…হেরি আমি আপন আত্মারে মৃত্যুর অতীত।” বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ একই সময়ে তাঁকে ছিন্নভিন্ন করছে। মানুষ মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করছে, এ যেন তিনি মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই! স্নেহভাজন কবি অমিয় চক্রবর্তীকে বললেন বিষণ্ণ কণ্ঠে, “একদল মানুষ ভয়ংকর পশুর মতো হয়ে উঠেছে যেমন, তেমনই আর-একদল মানুষ কিন্তু তীব্র দুঃখকে অনুভব করছে অন্তরে, তারা মেনে নিতে পারছে না এই সর্বনেশে যুদ্ধ।” অমিয় সায় দিয়ে বললেন, “ঠিকই বলেছেন। বেশির ভাগ মানুষই চায় এই রক্তারক্তি এখনই বন্ধ হোক। ক্ষমতার লড়াইয়ে ধ্বংস হচ্ছে আমাদের সভ্যতাই।”

কিছুক্ষণ যেন ধ্যানস্থ বসে রইলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর গভীর স্বরে বললেন, ‘দ্যাখো, এই যে তোমার মনে বেদনার জন্ম হল, এই যে আমি ব্যথা অনুভব করছি, এর কারণ কী জানো?”

অমিয় বললেন, “ধ্বংস কে চায়, গুরুদেব?”

রবীন্দ্রনাথ বললেন, “সে-প্রার্থনা কখনওই কাম্য হতে পারে না। আমি বলতে চাইছিলুম, আমাদের মনে কেন প্রতিবাদ উঁকি মারছে? কেন বেদনায় দীর্ণ হচ্ছি আমরা?”

অমিয় খানিক চিন্তা করে উত্তর দিলেন, “মানুষ সভ্যতা গড়েছে অস্তিত্বের স্বার্থে। গোষ্ঠীযুদ্ধে তাকেই বিপন্ন করছে আজ! এ তো মূর্খতার নামান্তর।”

বহু দূর থেকে যেন উঠে এল এবার কবিগুরুর কণ্ঠ-নিঃসৃত ধ্বনি, “আমি অনুভব করে চলেছি অনেক কাল ধরেই, একটা বিরাট মানব-সত্তা আছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে জুড়ে, যে-সত্তার মধ্যে কেবলই চলেছে একটা ভাল-র তপস্যা।”

মনে মনে চমকে উঠলেন অমিয়। তিনি আধুনিক সময়ের কবি। আধুনিকতা সব সময়েই পুরোনো চিন্তাকে সন্দেহ দিয়ে পরীক্ষা করে, পুরোনো ভাষাকে সময়-ভারাক্রান্ত মনে করে। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ তিনি, রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে, কিন্তু নিজে কবিতা রচনার সময় টের পান নতুন দিনের ভাষাকে, মেজাজকে। এই নিয়ে বিশ্বকবির সঙ্গে তাঁর খোলাখুলি চিন্তা-বিনিময়ও হয়। কিন্তু কী মানুষ এই রবীন্দ্রনাথ! দীর্ঘ কবিজীবন যাপনের পরেও তিনি কাব্যভাষা নিয়ে নিয়ত সন্ধানী। উপনিষদ-বাহিত কথাই বলছেন এখন। কিন্তু এ কী আধুনিক শব্দ-ব্যবহার! ‘ভাল-র তপস্যা’! মনে মনে গুরুদেবের পদচুম্বন করলেন অমিয়। আবেগ-বিহ্বল কণ্ঠে অমিয় বললেন, “অপূর্ব কথা বললেন। ভাল-র তপস্যা।”

রবীন্দ্রনাথ নির্বিকার। একই ঘোরে থেমে থেমে বলে চললেন, “মনে রেখো, সবার অন্তরেই ভাল-র জন্য একটা তাগিদ আছে, অকল্যাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে—এ এক পরম সত্য। এত কাল ধরে যে নিরন্তর জন্মপ্রবাহ বিরাট মানবসত্তা তৈরি করেছে, অনন্তকালের সেই ভাল-র তপস্যার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে আজকের মানুষও। এক জন্ম আর-এক জন্মের কাঁধে হাত রেখে তৈরি করেছে ঐক্য। অনুভব করতে পারছ?”

বিস্ময়াভিভূত অমিয় যুগ-যুগান্ত ধরে অবিচ্ছিন্ন মানবজন্মের ঐক্য দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন যেন সত্যিই। গাঢ় স্বরে বললেন, “হ্যাঁ, গুরুদেব।”

গুরুদেব বললেন, “এই ঐক্যের ভিতর দিয়ে যে-মানুষ সেই বিরাট মানবসত্তার পরম লক্ষ্যকে টের পায় না, সেই দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় না নিজের জীবন, সে ঝরে যায় অগুনতি আমের মুকুলের মতো। তাদের কোনও স্বীকৃতি নেই। ফলের পূর্ণতায় তারা পৌঁছতে পারবে না কোনও দিন। এই হল পরম জীবনসত্য।”

একটানা অনেক কথা বলে যেন হাঁফিয়ে পড়েছেন, রবীন্দ্রনাথ শরীর এলিয়ে দিলেন। জাপানি ঘরের গোল জানলার পাশে লম্বা আরামকেদারায় বসে আছেন তিনি। দুপুরবেলা। দূর থেকে এক নিঃসঙ্গ পাখির ডাক ভেসে আসছে। রানী এসে ঘরে ঢুকলেন। ইনি অনিল চন্দের স্ত্রী। রবীন্দ্রনাথের নিকটজন। অসুস্থ গুরুদেবের প্রতি তাঁর সর্বক্ষণের নজর। ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়াতে হয়। কখনও বা কলমটা এগিয়ে দেন, খাতাটা এনে দেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সহজ! রানী ঘরে থাকলেও কবির চিন্তার বা সৃষ্টির কোনও ব্যাঘাত ঘটে না।

রানী ঘরে ঢুকে দেখলেন গুরুদেব চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। অমিয় চক্রবর্তী চুপচাপ দূরে আনমনা চেয়ে আছেন। রানীর উপস্থিতি টের পেয়ে অমিয় তাঁর দিকে ফিরে মৃদু হাসলেন। রানী ইশারায় জানতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ ঘুমোচ্ছেন কি না। সব সময়ই সতর্ক থাকতে হয় শুশ্রূষাকারিণীদের। কারণ রবীন্দ্রনাথ সেবা নিতে কুণ্ঠিতবোধ করেন। তাঁর এই কুণ্ঠা সম্পর্কে রানী অবহিত। চেষ্টা করেন যাতে গুরুদেব টের না পান, তাঁর ওপর প্রখর নজর রাখা হচ্ছে। এবারের অসুস্থতায় অপারেশনের প্রসঙ্গ উঠছে বার বার, রবীন্দ্রনাথ বিমর্ষ হয়ে গিয়েছেন। মাঝে একদিন এরকম দুপুরে রানীকে বলেছেন, “দ্যাখ, আমার জন্য তোদের কত সময় নষ্ট হচ্ছে, এটা আমার একদম পছন্দ হয় না। এখন তো আমি বেশ ভাল হয়ে গেছি। নিজেদের কাজে মন দে এবার।”

রানী মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, “আপনার চরণে ঠাঁই পেয়েই তো জীবন ধন্য হয়ে গেছে, গুরুদেব। আমি সাধারণ মেয়ে। আর কী পারব?”

অল্প ধমকের সুরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ওটা কোনও কাজের কথা নয়। বই পড়, না হয় কিছু লেখ।”

গুরুদেবের পায়ে হাত রেখে রানী বলেছেন, “পরের জন্মের জন্য আশীর্বাদ করুন। এই জন্মে আর পারব না যে।”

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নাছোড়। রানী যখন ছবি আঁকতে পারে, লিখতেও পারবে। বলেছিলেন, “চেষ্টা করেই দ্যাখ না। তুই লেখ রানী, যা হোক কিছু একটা লেখ। কত কিছুর সাক্ষী থাকিস তুই। কবিতা না লিখলে সেই সব লিখে রাখ। সময় নষ্ট করিস নে আর।”

রবীন্দ্রনাথের মরিয়া স্বরের মধ্যে যেন কোনও নির্দেশ খুঁজে পেয়েছিলেন সেদিন রানী। আর ‘না’ বলার ক্ষমতা তাঁর নেই। কালিম্পং থেকে অসুস্থ হয়ে গুরুদেব প্রথমে জোড়াসাঁকোয় ছিলেন বেশ কিছু দিন। সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ রোজ সকালে-বিকেলে পাশের বাড়ি থেকে এ-বাড়ি আসতেন রবিকাকার খোঁজ নিতে। আসতেন, কিন্তু কবির ঘরে কবিকে দেখতে যেতেন না। কেউ উদ্যোগ নিলে বলতেন, “রুগ্‌ণ সিংহ বিছানায় পড়ে আছে, সেই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারব না।” সেরকমই একদিন স্মৃতিকাতর অবনীন্দ্রনাথ বিচিত্রা হল-এ বসে প্রচুর কথা বলেছিলেন রানীকে। সেদিন যেন পাথর সরিয়ে এক অপূর্ব ঝরনা ছুটে এসেছিল রানীর সামনে। অভিভূত রানী নিজের সৌভাগ্যের কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন কেবলই। বিদায় নেবার সময় অবনীন্দ্রনাথ ঘুরে রানীকে বলেছিলেন, “রানী, কত কথা এসে গেল আজ। অনেকে জিজ্ঞেস করে, কাউকে বলতে পারিনি কিছু। এই সব কথা তুমি নষ্ট কোরো না কিন্তু। ধরে রেখো।” তখন রানীর রাত-প্রহরা চলছে রবীন্দ্রনাথের ঘরে। মৃদু কেরোসিনের লণ্ঠনের আলোয় পর পর রাত জেগে লিখে রাখলেন সব। যেমন-যেমন বলেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, হুবহু সেই সব। রানী তো আর লেখক না, কিন্তু তাঁর ভাবনা ছিল, এই নোট অবলম্বনে কোনও লেখক একটা ভাল লেখা তৈরি করে দিতে পারবে। এখন রবীন্দ্রনাথের পুনঃপুন তাড়া খেয়ে অনতি-অতীতের কাণ্ডখানা মনে পড়ল রানীর। সলজ্জ কণ্ঠে তিনি গুরুদেবকে বললেন, “লিখতে তো জানি না আমি। তবে আপনার অসুখের সময় অবনীন্দ্রনাথ অনেক কথা বলেছিলেন একদিন, তা নোট করে রেখেছি আমি। যদি আপনি দেখিয়ে দেন, তাহলে আমি একটা লেখা তৈরি করতে পারি।” রবীন্দ্রনাথকে এখন পাতাঝরা গাছের মতো দেখায়। প্রকৃতির নিয়মে ক্ষয় নেমেছে সর্বাঙ্গে। কিন্তু চোখ দু’টি একইরকম উজ্জ্বল আজও। এই বিদায়বেলাতেও। রানীর কথা শুনে সেই চোখে বিদ্যুৎ-চমক এল মুহূর্তে। নড়েচড়ে বসে বললেন, “তোর কাছে আছে লেখাগুলি?”

রানী মাথা নাড়লেন। রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “নিয়ে আয়। নিয়ে আয়।”

রানী থাকেন কোনার্ক-এ। উদয়নের পাশেই সেই ডেরা। এক দৌড়ে তিনি নিয়ে এলেন কাগজপত্র। ছিনিয়ে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গোগ্রাসে পড়তে লাগলেন। এখন শরীর আর দেয় না। মৃদু উত্তেজনাও সইতে পারে না। দু-চার পাতা পড়বার পরিশ্রমেই তিনি ঘেমে উঠলেন। রানী ভয় পেলেন। ভাবলেন, বারণ করবেন গুরুদেবকে। কিন্তু গুরুদেব যেন অবনীন্দ্রনাথের কথার মধ্যে ডুবে গিয়েছেন। হয়তো লেখায় ধরে রাখা সময়ের মধ্যেও। ঝরঝর করে সব পড়ে ফেললেন তিনি। মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। রানীকে বললেন, “অপূর্ব। যেন অবন বলে যাচ্ছে, আমি শুনতে পাচ্ছি। শোন রানী, তুই অবনের কাছ থেকে আরও গল্প আদায় করে নে। ও তো আর নিজে লিখবার ছেলে নয়। একটুও দেরি করিস না। দাঁড়া, চিঠি লিখে দিচ্ছি।” লেখার কাগজের একপাশেই রবীন্দ্রনাথ কাঁপা কাঁপা হাতে লিখে দিলেন— “অবন, কোমর বেঁধে বসে লিখবার ছেলে তুমি নও। এ জিনিস তুমি ছাড়া আর কারো মুখে হবে না, রানীকে তুমি এমনিতরো আরো গল্প দাও।”

সেদিনেই রবীন্দ্রনাথের তাড়া শেষ হল না। কিছু দিন পরেই রানীকে তিনি কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠি পেয়ে অবনীন্দ্রনাথ খুব খুশি। টুকরো কাগজটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েই লাফিয়ে উঠলেন, “এ চিঠি আমার, রানী! এ যে রবিকা আমায় লিখেছেন—এ আমার চিঠি!” সাত দিন ধরে নানা গল্প অবনীন্দ্রনাথের মুখ থেকে শুনে লিখে নিয়েছিলেন রানী। তারপর শান্তিনিকেতনে ফিরে রবীন্দ্রনাথকে দিলেন। যেন এমন অপেক্ষাতেই ছিলেন গুরুদেব। পড়তে পড়তে গুরুদেব কখনও হাসছেন, কখনও-বা চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে—সে এক দৃশ্য। যে জীবন ফেলে এসেছেন তিনি, তাঁকে শেষ বেলায় ফিরে দেখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ আবেগে ভেসে যাচ্ছেন। তাঁর নির্বিকার ভাবটি একটু সময়ের জন্য যে বদলে গেল, তাতেই তো প্রকাশিত হয় তিনিও রক্তমাংসের মানুষ। সাধারণ মানুষ তাঁকে দেবতা ভেবেছে। র-বী-ন্দ্র-না-থ— এই ভাবমূর্তির আড়ালে একলা বাঁচে যে ক্ষত-বিক্ষত বাউল মানুষটি, তাঁকে যে নিয়ত কত মূল্য দিতে হয়েছে, তা উপলব্ধি করেছে ক’জন আর ভক্ত? ফলত, রানী এই প্রথম গুরুদেবের চোখে জল দেখে বাক্যহারা। প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথ একটু একটু পড়েন অবনীন্দ্রনাথের মুখে বলা গল্পগুলি, আর উদাস চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। অতীতে তলিয়ে যায় তাঁর মন। রবীন্দ্রনাথ, নিজের অবসানের সময় উপস্থিত, এ সত্য বুঝতে পেরেছেন। যাবার আগে এ যেন তাই এক লহমা নিজেকে ফিরে-দেখা। এমনই একদিন লেখাটি পড়ে রানীকে বললেন, “দ্যাখ রানী, এক-একটা যুগের এক-একটা মনোবৃত্তি ধরা পড়ে। আমাদের সেই স্বদেশী যুগে চারদিকে কী একটা উন্মত্ততা…বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন…কত গান…রাখী…হাজার হাজার মানুষ। পি এন বোস বলতেন— রবিবাবু, এ যে হল, হয়ে গেল—মানে দেশোদ্ধার হয়ে গেল! সেই যুগ চলে গেল। উন্মত্ততাও কেটে গেল তাড়াতাড়ি। তারপর শান্তিনিকেতনে চলে এলুম। খোড়ো ঘর, আসবাবপত্র কোথায় পাব? গরিবের মতো বাস করতে লাগলুম। …সবাই মনে করে চিরকাল বাবুয়ানি করেই কাটিয়েছি। কিন্তু কীসের ভিতর দিয়ে যে আমাকে আসতে হয়েছে…সেই অসামান্য আগুন…ক’জন জানে? অবন এই সব গল্পে সেই সব দিনের আমাকেই তুলে ধরেছে। …রথীকে ডাক দিকি একবার!”

রানী গিয়ে রথীন্দ্রনাথকে ডেকে আনলেন। রথীন্দ্রনাথ এসে পিছনে দাঁড়াতেই লেখার কাগজগুলি তাঁকে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, “প্রেসে দাও।”

রথীন্দ্রনাথ লেখাগুলো নিয়ে চলে গেলেন। কত কী ভাবনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ জানলার বাইরে চেয়ে রইলেন। নিজেকে পরিমাপ করা কঠিন। তবু তো একটা আবছা হিসাব আসে মনে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য আত্মত্রুটি বিশ্লেষণে অভ্যস্ত ছিলেন বরাবর। আত্মত্ৰুটিবোধ থাকলেই আত্মসংশোধন সম্ভব। শেষ দিকের কবিতায় বার বার প্রকাশ করেছেন নিজের অক্ষমতাকে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবির স্বীকৃতি পেয়েও রুগ্‌ণ স্বাস্থ্য নিয়ে জীবনের শেষ শীতঋতুতে লিখলেন—“আমার কবিতা, জানি আমি,/ গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।/ …যে আছে মাটির কাছাকাছি। সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।” ভবিষ্যৎকে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছেন।

শেষ সময় সমাসন্ন উপলব্ধি করেই যেন কবি বিচিত্র রচনাকার্যে মেতেছেন। শরীরের এইরকম পরিস্থিতিতে তা কী করে সম্ভব হচ্ছে বোঝা ভার। ‘জন্মদিনে’ এবং ‘আরোগ্য’ পর্যায়ের কবিতা তো লিখেছেনই, সেই সঙ্গে হাত দিয়েছেন শিশুদের দ্রুতপাঠ-উপযোগী সরস গ্রন্থ রচনার কাজে। শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের পাঠ্যগ্রন্থমালায় অন্তর্ভুক্ত হবে বইটি। ‘গল্পসল্প’ নামের বইটিতে ষোলোটি গল্প এবং ষোলোটি কবিতা থাকল। প্রায় সব কটাই ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মার্চের মধ্যে রচিত হল। চরিত্রগুলির মধ্যে ছাপ পড়ল রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় দেখা মানুষদের। ছড়ার ছন্দে নেচে উঠল সব ক’টি কবিতা, কোথাও কোনও অবসাদের চিহ্ন নেই। তত দিনে শান্তিনিকেতনে বসন্ত এসে গেল। অশোক-পলাশ-বনপুলকেরা চারদিক রঙিন করে দিয়েছে। আশ্রমে বসন্ত-উৎসবের আয়োজনে মেতে উঠেছে ছেলেমেয়েরা। গুরুদেবের অসুস্থতায় সকলের মন খারাপ। তবু উৎসব যাতে যথাযথ হয়, তার দেখভাল করছেন শৈলজারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও শান্তিদেব ঘোষ। এবার ‘নটীর পূজা’র অভিনয় হবে সন্ধ্যায়। সেই বসন্তে সবই আছে; পুষ্প, সুগন্ধ, ঋতুর আনন্দ-আবেদন, প্রেম-ব্যাকুলতা; কেবল রবীন্দ্রনাথ থেকেও নেই। পর পর ক’টি উৎসবে তিনি অনুপস্থিত। আশ্রমিকদের বুক কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। ‘নটীর পূজা’ তাঁর সামনে একদিন নিবেদন করা হল। রোগশয্যায় বন্দি গুরুদেব আনন্দ উপভোগ করলেন। কিন্তু শরীর ফুরিয়ে আসছে। গানের সব সুর তাঁকে আর ধরা দিচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছেন, প্রকৃতিতে বসন্তের আবির্ভাব হয়েছে, কিন্তু তাঁর ইন্দ্রিয়েরা আর বসন্ত বরণের যোগ্য নেই। এইবার তিনি বাতিলের দলে পড়ছেন। বসন্তোৎসবের দিন রচিত কবিতায় উঠে এল সেই সত্য—

রুদ্ধ কক্ষে দুরে আছি আমি—

এ বৎসরে বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রণ।

অধ্যায় ১ / ১৮

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন