বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্ব সেরে এসেছিল জন্মভূমিতেই। এই দেশে এসে হট্টগোল, দারিদ্রের ভিতরেই ভর্তি হয়েছিল বড় বিদ্যালয়ে। লেখাপড়া সপ্তমঅষ্টম শ্রেণির বেশি গড়ায়নি। তাঁবুতেই দেহ রাখলেন ঠাকুরদাদা। জ্যেষ্ঠপুত্র হবার সূত্রে কিশোর বয়সেই বাবা হয়ে গিয়েছিল ছিন্নমূল পরিবারের অভিভাবক। অতএব আয় করতে বার হল। তখন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সমাজে প্রবল ধানাই-পানাই চলছে। তাতে অংশ নিতে বিবেকে বাধল। দিশাহারা পরিস্থিতি ঠিক কথা, কিন্তু যথেষ্ট ভূমির মালিক, সম্পন্ন পরিবারের পুত্র, চিরন্তন গ্রামীণ মূল্যবোধ, পাপ-পুণ্যবোধের ভিতর শৈশব উত্তীর্ণ হয়েছে তার, কালোবাজারিতে অংশ নিতে বাবা ব্যর্থ হল। অতগুলি ক্ষুধার্ত মুখের কথা চিন্তা করে সে শ্রমিক জীবন যাপন করতে শুরু করল। সে সময় কংগ্রেস দায়িত্ব পেয়েছে স্বাধীন ভারতবর্ষের। গ্রাম-অংশের অন্ধকার দূর করবার নানা কাগজপত্রের সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বদেশি শাসকেরা প্রায় সকলেই অবশ্য শহরের অভিজাত শ্রেণির লোক। এই প্রসঙ্গে গাঁধীজির কথা মনে আসছে। দার্শনিক হিসাবে গাঁধীজির প্রতি আমার পরম শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু গ্রাম-অংশের মানুষ বলে একটি কঠিন কৌতুক অনুভব করি। তা হল একটি ছবি—গাঁধীজি চরকা কাটছেন। মহৎ উদ্দেশ্য সন্দেহ নেই। গ্রামীণ জীবনের বা পেশার বা দারিদ্রের প্রতীক চরকাটি গাঁধীজির মতো সর্বজনমান্য নেতার স্পর্শে এলিট হল। জীবনটি বা পেশাটি বা দারিদ্রটি সম্মানিত হল। কিন্তু ছবিটি আরও অতিরিক্ত কিছু বলছে। তা হল, গাঁধীজির হাতে চরকাটি অস্বাভাবিক। গ্রামে তাঁর অধিকার ছিল না। গ্রাম ছিল তার আদর্শগত ভাবনার বিচরণক্ষেত্র। চরকাটি তাঁর বাস্তব জীবনের অনুষঙ্গ নয়, ওটি প্রতীক, প্রতীক, কেবলই প্রতীক! এই ক্ষেত্রে ট্রাজেডির দিক হল, গ্রামের উন্নতি করতে হবে, তা হলে অধিকাংশ মানুষের মঙ্গল হবে, ফলত দেশের সমৃদ্ধি ঘটবে—এই ভাবনাটির বাস্তব ফল দাঁড়াল, গ্রামগুলিকে আধা-খাঁচড়া শহর বানিয়ে দেবার প্রচেষ্টায় রত হল কংগ্রেস সরকার। কংগ্রেস না বলে স্বদেশি শাসক দল বললেই চলে। দলটি তখন প্রায় বিরোধিতাহীন। অন্য মতবাদের অধিকারী সংগঠনগুলি সে সময় অঙ্কুরিত হলেও তাদের তেমন প্রতিষ্ঠা ছিল না, বা এমনটি বললেই ঠিক হয়, সেরকম প্রতিষ্ঠা তাদের ছিল না, যাতে করে কংগ্রেসের লাগাম কষে ধরতে পারে। যা হোক, ইতিহাসের বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাবার উপায় নেই, আমি কেবলমাত্র বাবার পরিস্থিতি অনুভব করছি। তাকে ঘিরে যে ইতিহাসবাষ্প তাইই আঁকছি।
যে-প্রসঙ্গটি হচ্ছিল, কিশোর বাবার শ্রমিক জীবনের মুহূর্তটি বুঝবার চেষ্টা করছিলাম। গ্রামের উন্নতির জন্য দেওয়া কিছু টাকা আমাদের প্রান্তরেও এসে পড়েছিল। সেই টাকায় প্রধানত সাফ করা হচ্ছিল গ্রামীণ বনজঙ্গল, মাটি কেটে উঁচু করা হচ্ছিল এত দিনকার পায়ে হাঁটা পথ। গ্রাম দ্রুত মফস্সল হচ্ছিল। মিউনিসিপ্যালিটির পত্তন হল, ভবন হল। কোর্ট চত্বর, থানা চত্বর ইত্যাদি শহরের কেন্দ্রবিন্দু ছোট্ট অংশটির রাতের অন্ধকার দূর হল, বাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা হল। সরকারি দপ্তরে নাম লিখিয়ে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বাবা-সহ ক্যাম্পের অনেক অসহায় ছেলেই বংশগরিমা ঝেড়ে ফেলে মাটি কাটতে শুরু করল। গাছ কাটতে লাগল। গ্রামেরও ছোট্ট একটি অংশ শহর হল দ্রুত, বণিক ও আমলারা (স্বাধীনতা-পূর্ব কাহিনি হলে বলতে হত রাজকর্মচারী) বড় বড় পাকাবাড়ি করে ফেলল সেই সভ্য অঞ্চলে। অল্প দূরেই অবশিষ্ট বনবাদাড়ে কোনও ক্রমে বাঁচতে থাকল স্বাধীনতার উচ্ছিষ্টরা অর্থাৎ বাবারা। স্থানীয় গ্রামবাসীরা দেখল, হাজার-হাজার বহিরাগত মানুষ তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে উপদ্রব হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। রাষ্ট্র খাতা-কলমে লক্ষ করল। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের সহায়তাতেই আর-এক দল সাধারণ মানুষ টিকে থাকল।
বাবার ছিল দারুণ আকর্ষণীয় চেহারা। গৌরবর্ণ। টিকালো নাক। মধ্য বয়সেও তার যে রূপ দেখেছি, আমার চোখে লেগে রয়েছে। পিছন দিকে চুল আঁচড়াত বাবা। চক্ষুদ্বয়ে সুদূরতা লেগে থাকত। প্রথমাবস্থায়, আমার লেখালেখির বা নাটকের ঝোঁক দেখে মিষ্টি প্রশ্রয় দিত। বুঝতাম, তার এইরকম হবার কথা ছিল। কিন্তু ইচ্ছাবিরুদ্ধ জীবন কাটিয়েছিল বাবা দায়ে পড়ে। মাঝে মাঝে বিদ্রোহ প্রকাশ পেত। সামান্য কারণেই অশান্তি করত। তখন প্রচণ্ড রাগ হত। এখন বুঝতে পারি, যে-জীবন দোয়েলের ফড়িংয়ের, তার সঙ্গে বাবার কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। সম্ভবত শৈশবে হয়েছিল, সেই জীবনের মায়াই বুঝি তাকে ডাক দিত, অধৈর্য করে তুলত।
বাবার বিয়ে হয়েছিল ২৩ বছর বয়সে। আমি জন্মলাভ করেছি মা-বাবার বিয়ের দু’ বছর পর। বড় হয়ে ওঠার কত স্মৃতি রয়েছে। দরিদ্র পরিবারে, মানুষগুলি ছাড়াও, বাড়ির গাছ, কুকুর, বিড়াল, ডোবা এঁদের সকলের সঙ্গেই সম্পর্ক বিশেষ ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে। কারণ শিশুগুলি ওদের কাছে পেয়ে থাকে আশ্রয়। ওদের সঙ্গে কথা বলে থাকে, খেলা করে থাকে। ওই পরিবার থেকে বিচ্যুত হয়ে দেড় দশকেরও উপর কাটিয়ে দিলাম, আজও মাথার ভিতর ছায়া ফেলে যায় বাড়ির বাতাবি লেবুর গাছ, ঘেউ করে ওঠে সেই কুকুর, মিঁয়াও করে ওঠে সেই বিড়াল, কতবার ডোবার ঘাটের ছায়াময় জলে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়ানো কাঁকড়া মস্তিষ্কে শিহরন জাগিয়েছে।
ভেবে দেখেছি, ১৯৯০ সাল নাগাদ, যখন বাবার পঞ্চাশ বছর মতন, তখন থেকে বাবা যেন নিজেকে গুটিয়ে নেয়, প্রবল নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, বিকৃতও হয়েছিল বোধহয় কিছুটা। তার পূর্বে বাবার বন্ধুগোষ্ঠী ছিল বিরাট। কী ভাবে এই বন্ধুগোষ্ঠী হল, কী ভাবে একসময় বাবা নিঃসঙ্গ, খিটখিটে, কিছু-বা নিষ্ঠুর হয়ে শ্মশান-মন্দিরে যাতায়াত শুরু করেছিল, তা আমাকে ইতিহাসের একটি নতুন পাঠের ইঙ্গিত দেয়। দ্রুত লিখছি। লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছি। দশ দিন হয়ে গেল, বাবার জ্ঞান ফেরেনি। আমি আর ধার পাচ্ছি না। ভাই ব্যবসাকেন্দ্রের মালিকের কাছ থেকে কিছু ধার করেছিল, তাও গিয়েছে। মা গয়না বন্ধক দিয়েছে নিরুপায় হয়ে। তাও অল্প বইকী! এমত পরিস্থিতিতে দ্রুত চিন্তা লিপিবদ্ধ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পিতৃ-মাতৃ-বিদ্রোহী, পরিবার-বিদ্রোহী একজন এইরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কী করতে পারে?
প্রথম দিকে বাবার বন্ধুদলের ভিতরে ছিল ষষ্ঠীকাকু, পরানকাকু, হৃদয়কাকু, অমিয়কাকু, আশুকাকুরা। তারা বাবার কথায় মাটি কাটার কাজে যোগ দিয়েছিল। আমাদের প্রতিবেশীই ছিল ওরা। প্রায় সমবয়সী হওয়ার কারণে এবং সমপেশায় নিযুক্ত থাকায় একটি পরিবার মতন হয়ে গিয়েছিল মানুষগুলি। পরবর্তীতে বাবার কাজটি সরকারি চাকরিতে পরিণত হয়। স্বল্প বেতন, তবু তো সরকারি চাকরি। জীবনের ভিত্তি নির্মিত হয়ে যায়। রোজগার বাড়াবার জন্য দলটি সন্ধেবেলায় বিড়ি কারখানায় বিড়ি বাঁধার কাজে যুক্ত হল। বিড়ি শ্রমিক হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিই বাবার জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা তখন গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা যে একটা বৃহৎ ধাপ্পা, তা বোঝাচ্ছে মানুষকে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে গরিব, অশিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত, অসহায় মানুষকে চেতনা দান করছে। বাবার ছিল এক অদ্ভুত অবস্থান। এক পুরুষ পূর্বেই তারা ছিল বিস্তর জমির অধিকারী এবং পেশায় কৃষক-শোষক। দুম করে শৈশবাবস্থা কাটতে না কাটতে হয়ে গেছে সর্বহারা এবং গতরবিক্রি করা শ্রমিক। প্রবল ক্ষোভ বা আবেগে আচ্ছন্ন বাবা সাম্যবাদী দলের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে গেল। বন্ধুদল তো ছিলই, আরও সব বিড়ি শ্রমিকরা ছোট্ট এক কামরার পার্টি অফিসে রাতে জড়ো হতে আরম্ভ করল। এইসব ইতিহাস আমি জেনেছি কিছু বাবার কাছে, কিছু আমাদের অঞ্চলের শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক সত্যরঞ্জন মৈত্রের কাছ থেকে। সত্যজেঠুর ছিল ছোট্ট লেটার প্রেস। অতীতে তিনিও বিড়ি বাঁধতেন। তাঁর রচিত একাধিক নাটক সারা বাংলায় অভিনীত হত, দর্শকের মনে জ্বলত বিদ্রোহের আগুন। সত্যজ্যেঠুর কবিতার পঙ্ক্তি তৎকালে স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির পোস্টারে ব্যবহৃত—‘কুসুমেরা আজ বুঝি রক্তমুখী গান/শহিদ হয়েছে আজ আমার বাগান!”
আমি যখন গোপনে লিখতে শুরু করেছি, একাদশ শ্রেণিতে পড়ছি, সে সময়ও বাবার দু’টি চোখ স্বপ্নবান। আমি ইচ্ছা প্রকাশ করা মাত্র আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সত্যরঞ্জন মৈত্রের প্রেসে। উনি তখন সত্তরোর্ধ্ব। শীর্ণ শরীর বেঁকে গিয়েছে। বাবা আলাপ করিয়ে দিল। উনি খুব খুশি হলেন। বাবা বলল, “আপনার কাছে দিয়ে গেলাম।” এটি একটি সমর্পণ-অনুষ্ঠানই বটে। আমি মাঝে-মাঝেই সন্ধ্যায় তাঁর কাছে যেতে শুরু করলাম। প্রেসটায় তখন আড্ডা বসত। যাঁরা আসতেন, তারা সকলে সত্যজেঠুর শিষ্যপ্রতিম কবি-সাহিত্যিক। এদের নাম সাহিত্যের ইতিহাস কোনও দিন জানবে না। কিন্তু এঁরাও লিখতেন, সাহিত্যসভা করতেন, সমাজচিন্তা করতেন। স্থানীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তাঁদের স্পষ্ট অবদান রয়েছে। প্রধান শহর তাঁদের নাই বা জানল! সত্যজেঠুর খ্যাতি কলকাতা অবধিই প্রসারিত হয়েছিল। নামী পত্রিকাগুলিতেও তিনি মাঝে মাঝে লিখতেন। তাঁকেও তো আজ কেউ মনে করতেই পারে না। বৈষম্যে ভরা সমাজে এরকমই ঘটবে। সত্যজেঠুর প্রেস থেকেই তাঁর গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হত, বিক্রি হত। সেসময় তার শিক্ষিত অনুরাগীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। টুকিটাকি ছাপবার কাজ আর গ্রন্থবিক্রয়ের টাকাতেই সত্যজেঠুর সন্তানহীন ছোট্ট সংসার চলত। এই সত্যজেঠুর অল্পবয়সী শিষ্য হয়ে অতীত দিনের কত কথাই না জেনেছি।
বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বাড়াবার আন্দোলন বাম নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল। একে দরিদ্র শ্রমিকের অর্ধভুক্ত শরীর, তার উপর তামাক ঘাঁটা, ফলত তাদের যক্ষ্মারোগ হত, শ্বাসকষ্টের অসুখ হত। তাদের স্বাস্থ্যভাতার দাবি পেশ করা হল। কিছু কিছু সুফল মিলল। সরকার কতটুকু করবে পরোয়া না-করে বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে ইউনিয়নভুক্ত করা হল, নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহের ব্যবস্থা হল, সংগৃহীত টাকা থেকেই বিপদগ্রস্ত শ্রমিককে সাহায্য করা শুরু হল। বৃহৎ পরিবারবোধে বিড়ি শ্রমিকরা মানসিক দিক থেকে হয়ে উঠল অনেক শক্তিশালী। ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা বোঝানো গেল তাদের। সমস্ত দিক থেকে দেখা দিতে শুরু করল অভূতপূর্ব উদ্যম। এই শ্রমিক ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন সত্যরঞ্জন মৈত্র, প্রথম সম্পাদক হয়েছিল বাবা। সে সময় বামপন্থী কর্মীদের পার্টি অফিসে কমিউনিজম নিয়ে পড়াশোনা বাধ্যতামূলক ছিল। প্রথাগত পড়াশুনায় অধিক দূর অগ্রসর হতে না-পারা বাবা মনোযোগ দিয়ে রাজনৈতিক পড়াশোনা শুরু করল। নেতৃত্বদানের স্বাভাবিক ক্ষমতা তার ছিল, ছিল বাগ্মিতা, অতি দ্রুত আমাদের অঞ্চলে বাবা বিড়ি শ্রমিকদের নেতা হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আমার অত কিছু বোঝার বয়স না। এইটুকু মনে করতে পারি, অনেক রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছি, বাঁশের খুঁটিতে পেরেকে ঝুলিয়ে রাখা হ্যারিকেনের আলোয় বাবা পড়ছে। বইয়ের রং লাল। একটি টাকমাথা মানুষের ছবি আঁকা। আমি উসখুস করতাম, বাবা যদি ডেকে নেয়। তা হত না। আমি জেগে গেছি বুঝলে বলত, “ঘুমিয়ে পড়ো। শিয়াল আসবে কিন্তু!”
এখন আমাদের কংক্রিটের শহরে কেউ বুঝতে পারবে না, তখন নিশুতি রাতে পাড়ার ইট-ফেলা রাস্তায় হুক্কা-হুয়া করতে করতে শিয়াল যেত। তাদের অস্তিত্ব টের পেলে কুকুরের দল তাড়া করত। তা এক হট্টগোলের ব্যাপার। শিয়ালের ডাক ছিল আমার ভয়ের বিষয়। চমকে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরতাম। মা বিরক্ত হলে বাবার দিকে যেতে চাইতাম। কোথায় চলে গেল রাত্রি জেগে লাল বই পড়া সেই বাবা, সেইসব শিয়াল, আদরপ্রার্থী-আশ্রয়প্রার্থী সেইসব ভয়? বাবা মৃত্যুমুখে পড়ার পূর্বে আমার অভ্যন্তরে লুকিয়ে পড়েছিল এই সব অনুভূতি। কেবল মনে থাকত বাড়ি ছাড়ার পূর্বে বাবার নিষ্ঠুর মুখভঙ্গি। আমি এমত অবস্থান নিয়েছিলাম সে সময়, ইচ্ছেমতন জীবন অতিবাহিত করব, সংসার থেকে কোনও সাহায্য নেব না, সংসারের কোনও দায়ও বহন করতে পারব না। সেই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠিত নেতার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে ভরা শরীরী ভাষা বাবার। আমার ভাবপ্রবণতা মানুষটি আর মানিয়ে নিতে পারছিল না। যখন গৃহত্যাগ করলাম, মা চোখের জল ফেলল, বাবা ‘তার কিছু এল-গেল না’ ভঙ্গিতে অটল রইল। নিজ পার্টির স্বভাবমতোই পরবর্তী দিন থেকে সকালে বারান্দায় জড়ো হওয়া শিষ্যদের সামনে আমার সম্পর্কে নানা খারাপ কথা বলতে থাকলেন, ‘সব শিয়ালের এক রা’ সূত্র অনুযায়ী এই দিগরে সেই সব কথা মুখে মুখে ছড়াল, প্রতিষ্ঠিত হল। তখন ১৯৮৬ সাল। বামপন্থী শাসন পশ্চিমবঙ্গে দৃঢ় হয়েছে। গ্রামেগঞ্জে জীবন সমর্পণ করে রাজনৈতিক চেতনা ছড়াবার কাজ করা নেতাদের কেউ কেউ খুন হয়েছে এক দশক পূর্বে, বাকিরা ল্যাজ মোটা করে মাতব্বরি করছে এই রাজ্যে। তখনও এই বদলে কষ্ট পাচ্ছে কেউ কেউ। আত্মনির্বাসনের বিষয়টি এই রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষিতে অকস্মাৎ প্রতীকী হয়ে গিয়েছিল, বুঝতে আমার অনেক বিলম্ব হয়েছে।
ইত্যবসরে বাবার সঙ্গে সদ্ভাবের সময়টির একটি ঝলকে ডুব দিয়ে আসি। দারিদ্র-জর্জরিত, স্বপ্নতাড়িত সেই বাবাকে ভুলতে পারি না, কী ভালই না বাসত আমাকে, সগৌরবে সর্বত্র নিয়ে যেত, যেন তার রাজনৈতিক সংগ্রামের উত্তরাধিকারের পতাকা আমার হাতে তুলে দেবার প্রস্তুতি সারছে। নদী পার হয়ে বাবাদের বিড়ি-গুমটিতে গিয়েছি কতবার সন্ধ্যায়। মা গজগজ করত। সন্ধ্যার পড়াশোনা হত না বলেই তার আপত্তি। বাবা হাসত। বলত, “কী রে, পড়াশুনোর অসুবিধে হবে?”
আমি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। সেই গর্বে ভাসত গোটা পরিবার। মায়ের দিক থেকে ছিল প্রবল সতর্কতা, বাবার দিক থেকে ভীষণ আস্থা। অতএব সন্ধ্যার সফর শেষ পর্যন্ত আটকাত না। সেই গুমটিতে বাবার হাত ধরে পৌঁছালে বাবার কমরেড শ্রমিক-বন্ধুরা আমাকে খুব আদর করত। আর বলত, “সেই কবিতাটা একবার হয়ে যাক!”
চা আসত। আমার জন্য লজেন্স। ওরা চা খেয়ে হাঁটুর উপর থেকে বিড়ির কুলো সরিয়ে খানিক বিশ্রাম নিত। সমবেত ধূমপানের ধোঁয়ায় অস্পষ্ট, রহস্যময়, কিছু-বা স্বপ্নিল হয়ে উঠত ঘন সন্ধ্যা। আমি বাবার শিখিয়ে দেওয়া সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘লেনিন’ কবিতাটি খুব উৎসাহ নিয়ে বলতাম। কচি গলা কাঁপিয়ে কিছু না বুঝেই বলতে থাকতাম।
মনে পড়ছে, সাতাত্তর সাল নাগাদ, তখন সম্ভবত হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি, বাবাদের পার্টি ভোটে জিতল। আমাদের বাড়ির ছোট্ট উঠোনে রেডিয়ো ঘিরে সারা দিন জনা-চল্লিশেক বাবার কমরেডরা বসে রয়েছে। তাদের চা পরিবেশন করতে করতে মা ক্লান্ত। মাঝে মাঝেই মা বাবাকে ঘরে ডাকছে। বাবাদের তখন উত্তেজনায়, উল্লাসে অপূর্ব চেহারা। স্বপ্নকে সত্যি হতে দেখলে যা হয়। মাটি কামড়ে ধরে এত দিনের সংগ্রামের ফল মিললে যেরকম আনন্দাশ্রু বার হয়, সেরকম। বাবা কিছুতেই বাস্তবে ধরা দিচ্ছে না। তখন তো কিছু পর-পর ভোটের খবর বলছে রেডিয়োতে। নানা জায়গা থেকে জয়ের খবর আসছে এর তরঙ্গ-মারফত। মা আমাকেই পাকড়াও করল। বলল, “যা, বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়। কথা কানে যাচ্ছে না?” ধমক খেয়ে বাবাকে গিয়ে খোঁচাতে লাগলাম। বাবা তখন বলছে, “বিষ্ট্র, কোর্টের মাঠ থেকে চট করে ঘুরে আয় তো! দেবজিৎদা সেকেন্ড-রাউন্ডে পাঁচ হাজার ভোটে এগিয়ে আছে, কখন থেকে বলছে। এতক্ষণে চার রাউন্ড গোনা হয়ে যাওয়ার কথা। বরেনদা’রা সব আছে। গিয়ে দেখা কর। মনে হচ্ছে দেবজিৎদাকে ঠেকাতে পারবে না এবার। যা-যা।”
আমি তো গুঁতো মেরেই যাচ্ছি। বাবা অকস্মাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন, “কী খবর কমরেড?”
এহেন সম্বোধনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। কোনও ক্রমে বললাম, “মা ডাকছে ঘরে।”
ঘোরগ্রস্ত বাবা বলল, “এখন পার্টি লড়ছে। ব্যক্তিগত কথা জরুরি নয়, কমরেড।” আমার মুখ দিয়ে আর কিচ্ছু বার হল না। ব্যর্থ হয়ে মা’র কাছে ফিরলাম। কথোপকথন তুলে ধরলাম। মা রেগে ফায়ার। বলল, “এতগুলো লোক খাবে কী? কমরেডের নিকুচি করেছে! চল তো!”
অগত্যা ঝড় তুলে মা যাচ্ছে, পেছনে বোকা-বোকা ভঙ্গিতে আমি। আমি বাবার দলেই আছি কিন্তু মায়ের নির্দেশ অমান্য করবার সাহস নেই।
মা সবার মাঝখানেই বাবাকে বলল, “তোমার কি কোনও হুঁশ আছে? ঠাকুরপোরা খাবে কী?”
বাবা কাঁচুমাচু হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “কিছু চাপিয়ে দাও। আমরা কখন কোথায় থাকি!”
মা চিৎকার করল, “যেখানেই থাকো গে পেটে কিছু পড়বে না?” মায়ের অগ্নিমূর্তিতে ভয় পেয়েই বোধহয় আশুকাকু বলল, “বউদি, খিচুড়ি চাপিয়ে দাও।”
মা আরও খেপে গেল। বলল, “উনি তো সব কথাতেই কমরেড-কমরেড বলছেন। ঠাকুরপো, তোমাদের কমরেডকে চাল-ডালের ব্যবস্থা করতে বলো। ঘরে যা আছে, তাতে পাঁচ-ছ’জনের হবে। এতগুলো মানুষের তাতে হয়? কোনও বোধ-ভাষ্যি আছে ওই মানুষের!”
বন্ধুদলের মধ্যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার তখন করুণ পরিস্থিতি। আশুকাকুকে বাবা চোখের ইশারা করে। আশুকাকু মা’কে বলল, “বউদি, তুমি যাও। আমি দেখছি।”
মা যেমন এসেছিল, তেমন ঝড় তুলে চলে গেল। এইবার আমার প্রতি আর ভ্রুক্ষেপও করল না। দ্রুত চাল-ডালের ব্যবস্থা হল। সেদিন পুরো ঘটনাটাই ম্যাজিক বলে মনে হয়েছিল। আজ বুঝতে পারি, সকলের চাঁদা দানেই অন্নের ব্যবস্থা হল।
দুপুর গড়িয়ে গেল খিচুড়ি তৈরি হতে। কোনও দিন ভুলতে পারব না সেই দিনের আনন্দ। আমাদের উঠোনে গোল হয়ে বসেছে বাবার কমরেডদল। সকলেই প্রায় বিড়ি-শ্রমিক। আজ তারা কেউ কাজে যায়নি। কয়েক জন কেবল ছিল, তারা আমাদের পাড়ারই মানুষ, বাবার সঙ্গে সরকারি অফিসে লেবারের কাজ করত। এরা সন্ধের পর বিড়ি বাঁধতে যেত। রেডিয়ো ততক্ষণে চতুর্দিকে বামপন্থীদের জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবার খবর দিচ্ছে। এক রাউন্ড-দুই রাউন্ড হয়তো গোনা বাকি মাত্র। বিষ্ঠুকাকু দেবজিৎ সেনের চতুর্থ রাউন্ডের খবর এনেছে। জোর লড়াই চলছে আমাদের বিধানসভায়। তবে গতবার কমরেড দেবজিৎ সেন গো-হারা হেরেছিল। পাঁচ বছরে কু-শাসন, জরুরি অবস্থা জারি ইত্যাদি কারণে কংগ্রেস জনপ্রিয়তা হারিয়েছে দ্রুত, পাশাপাশি বাম আন্দোলন আরও জোরদার হয়েছে। প্রধান বামদলগুলো মতপার্থক্য সত্ত্বেও এক ব্যানারের নীচে দাঁড়িয়ে নির্বাচনে লড়ছে। তাছাড়া, মানুষ বদল চাইছে। অতএব দেবজিৎ সেন জিতেই যাবে, এসব আলোচনা হচ্ছিল। পাতে খিচুড়ি পড়ছে, আমিও পরিবেশন করছি। সকলে আমাকে বসে পড়তে বলেছিল। কিন্তু এত আনন্দ পাচ্ছিলাম আমি! তখন তো ডানবাম বুঝি না, ভোট বুঝি না, বিধানসভা বুঝি না, কিন্তু বাবার এতগুলো বন্ধু আমাদের উঠোনে বসে দুপুরবেলায় খিচুড়ি খাচ্ছে, এই দৃশ্যে আমি ওই অল্প বয়সেই মোহিত হয়েছিলাম।
গভীর রাতে সারা পাড়ায় আনন্দ-উৎসব শুরু হল। উদ্বাস্তূপল্লি লাল আবিরে সেজে উঠল। রাজ্যে বামদল বিপুলভাবে জিতেছে। গরিব মানুষের পাড়া আমাদের, গরিবের দল এবার বড়লোকের দলকে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে, অর্থাৎ আমরা ভাল থাকব—এই অনুভূতিতে পাড়ায় উল্লাস চলছে। আমাদের বেড়া-টালির বাড়ির বারান্দায় সকলের মাঝখানে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ-হঠাৎ জেগে বড়দের অন্যরকম খুশি-খুশি রূপ দেখে ভাল লাগছে। রাজনীতি বুঝবার বয়স না, কিন্তু ভাল একটা কিছু হচ্ছে, তা টের পেয়েই আমার আনন্দ। সেদিনের আধো ঘুম-আধো জাগরণে যা দেখেছিলাম, তার অধিক আনন্দিত মুহূর্ত আমার জীবনে আসেনি। বড় বয়সেও তার চাইতে পরিণত বিপ্লব আমি দেখিনি।
শেষ রাত্রিতে একবার ঘুম ভেঙেছিল। কখন কেউ আমাকে বারান্দা থেকে তুলে ঘরে ভাইয়ের পাশে শুইয়ে দিয়েছে। সকলে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে যাবার পর বাবা ঘুমাতে এসেছে। কিন্তু ঘুম তার আসছে না। শুনলাম মা বলছে, “ঘুমিয়ে পড়ো তো! সারাদিন যা ঝামেলা গেল।”
বাবা যা বলেছিল, তার সম্পূর্ণটা বোঝার বয়স নয় বলে স্মৃতিতে নেই। যেটুকু সহজ কথা মনে রেখেছি, তা হল, “এইবার আমাদের সুদিন আসছে। তোমার কষ্ট কমবে।” এটা ছিল প্রিয় এক প্রত্যাশা, প্রিয় এক স্বপ্ন। এই স্বপ্ন ব্যক্তিগত সংসারে উচ্চারিত হলেও তা ছিল একটি শ্রেণির হয়ে দেখতে থাকা স্বপ্ন। শাসক হয়ে গেলে সম্ভবত স্বপ্ন দেখবার অবকাশ চলে যায়। এটি চিরন্তন সত্য কি না জানি না। আমার অভিজ্ঞতা আমাকে নিয়ত দংশন করে চলে। আমি বাবার বদলে যাওয়াকে কক্ষনও ভুলতে পারি না। দ্বন্দ্বে লটকে আছি এতটি বছর।
এক মাস হয়ে গেল হাসপাতালে জ্ঞান ফেরেনি বাবার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন