শেষের কবিতা

(ক)

মানুষ আর মানুষ। আকাশবাণীর নিয়মিত প্রচারে সকলে জানতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে ইহলোক ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। দলে দলে লোক ছুটে এসেছেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যেমন, তেমনই অগণিত সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণার পর জনতা উত্তাল হয়ে উঠল। একটি বার তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে দর্শন করবেন। দোতলার পাথরের ঘরেই রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ তখনও। দোতলায় ওঠার দুটি দরজার মধ্যে একটি লোহার কোলাপসিবল বড় গেট। অনেক চেষ্টা করেও স্বজনেরা ভিড় ঠেকাতে পারলেন না। লোহার গেট ভেঙে ফেলল দুরন্ত জনতা। এ কি শোকের চিহ্ন? না বিশ্বখ্যাত কবির মৃতদেহ দেখবার হুজুগ? নিরুপায়, ভীত আত্মীয়বন্ধুরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন। অনেকে অবশ্য দূর থেকে জোড়হাতে প্রণাম করে অন্য সিঁড়ি দিয়ে ধীরে নেমে যাচ্ছিলেন।

তখনই দেখা গেল একদল যুবক জলের পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠছে। ভিড়ের মধ্যে তারা মিশে থাকল। গুরুদেবের মৃত্যুর খবর পেয়ে যাঁদের হৃদয় ভেঙে গিয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগ মনমরা হয়ে রইলেন শান্তিনিকেতনে, কলকাতার ভক্তরা লুকিয়ে রাখলেন নিজেকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর যা ঘটতে লাগল, তাতে তাঁদের কোনও অংশ নেই। তবে এত বিশৃঙ্খল জনতা কোথা থেকে এল? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এদের কী সম্পর্ক? যাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত সম্পর্ক ছিল, তাঁদেরই একজন বনমালী, কবির ‘লীলমণি’, এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন। ভিড় ঠেলে কবির সামনে যেতে পারছেন না। রথীন্দ্রনাথ শোকে ভেঙে পড়েছেন। প্রতিমা দেবীও কাছে পিঠে নেই, তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

জনতার গর্জনের মধ্যেই দরজার ছিটকিনি তুলে দেওয়া হল একরকম জোর করেই। গুরুদেবকে স্নান করানো হবে, সাজিয়ে দেওয়া হবে শেষবারের মতো। রানী মহলানবিশ, নন্দিতা (বুড়ি), অমিতা পরম শ্রদ্ধায় রবীন্দ্রনাথকে যত্ন করে সাজাবেন। ছেলেদের মধ্যে ঘরে সুরেনবাবু, বিশু, আরও কয়েক জন পাহারায় আছেন। স্নান করানো হচ্ছে যখন কবিকে, তখনই দরজার ছিটকিনি খুলে পড়ল মানুষের ধাক্কায়। ঢুকে পড়ল হতচ্ছাড়া যুবক বাহিনী। মেয়েরা তাড়াতাড়ি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে ধরে আড়াল করলেন। আর্তনাদ করে উঠলেন রানী। চিৎকার করে বললেন, “বাইরে যান সব। কবিকে এ কী অপমান!”

জীবদ্দশায় লাজুক, স্পর্শকাতর মানুষটার মৃতদেহ কাদের কাছে এমন লোভনীয় হয়ে উঠল? তাদের স্বার্থটাই বা কী? পৃথিবীকে দেখানো রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক?

সুরেনবাবুরা সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা ঠেলে রইলেন। দরজা কাঁপছে মানুষের ধাক্কায়। উন্মত্ত চিৎকার শোনা যাচ্ছে, “দরজা খুলে দিন…দরজা খুলুন…”

কবিকে দ্রুত পরানো হল বেনারসির জোড়, চন্দনে সাজানো হল কপাল। চাদর পাট করে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল। অলৌকিক ব্যাপারই যেন, এত যে রোগকষ্ট ভোগ করেছেন কিছুকাল যাবৎ, এখন মুখে তার কোনও ছাপই নেই। অপরিসীম শান্তি যেন তাঁকে আবার স্নিগ্ধ করেছে।

রানী চেয়ে চেয়ে দেখছেন। মন ভরছে না। কিন্তু তাঁকে কে সময় দেবে? উন্মত্ত জনতার দর্শনের জন্য কবিকে এই ঘরে রেখে তাঁদেরকে এখনই আড়ালে যেতে হবে। হঠাৎ তাঁর মনে হল, রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর অপারেশন হল, কোনও লাভ হল না। কবির বরাবরের কামনা ছিল আরেকটি, তিনি শান্তিনিকেতনে সমাপ্ত হতে চান। রানীকে কতবার বলেছেন কবি, “তুমি যদি আমার সত্যি বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, ‘জয় বিশ্বকবি কি জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দেমাতরম’—এই রকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে।”

কবির ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নীচে, আশ্রমের ছেলেমেয়েদের মাঝখানে তাঁর জীবনের সমাপন হবে। যেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবে না।

রানী একজন কাউকে খুঁজে বেড়ালেন, যাঁকে বলবেন কবিকে নিয়ে যেতে হবে শান্তিনিকেতনে। গুরুত্বপূর্ণ কাউকেই তিনি দেখতে পেলেন না। সব অচেনা মাতব্বরে ভরে গিয়েছে চারপাশ। শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের এক প্রাক্তন ছাত্রকে সবটা বললেন। তিনি ছুটে গেলেন বড়দের কাছে। কিছুক্ষণ পর ম্লানমুখে ফিরে এসে বললেন, “না রানীদি, হল না। সবাই বলছেন শান্তিনিকেতনে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানেই সব আয়োজন হয়ে গিয়েছে।” ভাঙচুর মন নিয়ে রানীর মতো শেষবেলার কর্তব্যনিষ্ঠ সেবাকর্মীরা দূরে দূরে পড়ে থাকলেন। কারা সিদ্ধান্ত নিলেন, কারা লাফিয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথের ওপর, জানা গেল না। জানতে পারলেন না কবির ঘনিষ্ঠরাই। শান্তিনিকেতনের মানুষেরা উপেক্ষিত থাকলেন। মাথা নিচু করে তাঁরা যার-যার কর্তব্য করে যেতে লাগলেন আজও।

তিনটে নাগাদ দুপদাপ করে ঘরে ঢুকল বেশ কিছু অচেনা লোক। একপ্রকার জোর করেই দুর্বিনীত ভঙ্গিতে তাঁরা কবির অপরূপ সাজে সজ্জিত শুভ্র নিথর দেহখানি তুলে নিয়ে চলে গেল। যেন কেড়ে নেওয়া হল। ভেঙে পড়লেন কবির অন্তিম পর্বের সহচরীরা। মেয়েদের নীরব অশ্রুই প্রকৃত শোকের মতো ভিজিয়ে দিল শ্রাবণ মাস, বর্ষা ঋতুকে।

বাইরে সেই গর্জনই উঠল, “জয় বিশ্বকবির জয়”। পালঙ্কে শোয়ানো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জোড়াসাঁকোর বাইরে বের হল ওরা। উত্তর কলকাতার বড় বড় রাস্তা ঘুরে মৃতদেহ নিমতলায় যাবে। মানুষের অগুনতি মাথা। কোথাও এতটুকু ফাঁকা দেখা যাচ্ছে না। বাড়িগুলির বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়েছে শয়ে-শয়ে জনগণ। আর-একটু পরেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ দেবতাকে নিয়ে চরম কলঙ্কিত ঘটনাটি ঘটল। হুজুগে জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ল কবির মৃতদেহের ওপর। স্মারক নেওয়ার কাড়াকাড়িতে লুঠ হল মহামানবের মৃতদেহ। শ্বেতকমল, রজনীগন্ধার সজ্জা নষ্ট হয়ে গেল মুহূর্তে। শান্তিনিকেতন আর কলকাতার পার্থক্য বোঝা গেল তখনই। অবশিষ্ট চুল-দাঁড়িও ছিঁড়ে নিচ্ছে কি নিষ্ঠুর জনগণ? মৃত্যুটি রচনা করতে চেয়েছিলেন কবি নির্জনে। চেয়েছিলেন তাঁর দেহ মিশে যাবে শান্তিনিকেতনের মাটিতে। গঙ্গার দিক থেকে আচমকা যে বাতাসের ঢেউ এল, তা নিশ্চিত কবিরই দীর্ঘশ্বাস।

(খ)

বিদিশার ঘরে বাইশে শ্রাবণ কাঁদছে। সারা বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাবার লেখার পাতাগুলি। মোবাইলে অর্কের পাঠানো ছবিটা এসেছে। নিজের অর্ধনগ্ন ছবিটা একবার দেখেই মোবাইলটা একপাশে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে বিদিশা। তাতে তো ছবিটা মুছে যায়নি। নিশ্চয়ই দীপ এর-তার মোবাইলে পৌঁছে দিচ্ছে ছবিটা প্রবল আক্রোশে। যে দেখছে, সে-ই নিশ্চয় ধর্ষণ-কল্পনা করছে মনে মনে। অপমানিত হতে হতে মরে যাচ্ছে এক কবির মেয়ে। ভীষণ যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল বিদিশা। হাঁটুর ওপর মাথা রেখে দু’হাতে এলোমেলো করল চুল। তাকে পাগলিনির মতো লাগছে। অসহায়ের মতো সে ভাবল, তার আর উদ্ধার নেই কোনও। ছিন্ন-ভিন্ন আত্মা নিয়ে অনেকক্ষণ নিঝুম হয়ে পড়ে রইল বিদিশা।

একসময় রক্তজমাট-বাঁধা দুই চোখ নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। জানলা দিয়ে বাইরেটা একবার দেখল। দেখা মানে একটিবার তাকানো আকাশে। মেঘ আকুল হয়ে আছে। যখন-তখন ভাসবে পৃথিবী।

জানলার পরদা টেনে দিল বিদিশা। ভীষণ বাবা-বাবা করছে মনটা। বাবা যখন সব জেনে যাবে, তখন কী করবে? নিঃস্ব মানুষটার অবলম্বন হয়ে উঠেছিল সে। কান্নাভেজা গলায় একলা ঘরে বিদিশা বলল, “আমাকে ক্ষমা করো, বাবা…ক্ষমা করো…”

আরও অনেকক্ষণ কাঁদল বোকা মেয়েটা। তারপর বাবাকে ফোন করল। প্রভাতরঞ্জনের গলা ও-প্রান্তে পেতেই সে ফোনটা কানে চেপে ধরে ব্লেড টেনে দিল বা হাঁতের শিরায়। যন্ত্রণাবিদ্ধ গলায় হাউমাউ করল, “বাবা…বাবা…”

প্রভাতরঞ্জনের উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এল, “কী হয়েছে, মাম?”

“বাবা…”

“কী হয়েছে বলবি তো!”

“আমি তোমার কাছে যাব বাবা।”

“চলে আয়। কাঁদছিস কেন? এত বড় মেয়ে কাঁদে?”

“আমি তো ভাল মেয়ে না, বাবা।”

“তোর কী হয়েছে বল তো?”

“কবির মেয়ে লুঠ হয়ে গিয়েছে জানো?”

“মানে? কী বলছিস? কোথায় তুই?”

“রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহও তো লুঠ হয়ে গেল…”

“ও আচ্ছা। তাই বল! লেখাটা পড়ে তোর কষ্ট হয়েছে। এই কষ্ট পাওয়া ভাল। এই কষ্ট মনুষ্যত্বের জন্ম দেয়। সোনা মেয়ে আমার!”

“বাবা-আ…”

“কাঁদিস না। আমার কাছে চলে আয়। আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেব, কেমন?”

“তুমি আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও…”

বলতে বলতে মোবাইলটা ফসকাল বিদিশা। শিরা থেকে রক্ত ধেয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রায় উন্মত্ত জনতার দিকে ছুটে যাচ্ছে বোকা মেয়েটার কান্না। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল তখন।

(গ)

নদীর ওপারে কয়েকটা শিরীষ গাছ, বাবলা গাছ দেখা যাচ্ছে। আগুনের ডানা নেড়ে কতদূর উড়ে যাচ্ছে চিতার পতঙ্গ? আগুনের বর্ণমালায় বাবার ইহজীবন স্বাক্ষরিত হচ্ছে যেন। এক-একবার চিতার আগুন লক্‌লক্‌ করে যেন আকাশ স্পর্শ করছে। কখনও আবার অগ্নিশিখাকে ক্লান্ত, দমিত দেখাচ্ছে। এভাবেই চোখের সামনে পুড়ে যাচ্ছে এক ইতিহাস। উপলব্ধি হল, বিদ্রোহ করেছি, কিন্তু সেই ইতিহাসের উত্তরাধিকার আমি বহন করিনি। আরতিকে বললাম, “বাস্তব সমস্যা যখন আমাদের অসহায় করে, মনে হয় এই সমাজ মেনে, এই সংবিধান মেনে আর এগোনো সম্ভব না, তখন আত্মগোপনই একটা উপায়। রাষ্ট্রের চোখের আড়ালে, সভ্য সমাজের চোখের আড়ালে আবার সব নতুন করে শুরু করা যায়।”

আরতি কপাল কুঁচকে বলল, “খুব কঠিন করে কথা বলছ কেন?”

বললাম, “সহজ করে বলব? খুঁজতে হবে আমাদের পালানোর জায়গা। জখমের রক্ত মুছে ফেলার জায়গা।”

আরতি বলল, “পালানোর জায়গা? বহুত ঢ্যামনামি শিখেছ!”

আমি কুলকুল করে হাসলাম। বললাম, “খিস্তি দিয়ো না। যাবে? যাবে আরতি?”

আরতি আমার চোখে চোখ রেখে কিছু বুঝে নিতে চাইল। কিছু ভাষা কি সে খুঁজে পেল?

না হলে তার কঠিন মুখ যে নরম হয়ে এল! অদ্ভুত স্বরে সে বলল, “যাব। তারপর?”

দ্বিধাহীন কণ্ঠে উত্তর দিলাম, “আর ফিরব না। ছোট্ট একটা জীবন মানুষের।”

বাস্তব বিস্মৃত হয়ে আরতি ফুঁপিয়ে উঠল। তার শত আত্মসংবরণের ইচ্ছেকে হার মানিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল শূন্যে। বাবার চিতা নিভে এল তন্মুহূর্তে।

অজয় এসে সামনে দাঁড়াল। নদীর দিকে চোখ মেললে আর চিতার লেলিহান শিখা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। দাহকার্য শেষ। জীবন থেকে কে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল জনমের মতন। এখন বুক মুচড়ে উঠল। শূন্য দৃষ্টিতে অজয়ের দিকে চাইলাম। অজয় বিনীত কণ্ঠে বলল, “দাদা, একটা কথা বলতে এসেছি।”

রুদ্ধকণ্ঠে বললাম, “বলো।”

অজয় বলল, “সব কাজ তো আপনার ভাই-ই করছে। অসুবিধে হচ্ছে না কোনও। আমি ভাবছি, আপনি যদি একটু চিতায় জল দেন একবার, জ্যাঠামশাইকে আপনার দিক থেকে একটা শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্মশানযাত্রীরা সকলেই দেখুন জল দিচ্ছে।”

শুনেই কাঁপতে থাকলাম। আমার কোনও শক্তি নেই বাবার মৃত্যুর মুখোমুখি হবার। ফলে আড়ালে থাকছি। মনে মনে এই ইতিহাসকে আমি অভিবাদন জানাইনি, তা কি সম্ভব? বিচ্যুতি থাকলেও তিনি তো সংগ্রামীই ছিলেন!

আমি ইতস্তত করছি দেখে আরতি সাহস দিল। বলল, “মাস্টার, যাও। ওঁনাকে বিদায় জানাও।”

অজয় আমার হাত ধরে নদীর ঘাটে নিয়ে গেল। একজন মাটির হাঁড়ি হাতে ধরিয়ে দিল। জল ভরছি, গবগব শব্দ হচ্ছে, মনে হল এই মুহূর্তে আমি চেতনা হারিয়ে ফেলব। টলছিলাম। পিছল সিঁড়ি বেয়ে যখন উঠছি, আমাকে ধরে রাখল অজয় এবং কয়েকজন অচেনা ছেলে। ধীর পায়ে চিতার দিকে এগোলাম। মা গো!

জলপূর্ণ মাটির কলস শূন্যে তুলে ধরেছি…হাত কাঁপছে…এইবার জল ঢালব…

বাবার শরীর খেয়ে ফেলেছে অগ্নিরাক্ষস।

এখন সমস্ত ছাই।

কিন্তু যে-মুহূর্তে জল ঢাললাম, ছাইয়ের নীচে জীবিত অগ্নি হিসহিস করে উঠল। কাঁদব না। কাঁদব না। কাঁদব না। মন কঠিন করে রেখেছি। জল ঢালতে ঢালতে উপলব্ধি করলাম, ভস্মাবৃত অগ্নির চাপা গর্জন বাবার কণ্ঠস্বরে পরিবর্তিত হচ্ছে…বাবা বলছে, “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক…”

ফিরে আসার আগে একমুষ্টি কালো, ভেজা, ছাইমাখা মাটি রুমালে রাখলাম। অকারণেই বোধহয়।

(ঘ)

কলসিতে রবীন্দ্রনাথের চিতাভস্ম সংগ্রহ করে সুরেন্দ্রনাথ কর চোখের জল লুকিয়ে পরদিন দুপুরের ট্রেন ধরলেন। সঙ্গে আরও কয়েক জন। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী আগেই রওনা হয়ে গিয়েছেন। অজয় পার হচ্ছেন যখন সুরেনবাবুরা, তখন সন্ধ্যা নেমেছে। স্টেশনে নেমে কলসি মাথায় নিলেন সুরেন্দ্রনাথ। পথে আধো-অন্ধকার। পথের দু’পাশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, বালক-বালিকারা জোড়হাতে দাঁড়িয়ে। নিঃশব্দে।

সমুখে শান্তি-পারাবার,
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
তুমি হবে চিরসাথী,
লও লও হে ক্রোড় পাতি,
অসীমের পথে জ্বলিবে
জ্যোতির ধ্রুবতারকা।

বোলপুর-শান্তিনিকেতনের আকাশে তখন অমলিন অজস্র তারকা। ঘনীভূত অন্ধকারে ব্যঞ্জনাময় জোনাকির দল। বেদনা শব্দটির পাশে হৃদয় শব্দটি চুপ করে বসে আছে। কবি যেমন চাইতেন।

***

অধ্যায় ১৮ / ১৮

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন