সকাল থেকেই আকাশ গোমড়া হয়ে ছিল। নানা ভাবনায় জর্জরিত বিদিশা কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে বেরোতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বাবার কাছে যাওয়ার সময় তার সাজপোশাকে কোনও উগ্রতা থাকে না। পবিত্রতা আর পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সে বাবার মুখোমুখি হতে চায়। সে জানে, বাবা কী ভাবে তার জন্য অপেক্ষা করে।
কপালে চন্দনের টিপ আর ধবধবে সাদা সালোয়ার-কামিজে নিজেকে সাজিয়ে বিদিশা কৃষ্ণনগরে এসেছে। গ্লানিটুকু ধুইয়ে দিতেই যেন আষাঢ়ের বৃষ্টি নামল। রিকশার দিকে সে হেঁটে গেল মন্থর ভঙ্গিতে। ভিজুক, সব ভিজে যাক। যত দুঃখ আছে তার, যত অভিমান, ভালবাসার জন্য যত কাঙালপনা—সব। ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে থাকুক।
ইদানীং সে দুটো গন্ধে বিভোর হয়ে থাকে। এক—হত্যার গন্ধ। হত্যার গন্ধে সে বন্য। আততায়ীর মতো দিবারাত্র তৎপর। নিজে উপলব্ধি না করলেও এটা নিশ্চিত, বিদিশার মধ্যে অংশত বিকৃতি এসেছে। আর, দুই নম্বর গন্ধ হল, মৃত্যুর গন্ধ। বাবা তাকে যে-লেখা উপহার দেয়, সেখানে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছেন…তাঁর শেষ দিনগুলির ওপর ঝরে পড়ছে বৃষ্টি…কবির বেঁচে-থাকার ইচ্ছে তখনও অটুট..এই সব প্রসঙ্গ রয়েছে বাবার লেখায়। বিদিশার কাঁপুনি আসছে, কারণ রবীন্দ্রনাথের বদলে বাবার ছবিই তার মনে ভেসে ভেসে উঠছে কেবলই। হত্যার গন্ধ তাকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার সুড়ঙ্গে, মৃত্যুর গন্ধ তাকে ফিরিয়ে আনছে বড় আকাশের দিকে তাকিয়ে-থাকা এক ছাদের ঘরে। বিদিশার সত্তাটি যেন দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে নিদারুণ টানাপোড়েনে। নিয়ন্ত্রণহীন সে ভেসে বেড়াচ্ছে দু’রকম জগতে।
ভেজা পোশাকে বাবার বাড়ি পৌঁছতেই সব হইহই করে উঠল। “ছাতা নিয়ে বেরোতে পারিসনি?” …“এঃ হে, কী অবস্থা দ্যাখো!”…“ওরে মুন্না, তোর দিদিকে জামা-টামা দে।”
মুন্না এসেই হ্যা-হ্যা করে হাসল, “কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে দিদি!”
বিদিশা কপট ধমক দিল, “তুই চুপ কর তো! সব কিছুতেই হ্যা-হ্যা!”
মুন্না চোখ বড় বড় করল, “তুই একটু বেশি স্মার্ট। আজ ভিজে গিয়ে বেশ দেখাচ্ছে। একটু হ্যাবলা-হ্যাবলা।”
বিদিশা তাড়া দিল, “মার খাবি?”
মুন্না আবার হেসে তার হাত ধরে টানল। নিয়ে গেল দোতলায় নিজের ঘরে। জামা-টামা বের করে দিল। বলল, “তোর হাইট একটু বেশি আমার চেয়ে। দ্যাখ কোনটা ফিট করে।”
কচি কলাপাতা রঙের একটা চুড়িদার পরে নিল বিদিশা। মাথা-টাথা মুছে বাবার কাছে চলল। বাবার ঘরে ঢুকে বলল, “বাবা! মুন্নার জামা পরেছি।”
প্রভাতরঞ্জন একবার মুখ ফিরিয়ে দেখলেন। কিছু বললেন না। বিদিশা গিয়ে বাবার হাত ধরল।
“কী ব্যাপার? কথা বলছ না কেন? মুড খারাপ?”
তার বাবা বললেন, “যার মেয়ে অবাধ্য হয়, কারও কথা শোনে না, তার তো মুড খারাপ হওয়ারই কথা।”
ভ্রু কুঁচকাল বিদিশা। জিজ্ঞেস করল, “এ কথা বলার কারণ?”
বাবা বললেন, “বস। ঠান্ডা হ। তারপর বলছি।”
বিদিশা দুশ্চিন্তা লুকিয়ে হাসল, “বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা হয়েই আছি। শোনো, তুমি খারাপ ব্যবহার করবে না। আমি সহ্য করতে পারব না। কত দূর থেকে ছুটে এলাম।”
প্রভাতরঞ্জন এবার স্নেহের হাসি হাসলেন। মেয়েকে বসিয়ে দিয়ে নিজে পাশে বসলেন। নরম স্বরে বললেন, “কেন তুমি তোমার মা’কে অপমান করো?”
বিদিশা স্তব্ধ। রাগ চেপে বলল, “তোমাকে কে বলেছে?”
প্রভাতরঞ্জন বললেন, “রাগ করিস না, তোর মা-ই বলেছে। তোর ভাল-র জন্যই বলেছে।”
“কীসের ভাল? সে কি এই বাড়ি এসেছিল?”
“না। ফোন করেছিল।”
“ফোন নম্বর পেল কোত্থেকে? আমি তো দিইনি।”
“কখনও তোর মোবাইল ঘেঁটে বের করেছে।”
শুনে বিদিশার মাথায় আগুন জ্বলে গেল, “কী অসভ্য দেখেছ? চোরের মতো আমার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিয়েছে। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা।”
বিদিশা তক্ষুনি ফোন করতে যাচ্ছিল, প্রভাতরঞ্জন তাকে থামালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিছুক্ষণ। গোঁজ হয়ে বসে থাকল ছোট্ট মেয়েটির মতো বিদিশা। বাবা তাকে বললেন, “জয়া খুব কাঁদছিল ফোনে। জয়ার ধারণা, ওকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই তুই যা-ইচ্ছে-তাই শুরু করেছিস।”
বিদিশা রাগের গলায় বলল, “কী যা-ইচ্ছে-তাই?”
“একা-একা বন্ধুদের নিয়ে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলিস তুই।”
“ওর কী?”
“এভাবে কথা বলিস না। তোর একটা ক্ষতি হয়ে যায় যদি!”
“ওদের দু’জনকে আমার ভাল চাইতে হবে না।”
“তাছাড়াও এখন নাকি তুই নাইট ক্লাবে যাস? ড্রিংক করিস?”
“বেশ করি। এর পর খুনও করব।”
প্রভাতরঞ্জন কথা বলছিলেন, আর মেয়েকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। এবারের কথায় একেবারে হা হয়ে গেলেন। বুঝলেন, মেয়ের অসুখটা অনেক গভীরে চারিয়ে গিয়েছে। হতাশা নিয়েই তিনি ঘর করেন। এক্ষুনি যে-হতাশাটা এল, তা অন্য রকমের। এই হতাশাটা তাঁকেও আক্রমণ করছিল। জয়াকে হারিয়ে প্রবল অভিমানে জব্দ হয়ে গৃহবন্দি ছিলেন তিনি এত কাল। মেয়ের প্রতি তাঁরও তো একটা কর্তব্য ছিল। জীবনে যা-ই হোক, মেয়ে যদি বাবার স্নেহ-বঞ্চিত হয়, তার ভারসাম্যহীনতার জন্য বাবাও দায়ী থাকে। অতএব, অপরাধবোধে আক্রান্ত বাবা হিসেবে তিনি আরও নরম হয়ে পড়লেন বিদিশার প্রতি। গলায় কান্না উঠে এল যেন। তিনি আস্তে ডাকলেন, “মাম!”
বিদিশা মুখ গোঁজ করে থাকল। বাবার কাছে যেসব ফাঁস হয়ে গিয়েছে। পরমূহুর্তে তার মনে হল এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। বাবা যা বলে বলুক, সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না। তার জীবনের কোনও মূল্য নেই, বাবার জীবন অমূল্য।
প্রভাতরঞ্জন মেয়ের মাথা বুকে টেনে নিলেন। বললেন, “তুই আমাকে ক্ষমা করিস, মাম।”
বিদিশা অবাক গলায় বলল, “কেন?”
প্রভাতরঞ্জন বললেন, “তোর প্রতি আমার কর্তব্য ছিল, আমি অভিমানে অন্ধ হয়ে তা পালন করিনি।”
বিদিশা ফুঁসে উঠল, “তুমি কী করবে? ওরা তো আমাকে তোমার কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল।”
খানিক ভেবে, আঘাতটা সামলে, প্রভাত বললেন, “ঘটনাটা কি ঠিক তা-ই? তুই বড় হয়ে গিয়েছিস, সবই তো বুঝিস। ছোট্ট মেয়ে মায়ের কাছেই তো থাকবে। বাবা তো শিশুর দূরের আত্মীয়।”
প্রবল আবেগে দিশেহারা বিদিশা বলল, “আমি ওসব মানি না। তুমি…তুমিই আমার সব।”
বিষণ্ণ হাসলেন প্রভাতরঞ্জন, “তাই কি হয়?”
বিদিশা কী বলবে বুঝতে না পেরে কেঁদে উঠল সশব্দে। নিজেরও কান্না পাচ্ছিল প্রভাতরঞ্জনের। তাঁর জীবনে সব গোলমাল হয়ে গেছে। কিছুই আর ফেরানো যাবে না। সারানো যাবে না। মেয়ের কান্না থামিয়ে তিনি ভেজা স্বরে বললেন, “আরও যখন বড় হবি, মাম, বুঝবি জীবনে সবথেকে বড় কথা হল বিশ্বাস। বিশ্বাসের নানা রূপ। নিজের প্রতি বিশ্বাস, অন্যের প্রতি বিশ্বাস, এমনকী বিশ্বাসকে বিশ্বাস করাও তার মধ্যে পড়ে। আমি অনেক ভুল করেছি। তোকে হঠাৎ পেয়ে মনে হয়েছিল, এবার অলৌকিক কিছু হবে…জীবনে ফিরে আসব আবার আমি। কিন্তু আস্তে আস্তে টের পাচ্ছি, অনেক সময় চলে গিয়েছে অগোচরে…আজ আর কিছুই ঠিকঠাক হবে না। ধ্বংস আমার জীবনে অনিবার্য। তোর জন্য রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলি লিখছি তো…অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে…অত বড় মানুষটা দ্যাখ কীভাবে সচেতন ভাবে বিদায় নিচ্ছেন…। শেষ জন্মদিনে লেখা একটা কবিতায় যা বলেছেন, আমিও যেন তাই তোকে বলতে চাই—
“…শূন্য ঝুলি আজিকে আমার;
দিয়েছি উজাড় করি
যাহা কিছু আছিল দিবার,
প্রতিদানে যদি কিছু পাই—
কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা—
তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই
পারের খেয়ায় যাব যবে
ভাষাহীন শেষের উৎসবে।…”
বিদিশা চোখের জল মুছে বাবার দিকে তাকাল। কয়েক মাসে বাবার শরীর আরও ভেঙে গেছে। বয়সের তুলনায় তাঁকে বেশি ভাঙাচোরা লাগে। সে রেগে গেল, “শূন্য শূন্য কোরো না তো! কীসের শূন্য? আমি তোমাকে ভরিয়ে রাখব।”
প্রভাতরঞ্জন বললেন, “তা কোথায় করছিস তুই? সকলের ওপর রাগ করে তুই ধ্বংসের দিকে যাচ্ছিস।”
বিদিশা নরম স্বরে বলল, “তোমার ওপর তো আমার কোনও রাগ নেই।”
প্রভাত বললেন, “তুই যে নিজের ওপর খেপে গেছিস, তার জন্য তো আমিও দায়ী।”
বিদিশা এবার গলা তুলল, “না, তুমি দায়ী নও একটুও। চোরেদের ওপর আমার রাগ।”
মেয়ের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মেয়ের বাবা। জরিপ করলেন গভীর চোখে। তারপর বললেন, “আচ্ছা, তুই যে খুন করার কথা বললি, কাকে?”
বিদিশা উত্তর দিল না। একটা কলম নিয়ে একটুকরো কাগজের ওপর আঁকিজুঁকি করতে থাকল।
প্রভাত বললেন, “যাকে খুন করবি, সে লোকটা কি ছবি আঁকে?”
বিদিশা পাগলাটে গলায় বলল, “ইয়েস।”
সর্বনাশের শেষ অবধি যেন দেখতে পাচ্ছেন প্রভাতরঞ্জন। বিষাদে পাথর হয়ে রইলেন তিনি। অনেকক্ষণ পরে বললেন, “একবার তার কাছে হেরেছি, আবার তার কাছে আমাকে ছোট করে দিবি তুই?”
বিদিশা চোখ কুঁচকে বলল, “তার মানে?”
প্রভাত সরাসরি উত্তর দিলেন না। অন্যমনস্ক সুরে বললেন, “আমারই দোষ। দাবিহীন হয়ে সমস্তটা মেনে নিতে পারলে তুই আজ এত কষ্ট পেতিস না। জীবনে এরকম ঘটনা তো হয়েই থাকে। যার যাকে ভাল লাগে, সে তার সঙ্গে থাকবে।”
বিদিশা বলল, “তুমি ভাল মানুষ, তাই এসব বলছ। ওরা আমার জীবন থেকে তোমাকে মুছে দিতে চাইল কেন? সেটা তো একটা ক্রাইম।”
প্রভাতরঞ্জন মেয়েকে বোঝানোর সুরে বললেন, “মাম, তুই তো বড় হয়েছিস। তোকে একটা কথা বলি। আমি লিখতে ভালবাসতাম প্রচণ্ড। লেখা আর পড়া—এই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু কবি হিসেবে কী ভাবে বড় হওয়া যায়, আমি জানতাম না। আমাদের আড্ডায় কিন্তু বড়-বড় কবি-সাহিত্যিক-গায়ক-পেন্টাররা আসতেন। ওইসব দেখেই জয়া আমাকে নিয়ে উচ্চাশা পোষণ করত। আমি ওর ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি। এসব জোর করার ব্যাপারও না।…আমার জন্যে তুই কষ্টে পড়েছিস, কিন্তু বিশ্বাস কর, সত্যিই আমি জানি না কী ভাবে বড় হওয়া যায়।”
একটু চুপ করে থাকল বিদিশা। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমিও আমাকে বলতে পারো বাবা, কী ভাবে নষ্ট হওয়া যায়? সম্পূর্ণ নষ্ট?”
প্রভাতরঞ্জন মৃদু চমকে উঠে বললেন, “নষ্ট হবি কেন তুই?”
বিদিশা দুঃখিত গলায় বলল, “আমি নষ্ট না হলে মা উচিত শিক্ষা পাবে কী করে?”
প্রভাতরঞ্জন ভেতরে-ভেতরে তছনছ হয়ে যাচ্ছিলেন। মেয়েটার মাথা তো একদম গেছে আজেবাজে চিন্তা করে। ওর চিকিৎসা দরকার। কার সঙ্গে কথা বলবেন তিনি? জয়া সেদিন ফোন করেছিল বহু যুগের ওপার থেকে। জয়ার ফোন পাওয়ার ধাক্কাটা সামলানোর আগেই মেয়ে সম্পর্কে যা শুনলেন প্রভাতরঞ্জন, তার আঘাতটাই বেশি হয়ে দাঁড়াল। জয়া কান্নাকাটি করলেও অভিযোগের স্বরই ছিল জয়ার গলায়। বাবার কাছে আসার আগে মেয়ে তো এমন ছিল না। যেন প্রভাতই মেয়েকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছেন।
নিজে মেয়েকে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবেন, সে সাহস তার নেই। মেয়ের মা বা বর্তমান অভিভাবককে এ ব্যাপারে অনুরোধ করার উপায়ও তার নেই। অসহায়তায় ছটফট করতে থাকলেন তিনি মনে মনে, আর অভিসম্পাত করতে লাগলেন নিজেকে।
এরকম গুমোট পরিস্থিতির মধ্যে মুন্না এল লুচি, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে। আর পিছু পিছু যেন এল বাতাসের হুল্লোড়ও। মুন্না ঘরে ঢুকেই বলল, “কাকুমণি, আমার জামা তোমার মেয়েকে মানিয়েছে তো?”
প্রভাত ততক্ষণে ভাল করে খেয়াল করলেন বিদিশার পরনে মুন্নার পোশাক। তাকে অন্য রকম লাগছে কচি কলাপাতা রঙে। অসুখী মেয়েটা যেন কত ক্লান্ত, এমন ভঙ্গিতে এলিয়ে আছে।
মুন্না বলল, “নে, খেয়ে নে দিদি। তোরা কি ঝগড়া করছিলি? কাকুমণি তোর আসার জন্য দিন গোনে। আর তুই ঝগড়া করছিস?”
বিদিশা চোখ বড় করে শাসন করতে চাইল মুন্নাকে। মুন্না নিমেষে সেই দৃষ্টি উড়িয়ে দিয়ে বলল, “মুন্নার জামা পরে ঝামেলা করা বারণ আছে। কারণ মুন্না কারও সঙ্গে ঝামেলা বাধায় না।”
কোনও ক্রমে বিদিশা বলল, “ঝামেলার কী দেখলি তুই?”
মুন্না সঙ্গে সঙ্গে বলল, “দু’জন দু’দিকে তাকিয়ে, থমথমে মুখে ভাল ভাল কথা বলছিলিস নাকি? আমাকে একটু শিখিয়ে দিবি?”
বিদিশা হেসে ফেলল, “দেব।”
মুন্না বলল, “দাঁড়া, চা নিয়ে আসি। চা আনতে দেরি হলে কাকুমণির মেজাজ ভাল থাকে না। ওর শরীরটাও ভাল নেই ”
মুন্না চলে যেতেই আবার থমথমে হয়ে গেল ঘর। প্রভাতরঞ্জন আলমারির বই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিদিশা হাঁটুতে মাথা রেখে আলুথালু বসে রইল। নীরব এক আকুলতা খেলা করতে লাগল ছোট্ট ঘরে। বিদিশা মনে মনে আদুরে গলায় বলল, “তোমার কী হয়েছে বাবা? কেন শরীর ভাল নেই? চলো, ভাল ডাক্তার দেখাবে।”
প্রভাতরঞ্জনও মনে মনে বলতে থাকলেন, মাম, তোকে ডাক্তার দেখানো দরকার। একবার যাবি? বাস্তবে প্রভাতরঞ্জন বললেন, “খেয়ে নে।”
বিদিশা মুখ ভারী করে বলল, “খাব না।”
প্রভাত জোর করতে জানেন না। বিদিশা একগুঁয়েমি নিয়ে বড় হয়েছে। অচলাবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হবার কারণ ছিল না। কিন্তু কী যে হল! মনের চাপ সহ্য করতে না পেরে একটু পরে দু’জনেই নিজস্ব স্বভাব ভেঙে বেরোলেন। পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ করতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হল। দেখা গেল, কাঁদতে কাঁদতে দু’জন দু’জনকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে।
আবেগ না লুকিয়ে প্রভাতরঞ্জন বললেন, “একটা কথা বলব, মাম?”
বিদিশা আগ্রহে ভরা চোখ তুলে বলল, “অনেক কথা বলো, বাবা। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।”
প্রভাতরঞ্জনের কণ্ঠস্বর কাঁপছে, “হ্যাঁ রে, আমরা দু’জন দু’জনকে ভালবেসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারি না এখন থেকে? আর সব কথা বাদ।”
বিদিশা দু’ ঠোঁট ফাঁক করল, “সব কথা বাদ?”
প্রভাতরঞ্জন বলল, “কারও ওপর রাগ করে লাভ কী? আমার গায়ে অস্তাচলের আলো এসে পড়বে শিগগির। আর, তোর এখন জীবন গড়ে নেওয়ার পালা। দেখাই হল যখন, সময় নষ্ট করা যাবে না একটুও। রাজি?”
বিদিশা উঠে দাঁড়াল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলল, “রাজি।” তারপর দ্রুত এসে বাবার বুকে মাথা রাখল। প্রভাত মেয়ের কপালে এঁকে দিলেন স্নেহচুম্বন। বিদিশা টের পেল ক্ষয়ে আসা মানুষটার হৃদ্স্পন্দন যেন বেড়ে গেল অকস্মাৎ। ভাল লাগছে, তার খুব ভাল লাগছে। আর, নিশ্চিন্ত বোধ করতেই তার খুব ঘুম পেল। বাবার বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে নিমেষে। হাঁটু গেড়ে বসে পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন প্রভাতরঞ্জন।
দুপুরে খেয়েদেয়ে আরও একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বিদিশা কলকাতার উদ্দেশে রওনা হল। যে এসেছিল, আর যে ফিরে যাচ্ছে, যেন তারা দু’জন আলাদা মেয়ে। বাবাকে প্রণাম করে উঠতে উঠতেই সে টের পেল, মাথায় আর কোনও ভার নেই। অসহ্য যন্ত্রণাটা প্রায় উধাও। বাবা তাকে বললেন, “মন দিয়ে পড়াশুনো করবি, ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরবি, কারও প্রতি বিদ্বেষ রাখবি না মনে। আজ লেখার যে-অংশটুকু দিলাম, সেটা আমি কাঁদতে কাঁদতে লিখেছি। কবির মেয়ে, তুই ওটুকু কাঁদতে কাঁদতে পড়বি। তুই তো কবির মেয়ে, কবির মৃত্যু তোকে কাঁদাবে না, তাই হয়?”
ভাল মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বিদিশা বলল, “পড়ব, বাবা।”
প্রভাত বললেন, “তোকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে না। আমি তো তোর জন্যই শেষবেলাটুকু বেঁচে থাকতে চাই—এ কথাটা তুই মনে রাখবি সব সময়। এখান থেকে কলকাতায় রোজ পড়তে যাওয়া মুশকিলের। তোর পড়াশুনোটা শেষ হলেই তুই আমার কাছে চলে আসবি। দায়িত্ব নিতে আমি ভয় পাচ্ছি, ভাবছিস? কাল থেকেই আমি দাদার সঙ্গে আবার ব্যবসার কাজে যাব। আর বসে খাব না।”
বিদিশা খুব আদুরে হাসি হাসল।
প্রভাত মেয়ের কপালে আদরের স্পর্শ দিলেন।
ট্রেন দমদম পেরোচ্ছে, এমন সময় বিদিশার মোবাইল বাজল। দীপ৷
বিদিশা ফোন ধরল।
“হ্যাঁ, বল।”
“তুই কোথায়?”
“আমি কৃষ্ণনগর গিয়েছিলাম, ফিরতে দেরি হল।”
“আমার জন্মদিনে তোর আসার কথা ছিল না?”
“ছিল তো। কিন্তু সব গোলমাল হয়ে গেল রে দীপ।”
“তার মানে?”
“আমার আজ আর যাওয়া হবে না।”
“কখন বাড়ি ঢুকবি?”
“এখনও একঘণ্টা পর।”
“গাড়ি পাঠাই? সবে তো পৌনে সাতটা।”
“না, দরকার নেই। আজ খুব টায়ার্ড লাগছে।”
“তুই না এলে আমার ভাল লাগবে না।”
“হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ…এই তো উইশ করে দিলাম।”
“এত অতিথি। আমি নিজে যেতে পারছি না। অর্কও মেতে গেছে। আয় না, প্লিজ।”
“দীপ, রিকোয়েস্ট করিস না। আজ আমি পারব না।”
“অপমান করলি কিন্তু। ওক্কে!”
রেগে গিয়ে দীপ ফোন কেটে দিল। ওর বার্থ-ডে পার্টি গঙ্গার ধারে এক নামী রিসর্টে। দীপের বাবা বিরাট বিজনেসম্যান। আজ ফুর্তির ফোয়ারা ছুটবে। সকাল অবধি বিদিশা সেই হুল্লোড়ে বিশ্বাস করত। এখন করে না। প্রিয় দেবতা তাকে এক কান্নায় বদলে দিয়েছে। আগে বাবার লেখা রবীন্দ্রনাথের গল্প সে পড়েছে, উপলব্ধি করেনি। আজ নতুন অংশ পড়বে। পুরনো অংশকে ফিরে পড়বে নতুন চেতনা নিয়ে। দীপ ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে, অর্ক নামী অধ্যাপকের সন্তান, তাদের সমাজে দুঃখী, অবহেলিত কবির মেয়েকে মানায় না।
বিদিশা একা-একা উচ্চারণ করল, “বাবা…বাবা…আর একবার আদর করো।”
ঝলমলে কলকাতা শহরে আজ যখন সে পা ফেলল, তখন এক অখ্যাত কবির প্রাচীনগন্ধী ভালবাসা তাকে আগলে আগলে রাখল। সে ভিড়ে মিশে যেতে চাইল না আর। নির্জনতাকে রক্ষা করে যাবে সে। নির্জনতা এক নতুন পাওয়া তার জীবনে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন