উপরের পৃষ্ঠাসমূহে হাদীসের সংখ্যা ও হাদীস সংকলনের দীর্ঘ ইতিহাস সবিস্তারে আলোচিত হইয়াছে। ইতিহাসের বিভিন্ন স্তারে হাদীস সংরক্ষণ, হাদীস সংকলন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের বিরাট-মহান কর্মতৎপরতার সহিত পাঠকদের পরিচিত সংস্থাপিত হইয়াছে। পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা বিভিন্ন স্তরে রকম-বেরকমের হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নের সহিতও পরিচিত হইয়াছি। এখানে বিভিন্ন পদ্ধতি ও ধরনের হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে এক আলোচনা পেশ করা হইয়াছে।
হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নের বিভিন্ন ধরণ ও পদ্ধতি (Technique) রহিয়াছে। এই বিভিন্ন ধরনের প্রণীত গ্রন্হের নামও বিভিন্ন। যথাঃ
১. ‘আলজামে’– যেসব হাদীসগ্রন্হ আকায়েদ (বিশ্বাস) আহকাম (আদেশ-নিষেধ ও শরীয়াতের ব্যবহারিক নিয়ম), দয়া-সহানুভূতি, পানাহারের আচার, বিদেশ-সফর ও একস্থানে অবস্থান, কুরআনের তাফসীর, ইতিহাস, যুদ্ধ-সন্ধি , শক্রদের মুকাবিলায় বাহিনী প্রেরণ, ফিতনা-বিপর্যয়, প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা প্রভৃতি সকল প্রকারের হাদীস বিভিন্ন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়, এই সব গ্রন্হকে আল-জামে বলা হয়।
[********************] সিহাহ-সিত্তার মধ্যে নিম্নোক্ত গ্রন্হদ্বয় এই পর্যায়ে গণ্যঃ
(ক) আল-জামেউস সহীহুল বুখারী এবং (খ) আল-জামেউত তিরমিযী। সহীহ মুসলিম এই পর্যায়ে গণ নয়। কেননা উহাতে তাফসীল ও কিরাত সংক্রান্ত হাদীস সন্নিবেশিত হয় নাই।২
[********************]
২. ‘আল-মুসনাদ’ (********************)- যে সব গ্রন্হে সাহাবীদের হইতে বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁহাদের নামের আক্ষরিক ক্রমিকতার ভিত্তিতে পর পর সংকলিত হয়; কিন্তু ফিকাহর প্রণয়ন পদ্ধতিতে সজ্জিত করা হয় না, সেই সব গ্রন্হ ‘আল-মুসনাদ’ বা ‘আল-মাসানীদ’ নামে পরিচিত। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের বর্ণিত সমস্ত হাদীস উহার বিষয়বস্তু নির্বিশেষে একত্রে লিপিবদ্ধ করা, তাঁহার পর অপর এক সাহাবীর বর্ণিত হাদীস একস্থানে একত্রিত করা।
ইহার সংকলন দুইভাবে হইতে পারেঃ আক্ষরিক ক্রমিকতা সহাকারে, যেমন প্রথমে হযরত আবূ বকরের বর্ণিত হাদীস, তাঁহার পর হযরত উসামা ইবনে যায়দ বর্ণিত হাদীস।
অথবা বর্ণনাকারী সাহাবীর পদমর্যাদার বা বংশ ম র্যঅদার ভিত্তিতেও হাদীসসমূহ সজ্জিত হইতে পারে। যেমন প্রথমে ক্রমিক ধারায় খুলাফায়ে রাশেদুন বর্ণিত হাদীসসমূহ, তাঁহাদের পরে অন্যান্য সাহাবীদের হাদীসসমূহ উল্লেখ করা।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল সংকলিত হাদীস গ্রন্হ এই পদ্ধতিতেই সজ্জিত বলিয়া উহাকে ‘আল-মুসনাদ’ বলা হয়।
৩. আস সুনান (********************)-যেসব হাদীস গ্রন্হে কেবলমাত্র শরীয়াতের হুকুম আহকাম এবং ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি ও আদেশ-নিষেধমূলক হাদীস একত্র করা হ য়, আর ফিকাহর কিতাবের অনুরূফ বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে সজ্জিত হয়, তাহাই ‘সুনান’ নামে পরিচিত। যেমন সুনানে আবূ দাঊদ, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ। তরমিযী শরীফও এক হিসাবে ‘সুনান’ পর্যায়ভুক্ত।
৪. ‘আল-মু’জিম’ (********************)-যেসব হাদীস গ্রন্হে মুসনাদ পদ্ধতিতে এক একজন হাদীসের উস্তাদের নিকট হইতে প্রাপ্ত হাদীস পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়, তাহা আল-মু’জিম গ্রন্হ। যেমন তাবারানী সংকলিত তিনখানি গ্রন্হ।
৫. ‘আল-জুয’ (********************)-যেসব হাদীসগ্রন্হে একজন বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইবে, সেই ব্যক্তি সাহাবীই হউক, কি তাঁহার পরবর্তী কোন উস্তাদের হাদীস। যেমনঃ ****************************************************** ।
[********************]
কিন্তু অপর কতিপয় হাদীস-বিজ্ঞানীর মতে ইহাকে ভ্রৎপ্ট বরা বলা হয় না, বলা হয় ‘আল-মুফরাদ’। তাঁহারেদ মতে ******************** বলা হয় এমন সব গ্রন্হকে যাহাতে একই বিষয় সংক্রান্ত হাদীসসমূহ একত্রিত করা হয়। যেমনঃ ইমাম বুখারীকৃত ******************** ও ******************** ।
[********************]
৬. ‘আল-গরীবা’ (********************)-হাদীসের কোন উস্তাদ যদি তাঁহার বহু সংখ্যক ছাত্রের মধ্য হইতে মাত্র একজনকে বিশেষ কিছু হাদীস লখাইয়া দেন এবং অপর কাহাকেও তাহা না দেন, তবে এইসব হাদীসের সংকলনকে ‘আল-গরীবা’ বলা হইবে।
[********************]
৭. আল মুস্তাখরাজাত (********************)- যে কিতাবে উল্লিখিত হাদীসসমূহ (কিংবা উহার অংশ বিশেষ) সংকলিত হয় এবং উহার ‘মতন’ মূল হাদীস ও নিজস্ব সনদ উল্লিখিত হয়, তাহাকে আল-মুস্তাখরাজ বলা হয়। এইরূপ বহু গ্রন্হ বিরচিত হইয়াছে। সহীহ বুখারীর হাদীসসমূ এইভাবে ও এই পদ্ধতিতে অনেকেই আলাদা আলাদা গ্রন্হে সংকলিত করিয়াছেন। তন্মধ্যে ইসমাঈলী, বরকানী, ইবনে আহমদ আল-গাতরিফী, আবূ আবদুল্লাহ ইবনে আবূ যাহল ও আবূ বকর ইবনে মুরদুইয়া প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
[********************] অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমের হাদীসসমূহকেও সংকলন করা হইয়াছে। যাঁহারা করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে হাফেজ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-ইসফারায়েনী, আবূ জা’ফর ইবনে হামদান, আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে রাজা নিশাপুরী, আবূ বকর আল-জাওকী, আবূ হামেদ শায়েকী, আবুল অলীদ হাসান ইবনে মুহাম্মদ আল কারাশী প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ প্রধাণ।
আর আবূ নয়ীম ইসফাহানী, আবূ আবদুল্লাহ ইবনুল আহজাম, আবূ যার আল-হারভী, আবূ মুহাম্মদ আল-খালাল প্রমুক মুহাদ্দিসগণ বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হের হাদীসসমূহকে একত্রে সংকলন করিয়াছেন।
তবে উপরে যে হাফেজ ইয়াকুবের ‘আল-মুস্তাখরাজ’ গ্রন্হের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহা যেমন সম্পূর্ণ, তেমনি বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। ইহা জার্মানীর গ্রন্হাগারে এই সেদিন পর্যন্তও মজুদ ছিল।
[********************]
৮. ‘আল-মুস্তাদরাক’ (********************)।যেসব হাদীস বিশেষ কোন হাদীস গ্রন্হে শামিল করা হয় নাই অথচ তাহা সেই গ্রন্হাকারের অনুসৃত শর্তে পূর্ণমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়, তাহা যে গ্রন্হে একত্র করা হয়, তাহাকে ‘আল-মুস্তাদরাক’ বলা হয়। যেমন ইমাম হাফেজ সংকলিত ‘আল-মুস্তাদরাক’
[********************]
ইমাম হাকেম বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিয়া স্বতন্ত্র দুই খণ্ডবিশিষ্ট গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। তাঁহার বিশ্বাস বা ধারণা এই যে, এই সমস্ত হাদীসই ইমাম বুখারীর হাদীস গ্রহণের শর্তে পূর্ণামাত্রায় উত্তীর্ণ এবং সহীহ কিন্তু বুখারী শরীফে তাহা করা হয় নাই। যদিও হাদীস-বিজ্ঞানীদের মতে ইহাতে বহু যয়ীফ ও মনগড়া (********************) হাদীসও রহিয়াছে।
[********************]
এতদ্ব্যতীত বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হকারের শর্তের ভিত্তিতে হাদীস সংগ্রহ করিয়া আর একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন হাফেজ আবূ যায় আবদ ইবনে হুমাইদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (মৃঃ ৪৩৩ হিঃ)।
[********************]
৯. ‘কিতাবুল-ইলাল’ (********************)।দোষমুক্ত হাদীসসমূহ এক গ্রন্হে সংকলিত করা হইল ও সেই সঙ্গে হাদীসসমূহের দোষ বা ক্রটিও বর্ণনা করা হইলে উহাকে ‘কিতাবুল-ইলাল’ বলা হয়। ইমাম মুসলিম (র) ও ইমাম হাফেজ আবূ ইয়াহইয়া(র) এই ধরণের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইমাম যাহবী উল্লেখ করিয়াছেন যে, মুহাদ্দিস শাজীও এই পর্যায়ে এক গুরুত্বপূর্ণূ কিতাব রচনা করিয়াছেন।
[********************]
১০. ‘কিতাবুল আতরাফ’ (********************)-হাদীসসমূহের এমন কোন অংশের উল্লেখ করা, যাহা হইতে অবশিষ্ট অংশও বুঝা যায়। এইরূপ গ্রন্হকে ‘কিতাবুল আতরাফ’ বলা হয়। ইহাতে হাদীসের সনদ সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হয়। এই পর্যায়েও বহু সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করা হইয়াছে। তন্মধ্যে পরবর্তী পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত গ্রন্হদ্বয় উল্লেখযোগ্যঃ
১. ‘আল-আশরাফ আলিা তুহফাতিল আতরাফ’।
২. তুহফাতুল আশরাফ বি-মা’রিফাতিল আতরাফ।
[********************]
ইসলামী শরীয়াতের নিয়ম-বিধান ও ইসলামের আদেশ-নিষেধ সবিস্তারে জানিবার একমাত্র উপায় হইতেছে রাসূলের হাদীস। আর রাসূলের হাদীস জানিবারও একমাত্র উপায় হইতেছে রাসূল হইতে শুরু হওয়া বর্ণনাসমূহ যাচাই-বাছাই করা- তাহা স্বয়ং রাসূল হইতে সূচিত কিংবা কোন সাহাবী বা কোন তাবেয়ী হইতে সূচিত হউক না কেন। তবে বর্ণনা ধারার বিশুদ্ধতা, নির্ভূলতা ও অকাট্যতার প্রতি পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি অবশ্যই রাখিতে হইবে। আর রাসূলের হাদীসসমূহের বর্ণনা ধারা অনুসন্ধান করা এবং সে সবের যাচাই-বাছাই করার ও বর্তমানকালে সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহ পর্যালোচনা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় থাকিতে পারে না। কেননা বর্তমনা কালে রাসূলের এমন কোন হাদীসের সন্ধান লাভ ও উহার সনদ সুরক্ষিত ও নির্ভরযোগ্যভাবে পাওয়া= যাহা ইতিপূর্বৈ কোন হাদীষ গ্রন্হেই সংকলিত হয় নাই- একেবারে অসম্ভব ব্যাপার।
[********************]
অতঃপর সকল প্রকার হাদীস এবং সে সবের সনদ লাভ করার জন্য একালের সমস্ত মানুষকেই কেবলমাত্র সংকলিত ও সুরক্ষিত হাদীস গ্রন্হসমূহেরই আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে, একান্তভাবে উহারই উপর নির্ভর করিতে হইবে। আর এইজন্য। হাদীসগ্রন্হসমূহ সম্পর্কে আমাদিগকে বিস্তারিত ও সম্যক ধারনা হাসিল করিতে হইবে। জানিতে হইবে সে সবের শ্রেণী, স্থান ও মর্যাদা।
হাদীস গ্রন্হসমূহ প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধতার দিক দিয়া চারটি শ্রেণীতে পর্যায়িত। কেননা হাদীসসমূহই বিভিন্ন পর্যায়ের। সর্বোচ্চ পর্যায়ের হইতেছে সেই সব হাদীস, যাহা বর্ণনা পরম্পরায় পূর্ণ ধারাবাহিকতা সহকারে বর্ণিত (********************) এবং যাহা কবুল করা ও তদানুযায়ী আমল করার ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মত সম্পূর্ণ একমত।
অতঃপর সেই সব হাদীস, যাহা বিভিন্ন সূত্র হইতে বর্ণিত ও প্রাপ্ত, যাহাতে কোন প্রকার সন্দেহ বা সংশয়ের স্পর্শ পর্যন্ত লাগে নাই এবং যাহাকে ভিত্তি করিয়া সমগ্র ফিকাহবিদ আমল করিয়াছেন। অন্তত মক্কা-মদীনার হাদীসবিদগণ যেসব হাদীস সম্পর্কে কোনরূপ মতভেদ প্রকাশ করেন নাই। কেননা এই স্থানদ্বয় খুলাফায়ে রাশেদুনের জীবন যাপন ও কর্মকেন্দ্র, হাদীসের সকল দেশীয় আলিমগণের ইহা মিলনকেন্দ্র- সব সময়ই তাঁহাদের যাতায়াত রিহয়াছে, এক শ্রেণীর পর পরবর্তী শ্রেণীর মুহাদ্দিসদের অবিচ্ছিন্ন যাতায়াত রহিয়াছে এই কেন্দ্রদ্বয়ে। এই কারণে হাদীসে কোন প্রকার বাহ্যিক দোষ বা ভূল রহিয়াছে বলিয়া কিছুতেই ধারণা করা যায় না। আর সেই হাদীস বিরাট মুসলিম জাহানে প্রখ্যাত ও অনুসৃত হইয়া রহিয়াছে সব সময়ই এবং সাহাবী ও তাবেয়ী পর্যায়েল বিপুল সংখ্যক লোক হইতে তাহা বর্ণিতও হইয়াছে।
ইহার পর হইতেছে সেই সব হাদীসের স্থান, যাহা বিশুদ্ধ প্রমাণিত, যাহার সনদ উত্তম-নির্দোষ, হাদীসবিদগণ সেই সব হাদীস সম্পর্কে এই সাক্ষ্যই দিয়াছেন। উহা পরিত্যক্তও হয় নাই। বরং উহা গ্রন্হে সংকলিত হওয়ার পূর্ব ও পরে সব সময়ই কার্যত অনুসৃত হইয়াছে। হাদীসের ইমামগণ পূর্ব হইতেই উহার বর্ণনা শুরু করিয়াছেন। ফিকাহবিদগণ উহার ভিত্তিতে ফিকাহ রচনা করিয়াছেন, উহার উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করিয়াছেন।
যেসব হাদীস গ্রন্হ এই দুই ধরণের গুণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হইবে, তাহা প্রথম পর্যায়ের গ্রন্হ। এইভাবেই পর পর হাদীষ গ্রন্হসমূহের মর্যাদা নির্ধারিত হইবে।
এই দৃষ্টিতে হাদীস গ্রন্হসমূহ যাচাই-পরীক্ষা করিয়া দেখিলে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত হাদীস গ্রন্হের মধ্যে মাত্র তিনখানি কিতাব এই পর্যায়ে গণ্য হইতে পারে। তাহা যথাক্রমে এইঃ (ক) মুয়াত্তা ইমাম মালিক (খ) সহীহ বুখারী ও (গ) সহীহ মুসলিম।
[এই সমস্ত কথাই ******************** হইতে গৃহীত।]
এই গ্রন্হত্রয়ে উদ্ধৃত হাদীসসমূহে দুই-তৃতীয়াংশ বর্ণনাকারী (********************) প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত। এই হাদীসসমূহ আইন ও ব্যবহারিক বিষয়াদির সহিত সম্পর্কশীল। আর এক-তৃতীয়াংশ হাদীস হইতেছে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত। চতুর্থ পর্যায়ের কোন বর্ণনাকারীর বর্ণিত কোন হাদীসই এই গ্রন্হত্রয়ে স্থান পায় নাই। সর্বাধিক বিশুদ্ধ, ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন সনদ সম্বলিত হাদীস এ গ্রন্হত্রয়েই সন্নিবেশিত হইয়াছে। মুসলিম জাহানের আলিমগণ এই গ্রন্হত্রয়ের প্রতি যত বেশী ঔৎসুক্য ও শ্রদ্ধা-ভক্তি পোষণ করেন, তত আর কোন গ্রন্হের প্রতিই নহে।
[********************]
এই পর্যায়ে এমন সব গ্রন্হ গণ্য যাহা উপরোল্লিখিত গুণ-বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া মুয়াত্তা ও বুখারীর মুসলিমের সমমর্যাদার নহে। কিন্তু উহার কাছাকাছি নিশ্চয়ই। সে সবের গ্রন্হকারগণ নির্ভরযোগ্য অকাট্যতা, বিশ্বাস-পরায়ণতা, স্মরণশক্তি ও যথাযথভাবে হাদীস বর্ণনা করা এবং হাদীস-বিজ্ঞান সম্পর্কিত সকল সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম জ্ঞানে পূর্ণ পারদর্শিতার দিক দিয়া বিশেষ খ্যাত। তাঁহপাদের গ্রন্হাবলীতে তারাপ এক বিন্দু উপেক্ষা বা গাফলতির প্রশ্রয় দেন নাই। হাদীস গ্রহণের জন্য যে শর্ত তারা নিজেরা নির্ধারণ করিয়াছিলেন, প্রত্যেকটি হাদীসকে উহারই সূক্ষ্ম নিক্তিতে ওজন করিয়া করিয়া গ্রহণ ও গ্রন্হাবদ্ধ করিয়াছেন। অতঃপর প্রত্যেক পর্যায়ের মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদগণ উহার যথাযথ গুরুত্ব স্বীকার করিয়াছেন এবং মুসলিম জনগণের মধ্যে উহা ব্যাপক প্রচারও লাভ করিয়াছেন। আলিমগণ উহাদের ব্যাখ্যা করিয়া গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।
এই পর্যায়ে সুনানে আবূ দাঊদ, জামে তিরমিযী ও সুনানে নাসায়ী- এই গ্রন্হত্রয় গণ্য। ইমাম রুজাইন তাঁহার ‘তাজরিদুস সিহাহ’ এবং ইমাম ইবনুল আমীর তাঁহার ‘জামেউল উসূল’ গ্রন্হে এই হাদীসসমূহ সংকলন করিয়াছেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল সংকলিত ‘মুসনাদ’ গ্রন্হও এই পর্যায়ে গণ্য বলিয়া মহাদ্দিসগণ উল্লেখ করিয়াছেন।
[********************]
প্রথমোক্ত তিনখানি গ্রন্হে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস হইতেছে প্রায় অর্ধেক। অবশিষ্ট অর্ধেকের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ হইতেছে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের লোকদের বর্ণিত হাদীস। আর এক-তৃতীয়াংশ হইতেছে চতুর্থ পর্যায়েল বর্ণনাকারীদের বর্ণিত। অবশিষ্ট কিতাবসমূহে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস অর্ধেকেরও বেশী।
তৃতীয় পর্যায়ের হাদীসের সেইসব গ্রন্হ গণ্য, যাহা বুখারী মুসলিম সংকলিত হওয়ার পূর্বৈ, সমকালে ও পরবর্তী সময়ে গ্রন্হাবদ্ধ হইয়াছে। ইহাতে সহীহ, হাসান, যয়ীফ প্রভৃতি সকল প্রকারের হাদীসই সন্নিবেশিত হইয়াছে। এইসব হাদীস যদিও একেবারে অপরিচিত থাকিয়া যায় নাই; কিন্তু তবুও আলিমদের নিকট তাহা খুবই বেশি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে নাই। ফিকাহ রচনাকারিগণ সেসব হাদীসের প্রতি খুব বেশী ভ্রূক্ষেপ করেন নাই। মুহাদ্দিসগণও উহার দোষ-ক্রটি সম্পর্কে আলোচনা করার বিশেষ কোন প্রয়োজন বোধ করেন নাই। এই পর্যায়ে এমন সব গ্রন্হ রহিয়াছে, যাহার দুর্বোধ্য ভাষা বা শব্দের দুর্বোধ্যতা বিদূরণের জন্য বিশেষ কোন কাজ করা হয় নাই। কোন ফিকাহবিদ উহাতে সংকলিত হাদীসসমূহকে পূর্ববর্তী ইমামদের মতামতের সহিত মিলাইয়া দেখিবারও প্রয়োজন মনে করেন নাই। কোন হাদীস বিজ্ঞানী উহার অসানঞ্জস্যতা বর্ণনা ও প্রকাশ করার চেষ্টা করেন নাই। কোন ঐতিহাসিক এই হাদীসসমূহের বর্ণনাকারীদের জীবন সম্পর্কে কোন আলোকপাতও করেন নাই। এখানে অবশ্য শেষ যুগের ঐতিহাসিকদের কথা বলা হইতেছে না, বলা হইতেছে প্রাথমিক যুগের ঐতিহাসিকদের কথা। ফলে এই ধরনের গ্রন্হাবলী অপ্রকাশিত ও জনগণে অগোচরীভূত হইয়াই রহিয়া গিয়াছে।
নিমোক্ত হাদীস গ্রন্হাবলী এই পর্যায়ে গণ্যঃ
১) মুসনাদে আবূ আলী
২) মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক
৩) মুসান্নাফ বকর ইবনে শাইবা
৪) মুসনাদ আবদ ইবনে হুমাইদ
৫) মুসনাদে তায়ালিসী
৬) ইমাম বায়হাকীল গ্রন্হাবলী
৭) ইমাম তাহাভীর গ্রন্হাবলী
৮) ইমাম তাবারানীর গ্রন্হাবলী।
এই গ্রন্হকারদের গ্রন্হ প্রণয়নের মূল একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল তাঁহাদের প্রাপ্ত হাদীসসমূহ শুধু সংগ্রহ করা। উহাকে সুসংবদ্ধ কিংবা সুষ্ঠুরূপে সজ্জিতকরণ অথবা ব্যবহারোপযোগী করিয়া তোলা তাঁহাদের লক্ষ্য ছিল না।
[********************]
এই গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হাদীসসমূহের এক-তৃতীয়াংশেরও অধিক বর্ণনাকারী হইতেছেন তৃতীয় পর্যায়ের এবং এক-তৃতীয়াংশ বর্ণনাকারী চতুর্থ পর্যায়ের। এই গ্রন্হাবলীর মধ্যে কোন কোন কিতাব অপরাপর কিতাব হইতে অপেক্ষাকৃত দুঢ়মূল ও মজবুত বলিয়া মুহাদ্দিসগণের নিকট স্বীকৃত।
এই পর্যায়ের সেই সব হাদীস গ্রন্হ গণ্য, যে সবের গ্রন্হকারগণ দীর্ঘকাল পর এমন হাদীস সংকলন করিয়াছেন, যাহা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়েল গ্রন্হাবলীতে সন্নিবেশিত হয় নাই। বরং তাহা অপ্রখ্যাত ও অজ্ঞাতনামা গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়া পড়িয়াছিল। উত্তরকালে এই পর্যায়েল গ্রন্হকারগণ এই হাদীসসমূহের মূল্য স্বীকার করিয়াছেন। ইহা এমন সব লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হইত, যাহাদের নিকট হইতে পূর্বকালের মুহাদ্দিস ও হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নকারিগণ তাহা গ্রহণ করিতে ও নিজেদের গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিতে প্রস্তুত হন নাই। কিংবা তাহা উচ্ছৃঙ্খল কি দুর্বল বর্ণনাকারীদের কর্তৃক বর্ণিত হইত, অথবা তাহা সাহাবী কিংবা তাবেয়ীদের উক্তি ছিল; কিংবা তাহা ছিল বনী-ইসরাঈলের কিসসা-কাহিনী, দার্শনিক কিংবা ওয়ায়েজদের কথা, যাহাকে পরবর্তীকালের বর্ণনাকারিগণ ভ্রান্তিবশত রাসূলের হাদীসের সহিত সংমিশ্রিত করিয়া ফেলিয়াছিলেন।
ইবনে হাব্বান ও কামেল ইবনে আদী প্রণীত ‘কিতাবুল যুয়াফা’ খতীব আবূ নয়ীম, ঞ্জইবনে আসাকির, ইবনে নাজ্জার ও দায়লামী রচিত গ্রন্হাবলী এই পর্যায়ে গণ্য। মুসনাদে খাওয়ারিজিমীও এই পর্যায়ের গ্রন্হ বলিয়া মনে হয়।
[********************]
এই গ্রন্হাবলীর একটি পঞ্চম পর্যায়ও রহিয়াছে। এই পর্যায়ে সেই সব হাদীস গণ্য যাহা ফিকাহবিদ সূফী ও ঐতিহাসিক প্রমুখদের মুখে মুখে প্রচারিত হইয়াছে। উপরোক্ত চার পর্যায়ের হাদীসের সহিত ইহার কোন সামঞ্জস্য নাই।
বে-দ্বীন, বাক-চতুর লোকদের মনগড়া হাদীসও এই পর্যায়ে গণ্য। ইহারা সেই সব হাদীসের সহিত এমন সনদ বা বর্ণনাসূত্র যোগ করিয়া দিয়াছে যাহাতে কোন প্রকার আপত্তি উত্থাপিত হইতে না পারে। আর এমন সুন্দরভাবে কথাগুলি সাজাইয়া পেশ করিয়াছে যে, রাসূলে করীম (ﷺ) এই কথা বলেন নাই তাহা বাহ্যত জোর করিয়া বলা শক্ত।
বস্তুত এই লোকেরাই ইসলামের এক কঠিন বিপদের সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই বিপদের ঘনঘটা ইসলামের সাংস্কৃতিক আকাশকে বেশী দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে পারে নাই। হাদীস বিজ্ঞানিগণ সমালোচনার কষ্টিপাথরে এই হাদীসসমূহের যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন, রাসূলের অনুরূপ ভাবধারার হাদীসসমূহের সহিত উহা মিলিয়া দেখিয়াছেন এবং উহার ‘মনগড়া’ হওয়া রহস্য অকাট্যভাবে উদঘাটন করিয়াছেন। ফলে কোন মনগড়া হাদীসই হাদীস পর্যায়ে গণ্য হইবার সুযোগ পাইতে সমর্থ হয় নাই।
[********************]
উপরোক্ত আলোচনায় দুইখানি প্রখ্যাত হাদীসগ্রন্হের জন্য কোন পর্যায় উল্লেখ বা নির্ধারণ করা হয় নাই। গ্রন্হদ্বয় হইলঃ (ক) ইবনে মাজাহ (খ) সুনানে দারেমী। এই গ্রন্হদ্বয় কোন পর্যায়ে গণ্য তাহা আলোচনা সাপেক্ষ।
মুহাদ্দিস আবূ হাসান সনদী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
মোটকথা ইবনে মাজাহ মর্যাদার দিক দিয়া প্রধান পাঁচখানি গ্রন্হের পরে ও নিম্নে অবস্থিত।
[********************]
আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইয়ামানী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
সুনানে ইবনে মাজাহ আবূ দাঊদ ও সুনানে নাসায়ীর পরবর্তী পর্যায়ের গ্রন্হ। উহার হাদীসসমূহ পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করা আবশ্যক। কেননা উহাতে ফযীলত সংক্রান্ত অধ্যায়ে একটি মওযু হাদীস রহিয়াছে।
[********************]
এই সব উদ্ধৃতি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইবনে মাজাহ তৃতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্হ।
সুনানে দারেমী সম্পর্কেও হাদীস বিজ্ঞানিগণ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবী (র উহাকে এই তৃতীয় পর্যায়েল গ্রন্হাবলীর মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। শাহ ওলীউল্লাহ দেহল্বী (র)-রও এই মত।
[********************]
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন