হাদীস সমালোচনার পদ্ধতি
হাদীস-সমালোচনা বিজ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা জাল হাদীস চিনিবার বিভিন্ন উপায়ের উল্লেখ করিয়াছি। হাদীস জালকরণের এই পরিস্থিতিতে সূক্ষ্ম ও অকাট্য মানদণ্ডের ভিত্তিতে হাদীস যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া কোনটি জাল আর কোনটি বিশুদ্ধ তাহা স্পষ্টরূপে যাচাই করার তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়। এই জন্য প্রত্যেকটি হাদীসের সনদ, সনদের সহিত সংশ্নিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তি তাহাদের পারস্পরিক সাক্ষাত, হাদীস শ্রবণ ও গ্রহণ অবস্থা, হাদীসের মূল উৎস প্রভৃতি আঁতিপাতি করিয়া খুঁজিয়া দেখার কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এই সময়ে মুসলিম সমাজের বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত করা হয় যে, কেবলমাত্র বিশুদ্ধ ও নির্ভূল হাদীসই গ্রহণ করা হইবে, তাহা ব্যতীত অপর কোন ‘হাদীস’ই গ্রহণ করা হইবে না। কেননা হাদীস গ্রহণ ও তদানুযায়ী কাজ করা ঠিক তখনই সম্ভব, যখন প্রমাণিত হইবে যে, ইহা প্রকৃতই রাসূলের বানী এবং ইহার হাদীস হওয়ার ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নাই। আর হাদীসের এই প্রমাণ নির্ভর করে উহার বর্ণনা পরম্পরা বা সনদের বিশুদ্ধতার উপর, সনদে উল্লিখিত প্রত্যেক বর্ণনাকারীর বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার উপর, সমালোচনা আঘাতে তাঁহাদের মধ্যে কাহারো ‘আহত’ না হওয়ার উপর। হাদীসের সনদ এইসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে দ্বিতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা ও যাচাই করিতে হইবে মূল হাদীসের নিজস্ব গুণাগুণ; মূল বক্তব্যের যথার্থতা ও বিশ্বাস্যতা। হাদীস বিজ্ঞানের পরিভাষায় প্রথম পদ্ধতিকে বলা হয় ‘রিওয়ায়েত’- যাচাই করা। আর দ্বিতীয়টিকে বলা হয় দিরায়েত- বুদ্ধি ও সুস্থ বিবেকের কষ্টিপাথরে মূল কথাটির যাচাই করা।
সনদের দিক দিয়া হাদীসের সত্যাসত্য যাচাই করা এক বিশেষ বিজ্ঞান। বিশেষজ্ঞগণ সংজ্ঞা দান করিয়াছেন এই ভাষায়ঃ
******************************************************
রাসূলে করীম, সাহাবী ও তাবেয়ীনের যে কথা, কাজ, সমর্থন অনুমোদন বা কোন গুণ বর্ণনা করা হইবে, উহার বর্ণনা-পরম্পরাকে খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিবেচনা করার উপরই এই বিজ্ঞান নির্ভরশীল।
[********************]
হাদীস গ্রহণযোগ্য কিনা, তাহা নির্ধারণের জন্য সর্বপ্রথম হাদীসেন বর্ণনা সূত্রে যাচাই করিতে হইবে। এই পর্যঅয়ে হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির বিভিন্ন দিক দিয়া পরীক্ষা করা অপরিহার্য। বর্ণনাকারী কি ধরনের বা কি চরিত্রের লোক, ইসলামী জ্ঞান ও বিদ্যা তাঁহার কতখানি আয়ত্ত, বোধশক্তি কতখানি তীব্র ও উন্নত, প্রতিভা ও স্মরণশক্তিই বা কিরূপ, তাঁহার আকিদা, বিশ্বাস, চিন্তা ও মতবাদ নির্ভুল কিনা, ইসলাম মুতাবিক কিনা, বিদয়াতপন্হী নয়তো? সে সুস্থ বিবেক ও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন কিনা, মাসনিক রোগগ্রস্ত নয় তো, সত্য কথাকে যথাযথরূপে বলিতে অভ্যস্ত, না মিথ্যা কথাও কখনো কখনো বলিয়া থাকে, সৎকর্মশীল ও চরিত্রবান, না চরিত্রহীন ও দুষ্কৃতি অনুরাগী, হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনা বিজ্ঞানে এই ধরনের প্রশ্নই প্রধান। ইহার পরও জানিবার বিষয় হইতেছে, সে কোথায় কাহার নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও শিক্ষা করিয়াছে। যাহার নিকট হইতে সে হাদীস বর্ণনা করে, তাহার সহিত তাহার প্রকৃতই সাক্ষাৎ হইয়াছে কিনা, হইয়া থাকিলে কোথায়, কখন এবং তখন তাঁহার বয়স কত ছিল, এইসব বিষয়ও পুংখানুপংখরূপে বিচার্য।
বস্তুত ইহা এক বিশেষ জ্ঞান, ইহাকেই বলা হয়ঃ ******************** ইহার সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
ইহা এমন এক বিজ্ঞান, যাহাতে বিশেষ শব্দে হাদীস বর্ণনাকারীদের সমালোচনা করা হয় এবং তাহাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়।
এইজন্য হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির বিস্তারিত জীবনচরিত সম্পর্কে গভীর সূক্ষ্মজ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। এই জ্ঞানকে বলা হয়ঃ
******************************************************
লোকদের নাম-পরিচয় সংক্রান্ত বিদ্যা ও জ্ঞান।
ইহার ব্যাখ্যা করিয়া বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
অর্থাৎ হাদীসের সনদে উল্লেখিত সাহাবী, তাবেয়ী ও সকল বর্ণনাকারী সম্পর্কে জ্ঞান। কেননা এই জ্ঞান হইতেছে হাদীস জ্ঞানের অর্ধেক।
[********************]
এই জ্ঞানের প্রয়োনজনীয়তা সম্পর্কে সুফিয়ান সওরী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সনদসূত্র ও সনদ সম্পর্কিত জ্ঞান হইতছে ঈমানদার লোকদের হাতিয়ার বিশেষ, আর তাহার নিকট যদি হাতিয়ারই না থাকিল তবে সে কি জিনিস লইয়া যুদ্ধ (শক্রপক্ষের সহিত মুকাবিলা) করিবে?।
[********************]
ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সনদসূত্র ও তৎসংক্রান্ত জ্ঞান ব্যতীতই যে লোক হাদীস সন্ধান ও গ্রহণ করে, সে ঠিক রাত্রির অন্ধকারে কাষ্ঠ আহরণকারীর মত লোক। সে কাষ্ঠের বোঝা বহন করিতেছে, অথচ তাহার মধ্যে বিষধর সর্প রহিয়াছে। উহা তাহাকে দংশন করে; কিন্তু সে টেরই পায় না।
[********************]
হাদীষ বর্ণনাকারী সকল পর্যায়ের ও স্তরের লোকদের সমালোচনা ও যাঁচাই পরীক্ষা করা এবং তাঁহাদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য লোকদিগকে যথাযোগ্য মর্যাদা দান ইসলামে এক অতীব জরুরী কার্যক্রম। আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়াছেনঃ
******************************************************
হে ঈমানদারগণ! কোন ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন খবর লইয়া আসিলে তোমরা উহার সত্যতা যাচাই করিয়া লও। অন্যথায় অজ্ঞতাবশত কোন জাতির উপর বিপদ টানিয়া আনিতে পার এবং ফলে তোমরা লজ্জিতও হইতে পার।
[********************]
এই স্পষ্ট নির্দেশের কারণেই সাহাবায়ে কিরাম প্রত্যেকটি কথা বা হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষ কড়াকড়ি ও সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। যাহার-তাহর কথা বা হাদীস অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণ-সাক্ষ্য ব্যতীত গ্রহণ করিতে তারা প্রস্তুত হইতেন না। পরবর্তীকালে ইলমে হাদীসৈর ক্ষেত্রে ইহাই ‘হাদীস-সমালোচনার বিজ্ঞান’ উৎপত্তির ভিত্তি স্থাপন করে। ‘ইলমে আসমাউর রিজাল’ এই কারণেই রচিত হয়। হাদীস কোনটি গ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে ফায়সালা করার জন্য এই বিজ্ঞান একান্তই অপরিহার্য। এ সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির সমালোচনা ও যথাযোগ্য মর্যদা দান সম্পর্কে কথা বলা রাসূলে করীম, বিপুল সংখ্যক সাহাবী এবং তাবেয়ীন হইতে প্রমাণিত। তাঁহাদের পরেও এই কাজ চলিয়াছে। তারা সকলেই এই কাজকে বিধিসম্মত মনে করিয়াছেন ইসলামের শরীয়াতকে মিথ্যা ও জালিয়াতের করাল গ্রাস হইতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, লোকদিগকে নিছক আঘাত দান বা দোষী প্রমাণের উদ্দেশ্যে নহে।
[]
মুহাম্মদ ইবনে সিরীন তাবেয়ী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
নিশ্চয় জানিও, এই জ্ঞান দ্বীন-ইসলামের মৌলিক ব্যাপার, অতএব তোমরা কাহার নিকট হইতে দ্বীন গ্রহণ করিতেছে, তাহা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবশ্যই দেখিয়া লইবে।
[]
হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞঅন উৎপত্তির ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি আরো বলিয়াছেনঃ
******************************************************
পূর্বে লোকেরা হাদীসের সনদ ও বর্ণনাকারীদের পরিচয় জানিতে চাহিত না। কিন্তু যখন ফেতনা শুরু হইয়া গেল তখন তাহারা বলিতে লাগিলঃ তোমাদের বর্ণনাকারীদের নাম পরিচয় বল। প্রকৃত হাদীস ধারণকারী লোক হইলে তাহাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা হইবে আর বিদয়াত-পন্হী হইলে তাহাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা হইবে না।
[]
হাদীস যাচাই সংক্রান্ত এই জরুরী ইলম- ‘ইলমে আসমাউর রিজাল’ সম্পর্কে প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ডাঃ স্প্রিংগার বলিয়াছেনঃ
মুসলিমদের আসমাউর রিজাল- এর মত বিরাট ও ব্যাপক চরিতবিজ্ঞান সৃষ্টি করিতে পারিয়াছে এমন অপর কোন জাতি দুনিয়ায় কোন দিন ছিল না, বর্তমানেও এইরূপ অপর কোন জাতির অস্তিত্ব দুনিয়ায় নাই। এই বিজ্ঞানের সাহায্যেই আজ পাঁচ লক্ষ্য হাদীস বর্ণনাকারী লোকদের বিস্তারিত জীবনচরিত সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যাইতে পারে।
[******************** গ্রন্হের ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকা (কলিকাতায় মুদ্রিত ১৮৫৩ সন।)]
হাদীস সমালোচনার ব্যাপারে হাদীস-বিজ্ঞানিগণ অশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছেন। কোন স্মরণ-শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি যদি ষাট বৎসর বয়সে স্মরণশক্তি হারাইয়া ফেলে ও ভুলিয়া যাওয়ার রোগে আক্রান্ত হয়, তাহা হইলে তাহার জীবন চরিতে একথা অবশ্যই লিখিত হইয়াছে যে, ‘এই ব্যক্তি প্রথম জীবনে স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিল; কিন্তু ষাট বৎসর বয়সে তাহার স্মরণশক্তি বিলুপ্ত হইয়াছে। কাজেই তাহার বর্ণিত কেবল সেই সব হাদীসই গ্রহণ করা যাইবে, যাহা সে স্মরণশক্তি বর্তমান থাকা অবস্থায় বর্ণনা করিয়াছে, এ্ই দুর্ঘটনার পরে বর্ণিত কোন হাদীসই তাহার নিকট হইতে গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। এই চরিত-বিজ্ঞান রচনার ব্যাপারে রচয়িতাগণ কর্তৃক কোন পক্ষপাতিত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, বিশেষ কাহারো প্রতি অকারণ ঝোঁক ও কাহারো সম্পর্কে মাতাতিরিক্ত প্রশংসা করার মত মারাত্মক ক্রটি প্রদর্শিত হয় নাই। তারা প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ণ সত্যের উপর নির্ভর করিয়া বাস্তব ঘটনার বিশ্নেষণ করিয়াছেন। তাঁহাদের দৃষ্টি ছিল সম্পূর্ণ সত্যের উপর নির্ভর করিয়াবাস্তব ঘটনার বিশ্নেষণ করিয়াছেন। তাঁহাদের দৃষ্টি ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও আবিলতা বিমুক্ত। যাহার যতটুকু মর্যাদা ও স্থান, তাহাকে ঠিক ততটুকুই দিয়াছেন, দিতে কোন প্রকার কার্পণ্য বা সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিচয় দেন নাই।
হাদীস সমালোচনার পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি কথার উল্লেখ করা যাইতেছে। (অবশ্য নীতিগত আলোচনা পূর্বেও করা হইয়াছে।)
মুহাদ্দিস শেখ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক শেয়খ উবাদ ইবনে কাসীর সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁহার তাকওয়া পরহিযগারির তো বিপুল প্রশংসা করিয়াছেন, কিন্তু বলিয়াছেন যে, নৈতিক কারণে তাঁহার বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা যাইবে না।
ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে হাকেমকে এক ব্যক্তি একটি হাদীস শুনাইল। ইমাম, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ এই হাদীসটি তুমি কাহার নিকট হইতে কখন শুনিয়াছ? সে উত্তরে বলিলঃ ‘আবদ ইবনে হুমাইদের নিকট হইতে অমুক সনে আমি এই হাদীসটি শ্রবণ করিয়াছি’।
তখন ইমাম আবদুল্লাহ তাঁহার সম্মুখে সমবেত ছাত্রদের লক্ষ্য করিয়াবলিলেনঃ ‘দেখ, এই লোকটির মতে আবদ ইবনে হুমাইদ তাঁহার মৃত্যুর সাত বছর পরে এই ব্যক্তির নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন’।
কেননা সেই ব্যক্তি আবদ ইবনে হুমাইদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণের যে সনের উল্লেখ করিয়াছিল, তাহার সাত বৎসর পূর্বেই আবদ ইবনে হুমাইদ ইন্তেকাল করিয়াছেন। অর্থাৎ এই ব্যক্তি তাঁহার নিকট হইতে যে হাদীস শ্রবণের দাবী করিয়াছে তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য।
ইয়াহুদীরা মুসলিম খলীফার নিকট রাসূল কর্তৃক লিখানো একখানি দস্তাবেজ পেশ করিয়া দাবি করে যে, আমাদের উপর ধার্যকৃত জিযিয়া প্রত্যাহার হওয়া উচিত। দস্তাবেজে লিখিত ছিল যে, খায়বার অধিবাসী ইয়াহুদীদের জিযিয়া মাফ করিয়া দেওয়া হইল। খলীফা এবং শাসন পরিচালকদের পক্ষে ইহা অবনত মস্তকে মানিয়া লওয়া ও ইয়াহুদীদের জিযিয়া প্রত্যাহার করা ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু হাদীস বিজ্ঞানিগণ যখন দস্তাবেজখানা পাঠ করিলেন, দেখিলেন, উহাতে হযরত সায়াদ ইবনে মুয়াযের সাক্ষ্য উদ্ধৃত হইয়াছে। অথচ তিনি খায়বার যুদ্ধের পূর্বেই ইন্তেকাল করিয়াছেন।
দ্বিতীয়ত, এই দলীলের, লেখক হিসাবে মুয়াবিয়া ইবনে আবূ সূফিয়ানের নাম লিখিত রহিয়াছে, অথচ ইহা সর্বজনবিদিত যে, খায়বার যুদ্ধ পর্যন্ত মুয়াবিয়া ইসলামই কবুল করেন নাই।
তৃতীয়ত, উক্ত দলীলে যে সময়ের উল্লেখ করা হইয়াছে, তখন পর্যন্ত জিযিয়া সম্পর্কিত আল্লাহর ফরমান নাযিলই হয় নাই, নাযিল হইয়াছে তাহার অনেক পর। আর চতুর্থ, এই যে, যেসব ইয়াহুদী ইসলামের শক্রতা পরিহার করিয়া ইসলামের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, এই দলীল হইতে কেবল তাহাদের জিযিয়া মাফ করাই প্রমাণিত হয়। কিন্তু ইসলামের শক্রতায় যাহারা জর্জরিত, তাহাদের জিযিয়া মাফ করার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।
মুহাদ্দিসগণ এইসব যুক্তি অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে ঘোষণা করিলেন যে, এই দস্তাবেজখানি সম্পূর্ণ জাল। অতএব উহা প্রত্যাহারযোগ্য।
হাদীসের সমালোচনা-বিজ্ঞানের বাস্তব কার্যক্রম সম্পর্কে ইহা কয়েকটি দৃষ্টান্তমাত্র। এইরূপ সমালোচনা ও যাচাই পরীক্ষার কষ্টিপাথরে হাদীস বিজ্ঞানিগণ এক একটি হাদীসের সমালোচনা, যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। আর এই বিরাট মহান কার্য সম্পাদন সম্ভব হইয়াছে কেবলমাত্র ‘আসমাউর-রিজাল’ শাস্ত্রের সাহায্যে। ইহার ভিত্তি কুরাআন মজীদের পূর্বোক্ত আয়াতের উপর স্থাপিত। সাহাবায়ে কিরাম ইহার পূর্ণ অনুসরণ করিয়াছেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ এই মানদণ্ডের সাহায্যে সত্য ও মিথ্যা হাদীসের পার্থক্য করিয়াছেন।
হাদীস-সমালোচনা পর্যায়ে যাঁহারা কিছু না কিছু কাজ করিয়াছেন, তাঁহাদের নাম নিম্নে পর্যায়ক্রমে উল্লেক করা যাইতেছেঃ
সাহাবীদের পর্যায়েঃ ১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবাস (মৃঃ ৬৮ হিঃ), ২. উবাদাহ ইবনে সামিত (মৃঃ ৩৪ হিঃ), ৩. আনাম ইবনে মালিক (মৃঃ ৯৩ হিঃ)।
তাবেয়ীদের পর্যায়েঃ আমের শা’বী (মৃঃ ১০৪ হিঃ), ইবনে সিরীন (মৃঃ ১৬০ হিঃ), সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যিব (মৃঃ ৯৩ হিঃ)।
দ্বিতীয় শতকের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণ ইতেছেন, ইমাম শো’বা (মৃঃ১৬০ হিঃ), আনাস ইবনে মালিক (মৃঃ ১৭৯ হিঃ), মা’মর (মৃঃ ১৫৩ হিঃ), হিশাম আদাস্তাওয়ায়ী (মৃঃ ১৫৪ হিঃ), ইমাম আওযায়ী (মৃঃ ১৫৬ হিঃ), সুফিয়ান আস-সওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ) ইবনুল মাজেশূন (মৃঃ ১৬৩ হিঃ), হাম্মাদ ইবনে সালমা (মৃঃ ১৬৭ হিঃ), লাইস ইবনে সায়াদ (মৃঃ ১৭৫ হিঃ)।
তাঁহাদের পরবর্তী পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য হইতেছেনৎ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (মৃঃ ১৮১ হিঃ), হুশাইম ইবনে বুশাইর (মৃঃ ১৮৮ হিঃ), আবূ ইসহাক আলফাজারী (মৃঃ ১৮৫ হিঃ), আল-মুয়াফী ইবনে ইমরান আল-মুসেলী (মৃঃ ১৮৫ হিঃ), বিশর ইবনুল মুফাযাযল (মৃঃ ১৯৬ হিঃ), ইবনে উয়াইনাহ (মৃঃ ১৯৭ হিঃ)। তাঁহাদের পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য হইতেছেঃ ইবনে আলীয়া (মৃঃ ১৯৩ হিঃ), ইবনে অহব (মৃঃ ১৯৭ হিঃ) ও অকীত ইবনে জাররাহ (মৃঃ১৯৭ হিঃ)।
এই যুগে দুইজন বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। তারা হইতেছেনঃ ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতাব (মৃঃ ১৮৯ হিঃ) ও আবদুর রহমান ইবনে মাহদী (মৃঃ ১৯৮ হিঃ)।
তাঁহাদের পরের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হইতেছেনঃ ইয়াযীদ ইবনে হারূন (মৃঃ ২০৬ হিঃ), আবূ দাঊদ তায়ালিসী (মৃঃ ২০৪ হিঃ), আবদুর রাযযাক ইবনে হাম্মান (মৃঃ ২১১ হিঃ) ও আসেম নাবীল ইবনে মাখলাদ (মৃঃ ২১২ হিঃ)।
তাঁহাদের পরে উল্লেখযোগ্য হইতেছে সমালোচনা বিজ্ঞানের গ্রন্হকারগণ। এই পর্যায়ে প্রধান উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হইতেছেনঃ ইয়াইয়া ইবনে মুয়ীন (মৃঃ ২৩৩ হিঃ), আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে সায়াদ (মৃঃ ২৩০ হিঃ), আবূ খায়সামা যুবাইর ইবনে হারব (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), আবূ জাফর আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ নবীল, আলী ইবনে মদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ নুমাইর (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), আবূ বকর ইবনে আবী শাইবা (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল কাওয়ারীরী (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় ইমামে খুরাসান (মৃঃ ২৩৭ হিঃ), আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আম্মার আলমুসেলী (মৃঃ ২৪২ হিঃ), আহমদ ইবনে সালেহ- হাফেজে মিসর (মৃঃ ২৪৮ হিঃ), হারূন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাম্মাল (মৃঃ ২৪৩ হিঃ)।
তাঁহাদের পরে ইসহাক আল কাওসাজ (মৃঃ ২৫১ হিঃ), ইমাম দারেমী (মৃঃ ২৫৫ হিঃ), ইমাম বুখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ), হাফেজ আল-আজলী, ইমাম আবূ জুরয়া (মৃঃ ২৬৪ হিঃ), আবূ হাতেম (মৃঃ ২৭৭ হিঃ), ইমাম মুসলিম (মৃঃ ২৬১ হিঃ), আবূ দাঊদ সিজিস্তানী (মৃঃ ২৭৫ হিঃ), বাকী ইবনে মাখলাদ (মৃঃ ২৭৬ হিঃ), আবূ জুরয়া দেমাশকী (মৃঃ ২৮১ হিঃ)।
তাঁহাদের পরে উল্লেখযোগ্য আবদুর রহমান ইউসুফ আল বাগদাদী। তিনি হাদীস সমালোচনা পর্যায়ে একখানি গ্রন্হও রচনা করেন। ইবরাহীম ইবনে ইসহাক আল-হারবী (মৃঃ ২৮৫ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে অজ্জাহ (মৃঃ ২৮৯ হিঃ), হাফেজ কুরতবা আবূ বকর ইবনে আবূ আসেম (মৃঃ ২৮৭ হিঃ০ আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ (মৃঃ ২৯০ হিঃ), সালেহ জাজরা (মৃঃ ২৯৩ হিঃ), আবূ বকর আল বাযযার (মৃঃ ২৯২ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে নসর আল-মারওয়াযী (মৃঃ ২৯৪ হিঃ)-ও এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।
এইভাবে প্রত্যেক যুগেই বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উদ্ভব হইয়াছে, যাঁহারা হাদীসের সমালোচনা করিয়া উহার যথার্থতা যাচাই করিয়াছেন। ফলে কোন সময়ই নিতান্ত জাল ও মিথ্যা হাদীস ‘হাদীস’ নামে পরিচিত হইতে ও প্রচারিত হইয়া হাদীসরূপে টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। সাহাবীদের যুগ হইতে অষ্টম হিজরী শতক পর্যন্ত এইরূপ অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে।
এই পর্যায়ে যেই সব গ্রন্হ রচিত হইয়াছে, তন্মধ্যে এইখানে কয়েকখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্হের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যাইতেছেঃ
১. তাবকাতে ইবনে সায়াদ। ইহা বিরাটায়তন গ্রন্হ’ পনের খণ্ডে বিভক্ত ও সমাপ্ত।
২. ইমাম সুয়ূতী উক্ত গ্রন্হের সংক্ষিপ্তাসার রচনা করিয়াছেন। উহার নাম-
******************************************************
৩. ইমাম বুখারী রচিত তারীখে কবীর; তারীখে সগীর ও তারীখে আওসাত।
৪, ইবনুল মাদীনী লিখিত ইতিহাস দশ খণ্ডে সমাপ্ত।
৫. ইবনে হাব্বান রচিত ********************* দশ খণ্ডে সমাপ্ত।
৬. কিতাবুত তাকমীল- ইমাম ইবনে কাসীল রচিত। পূণ নামঃ
******************************************************
নবী করীম (ﷺ) ইতে হাদীস বর্ণনার দুইটি পদ্ধতি রহিয়াছে। নবী করীমের মুখ-নিসৃত কথা- যেভাবে যেসব শব্দ সহকারে তিনি কথাটি বলিয়াছেন, হুবহু সেইভাবে ও সেই সব শব্দ সহকারে বহু হাদীস বর্ণনা করা হইয়াছে। বর্ণনাকারী উহার ভাষা ও শব্দের কোনরূপ পরিবর্তন করেন নাই। এইরূপ বর্ণনাকে বলা হয় রেওয়ায়েত বিল- লাফজ- শাব্দিক বর্ণনা বা রাসূলের ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষায় বর্ণনা করা।
আর রাসূলের মূল বক্তব্যকে নিজস্ব ভাষায় ব্যক্ত ও বর্ণনা করা হইলে এই পদ্ধতিকে বলা হয় রেওয়ায়েত বিল মা’না- ভাব বর্ণনা বা নিজের ভাষায় মূল কথাটি বলিয়া দেওয়া। কিন্তু ইহাতে জরুরী শর্ত এই যে, রাসূলের ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষার পরিবর্তে যে শব্দ ও ভাষা ব্যবহৃত হইবে, তাহা অবশ্যই মূল ভাব ও অর্থের ধারক ও প্রকাশক হইতে হইবে। অর্থাৎ রাসূল যাহা বলিতৈ চাহিয়াছেন তাহাকে নিজস্ব ভাষায় এমনভাবে বলিতে হইবে যেন, তাহাতে মূল বক্তব্য যথাযথভাবে প্রকাশ করা হয়, শ্রোতার মনে যেন সেই ভাব ও অর্থই জাগ্রত হয়, যাহা জাগ্রত হইয়াছিল রাসূলের নিকট হইতে উহার প্রথম শ্রবণকারীদের মনে। ইহাতে কোন প্রকার পার্থক্য সৃষ্টি হইলে কিংবা মূল কথার কমবেশী হইয়া গেলে বর্ণনার দায়িত্ব সঠিকরূপে পালন হইতে পারে না।
এই শেষোক্ত পদ্ধতিতেও রাসূলের হাদীস বর্ণনা করা সম্পূর্ণ বিধিসম্মত। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে বর্তমান হাদীসসমূহের অধিকাংশই এই পদ্ধতিতে বর্ণিত। অর্থাৎ রাসূলের কথাটিকে নিজস্ব ভাষায় বর্ণনা করা হইয়াছে।
একজন সাহাবী নবী করীম (ﷺ)-এর খেদমতে আরয করিলেন, ‘আমরা আপনার হাদীস শ্রবণ করি; কিন্তু উহাকে শব্দে বর্ণনা করার সামর্থ্য আমাদের হয় না। (এখন আমরা কি করিব?) নবী করীম (ﷺ) বলিলেনঃ ‘তোমরা যখন হালালকে হারাম ও হারামকে হালালে পরিণত কর না, বরং মূল কথাটিকেই নিজস্ব ভাষায় পৌঁছাইয়া দাও, তখন উহাতে কোনই দোষ নাই।
[*********************]
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন