হাদীস সমালোচনার সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি

হাদীস যাচাই করার সামঞ্জস্যপূর্ণ পন্হা কি হইতে পারে, তাহা বাস্তবিকই গবেষণা সাপেক্ষ। এই সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত এই যে, প্রথমে সনদ যাচাই করিতে হইবে এবং তাহার হাদীমের মূল বাণী ********************* টুকু পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। সনদ যদি ঠিক হয় এবং মূল হাদীসটুকুও ‘দিরায়াতে’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়, তবে সেই হাদীস সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য।

তবে অনেক হাদীস এমন রহিয়াছে যাহার সনদ নির্ভূল, আর মূল হাদীসের কথাটুকু সাধারণ বুদ্ধির অগম্য, এই ক্ষেত্রে দেখিবার ও বিবেচনার বিষয় শুধু এতটুকু যে, উহা কুরআনের খেলাফ নয় তো; কুরআন যাহা হালাল করিয়াছে, হাদীস তাহা হারাম কিংবা ইহার বিপরীত কিছু প্রমাণ করিতেছে না তো। কেননা সকলেই জানেন, মি’রাজ সম্পর্কীয় হাদীস ২৫ জন সাহাবী ও তিনশত তাবেয়ী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, অথচ ইহা সাধারণ বুদ্ধির পক্ষে দূরধিগম্য। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইহা অবশ্যই সত্য ও বিশুদ্ধ হাদীসরূপে গ্রহণীয়। কেননা ইহা যেমন অসম্ভব ব্যাপার কিছু নয়, তেমনি কুরআনের সহিত পূর্ণ সামঞ্জস্যসম্পন্নও। ইহা কুরআনের অস্পষ্ট বা মোটামুটিভাবে উল্লিখিত বিষয়ের ব্যাখ্যা।

অনুরূপভাবে হাদীসসমূহের শব্দ ও ভাষা যাচাই করিয়াও নিশ্চিতরূপে বুঝিতে পারা যায় যে, উহা প্রকৃতই রাসুলে করীমের কথা কিনা। কোন হাদীসে রাসূলের যুগে অব্যবহৃত কোন পরিভাষার উল্লেখ থাকিলে তাহা রাসূলের হাদীস হইতে পারে না। যথাঃ

ক) হাদীসের কিাতবে উদ্ধৃতি পাওয়া যায়ঃ

******************************************************

কাদরীয়া পন্হীরা এই উম্মতের অগ্নিপূজক এবং রাফেযীরা এই উম্মতের ইয়াহুদী।

ইহার ভাষা ও শব্দসমূহ স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, ইহা কিছুতেই রাসূলের কথা হইতে পারে না। দ্বিতীয়ত ‘আল-কাদারী’ ও ‘রাফেযী’ ইত্যাদি শব্দ বিশেষ পরিভাষার পরিচয় বহন করে। আর এই ভাষা রাসূলে করীমের যুগে আদৌ প্রচলিত ছিল না বলিয়া রাসূল কর্তৃক ইহার প্রয়োগ হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।

খ) নিম্নোক্ত কথাটিও ‘হাদীস’ নামে কথিতঃ

******************************************************

যে লোক ‘কুরআন মখলুক’ মনে করে সে কাফির।

কুরআন ‘মখলূক’ কি মখলুক নয়’- ইহা লইয়া আব্বাসীয় যুগে তদানীন্তন মনীষীদের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। রাসূলে করীমের যুগে এই ধরনের কথা ধারণা পর্যন্ত করা যায় নাই। কাজেই এই ধরনের কথা কখনো রাসূলের মুখ হইতে নিঃসৃত হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাষ করা যাইতে পারে না।

হাদীস যাচাই পর্যায়ে ‘দিরায়াত’ রীতি প্রয়োগ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে জাওযী মুহাদ্দিসের যে নীতি ও পদ্ধতির উল্লেখ করিয়াছেন তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ

******************************************************

যেসব হাদীস সাধারণ বুদ্ধির বিপরীত পাইবে কিংবা সাধারণ মূলনীতির উল্টা দেখিবে, মনে করিবে যে, তাহা মওজু বা মনগড়া হাদীস। অতঃপর উহার বর্ণনাকারীদের যাচাই-পরখ করার কোন প্রয়োজন করে না। অনুরূপভাবে সেইসব হাদীসও মওজু যাহা সাধারণ অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে বাতিল প্রমাণিত হইয়াছে। যাহা কুরআন, মুতাওয়াতির হাদীস ও অকাট্য ইজমার খেলাফ এবং যাহার কোন ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, তাহাও মওজু অথবা যেসব হাদীসে সাধারণ ও গুরুত্বহীন কথার উপর কঠোর আযাবের ভীতি প্রদর্শন করা হয়; কিংবা সামান্য কাজের ফলে বিরাট পুরস্কার দানের ওয়াদার উল্লেখ হয়, তাহাও মওজু- এই ধরনের হাদীস সাধারণত ওয়ায়েজ ও সুফীদের বর্ণনাসনূত্রে পাওয়া যায়।

[*********************]

এতদ্ব্যতীত মনস্তাত্ত্বিক তুলাদণ্ডেও হাদীস যাচাই করার প্রয়োজন রহিয়াছে। যে ব্যক্তি রাসূলের হাদীস ব্যাপক ও নিরবচ্ছিন্নভাবে অধ্যায়ন করিবে, চর্চা করিবে, গভীর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে উহা লইয়া গবেষণা করিবে, তাহার অন্তর্লোকে এক তীব্র স্বচ্ছ আলোকচ্ছটা প্রস্ফূটিতে হইয়া উঠিবে। সে সহজেই বুঝিতে পারিবে কোনটি প্রকৃতই রাসূলের হাদীস, কোনটি নয়; রাসূল কোন ধরনের কথা বলিতে পারেন, কোন ধরনের কাজ নয়, কি ধরনের কথা বা কাজ তাঁহার সমর্থিত হইতে পারে, আর কোন ধরনের নয়।…………….. তাহা উপলীব্ধি করা তাহার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন হইবে না।

[*********************]

এই পর্যায়ে চূড়ান্ত অভিমত এই যে, হাদীসের গ্রহণীয় হওয়া না হওয়া সম্পর্কে শেষ ফয়সালা সনদ ও মূল হাদীস (মতন) উভয়ের যথাযথ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যাচাই করার ভিত্তিতেই হওয়া আবশ্যক।

সকল অধ্যায়

১. হাদীসের সংজ্ঞা ও পরিচয়
২. হাদীস শব্দের অর্থ
৩. হাদীস ও সুন্নাত
৪. হাদীসের বিষয়বস্তু
৫. বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীসের প্রকারভেদ
৬. হাদীসে কুদসী
৭. সনদ ও মতন
৮. জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল সূত্র
৯. ওহী
১০. হাদীসের উৎস
১১. কুরআন ও হাদীসের পার্থক্য
১২. ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব
১৩. হাদীসের অপরিহার্যতা
১৪. হাদীস ও রাসূলের ইজতিহাদ
১৫. হাদীসের উৎপত্তি
১৬. হাদীস সংরক্ষণ
১৭. হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য রাসূলের নির্দেশ
১৮. পারস্পরিক হাদীস পর্যালোচনা ও শিক্ষাদান
১৯. হাদীসেন বাস্তব অনুসরণ
২০. ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন
২১. সাহাবীদের হাদীস প্রচার ও শিক্ষাদান
২২. হাদীস বর্ণনায় সতর্কতা
২৩. হাদীস লিখন
২৪. নবী (ﷺ) কর্তৃক লিখিত সম্পদ
২৫. সাহাবীদের লিখিত হাদীস সম্পদ
২৬. হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের শ্রেণীবিভাগ
২৭. হাদীস বর্ণনায় সংখ্যা পার্থক্যের কারণ
২৮. তাবেয়ীদের হাদীস সাধনা
২৯. কয়েকজন প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাদ্দিস
৩০. হাদীস লিখনে উৎসাহ দান
৩১. হাদীস সংগ্রহের অভিযান
৩২. হাদীস গ্রন্থ সংকলন
৩৩. খুলাফায়ে রাশেদুন ও হাদীস গ্রন্থ সংকলন
৩৪. হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন
৩৫. হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীস চর্চা
৩৬. তৃতীয় শতকের হাদীস সমৃদ্ধ শহর
৩৭. তৃতীয় হিজরী শতকের কয়েকজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস
৩৮. মুসনাদ প্রণয়ন
৩৯. হাদীস সংকলনের চূড়ান্ত পর্যায়
৪০. ইলমে হাদীসের ছয়জন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি
৪১. ছয়খানি বিশিষ্ট হাদীসগ্রন্হ
৪২. চতুর্থ শতকে ইলমে হাদীস
৪৩. চতুর্থ শতকের পরে হাদীস-গ্রন্থ প্রণয়ন
৪৪. সপ্তম ও অষ্টম শতকে হাদীস চর্চা
৪৫. বিভিন্ন দেশে হাদীস চর্চা
৪৬. হাদীস গ্রন্হসমূহের পর্যায় বিভাগ
৪৭. হাদীস বর্ণনায় রাসূল (ﷺ)-এর নৈকট্য
৪৮. হাদীস জালকরণ ও উহার কারণ
৪৯. হাদীস সমালোচনার পদ্ধতি
৫০. হাদীস বর্ণনাকারীদের শ্রেণী বিভাগ (গুণগত)
৫১. হাদীস সমালোচনার সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি
৫২. উপমহাদেশে ইলমে হাদীস
৫৩. আরব উপনিবেশসমূহে হাদীস প্রচার
৫৪. উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের রেনেসাঁ যুগ
৫৫. বঙ্গদেশে ইলমে হাদীস
৫৬. ইলমে হাদীস বনাম অমুসলিম মনীষীবৃন্দ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন