ইলমে হাদীস বনাম অমুসলিম মনীষীবৃন্দ
হাদীস মুসলমানদের নিকট অমূল্য সম্পদ। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় হইতেই ইহার প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে এবং ইহার রক্ষণাবেক্ষণ, প্রচার ও শিক্ষাদানের উপযুক্ত ব্যবস্থা প্রথম হইতেই অব্যাহত রহিয়াছে। কুরআনের পরই হাদীসের এই মর্যাদার কথা মুসলিমগণ কোন দিনই বিস্মৃত হইতেপারে নাই। কিন্তু অমুসলিম মনীষীদের মনে হাদীস সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইয়াছে। কোন কোন মনীষী ইহাকে উদার দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইহার গুরুত্ব অনুধাবন ও উহার অকপট স্বীকৃতি দানে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন নাই।
কিন্তু কোন কোন ইউরোপীয় চিন্তাবিদ হাদীসের গুরুত্ব স্বীকার করিতে পারেন নাই। এমনকি অনেক লোক এমনও আছেন, যাঁহারা হাদীসের গুরুত্ব অস্বীকার সম্ভব নয় বলিয়াই উহার মধ্যে নানা প্রকার দোষক্রটি আবিস্খার করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছেন।
বর্তমান নিবন্ধে আমরা এই উভয় শ্রেণীর লোকদের কিছু কিছু উক্তি পেশ করিতে চাই। যাঁহারা কোন না কোন দিক দিয়া ইলমে হাদীস, উহার সংগ্রহ এবং মুহাদ্দিসণের হাদীস যাচাই বাছাই পদ্ধতির উপর কোনরূপ কটাক্ষ করিয়াছেন তাঁহাদের কথার উত্তরে আমাদের বক্তব্যও সেই সঙ্গে পেশ করা হইবে।
১. প্রখ্যাত ইউরোপীয় ঐতিহাসক এডওয়ার্ড গীবন লিখিয়াছেনঃ ‘প্রত্যেক জাতির প্রতিষ্ঠাতার জীবন-চরিত দ্বারা তাঁহার লিখিত জ্ঞানসম্পদ পরিপূর্ণতা লাভ করে। হযতর মুহাম্মদের হাদীসসমূহ প্রকৃত সর্ত কথার পূর্ণাঙ্গ উপদেশ, তাঁহার কাজকর্ম, সততা ও নেক কাজের বাস্তব প্রতীক’।(********************)
২. মিসরের ‘ওয়াতন’ পত্রিকায় জনৈক খৃষ্টান মনীষী লিখিয়াছেনঃ ‘মুসলিমগণ কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে গবেষণা করিলে তাহাদের ধর্মীয় ও বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণের সুব্যবস্থা তাহাতে পাইতে পরিবে।
৩. প্রসিদ্ধ রুশ দার্শনিক টলষ্টয় স্বীয় দেশ ও জাতির নৈতিক সংশোধনের জন্য হাদীসসমূহের এক সংকলন নিজ ভাষায় প্রকাশ করিয়াছিলেন।
(******************************************************)
৪. মুসলিমদের মধ্যে হাদীসের সূত্রে যেসব নৈতিক নিয়ম-কানুন প্রচলিত রহিয়াছে, হাইটিংগার উহার এক লা’চওড়া তালিকা প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টিতে মানুষকে কার্যত নেক কাজের দিকে আকৃষ্ট করার এবং পাপ হইতে বিরত রাখার এতদপেক্ষা উত্তম কর্মপ্রণালী আর কিছুই হইতে পারে না।(********************)
৫. স্যার উহিলয়াম ম্যূর লিখিয়াছেনঃ
‘প্রাথমিক যুগে মুসলিমদের জন্য সর্বাপেক্ষা অধিক উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তার বিষয়বস্তু সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কথা ও কাজ ছাড়া আর কি হইতে পারে। …………. এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিই এই বিশ্বজয়ী জাতির অস্তিত্ব ও উত্থান লাভের একমাত্র কারণ। তিনিই মুসলিমদের হস্তে ইহকাল ও পরকাল উভয়েরই কুঞ্জিকা সমর্পণ করিয়া দিয়াছিলেন। এই কারণে হযতর মুহাম্মদের অনুসারীদের মধ্যে বেশীর ভাগ কথাবার্তা তাঁহার সম্পর্কেই হইত। এইসব উপায় উপাদানের কারণে হাদীস বিজ্ঞান যথেষ্ট উন্নতি লাভ করিয়াছে। (Life of Muhammad)
রাসূলে করীমের কণ্ঠ নিঃসৃত বাণী, তাঁহার কার্যকলাপের বিবরণ এবং তাঁহার নিকট অনুমোদন প্রাপ্ত কোন কতা, কাজ বা আচরণকেই বলা হয় হাদীস। এই হাদীসের বিশ্বস্ততা ও অকাট্যতা স্বভাবতঃই নির্ভর করে সঠিক সময়ে ও নির্ভূল পদ্ধতিতে হাদীস সংকলিত হওয়ার উপর। আর অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে একথা সুস্পষ্ট ও অনস্বীকার্য হইয়া উঠিয়াছে যে, পৃকৃত পক্ষে হাদীস রাসূলের জীবদ্দশায়ই রাসূলের হিদায়ত অনুযায়ীই লিপিবদ্ধ হইতে শুরু হইয়াছিল। ইলমে হাদীসের ইতিহাস অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই ইহা অস্বীকার করিতে পারেন না। কিন্তু কোন কোন পাশ্চাত্য মনীষীর আচরণ এই ব্যাপারে নৈরাশ্যজনক। তারা হাদীসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকরূপে অবহিত না হইয়ই এমন সব উক্তি করিয়াছেন, যাহার ফলে হাদীসের সঠিক সময়ে ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ ও সুরক্ষিত হওয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ পাঠকদের মনে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইতে পারে।
এই প্রসঙ্গে আমরা Alfred Guillame-Fr Islam গ্রন্হ হইতে একটি উক্তি উদ্ধৃত করিতে চাই। তাঁহার উক্ত গ্রন্হের ৮৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখিয়াছেনঃ
Exactly when records of the deeds words of the Prophet were first written down we do not know; indeed early tradition is variance with itselt on this very point. Some say that the Prophet the writing of his saying; others that the forbade it.
ঠিক কখন যে হযরতের বাণী ও কার্যাবলীর বিবরণ প্রথম লিখিত হয়, তাহা আমরা জানি না। বাস্তবিকপক্ষে প্রথম যুগের হাদীসসমূহ এই বিষয়টি সম্পর্কে স্ববিরোধী। কেহ কেহ বলেন, রাসূল তাহার বাণী লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়াছিলেন। আবার অন্যরা দাবি করেন যে, তিনি উহা নিষিদ্ধ করিয়াছেন।
উদ্ধৃত উক্তিতে একই সঙ্গে কয়েকটি আপত্তিকর ইঙ্গিত করা হইয়াছে। ‘হাদীস ঠিক কখন লিপিবদ্ধ করা হইয়াছিল তাহা আমাদের জানা নাই’ বলিয়া লোকদের মনে হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক করার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। দ্বিতীয়ত রাসূলের ‘নিষেধ’ ও “অনুমতির’ মধ্যে বাস্তত সামঞ্জস্য স্থাপন না করিয়া এক চরম দ্বিধা ও সংশয় জাগাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অথচ এই বিরাট গ্রন্হের এতদসংশ্লিষ্ট আলোচনা প্রমাণ করে যে, কুরআনের সহিত হাদীস মিলিয়া মিশিয়া গিয়া মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব করিতে না পারে কেবল এই উদ্দেশ্যেই ইসলামী দাওয়াতের একবারে প্রাথমিক স্তরে হাদীস লিখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল। কিন্তু অনতিবিলম্বেই এই নিষেধ আদেশে পরিবর্তিত হয় এবং সাহাবিগণ দ্বিধাসংকোচহীন মনে হাদীস লিখিয়া রাখিতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে এই কথাও মনে রাখিতে হইবে যে, একেবারে প্রথম যুগে কুরআন লিখার সঙ্গে সঙ্গে হাদীস লিখিতে নিষেধ করার ফলে উহার লিপিবদ্ধকরণ বন্ধ হইলেও উহার মৌখিক বর্ণনা এবং পারস্পরিক চর্চা ও আলোচনা বিন্দুমাত্র বন্ধ হইয়া যায় নাই। কেননা লিখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল মাত্র। পরস্পরের নিকট মৌখিত বর্ণনা করিতে নিষেধ করা হয় নাই।
এতদ্ব্যতীত Goldziher এবং Sprenger নামে দুইজন প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদও এই পর্যায়ে জনমেনে সন্দেহের সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। Goldziher তাঁহার রচিত Muhammadanische Studim নামক গ্রন্হের দ্বিতীয় খণ্ডে পৃষ্ঠা ২৪১-২৫০ বহু সংখ্যক দলীল দিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরুতে হাদীস সংকলিত হইয়াছে। যদিও তিনি এই গ্রন্হেরই প্রথম ভাগে পৃষ্ঠা ১০-১২ এমন কিছু কথাও লিখিয়াছেন, যাহা হইতে রাসূলের যুগেই কতিপয় হাদীস সংকলন-সহীফা-সংকলিত হওয়া সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু একটু পরেই তিনি এই সহীফাসমূহের সত্যতার প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাষ সৃষ্টিাকারী অনেক তত্ত্বই করিয়াছেন।
তাঁহার এই রূপ ভূমিকার পশ্চাতে দুইটি উদ্দেশ্য নিহিত রহিয়াছে। প্রথম উদ্দেশ্য হইল হাদীস ও সুন্নাতের শুধু মুখস্থ করিয়া রাখার কথা বলিয়া উহার প্রমাণা মর্যদাকে দুর্বল করিয়া তোলা এবং হাদীস দ্বিতীয় হিজরী শতকে লিপিবদ্ধ হইয়াছে বলিয়া জনগণকে এক মারাত্মক বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত করা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হইল হাদীস সংকলনকারিগণ নিজেদের ধারণা ও অভিমতের সমর্থনে এবং নিজেদের ‘অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মতলবেঃ হাদীস রচনা করিয়াছেন বলিয়া গোটা হাদীস ও সুন্নাহকে অকেজো ও সমর্থন-অযোগ্য প্রমাণ করা। এই প্রাচ্যবিদ হাদীস সংকলনের ইতিহাস জানান উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় দলীলাদি সংগ্রহ করার জন্য কোন কষ্ট স্বীকার করার উদ্দেশ্যেই চিন্তা ও গবেষণা চালাইয়াছেন। আসলে এইরূপ কাজ নিতান্ত স্বার্থবাদী ও উদ্দেশ্যে প্রণোদিত ব্যক্তিদের দ্বারাই সম্ভব হইতে পারে।
স্প্রেংগান তাঁহার Dao Traditious wesen dei den Arabern 1856, 1-17 Dans নামক গ্রন্হে রাসূলের নিকট হইতে নিভূলভাবে হাদীস পৌঁছার কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা পাইয়াছেন। হাদীস সংকলন পর্যায়ে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করিয়াছেন যে, হাদীস রাসূলের জীবনকার নয়, দ্বিতীয় হিজরী শতকে সংকলিত হইয়াছে। মূলত এই প্রাচ্যবিদের উদ্দেশ্যও শুভ নহে।
অবশ্য ডোজী স্বীকার করিয়াছেন যে, রাসূলের বিপুল সংখ্যক হাদীস মুখস্থ রাখা হইয়াছে এবং তাহা হইতেই গ্রন্হাকারে সংকলিত হইয়াছে। তবে তাহাতে অনেক রচিত ও মিথ্যা ‘হাদীস’ও শামিল হইয়াছে। ডোজীর এইরূপ উক্তিতে অনেক লোকের মনেই হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হইতে পারে। অথচ তাঁহার এই উক্তির পশ্চাতে কোন সদিচ্ছা লুক্কায়িত নাই। বরং হাদীস ও সুন্নাতের ব্যাপারে লোকদের, বিশেষত যাহারা হাদীস সংকলনের নির্ভূল ইতিহাস জানে না তাহাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করাই তাঁহার উদ্দেশ্য।
এই পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য হইল, আমাদের অতীতকাল ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রাথমিক ইতিহাসের সত্যাসত্য প্রমাণের জন্য তথাকথিত প্রাচ্যবিদদের অসংলগ্ন উক্তি ও ভিত্তিহীন কথাবার্তার প্রতি আমরা মোটেই ভ্রূক্ষেপ করিতে রাযী নহি। রাসূলের জীবনে হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংগৃহীত হওয়ার কথা পশ্চিমা পণ্ডিতরা স্বীকার করুক আর না-ই করুক, তাহাতে মুসলমানদের কিছুই আসে যায় না। কেননা ‘ঘরের লোকেরাই ঘরের অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবহিত’- নবী করীমের সামনেই হাদীস লিখিত হইয়াছে, সংকলিত হইয়াছে হাদীসের বিপুল সম্পদ- সহীফা আকারে, ব্যক্তিগত নোট বই হিসাবে, একথা অকাট্য প্রমাণসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্হাবলী হইতেই অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। সেকালের সংকলিত সমস্ত হাদীস সম্পদই যে উত্তরকালে গ্রন্হাকারে সংকলিত ও সংযোজিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। দৃষ্টান্তসরূপ বলা যায়, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ‘মুসনাদ’ গ্রন্হে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স ও হযরত আবূ হুরায়রার সংকলিত বিপুল হাদীস-সহীফা- পুরাপুরি অন্তভূক্ত হইয়াছে।
অরিয়েন্টালিস্টরা মনে করেন, হাদীস লিখন ও সংকলন কিংবা উহা হইতে নিষেধ করার যেসব বাণী ও উক্তি উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা সবই মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদদের এক ধরনের মত পোষণের ফলে বিরচিত হইয়াছে। তারা নাকি নিজ নিজ মত ও রায়ের সমর্থনে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে হাদীস রচনা করিয়াছেন।
কিন্তু ইহা চরম মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর উক্তি। এই বিভ্রান্তির প্রধান হোতা হইলেন গোল্ডজেহের (Goldziher)। কেননা তাঁহার পূর্ববর্তী প্রাচ্যবিদ স্প্রেংগার খতীব বাগদাদী লিখিত ******************** গ্রন্হখানি ১৮৫৫ সনে আবিষ্কার করেন এবং লেখার মূল ও অগ্রগতি (origin progress of writing) শীর্ষক এক প্রবন্ধ রচনা করেন।(Asiatic Sociaty of Bangal XXV, 303-329) এই প্রবন্ধে তিনি আরব সমাজে লেখা প্রচলন, তদসংক্রান্ত প্রমাণাদির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, রাসূলের যুগে বিপুল সংখ্যক হাদীস লিখিত ও সংকলিত হইয়া থাকিবে।অথচ গোল্ডজেহের এইসব বিবরণকেই অসত্য মনে করিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন এবং উত্তরকালে পরস্পরবিরোধী লোকেরা এইসব কথা রচনা করিয়াছেন বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।
মূলত নিতান্ত কুমতলবে ও ইসলামের সংস্কৃতি বিকাশের প্রতি বিদ্বেষ পোষণবশত এইরূপ মিথ্যা প্রচারণা চালানো হইয়াছে। নতুবা বাস্তব দৃষ্টিতে বিচার করিলে এই ধরনের উক্তির কোন হেতুই থাকিতে পারে না। বহু সংখ্যক সাহাবী নবী করীমের জীবদ্দশায়ই যে হাদীস লিখন ও সংকলনের কাজ বিশেস গুরুত্ব সহকারে করিয়াছেন, তাহা এক অকাট্য সত্য। এই ব্যাপারে যে কোনরূপ সন্দেহ পোষণের কোনই কারণ থাকিতে পারে না, তাহা বলাই বাহুল্য। তবে এই কথা সত্য যে, সেকালে লিখিত ও সংকলিত সহীফার সংখ্যা খুব বিরাট এবং বেশী কিছু ছিল না। কিন্তু হাদীস যে লিখিত ও সংকলিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ করার কোনই হেতু নাই।
স্যার ইউলিয়াম ম্যূর তাঁহার গ্রন্হ Life of Muhammad- এ মুহাদ্দিসগণের হাদীস যাচাই পদ্ধতি সম্পর্কে একর্টি অমূলক উক্তি করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
মুহাদ্দিসগণ কি ধরনের হাদীস সমালোচনা ও যাচাই পরখ করিতেন তাহা সুস্পষ্ট। তাহা এতদুর কঠোর যে, গড়ে শতকরা নিরানব্বইটি হাদীসকেই গ্রহণ-অযোগ্য গণ্য করিয়াছেন।
বস্তুত মিঃ ম্যূরের এই কথাটিরও কোন মৌলিক ভিত্তি নাই। তিনি মুহাদ্দিসদের হাদীস-যাচাই-বাচাই পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিকরূপে অবহিত হইলে এইরূপ উক্তি কখনো করিতেন না। ইমাম বুখারী তাঁহার সংগৃহীত ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্য হইতে অন্তত নয় হাজার হাদীস সম্বলিত হাদীস বুখারী প্রণয়ন করিয়াছেন, ঠিক ইহা হইতেই মিঃ ম্যূরের উপরোক্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু ইমাম বুখারী তাঁহার গ্রন্হ সমাপ্ত করার পর বলিয়াছেন যে, বহু সহস্র সহীহ হাদীস এই গ্রন্হের অন্তর্ভূক্ত হইতে পারে নাই। ইহার সুস্পষ্ট অর্থ এই যে, তিনি যেসব হাদীস তাঁহার গ্রন্হে শামিল করেন নাই,তাহা অশুদ্ধ বা গ্রহণ অযোগ্য নহে এবং তাঁহার গ্রন্হে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহ ছাড়াও আরো বহু সহস্র সহীহ হাদীস বর্তমান রহিয়াছে। মিঃ ম্যূর ইহা হইতে সন্দেহ করিয়া বসিয়াছেন যে, যেসব হাদীস বুখারী গ্রন্হে সন্নিবেশিত হয় নাই ইমাম বুখারী বুঝি সেই-সবকে ‘অশুদ্ধ’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য; বলিয়াই মনে করেন। ইমাম বুখারীর অগৃহীত হাদীসসমূহের সবই যদি বাস্তবিক গ্রহণের অযোগ্য হইত, তাহা হইলে তিনি উহাদের মধ্যে ‘সহীহ হাদীস রহিয়া গেল’ এমন কিছুতেই বলিতেন না। বস্তুত প্রত্যেক গ্রন্হ প্রণেতাই স্বীয় গ্রন্হের উপযোগী তথ্য বিপুল পরিমাণে সংগ্রহ করিয়া থাকেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উহার সবকিছুকেই গ্রন্হে সন্নিবেশিত না করিলে যে তাহা সবই ‘অশুদ্ধ’ হইয়া যাইবে এমন কোন কথাই হইতে পারে না। এই তত্ত্ব বোধ হয় ম্যূর সাহেবের অজ্ঞাত রহিয়াছে। তিনি বোধ হয় ইহাও জানিতেন না যে, একজন মুহাদ্দিস কোন সব কারণে একটি হাদীসকে গ্রহণ- অযোগ্য ঘোষণা করিয়া থাকেন। এক একটি হাদীস বহুসংখ্যক সূত্রের মারফতে গ্রন্হকার পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে, তিনি তাঁহার নিজস্ব মানদণ্ড অনুযায়ী উহাদের প্রত্যেকটি সূত্রেরই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। যেসব সূত্রকে তিনি নির্ভরযোগ্য পাইয়াছেন, সেই সূত্র তিনি উক্ত হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন, আর যেসব সূত্রের উপর তিনি নির্ভর করিতে পারেন নাই, অথবা যাহা প্রয়োজনাতিরিক্ত হইয়াছে তাহা তিনি পরিহান করিয়াছেন। কিন্তু ইহার দরুন বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত সেই মূল হাদীসটি কখনো অগ্রহণযোগ্য হইয়া যায় না। বস্তুত হাদীসের সংখ্যা গণনা করা হয় উহার মতন-এর দৃষ্টিতে নয়, বরং বর্ণনা পরম্পরাসূত্রের ত্মঃশুস্ফত্র হিসাবে। এই কারণে ইমাম বুখারীর নিকট সংগ্রহীত মূল হাদীস কত সংখ্যক ছিল এবং তাহা কত কত সূত্রের মারফতে তাঁহার নিকট পৌঁছিয়াছিল, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না।
ডাঃ স্প্রেংগার বিশেষভাবে ইমাম বুখারীর হাদীস যাচাই পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন। তিনি তাঁহার গ্রন্হ Life of Muhammad- এ লিখিয়াছেনঃ
‘তিনি (ইমাম বুখারী) যেসব নীতি পদ্ধতির অনুসরণ করিয়াছেন, তাহাকে ‘হাদীস-সমালোচনা’ বলিয়া অভিহিত করা যায় না। তিনি কেবল দেখিতেন, বর্ণনাকারীদের পরম্পরা সুত্রের ধারাবাহিকতা সুরক্ষিত আছে কিনা, কোথাও তাহা বিচ্ছিন্ন হইয়া যায় নাই তো! এতদ্ব্যতীত হাদীস বর্ণনাকারীদের চালচলন- তথা চরিত্রেরও তিনি বিচার করিতেন। যেহেতু তাঁহার নীতি ছিল এই যে, যে হাদীস তাঁহার ‘বিদ্বেষ দুষ্ট’ মতের অনুকূল নহে তাহা তিনি প্রত্যাখ্যান করিতেন। এইজন্য তাঁহার কোন হাদীস প্রত্যাখ্যান করার অথ্য কোন মতেই ইহা হইতে পারে না যে, সেই হাদীস আসলেও গ্রহণ অযোগ্য। কিন্তু তাঁহার ‘জামে’ গ্রন্হ অন্যান্য মুসনাদ গ্রন্হ হইতে এই দিক দিয়া পৃথক ছিল যে, তাহা বিশেষ কোন ফিকাহ মতের অনুসারী ছিল না; বরং বর্ণনাকারীদের সততার উপরই নির্ভরশীল ছিল’।
ডাঃ স্প্রেংগারের এই কথা যাচাই করিলে সুস্পস্টরূপে মনে হয় যে, তিনি যেমন হাদীসের পরিভাষাসমূহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নহেন, তেমনি মুহাদ্দিসদের কর্মনীতি অবস্থা সম্পর্কেও তাঁহার কোন অভিজ্ঞতা নাই। উপরন্তু ইলমে হাদীসের বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কেও তাঁহার সুস্পষ্ট কোন ধারণা নাই।
মুহাদ্দিসগণ প্রথম ‘দেরায়াত’ নীতির মানদণ্ডে হাদীস যাচাই করেন। কুরআন হাদীস এবং সাহাবায়ে কিরামের আমলেও তাঁহার অনুসৃত কর্মপদ্ধতি হইতেই এই নীতি গৃহীত হইয়াছে। ইহা সকলের পক্ষে অনিবার্যরূপে অনুসরণীয়। ইহা যেহেতু সাধারণ ও প্রচলিত মূলনীতি বিশেষ, সেইজন্য ইহা প্রকাশ করা মুহাদ্দিসদের পক্ষে কোন প্রয়োজনীয় কজ নহে। যেহেতু সকলেরই একথা জানা আছে যে, মুহাদ্দিসগণ হাদীসসমূহকে এই সকল নীতির উপর অবশ্যই যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। এই যাচাই পরীক্ষার ব্যাপারে কাহারো কোন ভূল থাকিলে তাহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। প্রত্যেক মুহাদ্দিসই নিজস্ব সংগ্রহীত হাদীসসমূহের বর্ণনাপরম্পরা ধারা সঠিক ও দোষমুক্ত রাখার জন্য যারপরই নাই গবেষণা ও চেষ্টা চালাইয়া থাকেন। ইহা ছাড়া তারা কোন হাদীসই গ্রহণ করিতে আদৌ প্রস্তুত হইতে পারে না। এই কারণে প্রত্যেক মুহাদ্দিসই হাদীস বর্ণনাকারীদের যাচাই পরীক্ষা ও নিরীক্সা করিয়া নিজস্ব একটি বর্ণনাপরম্পরা সূত্র স্থাপন করিয়া থাকেন এবং সেই সূত্র হইতে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করিয়া থাকেন।
মনে হয় সহীহ বুখারী শরীফ কি ধরনের গ্রন্হ ‘জামে’ না ‘মুসনাদ’, ডাঃ স্প্রেংগার তাহাও ঠিকতম জানেন না। কেননা তিনি তো বুখারী শরীফকে ‘মুসনাদ’ ধরনের গ্রন্হ মনে করিয়া লইয়াছেন।
ডাঃ স্প্রেংগার ইমাম বুখারীর উপর হিংসা বিদ্বেষের অভিযোগ করিয়াছেন। ইহা সম্পূর্ণ অমূলক কথা। ইমাম বুখারী হিংসা বিদ্বেষ-দুষ্ট ছিলেন, এমন মনে করার কোন কারণ নাই। আসলে তিনি ইহা হইতে সর্বতোভাবে পবিত্র ও মুক্ত ছিলেন। এইজন্যই দেখিতে পাই যে, তিনি শিয়া মতাবলম্বী না হইয়াও তাঁহার অদ্বিতীয় হাদীস গ্রন্হে শিয়া বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ ও উহার অন্তর্ভূক্ত করিয়াছেন। উপরন্তু তিনি ছিলেন শাফেয়ী মতাবলম্বী, কিন্তু তাঁহার সংকলিত গ্রন্হে শাফেয়ী মতের বিপরীত অনেক হাদীস গ্রহণ করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। মনে হয় এই সব কথা ডাঃ স্প্রেংগারেরে একেবারেই অজ্ঞাত।
এই প্রসঙ্গে মিঃ ম্যূরের আরো কয়েকটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁহার Life of Muhammad গ্রন্হের এক স্থানে হাদীস যাচই পদ্ধতি সম্পর্কে কটাক্ষ করিয়া বলিয়াছেনঃ
মুহাদ্দিসদের নিকট কোন হাদীসের গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য সেই হাদীসের মূল কথাটির ******************** উল্লেক প্রয়োজনীয় বিবেটিত হইত না। কেবল হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট ছিল।
মিঃ ম্যূরের এই কথা হইতেও প্রমাণিত হয় যে, ইলমে হাদীসের পরিভাষা ও হাদীস যাচাইয়ের রীতিনীতি সম্পর্কে তিনি সবিশেষ অবিহিত নহেন। কেননা হাদীস যাচাই করার জন্য ‘রেওয়ায়েত’ ও ‘দেরায়েত’ এই দুইটি পদ্ধটিই হাদীস জগতে নির্ধারিত ও সর্বজন পরিচিত। হাদীস যাচাইয়ের ইহা অপেক্ষা উত্তম রীতিনীতি আর কিছুই হইতে পারে না। ‘রেওয়ায়েত’ পদ্ধতিতে হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা যাচাই করা হয় এবং তখন মূল হাদীস উল্লেখ করার কোন প্রয়োজনই হয় না। পক্ষান্তরে ‘দেরায়েত’ পদ্ধতিতে হাদীসের শুধু মূল বাণী ******************** টুকুর যথার্থতা যাচাই করা হয়, আর তখন- সেইসময়- বর্ণনাকারীদের অবস্থা যাচাই করা অবান্তর হইয়া দাঁড়ায়।
ম্যূর সাহেব আর একটি মারাত্মক ভূল উক্তি করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, মুহাদ্দিসগণের হাদীস অনুসন্ধান ও যাচাই পরখের নীতি এবং পদ্ধতি সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি কোন আস্থা ও উদারতার ভাব বর্তমান ছিল না। এইজন্য প্রত্যেক মুহাদ্দিসই নিজম্ব পদ্ধতি অনুযায়ী হাদীস গ্রহণ এবং বর্জন করিয়াছেন। মুহাদ্দিসদের সম্পর্কে এই উক্তিটি অমূলক। এই ধরনের কথা একমাত্র সেই ব্যক্তিই বলিতে পারেন ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে যাঁহার বিন্দুমাত্র ধারণা বা শ্রদ্ধা নাই অথবা ইসলামের দুশমনী করা্ই যাঁহার স্থিরসংকল্প। ইজতিহাদ-নীতিও এই সম্পর্কীয় মত-পার্থক্যের ম্যূর সাহেব পারস্পরিক অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা বলিয়া অভিহিত করিতে চাহেন। কিন্তু প্রকৃপক্ষে ইহা কোন অনাস্তার ব্যাপার নহে। ইহা প্রত্যেকের ইজতিহাদ নীতি ও মত বা রায়ের পার্থক্য মাত্র। এই জন্যই দেখিতে পাই- ইমাম মুসলিম ইমাম বুখারীর কোন কোন মত বা পদ্ধতির সমালোচনা করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহাকে ‘সাইয়েদুল মুহাদ্দিসীন- শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস’ বলিয়া মান্য করিতে ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠত হইতেন না। বস্তুত মত-পার্থক্যের কারণেই হাদীসের সূত্র বা সনদসমূহ যাচাই করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
মুহাদ্দিসদের পারস্পরিক মত-পার্থক্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ইমাম বুখারী ‘যে ব্যক্তি যাহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছে’ ******************** এতদুভয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষাত ও দীর্ঘদিন একত্র থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু ইমাম মুসলিম মনে করেন, উভয়ের সমসাময়িক ও একই যুগের হওয়াই যথেষ্ট। ইমাম বুখারী কেবল সেইসব বর্ণনাকারীর হাদীসই গ্রহণ করার পক্ষপাতী, যাঁহাদের ‘সিকাহ’‘বিশ্বস্ত’ ও ‘নির্ভরযোগ্য’ হওয়া সম্পর্কে সকলেই একমত। কিন্তু ইমাম নাসায়ী এমন লোকের বর্ণিত হাদীসও গ্রহণ করিতেন, যাহাদের ‘সিকাহ’ হওয়া সম্পর্কে সকলের একমত নহেন। বস্তুত পারস্পরিক আস্থাহীনতার কিংবা হিংসা-বিদ্বেষের কারণে এইরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় নাই, বরং ইহা নিছক মতবিরোধ- রায়- পার্থক্য মাত্র এব রায়- পার্থক্য ভিন্ন ইহা আর কিছুই নহে। পরবর্তিকালে মুহদ্দিসগণ যদি হাদীস বর্ণনাপরম্পরার নূতন কোন বিশ্বস্ত সূত্র পাইতেন, তবে ‘ছয়জন ইমামে হাদীসে’র মধ্য হইতে কোন একজনের নির্ধারিত মূল নীতি অনুযায়ী কোন হাদীস গ্রহণ করিতেন। ইহা ক্ষেত্র প্রশস্ততারই পরিচায়ক।
— সমাপ্ত —
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন