বঙ্গদেশে ইলমে হাদীস
আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ ইবনে সাইয়েদ আশরাফ মক্কী ৯০০ হিজরী হইতে ৯২৪ হিজরী পর্যন্ত বঙ্গদেশে রাজত্ব করেন। তিনি সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন করেন। শুধু তাহাই নহে, তাঁহার শাসনাধীন এলাকায় কুরআন ও হাদীস শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন করার ব্যাপারেও তাঁহার দান অবিস্মরণীয়। তিনি দূর ও নিকটবর্তী এলাকা হইতে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী লোকদিগকে তাঁহার রাজ্যে আসিবার ও এখানে বসবাস করিবার জন্য আহবান জানাইলেন। ৯০৭ হিজরী সনে (১৫০২ ইং) তিনি গৌড়স্থ গুরবায়ে শহীদ নামক স্থানে (বর্তমান মালদহ জিলার অন্তর্ভূক্ত) এখটি উন্নত ধরনের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পাণ্ডুয়াতে একটি কালেজও তিনি স্থাপন করেন। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইলমে হাদীসের শিক্ষাদান করা হইত। ৯১১ হিজরী সনে (১৫০৩ ইং) মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজদান বখশ (খাজেগীর শিরওয়ানী নামে খ্যাত) সহীহ বুখারীকে তিন খণ্ডে নকল করেন। ইহা বাকীপুরস্থ অরিয়েন্টাল লাইব্রেরীতে রক্ষিত আছে।
পূর্বেই উল্লেকিত হইয়াছে যে, মুহাদ্দিস শরফূদ্দীন আবূ তাওয়ামা বুখারী হাম্বলী (মৃঃ ৭০০ হিঃ) সপ্তম শতকে ঢাকা জিলাধীন সোনার গাঁও আগমন করেন এবং এখানে হাদীস শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে ইহা ইলমে হাদীসের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁহার ইন্তেকালের পরও কিছুদিন পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। এই সময় এতদঞ্চলে সায়াদাতের (৯০০-৯৪৫ হিঃ) রাজত্ব ছিল। পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসাবে সোনার গাঁয়ে বহু সংখ্যক হাদীস বিশারদ সমবেত হন এবং এই স্থানেও বহু লোক ইলমে হাদীস শিক্ষা করিয়া পারদর্শিতা লাভ করেন। এই যুগে এতদঞ্চলে হাদীস চর্চার এতই ব্যাপকতা ছিল যে, বহু মসজিদ ও বহু খানাকা এই উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করা হয়। প্রসিদ্ধ হাদীসবিজ্ঞ তকীউদ্দীন আইনুদ্দীন (৯২৯ হিঃ)- এর চেষ্টায় এখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন নুসরত ইবনে হুসাইন শাহ-এর রাজত্ব। কাজেই একথা বলিষ্ঠভাবেই বলা যাইতে পারে যে, সায়াদাতের শাসন আমলেই সোনার গাঁও হাদীস শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল। সম্ভবত পূর্ব বাংলার মুসলিম শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্তই উহার এই গৌরব অব্যাহত ও অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু পরবর্তী বৃটিশ শাসন আমলে সোনার গাঁওয়েল স্বর্ণকিরণ নিঃশেষে বিলীন হইয়া যায়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হইতে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক বড় বড় মাদ্রাসায় ইলমে হাদীসের উচ্চশিক্ষা দানের কাজ চালু হয়। ফলে প্রতি বৎসর যথেষ্ট সংখ্যক লোক হাদীসের শিক্ষা লাভ করিয়া দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির সহিত পরিচিত হন। যদিও শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রটির দরুন তাহারা পূর্বকালের হাদীস শিক্ষার্থীদের ন্যায় উপকৃত হইতে ও অনুরূপ পারদর্শিতা লাভ করিতে সমর্থ হন নাই।
উপমহাদেশের আযাদী উত্তর যুগে ইলমে হাদীস চর্চাও ব্যাপক প্রচারের দিকে মনীষীদের বিশেষ লক্ষ্য আরোপিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। বিশেষত ইসলামের মূল উৎস ও ভিত্তির সহিত জনগণকে পরিচিত করার উদ্দেশ্যে কিছু কিছু চেষ্টাও শুরু হইয়াছে। নূতনভাবে হাদীসগ্রন্হ সংকলন এবং উর্দূ ও বাংলা ভাষায় হাদীসের তরজমা ও ব্যাখ্যা রচনার কাজও শুরু হইয়াছে। অদূর ভবিষ্যতে ইহা ব্যাপক রূপ লাভ করিবে বলিয়া আশা করা যায়।
[ডঃ ইসহাক লিখিত Indian’s Contribution to the Study of Hadith Literatur অবলম্বনে লিখিত এবং তাহা হইতে সংগৃহীত।]
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন