হাদীস জালকরণ ও উহার কারণ
হাদীস সংকলনের যে দীর্ঘ ইতিহাস ইতিপূর্বে পাঠকদের সম্মুখে পেশ করা হইয়াছে তাহা হইতে এই কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে, হাদীসের উৎপত্তিকাল হইতে গ্রন্হকারে সংকলিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি স্তরে উহা সংরক্ষণের জন্য সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হইয়াছে। রাসুলের হাদীস যাহাতে সর্বোত্তমভাবে সংরক্ষিত থাকে, উহাতে কোন প্রকার সংমিশ্রণ না ঘটে এবং উহা বিলীন হইয়া না যায় সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রৃহণে কোন এক স্তরেই এক বিন্দু উপেক্ষা, অসতর্কতা বা গাফিলতির প্রশয় দেওয়া হয় নাই। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, হাদীসের এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় এমন এক-একটি অব্স্থা দেখা দিয়াছে, যখন দুষ্ট লোকেরা স্বার্থ কিংবা অসদুদ্দেশ্যে প্রণোদিত হইয়া নিজেদের ‘কথা’কে রাসূলের হাদীস নামে চালাইয়া দিতে চেষ্টা করিয়াছে এবং এমন কিছু কিছু ‘কথা’ রাসূলের বিরাট হাদীস সমুদ্রের সহিত মিশিয়া যাইবার সুযোগ লাভ করিয়াছে।
রাসূলের হাদীস সংরক্ষণের এই অবিমিশ্র ও নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় এইরূপ একটি দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটিতে পারিল, তাহা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি তাহা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ সাপেক্ষও।
আমরা এখানে হাদীস জালকরণের এই ইতিহাস সংক্ষিপ্ত ও ব্যাপকভাবে আলোচনা করিব।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতার পুংখানুপুংখভাবে পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় সর্বপ্রথম হাদীস জালকরণের কাজ প্রখ্যাত ‘খাওয়ারিজ’দের কর্তৃক সূচিত হয়। সিফফীন যুদ্ধে (৩৬ হিঃ) সন্ধিসূত্র লইয়া হযরত আলী (রা)-এর সমর্থকদের মধ্যে মারাত্মক মতভেদ দেখা দেয় এবং তাহারা এই সন্ধিকে মানিয়া লইতে বিন্দুমাত্র রাযী হয় না। অতঃপর তাহারা এক স্বতন্ত্র ধর্মীয় দলের রূপ ধারণ করে।
খাওয়ারিজগণ হাদীস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। তাহারা অন্যান্য লোকের নিকট হইতে কোন কথাকেই সত্যরূপে গ্রহণ করিতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। তাহারা মিথ্যুককে মনে করিত কাফির। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাহারা হাদীস জালকরণের কাজ করিতে ও রাসূলের নামে মিথ্যা প্রচার করিতে শুরু করে। আর ইহার মূলে তাহাদের উদ্দেশ্যে ছিল নিজেদের বিশেষ মতের সমর্থন যোগানো মাত্র।
আল্লামা ইবনুল জাওজী তাঁহার ‘কিতাবুল মওজুআত’ নামক গ্রন্হে ইবনে লাহইয়ার নিম্নোক্ত উক্তির উল্লেখ করিয়াছেনঃ
******************************************************
এই হাদীস দ্বীন-ইসলামের অন্যতম ভিত্তি। দ্বীনের এই ভিত্তিগত জিনিস তোমরা যাহার নিকট হইতে গ্রহণ কর, তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিও। কেননা আমরা যখন যাহা ইচ্ছা করিতাম তখনি উহাকে হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিতাম।
অর্থাৎ এই ব্যক্তি পূর্বে খাওয়ারিজ দলভুক্ত ছিল এবং তখন ইচ্ছামত কথা রাসূলের হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিত। খাওয়ারিজদের কর্তৃক হাদীস জালকরণের গোড়ার কথা ইহাই।
ইহারি পর আমরা শিয়া সম্প্রদায়কেও হাদীস জালকরণ কাজে লিপ্ত দেখিতে পাই। তাহারা আসলে ছিল ইসলামের উৎকট দুশমন। ইসলামের মূল বুনিয়াদের উ পর আঘাত হানিবার অবাধ সুযোগ লাভের কুমতলবে তাহারা শিয়া মতবাদের চরম বিভ্রান্তির আশ্রয় লইয়াছিল। প্রথমে তাহারা কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত চরম বিকৃতি ও কদর্থ প্রবিষ্ট করাইতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাহাতে তাহারা কোন সাফল্য লাভ করিতে পারিবে না মনে করিয়া রাসূলের হাদীসের প্রতি লক্ষ্য আরোপ করে এবং রাসূলের হাদীসের নামে অসংখ্য মিথ্যা কথা চালাইয়া দিতে চেষ্টা করে। তাহারা হযরত আলীর উচ্চ প্রশংসা ও হযরত মুয়াবিয়ার মর্যাদা লাঘবের উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক হাদীস জাল করে। হযরত আলীর স্বপক্ষে এমন অনেক হাদীস তাহারা চালাইয়া দিয়াছে, যাহার কোন কোনটি হইতে হযরত আলীর নবুয়্যাত এবং কোন কোনটি দ্বারা রাসূলের পরে হযরত আলীর খিলাফতের অধিকার প্রমাণিত হয়।
শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বপ্রধান ‘হাদীস রচনাকারী’ হইতেছে মুখতার ইবনে আবূ উবাইদ। তিনি প্রথমে ছিলেন খাওয়ারিজ দলভুক্ত। পরে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সমর্থকদের মধ্যে শামিল হন। আর শেষ পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণ শিয়া মত ধারণ ও শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়া যান। তিনি প্রকাশ্যভাবে হাদীস জাল করিতেন। তিনি যখন কূফার আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সহিত সাক্ষাৎ করেন, তখন জনৈক মুহাদ্দিসকে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমার জন্য রাসূলের নামে এমন কিছু হাদীস রচনা করিয়া দাও, যাহা হইতে প্রমাণিত হইবে যে, তিনি (মুখতার) তাহার পরই খলীফা হইবেন।
মুসলমানদের মধ্যে যাহারা দুর্বল ঈমানদার তাহারাও রাসূলের নামে অনেক হাদীস জাল করিতে শুরু করে। তাহারা হযরত আলীর সম্মান লাঘব এবং হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের অধিক মর্যাদা প্রমাণের জন্য ও বহু হাদীস রচনা করে।
হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস জালকরণের এক নূতন ফিতনা জাগ্রত হয়। লোকেরা কিসসা-কাহিনী, মিথ্যঅ ও অমূলক কিংবদন্তী হাদীসের রূপে বর্ণনা পরম্পরা সূত্র সহকারে প্রচার করিতে শুরু করে। এই সময়কার হাদীস রচয়িতাদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থবাদী, কিসসা-কাহিনী বর্ণনাকারী ও গোপনে ধর্মদ্রোহিতাকারী লোকেরাই প্রধান হইয়া দেখা দেয়।
[এই দীর্ঘ আলোচনার উৎসঃ ********************]
উপরোক্ত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, মোটামুটি তিনটি কারণে ইসলামে হাদীস জালকরণের ফিতনার উদ্ভব হয়ঃ
ক) রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের মতের প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য স্থাপন, নিজেদের আচরিত রাজনৈতিক মতাদর্শকে সপ্রমাণিতকরণ ও জনগণের নিকট উহাকে গ্রহণযোগ্য করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে হাদীস জালকরণ।
খ) জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচার, ওয়ায-নসীহত দ্বারা জনগণকে অধিক ধর্মপ্রাণ বানানো, ইবাদত বন্দেগীতে অধিকতর উৎসাহী বানানো এবং পরকালের ভয়ে অধিক ভীত করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে হাদীস জালকরণ।
গ) ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভ উহাকে সহজসাধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে মনগড়া কথাকে ‘হাদীস’ নামে চালাইয়া দেওয়া।
বিশেষ রাজনৈতিক কারণে হাদীস রচনা করা হয় প্রথমত হযরত আলী (রা)-কে কেন্দ্র করিয়া। নবী করীমের পরে তিনিই যে খলীফা হইবার অধিকারী- অন্য কেহ নয়, এই কথা প্রমাণ করাই এইরূপ হাদীস রচনার উদ্দেশ্য ছিল। এই পর্যায়ের তিনটি জাল হাদীসের দৃষ্টান্ত পেশ করা যাইতেছেঃ
ক) নবী করীম (ﷺ) বিদায় হজ্জ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় ‘গাদীরে খাম’ নামক স্থানে যে ভাষণ দান করেন, তাহাতে তিনি হযরত আলীর প্রতি ইশারা করিয়া নিম্নোক্ত কথাও বলিয়াছিলেন বলিয়া প্রচার করা হয়ঃ
(ক) ******************************************************
এই ব্যক্তিই আমার উত্তরাধিকারী, আমার ভাই, আমার পরে এই-ই খলীফা; অতএব তোমরা সকলে তাহার কথা শোন এবং তাহাকেই মানিয়া চল।
(খ)- ******************************************************
আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ এমন এক পূণ্য যে, ইহা থাকিলে কোন পাপই তাহার ক্ষতি করিতে পারিবে না। পক্ষান্তরে, আলীর প্রতি হিংসা ও শক্রতা পোষণ এমন এক পাপ যে, কোন নেক কাজই তাহাকে কোন ফায়দা দিতে পারে না।
******************************************************
যে ব্যক্তি হযরত আলীর প্রতি হিংসা পোষণ করা অবস্থায় মরিবে, সে হয় ইয়াহুদী কিংবা নাসারা হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইবে।
হাদীস নামে প্রচারিত এই বাক্যত্রয় যে কিছুতেই হাদীসে রাসূল হইতে পারে না; বরং ইহা নিছক রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে স্বকপোলকল্পিত তাহা প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝিতে পারা যায়।
[********************]
হযরত আলী নবী করীমের উত্তরাধিকারী প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে শিয়াগণ যে কত শত হাদীস জাল করিয়া চালাইয়াছে, তাহার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু তাহাদের প্রত্যেকটি কথাই যে সুস্পষ্ট মিথ্যা, তাহা হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস হইতেও প্রমাণিত হয় এবং তাহা সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির অগম্য বিবেচিত হয়।
ইহার বিপরীত দিকে হযরত আবূ বকর ও উমরের অতিরিক্ত প্রশংসায় যেসব জাল হাদীস প্রচার করা হইয়াছে তাহাও অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বিবেচিত হইতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না।
দৃষ্টান্তস্বরূপ এই পর্যায়ের দুইটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ
******************************************************
আমাকে যখন আকাশের দিকে মি’রাজে লইয়া যাওয়া হইল, তখন আমি বলিলামঃ হে আল্লাহ! আমার পরে আলী ইবনে আবূ তালিবকে খলীফা বানাও। তখন আকাশ-জগত কম্পিত হইয়া উঠিল এবং সর্বদিক হইতে ফেরেশতাগণ অদৃশ্য ধ্বনি করিয়া উঠিলেনঃ হে মুহাম্মদ! আল্লাহর এই আয়াত পাঠ কর, (যাহার অর্থ) তোমরা কিছু চাহিতে পারিবে না, আল্লাহ যাহা চাহিবেন তাহাই হইবে। আর আল্লাহ ইচ্ছা করিয়াছেন যে, তোমার পরে আবূ বকর সিদ্দীকই খলীফা হইবে।
******************************************************
বেহেশতের প্রত্যেকটি বৃক্ষের প্রত্যেকটি পত্রে লিখিত আছেঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, আবূ বকর, উমর ফারুক ও উসমান যুন্নুরাইন।
হযরত মুয়াবিয়ার প্রশংসায়ও হাদীস জাল করা হইয়াছে। যেমনঃ
******************************************************
তোমরা যখন মুয়াবিয়াকে আমার মিম্বারে দাঁড়াইয়া খুতবা দিতে দেখিবে, তখন তাঁহাকে তোমরা গ্রহণ করিও, কেননা সে বড়ই বিশ্বস্ত-আমানতদার ও সুরক্ষিত।
এইভাবে জনগণের মধ্যে ভিত্তিহীন ও নিতান্ত অমুলক অনেক কথাই রাসূলের হাদীস নামে প্রচার করা হইয়াছে। এখানে এই পর্যায়ের আরো তিনটি কথা উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
(ক)****************************************************** – জন্মভূমির প্রেম ঈমানের অংশ।
(খ)******************************************************- হে মুহাম্মদ! তোমাকে যদি সৃষ্টি করিতে না হইত, তাহা হইলে এই আকাশমণ্ডল ও জগতই সৃষ্টি করিতাম না’।
(গ)******************************************************- আলী ইবনে আবূ তালিবের জন্য অস্তমি সূর্যকে পুনরুত্থিত করা হয়।
[আহমদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ ******************** এই হাদীসের কোন ভিত্তি নাই। ইবনে জাওজী দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ ******************** “ইহা হাদীস নয়, রচিত কথা। অবশ্য ইমাম সয়ূতী ও তাহাভী সহীহ বলিয়া দাবি করিয়াছেন। ********************]
এই তিনটি কথাই হাদীসরূপে সমাজে প্রচারিত হইয়াছে এবং ওয়াজকারীদের মুখে মুখে ব্যাপক প্রচার লাভ করিয়াছে। কিন্তু প্রকৃতপকেষ এই তিনটি কথাই সম্পূর্ণ মিথ্যা- জাল।
খাওয়ারিজগণ প্রথমত নিজেদের গরজে হাদীস জাল করিতে শুরু করিলেও ইহা বেশী দূর চলিতে পারে নাই। খাওয়ারিজদের নিজস্ব আকীদা বিশ্বাসই তাহাদিগকে এই পথে বেশী দূর অগ্রসর হইতে দেয় নাই।
১. খাওয়ারিজদের আকীদা ছিলঃ যে লোক মিথ্যাবাদী যে কাফির! ফলে তাহাদের মধ্যে মিথ্যা কথা ও হাদীস জালকরণের প্রবণতা আপনা হইতেই খতম হইয়া যায়।
২. খাওয়ারিজগণ ছিল বেদুঈন, স্বভাবত কঠোর ও রূঢ় প্রকৃতির। তাহারা অন্যান্য জাতি বা গোত্রের কোন কথা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত ছিল না। এই কারণে পারস্যবাসী ও ইয়াহুদীদের- যাহারা প্রধানত শিয়া মত গ্রহণ করিয়াছিল ও জাল হাদীস রচনা করিয়াছিল- কোন কথাই তাহাদের নিকট কোন গুরুত্ব লাভ করিতে পারে নাই।
৩. খাওয়ারিজগণ প্রতিপক্ষের সহিত লড়াই করার ব্যাপারে তাহাদের নিজেদের বীরত্ব, শক্তি-সামথ্য ও অস্ত্রশসস্ত্রের উপর অধিক নির্ভরশীল ছিল। এইজন্য তাহারা মিথ্যা কথার আশ্রয় ******************** লইতে কখনো প্রস্তুত হয় নাই। আর প্রতিপক্ষকে তাহারা কাফির মনে করিত বলিয়া মিথ্যার আশ্রয় লওয়ার কোন প্রয়েঅজন বোধ করে নাই। কেননা কাফিরদিগকে দমন করার জন্য তরবারির ব্যবহার ভিন্ন অন্য কোন হাতিয়ার ব্যবহার করা যায় বলিয়া তাহারা মনেই করিত না।
এই তিনটি কারণেই অন্যান্য ফাসাদ ও বিপর্যয়কারী উপদল অপেক্ষা খাওয়ারিজ দের দ্বারা খুব কম সংখ্যকই জাল হাদীস রচিত হইয়াছে। আর যে দুই চারটি হাদীস তাহারা জাল করিয়াছে, ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ মুসলিম সমাজ তাহা সহজেই চিনিতে ও উহা প্রত্যাহার করিতে সমর্থ হইয়াছে। ফলে এই পর্যায়ে হাদীস জালকরণের কাজ যতটুকুই হইয়াছে তাহা তেমন কোন বিপদের কারণ হইয়া দেখা দেয় নাই।
কিন্তু পরবর্তীকালে শিয়া সম্প্রদায়ের রচিত হাদীসসমূহ মুসলিম সমাজে মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব করে। অবশ্য আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহ এই পর্যায়ে মুসলিমদের ঈমান ও দ্বীন রক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করিয়া দেয়। খাওয়ারিজ, শিয়া ও তাহাদের মত অন্যান্য ভ্রান্ত ও অসৎ প্রকৃতির দল-উপদল ছিল একদিকে- ইসলামের মূলোৎপাটনে আত্ম নিয়োজিত; কিন্তু ইহার বিপরীত দিকে অচলায়তন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল সুসংবদ্ধ মুসলিম সমাজ ও ইসলামী জনতা। তাহাদিগকে খাওয়ারিজ ও শিয়াদের ভ্রান্ত মতবাদ ও অমূলক প্রচারণা কিছুমাত্র প্রভাবান্বিত করিতে পারে নাই। বরং তারা অত্যন্ত দৃঢ়তাসহকারে কুরআন ও সহীহ হাদীসকে আঁকাড়াইয়া ধরিয়া থাকে। সেই সঙ্গে তারা বিশুদ্ধ ও সহীহ হাদীসসমূহের ব্যাপক শিক্ষা দান ও প্রচারে নিযুক্ত হন। এই সময় পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক সাহাবী বাচিঁয়াছিলেন, তাঁহাদের সঙ্গে ছিল উহাদেরই সর্বপ্রযত্নে তৈরী করা ইসলামী জ্ঞানে দীক্ষিত তাবেয়ীনের এক বিরাট জামা’আত। তারা সকলেই সমবেতভাবে হাদীস জালকরণের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিয়াছেন, ইসলামের স্বচ্ছ বিধানে গোলক ধাঁধা সৃষ্টির সকল ষড়যন্ত্রের জাল তারা ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দেন এবং মিথ্যাবাদীদের মিথ্যাকে একটি একটি করিয়া জনসমক্ষে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়া ধরেন।
এই সময় মুসলিম সমাজ ‘হাদীস’ নামে কোন কথা গ্রহণের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন হইয়া উঠে। কেবলমাত্র বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হইলেই কোন কথাকে হাদীস বলিয়া গ্রহণ করিতে তারা আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। বরং তারা উহার সনদ সূত্রকে যাচাই করিতে শুরু করেন, উহাতে উল্লিখিত প্রত্যেকটি ব্যক্তি চরিত্র, তাকওয়া, ইলম, স্মরণশক্তি ও বর্ণনাকারীদের পারস্পরিক সাক্ষাৎ সম্পর্কে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে খোঁজ-খবর লইতে শুর করেন।
ইমাম মুসলিম সহীহ মুসলিমের ভূমিকায়
[১১ পৃষ্ঠা] ইবনে সিরিন তাবেয়ীর এই উক্তিটি উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ
******************************************************
মুসলমানগণ পূর্বে হাদীসের সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন না, কিন্তু পরে যখন ফিতনা ও বিপর্যয় দেখা দেয়, তখন তারা বলিতে শুরু করেনঃ বর্ণনাকারীদের নাম বল, তাহাদের মধ্যে যাহারা আহলে সুন্নাত, তাহাদের নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করা হইবে; আর যাহারা বিদয়াতপন্হী, তাহাদের বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যান করা হইবে।
এইভাবে তাবেয়ী মুহাদ্দিসগণ সাহাবীদের নিকট হাদীস বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন। ভাল-মন্দের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য করা ও অন্ধভাবে সব কথা গ্রহণ না করাই ছিল এই জিজ্ঞাসাবাদের মূল উদ্দেশ্য।
এই সময় গোটা মুসলিম সমাজ হাদীসের ব্যাপরে অত্যন্ত কঠিন ও অনমনীয় হইয়া উঠে। মিথ্যা কথা প্রচারকারী লোক হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে মসজিদে সাহাবীদের নিকট আসিয়া বসিত, তখন সাহাবিগণ তাহাদিগকে কঠোর ভাষায় ভৎসনা করিতেন ও মসজিদ হইতে বিতাড়িত করিয়া দিতেন। অনেক সময় এই ধরনের লোকদিগকে তাড়াইবার জন্য পুলিশের সাহায্যও গ্রহণ করা হইত।
একবার একজন কিসসা-কাহিনী বর্ণনাকারী ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর নিকটে আসিয়া বসে। তিনি তখন তাহাকে সেখান হইতে উঠিয়া যাইতে বলেন। কিন্তু সে উঠিয়া যাইতে অস্বীকার করে। তখন হযরত ইবনে উমর (রা) পুলিশ ডাকিয়াপাঠান ও তাহার সাহায্যে তাহাকে বিতাড়িত করেন।
এই ধরনের অনেক ঘটনারই উল্লেখ পাওয়া যায় হাদীসের কিতাবসমূহে। তাহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবী ও তাবেয়ীনের যুগে হাদীস জালকারী ব্যক্তিগণ সাধারণ্যে পরিচিত ও চিহ্নিত ছিল। তারা ইহাদের শয়তানী তৎপরতা ধরিয়া ফেলিতেন, ফলে জনসাধারণ তাহাদের বিভ্রান্তির জালে কখনোই জড়াইয়া পড়িতে পরিত না।
এই সময়কার হাদীসবিদগণ কেবল মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালকারীদের ষড়যন্ত্র জাল ছিন্ন করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই; বরং এই গ্রন্হের পূর্ববর্তী আলোচনা প্রমাণ করে যে, এই সময় অপর দিকে তারা সহীহ হাদীসসমূহ নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংগ্রহ ও সংকলনের কাজেও পূর্ণরূপে আত্মানিয়োগ করিয়াছিলেন।
[********************]
শুধু তাহাই নয়, এই সময় হাদীস সমালোচনা করা এবং যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া প্রত্যেকটি হাদীস গ্রহণের জন্য স্থায়ী মানদণ্ডও নির্ধারিত হয়। ইহার ফলেই হাদীস সমালোচনা-বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়।
উপরে যে হাদীস জালকরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে, উহারই প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এক স্বতন্ত্র হাদীস-বিজ্ঞান রচিত হয়। উহাকে (******************************************************
) –‘হাদীস জালকারণ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা’ বলা হয়। এই জ্ঞানের সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে নওয়াব সিদ্দীক হাসান লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
হাদীস জালকরণ সম্পর্কিত ইলম এমন এক প্রকারের বিজ্ঞান, যাহা দ্বারা কোন হাদীসটি জাল এবং কোনটি প্রমাণিত-প্রতিষ্ঠিত তাহা জানিতে ও চিনিতে পারা যায় এবং উহা দ্বারা জালকারীর অবস্থাও জানা যায় যে, সে উহা সত্য বলিয়াছে, না মিথ্যা। এই বিশেষ জ্ঞানের উদ্দেশ্য হইতেছে সত্য ও মিথ্যা হাদীস এবং সত্য বর্ণনাকারী ও মিথ্যা বর্ণনাকারীর মধ্যস্থিত পার্থক্য বুঝিবার প্রতিভা ও যোগ্যতা অর্জন। এই জ্ঞানের লক্ষ্য ও ফায়দা এই যে, ইহার সাহায্যে এই ধরনের মিথ্যা ও জাল হাদীস হইতে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হয়। অথবা হাদীসটি বর্ণনা করার সঙ্গে সঙ্গে উহা যে জাল তাহাও বলিয়া দেওয়া সম্ভব হয়। হাদীসের ক্ষেত্রে ইহা অত্যন্ত জরুরী ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান। কেননা নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি আমার প্রতি কোন মিথ্যা কথা আরোপ করে, যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়।
[********************]
এইরূপ জ্ঞানের উৎপত্তি হওয়ার ফলে সকল প্রকার জাল হাদীস হএত মুসলিম সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হইয়াছে। এই পর্যায়ে হাদীসজ্ঞান সম্পর্কে পারদর্শী মনীষিগণ অভাবিতপূর্ব ও অতি প্রয়োজনীয় এবং বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় দান করিয়াছেন। মনীষিগণ এমন অনেক নীতিগত (theoritical) নিয়ম-নীতি রচনা করিয়া দিয়াছেন, যাহার সাহায্যে মওজু বা জাল হাদীস অতি সহজেই চিনিতে পারা যায়। এইজন্যই তারা কতকগুলি লক্ষণ ও চিহ্নিত করিয়া দিয়াছেন। সেই সব লক্ষণ যে সব হাদসে পরিলক্ষিত হইবে, সে সবের জাল হওয়া সম্পকে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকিবে না।
আর দ্বিতীয়পন্হা হইতেছে practical- ব্যবহারিক ও বাস্তবঃ এই পর্যায়ে তারা হাদীস জালকরণে অভ্যস্ত লোকদের বিস্তারিত পরিচয় জনসমক্ষে পেশ করিয়া দিয়াছেন। জনগণের সহিত তাহাদিগকে সবিস্তারে পরিচিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং তাহাদের মনগড়াভাবে রচিত ও মিথ্যা-মিথ্যি প্রচারিত ‘হাদীসসমূহ’ও সকলের সম্মুখে উপস্থাপিত করা হইয়াছে।
মনীষিগণ এই পর্যায়ে বহুসংখ্যক মূল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। এই গ্রন্হাবলী ‘কিতাবুল মওজুয়াত’ নামেই পরিচিত। একদিকে যেমন রাসূলে করীম (ﷺ)-এর প্রকৃত হাদীসসমূহ সহীহ, জামে, সুনান ও মুসনাদ প্রভৃতি ধরনের হাদীস গ্রন্হাবলীতে সন্নিবদ্ধ ও সুসংকলিত হইয়াছে, অপরদিকে তেমনি মিথ্যা ও রচিত হাদীসসমূহ হাদীসবিদ আলিমের নিকট স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। ফলে প্রকৃত হাদীস ও উহার মর্যাদা জানিয়া লওয়া উহা ‘সহীহ’ কিংবা ‘হাসান’ বা যয়ীফ কিংবা মওজু তাহা চিনিতে পারা খুবই সহজ হইয়া পড়িয়াছে। হাদীস-বিজ্ঞানীদের এই অবদান ইসলামী জ্ঞান-চর্চার ইতিহাসে চির উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।
পূর্বেই বলিয়াছি জাল হাদীস চিনিয়া লইবার জন্য মনীষিগণ এমন সব নিয়ম নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, যাহা বাস্তবিকই অব্যর্থ ও সর্বতোভাবে নির্ভরযোগ্য। কেননা হাদীস সমালোচনা ও যাচাই পরীক্ষা করার সুদৃঢ় ও তীক্ষ্ণ জ্ঞান এবং প্রতিভা তাঁহাদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিল। এখানে আমরা কয়েকটি নিয়মের উল্লেখ করিতেছিঃ
১. জাল হাদীস বর্ণনাকারীর মধ্যে এমন লক্ষণ দেখা যায়, যাহার ভিত্তিতে সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, বর্ণনাকারী সম্পূর্ণ মিথ্যঅ কথা রচনা করিয়া রাসূলের হাদীস হিসাবে চালাইয়া দিয়াছে।
এখানে দুইটি জাল হাদীসের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিয়া কথাটিকে স্পষ্ট করিয়া তুলিতে চেষ্টা করা যাইতেছেঃ
(ক) সাইন ইবনে উমর তামামী বলেন, আমি সায়াদ ইবনে জরীফের নিকট উপস্থিত ছিলাম। এই সময় তাহার পুত্র একখানি কিতাব হাতে লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা করিলঃ তোমার কি হইয়াছে? পুত্র বলিলঃ আমাকে শিক্ষক মারিয়াছেন। তখন সে বলিলঃ ‘আমি আজ তাহাকে নিশ্চয়ই লজ্জিত করিব’। ইবনে আব্বাস হইতে ইকরামা রাসূলের এই কথাটি বর্ণনা করিয়াছেনঃ
******************************************************
তোমাদের বালকদের শিক্ষকগণ তোমাদের মধ্যে অধিক দুষ্ট লোক, ইয়াতীম ছেলেদের প্রতি তাহারা খুবই কম দয়াশীল এবং মিসকীনের প্রতি অন্যন্ত কঠোর।
(খ) মা’মুন ইবনে আহমদ আল হারাভীকে লক্ষ্য করিয়া একজন বলিলঃ শাফেয়ী ও তাঁহার খুরাসানী অনুসরণকারীদের সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? নবী করীম (ﷺ) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
******************************************************
‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি হইবে, যাহার নাম হইবে মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস। সে আমার উম্মতের পক্ষে ইবলীস হইতেও ক্ষতিকর। আমার উম্মতের মধ্যে আর এক ব্যক্তি হইবে, যাহার নাম আবূ হানীফা, সে আমার উম্মতের জন্য প্রদীপস্বরূপ।
এই হাদীস দুইটির বর্ণনাকারী যে স্বার্থ ও হিংসা-প্রণোদিত হইয়া রাসূলের নামে মিথ্যা কথাকে হাদীস বলিয়াচালাইয়া দিয়াছে তাহা বুঝিতে একটুও কষ্ট হয় না।
২. বর্ণিত হাদীসের মধ্যে এমন লক্ষণ পাওয়া যায়, যাহা হাদীসটির জাল হওয়ার কথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। যেমন হাদীসের মূল কথায় এমন কোন শব্দের উল্লেখ থাকা, যাহার অর্থ অত্যন্ত হাস্যকর কিংবা শব্দ ও অর্থ উভয়ই বাচালতাপূর্ণ। কেবল শব্দটি যদি হাস্যকর হয় তাহা হইলেই হাদীসটি জাল হইবে এমন কথা সাধারণভাবে বলা যায় না। কেননা হাদীসটি হয়ত মূল অর্থের দিক দিয়া সহীহ, কিন্তু উহার কোন পরবর্তী বর্ণনাকারী শব্দে কিছুটা পরিবর্তন সূচিত করিয়া নিজের ইচ্ছামত কোন শব্দ বসাইয়া দিয়াছে। অথচ মূলতঃ হাদীসটি রাসূলে করীম (ﷺ) হইতে বর্ণিত। তবে বর্ণনাকারী যদি এই দাবি করেন যে, হাদীসের ভাষা ও শব্দসমূহ সবই রাসূলে করীম (ﷺ) হইতে বর্ণিত, তাহা হইলে তাহাকে মিথ্যাবাদী না বলিয়া উপায় নাই। কেননা, নবী করীম (ﷺ) ছিলেন আরবদের মধ্যে অত্যন্ত শুদ্ধ ও মিষ্টভাষী। এইরূপ অবস্থায় হাদীসের একটি শব্দও যদি হাস্যকর বা হালকা ধরনের হয় তাহা অবশ্যই জাল এবং মিথ্যা হইবে।
[********************]
হাস্যকর অর্থ সম্বলিত একটি জাল হাদীস এইরূপঃ
******************************************************
তোমরা মোরগকে গালাগালি করিও না, কেননা উহা আমার বন্ধু।
[এই গোটা হাদীসটি জাল হইলেও উহার প্রথম অংশ রাসূলেরই কথা। আবূ দাউদ উত্তম সনদে উহা উদ্ধৃত করিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ ******************** মোরগকে গাল দিও না, কেননা উহা নামাযের জন্য সজাগ করে। ********************]
ইহা নবী করীম(ﷺ)-এর কথা হইতে পারে না, তাহা কে-না বুঝিতে পারে?.
৩. হাদীস জাল হওয়ার আল একটি লক্ষণ হইতেছে উহার স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেকের বিপরীত হওয়া। হাদীস যদি স্বাভাবিক বুদ্ধি ও বিবেকের বিপরীত হয় এবং উহার গ্রহণযোগ্য কোন তাৎপর্য দান সম্ভব না হয়, অথবা উহা যদি সাধারণ অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণের বিপরীত হয়, তবে তাহাও জাল বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে। যেমন দুই বিপরীত জিনিসকে একত্র করার সংবাদ দান; কিংবা সৃষ্টি কর্তাকে অস্বীকারের কোন কথা। কেননা শরীয়াতের কোন বিধান স্বাভাবিক ও সুষ্থ বিবেকবুদ্ধির বিপরীত হইতে পারে না।
একটি জাল হাদীস এইরূপঃ
******************************************************
আল্লাহ অশ্ব সৃষ্টি করিলেন। উহাকে চালাইলেন। ফলে উহার খুব ঘাম বাহির হইল। অতঃপর উহা হইতে তিনি নিজেকে সৃষ্টি করিলেন।
কোন সুস্থ বুদ্ধির লোক-ই কি এইরূপ হাস্যকর কথা বলিতে পারে?
দ্বিতীয়টি এইরূপঃ
******************************************************
‘বাজেঞ্জান বেগুন সকল প্রকার রোগের ঔষধি’।
ইহা সম্পূর্ণ বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা। কেননা পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হইয়াছে যে, বাজেঞ্জান রোগের মাত্রা বৃদ্ধি করে ও উহাকে কঠিন করিয়া দেয়। এই হাদীসটি (?) শুনিলেই সাধারণ বুদ্ধি (common sense) বলিয়া উছে, ইহা মিথ্যা।
[********************]
৪. হাদীস যদি ক কুরআনের স্পষ্ট বিধানের কিংবা মুতাওয়াতির হাদীস বা অকাট্য ধরনের ইজমার বিপরীত হয়, তবে তাহাকে জাল বা মওজু মনে করিতে হইবে।
[********************]
এই দৃষ্টিতেই যেসব হাদীসে দুনিয়ার অবশিষ্ট আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হইয়াছে সাত হাজার বৎসর, সে সবকে মিথ্যা বলিয়া ঘোষণা ক রা হইয়াছে। কেননা তাহা কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের বিপরীত। আল্লাহা তা’আলা বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হে নবী! লোকেরা তোমার নিকট জিজ্ঞাসা করে কিয়ামত কখন কায়েম হইবে। তুমি বলিয়া দাও যে, এ সম্পর্কিত জ্ঞান কেবলমাত্র আমার আল্লাহরই আয়ত্ত, তিনিই উহা উহার সঠিক সময়ে উঘাটিত করিবেন।
[********************]
হাদীসবিদ নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটিকে বাতিল ও মওজু ঘোষণা করিয়াছেন।
[********************]
******************************************************
অবৈধ সন্তান বেহেশতে প্রবেশ করিতে পারিবে না।
কেননা উহা কুরআনের নিম্নোক্ত স্পষ্ট ঘোষণার বিপরীত। আল্লাহ বলিয়াছেনঃ
******************************************************
কোন বোঝা বহনকারীই অপর কাহারো (পাপের) বোঝা বহন করিবে না।
[********************]
এইভাবে যেসব ‘হাদীস’ এই ধরনের অর্থ প্রকাশ করে যে, যাহার নাম আহমদ কি মুহাম্মদ সে কখনো দোযখে যাইবে না। কেননা এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কেবলমাত্র নাম বা উপনাম কি উপাধি কখনই দ্বীন পালনের প্রয়োজন পূর্ণ করিতে পারে না। অতএব কেবল নাম বা উপনাম উপাধির সাহায্যেই কেহ দোযখ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে না। তাহা রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হইতেছে ‘আমালুস সালেহ’- নেক আমল।
৫. যেসব হাদীসে বিপুল সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত কোন ঘটনার উল্লেখ থাকে; কিন্তু তাহা না সাহাবীদের যুগে ব্যাপক প্রচার লাভ করিতে পারিয়াছে, না অল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত অপর কেহ তাহার বর্ণনা করিয়াছে। এইরূপ হাদীস যে জাল, তাহাতে সন্দেহ নাই। এক শ্রেণীর শিয়াদের নিম্নোক্ত দাবিটিও এই পর্যায়ের জাল হাদীসঃ
******************************************************
বিদায় হজ্জ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় গদীরে খাম-এর এক লক্ষেরও অধিক সাহাবীর উপস্থিতিতে নাবী করীম (ﷺ) হযরত আলী (রা)-কে খিলাফত দান করিয়াছিলেন।
দাবি করা হইয়াছে যে, বিপুল সংখ্যক- এক লক্ষেরও অধিক সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে নবী করীম (ﷺ) হযরত আলী (রা)-কে খিলাফত দান করিয়াছিলেন; কিন্তু সাধারণভাবে সাহাবীগণ ইহার কোন গুরুত্বই দিলেন না, নবী করীমের ইন্তেকালের পরে খলীফা নির্ধারণের সময়ে এই কথা কোন সাহাবীর স্মরণই হইল না, ইহা এক অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই ইহা সম্পূর্ণ স্বকপোলকল্পিত।
৬. সাধারণ যুক্তি ও সুস্থ বিবেক-বিরোধী কোন কথা কোন হাদীসে উল্লিখিত হইলেও তাহাকে জাল মনে করিত হইবে। যেমন হাদীস বলিয়া পরিচিত একটি কথায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
******************************************************
না তুর্কিদের জুলুম ভালো, না আরবদের সুবিচার।
কেননা জোর জুলুম সাধারণভাবেই নিন্দিত, যেমন সুবিচার সকল অবস্থায়ই প্রশংসনীয়।
৭. হাদীসের বর্ণনাকারী যদি রাফেযী মতাবলম্বী হয় এবং হাদীসে যদি রাসূলের বংশের লোকদের ফযীলত বর্ণিত হয়, বুঝিতে হইবে যে তাহা জাল। কেননা রাফেযী মতের লোকেরা সাধারণতই রাসূলের বংশের লোকদের অমূলক প্রশংসায় এই ধরনের কথা রাসূলের নামে চালাইয়া দিতে এবং সাহাবীদের গালাগাল ও কুৎসা বর্ণনায় অভ্যস্ত। বিশেষতঃ তাহারা প্রথম দুই খলীফার প্রতি রীতিমত শক্রতা পোষণ করে এবং তাঁহাদিগকে খিলাফতের ব্যাপারে হযরত আলীর অধিকার হরণকারী বলিয়া মনে করে।
৮. কোন হাদীসের উল্লেখিত ঘটনা যদি বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য ও সপ্রমাণিত ইতিহাসের বিপরীত হয়, তবে বুঝিতে হইবে যে, তাহা নিঃসন্দেহে জাল। যেমন এক হাদীসে বলা হইয়াছে যে, খায়বারবাসীদের উপর হইতে জিযিয়া প্রত্যাহার করা হইয়াছিল হযরত সায়াদ ইবনে মুয়ায- এর শাহাদাতের কারণে। ইহা প্রকৃত ইতিহাসের বিপরীত কথা। কেননা হযরত সায়াদ খন্দক যুদ্ধে শহীদ হইয়াছিলেন এবং তাহা খায়বার যুদ্ধের পূর্বে অনুষ্ঠিত ঘটনা। দ্বিতীয়তঃ ‘জিযিয়া’ খায়বার যুদ্ধকালে বিধিবদ্ধও হয় নাই, বরং তাবুক যুদ্ধের পূর্বে তাহা সাহাবীদের নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিতই ছিল। তৃতীয়তঃ উহাতে বলা হইয়াছে যে, উহা মুয়াবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ান লিখিয়াছেন। অথচ মুয়াবিয়া তো মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম কবুল করিয়াছিলেন। খায়বার যুদ্ধকালে তিনি মুসলমানই ছিলেন না।
৯. কেহ যদি আল্লাহর নির্ধারিত সাধারণ আয়ূষ্কালের অধিক আয়ূ লাভের দাবি করে এবং বহু পূর্বকালে অতীত কোন ব্যক্তির সাক্ষাত লাভ করিয়াছে বলিয়া প্রচার করে, বুঝিতে হইবে যে, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যেমন রতনহিন্দীস দাবি করিয়াছে যে, নবী করীম (ﷺ)- এর সাক্ষাৎ পাইয়াছে। অথচ এই ব্যক্তি ব্যক্তি জীবিত ছিল ছয়শত হিজরী সনে। জাহেল লোকদের ধারণা এই যে, এই ব্যক্তি নবী করীমের সহিত একত্রিত হইয়াছিল, তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছে এবং রাসূল তাঁহার দীর্ঘায়ু লাভের জন্য দোয়া করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ এইরূপ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কেননা নবী করীম (ﷺ)- এর সহিত সাক্ষাৎপ্রাপ্ত সাহাবাগণের অধিকাংশই ঊনষাট হিজরী সনের পূর্বেই অন্তর্ধান করেন। তখন কেবলমাত্র হযরত আবূত-তোফাইল জীবিত ছিলেন। আর তিন যখন ইন্তেকাল করেন, তখন লোকেরা এই বলিয়া কাঁদিয়াছিলঃ
******************************************************
নবী করীমের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে ইনিই সর্বশেষ ব্যক্তি।
১০. সূফীগণ রাসূলের নিকট হইতে কোন ধারাবাহিক সনদ সূত্র ব্যতীত কাশফ বা স্বপ্নযোগে হাদীস লাভ করিয়াছেন, এইরূপ দাবিও সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। দ্বীন-ইসলামের সকল আলিমই এই সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত যে, স্বপ্ন বা কাশফ এর সূত্রে শরীয়াতের কোন সত্য প্রমাণিত হয় না। কেননা তাহা আদৌ নির্ভরযোগ্য নহে। উহা বরং শরীয়াতের মূল বিধানের উপর অমূলক বাড়াবাড়ি মাত্র। কুরআন এবং ধারাবাহিক ও বিশুদ্ধ সনদসূত্রে বর্ণিত হাদীস ব্যতীত শরীয়াতের তৃতীয় কোন ভিত্তি নাই, আছে বলিয়া কেহ মনে করিলেও তাহা মিথ্যা এবং প্রত্যাখ্যানযোগ্য।
[এই পর্যন্তকার দীর্ঘ আলোচনা গৃহীত হইয়াছে ******************** গ্রন্হের ৪৭৯-৪৮৫ পৃষ্ঠা হইতে এবং ******************** হইতে সাহায্য গ্রহণ করা হইয়াছে।]
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন