কবিকে অস্ত্রোপচারের জন্য জোড়াসাঁকো নিয়ে যাওয়া হবে। সমগ্র দেশ তাঁকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। একান্ত সহচরী, সেবিকাদের সামনে রবীন্দ্রনাথ চোখের জল অবধি ফেলছেন। সেকথা জানতে পেরে ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকরা পর্যন্ত বলছেন, কবির সম্মতি না থাকলে অপারেশন এখন না করলেই হয়। তিনি যে ভাল হয়ে যাবেনই, এই বয়সে তা নিশ্চিত বলা যায় না। কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়দের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ গেলেন না। শান্তিনিকেতনে গোছগাছ শুরু হয়ে গেল। এরই মধ্যে প্রতিমা দেবী জ্বরে পড়লেন। বুকে সর্দি বসে তাঁর ব্রঙ্কাইটিস হয়েছে। বিপন্নতম পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সবচেয়ে ভরসার মামণিকে দেখতে না পেয়ে আকুল হয়ে উঠলেন। প্রতিমা দেবী নিজেই চান না তাঁর অসুস্থতার খবর কবি জানুন। তাহলেই তিনি বিচলিত হয়ে পড়বেন। প্রশান্ত মহলানবিশ আবার কলকাতায় বেশ অসুস্থ। সেই খবর পেয়েও রানী মহলানবিশ কবিকে ছেড়ে স্বামীর কাছে যেতে পারছেন না। প্রশান্তরও বক্তব্য, রানী যেন এই অবস্থায় কবিকে ছেড়ে চলে না আসেন।
রবীন্দ্রনাথ কবে কখন কলকাতায় আসছেন, গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নইলে হাওড়া স্টেশনে খুব ভিড় হয়ে যাবে। রথীন্দ্রনাথ, অনিল চন্দ আগের দিন পৌঁছে গেলেন চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা করতে। শান্তিনিকেতনে কবি-বিদায়ের সুর বেজে উঠল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ জিনিসপত্র গোছগাছ করা নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। বনমালী জরুরি কারণে নিজের বাড়ি গিয়েছিলেন। হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসেছেন খবর পেয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে বললেন, “তুই তো হাওয়া হয়ে গিয়েছিলি ক’দিন, জিনিসপত্র কোথায় কী গেছে, ঠিক করে দেখেশুনে নিস কিন্তু। দরকারের সময় সব যেন পাওয়া যায়।”
অনিল চন্দ বিদায় নেওয়ার সময় প্রণাম করে বললেন, “গুরুদেব, আগে চলে যাচ্ছি। আপনার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।”
রবীন্দ্রনাথ জানলার বাইরে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “গাড়ির ব্যবস্থা, না মারবার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছ?”
উপস্থিত সকলেই রবীন্দ্রনাথের এই কথায় হা হা করে উঠলেন। অনিল চন্দ কেঁদে ফেলবার গলায় শুধু এটুকুই উচ্চারণ করতে পারলেন, “গুরুদেব!”
সমবেত প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ একটু হাসলেন। অভিমানাহত হৃদয় থেকে কথাটা উঠে এসেছিল। এখন বিষয়টাকে লঘু করে দেওয়ার জন্য বললেন, “বাঙাল ঠাট্টাও বোঝে না।”
রানী মহলানবিশ বললেন, “এরকম ঠাট্টা মোটেই ভাল নয়।”
রবীন্দ্রনাথ চুপ করে থাকলেন। অনিল বিদায় নিলেন।
পর দিন যাওয়া হবে, শেষ বেলায় যদি ভুলে যান, তাই সব কর্তব্য সেরে নিচ্ছেন কবি। প্রতিমা দেবীর অনুপস্থিতির কারণ তাঁকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে। কবি যাতে সর্দি-কাশির জীবাণুতে সংক্রামিত না হন, তাই অসুস্থ প্রতিমা দেবী সামনে আসছেন না। ‘বিশ্বভারতী কোয়াটারলি’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলেন “মা-মণিকে, বাবামণি”। তারপর নাতনি নন্দিতা অর্থাৎ বুড়িকে দিলেন প্রতিমা দেবীকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
আশ্রমবাসীরা গুরুদেবের চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাওয়ার খবরে চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। সবার মন খারাপ। সবাই ছুটে আসতে চান কবির কাছে। কিন্তু তাঁর শরীরের কথা ভেবে সবাই দূরে দূরে শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
সাধারণ দর্শনার্থীও রোজকার মতো ভিড় করে আছে। বিজ্ঞপ্তি দেওয়া সত্ত্বেও মানুষ প্রতিদিন উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন একটিবার কবিকে যদি দেখতে পান। কবির শরীরের কথা ভেবে কাউকেও অনুমতি দেওয়া হয় না। তাঁরা আশ্রম প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ান উদ্দেশ্যহীন। ময়মনসিংহ থেকে একটি অল্পবয়সি তরুণ তিন-চার দিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে কবিকে দেখবে বলে। অনুমতি পাচ্ছে না, ফিরেও যাচ্ছে না বাড়ি। রানী মহলানবিশকে সামনে পেয়ে ছেলেটি কেঁদে পড়ল, “একটিবার গুরুদেবকে চোখের দেখাও দেখতে পাব না! তিন দিন ধরে বসে আছি।”
রানী সেই কাতরতায় বিচলিত হলেন। কিন্তু কবির কাছে কাউকে নিয়ে যাওয়া এই মুহূর্তে সম্ভবও নয়। তিনি ছেলেটিকে বুঝিয়ে বললেন, “কবির ক্লান্ত, দুর্বল শরীর। কাউকেই তাঁর কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ওঁর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।”
ছেলেটি কেঁদে পড়ল, “একবার বাইরে থেকে দেখে চলে আসব।”
রানী অসহায় ভাবে তাকে ‘না’ বলে চলে এলেন। কিন্তু ছেলেটির মুখ তিনি ভুলতে পারছিলেন না। কবির ঘরে গিয়ে তিনি দেখলেন সুধাকান্তবাবু আছেন। সুধাকান্তবাবুকে কাছে ডেকে ফিসফিসিয়ে ছেলেটির কথা বললেন। শুনেই সুধাকান্ত লাফ দিয়ে উঠলেন, “অসম্ভব। একজনকে অনুমতি দিলেই সর্বনাশ। কাউকেই আর ঠেকানো যাবে না।”
রানী অগত্যা বললেন, “আপনি একটু ছেলেটিকে মিষ্টি কথা বলে বিদায় দিয়ে আসুন।”
সুধাকান্তবাবু চলে গেলেন। রানী কবির শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, “কী গোপন পরামর্শ হচ্ছিল আমার বলডুইনের সঙ্গে?”
রবীন্দ্রনাথ নিকট-সঙ্গীদের নানা মজার নামে ডেকে থাকেন। সুধাকান্তবাবুকে ‘বলডুইন’ নামে ডাকার কারণ প্রধানমন্ত্রী বলডুইনের মতো সুধাবাবুরও টাকমাথা। কবি বলেন, “শুধু একটা ছাতা বগলে নেই, এই যা।”
যা হোক, কবির প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রানী ছেলেটির কথা জানালেন রবীন্দ্রনাথকে। সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, “আহা, ছেলেটিকে একবার আসতে দাও না। আমি চুপ করে থাকব। কথা না বললে তো আর ক্লান্ত হ’ব না। একবারটি দেখা দিলেই কি ক্ষয়ে যাব? আমার ভাল লাগে না সবাইকে তোমরা এইভাবে ঠেকাও বলে।”
কথা শেষ হতে না হতে সুধাকান্তবাবু ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনিও এড়াতে পারেননি সেই যুবককে। অবাক চোখে তরুণটি অসুস্থ, বৃদ্ধ, বিশ্বজয়ী কবিকে দেখছেন। চোখের পলক পড়ছে না যেন। অভিভূত হয়ে পড়ার মতো দৃশ্য। কত ভালবাসে মানুষ রবীন্দ্রনাথকে। যেন তিনি বাঙালির দেবতা। বুড়ি গিয়ে ছেলেটিকে বলল ঘরে এসে গুরুদেবকে প্রণাম করে যেতে। জীবন যেন ধন্য হয়ে গেল ছেলেটির। প্রণাম করার সময় ভক্ত ছেলেটি কোনও কথা বলল না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেল।
সন্ধের পর নন্দলাল বসু, ক্ষিতিমোহন সেনরা কয়েকজন এলেন গুরুদেবের কাছে। সকলে প্রণাম করে বসলেন। শরীর নষ্ট হয়ে গেছে, মনও যেন বিভ্রান্ত, রবীন্দ্রনাথ সারা দিন এলিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ এতগুলো আশ্রমসঙ্গীকে কাছে পেয়ে খুশি হলেন। পুরনো মেজাজে ফিরে আসার চেষ্টা করলেন প্রাণপণ। ঠাট্টা-তামাশা করছেন। কিন্তু সব কথাবার্তাই ঘুরেফিরে অস্ত্রোপচার প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে। তিনি মাঝে মাঝেই অন্যমনা হয়ে পড়ছেন।
নন্দলাল বললেন, “আপনি কলকাতা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরবার পর আমরা আনন্দ-উৎসব পালন করব।”
রবীন্দ্রনাথ বিড়বিড় করে কী বললেন, বোঝা গেল না।
ক্ষিতিমোহন কিছুটা সময় রবীন্দ্রনাথের ভাব লক্ষ করলেন। তারপর বললেন, “শ্রাবণে তো বৃক্ষরোপণ উৎসব হয়। আপনার প্রত্যাবর্তনের দিনই এবার আমরা উৎসব করব।”
রবীন্দ্রনাথ সচকিত হলেন। প্রতিমা দেবীর টবের বকুল গাছটা নিয়ে একবার বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান হয়েছিল, মনে পড়ল। মজা পেলেন খুব। বললেন, “নন্দলাল সাজিয়েছিলেন পঞ্চভূত। বেশ হয়েছিল।”
নন্দলাল বললেন, “ক্ষিতি সেজেছিল সত্যেন্দ্রনাথ বিশী। অপ্ হয়েছিল। সুধীর খাস্তগীর। তেজ হয়েছিল প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মরুৎ মনোমোহন ঘোষ, আর ব্যোম অনাথনাথ বসু। আপনি সেবার ‘বলাই’ পড়েছিলেন।”
কবি কিছুক্ষণ ভাবের ঘোরে হারিয়ে গেলেন যেন। তারপর ক্ষিতিমোহনকে বৃক্ষরোপণ উৎসব মন্ত্রের একটা অংশ মনে করিয়ে দিয়ে আবৃত্তি করতে বললেন।
ক্ষিতিমোহন উচ্চারণ করলেন,
“অসদ্ ভূম্যাঃ সমভবৎ তদ্যাম্ এতি মহদ্ ব্যচঃ।
শতেন মা পরি পাহি সহস্রেণাভি রক্ষ মা ॥”
রবীন্দ্রনাথ মনে মনে ভাবলেন মন্ত্রের কথাই। যা অভূত, পৃথিবীর অন্তর থেকে তা-ই হল আবির্ভূত, তারই মহাবিস্তার চলেছে দ্যুলোকের দিকে…শতভাবে আমাকে তুমি প্রতিপালন করো, সহস্রভাবে আমাকে তুমি অভিরক্ষণ করো…
রবীন্দ্রনাথ হাজার ঢেউয়ের ভেতর ভাসতে লাগলেন। সেই আচ্ছন্নতা দেখে স্বজনেরা ঘর ছেড়ে গেলেন।
ই. আই. রেলওয়ের অধিকর্তা এন. সি. ঘোষ কবির জন্য বিশেষ একখানা সেলুনগাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। সন্ধেবেলা মি. ঘোষ এসে গেলেন। সঙ্গে জ্যোতি। ঘোষবাবু স্টেশনেই থেকে গেলেন। জ্যোতি এলেন উদয়নে। রবীন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ভোরবেলাতেই কবি পোশাক পরে তৈরি। বসে আছেন পুবদিকের জানলার কাছে। শান্তিনিকেতনের শেষ ভোরকে যেন শেষবেলার ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নিচ্ছেন।
কিছু পরে আশ্রমের ছেলেমেয়েরা এল। তাদের গলায় গান “এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার…”। গাইতে গাইতে তারা উদয়নের ফটক পেরিয়ে কবির জানলার নীচে এসে দাঁড়াল। কবি জানলার পাশে বসে ছেলেমেয়েদের ভালবাসা গ্রহণ করলেন। এরা একদিনও অসুস্থ কবির কাছে আসতে পারেনি। তাদের নিরুচ্চার প্রার্থনায় কবি অশ্রুভেজা হয়ে উঠলেন। কেন এত রক্তমাংসের আবেগ হচ্ছে তাঁর, বুঝতে পারছেন না। শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে তাঁর মন চাইছে না। মনে হচ্ছে এই-ই শেষ যাত্রা। স্বপ্নের পৃথিবীতে আর ফেরা হবে না। কত স্মৃতি মনে ভিড় করছে। কেউ তাঁর ভেতরটা পড়ে দেখছে না! কর্মকর্তারা তাঁকে সুস্থ করার নামে কেন আশ্রমের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে?
ক্রমে সময় হয়ে এল। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মা-মণি বিদায়বেলাতেও সামনে আসতে পারল না। বুকটা ব্যথায় টনটন করছে কবির। সবাই কবিকে বড় ইজিচেয়ারে বসিয়ে নীচে নামিয়ে আনল। উদয়ন প্রাঙ্গণে তিনি একটু অপেক্ষা করলেন। কবির চোখে কালো চশমা। আশপাশ থেকে সেই দৃশ্য দেখে শান্তিদেব ঘোষ একা-একাই ফুঁপিয়ে উঠলেন। তাঁর মনে হল, বিদায়বেলার বেদনা তাঁকে কাঁদাচ্ছে। সেই কান্না আড়াল করার জন্যই গুরুদেব কালো চশমা পরেছেন। আশ্রমের ছেলেমেয়েরা এবার গাইল—“আমাদের শান্তিনিকেতন/ সে যে সব হতে আপন/ তার আকাশ ভরা কোলে/ মোদের দোলে হৃদয় দোলে/ মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন…”
স্ট্রেচারে শুইয়ে কবিকে গাড়িতে তোলা হল। উদয়নের সামনে আশ্রমিকরা সব জোড়হাতে দাঁড়িয়ে। রাস্তার দু’পাশে মানুষ তাঁকে প্রণতি জানাচ্ছে। গাড়ির পেছনে রথীবাবুর মোটরে রানী মহলানবিশ ও মীরা দেবী। বুড়ি, জ্যোতি আরও অনেকে কবির গাড়িতে। আশ্রমের ভেতর দিয়ে চলল কবির গাড়ি। অনেক দিন ঘর থেকে বেরোননি। গালের নীচে হাত দিয়ে চশমা চোখে আধশোয়া অবস্থায় কবি সব দেখতে দেখতে চলেছেন। ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ পার হতে হতে কবির শুকনো গালে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুধারা। জীবনে প্রিয়জন-বিচ্ছেদের এত শোক পেয়েছেন, সহ্য করার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসম্ভব। কিন্তু আশ্রম পার হতে হতে রবীন্দ্রনাথ মনে মনে কাতর হয়ে পড়লেন। দূরদর্শী মানুষটি কি আর তাঁর ভাগ্যলিপি পড়তে পারেননি? বুঝেছিলেন, আশ্রমে আর ফেরা হবে না কোনও দিন। আশ্রমের প্রতিটি গাছপালাও আজ যেন বিচ্ছেদ-কাতর।
গাড়ি আশ্রম পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছতে দেখা গেল দু’পাশে গ্রামের মানুষ নীরব শ্রদ্ধা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে প্রণাম জানাচ্ছেন। খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চলছে। যাতে কবির শরীরে কোনও ঝাঁকুনি না লাগে। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের কলকাতায় যাওয়ার খবরে উদ্বিগ্ন মানুষেরা নিজেরা খেটে রাস্তার খানাখন্দগুলো ভরাট করেছেন। সাধারণ মানুষের কাছে দেবতার সম্মান পেয়েছেন তিনি। খ্যাতির বদলে এই প্রীতিকেই রবীন্দ্রনাথ বরাবর বেশি মূল্য দিয়েছেন। তাঁর অন্তরে যে তোলপাড় চলছিল, বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। স্টেশনে পৌঁছানোর পর তাঁকে স্ট্রেচারে বয়ে নিয়ে গিয়ে বিশেষ সেলুনকারে তোলা হল। একটা বসবার ঘর আর তার পাশে শোবার ঘর রয়েছে। প্রথমে কিছুক্ষণ বসবার ঘরে চেয়ারে বসে জানলা দিয়ে পিছনে চলে যাওয়া বোলপুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কবি। অজয় পার হবার সময় বুড়ি অর্থাৎ নন্দিতা বলল, “অজয় দেখছ?”
ম্লান কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “কতদিন পরে।”
একটু পরেই শোবার ঘরে শুইয়ে দেওয়া হল তাঁকে। গাড়িতে বেশ গরম। হাতপাখায় বাতাস করছিলেন রানী মহলানবিশ। মীরাদি আর বুড়ি মাঝে মাঝে এ ঘরে এসে বসছেন। চিঁড়ের মণ্ড খাওয়ানো হল অল্প করে। বর্ধমান স্টেশনে মি. ঘোষ এসে যেই জিজ্ঞেস করেছেন, “কষ্ট হচ্ছে না তো?” সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ গলায় বললেন, “না, ‘মুণ্ডু’ খেতে খেতে বেশ চলেছি।” শরীরে প্রাণশক্তি নেই বললেই চলে, তবু কবির কৌতুকপ্রিয়তার জবাব নেই।
এভাবেই কবি হাওড়ায় পৌঁছলেন। তাঁর আসার খবর গোপন রাখা হয়েছিল। স্টেশনে ফলে ভিড় হয়নি। নিউ থিয়েটার্স-এর বাস কথামতো এসে হাজির। কবিকে নিয়ে বাস এবার ঢুকে পড়ল মহানগরে। জোড়াসাঁকোর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছেন শয্যাশায়ী রবীন্দ্রনাথ। শরীর তাঁর অনেক দিনই ভাল নেই। আজ মনও ভাল নেই। ধীরে ধীরে আচ্ছন্নতার মধ্যে হারিয়ে গেলেন কবি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন