জ্বর এবার আর নামছেই না। একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছেন কবি। তবু অপারেশনে মত দিচ্ছেন না। কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ দেখতে এসেছেন রবীন্দ্রনাথকে। বিমলানন্দের ওপরেই কবির ভরসা। কয়েক দিন সকলকে বোঝানোর চেষ্টাও করলেন, আগের থেকে অনেক সুস্থ বোধ করছেন। কিন্তু জ্বর কখনওই একশোর নীচে নামে না। রাতের দিকে বরং বাড়ে। সেই সঙ্গে শরীরের কষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ সারা দিন শুয়েই কাটান এখন। ঘরটি এয়ারকন্ডিশনড করায় অসহ্য গরমের কষ্ট থেকে বাঁচোয়া। সন্ধের পর বারান্দায় এনে তাঁকে বসানো হয়। মাঝে মাঝে ক্ষীণ কণ্ঠে গল্পের প্লটও বলছেন দু’-একটা। সেগুলো লিখে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এরকমই একটি গল্প ‘বদনাম’। ২৩ জুন একটি চিঠি লেখালেন। পরিচয় পত্রিকায় কবির আঁকা ছবি নিয়ে বিশু মুখোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে চিঠি। শরীরে কোনও বল নেই। একা একা এখন নড়তেও পারেন না। জীবনীশক্তি ক্রমশ নিঃশেষিত হচ্ছে। রোজ। তবু সৃজন-চেতনা তখনও কেমন প্রখর, চিঠিটি তার প্রমাণ। এক জায়গায় জানিয়েছেন, “…সাহিত্যের বাহন হচ্ছে ভাষা, ভাষা আপন অর্থ আপনি নিয়ে চলে। সেই অর্থের কৈফিয়ত দিতে হয়। কিন্তু বর্ণবিন্যাস ও রেখাবিন্যাস সে নিস্তব্ধ, তার মুখে বাণী নেই, তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে সে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেয় যে, ঐ দেখো। আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা কোরো না।”
স্তব্ধতাকে এতকাল ধ্যানে অর্জন করেছেন কবি। এবার যে পারিপার্শ্ব এমনই স্তব্ধ হয়ে আসছে। নীরবতা খেলা করছে সর্বত্র।
আষাঢ়ের মেঘ এসেছে জীবনে শেষবার। সেই রূপ দেখবার জন্য রবীন্দ্রনাথ অস্থির হয়ে উঠলেন। প্রতিমা দেবী ব্যবস্থা করলেন তাঁকে উত্তরায়ণের দোতলায় নিয়ে আসার। এখানকার জানালায় বড় আকাশ। কিন্তু এই বিশেষ অনুগ্রহ যেন তিনি নেবেন না। কাউকে বিব্রত হতে দেবেন না। কিছুতেই যাবেন না। জেদ ধরে বসে রইলেন। অনেক পীড়াপীড়ি করে তাঁকে রাজি করানো হল। একদিন ঝর ঝর করে তাঁর ক্লান্ত চোখের সামনে বৃষ্টি নামল। মনে চঞ্চলতা এল। শরীরে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে।
তারপর আধো ঘুমে প্রবেশ করল বৃষ্টি, গভীর ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেল। পুনরায় নির্জীব হয়ে পড়লেন যেন কবি।
ডাক্তার রামচন্দ্র অধিকারী, ডাক্তার জিতেন্দ্রনাথ দত্ত, ডাক্তার ইন্দুভূষণ বসু, ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়রা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে রবীন্দ্রনাথকে জানিয়ে দিয়েছেন, “আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”
কোনও আলোচনাই রবীন্দ্রনাথের সামনে হয় না। কিন্তু তিনি প্রখর ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুমান করে নেন। বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। একদিন কবিরাজ বিমলানন্দকে ডেকে বললেন, “সবাই তো শরীরটা কাটা-ছেঁড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দাও না একটা ভাল ওষুধ, সেরে যাই।”
বিমলানন্দ বললেন, “আমি সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা চালাচ্ছি।”
বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথ বললেন, “কোনও না কোনও ভাবে এই শরীরের তো শেষ হবে। তা এইভাবেই হোক না কেন! কী ক্ষতি তাতে?”
বিমলানন্দ সান্ত্বনা দেওয়ার মতো জানালেন, “আপনার মনের যা জোর, ভাল হয়ে যাবেন। অপারেশনের কোনও দরকার হবে না।”
বেশ খুশি হলেন রবীন্দ্রনাথ, “আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি না, কবিরাজ?”
বিমলানন্দ বললেন, “অনেক ইম্প্রুভ হচ্ছে সেটা ঠিক।”
কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ সাংবাদিকদের জানালেনও এই কথা, “কবির অবস্থা মোটেও আশঙ্কাজনক নয়। তাঁর স্বাস্থ্যের কোনও অবনতিও হয়নি। অতি দুর্বলতার জন্য মাঝে মাঝে স্বাস্থ্যের অবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।”
এতদিনে ডাক্তার রামচন্দ্র, ডাক্তার ইন্দুভূষণ, রবীন্দ্রনাথের পরিবারের বন্ধু জ্যোতিঃপ্রকাশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অপারেশনই করাতে হবে। ইন্দুভূষণ বিখ্যাত অস্ত্রচিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখানে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিয়েছেন। ললিতবাবু শিলঙে আছেন। সেখান থেকে ফিরলেই তাঁকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হবে। তারপর ঠিক হবে অপারেশনের দিন। জ্বর কমাবার জন্য অটোভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
একদিকে কবিরাজ বলছেন, “আপনার নাড়ি খুব ভাল দেখছি”, অন্য দিকে ইন্দুবাবুরা বলছেন, “সার্জারি ছাড়া আর কিছু অসম্ভব”— রবীন্দ্রনাথ অদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে রোগশয্যায় পড়ে আছেন।
কবির জন্যে পালা করে সেবক-সেবিকারা ডিউটি দেন। ডাক্তার দীননাথ চ্যাটার্জি কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে চাকরি নিয়ে এসেছেন। তরুণ এই ডাক্তারের মূল দায়িত্ব কবির অবস্থা সম্পর্কে কলকাতার ডাক্তারদের ওয়াকিবহাল রাখা। তিনি রোজ নাড়ি দেখতেন, জ্বর মাপতেন—এইসব। আর কিছু চিকিৎসার সুযোগ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেননি। কিন্তু কবি ওঁকে নিয়ে স্নেহবশত অনেক মজা করতেন। ডাক্তারও চাকরি বিস্মৃত হয়েছিলেন একসময়। হয়ে পড়েছিলেন সর্বক্ষণের সেবাকর্মীদের একজন।
একেবারে জরদ্গব পরিস্থিতি হওয়ায় নানা কাণ্ড হতে লাগল। অন্যের কাছে কবির এই মর্মান্তিক পরিস্থিতি দুঃখের হলেও রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিয়ে কৌতুকে মাততেন। একদিন রাতে তাঁর বিছানা থেকে ওঠার দরকার হল। রাতের ডিউটিতে ছিল ভদ্রা নামে একটি মেয়ে। ডাক্তার দীননাথ তো ছিলেনই কাছেপিঠে। কবির ডাকে তাঁরা এসে তাঁকে যখন মাটিতে নামালেন, কবির দু’পায়ে কোনও জোর নেই। তিনি বসে পড়ছেন। তাঁকে ওঁরা টেনে তুলছেন। কোনও ক্রমে কবিকে গন্তব্য পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া গেল। বিছানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল ওভাবেই টেনেটুনে। কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে আবার ওঠার প্রয়োজন হল কবির। ভদ্রাকে ডেকে আর পাওয়া গেল না। দীননাথ একাই কবিকে তুলে নিয়ে গেলেন। সারারাত দীননাথ জেগে থেকে কবিকে পাহারা দিলেন। পরদিন সকালে আবার ভদ্রা আর রানী চন্দের ডিউটি। ভদ্রাকে দেখেই কবি হাসতে লাগলেন। বললেন, “কী গো ভদ্রে, কাল রাতে খুব বিপদ হয়েছিল তোমার, না? যত টেনে তুলছ, তত বসে পড়ছি। শেষকালে কোনও মতে বিছানায় দিয়েই পালালে! পরে ডেকে দেখি, ভদ্রা অভদ্রা কেউই কাছে নেই। ডাক্তার একাই সব করল।” এর পর সবাইকে তারিয়ে তারিয়ে কবি বললেন রাতের দুর্গতির কথা। এত বড় একজন মানুষ, বয়সকালে তাঁর এ কী ভোগান্তি! উপস্থিত কেউই হাসিতে অংশ নিতে পারছেন না। কিন্তু কবির ছেলেমানুষি আনন্দের যেন শেষ নেই।
সকাল সাতটা থেকে ন’টা ভদ্রা আর রানী চন্দের দায়িত্ব। তাঁদের পালা শেষ হলে নন্দলাল বসুর ছেলে বিশ্বরূপ ওরফে বিশু আর বুড়ি (নাতনি নন্দিতা) কবিকে স্নান করানোর ব্যবস্থা করতেন। একজন শিক্ষিত নার্স ছিলেন। তিনি ইংরেজ মেয়ে। কবি নাম রেখেছিলেন ‘বাসন্তী’। তিনি কবিকে তেল-মালিশ করে দিতেন। অন্তর্মুখী মেয়েটিকে কবি বিশেষ পছন্দ করতেন না। প্রতিমা দেবী মেয়েটিকে খুব স্নেহ করতেন। সম্ভবত ভাষার কারণে কবির রসিকতা বুঝতেন না, হাসিখুশি থাকতেন না, এটাই কবির অপছন্দের কারণ।
ইতিমধ্যে তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে খবর পেয়ে স্নেহধন্যা রানী মহলানবিশ শান্তিনিকেতনে চলে এসেছেন। তিনি স্বামী প্রশান্তের সঙ্গে গিরিডিতে শরীর সারাতে গিয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথের চিঠি পেয়ে তাঁরা দ্রুত এসে হাজির হয়েছেন। রানীকে দেখে প্রতিমা দেবী বললেন, “যাক, এসে গিয়েছ। বাবামশায় তোমাকে কাছে পেলে খুব খুশি হন।”
রানীর তো আর এখন খুশির কিছু নেই। তাঁর মন কুডাক ডাকছে। রবীন্দ্রনাথকে দেখেই ছ্যাঁৎ করে উঠল তাঁর বুক। পঁচিশে বৈশাখ দেখে-যাওয়া সেই চেহারাটাও কবি হারিয়ে ফেলেছেন। একদম ফ্যাকাসে লাগছে কবিকে। কপালে গভীর রেখা, গালের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে, চোখের দৃষ্টি যেন নিষ্প্রভ। কী এক ব্যথায় টনটন করে উঠছে অন্তর। চলে যাবেন? এবার তবে চলে যাবেন কবি?
কবির ঘরের ঠিক নীচেই তিনি অতিথি হলেন। পাশেই জাপানিঘরে মীরাদেবী থাকেন। চারপাশে সবাই অসাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন যেন সবাই আলো হারিয়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন। প্রধান মানুষটি এমন রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন দীর্ঘদিন, কারও মনে আনন্দ নেই। সবাই কর্তব্য করছেন প্রাণপণ। কিন্তু যেন কোনও ভরসা পাচ্ছেন না। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবীর শরীরও ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু পুরো চাপটা তো তাঁদেরকেই নিতে হচ্ছে। কবিকে একটু সঙ্গ দেওয়া ছাড়া রানী আর কীই বা করতে পারেন! স্বামী প্রশান্ত তবু রথীন্দ্রনাথ ও ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শে বসার সুযোগ পান।
এক সকালে রবীন্দ্রনাথ আপনমনে কত কিছু বলে যেতে থাকলেন। ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, জড়িয়ে যাচ্ছে উচ্চারণ। রানী চন্দ যতটা পারলেন, লিখে নিতে থাকলেন। স্রোতের মতো বলে যাওয়া কথা লেখায় ধরে রাখা এমনিতেই কঠিন। বলছেন, “…মেয়েরা যে শুধু শুশ্রুষা করে তা তো নয়, একটু বেশিই পাই—তা হল সান্ত্বনা। বয়স বেশি হলে মনটা যে শিশু হয় তা এখন বুঝতে পারি, কারণ মায়ের স্নেহ পেতে ইচ্ছে করে। এই বয়সে না পৌঁছলে এই এক্সপেরিয়েন্সটা আমার হত না। মামণি (প্রতিমা দেবী) শান্তিনিকেতনে কোনও কারণে না থাকলে নিজেকে মাতৃহীন অসহায় মনে হয়।”
জীবনের সেইসব দিনগুলো, যা কেবল কল্পনা আর সৃজনে কাটত, সেসব এখন আচ্ছন্ন করে রেখেছে কবির শেষবেলার মন। কত দূর উড়ে এসেছে পাখি, এখন যেন মনে পড়ে যাচ্ছে ফেলে আসা কবেকার আকাশ! বড় মানুষের কান্না থাকে গভীরে, গোপনে। সহজ, সরল যে শিল্পী-জীবনটা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন, আর কোনও দিন যে-জীবনের কাছে পৌঁছানো হয়নি, তাকে তিনি যখন উচ্চারণ করেন, সে একরকম কান্নাই। রবীন্দ্রনাথ ঘোরগ্রস্ত হয়ে বলে চলেছেন প্রিয় সেবিকাদের সামনে, “..শিলাইদহের দিনগুলো…প্রতিদিন বোটে বসে চেয়ে চেয়ে দেখেছি—ঋতুর পর ঋতু বদল হচ্ছে। হাঁসের দল উড়ে চলেছে, জলে বুঝি তার ছায়াও পড়ে না…ধু ধু করছে বালির চর। শীতের সোনারোদ ছড়িয়ে পড়েছে…বোটের জানলা দিয়ে কখনও শুধু তাকিয়ে আছি…দু চোখ ভরে দেখছি…কখনও বা লিখছি। সারাদিন চুপচাপ নির্জন…সেদিন শুধু ছিলুম আমি আর আমার মন। কখনও সন্ধ্যায় একা একা নদীর চরে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় দূরে চলে যেতুম। হঠাৎ খেয়াল হত রাত অনেক হয়েছে, ফিরে আসতুম তখন। অন্ধকার…আকাশভরা তারা…দূরে বোটের আলো…নিজেকে ভাবতুম অজানা এক আগন্তুক। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখেছি জানলার ওপাশের দিগন্তে জ্বলজ্বল করছে শুকতারা…সেও যেন নিসঙ্গ। বর্ষার আকাশে ঘন মেঘ…দূরে ঘন সবুজ গ্রাম…বৃষ্টি নেবে এল…বোটের তলায় ধাক্কা দিচ্ছে নদীর ঢেউ…সে আসছে…তারই আগমনবার্তা দিকে দিকে…কত গান এসেছে তারই পিছু পিছু…”
সত্যিই আজ কেউ এসেছে কবির মনে। পারিপার্শ্ব তাকে জানবে কী করে? কিন্তু কেউ না এলে হঠাৎ কবি এমন ঝর্না হয়ে উঠলেন কী করে? ইদানীং কথা বলেন থেমে থেমে। কত কথা মনে পড়ে না। অধৈর্য হয়ে শ্রোতাকেই বলেন, “আঃ, বলো না কী বলতে যাচ্ছি”। আজ দু’ ঘণ্টার ওপর একটানা বলে গেলেন। বিশ্বযুদ্ধের বেদনার কথাও একটু বললেন। অকপট স্বীকারোক্তির মতো শেষে জানালেন, “যদি এখন কেউ এসে বলে—রবীন্দ্রনাথ, তোমার এই দণ্ডমুকুট খসিয়ে নিয়ে যদি তোমাকে শিলাইদহের অখ্যাত দিনগুলি শুধু ফিরিয়ে দিয়ে যাই, রাজি হবে? তখন কিন্তু আমি বলব, ‘না।’ এই খ্যাতি, এই সম্মান, এই দায়ভার, এসবের মোহ আমার নেই, সেকথা তো মিথ্যা, এটাও চাই, ওটাও চাই। মানুষের মন কী মজার!”
বুড়ি আর বিশু চলে এলেন ইতিমধ্যে। স্নান করানোর সময় হয়েছে। ইংরেজ নার্স তেল-মালিশ করতে লাগলেন। বাধ্য হয়ে কথা বন্ধ করলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবিকে একটু অস্থির দেখাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই ছটফট করছেন। যেন কথা শেষ হয়নি। যেন না-বলা কথা এসে বেগ দিচ্ছে। শারীরিক কষ্ট থেকে দূরে থাকার জন্যই যেন কবি উড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজের মন। যদিও কবিরাজের চিকিৎসায় তিনি ভাল আছেন, কিন্তু অন্যরা তা বিশ্বাস করছে না বলেই কবির মনে হয়। অপারেশনেই অধিকাংশের মত। সবাই কবিকে ওই দিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। নিদারুণ উদ্বেগে ভরে আছে কবির মন। যথাসম্ভব সেই সব উদ্বেগকে দূরে সরিয়ে রাখবার জন্য তিনি ডানা মেলতে চাইছেন অন্তরের অন্তঃপুরে।
কবিরাজ মশাই প্রথমে কবির লিভারের চিকিৎসার কথা ভেবেছেন। লিভারটা ভাল হয়ে উঠলে অন্য ব্যাধিরও প্রকোপ কমবে। মাছ-মাংস বাদ তাই। সেদ্ধ গোছের খাবার। কোনও দিনই বেশি খেতেন না রবীন্দ্রনাথ। এখন খাওয়া একদম পড়ে গেছে। চালকুমড়োর পায়েস দেখে তো আরও অনিচ্ছা। কেবলমাত্র অপারেশনের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই যেন এক চামচ তুলে মুখে দিলেন।
কবিরাজ বিমলানন্দ ওষুধপত্র বুঝিয়ে সহকারী কমলাকান্ত ঘোষকে। শান্তিনিকেতনে রেখে গিয়েছেন। দরকার পড়লেই তিনি মাঝে মাঝেই কলকাতা থেকে চলে আসছেন। রবীন্দ্রনাথ তো ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন। কিছুক্ষণ পর-পরই ছোট কবিরাজকে খবর পাঠান। ভদ্রলোক আসতে একটু দেরি করলেই তাঁর মেজাজ রুক্ষ হচ্ছে। যত এরকম হচ্ছে, তত প্রমাদ গুনছেন সেবক-সেবিকারা। রথীন্দ্রনাথ সেদিন দেখা করতে এলেই কবি বললেন, “রথী, কবিরাজ তো বলছেন যে তিনি খুবই আশা করেন তাঁর ওষুধেই আমাকে ভাল করে তুলবেন। তবে একটু সময় লাগবে। আঃ! বাঁচি যদি কাটাছেঁড়া না করতে হয়।”
রথীন্দ্রনাথ আর কী বলবেন? ডাক্তাররা অপারেশনের তারিখ দ্রুত স্থির করতে চান। সেই ব্যাপারেই কলকাতা যাওয়ার আগে তিনি বাবাকে প্রণাম করতে এসেছিলেন। পুরো ব্যাপারটা আন্দাজ করেই রবীন্দ্রনাথের এই আকুতি। গম্ভীর ও চিন্তিত মুখে রথী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দৃশ্যটা সহ্য করা তাঁর পক্ষে খুবই কঠিন। কোনও দিন রবীন্দ্রনাথের মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার কথা তাঁর স্বপ্নেরও বাইরে। কিন্তু এখন তো রবীন্দ্রনাথের জীবন-মরণ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। আর, তিনি তো এক্ষেত্রে একা নন। দেশবাসীর সম্পত্তি এখন বিশ্বকবি। সবাই তাঁর দ্রুত আরোগ্য চান। পরিণত-বয়সের কবিকে তাঁরা বাঁচিয়ে রাখতে চান আরও অনেক দিন। একমাত্র ডাক্তার নীলরতন সরকার ছাড়া সব প্রথিতযশা চিকিৎসকই অপারেশনের পক্ষে। রবীন্দ্রনাথের মনোভাব তাঁকে বিচলিত করলেও তিনি আশু কর্তব্যের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে চাইলেন। বাতিল করলেন না কলকাতা যাত্রা। আর বিলম্ব অনুচিত হবে।
রথীন্দ্রনাথ কলকাতায় আসার পর বিমর্ষ কবি ভেতরে-ভেতরে কি একটু ভেঙে পড়লেন? নতুবা তাঁর অবস্থা কিছুটা ভাল হয়েছিল ক’দিন, হঠাৎ তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেন আবার? খবর পেয়ে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে রওনা হলেন। রাতে প্রবল আচ্ছন্নতার ভেতর রবীন্দ্রনাথ কী সব বলতে লাগলেন। চমকে উঠে লণ্ঠনের আলোয় সেই টুকরো টুকরো কথা লিখছিলেন সেই রাতে তাঁর ঘরে ডিউটিতে থাকা রানী মহলানবিশ। অস্পষ্ট জড়ানো কথা…আওয়াজ ক্ষীণ..সবটা ধরে রাখতে পারলেন না রানী। অর্ধেক ঘুমের ভেতরেও রবীন্দ্রনাথ যেন সেবিকাদের কাণ্ড টের পান। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। অথবা মহাপুরুষদের অনেকেরই মতো আপন মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সব জানা ছিল। কবিতা বলা শেষ হলে তিনি জাগরিত হলেন। রানী সাহায্য করতে এগিয়ে এলে বললেন, ‘লিখে নিচ্ছিলে? ও কিছু না। এমনি মনে এল, তাই বলে গেলুম। …দাও এবারে গুলকুশ খাওয়াও একটু। আমার লীলমণি ভাল নাম দিয়েছে— গুলকুশ!”
সকালে কবি লিখলেন কবিতা। তাঁর মনে ছিল সবটাই। নিজের জীবনের শেষটুকু নিজেই নির্মাণ করছেন এভাবে। জীবনের শেষ পর্বের সঙ্গীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এই কবিতায়:
বহু লোক এসেছিল জীবনের প্রথম প্রভাতে
কেহ বা খেলার সাথী, কেহ কৌতূহলী,
কেহ কাজে সঙ্গ দিতে, কেহ দিতে বাধা।
আজ যারা কাছে আছে এ নিঃস্ব প্রহরে,
পরিশ্রান্ত প্রদোষের অবসন্ন নিস্তেজ আলোয়
তোমার আপন দীপ আনিয়াছ হাতে,
খেয়া ছাড়িবার আগে তীরের বিদায়-স্পর্শ দিতে।
তোমরা পথিক বন্ধু,
যেমন রাত্রির তারা
অন্ধকারে লুপ্তপথ যাত্রীর শেষের ক্লিষ্ট ক্ষণে৷৷
ক’দিন পরে কবির প্রিয় বিবি অর্থাৎ ইন্দিরা দেবী এলেন কবিকে দেখতে। ইন্দিরা দেবী ও প্রমথ চৌধুরী। কবি বিবি এসেছেন বলে খুব খুশি। বিবিকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলেন। যেই দেখতে পেলেন এক সময় ইন্দিরা দেবী দক্ষিণের বাগানে ঘুরছেন, শরীর ভুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই, তুই ওপরে না এসে বাগানে কী করছিস? আমি বসে আছি কখন থেকে তোর জন্য, আর তুই আমার কাছে না এসে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! ওপরে আয়।”
ইন্দিরা দেবী আদতে প্রমথ চৌধুরীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একটু পরে প্রমথবাবু তৈরি হয়ে নিলে দু’জনে কবির ঘরে এলেন। খুব গল্প হল। ঝলমলিয়ে উঠলেন কবি কিছুটা। প্রমথ চৌধুরীর শরীরের অবস্থা দেখে উদ্বেগও প্রকাশ করলেন।
মৈত্রেয়ী, মীরা, প্রতিমা, রানী চন্দ, রানী মহলানবিশ—কেউ কন্যা, কেউ বউমা, কেউ স্নেহের পাত্রী—এঁরা কাছে থাকলে রবীন্দ্রনাথ কৌতুকে মেতে ওঠেন, অবশিষ্ট জীবনীশক্তিটুকু প্রকাশিত হয়।
এর মধ্যে একদিন ইন্দিরা নতুন স্টাইলে মৈত্রেয়ীর চুল বেঁধে দিচ্ছেন। কবি দিলেন এক ফুলেল তেলের শিশি। মৈত্রেয়ী খুব লজ্জা পাচ্ছেন। কবি সেই লজ্জা উপভোগ করছেন খুব। বললেন, “ফুলেল তেলের শিশিটা মামণি আমার জন্যে আনিয়েছিল। আমি গায়ে মাখব, তাই। এই বয়সে তা কি আর মানায়! তাই ওটা দান করলুম। মংপুতে থাকার সময় অনেক খরচ হয়েছে আমার জন্য, এইভাবে যদি কিছু শোধ হয়!”
রসিয়ে-বসিয়ে বলছেন কবি, লজ্জারুণ মৈত্রেয়ী প্রসাধন শেষ হতে কোনও রকমে পালিয়ে বাঁচলেন। সবাই খুব হাসল।
এইসব আনন্দের মুহূর্ত বেশিক্ষণের জন্য নয়। পরে-পরেই কবির জ্বর বাড়ত, বেড়ে যেত শরীরের কষ্ট। নিজেকে নানাভাবে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতেন প্রাণপণ। কিন্তু রাত্রি নেমে এলেই আর কিছুই ভান টিকত না। কষ্ট পেতেন রবীন্দ্রনাথ। বিধানচন্দ্র রায় জরুরি তাগিদে এসে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে গম্ভীর মুখে কলকাতায় ফিরে গেলেন একদিন। সংবাদপত্রে গভীর আশঙ্কার কথা প্রচারিত হল।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা কবিকে গিয়ে কে বলবেন, তাই নিয়ে সমস্যা। শেষ পর্যন্ত একজন শুভানুধ্যায়ী তাঁকে গিয়ে বললেন, “কলকাতার ডাক্তাররা মনে করছেন, আপনার অপারেশনটা করিয়ে ফেলাই ভাল। শরীর থেকে বিষটা বেরোচ্ছে না বলেই জ্বর কমছে না, এত দুর্বল হয়ে পড়ছেন আপনি। অপারেশন করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মাথার কাজ আবার স্বচ্ছন্দে দশ বছর চালিয়ে যেতে পারবেন। ব্যাপারটা তো একটা ফোঁড়া কাটার মতো। তাই বিধানবাবুরা সবাই রথীবাবুকে বলেছেন, অপারেশনটা এখনই হয়ে যাক।”
কবি ঝিমিয়ে রইলেন। তিনি জানতেন, তাঁর যারা ভাল চায়, তারা তাঁর মত অগ্রাহ্য করবেন। তবু যেন আশাও ছিল, কবিরাজমশাই নিশ্চয়ই তাঁকে অস্ত্রের হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন। বলেও ফেললেন কথাটা, “কবিরাজমশাই তো মনে করছেন, সারাতে পারবেন। মিছিমিছি কাটা-ছেড়া…”।
শুভানুধ্যায়ী মাথা চুলকে বললেন, “ঠিক আছে। আজই তো আর অপারেশন হচ্ছে না। এক মাসের মধ্যে কবিরাজমশাই যদি ব্যাধিটিকে সারিয়ে দিতে পারেন বা অনেকটা কমিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আর অপারেশনের দরকার হবে না।”
রবীন্দ্রনাথ কবিরাজ বিমলানন্দের সাহায্যকারী ছোট কবিরাজ কমলাকান্তকে ডেকে পাঠালেন। কমলাকান্ত এলে তাঁকে বললেন, “দ্যাখো হে, ডাক্তারদের সঙ্গে লড়ে এক মাস সময় নেওয়া গিয়েছে। এইবার ছাড়ো তোমাদের ব্রহ্মাস্ত্র। এক মাস মোটে সময়—এর মধ্যে যেমন করে পারো লেগে আমাকে অস্ত্রাঘাত থেকে রক্ষা করো।”
কমলাকান্ত তাঁকে জানালেন, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এই ক’দিন নানা ভাবে ওষুধ দিয়ে আপনাকে পরীক্ষা করা হল। এবার বিমলানন্দ আপনার রোগের চিকিৎসা আরম্ভ করবেন।”
রবীন্দ্রনাথের তারপর খুবই উৎসাহ। থেকেই থেকেই জানাচ্ছেন সেবিকাদের, ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। চেয়ে খাচ্ছেন পায়েস। বুড়ির জন্মদিনে ভোরবেলায় কবিতা লিখে উপহার দিলেন। আঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে যেন। অনেক পরিশ্রমে লেখা শেষ করলেন। প্রচণ্ড আবেগগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। দু’চোখে বিষাদ ঘনাল। বললেন, “আমি আর পারি না। বিধাতা আমার সব শক্তি কেড়ে নিলেন।… আগে কত অজস্র লিখেছি, আর আজ অতি কষ্টে এইটুকু লিখতে পারলুম। আঙুলের জন্য হাতের অক্ষরগুলো পর্যন্ত পরিষ্কার হল না। বিধাতাকে দত্তাপহারক বলতে ইচ্ছে করে।”
শরীরের সঙ্গে সঙ্গে এবার মনও ভেঙে যাচ্ছে কবির। তবু কতর্ব্যজ্ঞান, দায়িত্বজ্ঞান টনটনে।
অবনীন্দ্রনাথের সত্তর বছর বয়স হবে আর ক’দিন পরেই। কবি সেটা পালন করবার জন্য সকলকে বলছেন। মুখে বলে সুধাকান্তবাবুকে দিয়ে তিনি লিখিয়ে রাখলেন অবনীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর বক্তব্য। পরে যদি সময় না পান। যদি নিভে যান যে-কোনও মুহূর্তে। অবনীন্দ্রনাথের অনেক কথা রানী চন্দ কবির নির্দেশে লিখেছিলেন। তাই দিয়ে ঘরোয়া’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হবে। কবি রানী চন্দকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “তুই কলকাতায় অবনের কাছে চলে যা। ঘরোয়া-র জন্য আরও কয়েকটি গল্প অবনের মুখ থেকে আদায় করতে হবে।”
রানী মৃদুকণ্ঠে বললেন, “এখন আপনাকে ছেড়ে যেতে মন যে চায় না, গুরুদেব।”
অধৈর্য রবীন্দ্রনাথ বললেন, “সময় নেই, রানী। তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস, যা।”
রানী গুরুদেবের আদেশ অমান্য করবেন কী ভাবে? যখন স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হবেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে বিদায় চাইতে গেলেন। কবিকে প্রণাম করে কৌচ ঘেঁষে বসলেন রানী। শরীর এমন ভার হয়ে গেছে বেদনায়, উঠবার শক্তিটুকু যেন রানীর নেই। তাঁর মন কেঁদে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ যেন আজ রবীন্দ্রনাথের ছায়াশরীর। রানীর পিঠে হাত রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। আস্তে আস্তে বললেন, “অবনকে গিয়ে বলিস আমি খুব খুশি হয়েছি। জীবনের যেসব ঘটনা ভুলে গিয়েছি, তা অবনের মুখে এমন করে ফুটে উঠবে, তা কখনও মনে করিনি। সাবধানে যাস।”
রানী গুরুদেবের পায়ে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদলেন। কান্না এখন নিঃশব্দই শান্তিনিকেতনের বাতাসে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন