সম্ভবত ১৯৮৫-৮৬ সাল হবে, আমার জিহ্বা তখন প্রখর, আর বাবা ক্ষমতাসীন বাম দলের একজন শ্রমিক নেতা হিসাবে মফস্সল শহরে বিড়ি-শ্রমিকদের মধ্যে রাজত্ব চালাচ্ছেন। সরকারি চাকরিতে বেতন বৃদ্ধি হয়েছে। বাবা আর বিড়ি বাঁধছেন না। বাবার চাকরি পাওয়া বন্ধুরা সকলেই লায়েক হয়েছেন। পাড়ায় তাদের দাপট দেখছি। কেউ আর সুকান্তের কবিতা শুনতে চায় না। বরং দেখা হলেই আমাকে জ্ঞান দান করছে “মন দিয়ে লেখাপড়া করো, চাকরি জোটাও, সংসারের দায়িত্ব নাও, বাবা নেতা থাকতে থাকতেই…”। শুনতে শুনতে আমার গুটিয়ে থাকা মন ক্রুদ্ধ হত। কিছু বলতাম না। কিন্তু ওদের আর মানতামও না। বাবাকেও আর পছন্দ হত না। সংগ্রামের পরিবেশে বড় হবার কারণে আমারও সংগ্রামী মেজাজ! তদুপরি বাবার ব্যবহৃত লাল বই তখন আমার বইয়ের তাকে শোভা পেত। বই পড়বার সময় নেই, অফিস করবার সময় নেই, মিটিং-মিছিল, হাজারও সভায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো—বাবার জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমার লেখালেখির ইচ্ছা, নাট্যদল পরিচালনা ইত্যাদিকে কটাক্ষ করা তখন তার নিত্য অভ্যাস। এরকম দ্বন্দ্বেই আমি গৃহত্যাগ করার পরিকল্পনা নিচ্ছি মনে মনে। চূড়ান্ত বাধল তাদের এক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিয়ে। আমাদের অঞ্চলের কিংবদন্তি সাহিত্যিক সত্যরঞ্জন মৈত্রের কথা আগেই বলেছি। বাম আন্দোলন শুরু হবার দিনে এই শ্রমিক-কবির অবদান বলার নয়। বাবাদের বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি তিনি হয়েছিলেন। যা হোক, বাবাদের পার্টি ক্ষমতায় আসার সময় তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন, জীর্ণ-শীর্ণ শরীর, কতকগুলি প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিড়ি শ্রমিক সংগঠন তখন আর কেবলমাত্র বিড়ি শ্রমিকদের নেই। পার্টির নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। তখন তো আর বিরোধী শক্তি হিসাবে অ-বাম সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করবার পরিস্থিতি নয়, দাবি আদায়ের জঙ্গি আন্দোলন করা যাচ্ছে না। শ্রমিকবন্ধু-সরকার এমনিতেই বিড়ি শ্রমিকদের ভাল জীবন লাভ করার ব্যবস্থা করবে, ভাবা হয়েছিল। তা হল না। মজুরি কিছু বাড়ল, এই মাত্র! সত্যজেঠুর কাছে শুনেছি, এইসব প্রশ্ন তিনি তুললে তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। উনি সৃষ্টিশীল মানুষ। আঘাত পেয়ে, অভিমান বুকে নিয়ে কবিতা-গল্প-নাটকের জীবনে আত্মগোপন করলেন। কলমে উঠে আসতে থাকল স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। বাবার তো কোনও সৃষ্টিশীল জগৎ ছিল না। বাবা সত্যজেঠুর অনুপস্থিতিতে পার্টির অনুগত দাস হয়ে বড় নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হল। আমাকে সত্যজ্যেঠুর কাছে বাবাই নিয়ে গিয়েছিল একদিন, তখন বাবাই আবার তাঁকে ‘বুর্জোয়া’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘অন্তরে কংগ্রেসি’ বলে গালাগালি পাড়ল নিজের বন্ধুবর্গের কাছে, আর আমাকে নিষেধ করছে যাতে সত্যরঞ্জন মৈত্রের সান্নিধ্যে না যাই। প্রত্যাশাভঙ্গের কথা বলে পার্টির কাছে সমস্ত মহিমা হারালেন সত্যজেঠু। তাঁর ছোট্ট প্রেসে পার্টির ছাপাছাপির কাজ হত। সকলই বন্ধ হল। শাসকদল-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তাঁর প্রেসে আর কিছু ছাপাতে পাঠাল না। দরিদ্র প্রতিভাবান মানুষটি জলে পড়লেন। আমি তাঁর সহচর। উনি নতুন কাগজ প্রকাশ করলেন। বিজ্ঞাপন জোগাড় করতাম, বন্ধুদের কাছে বিক্রি করতাম। যতটুকু সাহায্য আমার পক্ষে করা সম্ভব। তাতে জেঠুর লাভ হয়েছিল সামান্যই, কিন্তু আমি বাড়িতে বাবার চক্ষুশূল হয়ে উঠলাম। আমি বিচ্ছিন্ন না হলে বাবা পার্টিতে চাপে পড়ত। গৃহত্যাগের সময় আসন্ন বুঝে নিজের জীবনের পরিকল্পনা করলাম। ভারমুক্ত জীবন কাটাব। স্বাধীন, সৃষ্টিশীল, অরাজনৈতিক মৃত্যুর শপথ নিলাম। সেই সময় সত্যরঞ্জন মৈত্র ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। অতি দ্রুত কলকাতার হাসপাতালে অল্প কিছু গুণগ্রাহীর প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি দেহত্যাগ করলেন। আমাদের নদী-তীরবর্তী শ্মশানে তাঁকে নিয়ে আসা হল তাঁর শেষ ইচ্ছাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য। শেষযাত্রায় একজনও পার্টিবন্ধু নেই। মাথায় আগুন জ্বলল, বাবা নেই? বাবাও নেই? ষোলো কেজি ওজন হয়েছিল মৃত্যুকালে সত্যজ্যেঠুর। নিরলস সংগ্রামী এই সাহিত্যিককে এখন সকলেই ভুলে গেছে। আমি ভুলিনি। আজকের জীর্ণ, শীর্ণ, মরণোন্মুখ, পার্টিবন্ধুহীন, অসহায় বাবার প্রসঙ্গে সত্যজেঠুর ছবিটি বারবার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠছে। যা হোক, অকস্মাৎ ঝগড়ায় উঠে এসেছিল কিছু ঝলক, একদিন, আমার এবং বাবার ভিতর। একদিকে দেশ ভেঙে যাবার কারণে ধনীর দুলাল থেকে সর্বহারা শ্রমিকে পরিণত হওয়া অশিক্ষিত পটুত্বে নির্মিত বাম শ্রমিকনেতা, অন্য দিকে সর্বহারার সন্তান, যে শৈশবাবধি বামপন্থী পরিবেশে বড় হয়েছে, সুকান্ত ভট্টাচার্যকে শ্রেষ্ঠ কবি ভেবেছে যার শিশুমন-কিশোরমন, লাল বই যার পড়া, শিক্ষা ও সংস্কৃতি যাকে পরবর্তী কালে নিজের মতো চিন্তা করতে শিখিয়েছে, চতুরও করেছে কিছু-বা। পলায়নবাদীতে রূপান্তরিত হওয়াই যার নিয়তি। কেননা অ-বাম রাজনৈতিক দলগুলির উপর তার ঘৃণা রক্তসূত্রে অর্জিত, অপর পক্ষে বামেরা আদর্শ সমাজ আনবে তা আর সে বিশ্বাস করতে পারছে না, ফলত সে কল্পভুবন নির্মাণ করবে, আর তার ভিতরেই বাস করতে থাকবে ভয়ার্ত অন্ধের মতন। দুইজনে মুখোমুখি এক অমীমাংসিত কথোপকথনে নেমেছিলাম। সাম্প্রতিক ইতিহাস সব দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে পারে না। ভবিষ্যতের দিকে তা প্রবাহিত হয়। আজ এই সংকটের মুহূর্তে তা লিপিবদ্ধ করা গেল।
আমি—তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
বাবা—হ্যাঁ। তাই নাকি?
আমি—এভাবে বলছ কেন?
বাবা—না, তুমি তো খুব লায়েক হয়েছ আজকাল।
আমি—তুমি কি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দিয়েছিলে যে, আমার বিকাশ হবে না ঠিকঠাক!
বাবা—হুম্ম্ম্! আদর্শ না থাকলে কথাবার্তা এরকমই হয়। কী বলবি বল! আমার অফিস আছে।
আমি—তোমাকে কি অফিস করতে হয়? ইউনিয়ন করলেই তো চলে যাচ্ছে।
বাবা—খাচ্ছিস আমার টাকায়! সংগঠন না করলে এই সুদিন আসত কোনও দিন? কংগ্রেসিদের মতো টিপ্পনী কাটছিস!
আমি—আমি কিন্তু কংগ্রেস করি না।
বাবা—না করতেই পারিস! কিন্তু চিন্তাটা তো ওদের মতোই হয়ে যাচ্ছে। যাহোক, কথাটা বল! টাকা লাগবে, তাই তো?
আমি—টাকা আমার লাগবে না। কথা আছে। কথাই।
বাবা—আচ্ছা! সংক্ষেপে বল।
আমি—সত্যজেঠুর শেষযাত্রায় গেলে না কেন?
বাবা—কেন যাব? উনি আমাদের লোক আর ছিলেন না।
আমি—বিরোধী দলের লোক ছিলেন?
বাবা—বিরোধী তো বটেই। অন্য দল না-করুক, পার্টির শত্রু ছিলেন।
আমি—পার্টিটা কী?
বাবা—ফালতু প্রশ্ন করিস না। আর কিছু?
আমি—তোমাদের পার্টি কী আমি জানি না। এই অঞ্চলে তিনি একজন সম্মানীয় সাহিত্যিক। তাঁর কবিতা দিয়ে তোমাদের পোস্টার হত পর্যন্ত! বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের তিনিই প্রথম সভাপতি। তাঁর মতো শিক্ষিত লোক বিড়ি শ্রমিক ছিলেন বলেই অত বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে তোমাদের ইউনিয়ন। শ্রমিকেরা তাঁকে ঈশ্বরের মতো মানত। যখন কিছু ছিল না, উনিই ছিলেন সবটা। এখন পালে বাতাস পড়তেই তাঁকে বেমালুম ভুলে গেলে?
বাবা—উনি পার্টির সঙ্গে বেইমানি করেছেন।
আমি—কী বেইমানি?
বাবা—বাইরের লোক হয়ে সবটা তুই বুঝবি না। সাহিত্য-টাহিত্য করিস তো, সেই মোহেই ওকে ভগবান ভাবছিস। আমাদের পার্টিতে ভগবানটগবান হয় না। সবাই একজোট হয়ে সংগ্রাম করি।
আমি—তোমাকে সত্যি সংগ্রাম করতে আমি একসময় দেখেছি। এখন সংগ্রাম শব্দটা একটা অভ্যেস। রোজ দশবার বক্তৃতায় ব্যবহার করতে করতে ঠোঁটের আগায় ঘোরে।
বাবা—তুই কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছিস! কী বলতে চাস স্পষ্ট করে বল।
আমি—তুমিও স্পষ্ট করে বলো, কেন সত্যজেঠুর দুর্দিনে পাশে দাঁড়ালে না? ওঁর মৃত্যুকে সম্মান করলে না?
বাবা—পার্টির কাছে উনি বেশ কিছুকাল হল মৃত।
আমি—তোমার কাছে?
বাবা—আমার কাছে…মানে…আমি তো সত্যদাকে…শোন, আমি হানড্রেড পারসেন্ট পার্টিম্যান!
আমি—পার্টিম্যান? তাহলে স্পষ্ট করে বলো পার্টি কী?
বাবা—বোকার মতো কথা বলিস না। পার্টি কী, তুই জানিস না? তুই কি অশিক্ষিত?
আমি—আমি আমার মতো করে জানি। বলা যায়, মার্কসের মতো করে জানি। স্বপ্নদল হিসেবে জানি। স্বপ্নকর্মীও বলা যায়।
বাবা—হাঃ-হাঃ! কাব্য করে তোর মাথাটা গেছে! তোর তো কোনও সংগ্রাম নেই। কোনও দিন কোনও শ্রমিককে বুকে জড়িয়ে ধরে কমরেড বলেছিস? তোর সঙ্গে কী কথা বলব?
আমি—তাচ্ছিল্য করো। কিন্তু উত্তর দাও ক্ষমতা থাকলে! ক্ষমতা থাকলে আমাকে কমরেড বলে জড়িয়ে ধরো তো! একটু অপছন্দের কথা বললেই তাকে তাচ্ছিল্য করা! প্রয়োগকর্তাদের ক্ষমতার অহংকারই মার্কসের তত্ত্বকে মানববিরোধী করে দিয়েছে।
বাবা—খুব ইনটেলেকচুয়াল হয়েছিস তো! কাগজের বাঘ! তুই কি অতিবামদলে নাম লেখালি?
আমি—ক্ষতি কী? সিলেবাস তো এক।
বাবা—তার মানে?
আমি—তোমার তো বামপন্থী তত্ত্বের বই দু’-একটা পড়ার পর আর পড়ার সময় নেই, নেতা হয়ে গেলে! ক্লাস-টেলাসও আর হয় না। আমি কাগজের বাঘ তো, তাই অনেক পড়েছি। সেজন্যই জানি বামতত্ত্বের বইগুলো ফালতুবাম আর অতি-বাম—দু’দলের ক্ষেত্রেই একই। কেউ আপস করেছে, কেউ এককাট্টা হয়ে আছে!
বাবা—বড় বড় কথা তো বলছিস! বল তো, আমাদের ত্রুটিটা কী?
আমি—এর আগে যারা শাসন করেছে, তাদের থেকে তোমরা আলাদা হবে কথা ছিল। মেহনতি মানুষের স্বার্থে কাজ করবে কথা ছিল। এক দশক হয়ে যাচ্ছে শাসন, কিছু কি হয়েছে?
বাবা—হয়নি? বিদ্রুপের চোখে দেখলে সবই খারাপ দেখবি। শ্রমিকরা, কৃষকরা আগের থেকে অনেক ভাল আছে। আরও ভাল হবে।
আমি—সেটুকু ভারতবর্ষের যেসব রাজ্যে অ-বাম সরকার, সেখানেও হয়েছে। ওটা তো সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস। এমনিতেই হবে। হাসপাতাল উন্নত হবে, রাস্তাঘাট পাকা হবে, যানবাহন-ব্যবস্থা ভাল হবে। সব জায়গাতেই হবে। সারা পৃথিবী জুড়েই হবে। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে সমাজের? শ্রমিককৃষকেরা সমাজে শ্রেষ্ঠ আসন না হোক, সম্মানজনক আসন পেয়েছে? গ্রাম যোগ্য মর্যাদা পেয়েছে?
বাবা—মনে রাখবি, পার্টি কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করতে পারেনি।
আমি—ভোটে দাঁড়ালে আর দখল হয়? বড়জোর নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত হওয়ার মেশিনারি তৈরি করতে পারলেই জিতবে, বুঝতে পেরে এখন তো তোমাদের সেই দিকেই মন। সরকারি কর্মচারীদের মাইনে বাড়ল, শিক্ষক-অধ্যাপকদের মাইনে ক্রমশ আকাশছোঁয়া হচ্ছে। মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ, অতএব ওরা খুশি হলেই ভোটে জেতা সহজ হবে। কে আর শ্রমিক-কৃষক মনে রাখে?
বাবা—আমাদের হাতে নিষিদ্ধ নৈরাজ্যবাদী বামপন্থীদের যেসব ইস্তাহার আসে, তার সঙ্গে তোর কথাবার্তা মিলে যাচ্ছে। তুই কি ঘরশত্রু বিভীষণ হলি শেষ পর্যন্ত?
আমি—মনে হচ্ছে, ভয় পেয়েছ?
বাবা—আমরা সংগ্রামী। মরতে ভয় পাই না।
আমি—হারতে ভয় পাও।
বাবা—কী বলতে চাস?
আমি—আমি কাগুজে বাঘ তোমার কথায়। তাই মেনে নিলাম। আমার যা মনে হয়, সেটাও শুনে রাখো।
বাবা—শুনতে আমি বাধ্য?
আমি—ভয় নেই, তোমার ক্ষতি হবে না। পার্টিতে তোমার বদনাম হবে না। এই সব কথাগুলো ক’বছরে জন্মেছে। বলে ফেলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তুমি বোলো, ও বুর্জোয়া, তাই ওকে ফ্যামিলি থেকে সাসপেন্ড করেছি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন