ছিন্নপত্র-২

চৈত্রের শেষ। বোলপুর গনগনে হয়ে আছে। এই সেই চৈত্রমাস, যখন দুর্লভ কারও চোখে সর্বনাশ ঘনায়! সে সুন্দর সর্বনাশকে একদিন আবিষ্কার করেছিলেন কবি। আজ ‘সর্বনাশ’ শব্দটি থেকে রোমান্টিকতা ঝরে গিয়েছে। ভগ্ন-স্বাস্থ্য রবীন্দ্রনাথ প্রবল গরমে আরও কাহিল হয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেকেই চিন্তায় পড়েছেন। সন্ধেবেলা দেহের তাপমাত্রা বাড়ছে। যাঁরা সেবার দায়িত্বে আছেন, তাঁরা টের পাচ্ছেন এই জ্বরের ব্যাপারটা। ভিতরে আরও কী কী সমস্যা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ তো কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না। অপারেশনের ভয়ে তিনি সদা তটস্থ। সেই ভয়েই কষ্ট গোপন করে এমন ভাব দেখাচ্ছেন, যেন ওষুধেই তিনি ভাল হয়ে যাচ্ছেন, আর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী-সহ নিকটজনেরা সবই টের পাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর ওপর জোর করবে কে? শরীরের প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই রবীন্দ্রনাথ ক্ষুন্ন হন। প্রায়শই অভিমান প্রকাশ করে ফেলেন। কখনও-বা অধৈর্যও হয়ে যান। সেসব থেকেই বুঝতে পারা যায়, উত্তরোত্তর তিনি ফুরিয়ে যাচ্ছেন। টের পাওয়া যায়, চুড়ান্ত বাস্তব এক সর্বনাশের গন্ধ।

গৃহবন্দি কবি ভীষণ দুর্বল এখন। তারই মাঝখানে লেখার কাজ করছেন। পয়লা বৈশাখ ‘জন্মদিন’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবে। মুদ্রণকার্য চলছে। ‘গল্পস্বল্প’-এর কাজও চলছে। এরই মধ্যে আবার কোনও কোনও সংবাদপত্রে প্রকাশ পেল, কবি কাঙ্গড়া গুরুকুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দেবেন। সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এই খবরের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি অনিলকুমার চন্দকে বিবৃতি দিতে হল যে, কবি এখনও নিজের ঘরের বাইরেই যাচ্ছেন না। কী করা যাবে? বিশ্বকবি, নোবেল-বিজয়ী সাহিত্য-নক্ষত্রকে সবাই কাছে পেতে চায়। মরণাপন্ন হলেও তাঁর ছাড় নেই। প্রিয় পুত্র অল্পবয়সি শমী-র মৃত্যু হল আচমকা, পুত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হলে কবি ট্রেনে চেপে ফিরছেন শোকাহত, সেই সময়েও ভক্তরা তাঁকে সম্বর্ধনা দিচ্ছেন, ছুঁয়ে দেখার জন্য ভিড় করছেন। বেশ কিছু কাল হল, রবীন্দ্রনাথের এই পরিণতি। তিনি দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছেন। মানুষের দেবতা হয়ে ওঠার ইতিহাস এরকমই করুণ। যে-কোনও কবিরই প্রিয় বিষয় ‘মৃত্যু’। রবীন্দ্রনাথও নানা কবিতায় নানা রকম মৃত্যুস্বপ্ন লিখে গিয়েছেন। ‘পুরবী’র ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’ কবিতায় তাঁর মৃত্যুর প্রিয় লগ্নগুলি সেই কবে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই মৃত্যু-সময়গুলি কেমন? শান্ত শিউলি-ঝরা শুক্লরাত, দখিনা বাতাস-মেশা পাখি-ডাকা বসন্তের সকাল, শ্রাবণের ঝিল্লিমন্দ্র সঘন সন্ধ্যা বা ঝড়বৃষ্টির রাত্রি, হেমন্তের শেষ বেলা। নির্জন মৃত্যু, প্রকৃতির কোলে মৃত্যু—এই তাঁর কবিবাসনা। এসব কারণেই সম্ভবত শান্তিনিকেতন ছেড়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যেতে তাঁর আপত্তি এত। অস্ত্রোপচারেও তাঁর মত নেই এই কারণেই। কিন্তু এখন তো তিনি বিশ্ববাসী তথা দেশবাসীর সম্পদ। মৃত্যুর জন্য তাঁর যে নিভৃতি-প্রার্থনা, তা কেউ শুনবে? বিষণ্ণতা লুকিয়ে রাখতে জানেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু বিষাদ তাঁকে কুরে কুরে খায়।

নতুন বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে তাঁর জন্মোৎসব পালিত হয়। নববর্ষ উপলক্ষে কবিকে গান রচনা করে দিতে বলা হল। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি পারবেন? জ্বর রোজই আসছে। খাওয়া কমে গিয়েছে একদম। রথীন্দ্রনাথের ইচ্ছে, অপারেশন যদি অনিবার্য হয়, দেরি করে লাভ নেই। শরীর প্রতিদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আরও, এরপর তিনি কি অপারেশনের ধকল নিতে পারবেন? অবশ্যই এইসব আলোচনা রবীন্দ্রনাথকে জানানো হচ্ছে না। তিনি কবিরাজি চিকিৎসা, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ওপরই ভরসা রাখছেন। ঈশ্বরের দেওয়া শরীরে কোনও কাটাছেঁড়া হবে, এ তিনি মানতেই পারছেন না।

এহেন মানসিক অস্থিরতার মধ্যেই রথীন্দ্রনাথ রানী ও প্রশান্ত মহলানবিশকে চিঠিতে লিখলেন, “শত বাধাবিঘ্নের মধ্যেও আমরা জন্মোৎসব যাতে অনুষ্ঠিত হয় তার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে এইটাই স্মৃতিবার্ষিকী উৎসব হবে— মৃত্যুতারিখে করতে চাই না। বলাবাহুল্য তোমরা উপস্থিত থাকতে পারলে বিশেষ রকম খুশি হবো।”

চিঠির বয়ান থেকেই বোঝা যায়, শেষের সে-দিন যে আগত, রথীন্দ্রনাথ তা টের পেয়ে গিয়েছেন। ঘনিষ্ঠজনেরা সকলেই জেনে গিয়েছেন, তবু তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না, ভাবছেন কোনও না কোনও ভাবে গুরুদেব আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। রবীন্দ্রনাথ তখন জানলার বাইরে দৃষ্টি ভাসিয়ে দিয়েছেন, কত অনুভূতির প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে শূন্যে-মহাশূন্যে। মৃত্যুর কত রূপ তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন কবিতায়-গানে-গদ্যে-নাটকে। ‘ডাকঘর’-এর শেষটুকু যেন স্বপ্নে-পাওয়া। হুবহু মনে পড়ল তাঁর—

সুধা : অমল।

রাজকবিরাজ : ও ঘুমিয়ে পড়েছে।

সুধা : আমি যে ওর জন্যে ফুল এনেছি—ওর হাতে কি দিতে পারব না?

রাজকবিরাজ : আচ্ছা, দাও তোমার ফুল।

সুধা : ও কখন জাগবে?

রাজকবিরাজ : এখনই, যখন রাজা এসে ওকে ডাকবেন।

সুধা : তখন তোমরা ওকে একটি কথা কানে কানে বলে দেবে?

রাজকবিরাজ : কী বলব?

সুধা : বোলো যে, ‘সুধা তোমাকে ভোলেনি’।

রবীন্দ্রনাথ আপনমনে বলতে থাকলেন ‘সুধা তোমাকে ভোলেনি…সুধা তোমাকে ভোলেনি… সুধা তোমাকে ভোলেনি…’, আর আপন-মৃত্যুকল্পনার নিঃসীম অন্ধকারে অল্প অল্প আলো এল, ক্রমে স্পষ্ট হয়ে আসতে লাগল এক পরমাত্মীয়ার মুখ। কবিজীবনের সেই শুরুর দিনগুলোতে যিনি ছিলেন তার মানসিক আশ্রয়। রহস্যময় ভাবে অকালে তিনি স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন। তারপর কবির জীবনে কত বাঁক, কত মানুষ, কত স্বীকৃতি, কিন্তু সেই মানবী গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে আছেন তাঁর অপরূপ সৃজনে। আজ নিজের মৃত্যুলগ্ন উপস্থিত। কেন যেন সকলকে ছাপিয়ে বউঠান আসছেন তাঁর স্মৃতিতে। ঘরে কেউ নেই, নিঃশব্দে চোখের জল মুছে দেবতা-হয়ে-যাওয়া এক ব্যথাতুর কবি আবার অস্ফুট স্বরে বললেন, “সুধা তোমাকে ভোলেনি…ভোলেনি…”।

তখন ঘরে কেউ ঢুকলেন। সেদিকে না ফিরেই কবি বুঝলেন, আশ্রমের কেউ এসেছে। সত্যিই, শান্তিদেব এসেছেন। শান্তিদেব ঘোষ। আবার একটা নতুন গানের উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বেন রবীন্দ্রনাথ এখন। এভাবেই সারা জীবন শূন্যতাকে পূর্ণ করেছেন তিনি। শান্তিদেব প্রথমে যখন গান রচনা করার কথা বলেছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ কিছুটা আপত্তিই করেছিলেন, “সুর আর যেন টের পাই না আমি। পুরনো গান দিয়েই অনুষ্ঠান হোক।” শান্তিদেব সে কথায় দমেননি। প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ পর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ঠিক আছে। একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।” এখন শান্তিদেব এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে জীবনশক্তির অবশিষ্টাংশে ফিরলেন। মনে করতে পারলেন, একটা কবিতা লিখেছেন, সেটাকেই গানে রূপ দেবেন। বললেন, “সৌম্য আমাকে বলেছে, আমি যন্ত্রের জয়গান করেছি, কিন্তু মানবের জয়গান করিনি। এবার তাই একটা কবিতায় মানবের জয়গান গাইলুম। ওটিই এবারের নববর্ষের গান।”

পরম আনন্দে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল শান্তিদেবের। এ ক’দিন পেছনে পড়ে ছিলেন গুরুদেবের, কিন্তু মনে মনে তার আশঙ্কা ছিল শরীরের এই অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ হয়তো নতুন গান রচনায় সক্ষম হবেন না। কিন্তু তিনি যে মহাপুরুষ, তাঁর পক্ষে সবই সম্ভব। কবিতাটা হাতে পেয়ে শান্তিদেব দেখলেন, লেখাটা বেশ বড়। এত বড় কবিতায় সুর দেওয়া গুরুদেবের পক্ষে খুবই কষ্টের হবে। কিন্তু ভাবনাটা তিনি মুখে প্রকাশ করলেন না। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটায় সুর দেওয়ার চেষ্টা করলেন একটু পরে, কিন্তু সফল হলেন না। মন ভার হয়ে আছে। বিমর্ষতা এই গানটিতে মানাবে না। তিনি শান্তিদেবকে বললেন, “কালকে হবে।”

পরের দিন কবিতাটি ছোট হয়ে গানের রূপ নিল। আবাহনের সুরে মেতে উঠলেন ভাঙাচোরা রবীন্দ্রনাথ। কোনও ব্যক্তির উদ্দেশে নয়, চিরন্তন মানবকে স্বাগত জানিয়ে এই গান। যাঁর আবির্ভাবে মর্ত-ধূলির ঘাসে ঘাসে রোমাঞ্চ জাগে। সমবেত কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে উঠল সদ্য রচিত সঙ্গীত।

ঐ মহামানব আসে,

দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে

মর্ত্যধুলির ঘাসে ঘাসে…

গায়কদলের গলায় গান ঠিকঠাক উঠে যাওয়ার পর একদিন কবির সামনেই গাওয়া হল। চোখ বুজে শুনলেন। মৃদু কৌতুকও অনুভব করলেন। এখন কানের যা অবস্থা, সামনে গাওয়া হলেও গানটি যেন ভেসে আসছে দূর আম্রকুঞ্জ বা ছাতিমতলা থেকে! মুহূর্তে আশ্রমের ছবি তাঁর মনে ভেসে উঠল। রুক্ষ প্রান্তর ছিল সেখানে। ক্রমে তাই গাছে গাছে ভরে উঠল। কুটিরগুলি গড়ে উঠলে স্বপ্নের তপোবন দেখতে পেলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথমবার ছাত্র ছিল মাত্র পাঁচজন। রথীন্দ্রনাথ, বন্ধু শ্ৰীশচন্দ্র মজুমদারের বড় ছেলে সন্তোষচন্দ্র এবং আর তিনটি বালক। সেই রথী এখন আশ্রমের পূর্ণ দায়িত্বে, সন্তোষ অকালে সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সকালে উঠে বালকবৃন্দের সঙ্গে উপাসনায় যোগ দিয়ে এত আনন্দ পেতেন রবীন্দ্রনাথ! শান্ত এক পুরনো সকালের ছবি তাঁর রোগক্লিষ্ট শরীরে আজও যেন চন্দনের স্পর্শ দিল। সেকালের এক বৃষ্টিদিনের কথাও মনে এল। কাচের মন্দিরের পাশের দোতলা বাড়িটা থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন নিয়ে বৃষ্টি নেমেছে সেদিন। শ্রাবণই হবে। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই কয়েক জন বালক দৌড়োদৌড়ি করছে। সঙ্গে একজন মাস্টারমশাই। রবীন্দ্রনাথই বৃষ্টিতে ছাত্রদের ভেজার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। প্রকৃতির সন্তান হিসেবেই ওরা বড় হোক। বৃষ্টির চাঞ্চল্য, বৃষ্টির ছন্দ তাদের শরীরে নামুক। নিজে ছেলেবেলায় প্রাসাদে বন্দি থেকেছেন। এখন ছোটদের বৃষ্টিখেলা খেলতে দিয়ে নিজের হারানো বয়সে ফিরে যান। জীবনটা তো আর বদলানো যায় না। অন্যের মধ্যেই নিজের ইচ্ছেকে পূরণ হতে দেখা এক আনন্দ। বালকেরা লাফাচ্ছে, গাইছে। সব ভিজে ঝুপ্পুস। সেদিন পায়ে পায়ে রবীন্দ্রনাথও নীচে নেমে এসেছিলেন। ভিজেছিলেন। এগিয়ে গিয়েছিলেন দিগন্ত-ঘেঁষা কোপাইয়ের দিকে। বৃষ্টির ছন্দে গান নেমে এসেছিল তাঁর মাথায়। কোপাই নদীতে কম জল থাকে। বর্ষার জল গিয়ে পড়লে কোপাই জীবন্ত হয়ে যায়। বালকেরা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর জলে। রবীন্দ্রনাথ অপূর্ব রোমাঞ্চ নিয়ে দেখেছিলেন দুরন্ত বালকেরা মেঘগর্জন-বৃষ্টিপাত-ঝাপটা হাওয়ার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছে। ওই তারা ভেসে যাচ্ছে কেয়াঝোপের পাশ দিয়ে। পাড় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে চললেন। জলের টানে ভেসে-চলা ছেলেরা যেন দুর্ঘটনায় না পড়ে। প্রকৃতিই তাদের রক্ষা করুক। একটা তালগাছের পাশে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টিতে ভিজছেন, গানে ভাসছেন, আর ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করছেন। স্রোতে দুর্দান্ত গতিতে ভেসে যাওয়াটাই তাদের খেলা। একটু পরে দলটা উঠে এসেছিল। তাদের ফিরতে দেখে রবীন্দ্রনাথ বড় বড় পা ফেলে আশ্রমের দিকে ফিরে এসেছিলেন। ওরা হয়তো তাঁকে দেখে অভিভাবক ভেবে সন্ত্রস্ত হবে। কী দরকার? আনন্দ নষ্ট করার? রবীন্দ্রনাথ সবাইকে বলে রেখেছেন, ভিজে চুর ছেলেরা ফিরে এলে যেন গরম আদার চা দেওয়া হয়। তা হলে আর ঠান্ডা লাগার ক্ষতিটা হবে না।

পুরোনো কথা ফিরে ফিরে আসছে ঘোরের ভেতর। গানের দল গুরুদেবকে আত্মমগ্ন দেখে নিঃসাড়ে চলে গিয়েছে কখন। রবীন্দ্রনাথের অসুস্থ ঘুমের ভেতর শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের এক চিরসুস্থ বৃষ্টি অবিরাম ঝরে যেতে থাকল।

নববর্ষের দিন অনুষ্ঠানাদি হল। কবিতার বই প্রকাশিত হল। সন্ধ্যায় সভার আয়োজন। শুরু হতে হতে সাতটা বেজে গেল। বিদায়বেলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবিকে কষ্ট দিচ্ছে খুব। তাঁর বিশ্বাসের উপর আঘাত হেনেছে কিছু হিংসুটে মানুষ। সমস্ত আলোড়ন তিনি ধরে রাখলেন নববর্ষে তাঁর জন্মোৎসবের ভাষণে। প্রবন্ধটি তিনি লিখেছেন। কবির উপস্থিতিতে সেটি পাঠ করে সকলকে শোনালেন ক্ষিতিমোহন সেন। কালজয়ী এই রচনাটির নাম ‘সভ্যতার সংকট’। প্রবন্ধপাঠ শুরু হওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথ সবাইকে উদ্দেশ করে কিছু কথাও বললেন। এত যে অসুস্থ, তাঁর কথা শোনবার সময় কেউ যেন তা টেরই পেল না। বিদায়বেলার দায় পালন করছেন যেন কবি। ‘সভ্যতার সংকট’-এ পরিষ্কার তুলে ধরলেন তাঁর বক্তব্য। ইংরেজরা মানব-আদর্শকে কেমন নিষ্ঠুর ভাবে বিকৃত করছে, ভারতবর্ষের জনসাধারণ তাদের শাসনে কী করুণ ভাবে লাঞ্ছিত, এ কথা খোলা গলায় বলে দিলেন। ক্ষিতিমোহনবাবুর গলায় ফুটে উঠল কবির বক্তব্য—“…জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। …আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি—পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।”

নববর্ষ উৎসবে নেমন্তন্নের পোস্টকার্ড পেয়ে রানী মহলানবিশ এসেছেন। প্রশান্ত মহলানবিশ রানীকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। চৈত্রসংক্রান্তির রাতটা থেকে নববর্ষের সন্ধের অনুষ্ঠানের আগেই বোলপুর ছেড়েছেন। জরুরি কাজে তাঁকে দিল্লি যেতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে নববর্ষের সন্ধ্যায় রানী দেখেছেন প্রবল বেদনা নিয়ে। কবিকে অনেক সুস্থ লেগেছে, তবু রানীরও মনে হয়েছে সকলের সামনে এসে কবির এই শেষবার কথা বলা। চোখের জল মুছে তিনি সূর্যাস্তের কবিকে মনে মনে প্রণাম করেছেন শতবার। রাতে আর গুরুদেবের সঙ্গে দেখা হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ধারণা হয়েছিল রানী শেষ রাতের গাড়িতে কলকাতায় ফিরে গিয়েছেন। প্রিয় মানুষজনকে কাছে পাওয়ার জন্য এখন তিনি একটু আকুলই থাকেন যেন। ওষুধ খেতে খেতে, রোগে ভুগতে ভুগতে ইদানীং অধৈর্য মনোভাবও দেখা যায় কখনও চকিতে। পরে সেই ব্যবহারের জন্য অনুতাপও বোধ করেন। এ দিন রানী যখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করলেন কী খুশি তিনি। সত্যিকারের আনন্দে বলে উঠলেন, “আরে! এ যে যায়নি দেখছি!”

রানী মনে মনে নিজেকে পুরস্কৃত বোধ করলেন। ঘরে তখন অনেকেই আছেন। রবীন্দ্রনাথ বেশ আড্ডার মেজাজে। হঠাৎ মিস র‍্যাথবোনের চিঠির প্রসঙ্গ উঠল। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট-সদস্যা মিস এলিনর র‍্যাথবোন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভারতীয়দের সাহেবদের পক্ষে যোগ দেওয়ার ডাক দেন। তাঁর মতে, ভারতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা দিয়ে উন্নত করেছে ইংরেজ। এ বিষয়ে তিনি একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আত্মা এতে অপমানিত বোধ করে। তিনি ক্ষোভপ্রকাশ করে চিঠির উত্তর দেন, জানিয়ে দেন ভারতবাসীর বিবেকের প্রতি মিস র‍্যাথবোন অশোভন অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন।

উপস্থিত একজন বললেন, “আপনি উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন।”

রবীন্দ্রনাথ বললেন, “আমার আজকাল ইচ্ছে করে না একটুও পরিশ্রম। করতে। এই রকম শরীরের হাল। কিন্তু কী করি বলো? ওই মন্তব্য তো মেনে নিতেও মন চায় না। তাই মনে যা ছিল, বাধ্য হয়ে লিখে জানালুম।”

কেউ একজন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, “যত সভ্য ইংরেজরা নিজেদের মনে করে, ব্যবহারে তো তার চিহ্ন দেখছি নে।”

রবীন্দ্রনাথ যেন জ্বলে উঠলেন, “সভ্য জাত! আজ দুশো বছরের সিভিলাইজড রাজ্যশাসনের গুঁতোয় দেশে না আছে অন্ন, না আছে বস্ত্র, না আছে স্বাস্থ্য, না আছে শিক্ষা! একটুখানি তৃষ্ণার জলও পায় না দেশের মানুষ। শুধু ল অ্যান্ড অর্ডার আর এই সব দাম্ভিক কথাবার্তা। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছে। অসহ্য লাগে আমার।”

রানী দেখলেন অশক্ত, কুঁজো হয়ে যাওয়া মানুষটা গনগনে হয়ে উঠেছেন। এ একেবারে অচেনা রূপ তাঁর কাছে। কবিকে এত উত্তেজিত হতে তিনি এর আগে দেখেননি। রাগ হলেও বরাবর রবীন্দ্রনাথ শান্ত ভাবেই কথা বলেছেন। বোধহয় শরীরের দুর্বলতার জন্যেই বিদ্রোহের প্রকাশটা সর্বসমক্ষে হচ্ছে। দেশকে ভালবাসার বোধ তাঁর ছিল অত্যন্ত গভীর। কিছুক্ষণ পর রবীন্দ্রনাথ আবার অস্থির ভাবে বলতে শুরু করলেন, “তোমরা তো দ্যাখোনি, আমি দেখেছি গ্রামের মানুষের কী জলকষ্ট। জমিদারিতে যখন ছিলুম দেখেছি, পাঁচ মাইল দূর থেকেও মেয়েরা আসছে নদীতে এক কলসি জল সংগ্রহের জন্য। নিজের চোখে দেখেছি মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেই কাদাগোলা জল গামছা দিয়ে ছেঁকে কলসিতে ভরছে ওরা। ল অ্যান্ড অর্ডার দিয়ে হবেটা কী, যদি গরমের দিনে জল না পেয়ে তেষ্টায় মরে যেতে হয়? আগে পানীয় জল দাও, তারপর সভ্যতার কথা বলো।”

শ্রোতারা সবাই রবীন্দ্রনাথের বাক্যনিঃসৃত আবেগে আত্মহারা। মেয়েদের চোখে অবশ্য একটু আশঙ্কাও। উত্তেজনায় কবির ক্ষতি হতে পারে। রানী মহলানবিশ রানী চন্দকে নিয়ে গুরুদেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। রানী মহলানবিশ স্নিগ্ধ স্বরে বললেন, “গুরুদেব!”

রবীন্দ্রনাথ ফিরে ওদের দৃষ্টির মধ্যেই শান্ত হওয়ার প্রার্থনা খুঁজে পেলেন। নারীর মধ্যে চিরকাল তিনি কল্যাণময়ী রূপ দেখতে পেয়েছেন। আজও দেখলেন দুই নারী তাঁর সুস্থতা চাইছেন প্রবল ভাবে। নিজেকে সংযত করতে গিয়েও বিস্ফোরিত হলেন রবীন্দ্রনাথ, আবেগ আজ আর তাঁর বশে নেই। খোলা গলায় বিস্ফোরিত হলেন, “এদের লজ্জা করে না নিজেদের সিভিলাইজড গভর্নমেন্ট বলতে? ওই জলকষ্টের কথা যেই আমার মনে আসে, শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে! মনে হয় হাতে যদি বন্দুক থাকে তো দিই গুডুম করে চালিয়ে!”

গুরুদেবের এই ভয়ংকর রূপ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন দুই নারী। রানী চন্দ ছুটলেন ঠিক জায়গায় খবর দিতে। দ্রুত খবর পেয়ে এলেন রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমা দেবী। প্রতিমা দেবী যা বলবেন, গুরুদেব অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন, এমন নির্ভরতা। তিনি পাশে বসে, যেমন করে জননী খ্যাপা শিশুকে শান্ত করেন, তেমন ভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরলেন। অভিভাবকদের নির্দেশ আর স্নেহময়ীর আকুলতা মিশিয়ে ডাকলেন, “বাবামশায়!”

রবীন্দ্রনাথ লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে রাখলেন জানলার দিকে। এভাবে কিছুক্ষণ। তাঁকে এরপর বিছানায় শুইয়ে দিতে গিয়ে প্রতিমা দেবী খেয়াল করলেন রবীন্দ্রনাথের চোখের কোল ভেজা। ধৈর্যচ্যুতি, কান্না—এসব রবীন্দ্রনাথে বিরল। বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল প্রতিমা দেবীর। এসব কি তবে অবসানের লক্ষণ? রথীন্দ্রনাথ এবং রানী চন্দ, রানী মহলানবিশ ছাড়া অন্যেরা চলে গিয়েছে। প্রতিমা দেবী গিয়ে রথীন্দ্রনাথকে ডাকলেন ঘরের বাইরে। বললেন, “বাবামশায়ের এমন রূপ আমার ভাল লাগছে না কিন্তু।” রথীন্দ্রনাথের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন