উপমহাদেশে ইলমে হাদীস

উপমহাদেশে ইলমে হাদীস

উপমহাদেশে সাহাবীদের আগমন

এই উপমহাদেশের সহিত আরব দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক অতিশয় প্রাচীন। কাজেই ষষ্ট ঈসায়ী শতকে আরব সাগরের পশ্চিম উপকূলে- আরব দেশে- যে বিপ্লব সাধিত হইয়াছিল, পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই উপমহাদেশে উহার প্রথম তরংগাভিঘাত আসিয়া পৌঁছা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। নির্ভরযোগ্য ইতিহাস হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী বিপ্লবের প্রথম কয়েক বৎসরে- নবূয়্যাত ও প্রথম খলীফার আমলে- না হইলেও দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক (রা)-এর খিলাফতকালে বিশ্ব নবীর সাহাবিগণের কেহ কেহ এই উপমহাদেশে আগমন করিয়াছেন। এই সময়ে যে কয়জন সাহাবীর ভারত আগমনের সন্ধান পাওয়া যায়, তারা হইতেছেন-

(১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবান,

(২) হযরত আসেম ইবনে আমর আততমীমী,

(৩) হযরত সুহার ইবনে আল-আবদী,

(৪) হযরত সুহাইব ইবনে আদী এবং

(৫) হযরত আল-হাকেম ইবনে আবিল আস আসসাকাফী (রা)।

[সিয়ারুস সাহাবা, ৬ষ্ঠ খণ্ড।]

অতঃপর হযরত উসমান, হযরত আলী ও আমীর মুয়াবিয়ার শাসনামলেও ভারতে সাহাবীদের আগমন অব্যাহত থাকে। কিন্তু এই যুগে ভারত আগমনকারী মাত্র তিনজন সাহাবীর সন্ধান পাওয়া যায়। হযরত উসমানের খিলাফতকালে যে দুইজন সাহাবী ভারতবর্ষে আগমন করেন, তারা হইতেছেন

(১) হযরত উবাইদুল্লাহ ইবনে মা’মর আততামীমী ও

(২) হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা ইবনে হাবীর ইবনে আবদে শামস। আর হযরত আমীর মুয়াবিয়ার যুগে আসেন হযরত সিনান ইবনে সালমাহ ইবনে আল মুহাব্বিক আল- হযালী। তদানীন্তন ইরাক শাসনকর্তা যিয়াদ তাঁকে ভারত সীমান্তের শাসনকর্তা নিযুক্ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন।

উপমহাদেশে তাবেয়ীদের আগমন

সাহাবাদের পর বহু সংখ্যক তাবেয়ী ভারতে আগমন করিয়াছেন, ইতিহাস হইতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমীর মুয়াবিয়ার যুগে সর্ব প্রথম যে তাবেয়ী ভারত আগমন করেন, তিনি হইতেছেন মূলহাব ইবনে আবূ সফরা। তিনি ৪৪ হিজরী সনে হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা সাহাবীল সঙ্গে একজন সেনাধ্যক্ষ হিসাবে এখানে পদার্পণ করেন। তিনি সিজিস্তান ও কাবুল সীমান্ত অতিক্রম করিয়া লাহোরে আসিয়া উপনীত হন।

উপমহাদেশে হাদীস প্রচার

সাহাবায়ে কিরামই ছিলেন ইলমে হাদীস প্রচারের সর্বপ্রথম বাহন। তারা ছিলেন দ্বীন-ইসলাম প্রচারের বাস্তব নমুনা ও অগ্রদূত। তারা যেখানেই গিয়াছেন, সেখানেই ইসলাম তখা কুরআন-হাদীস প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন। কাজেই এই দেশেও যে তারা কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসের প্রচারের কাজও করিয়াছেন তাহাতে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। এই কারণে এই কথা বিশ্বাস করা যাইতে পারে যে, প্রথম হিজরী শতকের প্রথমার্ধে এই এলাকায় ইলমে হাদীসের কিরণ বিচ্ছুরিত হইয়াছে, যদিও তাহার বিস্তারিত ইতিহাস জানিবার কোন উপায় নাই।

সিন্দুদেশে ইলমে হাদীস

এই উপমহাদেশের সীমান্ত এলাকায় ক্রমাগত কয়েক বৎসর পর্যন্ত মুসলিম অভিসান পরিচালিত হয়। সিনান ইবনে সালমাহ ‘কুসদার’ দখল করেন। অতঃপর হুরী ইবনে হুরী বাহেলী এক ব্যাপক অভিযানের সাহায্যে সিন্ধুর অধিকাংশ এলাকার উপর ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন।

[বালাযুরী, ৪৩৯ও ৪৪০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]

৯৩ হিজরী সনে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম সিন্ধু বিজয় সম্পূর্ণ করিয়া উহাকে ইসলামী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশে পরিণত করেন। মূলতান, মনসুরা, আলোর, দেবল, সিন্দান, কুসদার ও কান্দাবীল প্রভৃুতি স্থানে আরবারা উপনিবেশে স্থাপন করেন। মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের সঙ্গে ৫০ সহস্র অশ্বারোহী সৈনিক স্থায়ীভাবে বর্তমান। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্যে এই সময় এদেশের বহু সংখ্যক আরব আগমন করেন। ফলে উল্লিখিত সকল স্থানেই ইসলামী শিক্ষার- কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদানের- কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই আরবদের মধ্যে ব হু হাফেজে কুরআন ও হাদীসের হাফেজ লোকও বর্তমান ছিলেন। তাঁহাদের চেষ্টা যত্নে এই এলাকায় কুরআন-হাদীসের শিক্ষা ব্যাপক প্রচার লাভ করে। তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা বিশেষভাবে হাদীস প্রচারের কাজ করিয়াছেন তাঁহাদের কয়েকজনের নাম পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১. মূসা ইবনে ইয়াকুব আসসাকাফী। তিনি সিন্ধুদেশে বিচারপতি (কাযী) হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। ইলমে হাদীসে তাঁহার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল।

২. ইয়াযীদ ইবনে আবী কাবশী আদ-দেমাশকী (মৃঃ ৯৭ হিঃ)। তিনি ছিলেন তাবেয়ী, হযরত দারদা শারাহবীল ইবনে আওজ ও মারওয়ান ইবনে হাকাম প্রমুখ সাহাবীর নিকট হইতে তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবেও তিনি স্বীকৃত ছিলেন।

৩. মুফাযযল ইবনে মুহালাব ইবনে আবূ সাফরা (মৃঃ ১০২ হিঃ) তাবেয়ী। হাদীস বর্ণনায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অবলম্বন করেন। সাহাবী হযরত নুমান ইবনে বশীল হইতে তিনি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন এবং তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন (তাঁহার পুত্র) হাজিব, সা-বিতুল বানানী ও জরীর ইবনে হাযেম।

৪. আবূ মূসা ইসরাঈল ইবনে মূসা আল বসরী (মৃঃ ১৫৫ হিঃ) সিদ্ধী। তিনি বসরা হইতে ব্যবসার উপলক্ষে ভারতে আগমন করেন। তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত হাদীস বর্ণনাকারী। সুফিয়ান সওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ), সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) ও ইয়াহইয়া ইবনে সায়াদুল কাত্তান (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) প্রভৃতি প্রখ্যাত হাদীস পারদর্শিগণ তাঁহার ছাত্র। ইলমে হাদীসে আবূ মূসার মর্যাদা যে কত উচ্চ, তাহা এই বিবরণ হইতেই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। ইমাম বুখারী তাঁহার হাদীস গ্রন্হে আবূ মুসার সূত্রে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

৫. আমর ইবনে মুসলিম আল বাহেলী, তিনি খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের অধীনে প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসাবে সিন্ধু আগমন করেন। তিনি ইয়ালা ইবনে উবাইদ হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

৬. রবী ইবনে সবীহ আস-সায়দী আল-বসরী (মৃঃ ১৭০ হিঃ) তিনি বহু হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন; হাদীস গ্রন্হও তিনি সংকলন করিয়াছেন। ১৬০ হিজরীতে তিনি ভারত পদার্পণ করেন।

সকল অধ্যায়

১. হাদীসের সংজ্ঞা ও পরিচয়
২. হাদীস শব্দের অর্থ
৩. হাদীস ও সুন্নাত
৪. হাদীসের বিষয়বস্তু
৫. বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীসের প্রকারভেদ
৬. হাদীসে কুদসী
৭. সনদ ও মতন
৮. জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল সূত্র
৯. ওহী
১০. হাদীসের উৎস
১১. কুরআন ও হাদীসের পার্থক্য
১২. ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব
১৩. হাদীসের অপরিহার্যতা
১৪. হাদীস ও রাসূলের ইজতিহাদ
১৫. হাদীসের উৎপত্তি
১৬. হাদীস সংরক্ষণ
১৭. হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য রাসূলের নির্দেশ
১৮. পারস্পরিক হাদীস পর্যালোচনা ও শিক্ষাদান
১৯. হাদীসেন বাস্তব অনুসরণ
২০. ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন
২১. সাহাবীদের হাদীস প্রচার ও শিক্ষাদান
২২. হাদীস বর্ণনায় সতর্কতা
২৩. হাদীস লিখন
২৪. নবী (ﷺ) কর্তৃক লিখিত সম্পদ
২৫. সাহাবীদের লিখিত হাদীস সম্পদ
২৬. হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের শ্রেণীবিভাগ
২৭. হাদীস বর্ণনায় সংখ্যা পার্থক্যের কারণ
২৮. তাবেয়ীদের হাদীস সাধনা
২৯. কয়েকজন প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাদ্দিস
৩০. হাদীস লিখনে উৎসাহ দান
৩১. হাদীস সংগ্রহের অভিযান
৩২. হাদীস গ্রন্থ সংকলন
৩৩. খুলাফায়ে রাশেদুন ও হাদীস গ্রন্থ সংকলন
৩৪. হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন
৩৫. হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীস চর্চা
৩৬. তৃতীয় শতকের হাদীস সমৃদ্ধ শহর
৩৭. তৃতীয় হিজরী শতকের কয়েকজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস
৩৮. মুসনাদ প্রণয়ন
৩৯. হাদীস সংকলনের চূড়ান্ত পর্যায়
৪০. ইলমে হাদীসের ছয়জন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি
৪১. ছয়খানি বিশিষ্ট হাদীসগ্রন্হ
৪২. চতুর্থ শতকে ইলমে হাদীস
৪৩. চতুর্থ শতকের পরে হাদীস-গ্রন্থ প্রণয়ন
৪৪. সপ্তম ও অষ্টম শতকে হাদীস চর্চা
৪৫. বিভিন্ন দেশে হাদীস চর্চা
৪৬. হাদীস গ্রন্হসমূহের পর্যায় বিভাগ
৪৭. হাদীস বর্ণনায় রাসূল (ﷺ)-এর নৈকট্য
৪৮. হাদীস জালকরণ ও উহার কারণ
৪৯. হাদীস সমালোচনার পদ্ধতি
৫০. হাদীস বর্ণনাকারীদের শ্রেণী বিভাগ (গুণগত)
৫১. হাদীস সমালোচনার সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি
৫২. উপমহাদেশে ইলমে হাদীস
৫৩. আরব উপনিবেশসমূহে হাদীস প্রচার
৫৪. উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের রেনেসাঁ যুগ
৫৫. বঙ্গদেশে ইলমে হাদীস
৫৬. ইলমে হাদীস বনাম অমুসলিম মনীষীবৃন্দ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন