চাঁদের আলো

জানলা খুলতেই কুয়াশামাখা কনকনে ভোর ছুঁয়ে দিল বিদিশাকে। প্রান্তিকের এই দিকটাতেও এখন প্রাসাদ উঠেছে, তবু দূরে দিগন্তছোঁয়া মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। তালগাছওয়ালা একটা গ্রাম রয়েছে পাশেই। অনেকটা জায়গা নিয়ে রিসর্টটা। নামও সুন্দর—‘দিগন্ত’। দুপুরে ওরা কোপাই নদীর কাছে যাবে। এখন ছুটবে শান্তিনিকেতনে। খুব সকালেই বসন্তোৎসবের অনুষ্ঠান শুরু হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা সেজেগুজে এতক্ষণে জড়ো হচ্ছে ছাতিমতলায়। এই প্রথম স্বাধীন দোল এসেছে বিদিশার জীবনে। সে একটু কেঁপে উঠল ভিতরে-ভিতরে। বাবার লেখা বেশ কিছুটা তার সঙ্গেই আছে। রবীন্দ্রনাথের শেষ বসন্তোৎসব বন্দিদশায় কেটেছে, বিদিশা পড়ে জেনেছে। তার স্বপ্নের মধ্যে কাল রাতে রবীন্দ্রনাথ আসতেই পারতেন। কিন্তু অন্যজন এল। বাবা। বিদিশার অসুস্থ দেবতা। দু’চোখে অসীম ভালবাসার অশ্রু জমিয়ে বিদিশা আপনমনে ডাকল, “বা-বা!”

তখন ঘরেও কুয়াশা নামল। বিদিশা বলল, “বাবা, বাবা, তুমি ভাল থেকো।”

কুয়াশার ভেতরে বেদনা থাকে। দূরাগত উত্তর এল, “তুই ভাল থাকিস। খুব বড় হ’।”

“আমি ভালও থাকব না, বড়ও হব না, বাবা।”

“কী হয়েছে তোর? কেন এমন বলছিস?”

“আমি নষ্ট হয়ে যেতে চাই। আমার কিছু ভাল্লাগে না।”

“এমন বলতে নেই, মামণি। ভোরবেলাটা বড় পবিত্র। ভাল করে কান পাতবি, ঠিক শুনতে পাবি সরস্বতী নূপুর বাজিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। মামণি…”

“বলো, বাবা।”

“কেন কষ্ট পাচ্ছিস?”

“মাকে আমি ক্ষমা করতে পারি না। আমি নষ্ট হয়ে মা’র মুখ পোড়াব।”

“আমি কি তোকে একবার বকতে পারি?”

“না। তুমি শুধু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে পারো।”

“ঠিক আছে। এবার যেদিন আসবি, তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।”

“ইঃ! এখন কি আমি ছোট্ট নাকি! কত্তো বড় হয়ে গিয়েছি।”

“বড় যখন হয়েছিস, আমি বকুনি দিতেই পারি।”

“কেন? কী করেছি আমি?”

“মা’কে নিয়ে কোনও খারাপ কথা কখনও ভাবতে নেই।”

“জয়শ্রীকে আমি মা বলে মানি না।”

“আমি সাক্ষী, জয়শ্রীই তোর মা। নার্সিংহোম থেকে জয়শ্রী আর তোকে আমিই বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। সেদিনের ছবি আমার কাছে আছে।”

“বাবা, প্লিজ পুড়িয়ে ফ্যালো সেই ছবি।”

“কেন রে? মা’র ওপর তোর এত রাগ কেন?”

“মা’র জন্যই আমি বাবাকে হারিয়েছি। ও একটা ডাইনি!”

“ভোরবেলায় ভাল ভাল কথা ভাব। নিজেও কষ্ট পাস নে। আমাকেও কষ্ট দিস নে। তুই কি জানিস, তোর জন্য আমি আবার লিখছি?”

“তাই বাবা?”

“হ্যাঁরে। আর তো লিখতে ভাল লাগত না। পড়তে পড়তে ঘুমোতাম…ঘুম থেকে উঠে আবার পড়তাম…কোনও ক্রমে দিন কেটে যেত। তুই এলি, বললি, আবার কেমন লেখার ইচ্ছে হল। ক’দিন চেষ্টা করে দেখলাম, লেখা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে কবে। মন খারাপ হয়ে গেল। তোর জন্য তাহলে কিছুই লেখা হবে না? তারপর রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলো নিয়ে যা পড়েছি, তা-ই তোকে উপহার দেব ঠিক করলাম। কিছুটা সেদিন তুই নিয়ে এসেছিলি, বাকিটা আমি একটু একটু করে লিখছি। তোকে পাঠিয়ে দেব কিংবা তুই পারলে এসে নিয়ে যাবি। বল তো, রবীন্দ্রনাথের এত কিছু থাকতে তাঁর মৃত্যুই কেন তোকে পাঠাচ্ছি?”

“কেন বাবা?”

“কারণ রবীন্দ্রনাথ একজন মহামানব। তাঁর মতন আর কেউ না। তাঁর মৃত্যুকে যদি তুই জানিস, মনে ধরে রাখিস, তবে তোর ভেতরে নতুন এক শক্তি জন্মাবে। তুই ক্ষুব্ধ হবি, বেদনাহত হবি, কিন্তু অকারণে আর নিজেকে ক্ষইয়ে দিবি না কোনও দিন। কিছু বুঝলি?

“আমি বুঝতে চাই না। রবীন্দ্রনাথ আমার কে? রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু আমাকে ছোঁবে না।”

“এমন বলিস না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেবতা।”

“রবীন্দ্রনাথ আমার কেউ না। তুমি আমার দেবতা। তোমাকে যারা অসুস্থ করেছে, তাদের আমি দেখে নেব। মাস্ট।”

“তবে আর একটা কথা শোন। আমি আর বাঁচতে চাই না। মৃত্যুর আগে তোকে পাব, তা কোনওদিন আশা করিনি। তোকে যে ফিরে পেলাম, এ একেবারে যেন দৈব ঘটনা। তো কথাটা কী জানিস? খুব লজ্জা লাগছে। বলতে, এই মৃত্যুর লেখাটায় একজন সফল কবির মৃত্যুর ভেতরে আমার মতো একজন ব্যর্থ কবির মৃত্যুও মিশে থাকছে কিন্তু।”

“বাবা!”

“মন দিয়ে পড়িস লেখাটা, মামণি। কবে আসবি?”

আচ্ছন্নতা ধ্বংস করে ডোরবেল বেজে উঠল। বিদিশা দেখল, কুয়াশা উধাও। ঘরেও। জানলার বাইরেও। মনে পড়ল, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে হবে। দরজা খুলে সে দেখল, অর্ক দাঁড়িয়ে। গায়ে চাপিয়েছে প্রচুর। বিদিশা বলল, “সরি। এখুনি রেডি হয়ে নিচ্ছি। দীপ কই?”

অর্ক বলল, ‘ঘুমোচ্ছে। আমি তোকে ওর আগে গুডমর্নিং বলতে এসেছি রে।”

বিদিশা অন্যমনস্ক হল, “লাভ?”

অর্ক হাসল, “তুই কী রে দিশা? সাতসকালেও খিঁচোচ্ছিস?”

বিদিশা সাড়া দিল, “উঁ?”

অর্ক বলল, “তুই খুব জটিল। গুডমর্নিং বলতে এলাম!”

বিদিশা দূর থেকে যেন ফিরে এল। হেসে বলল, “ও ইয়েস। গুডমর্নিং।”

অর্ক নিজের রুমের দিকে এগোল। হঠাৎ ফিরে বলল, “এই দিশা, শোন। তোকে এত মিস্টিরিয়াস লাগে! তুই আমাদের সঙ্গে এলি কেন?”

দিশা ভ্রু কুঁচকাল। বলল, “আমরা তিন বন্ধু শান্তিনিকেতনে এসেছি দোল খেলতে।”

অর্ক একটু শ্লেষ মিশিয়ে উচ্চারণ করল, “বন্ধু? মনে তো হচ্ছে তুই বেড়াতে এসেছিস, আমরা দু’জন এসেছি তোর সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে।”

দিশা ভেতরে ভেতরে একটু খেপে গেল, “সেটা তোর মনের সমস্যা। কাল রাতে তোর সঙ্গে থাকিনি বলে এত রাগ! অভিযোগ করছিস!”

অর্ক দৌড়ে এসে বিদিশার হাত ধরল, “এঃ! তুই সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস। তুই গুছিয়ে নে। তোর জন্য পলাশফুলের মালা কিনে এনেছিলাম রাতে, নিয়ে আসছি আমি। গলায় পরবি।”

ঘরে ফিরে বিদিশা আবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রোদ্দুর। কুয়াশা পালিয়ে গিয়েছে। এখন বাস্তব সমস্যাগুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে। সে একটা পরিকল্পনা করেছে—নিজে নষ্ট হবে, শরীর দিয়ে বশ করবে দীপ আর অর্ককে। তারপর দীপ-অর্ককে দিয়ে চুড়ান্ত আঘাত হানবে শ্যামলেশ সেনের ওপর। ভাবতে ভাবতে হিংস্র হয়ে উঠল লাবণ্যময়ী তরুণীর মুখ। চোখে আগুন জ্বলল। হাতে-পায়ে ধারালো হয়ে উঠল নখর। এই অবধি কোনও সমস্যা নেই তেমন। বাবার জন্য মরিয়া এক মেয়ে তার মা আর মায়ের প্রেমিক-স্বামীর ধ্বংস চায়। প্রতিশোধস্পৃহা, একাকিত্ব তাঁকে বিকৃত করেছে হয়তো কিছুটা। কিন্তু শরীর ব্যবহার করে কিছু আদায় করার ব্যাপারে তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। বড় হওয়ার সময় থেকেই বিদিশা লক্ষ করেছে কিছু পুরুষ গায়ে ঢলে পড়তে চায়, বোকা-বোকা মিষ্টি কথা বলে। শ্যামলেশ সেন বিখ্যাত লোক। তাঁর কাছে অনবরত নানা রকম লোকজন আসে-যায়। বিদিশাকে দেখলে অনেকেরই দৃষ্টি ঘন হয়ে ওঠে, সে খেয়াল করেছে কিশোরী বয়সেই। শ্যামলেশ সেন বরাবরই চাইতেন, বিদিশা তাঁর অতিথিদের সামনে ফুলের মতো ফুটে থাকুক। কিন্তু মা’র তাতে ঘোর আপত্তি। অল্প বয়সে শ্যামলেশের স্টুডিয়োতে অল্প মানুষের মদ্যপানের আসরে বিদিশা মা’র সঙ্গে গিয়েছে, অনিচ্ছুক ভাবেই গিয়েছে, কারণ মা তাকে জোর করত। মা চাইত, তার মেয়ে শ্যামলেশকে বাবা বলে মেনে নিক। বড় হওয়া-মাত্র মা-ই তাকে আড়াল করেছে সব কিছু থেকে। মা তাকে ভাল মেয়ে হিসেবে রক্ষা করতে চায়। আর এটা টের পেয়েই বিদিশা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে বেলেল্লাপনায় মেতে উঠে মা’র সব স্বপ্নকে ছাই করে দেবে ধীরে ধীরে। কিন্তু নষ্ট হওয়া কি মুখের কথা? ওপর-ওপর ছেলেদের সঙ্গে দিনরাত ঘুরলেই কি আর কলঙ্ক হয়? একটা ঘটনা মনে পড়ে বিদিশার। কলেজ থেকে দলবেঁধে ওরা কোলাঘাট গিয়েছিল শীতে। খুব জমেছিল। আচমকাই কখন সে একা হয়ে গিয়েছিল দল থেকে। সন্ধে নামার সময় কোত্থেকে ছুটে এসে ধ্রুব তাকে ধরল। ছেলেটাকে একটুও পছন্দ হয় না বিদিশার। চাউনিটা চঞ্চল। যেন সব সময় সুযোগ খুঁজছে কিছু। সেদিনও কিছু বোঝার আগেই ধ্রুব তাকে চুমু খেল জড়িয়ে ধরে। তাতে কোনও আদর নেই। কী যেন মূল্যবান বস্তু খাবলে-খুবলে নেওয়া হল! বিদিশা বিরক্ত হয়ে প্রথমে ভেবেছিল অর্কদের বলবে। তার ঠোঁট জ্বলছিল। চাপাচাপি ও তাড়াহুড়ো করায় দাঁত বসেছে ঠোঁটে। মুহূর্তে কোথায় পালিয়েও গিয়েছিল ধ্রুব। বন্ধুদের কাছে ফেরার পথে হঠাৎ বিদিশার মনে উত্তেজনা এল। এই তো! একেই তো বলে নষ্ট মেয়ে হওয়া। কে বলে? সমাজ বলে। কোন সমাজ? মায়ের সমাজ। মা নিজে স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে এসেছে, সমাজ মানেনি, তবু মা বলছে? হ্যাঁ, কারণ সামাজিক বিধি অমান্য করার জন্য নয়, মা ঘর ছেড়েছিল উচ্চতর শ্রেণির বাসিন্দা হবার লোভে। এইসব ভেবেছিল বিদিশা, আর মজা পেয়ে হেসেছিল। তার রক্ষণশীল, মধ্যবিত্ত-অপরাধবোধে ভরা মা এবার উচিত শিক্ষা পাবে। সবাই আঙুল তুলে বলবে, যেমন মা, তার তেমন মেয়ে! অর্কদের কিছু বলল না সে। সারা রাস্তা ছটফট করল বিদিশা। কিন্তু কেউ বুঝতেই পারল না তার শরীর এঁটো হয়েছে। বিদিশা শেষমেশ ভাবল, মা ঠিক বুঝতে পারবে। আর মা বুঝলেই যথেষ্ট। বাড়ি ফিরে সে দেখল, দেরি করে ফেরায় মা ক্ষুব্ধ। মা’র চারপাশে অনেকবার পাক খেল, অকারণে সামনে গিয়ে ঝগড়াও করল, কিন্তু মা টেরই পেল না তার বিপ্লব। মা যদি বুঝতে না পারে, তার মেয়ে নোংরা হয়ে গিয়েছে, তাহলে বিদিশা কী করে খুশি হবে? আরও কিছু দিন পরে বিদিশার উপলব্ধি হল, মাকে ধাক্কা দিতে হলে চুপিসারে কিছু ঘটালে চলবে না। আয়োজন করে ঘটনা ঘটাতে হবে। তখনই এল আইডিয়াটা। অর্ক আর দীপের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবে সে আসবে। দু’দিন থাকবে। পরিকল্পনাটা প্রথম থেকেই হিট। রাতে খাওয়ার টেবিলে মাকে বলতেই চিৎকার-চেঁচামেচি। তখন শ্যামলেশ সেন বাড়ি নেই। প্যারিস গিয়েছেন দিন কুড়ির জন্য। মা অর্থাৎ জয়শ্রী আঙুল তুলে বিদিশাকে শাসিয়েছিলেন। বিদিশা নির্বিকার। জয়শ্রী বলেছিলেন, “যথেষ্ট হয়েছে। তোমার কলেজ যাওয়া বন্ধ।”

বিদিশা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, “হু কেয়ারস?”

জয়শ্রী রেগে লাল। মা’কে সাহায্য করা আন্টিকে প্রথমে বলেছিলেন, “মায়া, তুমি যাও, আমি গুছিয়ে রাখব।” আন্টি চলে যেতে হিস্‌হিসিয়ে বলেছিলেন, “ইউ মিন তোমার কথা শুনে আমাদের চলতে হবে? বাবা বাড়ি নেই…”

কথা শেষ করতে না দিয়ে বিদিশা চেঁচিয়েছিল, “কে বাবা?”

জয়শ্রী বলেছিলেন, “তুই জানিস না? কে তোকে মানুষ করল? কে তোর বাবা?”

ফুঁসে উঠেছিল বিদিশা, “যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, তিনিই আমার বাবা।”

উন্মাদিনীর মতো লাফাচ্ছিলেন জয়শ্রী, শ্যামলেশ সেনের স্ত্রী সেজে এত কাল পর মেয়ের এই কথা তাঁর শিকড় ধরে টান মারল। খানখান হয়ে গেলেন তিনি। অসহায় এক রাগে ছুটে গিয়ে তিনি চুলের মুঠি ধরলেন মেয়ের। মেয়েও কম যায় না। অভিমান তাকেও মরিয়া করেছে। বিদিশা যন্ত্রণায় চিৎকার করে বলল, “আমাকে মেরে ফেলো তুমি। আগেই মেরে ফেললে না কেন? আমাকে এরকম অভিশপ্ত জীবন দিলে কেন?”

মেয়ের কথা শুনে ছিটকে দূরে সরে গেলেন জয়শ্রী। দেয়ালে মাথা রেখে ঘষতে লাগলেন প্রবল। মায়ের কষ্টে বিচলিত হয়নি বিদিশা। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ প্রাণীর মতো সারা রাত ছটফট করেছিল।

ভাবতে ভাবতে যেন সেদিনের দৃশ্যেই ফিরে গিয়েছিল বিদিশা, ডোরবেল বাজার শব্দে সে বর্তমানে ফিরল। জিনসের ওপর হলুদ পাঞ্জাবি চাপিয়ে একটু পরেই সে দীপ আর অর্কের সঙ্গে বেরোল। রোদুর উঠলেও বাতাসের কনকনে ভাবটা এখনও যায়নি।

ছাতিমতলা থেকে যে-পথে নাচতে নাচতে ছেলেমেয়েরা গৌরপ্রাঙ্গণে যাবে, সেটার দু’পাশে বাঁশের ব্যারিকেড করা। হাজার হাজার মানুষ দু’পাশে বাগানে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আবির কিনে ঢুকেছে তারাও। একটু পরেই গান শুরু হল “ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল…”। প্রথমে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা, তারপর বড়রা, তারপর শিক্ষকেরা, বিশেষ অতিথি বা প্রাক্তন-প্রাক্তনীরা নাচতে নাচতে চলল। দোলমঞ্চে সবাই নাচবে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে আবির-খেলা নিষেধ। অজস্র মানুষ, যাদের অধিকাংশই টুরিস্ট টাইপের, আগে থেকেই তবু আবির খেলতে শুরু করে। এরা তো বসন্ত উৎসবের তাৎপর্য বোঝে না!

আম্রকুঞ্জের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অর্ক, দীপ, বিদিশা অনুষ্ঠান দেখছিল। ভিড় আর ভিড়। অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার মতো ব্যাপার। ভাল লাগছিল না তেমন।

অর্ক বলল, “এ তো মানুষের মচ্ছব লেগে গিয়েছে!”

দীপ বলল, “দূর! দূর! চল, কাটি। ব্রেকফাস্ট সেরে আসি।”

বিদিশা বলল, “ভিড় একটু বেশি। তবে সবাই আবির খেলতে শুরু করুক, দেখবি ভাল লাগবে। চারপাশ রঙিন হয়ে যাবে।”

একটু পরেই সেই দৃশ্য শুরু হল। হাজার হাজার লোক পরস্পরকে লাল-নীল-সবুজ-গেরুয়া আবির মাখাতে শুরু করল। মন নেচে উঠল আপনা থেকেই। এখন ভিড়টা মাঠের দিকে।

বিদিশা বলল, “দাঁড়া, তোদের আবির মাখাই।” বলে দুই বন্ধুকে খুব করে। আবিরে রাঙাল।

অর্ক লাফাল, “এবার তোকে মাখানোর পালা। তোর কপালে তিন রঙের তিনটে রেখা এঁকে দিই। শান্তিনিকেতনের মেয়েরা কেমন সেজেছে দেখেছিস!”

দীপ বলল, “আমার কিন্তু আর্ট-সেন্স নেই। আবির মাখানোর সময় অসভ্য বলবি না যেন!”

তিনজনে আশ্রম জুড়ে ছড়ানো অগুনতি মানুষের ভিড়ের মধ্যেও নিজেদের রঙিন জগৎ নির্মাণ করল মুহূর্তে। নারীশক্তিই প্রকৃতির প্রধান শক্তি। অতএব বসন্ত উৎসবে তিন নবীন-নবীনার দলে মধ্যমণি হয়ে উঠেছে বিদিশা। অর্ক বুকের কাঁপুনি টের পেল। দীপ অধিকারবোধ অনুভব করল তীব্র। বিদিশা পরিকল্পনা করে এসেছিল, তার একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে, তবু যৌবনের মন্ত্রে জেগে গেল সে, সব ভুলে হয়ে উঠল স্বতঃস্ফূর্ত।

রাস্তার পাশের দোকান থেকে চট করে খেয়ে এল তারা। তারপর হাত ধরাধরি করে আশ্রমে ঘুরে বেড়াতে থাকল। সঙ্গীত ভবনের সামনে গোল করে একাধিক দঙ্গল বসে আছে। নাচ, গানবাজনা করছে তারা। দর্শকরা ঘিরে আছে তাদের। অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে গেল বিদিশাদের মন। মাঝে মাঝেই পলাশের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। রামকিঙ্করের ভাস্কর্যের পাশে একটা প্রায় শুয়ে পড়া পলাশ গাছ আগুন ছড়াচ্ছে। অনেকেই ফুল ছিঁড়তে যাচ্ছে। সতর্ক ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বারণ করছে। সেখানেই একটা অশোক গাছের নীচে বাউলের দল গান গাইছে। অপূর্ব সেই গান। ‘ফাঁকি দিলে সোনার গৌর/ আর তো গৌর পাব না/ তোমায় হৃদ্‌মাঝারে রাখিব/ যেতে দিব না’। শুনলেই শরীরে নাচ এসে যাবে। গেলও। বিদিশা নাচতে শুরু করল সকলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে। অর্ক-দীপও যোগ দিল। এই প্রথম বিদিশা এমন খোলামেলা হয়ে যেতে পারল। সে নাচতে নাচতে তৃপ্তির সঙ্গে পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করল। দীপরা জলের বোতলে ভদকা মিশিয়ে এনেছিল। দু’-এক ঢোক খেল সে।

এগারোটার রোদুরে গা পুড়ে যাচ্ছে শান্তিনিকেতনে। সবাই এবার যারযার অস্থায়ী বাসায় ফিরছে। বিদিশারাও ফিরে এল। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে হঠাৎ বিদিশা দীপকে ডাকল, “এই দীপ, শুনবি?”

দীপ বেরিয়ে এল। বলল, “কী?”

বিদিশা চোখে জাদু এনে বলল, “আমাকে স্নান করাবি?”

দীপ তাকিয়ে থাকল তার চোখে। রোমাঞ্চিত হল তার শরীর। সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “গ্ল্যাডলি।” বিদিশা দীপকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। আয়নার সামনে গিয়ে পলাশ ফুলের মালা খুলল। কী করবে এরপর বুঝতে না পেরে নানা কাজের ছল করতে লাগল। শরীরে কেমন একটা ঢেউ এসেছে। ভাল-মন্দ বোধ উবে যাচ্ছে। এবার ঘুরে সে দীপের দিকে এগোচ্ছে, দীপ বলল, “দরজা বন্ধ করে দেব?”

ঝম্ করে ধাক্কাটা লাগল বিদিশার মনে। ভয় হল অজানা। সে অস্ফুট চিৎকার করল, “না!”

দীপ অধৈর্য হল, “তুই কি দরজা খুলেই স্নান করবি?”

বিদিশা মাথা নিচু করে বলল, “কথাটা আমি কেন বলেছিলাম বুঝতে পারছি না। মনে হয় তোকে আদর করতে চেয়েছিলাম।”

দীপ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আদর-টাদর আবার কী? এদিকে আয় আর পারছি না।”

কেঁপে উঠল বিদিশা। বাবার রুগ্‌ণ মুখটা মনে পড়ল হঠাৎ। সে বলল, “তুই যা, দীপ।” পরক্ষণেই তার মেজাজ খারাপ হল। মাথায় রি-রি করে উঠল রাগ। বাবার জন্য তাকে অনেক কিছু করতে হবে। নিরীহ মানুষটাকে যারা আঘাত করেছে, তাদের পালটা আঘাত করবে সে। তার পরিকল্পনা কার্যকরী করতে গেলে দীপ-অর্ককে একটু শরীর দিয়ে ভোলাতেই হবে। এতক্ষণ বসন্তের পাল্লায় পড়ে যা হচ্ছিল আপনা-আপনি, তাকেই উদ্দেশ্যমূলক করতে চাইল মাথা-খারাপ মেয়েটা।

তার আচরণে বিরক্ত দীপকে বিদিশা কাছে টেনে নিয়ে চুম্বন করল তীব্রভাবে। তারপর দীপকে বলল, “আজ আর তোর আমাকে স্নান করাতে হবে না। অর্ক কষ্ট পাবে। আমার যে তোদের দু’জনকেই চাই।”

আবিষ্ট দীপ বলল, “মানে?”

বিদিশা চোখে বিদ্যুৎ এনে বলল, “মানে আমি কাউকেই হারাতে চাই না। আমরা তিনজন একটা দল। একদিন আমার একটা ইচ্ছের কথা তোদের বলব।”

দীপ হাসল। বলল, “তুই আমাদের জীবন বদলে দিয়েছিস দিশা। থ্যাংক ইউ।”

তারপর বমি করল বিদিশা।

রাতে অর্ক ফাঁকা দেখে এক সময় বিদিশাকে ধরল, “এই দিশা, শোন।” চাঁদের আলোয় তখন ভেসে যাচ্ছে রিসর্টের বাগান। সন্ধ্যার অনুষ্ঠান দেখে ওরা একটু আগে ফিরেছে। বিদিশা এখন শাড়ি পরেছে। হালকা নীল রং। সে বলল, “কী রে?”

অর্ক বলল, “তোর জন্য আমার অন্য রকম ফিলিংস হচ্ছে।”

খুব হেসে বিদিশা বলল, “কী রকম?”

অর্ক গভীর স্বরে বলল, “আমি বোধহয় তোর প্রেমে পড়েছি। বিলিভ মি।”

বিদিশা অর্ককে কাছে টেনে ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। তারপর বিহ্বল অর্ককে বলল, “আমরা তিনজন বন্ধু। প্রত্যেকে প্রত্যেককে ভালবাসি। আয়, তুই আমায় আদর কর।”

ফিসফিসিয়ে অর্ক বলল, “তুই খুব সুন্দর। তোকে পাব কোনও দিন ভাবিনি।”

রাত বাড়লে চাঁদ বিদিশার থেকেও রহস্যময় হয়ে উঠল শান্তিনিকেতনের ভুবন জুড়ে। রাতপাখি ডাকল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন