ভাঙন

ক্যানেল পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিদিশা। বিশ্রী জ্যাম। গাড়ি, গাড়ি আর গাড়ি। বিরক্তির শেষ নেই। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবে এত গাড়িবাবু কোত্থেকে আসে? ক’বছর আগে, বিদিশা মাধ্যমিক দিয়েছে সেবার, মা আর শ্যামলেশ সেনের সঙ্গে এখানে এসেছিল সে। ভিড় ছিল। কিন্তু এরকম ধর্মতলার মোড় হয়ে যায়নি।

“শিট! এই অর্ক, চল চা খাই।”

ওরা পেছন ফিরল। দীপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ জ্যামে-অচল এক ঝা-ঁচকচকে গাড়ির জানলায়।

বিদিশা দাঁত কিড়মিড় করে উঠল, “অ্যাই দীপ! কী দেখছিস? চলে আয়।”

দীপ তাড়াতাড়ি ওদের কাছে চলে এল। চোখ বড় বড় করে বলল, “এক্সপোর্ট-কোয়ালিটি মাইরি। এইসব মেয়ে কানাডা-ফানাডা চলে যাবে।”

ঝামড়ে উঠল বিদিশা, “তাতে তোর কী?”

বোকা-বোকা মুখ করল দীপ, “আমার? আমার শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা!”

অর্ক চোখেমুখে মজা এনে বলল, “দীপ, শান্তিনিকেতনে এসেছিস, মনটা পবিত্র রাখ, মা বলে ভাব। গাইতেও পারিস—ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে…।”

বিদিশা অর্কের হাত ধরে টানল, “চল তো! ন্যাকামি করছিস।”

ওরা শেষ বিকেলে গিয়েছিল সোনাঝুরি পেরিয়ে দিগন্তের দিকে। দিগন্ত অবধি এখন আর দৃষ্টি যায় না। মাঠ ফুঁড়ে গজিয়ে উঠেছে কত না বাহারি প্রাসাদ। তবু ভাঙনের দিকে ঝুঁকে পড়লে অস্তিত্ব নাড়া খায়। কে যেন ডেকে ওঠে বুকের ভেতর। দীপ আর অর্ক অভিজাত ঘরের ছেলে। মা-বাবা দু’জনেই ব্যস্ত থাকায় তারা যেমন একাকিত্ব পেয়েছে, তেমনই পেয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। দুঃসাহসী হতে তাদের বাধা নেই। পরীক্ষার রেজাল্টটা সভ্য-ভব্য হলেই মা-বাবা খুশি। তারপর যা-ইচ্ছে করো। অতএব দীপ বা অর্ক নিত্যনতুন অ্যাডভেঞ্চারে জড়ায়। সম্পর্কের বাঁধন কী, তা তাদের জানা নেই। বাতাসে তুলোর মতো ভেসে বেড়ায় অভিজাত পরিবারগুলোর এই নতুন প্রজন্ম। শিক্ষা, কেরিয়ার, প্রেম, সর্বনাশ—কোনও ক্ষেত্রেই এদের আলাদা অনুরণন নেই, সব ব্যাপারেই যেন ‘ইটস ওকে’ টাইপ। অতএব ভাঙন দীপ-অর্ককে কী বলবে? সে যখন হাড়ে কাঁপন ধরাতে চাইল প্রেসিডেন্সির দুই সেকেন্ড ইয়ারকে, দীপ বলল, “ইউ আর রিয়েলি হট, দিশা!” …অর্ক বলল, “অ্যান্ড টু ইজ নট এনাফ।” …দাঁতে দাঁত ঘষে বিদিশা যেন মুন্ডু চিবোতে চাইল দু’জনের, “জাস্ট লাইক ঢ্যামনা গাইজ!”

হোঃ হোঃ করে হাসল দুই যুবক। দীপ আর অর্ক হাঁচড়ে-পাঁচড়ে নেমে পড়ল ভাঙনের গভীর শরীরে। কে একজন মোবাইলে গান বাজাল ইংলিশ রক। ওপর থেকে মৃদু জলধ্বনির বদলে আবছা রিদম শুনতে থাকল বিদিশা। তার গল্পটা অর্ক আর দীপের থেকে আলাদা। রিদিশার একটা মলিন বাবা আছে। কৃষ্ণনগরের এক বড়সড় বাড়ির তিনতলার ছাদের ঘরে থাকেন। অসুস্থ। স্বেচ্ছা-নির্বাসিত। বিদিশার বাবা প্রভাতরঞ্জন রায়ের সাহিত্যের নেশা ছিল খুব। এদিক-ওদিক ছোট পত্র-পত্রিকায় অনেক লিখেছেন তখন। কবিতাই বেশি, কিছু ছোটগল্পও। তখনই জয়শ্রীর সঙ্গে আলাপ, প্রেম, বিয়ে। মানুষটা বরাবরই উদাসীন। একান্নবর্তী পরিবারে মিশে থেকে পারিবারিক ব্যবসার টুকটাক কাজ, বই পড়া, লেখাপত্তর—এসব নিয়েই দিন কাটিয়ে দিতেন। আলাদা কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। তাঁকে কেন্দ্র করে একটা আড্ডা ছিল। বাইরের সাহিত্যিক-শিল্পীবন্ধুরাও অতিথি হিসেবে আসতেন প্রায়ই। সেই অতিথিদেরই একজন চিত্রকর শ্যামলেশ সেন। তখন ছবি এঁকে খাওয়া জুটত না। বিদিশার বাবা তাঁকে নানা ভাবে সাহায্য করতেন। আট বছরের মেয়ে নিয়ে জয়শ্রী একদিন চলে আসে শ্যামলেশ সেনের ফ্ল্যাটে। সবে তখন দর উঠতে শুরু করেছে শ্যামলেশের ছবির। সম্রান্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষা মিটল জয়শ্রীর। কিন্তু বিদিশা আর প্রিয় মানুষটাকে কাছে পেত না। নানা উপহার, ভ্রমণ, অতিরিক্ত আদরে ভরে থাকত তার অল্প বয়সের জীবনটা। কিন্তু কাউকে জানতে দিত না বিদিশা, গলার কাছে সব সময় আটকে আছে একটা ব্যথা, একজনকে না-পাওয়ার ব্যথা। বয়স বাড়তে ব্যথা থেকে তৈরি হল অদ্ভুত এক ঘৃণা, শ্যামলেশ সেনের প্রতি ঘৃণা। ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলের এক প্রান্তে বসে, আসন্ন সন্ধ্যায়, মা’র হাজব্যান্ড ওই সেলিব্রিটি-পেন্টারের লম্বা চুল-দাড়ির মুখটাকে অশ্রু-র আগুনে পোড়াতে লাগল বিদিশা। এ কথা সে একসময় জেনে গেছে, মা চলে-আসা মাত্র বাবা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে, ভালবাসা শব্দটার গুরুত্ব ভাবুক লোকটার কাছে ছিল খুব বেশি, জীবন সম্পর্কে সব আগ্রহ তাঁর চলে যায়। বাবা মিউচুয়াল ডিভোর্সে সায় দিয়েছে চুপচাপ। মেয়েকে দাবি করেনি একবারও। শুধু লেখা-টেখা, ব্যবসা, আড্ডা সব ছেড়ে দিয়ে মরমে মরে গেছে একদম। ছাদের ঘরে বন্দি করে রেখেছে নিজেকে। একান্নবর্তী সংসার বলেই খাবারটা জুটে যায়। কিন্তু বাবার আর কোনও সামাজিক জীবন নেই। মাধ্যমিক পাশ করার পর কেমন বড়-বড় ভাব হয় না? মনে হয় না স্বাধীনতা এসেছে? বিদিশা আর একটুও দেরি করেনি। একদিন ডিনার-টেবিলে মা’কে জানিয়ে দেয়, সে বাবার কাছে যাবে। তারপর মা’র কী নাটক! ডায়লগ উইথ কান্না! “ওই লোকটা তোকে মেরে ফেলত…ও কি একটা মানুষ! …লেখে তো রাবিশ…আমরা তোকে এত যত্ন করে মানুষ করলাম…আর তুই বাবা-বাবা করছিস।…এই ছিল তোর মনে!”

শ্যামলেশ সেন ধুরন্ধর মানুষ। মা’র পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, “শান্ত হও, শ্ৰী। বিদিশা বড় হয়েছে। সে যা চায়, তাই আমাদের মেনে নেওয়া উচিত।”

ফুঁসে উঠেছিল জয়শ্রী, “লোকটা কোনও দিন খোঁজ নিয়েছে ওর? যা, তোকে মেয়ে বলেই চিনবে না।”

বিদিশা খাবারের প্লেট ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলেছিল, “কী খোঁজ করবে? তোমরা তো আমাকে বাবার কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছ।”

শুনে জয়শ্রী চোখ উলটে জ্ঞান হারিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। কারণ আঘাতটা ছিল অপ্রত্যাশিত। কারণ বিদিশা তখনও মুখচোরা মেয়ে। সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকত, আর মনে মনে কথা বলত। সেদিন ডিনার-টেবিলে সে প্রথম বিস্ফোরিত হয়। এত দিনের জমানো বারুদে সেদিনই প্রথম আগুন লাগল। শূন্যতাকে সব সময়ই বাইরে থেকে নিরীহ, অবসাদগ্রস্ত দেখায়। কিন্তু শূন্যতার যে পাল্টা-মার আছে, তা আগে থেকে কেউ টের পায় না। জয়শ্রীরাও টের পায়নি। এমনকী বিদিশা নিজেও না। সেদিনের পর থেকে সে মরিয়া হয়ে গেল। তার গুটিয়ে-থাকা মনটাই গেল বদলে। কোত্থেকে হাজার-হাজার প্রতিশোধ-ভাবনা এসে গেল। মা’কে সে শাস্তি দেবে নিজে নষ্ট হয়ে। আর শ্যামলেশ সেনকে…শ্যামলেশ সেনকে…নাঃ, ভণ্ড শিল্পীটাকে কী করবে, তা তার মনেই থাক আপাতত।

প্রথম দিন কৃষ্ণনগরে বাবার কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা কী করুণ ছিল! মনে পড়লেই বিদিশার কান্না পায় আজও। এক্ষুনিও পেল। ওই বাড়ির কেউ তাকে চিনতে পারছে না। কী করে পারবে? কত কাল আগের সেই বাচ্চা মেয়েটি রীতিমতো কিশোরী। ঝাঁ-ঝাঁ সৌন্দর্য, তাতে লেগে আলগা বিষাদ। ফ্ল্যাটে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে হঠাৎ এই ছড়ানো উঠোন আর পেল্লাই বাড়িটার সামনে এসে বিদিশা কিছু-বা দিশেহারাও। এক বর্ষীয়ান মহিলা জিজ্ঞাসু চোখে সামনে এসে দাঁড়ালে বিদিশা কোনও ক্রমে বলেছিল, “আমি বিদিশা।”

“কিছু বলবে তুমি? তুমি কোন বাড়ির মেয়ে?”

সত্যিটা বলতে কেন যেন আটকাচ্ছিল। যেন তারও কিছু অপরাধবোধ আছে। চোখে জল এসে গেল বিদিশার। বলল, “আমি এই বাড়িরই মেয়ে। আমার বাবা প্রভাতরঞ্জন রায়।” ভদ্রমহিলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ছুটে এলেন। বিদিশার গালে হাত বুলিয়ে বললেন, “কী কাণ্ড দ্যাখো! কত্ত বড় হয়ে গেছিস রে! মুন্না, কোথায় গেলি? দ্যাখ, কে এসেছে!” বিদিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তাকে ঘিরে বেশ ভিড় হয়ে গেল বাড়ির মেয়েদের। সে বুঝতে পারল ভদ্রমহিলা তার জেঠিমা। জেঠিমা সকলের সঙ্গে তার পরিচয় করে দিচ্ছিল। সবাই তাকে অবাক হয়ে দেখছিল। তেমন কথা হচ্ছিল না। সে যেমন জেঠিমাকে স্মৃতির ভেতর খুঁজতে চাইছিল, সব ঘোলাটে দেখাচ্ছিল, এক-একবার মনে হচ্ছিল আবছা মূর্তিটার বয়স বেড়ে আজকের জেঠিমা হয়েছে, ওরাও নিশ্চয়ই সেভাবেই বিদিশাকে মনের ভেতর মেলাচ্ছে। বিদিশা ভয়ানক ভাবে টের পাচ্ছিল, একটা দুর্ঘটনা কীভাবে তার জীবনকে জটিল করে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে তার আপনজনদের।

কিছু পরে সে মুন্নার হাত ধরল। সে জানতে পেরেছে মুন্না তার কাকিমার মেয়ে, এইটে পড়ছে। মুন্নাকে সে ফিসফিস করে বলতে পারল, “বাবা বাড়ি নেই?”

মুন্না হেসে ওকে নিয়ে এগিয়েছিল। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে পৌঁছেছিল তিনতলার ছাদের ঘরের সামনে। যত এগোচ্ছিল বিদিশা, তত তার হাঁফ ধরে আসছিল। সে তো কেবলমাত্র সিঁড়ি ভাঙার পরিশ্রমের জন্যে নয়, ভীষণ টেনশন ঘিরে ধরছিল বিদিশাকে। কেমন দেখবে মানুষটাকে? মানুষটাই বা তাকে কী ভাবে নেবে? টেবিলে বসে বই-পড়া এক আবছা বাবার ছবি তার মনে আছে। মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে। ভারী নরম, শান্ত মুখ। রোগাটে লম্বা চেহারা। তাকে খুব আদর করত। মা দুপদাপ পা ফেলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত তাকে।

আরও ভেবে দেখলে আরও মনে পড়ে যেতে পারে। স্মৃতি থেকে উজাড় হতে পারে বাবা তাকে কী নামে ডাকত। কী গল্প করত। কিন্তু শান্ত, নরম মুখটা ঘুরে তাকে দেখছে, সে-ও যেতে চাইছে না, এইটুকু অবধি ভেবেই থেমে যায় বরাবরই বিদিশা। কারণ এই অংশেই কান্না উথলে ওঠে তার ভেতরে। কে এসে স্বপ্নটার গলা টিপে ধরে যেন।

তিনতলার ছাদের ঘর তখন বন্ধ। মুন্না কড়া নাড়ল মৃদু। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। স্বপ্নের মানুষটার সঙ্গে বাবা লোকটা মিলল না একদম। অযত্নের চুলে পাক ধরেছে। মুখে না-কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চশমাটা নাকের ডগায় ঝুলছে। পরনে গোলগলা সাদা গেঞ্জি আর কোঁচকানো সাদা পায়জামা। কী করুণ দৃশ্য! কোনও কথা না বলে শব্দ করে কেঁদে ফেলল বিদিশা। মানুষটা হতভম্ব হয়ে পড়লেন একেবারে। টলমল করে এসে ওর হাত ধরলেন। “আয় মুন্না” বলে মুন্নাকে ডেকে বিদিশাকে নিয়ে গেলেন এক চিলতে ঘরে। সেখানে কোনও খাট নেই। মেঝের ওপর পুরু বিছানা পাতা। ঘরময় বই। আলমারিতে, মেঝেতে, বিছানায় সর্বত্র বই।

মুন্না ঘরে ঢুকে বলল, “দাঁড়াও, চা নিয়ে আসি।” বলেই একছুটে বেরিয়ে গেল।

এখনও ভাবতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসছে বিদিশার। ঘরে হঠাৎ তারা দু’জন। জীবন থেকে হারিয়ে-যাওয়া, স্বপ্নের ভেতর ফিরে ফিরে আসা তার প্রিয়তম দেবতা বাবা এবং স্নায়ুচাপে কোণঠাসা সে।

কয়েক মুহূর্ত এভাবেই পার। তারপর মানুষটা তাকে বললেন, “কেঁদো না তুমি।”

চোখের জল মুছতে গিয়ে ভ্যাবলার মতো আরও কান্নায় ভেঙে পড়ল বিদিশা। মানুষটা তাকে বিছানায় বসিয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুমি আসবে কোনও দিন, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কেমন আছ?”

কোনও ক্রমে বিদিশা বলল, “তুমি ভাল আছ, বাবা?”

দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিলেন মানুষটা হঠাৎ। একটু যেন কেঁপে উঠছে তাঁর শরীর। বিদিশা কী করবে বুঝতে না পেরে বলে ফেলল, “আমি আবার আসব বাবা।”

ঘুরে দাঁড়িয়ে মানুষটা তার দিকে তাকালেন। বিদিশা কাঙালের মতো দেখল বাবাকে। টের পেল ভাল মানুষটার ওপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়েই রইল অনেকক্ষণ। যতক্ষণ না মুন্না দু’কাপ চা আর চানাচুর নিয়ে ঢুকল। বয়সোচিত চঞ্চলতায় মুন্না বলে উঠল, “কী খুশি হয়েছি আমরা, মামদি’ তুমি এসেছ বলে! মিষ্টি আনতে গিয়েছে হাবুলদা। এখন চানাচুর আর চা খাও।”

বিদিশা হাসল একটু, “তুমিও আমাদের সঙ্গে খাও। তোমার চা কই?”

মুন্না একটু নেচে নিল যেন,“আমি চা খাই না। চানাচুরও না। আগে সরভাজা আসুক। একসঙ্গে গপগপ করে খাব। কাকুমণি, চা নাও!”

বিদিশা বলল, “আমি মিষ্টি খাব না কিন্তু।”

মুন্না গলা ফাটাল, “বলো কী? কৃষ্ণনগরের সরভাজা পৃথিবী-বিখ্যাত। সরভাজা খাবে না, তাই হয়? ও কাকুমণি, তুমি কি এখনও রোজকার মতো চুপ করেই থাকবে? আজ তো মেয়ে এসেছে!”

মানুষটা মুখ তুলে একবার তাকালেন। মুন্নার হইচইয়ে যে মজা আছে, তার ছোঁয়া লেগেছে মানুষটার মুখে। বললেন, “তা তোরা তুমি-তুমি করছিস কেন? তোরা তো দুই বোন।”

মুন্না টরটরিয়ে উঠল, “আলাপ তো হল একটু আগে। মামদি’ আগে তুই বলুক।”

হেসে উঠল বিদিশা, “তুই তো দুরন্ত হয়েছিস খুব!”

মুন্না বলল, “মামদি’, শোন। তোকে তো আগে দেখিনি। বাড়িতে গল্প শুনি তোর। সবাই বলে, মাম থাকলে কাকুমণির এমন অবস্থা হত না।”

বিদিশার মুখে বিষাদের ছোঁয়া লাগল। আস্তে বলল, “কী অবস্থা?”

অপ্রস্তুত মানুষটা মুন্নাকে ব্যস্ত করতে চাইলেন, “মুন্না, গিয়ে দ্যাখ তো মিষ্টি এল কি না।”

মুন্না বলল, “যাচ্ছি।” তারপর বিদিশার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করল, “আধপাগল অবস্থা। ঘর থেকে নীচেই নামতে চায় না। আমিই তো কাকুমণির হুকুম খাটি। যা লাগে, দিয়ে যাই।” বলেই ছুট্টে পালাল মেয়েটা।

একটুক্ষণ নীরবতার পরে মানুষটা বললেন, “আমিও তুই বলছি তোকে।”

অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে আঙুল কামড়াচ্ছিল বিদিশা। সোজা হয়ে বসে বলল, “আমাকে তুমি কী করে চিনলে?”

বিদিশার চোখে চোখ রেখে গভীর গলায় প্রভাতরঞ্জন রায় বললেন, “সত্যি কথা বলছি, তোর কান্না দেখে। এত বড় হয়ে গিয়েছিস তুই…আমার মনের ভেতরে তো আর তোর এই বয়সের ছবি নেই…প্রথমে অবাক হচ্ছিলাম, তুই কে? চেনা-চেনা, অথচ…। যেই তুই কেঁদে ফেললি, ছোট্ট মাম বেরিয়ে এল বড় চেহারার মুখোশ ছিঁড়ে। …এখন বল, কেন এলি?”

বিদিশা ছোট্টটি হয়ে গেল নিমেষে। বাবার বুকে মাথা রেখে বলল, “আমি তোমার কাছে থাকব বাবা।”

মেয়েকে বুকে ধরে পাথর হয়ে রইলেন মানুষটা। তারপর একটু ধাতস্থ। হয়ে বললেন, “বেশ।”

আরও কিছু সময় বিদিশা বাবার বুকে মাথা রেখে ছোটটি হয়েই ছিল। ক্রমে সে-ও ফিরেছিল বাস্তবে। এখন সে বাবার কাছে থাকবে না। একটা প্রতিশোধ সে নেবে সব কিছুর। তারপর চিরকালের জন্য চলে আসবে। বাবাকে তাই সে কিছু পরে বলেছিল, “আমি মাঝে মাঝে তোমার কাছে আসব বাবা। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। সেটা মিটিয়েই বরাবরের জন্য চলে আসব। তুমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থেকো এবার থেকে। সবার সঙ্গে কথা বোলো। নতুন কী লিখলে? শোনাও না!”

হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন মানুষটা। বলেছিলেন হতাশ সুরে, “মানে…আমি তো আর লিখি না।”

কাঁদো-কাঁদো, আদুরে গলায় বিদিশা বলেছিল, “কেন লেখো না? আমি যে সবাইকে বলি, আমি কবির মেয়ে। কী হয়েছে তোমার? আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি। সব কষ্ট ভুলে এবার থেকে ভাববে, তোমার একটা মেয়ে আছে, সে একজন কবির মেয়ে। লিখবে তো বাবা?”

দু’চোখ জলে ভরে গিয়েছিল মানুষটার। কান্নার ঢোক গিলে বলেছিলেন, “চেষ্টা করব। তুই আগে কেন এলি না?”

বিদিশা ফের বাবার বুকে মাথা রেখে বলেছিল, “এই তো এখন এসেছি বাবা।”

মানুষটা বলেছিলেন, “আমি আবার জন্মালাম।”

জিভে জল আনা সরভাজা খেয়ে, মুন্নার সঙ্গে অনেক গল্প করে কলকাতায় ফিরেছিল সেদিন বিদিশা। বিদায় দেবার সময় বাবা বলেছিলেন, “মন দিয়ে পড়াশুনো করবি কিন্তু।” বাবা তো জানে না, বিদিশা অন্য ব্রত নিয়েছে তত দিনে। নিজে পুড়ে অন্যকে ছাই করে দেবে সে।

ভাঙনে না-নেমে বিদিশা যখন মনের গহনে নিজস্ব ভাঙনের ভেতর আলুথালু, তখন সন্ধে পার হয়ে গিয়েছে, আকাশে ইয়াব্বড় এক চাঁদ, জোছনামাখা খাদের মধ্যে থেকে দীপ আর অর্ক একসুরে চিৎকার করছে, “বি-দি-শা…”। কাঁপতে কাঁপতে গমগমে ডাকটা উঠে আসছে যেন কত দূর থেকে। সবটাই স্বপ্ন-স্বপ্ন মনে হচ্ছে। বিদিশা যেখানে বসেছিল, তার আশেপাশে বন দপ্তরের লাগানো অনেক গাছ। হঠাৎ ছমছমে লাগছিল চারপাশ। নিজেকে খুব একলা মনে হচ্ছিল। অনেকটা তার হেরে-যাওয়া বাবার মতো। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বিদিশাও তখন চিৎকার করেছিল, “অর্ক…অ্যাই অর্ক…দীপ…অ্যাই দীপ…উঠে আয়…”

খানিক পরে দীপ-অর্ক ফিরে এলে ওরা চাঁদের আলোয় ভিজতে ভিজতে চলে এসেছিল ক্যানেল-পাড়ে। এতটা একাকিত্বের পরেই এই বিশ্রী ভিড় বিদিশার তাই অত অসহ্য লেগেছে। জীবন তাকে বাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। প্রবল অভিমান তাকে অবাধ্য করে তুলেছে বলেই সে মা’র নিষেধাজ্ঞা না মেনে দুই বন্ধুর সঙ্গে চলে এসেছে শান্তিনিকেতনে। কিন্তু যেই একলা লাগছে, খারাপ লাগছে খুব, বাবা এবং মা’র মুখই তার মনে আসছে। একবার কান্না পাচ্ছে। একবার সে দাঁত কিড়মিড় করছে অক্ষম রাগে।

চা-পান শেষ হতে না হতেই বিদিশা অস্থির ভাবে হাত-পা ছুড়ল, “দুর! কিছু ভাল লাগছে না।”

অর্ক-দীপের চোখে ঘনাচ্ছে অন্য নেশা। দীপ বলল, “তাহলে রিসর্টে ফিরি।”

বিদিশা দীপকে দেখল একবার। সে নিয়ম ভাঙতেই এসেছে। শরীরের অ্যাডভেঞ্চারে মাতলেই হয়। শরীর-খেলা নিয়ে তার স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই। আবছা সম্মোহন আছে। কিন্তু দীপের চোখে মনে হল হ্যাংলামি আছে। সে কপালে ভাঁজ ফেলল। চায়ের দোকান থেকে পাকা রাস্তায় উঠে এল। গৌর প্রাঙ্গণে আজ নৃত্যনাট্য আছে। ভিড় সেদিকেই যাচ্ছে।

অর্ক পাশে চলে এল, “তোর কি অন্য প্ল্যান? কোথাও যাবি?”

বিদিশা মুখ ঝামড়াল, “ঘুরতেই তো এসেছি,। দীপটা ছোঁক-ছোঁক করছে কেন?”

অর্ক হাসল, “কী উলটো-পালটা বকছিস? দীপ স্রেফ জিজ্ঞেস করেছে। অ্যাই দীপ, শুনে যা দিশা কী বলছে।”

দীপ এসে দাঁড়াল পাশে, “তোর কী হয়েছে রে দিশা? এসে অবধি গোমড়া হয়ে আছিস। এনজয় কর। তোর কী ভাল লাগবে, বল।”

দীপ-অর্কদের কথায় বন্ধুত্বের ছোঁয়া পেয়ে মনটা শান্ত হল বিদিশার। ওদেরকে তার চাই। ওদেরকে সে একটা কাজে লাগাবে। তার জন্য যত দূর নামতে হয়, নামবে। এত সব ভেবে রাখার পরেও শরীর নিয়ে কেন যে অদ্ভুত সংকোচ হচ্ছে। কেবলই মনে আসছে কথাটা, সে একজন কবির মেয়ে। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, অবহেলিত কবির হয়ে প্রতিশোধটা তাকেই নিতে হবে যে-কোনও মূল্যের বিনিময়ে। যুক্তি-পাল্টাযুক্তি-আবেগ-মনরহস্য—সব কিছুর পাল্লায় পড়ে মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে বিদিশার। সে অস্থির ভাবে বলল, “চল তো। ভিড়টা একটু কমেছে।”

অর্ক জানতে চাইল, “কোথায়?”

বিদিশা বলে ফেলল, “আশ্রমের দিকেই চল।”

দীপ বলল, “অনুষ্ঠান দেখবি? লক্ষ মানুষ। মাঠ এতক্ষণে ভরে গেছে।”

বিদিশা অন্যমনস্ক সুরে উচ্চারণ করল, “ওখানে যাব না।”

অর্ক বলল, “তাহলে কোথায় যাবি? খেপি হয়ে গেলি একেবারে!”

বিদিশা কী একটা ভেবে বলল, “উদয়নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব।”

দীপ বলল, “সব তো বন্ধ। কী দেখবি?”

বাবার লেখা পড়েছে বিদিশা। সে বলল, “জানিস, ওখানে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ থাকতেন। মৃত্যুর আগে।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন